চিৎকার চেঁচামেচি করার মেয়ে ছিলাম না কখনও। কিছু পছন্দ না হলে আলগোছে নিজেকে সরিয়ে নিতাম। এখনও তাই করি। মা চাইতো আমি ধর্ম-কর্ম করি। করিনি কখনও। করিনি কারণ সৃষ্টিকর্তা আছে এই প্রমাণ পাইনি। জিন ভূতে বিশ্বাস করানোর অনেক চেষ্টা চলেছে, কিন্তু ওসবেও বিশ্বাস জন্মায়নি, কারণ ওদের অস্তিত্বেরও কোনও প্রমাণ পাইনি। কিশোরী-বয়সে স্মার্ট যুবকদের ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু লজ্জায় পারতাম না। ছোট বেলা থেকেই অনাত্মীয় পুরুষের সামনে না যাওয়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে। পত্র মিতালি বলে একটা ব্যাপার তখন সবে শুরু হয়েছে, বাড়ির বারণ সত্ত্বেও পত্র মিতালি করেছি। চিঠিতেই সম্ভব ছিল যুবকদের সঙ্গে কথা বলা। চিঠিতেই বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রেম চিঠিতেই করেছি। পত্র মিতালি করি বলে বাবার মার খেয়েছি। প্রেম করি বলেও মার খেয়েছি। কিন্তু মেরে আমাকে বাগে আনা যায়নি। প্রেমিককে বিয়ে করে সুখের সংসার করতে শুরু করলাম। ওই সংসারটি করতে গিয়েই গোল বাঁধলো। দেখলাম আমিই প্রেম দিচ্ছি, আমিই উজাড় করে দিচ্ছি, বিনিময়ে যা পাচ্ছি তা হলো, স্বার্থপরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা। আমি তখন আমার পূর্ব নারীদের মতোই কোনও এক নারী। নির্যাতিত। তবে আমার পূর্বনারীরা যা পারেনি, তা আমি পেরেছি, নিজের একনিষ্ঠতা, একগামিতা নিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। পূর্বনারীদের মতো পরনির্ভর ছিলাম না বলেই সম্ভব হয়েছে।
পিতার সঙ্গে নহে, ভ্রাতার সঙ্গে নহে, স্বামীর সঙ্গে নহে, একা মেয়ে একা থাকবো। কিন্তু ঊননব্বই/নব্বই সালে ঢাকা শহরে একটি মেয়েকে, সে মেয়ে ডাক্তার হলেও, কোনো বাড়িওয়ালাই একা থাকতে দিতে রাজি ছিলেন না। শেষ অবধি পেরেছি একা থাকতে। সেই থেকে একা থাকছি। পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে, কিন্তু একা থাকার সঙ্গে আপস করিনি। একা থাকা মানে সঙ্গীহীন হয়ে থাকা নয়, একা থাকা মানে স্বনির্ভর হয়ে থাকা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া, নিজের আনন্দ নিজে খুঁজে নেওয়া। কোনও পুরুষের অভিভাবকত্ব না মানা। পুরুষকে সহযাত্রী ভাবা, বন্ধু ভাবা, অভিভাবক না ভাবা, প্রভু না ভাবা। এগুলো বলা সহজ হলেও একটা কট্টর পুরুষতান্ত্রিক আর ধর্মান্ধ সমাজে করা সোজা নয়। করে দেখিয়েছিলাম। একা থেকে। একা কথা বলে। একা যুদ্ধ করে। চিরকালই আমার অস্ত্র কলম আর কীবোর্ড। ওদের মতো ছুরি তলোয়ারে আমার বিশ্বাস নেই, গুলি বোমাতেও বিশ্বাস নেই। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে মানুষের ন্যূনতম অধিকারটুকু নিয়ে বাঁচার জন্য। নিশ্চিন্তে হাটে মাঠে ঘাটে হাঁটাচলা করার, যানবাহনে চড়ার, ইস্কুল কলেজে পড়ার, চাকরি বাকরি করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার, ভাবার এবং মতপ্রকাশ করার ন্যূনতম অধিকার। যৌন-সামগ্রী বা যৌন-দাসী না হওয়ার, ধর্মের-সমাজের-আইনের বৈষম্যের শিকার না হওয়ার, নারী বলে নির্যাতিত না হওয়ার ন্যূনতম অধিকার। শুধু আমার জন্য নয়, সব মেয়ের জন্য।
ডাক্তার হয়েছি। পুরুষের পাশাপাশি বসে রোগীর চিকিৎসা করেছি। তারপরও যতটুকু সম্মান পাওয়া উচিত, ততটুকু পাইনি, মেয়ে বলেই পাইনি। কবিতা লিখি অল্প বয়স থেকেই। যতক্ষণ শুধু প্রেমের পদ্যে ছিলাম, ততক্ষণ আমি ভালো। আমার প্রতিবাদের গদ্য যত প্রখর হয়েছে, তত শুনেছি আমি মন্দ। শুনেছি কুৎসা, নিন্দে, চরিত্র হনন। যে মেয়েকে বন্দি করা যায় না, যে মেয়ের নিজস্ব স্বর আছে, নিজস্ব ভাবনা আছে, তার বিরুদ্ধে এসব ভালো জমে। এ নতুন কিছু নয়।
নারীবাদ নিয়ে প্রচুর লোকের জ্বলুনি দেখেছি দেশে বিদেশে সর্বত্র। তারা বলতে চায়, তুমি মানবতন্ত্রে বিশ্বাস করো ওটাই তো ভালো, নারীবাদী হওয়ার তো দরকার নেই। আমি বলি, যতদিন নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততদিন নারীবাদকে টিকে থাকতে হবে। নারীবাদী আন্দোলন না থাকলে নারী আজ ভোট দিতে পারতো না, ভোটে দাঁড়ানোর কথা না হয় বাদই দিলাম। নারীবাদী আন্দোলন ছাড়া নারীর শিক্ষাও হতো না, স্বনির্ভরতাও হতো না, সমানাধিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। নারী এ পর্যন্ত যা কিছুই পেয়েছে, শ্রদ্ধা, সম্মান, স্বাধীনতা সব কিছুই কিন্তু নারীবাদী আন্দোলনের ফলে। সে আন্দোলন নারী করুক, বা পুরুষ করুক, বা উভয়ে মিলে করুক।
আমার পথ কখনও মসৃণ ছিল না। কাঁটার ওপর দিয়েই হাঁটতে হয়েছে আমাকে। এখনও হচ্ছে। নারীর সমানাধিকারের কথা বলতে গিয়ে ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করেছি বলে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে ডাক্তারি চাকরি ছাড়তে, এক দেশ থেকে এবং এক রাজ্য থেকে আক্ষরিক অর্থে বের করে দেওয়া হয়েছে আমাকে, বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বইয়ের প্রকাশক, ছবির পরিচালক আর পত্রিকার সম্পাদকদের আমার চৌহদ্দি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে একা করে দেওয়া হয়েছে। শারীরিক আক্রমণ চলেছে আমার ওপর, আমি মানুষটাকে নিষিদ্ধ করেছে বইমেলা, সাহিত্য উৎসব। ভেঙে ফেলা হয়েছে আমাকে, টুকরো টুকরো করা হয়েছে আমার জগেক। তারপরও উঠে দাঁড়িয়েছি। না, কেউ আমাকে সাহায্য করেনি কোনও গন্তব্যে যেতে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ আমার গন্তব্য। একটি ভায়োলেন্সহীন পৃথিবী আমার গন্তব্য। বলি স্বর্গে পৌঁছানো সহজ, এমন ইউটোপিক গন্তব্যে নয়।
ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছি ভারতে। ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েদের তো বেশি জানি আমি, তারা তো আমারই মতো মেয়ে। আমারই মতো দেখতে, আমার ভাষার মতো ভাষা তাদের, আমার পূর্বনারীদের মতো তাদেরও পূর্বনারী, আমার ইতিহাসের মতো তাদেরও ইতিহাস, আমার মতো তারাও শিকার পুরুষতন্ত্রের, ঘৃণার, হিংসের, বিদ্বেষের এই অঞ্চলের নির্যাতিত মেয়েদের যদি স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী হতে এবং পাশাপাশি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার উৎসাহ দিতে পারি। তাহলেই আমার এই দীর্ঘ কণ্টকময় পথের যাত্রা সার্থক হবে।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ মার্চ, ২০১৭