নাম বদল

নাম বদল

ইস্কুল থেকে বেরিয়ে ময়ূখ জিজ্ঞেস করল, ‘‘এখন কোথায় যাবি রে?’’

নিলয় অবাক হয়ে বলল, ‘‘কেন, বাড়ি যাব? তুই কোথায় যাবি?’’

ময়ূখ ভুরু কুঁচকে কী যেন চিন্তা করতে লাগল৷ ময়ূখের মাথায় নানারকম দুষ্টুবুদ্ধি ঘোরে৷ ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই সে ঘুরপথে যায়৷ একদিন রাস্তার দুটো ছেলের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দৌড়ে একটা কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল৷

ময়ূখ বলল, ‘‘আজ একটা কাজ করবি? মনে কর, এখন থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত তোর নাম ময়ূখ আর আমার নাম নিলয়৷ আমি নিলয় বসু আর তুই ময়ূখ চ্যাটার্জি!’’

নিলয় বলল, ‘‘নাম বদলে কী করব?’’

ময়ূখ বলল, ‘‘মনে কর, এটা একটা খেলা! আজ বিকেলে আমরা এই খেলাটা খেলব৷’’

নিলয় বলল, ‘‘আমি বাড়ি গেলে মা যখন নিলয় বলে ডাকবে, তখন আমি কী করব? সাড়া দেব না?’’

ময়ূখ বলল, ‘‘তুই কী বোকা রে! খেলাটা বুঝতে পারলি না? তুই ময়ূখ হলে কার বাড়িতে যাবি? ময়ূখের বাড়িতেই যাবি৷ সেখানে কেউ তোকে নিলয় বলে ডাকবে না!’’

‘‘আমি তোর বাড়িতে যাব?’’

‘‘হ্যাঁ৷ আর আমি যাব তোদের ফার্ন রোডের বাড়িতে৷ তুই আমাদের বাড়ি চিনিস তো?’’

‘‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো একদিন৷ কিন্তু তোর বাড়িতে আমি একা যাব, তুই সঙ্গে থাকবি না, সেটা কেমন হবে?’’

‘‘সেইটাই তো খেলা! গিয়ে দেখতে হবে কীরকম মজা হয়!’’

ময়ূখের কথায় নিলয় আর আপত্তি করতে পারে না৷ এখন চারটে বাজে, ছ’টা-সওয়া ছ’টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছলেও মা চিন্তা করবেন না৷ স্কুলের মাঠেই এখন ফুটবল খেলা হয়, ক্লাস নাইনের টিমে ময়ূখ চান্স পায়নি, কিন্তু নিলয় খেলে৷ আজ অবশ্য ক্লাস নাইনের খেলা নেই৷

ময়ূখদের বাড়িটাই আগে, ট্রাম-লাইনের পাশ দিয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকতে হয়৷ একটা তিনতলা বাড়ির তিনতলায় ময়ূখরা থাকে৷ মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ময়ূখ পিঠ চাপড়ে বলল, ‘‘যা, তুই ময়ূখ চ্যাটার্জি হয়ে চলে যা!’’

নিলয়ের বুকটা ঢিপ-ঢিপ করছে কেন? এর আগে একদিনই মাত্র ময়ূখদের বাড়িতে এসেছিল সে, সারা দুপুর ক্যারাম খেলছিল, ময়ূখের বাড়ির কারও সঙ্গে বিশেষ দেখা হয়নি, শুধু ওর এক দিদি একবার ঘরে এসে খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেদিন যে ময়ূখ সঙ্গে ছিল!

সিঁড়ি দিয়ে নিলয় সোজা উঠে গেল তিনতলায়৷

সাহসে ভর করে সে দরজায় বেল টিপল৷ একটু বাদে একজন বুড়োমতন কাজের লোক দরজা খুলেই মুখ ফিরিয়ে চলে গেল৷ ছাই রঙের হাফ-প্যান্ট আর সাদা শার্ট দেখেই বোধহয় সে ধরে নিয়েছে যে, ময়ূখই এসেছে৷

নিলয়ও কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে এল৷ ডান দিকের ঘরটা ময়ূখের৷ সেই ঘরে ঢুকে নিলয় ভাবল, এবার কী হবে?

ময়ূখের চেয়ারটায় বসে সে দু’বার বলল, ‘‘আমি ময়ূখ! আমি এখন নিলয় নই, আমি ময়ূখ!’’

কিন্তু এ-আবার কীরকম খেলা? খেলাটা ঠিক জমছে না৷ এ-বাড়িতে আর কেউ নেই নাকি? ময়ূখের বাবা-মা সম্পর্কে নিলয় কিছুই জানে না৷

বুড়ো কাজের লোকটি একটা বাটিতে করে খানিকটা মুড়ি, কলা আর দুধ নিয়ে এসে বলল, ‘‘খেয়ে নাও, বাবুন! মাস্টারবাবু আসবেন সাতটার সময়, তার আগে কোথাও বেরিয়ো না!’’

নিলয় খুক-খুক করে হেসে ফেলল৷ সত্যিই তা হলে তাকে একজন ময়ূখ বলে ভাবছে৷ এই লোকটা নিশ্চয়ই চোখে কম দেখে৷

কিন্তু দুধ-কলা-মুড়ি যে একেবারেই পছন্দ করে না নিলয়! ময়ূখ বুঝি খুব পছন্দ করে এসব? নিলয় বাড়ি ফিরে রোজ দু’খানা টোস্টের মাঝখানে একখানা ওমলেট দিয়ে স্যান্ডউইচ করে খায়৷

আজ সে ময়ূখ সেজেছে, আজ তাকে মুড়িই খেতে হবে!

বাড়ির ভেতরে কিসের যেন ঝনঝন একটা শব্দ হল৷ চোর-টোর এল নাকি? বুড়ো লোকটি ছাড়া আর তো কেউ নেই মনে হচ্ছে৷

ঘরের বাইরে গিয়ে উঁকি মারল নিলয়৷

রান্নাঘর থেকে একটা বিরাট ল্যাজ-মোটা বেড়াল বেরিয়ে আসছে৷ নিলয় বেড়াল দেখতে পারে না দু’চক্ষে৷ তাদের বাড়িতে কুকুর আছে দুটো, সেইজন্য কোনও বেড়াল ঢুকতে পারে না৷

ময়ূখ কি বেড়াল দেখে ভয় পায়? ময়ূখ বেশ সাহসী৷ নিলয় এখন ময়ূখ, তাকেও সাহসী হতে হবে৷ ঘরের কোণে একটা ছাতা রয়েছে, সেটা তুলে সে বেড়ালটাকে বলল, ‘‘হ্যাট, হ্যাট!’’

বেড়ালটা নিলয়ের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ফ্যাঁস করল, তারপর দৌড়ে পালিয়ে গেল!

একটু পরে সিঁড়িতে পদশব্দ পাওয়া গেল৷ খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে এলেন এক মহিলা৷ ময়ূখের দিদি৷ উনি একটা অফিসে কাজ করেন৷ এইমাত্র ফিরলেন৷

নিলয়কে দেখে তিনি বললেন, ‘‘তুমি ময়ূখের বন্ধু না? আর একদিন এসেছিলে৷ সে কোথায়?’’

নিলয় বলল, ‘‘এখনও ফেরেনি!’’

দিদি বললেন, ‘‘ওমা, এখনও ফেরেনি? তুমি একা বসে আছ? বোসো, তোমার নাম কী?’’

নিলয় মাথা নীচু করে বলল, ‘‘ময়ূখ!’’

দিদি হেসে বললেন, ‘‘ওমা, তোমারও নাম ময়ূখ! দুই বন্ধুর এক নাম৷ ঠিক আছে, তুমি বোসো তা হলে!’’

ব্যস, খেলা তো হয়ে গেল৷ নিলয় ময়ূখ হতে পেরেছে, তার প্রমাণও রয়ে গেল৷ আর এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না!

চেঁচিয়ে বলল, ‘‘দিদি আসছি!’’

তারপর একছুটে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে৷

নিলয় বাড়ি ফিরে দেখল, তাদের বাড়ি ভর্তি লোক৷ পাটনা থেকে মামা আর মামিমা এসেছেন, নিয়ে এসেছেন দু’ঝুড়ি ভর্তি লিচু আর আম৷ দিদি আর জামাইবাবু এসেছেন কৃষ্ণনগর থেকে, তাঁরা এনেছেন সেখানকার বিখ্যাত মিষ্টি, সরভাজা৷

ময়ূখদের বাড়িতে যেমন প্রায় কেউই থাকে না, সেই তুলনায় নিলয়দের বাড়ি সবসময় জমজমাট৷

ময়ূখ বসে আছে বসবার ঘরে, তাকে ঘিরে আছে সবাই, আর ময়ূখের সামনে দু’খানা প্লেট ভর্তি খাবার৷ একটা প্রায় শেষ করে ফেলেছে, আর একটায় হাত দিয়েছে৷

মা নিলয়কে দেখে বললেন, ‘‘তুই এত দেরি করলি যে! দ্যাখ, তোর বন্ধু ময়ূখ কতক্ষণ ধরে বসে আছে!’’

নিলয় ময়ূখের দিকে তাকাল৷ ও তো নিলয় সাজেনি! ওর নাম যে ময়ূখ তা মা আগে থেকেই জানেন, ময়ূখ এ-বাড়িতে এসেছে অনেকবার৷

তা হলে আজকের খেলায় হেরে গেছে ময়ূখ৷ নিলয় নাম বদলাতে পেরেছে, ময়ূখ পারেনি!

তবে কি খাওয়ার লোভেই ময়ূখের মাথায় এই বুদ্ধিটা এসেছিল! কোনওক্রমে জেনে গিয়েছিল যে, নিলয়দের বাড়িতে আজ অনেক লোক খাবারদাবার নিয়ে আসবে? লোভী কোথাকার!

শান্তশিষ্ট, ভালোমানুষ সেজে সে দিব্যি খাবার খাচ্ছে৷ সে যে নিলয়ের কাছে খেলায় হেরে গেছে, সেজন্য লজ্জা নেই!

মা বললেন, ‘‘আজ তোর দিদি পোলাও রাঁধবে৷ ময়ূখকে আমি থেকে যেতে বলেছি৷ রাত্তিরে খেয়ে যাবে৷ ওর বাড়িতে একটা খবর দিতে হবে৷’’

নিলয় নিজের ঘরে চলে গেল৷ ময়ূখ তবু সেখানে এল না৷

একটু বাদে মা এসে বললেন, ‘‘ময়ূখ এখানেই চানটান করে নিক৷ তোর একটা জামা-প্যান্ট ওকে দে!’’

মা নিজেই আলমারি থেকে প্যান্ট-শার্ট বার করে দিলেন৷

দিব্যি ভালো ছেলের মতন ময়ূখ স্নান করে এল!

মা ওকে দেখে বললেন, ‘‘এ কী! চুল আঁচড়ালে না? তোমার কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল, কী অবস্থা হয়েছে! এসো, আমি আঁচড়ে দিই!’’

ময়ূখ মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াল৷

নিলয় চেয়ে রইল সেদিকে৷ ময়ূখ তার মায়ের স্নেহের ভাগ নিচ্ছে৷ তা নিক৷ ময়ূখ তার প্রাণের বন্ধু!

হঠাৎ নিলয়ের বুকটা ধক করে উঠল৷ ময়ূখের মা নেই৷ সেইজন্যই সে নিজের বাড়ি ফিরতে চায় না৷ এ-বাড়িতে আসে৷ সেইজন্যই সে আজ নাম বদলাতে চেয়েছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *