নায়েবে নবী
ওয়াযের মজলিস্।
গ্রামের মাতব্বরের বহির্বাটীর প্রাঙ্গণে শামিয়ানা টাঙাইয়া বসিবার জায়গা করা হইয়াছে।
বহু যোগাড়যন্ত্র করিয়া এই মহফেলটি ডাকা হইয়াছে। সাতদিন পূর্ব হইতে ঘোষণা এবং তিনদিন আগে হইতে তাগিদ করিবার পরও যাহারা স্বেচ্ছায় মহফেলে যোগদান করে নাই এবং স্বয়ং ওয়ায়েয সাহেবের পুনঃ অনুরোধে মাতব্বর সাহেব একাধিকবার লোক পাঠাইয়া যাহাদিগকে একমাত্র মাঠ হইতে ধরিয়া আনিয়াছেন, হাযেরানে মজলিসের অধিকাংশই সেই শ্রেণীর লোক।
ওয়ায়েয মৌলবী সুধারামী সাহেব।
তিনিই গ্রামের সরদার বা শরিয়তী শাসক।
কয়েক গ্রামের পরবর্তী এক গ্রামে তিনি বাস করেন। তিনি সেখানকার পুরাতন বাসেন্দা নহেন। তাঁহার জন্মস্থান সুধারাম। তারও আগে তাঁহার পূর্বপুরুষরা পশ্চিম হইতে তথায় তশরিফ আনেন।
দীনি-এলেম হাসেল করিলে তার যাকাৎ দিতে হয় শরা জারি করিয়া। এই সুধারামী সাহেব শরা জারির উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এক শুভ মুহূর্তে পদার্পণ করেন।
কোথাও দীর্ঘদিন থাকিতে গেলে তথায় বিবাহ করা সুন্নত। তা না হইলে শহওয়াৎ গালেব হয় এবং নফসে-আম্মারা দেহের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ঢালিয়া দেয়।
তাই সুধারামী সাহেব কেবল সুন্নতের ইযযত রক্ষা ও শয়তানের বদৃমায়েসির রাস্তা বন্ধ করিবার জন্য ঐ গ্রামের পুত্রহীন এক গৃহস্থের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
তথাপি দেশের দুই বিবির প্রতি তিনি কদাচ অবহেলা করেন না। শরিয়তের ঠিক ঠিক ব্যবস্থা মতো যথারীতি তাঁহাদের খোরপোষ যোগাইয়া থাকেন এবং সময় পাইলে বৎসরে এক-আধবার দেশেও গিয়া থাকেন।
হাদিস-কোরআনে লার্নি কাবেলিয়ৎ থাকার দরুন তিনি অল্পকাল মধ্যেই পার্শ্ববর্তী তিন-চারিখানা গ্রামের সরদারি দখল করিয়াছেন।
প্রথম-প্রথম কয়েকখানা গ্রাম বাহাস করিয়াই জিতিয়াছিলেন বটে, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবী (সুধারামী সাহেবের মতে মুনশী) গরিবুল্লাহর গোয়ার্তুমিতে শেষ কয়েকটি গ্রাম দখল করিতে হাদিস কোরআন রাখিয়া লাঠি-সোটার ও আদালতের সাহায্য লইতে হইয়াছিল।
সে-সব নিতান্ত পুরান কথা।
ইহার পরে গরীবুল্লাহ সাহেব ও সুধারামী সাহেবের মধ্যে একটা রফা হইয়া গিয়াছে। এই রফার ফলেই সুধারামী সাহেব এই সমস্ত গ্রামের সরদারি ভোগ করিতেছেন।
তবে গরীবুল্লাহ লোক মোতেবর নহেন বলিয়া তিনি ভিতরে ভিতরে এই সমস্ত গ্রামের লোককে গোমরাহ্ করিয়া ফেলিতে যাতে না পারেন, সুধারামী সাহেবের সেদিকে নজর আছে।
গ্রামের সকলে বিশেষ করিয়া অবস্থাশালী সকলে, উপস্থিত আছে কি না, তা নিজে জনে-জনে নাম ডাকিয়া পরীক্ষা করিয়া মৌলবী সাহেব ওয়াজ শুরু করিলেন। মোরেজ ও তালাফফুযের ইযৎ রক্ষা করিয়া, আইন-গাইন কাফের কারী উচ্চারণ করিয়া এবং হায় হুত্তির উচ্চারণ ঠিক হম হইতে বাহির করিয়া তিনি মিস্ত্রী এলহানে যথাক্রমে আউযু, বিসমিল্লাহ ও সূরা ফাতেহা পড়িলেন।
হাযেরানে-মজলিসের কাহারও পক্ষে তাঁহার কথা না শুনিবার কোনও সুবিধা থাকিল; কারণ হাযেরানে-মজলিসের সুবিধার জন্যই হউক, কিম্বা অন্দরে যে, মুরগী পাক হইতেছিল তার খুশবু নাকে প্রবেশ করাতে উৎসাহিত হইয়াই হউক, তিনি কালামে-পাক এত বুলন্দ আওয়াজে পড়িলেন যে, উহা শুনিবার জন্য গ্রামের অনেকেরই পক্ষে কষ্ট করিয়া বাড়ি ছাড়িয়া আসার কোন প্রয়োজন ছিল না।
তিনি আউযু ও বিসমিল্লাহ শরিফের টিকাটিপ্পনি ও সূরা ফাতেহার তফসির বয়ান করিবার পর আরেকবার গলা সাফ করিয়া “ওই কোরিয়াল কুরআনু ফাসতামেউ” আখেরতক পাঠ করিলেন এবং উহার শানে-নযুলও খোলাসা বয়ান করিলেন। এই উপলক্ষে তিনি আল্লাহপাকের বহুৎ বহুৎ তারিফ, কোরআন-মজিদ ও ফোরকানে-হামিদের বরহকত্ব, উহা শ্রবণ করিবার সোওয়াবের বেশুমারত্ব, সোওয়াবের বদলা যে বেহেশত পাওয়া যাইবে তার হুর ও গেলমানদের সুরত ও চান্দের সুরতের পার্থক্য, বেহেশতের শারাবন-তহুরার মিষ্টতা ও মধুর মিষ্টতার আনুপাতিক হিসাব ওগায়রা বয়ান করিলেন এবং তাঁহার ওয়াজ চুপ করিয়া শুনিলেই যে সমস্ত পাওয়া যাইবে, সে সম্বন্ধে হাযেরানে মজলিসকে পুনঃপুনঃ গ্যারান্টি দান করিলেন।
কারণ তিনি তাহার ওয়াজে হাদিস-কোরআনের বাহিরের এক আলফাযও এস্তেমাল করিতেন না।
এই উপলক্ষে তিনি মনগড়া হাদিস ব্যাখ্যাকারী আলেম নামধারী জাহেলদের ফেরেব হইতে পরহে থাকিবার জন্য হাযেরানে-মজলিসকে বিশেষ সাবধান করিয়া দিলেন এবং মুন্সী গরীবুল্লাহও যে এই শ্রেণীর লোক; নিতান্ত প্রসঙ্গক্রমে তিনি তারও দু’একটা চাক্ষুষ প্রমাণ উপস্থিত করিয়া রসিকতা করিলেন। সকলেই হাসিয়া সে-রসিকতার মর্যাদা রক্ষা করিল।
ভূমিকাতে ঘণ্টা দেড়েক কাবার হইল।
বাড়িওয়ালা পিছন হইতে বলিয়া গেলেন : খানা তৈয়ার।
সুতরাং মৌলবী সাহেব ভূমিকা হইতে সটান উপসংহারে চলিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন যে, সময় কম বলিয়া আজ কেবল মুখৃতসর-মুখতসর বয়ান করিলেন। আল্লাহর কালাম খোলাসা বয়ান করিতে অনেক সময়ের দরকার। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার খেয়ালে এতই মশগুল হইয়া গিয়াছে যে দীনের কথা শোনার কাজে তাহারা মোটেই সময় ব্যয়। করতে চায় না।
যাহারা মৌলবী সাহেবের সারবান্ ওয়াযের গুরুপাকত্ব হজম করিতে না পারিয়া ইতিমধ্যে উঠিবার জন্য উসপিস করিতেছিল, লজ্জা পাইয়া তাহারাও আবার ভাল হইয়া বসিল।
মৌলবী সাহেব বলিয়া যাইতে লাগিলেন ও হাদিস-কোরআনে কেয়ামতের যে সমস্ত আলামৎ বয়ান করা হইয়াছে, আজকালকার জমানার হালচাল তার সঙ্গে ঠিক ঠিক মিলিয়া যাইতেছে। আজকার মুসলমানরা আখেরাত ছাড়িয়া দুনিয়ার আয়েশ-আরামের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। দুনিয়ার সুখ মুসলমানের জন্য হারাম একথা তাহারা ভূলিয়া গিয়াছে। হযরত পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পেটে পাথর বাঁধিয়া দিন কাটাইয়াছেন, আজ তাহার উম্মত আমরা কিনা দুনিয়ার ফেকেরে মসরুফ আছি।
এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব কাঁদিবার মতো মুখ ভঙ্গি করিয়া কোর্তার খুঁটে চোখ মুছিয়া লইলেন।
হাযেরানে-মজলিসেরও অনেকের চক্ষু ছলছল হইয়া আসিল। মৌলবী সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন : আমরা ধন-দৌলৎ পাইয়া শয়তানের ওসওয়াসায় খোদাকে ভুলিয়া গিয়াছি। বড়ই আফসোসের কথা, ধন-দৌলতের মায়া আমরা কাটাইতে পারি না। নেহায়েত শরমের কথা, আমরা আজ যাকাত-খয়রাত দেই না। আলেমের হক আদায়। করি না। নায়েবে-নবী, হাদিয়ে উম্মত চেরাগে দিন আলেম ফাযেলের খেদমত করি না। দিনের চেরাগ আলেম ফাযেলেরা দুনিয়ার চিন্তা হইতে ফারেগ হইতে না পারিলে তাহারা এস্লামের রওনক বৃদ্ধি করিবেন কেমন করিয়া? মুসলমানদের যে আজ তদস্তি হইতেছে, তার কারণ ইহারা আলেম-সমাজের হক আদায় করিতেছে না। আলেম সমাজকে যদি পেটের চিন্তা করিতে হয়, তবে আর এসলামের চেরাগ জ্বালাইয়া রাখিবে কাহারা? এইজন্য হাদিস শরীফে আসিয়াছে : নায়েবে-রসুলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব সমাজের।
এখানে মৌলবী সাহেব নিজের আর্থিক দুরবস্থার কথা তুলিলেন।
কিভাবে এক দুষ্টের পাল্লায় পড়িয়া নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাটের কারবার করিতে গিয়া তিনি দেনাগ্রস্ত হইয়া পরিয়াছেন। কিভাবে বেদিন কাফের মহাজন মাসে মাসে সুদের টাকা আদায় করিয়া নিতেছে, কিভাবে তিনি ছেলেমেয়েদের লইয়া মহাবিপদে পড়িয়াছেন, কিভাবে তিনি দেশের বিবি ও ছেলেমেয়েদের জন্য দেড় বৎসর যাবৎ একটা পয়সাও পাঠাইতে পারিতেছেন না; সমস্ত বিষয় ছল ছল চোখে বয়ান করিলেন।
এবার সত্য সত্যই তাঁহার চোখে পানি দেখা দিল। তিনি বাম হাতের পিঠ দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিলেন। আলেম ফাযেলকে খোদা বিপদে ফেলেন মুসলমানদের ঈমান পরীক্ষার জন্য। মৌলবী সাহেবকে অর্থ সাহায্য করিয়া এই পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য তিনি সকলকে অনুরোধ করিলেন।
এতক্ষণ শ্রোতৃমণ্ডলী কোনরূপে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।
এইবার কেহ কাহারও মুখের দিকে না চাহিয়া সকলেই উঠিয়া পড়িল। কেহ-কেহ অতিসন্তর্পণে রওয়ানার উদ্যোগ করিল।
মৌলবী সাহেব পাশে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালা মাতব্বর সাহেবের দিকে ছল-ছলে নেত্রে চাহিলেন।
মাতব্বর সাহেব উচ্চস্বরে বলিলেন : মৌলবী সাহেবের এখনও খাওয়া হয় নাই। আপনারা কে কি দিবেন, একটু শীগগির শীগগির দিয়া যাবেন।
কথা শেষ করিয়া মাতব্বর সাহেব দেখিলেন : বাড়ি যাওয়ার আয়োজনে সবাই এত ব্যস্ত যে, কেহ তাহার কথা শুনিয়াছে বলিয়া বোধ হইল না।
তখন তিনি অপেক্ষাকৃত উঁচু গলায় হুকুমের সুরে বলিলেন : যাবেন না মিয়ারা। মৌলবী সাহেবের একটা ব্যবস্থা না করে কেউ যাবেন না।
প্রধান প্রধান অনেকেই ফিরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হইল। কিন্তু টাকা-পয়সা দানের একটা ফ্যাসাদে পড়িয়া অনেকেরই মুখ একটু ভার বোধ হইতে লাগিল।
অবশেষে এক এক করিয়া প্রায় সকলেই বলিল যে, তার টাকার আজকাল বড় টানাটানি। মাতব্বর সাহেবই তার চাঁদাটা চালাইয়া দিন।
দানের টাকা চালাইয়া দিলে যে তা আর ফিরিয়া পাওয়া যায় না, মাতব্বর সাহেবের সে অভিজ্ঞতা ছিল।
তিনি বলিলেন : নূতন করে চাঁদা আদায় করায় হাঙ্গামা অনেক। লোকের সত্যই আজকাল বড়ড় টানাটানি। আমি বলি কি, কোরবানির চামড়ার যে-টাকা আমার নিকট আমানত আছে, সেই টাকাটাই মৌলবী সাবকে দিয়ে দেওয়া যাক।
ত্রিপলি-যুদ্ধরত তুরস্ককে সাহায্য করিবার জন্য মাত্র তিন চার দিন পূর্বে যে ঐ টাকা দান করিবার ওয়াদা করা হইয়াছে, এবং সে টাকা আদায় করিবার জন্য যে আজকালই লোক আসিতে পারে, মৌলবী সাহেব হইতে আরম্ভ করিয়া মাতব্বর সাহেব পর্যন্ত উপস্থিত সকলেরই সে কথা মনে পড়িয়া গেল।
কিন্তু ঐ প্রতিশ্রুতি উপস্থিত সকলেরই স্বার্থের প্রতিকূল বলিয়া কেহ সে কথার উল্লেখ করিলেন না।
ঐ টাকা মৌলবী সাহেবকে দেওয়াই সাব্যস্ত হইল।
মৌলবী সাহেবের মুখের গাম্ভীর্য বাড়িয়া গেল।
তিনি এতক্ষণে জোর গলায় বলিলেন : মোনাজাত না করিয়া মজলিস ভাঙ্গিতে নাই, কারণ ওয়াযের মজলিসে ফেরেশতা আসে।
এই বলিয়া তিনি উচ্চস্বরে উর্দুতে উপস্থিত সকলের, তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের, তামাম জাহানের মুসলমান যিন্দা ও মুর্দা মরদ ও আওরতের, বিশেষ করিয়া হযরত ইব্রাহিম মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হেওসাল্লামের আল-আওলাদের উপর আহসানি পৌঁছাইবার জন্য ও তাঁহাদের প্রত্যেকের কবর মগরেব হইতে মশরেক পর্যন্ত কুশাদা রওশন করিবার জন্য আল্লাহ পাকের নিকট বহুৎ বহুৎ সুপারিশ করিয়া এবং সমস্ত মোমেন মুসলমানকে দুনিয়াবী ধন-দৌলতের ফেরেব হইতে হামেশা দূরে রাখিবার জন্য খোদাকে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করিয়া মোনাজাতের উপসংহার করিলেন। উপস্থিত সকলে পিছন হইতে “আমিন। ইয়া রাব্বেল আলামিন!” বলিয়া তাহার সুপারিশের গোড়া শক্ত করিয়া দিল।
খানা আসিল।
মৌলবী সাহেব খাইতে বসিলেন।
চাঁদা সম্বন্ধে উপরোক্ত মীমাংসা হইবার পূর্বে কামকাজের তাড়নায় যাহাদের এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিবার জো ছিল না, তাহারা এখন নিরুদ্বেগে গল্পগোযারি ও মাতব্বর সাহেবের তামাক ধ্বংস করিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেবের খাওয়া আধা-আধি হইয়াছিল। হঠাৎ অদূরে বহু কণ্ঠের মিলিত ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শোনা গেল। মৌলবী সাহেব ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিলেন।
উপস্থিত সকলে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেব কথার জবাব দিবার ফুরসৎ হইল না। প্রায় জন কুড়ি পঁচিশেক ছেলেপিলে এক যুবকের নেতৃত্বে আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। সকলের হাতে চাঁদ তারা মার্কা নিশান, গলায়-কোমরে প্যাঁচ দেওয়া সবুজ রঙের ব্যাজ!
ইহারা ভলান্টিয়ার। পাশের গ্রামের মাইনর স্কুলের ছাত্র। যুদ্ধরত তুরস্কের জন্য চাঁদা আদায় করা এবং তুর্কীটুপি পোড়ানো ইহাদের কাজ।
স্কুলের জনৈক যুবক শিক্ষক ইহাদের নেতা।
ঘরে প্রবেশ করিয়াই ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলিয়া নেতা মাস্টার সাহেব একটি টুলে বসিয়া পড়িলেন।
ছেলেরা সব জটলা করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল কেহ-কেহ ছেলেদেরও বসিতে বলিল। কিন্তু বসিবার কোন স্থান না থাকায় ছেলেরা দাঁড়াইয়া থাকিল।
মাস্টার সাহেব চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন : থাক, থাক, ওদের আর বসতে হবে না। কতক্ষণেরই বা কাজ!
ছেলেরা বসিতে না পারিয়া স্বভাবতই কোন কাজ খুঁজিতে লাগিল।
মৌলবী সাহেবের পাশে পার্টির উপর তাঁহার পাগড়ি পড়িয়াছিল। সেই পাগড়ির ভিতর হইতে একটি টুপির অর্ধেক বাহির হইয়াছিল।
টুপিটি এককালে লাল রঙেরই ছিল; কিন্তু আজকাল তার যে রঙ হইয়াছে, তাকে কোন মতেই লাল বলা চলে না।
তথাপি উহা যে তুর্কীটুপি–অন্ততঃ এককালে তাই ছিল, তাহা বুঝতে দুষ্ট ছেলেদের আর বাকি রহিল না। দুই-তিনজন এক সঙ্গে লম্ফ প্রদান পূর্বক সেই টুপির উপর পড়িল এবং কাড়াকাড়ি করিতে-করিতে তারা আগুন খুঁজিতে লাগিল।
তামাক খাইবার জন্য বিচালির বেণীতে আগুন রাখা হইয়াছিল। মুহূর্তে টুপিটি তারা সেই বেণীতে গুঁজিয়া ধরিল।
মৌলবী সাহেব ‘হেই, কি কর’ বলিয়া এঁটো হাতেই এক লাফে ছেলেদের উপর পতিত হইলেন এবং তাহাদিগকে সজোরে ধাক্কা মারিয়া সরাইয়া দিয়া টুপি উদ্ধার করিলেন।
বহুদিন ধরিয়া মৌলবী সাহেবের বাবরী চুল হইতে পরের বাড়িতে দেওয়া খাঁটি সরিষার তেল চুষিয়া-চুষিয়া টুপিটি এমন সরস হইয়াছিল যে নিংড়াইলে বেশ দুই-চার ফোঁটা তেল বাহির হইত। কাজেই উহাতে বেণীর আগুন অত তাড়াতাড়ি ধরিতে পারে নাই। মৌলবী সাহেব মুখে ছেলেদের বেআদব, বেতমি, রযিল, আতরাফ, বলিয়া গাল দিতে দিতে ঝুটা হাতে টুপি সাফ করিতে গিয়া উহাকে কাল ও হলুদ রঙে রঞ্জিত করিয়া ফেলিলেন।
উপস্থিত সকলে ব্যাপারটা আকস্মিকতায় হতভম্ভ হইয়া গেলেও ছেলেদের উদ্দেশ্য সকলেই বুঝিতে পারিল। তাই মাস্টার সাহেব ছেলেদের তম্বি করিতে গেলে দুই একজন আস্তে-আস্তে বলিল : ছেলেদের আর দোষ কি?
মাস্টার সাহেব ছেলেদের পক্ষ হইতে মৌলবী সাহেবের নিকট মাফ চাহিয়া বলিলেন : ছেলেরা তাদের নেতৃস্থানীয় লোকের আদেশেই তুর্কি টুপি পোড়াচ্ছে। কেউ তাতে রাগ করে না। আপনি আলেম, আপনিও রাগ করবেন না, এই ভরসাতেই তারা আপনার টুপিতে হাত দিয়েছিল।
মৌলবী সাহেব তখনও রাগে ফেঁপাইতেছিলেন। তিনি মুখ ভ্যাঙচাইয়া বলিলেন :, রাগ করব না! ছোকরারা বে-আদবি করবে আমি রাগ করব না। আপনিই বা কেমন ধারা মাস্টার? আপনার ছাত্ররা একজন আলেমের সঙ্গে বে-আদবি করল, আর আপনি তাদেরই তরফে ওকালতি করছেন।
মাস্টার সাহেব বলিলেন : কাজটা যেভাবে করেছে; সেটা সত্যি দোষের, কিন্তু যে কাজটা করতে ওরা যাচ্ছিল, তার আমরা সমর্থন করি।
মৌলবী সাহেব গর্জন করিয়া উঠিলেন : টুপি পোড়ান আপনি সমর্থন করেন?
মাস্টার সাহেব শুদ্ধ করিয়া দিলেন : তুর্কী টুপি পোড়ান।
তুর্কী-ফুকী আমি বুঝি না। টুপি তো? যে টুপি মাথায় দেওয়া হযরতের সুন্নত, যে টুপি মাথায় না দিলে নামাজ হয় না, সেই টুপি আপনারা পুড়িয়ে ফেলেছেন? এসলামের এ বে ইজ্জতি আপনারা মুসলমান হয়ে করেছেন? ইংরাজি পড়লেই এমন হবে, তা আলেমরা আগেই জানত।
মাস্টার হাসিয়া বলিলেন : আমরা এসলামের ইজ্জত রক্ষার জন্যই তুর্কী টুপি পোড়াচ্ছি। অন্য টুপি আমরা পোড়াতে যাব কেন?
–তুর্কী টুপি কি অপরাধ করেছে? এ টুপি ত রোমের বাদশার হুকুমে তৈরি হচ্ছে।
মাস্টার সাহেব হাসিয়া বলিলেন : এটা আপনাদের ভুল ধারণা। তুর্কী টুপি নামেই তুর্কী। আসলে এ তৈয়ার হয় খ্রিস্টানদের দেশে। সেই দেশের নাম ইটালি। এই ইটালি দেশ আজকাল রোমের সুলতান আমাদের খলিফার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেইজন্য সে দেশের তৈরি টুপি আমরা বয়কট করেছি।
কথোপকথনে মৌলবী সাহেবের খাওয়া শেষ হইয়াছিল, সুতরাং রাগও কমিয়া আসিয়াছিল। তিনি এইবার খেয়াল করিতে-করিতে অবিশ্বাসের উচ্চ হাসি হাসিয়া বলিলেন : রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইটওয়ালি না কে, এই কেস্সায় আপনারা এতবার করছেন? কে বলেছে এই কথাকে এনেছে এই খবর? কে গিয়েছিল রোমে?
–বলিয়া বিজয়গর্বদীপ্ত মুখে তিনি উপস্থিত প্রত্যেকের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং হাসিতে-হাসিতে সম্মুখস্থ পানদান হইতে একটা পান গালে পুড়িয়া আঙ্গুলের ডগায় চুন লইয়া নিপুণতার সহিত শাদাপাতা ছিড়িতে লাগিলেন।
মাস্টার যুবক মানুষ। মৌলবী সাহেবের এই অমার্জনীয় অজ্ঞতায় তাঁহার রাগ হইল। তিনি কিঞ্চিৎ রাগতস্বরে বলিলেন : আপনি তা হলে লড়াইর কথাটাই অবিশ্বাস করেন?
মৌলবী সাহেব ফিক্ করিয়া ঘরের বেড়ায় একগাল পিক ফেলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত জয়ের গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন : অবিশ্বাস করব না? রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে যে ইটওয়ালি না কে লড়াই করছে, আপনি বলতে পারেন, তার সোলতানৎ কত বড়? তার কয় লাখ সিপাই আছে?
মাস্টার বলিলেন তা, তার রাজ্য খুব বড় নয় বটে, কিন্তু ইংরাজ তাকে সাহায্য করছে।
মৌলবী সাহেব মাস্টারের অজ্ঞতায় এবার রাগিয়া গেলেন। বলিলেন : ইংরাজ রোমের সুলতানের দুশমনকে সাহায্য করছে, এও আপনার বিশ্বাস করেছেন? ইংরাজি পড়ে আপনাদের ঈমান-আমান সব গেছে, যাক, আক্কেলের মাথাও কি আপনারা খেয়েছেন? প্রজা হয়ে মনিবের বিরুদ্ধে লড়াই করবে ইংরাজ?
মাস্টার অবাক হইয়া বলিলেন : কে কার প্রজা? কে কার মনিব?
মৌলবী সাহেব বলিলেন : বাহ্। কেন, ইংরাজ রোমের সুলতানের প্রজা নয়? এটাও জানেন না? কি লেখাপড়া শিখেছেন তবে?
মাস্টার এবারে হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন : ইংরাজ রোমের সুলতানের প্রজা নয়, সুলতানের চেয়ে ঢের বড় বাদশাহ।
মৌলবী সাহেব কানে আঙ্গুল দিয়া “আসতা ফেরুল্লাহ পড়িতে লাগিলেন। অবশেষে বলিলেন : আপনি হাদিস-কোরআনের খেলাফ কথা বলতে শুরু করেছেন। আপনার সঙ্গে বাহাস করে আমি গোনাহগার হতে চাই না।
বলিয়া তিনি সমবেত লোকজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : হাদিস শরীফে এসেছে : তামাম জাহানের মধ্যে রোমের সোলতানৎ সকলের চেয়ে বড় মুকুল। কোরআন-পাকেও খোদাতালা রোমের সুলতানের বয়ান করেছেন। আর আজ কিনা ইংরাজি-পড়া লোকের কাছে শুনতে পাই ইংরাজদের বাদশাহি রোমের বাদশাহির চেয়েও বড়। হাদিস শরীফে রোমের সুলতানকে শারেজাহানের বাদশাহ বলা হয়েছে। ইংরাজরা কি জাহানের বাইরে বাস করে? কোরআনের কথা কি ঝুট হয়ে গেল? নাউযুবিল্লাহে-মিন যালেক।
মাস্টার দেখিলেন : ইহার সঙ্গে তর্ক করিয়া জিতিবার কোন সম্ভাবনা নাই। তাই তিনি আর কোন কথা না বলিয়া বাড়িওয়ালা মাতব্বর সাহেবের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : এ গ্রাম থেকে যে চাদার ওয়াদা করেছিলেন, তা আদায় করতেই আমরা এসেছি।
মাতব্বর সাহেব কোন কথা বলিবার আগেই মৌলবী সাহেব যেন কিছুই জানেন না এইভাবে জিজ্ঞেস করিলেন : কিসের চাঁদা?
মাস্টার কোন জবাব দিলেন না। মাতব্বর বলিলেন : সেই যে রোমের সুলতানের যুদ্ধের সাহায্য।
মৌলবী সাহেব আবার চিৎকার করিলেন? কোথায় যুদ্ধ যে তার সাহায্য? কার ঘাড়ে দশটা মাথা যে রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করবে? আর লড়াই বাধলেই যে সুলতান হিন্দুস্থানের সাহায্য চাইবেন, একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে রোমের সুলতানের মাল-মাত্তার কথা কোরআন-হাদীসে বয়ান করা হয়েছে, হিরা, ইয়াকুৎ, লাল, জওয়াহের যার খাযাঞ্চিখানা বোঝাই, তিনি কিনা যুদ্ধের জন্য ভিক্ষা চাইতে এসেছেন এই হিন্দুস্থানে–এই দারুল হরবে! যত সব মতলববাজ লোক টাকা রোজগারের এ-একটা ফন্দি বের করেছে। নইলে রোমের বাদশাহ-সাত মুলুকের যিনি বাদশাহ–তিনি এলেন ভিক্ষা করতে, এটাও কি একটা কথা হল? যান যান, সাব এ গ্রামের সকলেই উম্মি লোক নয়। এখানে ও-সব ঠকামি চলবে না।
মাস্টারের রক্ত গরম হইয়া উঠিল। তিনি মৌলবী সাহেবের দিকে চোখ গরম করিয়া বলিলেন : হয়েছে, আপনার আর বক্তৃতা করতে হবে না।
মাতব্বরের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : কই মিয়াসাব চাঁদাটা দিয়ে দিন।
মাতব্বর আমতা আমতা করিয়া বলিলেন : দিব বই কি! তবে কিনা লড়াই-উরাইর কথাই যদি মিথ্যা হয়, তবে আর চাঁদা দিয়ে কি হবে?
মৌলবী সাহেব মাতব্বরের কথার মাঝখানে বলিলেন : মিথ্যা মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা। সব জোয়াচুরি!
মাস্টার আরও উষ্ণ হইয়া বলিলেন : আপনারা যে ওয়াদা করেছিলেন?
মাতব্বর সাহেব কি বলিতে যাইতেছিলেন। মৌলবী সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন : লড়াইর কথা যে ডাহা মিথ্যা, তখন ত এরা সে কথা জানত না। এ-রকম ওয়াদা খেলাফে দোষ নাই।
মাস্টার মৌলবীর দিকে একটা ক্রুর কটাক্ষ করিয়া মাতব্বরের দিকে চাহিয়া বলিলেন : তবে কি আপনারা চাঁদা দেবেন না?
মাতব্বর সাহেব ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন : লড়াই-টড়াই কথা যখন সব মিথ্যা, তখন—
বাধা দিয়া মাস্টার উপস্থিত অন্যান্য সকলের দিকে চাহিয়া বলিলেন : আপনাদেরও কি তাই মত?
রোমের সুলতান বড় কি ইংরাজ বড়, যুদ্ধ সত্যই লাগিয়াছে কি লাগে নাই, এসব কথা তাহারা মোটেই ভাবিতেছিল না। তাহারা ভাবিতেছিল? কোরবানির চামড়ার টাকাটা রোমের সুলতানকে দিয়া দিলে মৌলবী সাহেবের জন্য নতুন করিয়া চাঁদা দিতে হইবে। তাই তাহারা মাস্টারের প্রশ্নে প্রায় এক বাক্যে উত্তর দিল। আমাদের মাতব্বর সাব যা বলেছেন—
মাস্টার আর শুনিলেন না। চলে এসো–বলিয়া ছাত্রদের ডাকিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
ছাত্রগণ সারি দিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া চিৎকার করিল? আল্লাহু আকবর।
অহরহ-আল্লাহর-নামাজ-যেকেরে-অভ্যস্ত মৌলবী সাহেবের কানে ছেলেদের এ আল্লাহু-আকবর-ধ্বনি বিষাক্ত ছুরিকাঘাতের মতো বিদ্ধ হইল।
.
তিন
সেদিন গ্রামের একটি মাতব্বর লোক মারা গিয়াছেন।
আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী অনেক লোক জানাজা পড়িতে আসিয়াছে।
আত্মীয়-স্বজনদের মাঝখানে বহুদিনের-অব্যবহৃত-কাল-সাটিনের চওগা-পরা মৌলবী গরীবুল্লাহ সাহেবকেও দেখা গেল।
মৌলবী সুধারামী সাহেব সেখানে পৌঁছিয়া গরীবুল্লাহ সাহেবকে দেখিয়া অত্যন্ত গম্ভীর। হইয়া গেলেন এবং দন্তপূর্ণ সুরে আস্সালামু আলায়কুম” বলিয়া গরীবুল্লাহ সাহেবের প্রতি একটা ক্রুর দৃষ্টিপাত করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। আসন গ্রহণ করিয়াই তিনি খুব হয়বতের সঙ্গে চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। তিনি দেখিলেন : জনতা চার-পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হইয়া ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কি যেন কানাকানি করিতেছে। মুহূর্তে তাঁহার মুখের ভাব বদলিয়া গেল। তিনি একটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় ভীত হইয়া পড়িলেন।
ক্রমে তিনি অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। বলিলেন : সব তৈয়ার ত? তবে আর দেরি কিসের? লাশ নিয়ে বসে থাকা বহুত গোনার কাজ। হযরত তিনটা কাজের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। প্রথমতঃ স্ত্রীলোক বিধবা হলে জলদি তার নিকাহ দেওয়া, নামাজের ওয়াক্ত হলে জলদি নামাজ আদায় করা এবং মাইয়েৎকে ফওরান দাফন করা। এই তিন কাজের মধ্যে আবার হযরত মাইয়েৎ সম্বন্ধেই সবচেয়ে বেশি তাগিদ দিয়েছেন। কারণ লাশ যতক্ষণ কবরস্থ না করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপর আযাব হতে থাকে।
হযরতের এই তাগিদের কথা, বিশেষ করিয়া মৃত ব্যক্তির দেহের উপর আযাব হইতেছে শুনিয়া মাইয়েতের পুত্রেরা ছুটাছুটি করিতে লাগিল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই মেয়েলোকের কান্নাকাটি ও শোরগোলের মধ্যে লাশ বাড়ির বাহির করা হইল।
লাশ সামনে লইয়া সকলকে কাতার করিয়া দাঁড়াইবার জন্য মৌলবী সুধারামী সাহেব আদেশ করিলেন।
অনেকে দাঁড়াইল, অনেকে দাঁড়াইল না।
মৌলবী সাহেব অতিষ্ঠ হইয়া ধমকের সুরে তাঁহার আদেশের পুনরাবৃত্তি করিলেন।
গরীবুল্লাহ সাহেবের পুনঃ পুনঃ ইশারায় একজন বলিল : আগে জানতে চাই, জানাজা পড়া হবে কিভাবে?
সুধারামী সাহেব এই আশঙ্কাই করিতেছিলেন। তিনি কথা না বুঝিবার ভান করিয়া বলিলেন : কিভাবে কি রকম? এ সওয়ালের মানে কি? শরিয়তের হুকুম-মতেই জানাজা পড়া হবে।
প্রশ্নকর্তা গরিবুল্লাহ সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : এইবার বলুন মৌলবী সাহেব আপনার কি বলবার আছে।
সকলের সমবেত দৃষ্টি গরীবুল্লাহ সাহেবের উপর পতিত হইল।
তিনি বলিলেন : শরিয়তের হুকুমটা কারও বাপের ঘরের কথা নয়। সাহেবান আপনারা বাপদাদার আমল থেকে মাইয়েতের সিনা বরাবর দাঁড়িয়ে জানাযা পড়ে আসছেন। আমি শুনতে পেলাম, আপনাদের এমাম মুনশী সুধারামী সাব নূতন শরিয়ত বের করেছেন। তিনি নাকি মাইয়েতের শির বরাবর দাঁড়িয়ে জানাযা পড়বার ফতোয়া দিয়েছেন। আল্লাহর কালাম, হযরত রসূলে করীমের হাদিস কি নূতন হচ্ছে? আল্লাহ্ রসূলের নামে যারা এইভাবে তামাশা করে, তারা যদি আলেম, তবে জাহেল কে?
সুধারামী সাহেব চটিয়া রাগে কাঁপিতেছিলেন : গরীবুল্লাহ সাহেবের কথায় বাধা দিয়া কথা বলিবার জন্য দুই-তিনবার চেষ্টাও করিয়াছিলেন। কিন্তু গরীবুল্লাহ সাহেবের গলা তাঁহার গলার চেয়ে বেশ কিছুটা মোটা ছিল বলিয়া তিনি সুবিধা করিয়া উঠতে পারেন নাই। এইবার গরীবুল্লাহ সাহেব চিৎকার করিয়া বলিলেন : আল্লাহর কালাম ও রসূলে-করিমের হাদিস বদলায় নাই; যে সব জাহেল ওর মানে বুঝতে পারে না, তারাই বলে যে ওর অর্থ বদলান হয়েছে।
গরীবুল্লাহ সাহেবও একথার যথোচিত জবাব দিলেন।
এইভাবে বাহাস শুরু হইল।
উভয় মৌলবী সাহেবেই বুঝিলেন? দু’জনের পক্ষেই লোক আছে; সুতরাং নির্ভয়ে তর্ক চলিতে লাগিল।
তর্কে প্রথম-প্রথম উভয় মৌলবীই পরস্পরকে ‘মুনশী সাব’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন। কিন্তু বাহাস গরম হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই সম্বোধন ‘জাহেল’ নাদানে নামিল। কে কতটুকু পড়াশোনা করিয়াছেন, কে কবে মাদ্রাসায় মার খাইয়া পালাইয়াছিলেন আর যান নাই, এসব পুরাতন স্মৃতির দ্বারউদঘাটিত হইতে লাগিল। কে কবে কত টাকা লইয়া একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে আরেকজনের সঙ্গে নিকাহ দিয়াছিলেন, গ্রামের অনেক অজ্ঞের-সামনে এই প্রকার অনেক নূতন তথ্যও প্রকাশ পাইতে লাগিল।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলিয়া গেল। মজা দেখিবার জন্য ভিড় বাড়িতে লাগিল।
বাপের দেহের উপর আযাব হইতেছে ভয়ে মৃত ব্যক্তির পুত্রেরা অনেক তাগাদা করিল। কিন্তু তাহারা ব্যতীত আর সকলে উৎসাহের বাহাস-শুনিতে লাগিল।
লাশ রৌদ্রের মধ্যে পড়িয়া রহিল।
বেলাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যখন নায়েবে-নবীদ্বয়ের ক্ষুধাবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তখন স্বভাবতই তাঁহাদের কথার উষ্ণতাও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
কিন্তু কেহ হার মানিল না। গরীবুল্লাহ সাহেবের নষ্ট সরদারি পুনরুদ্ধারের এই শেষ চেষ্টা, সুতরাং তিনি হারিতে পারেন না। আল সুধারামী সাহেবের এই যুদ্ধজয়ের উপরই সর্বস্ব নির্ভর করিতেছে, সুতরাং তিনিও হারিতে পারেন না।
অতএব বাহাস চলিতে লাগিল। এ বাহাসের পনর আনাই গালাগালি। হাদিস কোরআনের বাহাস হইলে এতক্ষণ আর কিছুতে না হইক শ্রোতার অভাবেই বাহাস শেষ হইত। কিন্তু ব্যক্তিগত গালাগালি হাদিস-কোরআন অপেক্ষা অনেক বেশি শ্রুতিমধুর বলিয়া শ্রোতার সংখ্যা হু হু করিয়া বাড়িতে লাগিল। যাহারা কাজের চাপে জানাযা পড়িতে আসিতে পারে নাই, তাহারাও বাহাস শুনিতে আসিল।
বেলা যত উপরের দিকে উঠিতে লাগিল, তার্কিকদ্বয়ের গালাগালিও ততই ধাপে ধাপে পরস্পরের পিতৃপুরুষের উধ্বদিকে উঠিতে লাগিল। কার বাপের পেটে এক হরফ খোদার কালাম পড়ে নাই, কার বাপ চাষা ছিল, কার দাদা লবণের দোকানদারি করিত, কার নানা পান বিক্রি করিত, হাদিস-কোরআনের এইসব গভীর তথ্য সম্বন্ধে পরস্পরের জ্ঞানের প্রতিযোগিতা চলিতে লাগিল।
কিন্তু বাক্-যুদ্ধেরও শেষ আছে। উভয়পক্ষ হইতেই গালাগালির গুদাম সাবাড় হইয়া আসিল।
সুধারামী সাহেব যুদ্ধের নূতন অধ্যায় শুরু করিলেন। তিনি তবে রে শালা’ বলিয়া এক পা হইতে দেলওয়ারী জুতা খুলিয়া গরীবুল্লাহ সাহেবের দিকে সাজোরে নিক্ষেপ করিলেন। কিন্তু গরীবুল্লাহ সাহেবের গায়ে না লাগিয়া উহা দূরে গিয়া পড়িল।
জুতাটা কুড়াইয়া আনিবার জন্য যেই সুধারামী সাহেব সেদিকে ছুটিয়া গেলেন, অমনি গরীবুল্লাহ সাহেব এক লাফে লাশের সামনে এমামের জায়গায় গিয়া দাঁড়াইলেন এবং চিৎকার করিয়া কহিলেন : হাদিস-কোরআনকে বেদ আতীদের হাত থেকে রক্ষা করে যারা সওয়াব হাসেল করতে চান, তারা আসুন-মাইয়েৎ ফেলে রেখে আর গোনাহ করিতে পারব না।
উপস্থিত লোকের বেশির ভাগ কাতার করিয়া দাঁড়াইল। গরীবুল্লাহ সাহেব তাড়াতাড়ি আল্লাহু-আকবর’ বলিয়া জানাজায় দাঁড়াইয়া গেলেন।
সুধারামী সাহেব জুতা কুড়াইয়া পায়ে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। এই না দেখিয়া তিনি এক জুতা হাতে লইয়াই ছুটিয়া আসিলেন এবং এক ধাক্কায় গরীবুল্লাহ সাহেবকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া আল্লাহু-আকবর বলিয়া নিজেই এমামতিতে দাঁড়াইলেন।
গরীবুল্লাহ সাহেবও উঠিয়া সুধারামীকে এক ধাক্কা মারিলেন।
হাতাহাতি লাগিয়া গেল। সমবেত লোকেরা বহু কষ্টে জেহাদরত নায়েবে-নবীদ্বয়কে পরস্পরের বজ্রমুষ্টি হইতে মুক্ত করিল!
একটি উম্মিলোক মন্তব্য করিল আলেমদের মধ্যে এইরূপ হাতাহাতি দেখতে বড়ই খারাপ।
জবাবে সুধারামী সাহেব বলিলেন : হাদিসের এক-একটি হরফের সত্যতা বুঝাবার জন্য কত বড় বড় মোজতাহেদ মোহাদ্দেস উম্মুরভর এত এজতেহাদ করেছেন; কোরআনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য কত মোজাহেদ জান নেসার করেছেন, আর আমরা হাতাহাতি করেই কি এমন অন্যায় করেছি? হাদিস-কোরআন যে আমাদের জানের কতটা, তোমরা উম্মিলোক তা বুঝবে না।
সকলে শুনিয়া আশ্চর্য হইল, গরীবুল্লাহ সাহেব তাঁহারা বিশৃঙ্খল কাপড় ও দাড়ি বিন্যস্ত করিতে করিতে সায় দিলেন : ঠিক কথা।
মৃত ব্যক্তির পুত্ররা বিরক্ত হইয়াছিলেন।
এইবার বড়পুত্র কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল : আপনারা হাদিসের মসলা পরে ঠিক করবেন, আগে আমার মরা বাপকে গোর দিতে দিন।
প্রায় সকলেই বলিল : তাই ত, লাশ আর ফেলে রাখা যায় না।
কিন্তু এমাম শির বরাবর কি সিনা বরাবর দাঁড়াইবেন; তা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত জানাযাও ত পড়া যায় না।
গ্রামের মাতব্বর সাহেব বলিলেন : দুই মৌলবী সাহেবের একজন আজকার জন্য জিদ ত্যাগ করুন। আজ একজনের মতেই জানাযা পড়া হয়ে যাক, পরে বাহাসের মহাফেল করে এই মসলা ঠিক করা হবে।
উভয় মৌলবীই বলিলেন : ইহা তাহাদের জিদও নয়, তাহাদের ঘরের কথাও নয়; হাদিস-কোরানের কথা নিয়া আপোস করা যাইতে পারে না।
সুতরাং কেহই জিদ ছাড়িলেন না।
গোলমালও মিটিল না।
বিশেষ ভাবনার কারণ হইয়া পড়িল।
মাতাব্বররা মণ্ডলি দিয়া বসিয়া এরপর কি করা যায় তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।
অবশেষে একজন উম্মিলোক বলিল? আজকে উভয় মৌলবী সাহেবের মত মতই জানাযা পড়া যাক; দু’জনের জিদই বহাল থাক। পরে দু’চার দিনের মধ্যে বড় বড় আলেমের বাহাসের সভা ডেকে তাতে যে মত জিতবে, আমরা আগামীতে সেই মতই মনে চলব।
গরীবুল্লাহ সাহেব তৎক্ষণাৎ বলিলেন : বাহাসে যার মত টিকবে, সরদারি তারই হবে ত?
সুধারামী সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন : জানাযা নামাজের সঙ্গে সরদারির কি তা আল্লুক আছে? সরদারি এখন যেমন আছে তখনও তেমনি থাকবে।
প্রধান মাতব্বর সাহেব বলিলেন : সে পরে দেখা যাবে। কিন্তু এখনকার মতো কি করা যায়? বাহাসের মহফেলও ত আর এমনি ডাকা যায় না। আর ও-যে বললে, দুই জনের মতে জানাজা পড়ার কথা, তাই বা কি করে হতে পারে? একই লাশের দু’বার জানাযা পড়া যায় কি? কি বলেন মৌলবী সাবরা?
উভয়ের মত মতে জানাযা পড়ার কথা যে বলিয়াছিল, মৌলবী সাহেবরা কোন জবাব। দিবার আগেই সে দাঁড়াইয়া বলিল : আমি দু’বার জানাযা পড়ার কথা বলি নাই। এক বারেই দুই-এর মত মতো জানাযা পড়া যেতে পারে।
সকলে, বিশেষ করিয়া মৌলবীদ্বয়, চিৎকার করিয়া বলিলেন : কি রূপে?
সে বলিল : শির আর সিনা খুব তফাৎ নয় : পা একটু ফাঁক করে দাঁড়ালেই এক পাশির বরাবর আর এক পা সিনা বরাবর থাকবে। এতে উভয়ের মতই বজায় থাকবে। আর এমামতি কে করেন, সেটা ঠিক হয় এমামের পাওনা দিয়ে। এমামের পাওনা উভয় মৌলবীর মধ্যে সমান ভাগ করে দেওয়া হোক, তা হলেই উভয়ের এমামতি ঠিক থাকবে। কারও হারজিৎ হবে না।
এই ব্যবস্থা সকলের পছন্দ হইল! মাতব্বর সাব মৌলবী সাবদের জিজ্ঞেস করলেন : কেমন এ ব্যবস্থা চলতে পারে? হাদিসের বরখেলাফ হবে না ত?
নায়েবে-নবীদ্বয় পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া মুহূর্তে দৃষ্টি বিনিময় করিলেন এবং প্রায় সমস্বরে বলিলেন : হাদিস শরীফে এ বিষয়ে কোন নিষেধ নাই।
ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নো ও ডিসেপশন পয়েন্টের অনুবাদ চাই