নাম-না-জানা বন্ধু – এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

নাম-না-জানা বন্ধু – এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

“ওই তো, ওই তো, সেই কলকা”, উল্লাসে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল দিপু। কিন্তু লাফ দেওয়া তো দূরের কথা, সিট থেকে এক ইঞ্চিও নড়া গেল না। এমন টাইট করে সিট-বেল্ট বাঁধা। ওই অবস্থাতেই যতটা সম্ভব ঘাড় বেঁকিয়ে গলা টান টান করে সে দেখতে চেষ্টা করল, জানলা দিয়ে অনেক নীচে সমুদ্রের সবুজ-নীল জল থেকে প্রায় যেন লাফ দিয়ে উঠে আসা কলকা আকৃতির দ্বীপটা।

দিপু কলম্বো যাচ্ছে শুনে অনেকে অনেকরকম কথা বলেছিল। বাগড়া দিতে চেষ্টা করেছিল প্রায় সবাই। ভাগ্যিস, জেঠু তাদের কথা কানে নেননি। দিপু জানত। জেঠু ওরকম একটুতে ঘাবড়ে যাওয়ার লোকই নন। ভয় কাকে বলে জেঠুর জানা নেই। তাই অবিনাশকাকা অকারণেই বেড়াতে এসে যখন বললেন, “বলি ব্রজগোপাল, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? রাক্ষসদের দেশ। সেখানে এই কচি ছেলেটাকে একেবারে একা পাঠাচ্ছ।”

চোখ লাল করে জেঠু বললেন, “রাক্ষসদের দেশ! তা রাক্ষসরা তো ছোট খোকাকে আর বউমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেনি এই পাঁচ মাসে। মনে হয় দিপুকেও খাবে না।”

“আরে খায়নি। কিন্তু খেতে কতক্ষণ?”

অবিনাশকাকার কথা বলাই সার। জেঠু নিজের মনে যা করছিলেন, করে যেতে লাগলেন। খানিক পরে এলেন সামনের বাড়ির লাহিড়ীকাকু। বললেন, “এই মারামারি কাটাকাটির মধ্যে ছেলেটাকে পাঠাচ্ছিস। তোর মাথাটাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?”

জেঠু বললেন, “সে তো উত্তরে। কলম্বো একদম শান্ত। তা হলে ছোটখোকা কি ওকে পাঠাবার জন্যে লিখত? ওদের কাজকর্ম তো ভালমতোই হচ্ছে। ইউনেস্কোর লোকজনেরা খুব প্রোটেকটেড। ওদের কিছু হবে না।”

লাহিড়ীকাকু আগে চাকরি করতেন ইরাকে। ঘরের মধ্যে গুঁড়ি মেরে বসে আছেন, খোলা জানলা দিয়ে সাঁ সাঁ করে গুলি ছুটে যাচ্ছে, এইরকম একটা আবহাওয়ায় অনেক বছর কাটিয়েছেন। তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা শুনে দিপুর লোম খাড়া হয়ে যেত। ভাবত, ইশ, শ্রীলঙ্কাও যেন ওরকম হয়। কিন্তু বাবার চিঠিতে কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহের খবর থাকে না। কলম্বো একদম শান্ত। প্রত্যেক চিঠিতে বাবা এই কথা লেখেন।

লাহিড়ীকাকু কেবল খুঁতখুঁত করেন। শেষে জেঠু বেশ কঠিন কণ্ঠে বলেন, “দ্যাখো, শ্রীলঙ্কা ইরাক নয়। হলে দিপুকে পাঠাবার কথা ছোটখোকা লিখত কি? এই নিয়ে বেশি বকবক করবে না, বলে দিচ্ছি।”

মনে হয়েছিল, সবচেয়ে মুশকিল হবে ঠাকুমাকে নিয়ে। কিন্তু ঠাকুমার ফেভারিট নাতনি যখন যাচ্ছে না, তখন ঠাকুমার কোনও চিন্তাই নেই। বনিকে যাবার কথা মা-বাবা অবশ্য লিখেছিলেন, কিন্তু তার পরীক্ষা সামনে। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কা যাবার জন্য বনি খুব একটা উৎসাহবোধ করেনি। দিপু জানে আসল কারণটা কী। কলম্বো থেকে তো আর সকাল-বিকেল প্রাণের বন্ধু শ্ৰীলাকে ফোন করা যাবে না।

পাশের বাড়ির প্রদীপদা খবরটা শুনে সত্যিকার খুশি। অনেক কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে একটা দারুণ কবিতার লাইন। ‘ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ।’ কাঞ্চনময় কাকে বলে দিপু জানে না, সিন্ধু মানেও না। অবশ্য সিন্ধু নদীর কথা বাদ দিলে। সেন্ট্রাল স্কুলে তো বাংলা শেখার উপায় নেই, তবে বাড়িতে মা আর দিদির বকাবকির চোটে খানিকটা বাংলা হাতের লেখা রপ্ত হয়েছে, বইও যে পড়তে পারে না, তা নয়, কিন্তু হিন্দি কিংবা ইংরেজির মতো তাড়াতাড়ি এখনও পারে না। মা বলেন, “চেষ্টা থাকলে আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। তুইও বরং গরমের ছুটিতে বেশি করে বাংলা গল্পের বই পড়িস।”

প্রদীপদা, অবশ্য মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সোনার লঙ্কা, যাকে বলা হত, স্বর্ণলঙ্কা। রামায়ণের বর্ণনা তো নিশ্চয় মনে আছে। আর সিন্ধুর মানে হল, সমুদ্র। ম্যাপে শ্রীলঙ্কার চেহারাটা দেখেছিস? ঠিক মনে হয় না একফোঁটা জল কিংবা সমুদ্রের কপালে সাঁটা কলকামতো টিপ?

লাইনটা ভারী চমৎকার, দিপু মনে মনে অনেকবার আউড়ে মুখস্থ করে নিয়েছে। ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ। মনে মনে ভেবেছিল, বোধহয় প্লেন থেকে দেখা যাবে সোনালি সব গম্বুজওয়ালা উঁচু উঁচু বাড়ি, রোদে চকচক করছে। কাঞ্চনময়, সোনায় মোড়া। কিন্তু তার বদলে সবুজ কলকা। ভারী আশ্চর্য লাগল তার। মুখ ফসকে তাই বেরিয়ে গেল, “আরে, আরে, ওই তো কলকা…”

পাশের ভদ্রলোকটি তার স্বগতোক্তি শুনে একটু হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিলেন। “নট কলকাত্তা মাই সন, উই আর অ্যাপ্রোচিং কলম্বো।”

অচেনা লোকে পিঠ চাপড়ে কথা বললে দিপুর খুব বিরক্ত লাগে। তা ছাড়া মাই সন আবার কী? উনি কি ওর বাবা নাকি? কানেও কি কম শোনেন ভদ্রলোক। কলকা শুনে ভেবেছেন কলকাতা। দিপু কি এতই ছেলেমানুষ যে, কোথায় যাচ্ছে তাও জানে না? মাদ্রাজে প্লেন বদল করে ভোরবেলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে যে প্লেনে চড়ে বসল, সেটা ওকে আবার কলকাতা ফেরত নিয়ে যাবে এরকম ভাবার মতো বোকা কেউ হয় নাকি। উনি নিজে হতে পারেন, তা ছাড়া এ কীরকম বিশ্রী গায়ে পড়ে কথা বলা স্বভাব। দীপু তাই শুধু একবার ভদ্রলোকের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ‘আই নো’ বলেই মুখটা ফিরিয়ে নিল। আরে, এই ভদ্রলোককে নিয়েই তো একটু আগে খুব ঝামেলা হয়েছিল। প্রকাণ্ড বড় হাতব্যাগ নিয়ে ঢুকছিলেন উনি সিকিউরিটি চেকের মধ্যে দিয়ে। ওরা বোধহয় ব্যাগের সাইজ নিয়ে কিছু বলেছিল। দিপুর কানে যা এসেছিল, তা এইরকম:

“এত বড় ব্যাগ কেন?”

“জিনিস আছে, তাই।”

“জিনিসের জন্যে তো সুটকেস আছে। তাতে ঢোকাবেন তো।”

‘আঁটেনি, আর জায়গা ছিল না সুটকেসে।”

“তাই সব হ্যান্ডব্যাগে পুরেছেন? বাঃ!”

দিপু ভাবছিল, এত বড় হাতব্যাগে কী পুরেছেন উনি? ওর নিজের ব্যাগে পাশপোর্ট, স্কুলের আই-ডি কার্ড, ডায়েরি, কলম, টুথব্রাশ, চিরুনি, সেলোটেপ, আলপিন আর ছোট্ট ছুরি, তাও অনেক জায়গা।

ওরা শেষ অবধি ভদ্রলোককে ব্যাগ খোলাতে বাধ্য করেছিল, সব কথা দিপু ঠিক শুনতে পায়নি।

খোলা হল হাতব্যাগ। প্রকাণ্ড চারখানা টিন, মুখ আঁটা।

“কী আছে এর মধ্যে?” সন্দেহ-ভরা চোখে। তাকালেন অফিসার।

“নাথিং, নাথিং। ওনলি চিলি পাউডার।”

“কী? চিলি পাউডার?” অফিসারের তো চক্ষু ছানাবড়া। “আপনি শ্রীলঙ্কায় লঙ্কা নিয়ে যাচ্ছেন?”

“মিৰ্চ মসালা?” এক ভদ্রমহিলা ফোড়ন কাটলেন। হাসির রোল উঠল।

“ইউ আর রাইট ম্যাডাম। মির্চ কি দেশ মে মির্চ মসালা।”

“ক্যারিং কোল টু নিউ ক্যাস্‌ল৷”

নানারকম মন্তব্য ছুড়তে লাগল আশপাশের লোকেরা। ভদ্রলোক কিন্তু নির্বিকার। ওই চার টিন লঙ্কার গুঁড়ো উনি শ্রীলঙ্কাতে নিয়ে যাবেনই, এবং ওই হাতব্যাগে ঢুকিয়ে।

শেষ অবধি এই সমস্যার কী সমাধান হয়েছিল দিপু জানে না, কিন্তু তিনি এখন ওরই পাশে বসে জ্ঞান দেবার চেষ্টা করছেন। যাকগে, তার চেয়ে কলকা দ্বীপের ভেতরে কী দেখা যাচ্ছে সেদিকে মন দেওয়া যাক।

প্লেন ততক্ষণে নামতে শুরু করেছে। আরে, আরে, ছাতার মতো এই গাছগুলো কী? মনে হচ্ছে, সমস্ত দ্বীপটাই কেউ ছাতা মুড়ে রেখে দিয়েছে। সোনার গম্বুজ দূরে থাক বাড়িঘরও নেই, কেবল এই আশ্চর্য গাছ— হাজার হাজার সবুজ ছাতার মতো। পরক্ষণেই দিপু বুঝতে পারল ওগুলো কী গাছ। ও তো নারকোল গাছ। তা হলে ওপর থেকে নারকোল গাছের জঙ্গল এইরকমই দেখায়। এরকম দিক থেকে দেখার সুযোগ তো হয়নি, তাই নারকোল গাছ বলতেই যে চেহারাটা ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে একে ঠিক মেলানো যাচ্ছিল না। নামবার সময় কীরকম দেখব? দিপুর মনে হল, এই খোলা ছাতাগুলো কী করে সাধারণ নারকোল গাছ হয়ে যাবে? হবে কি? দেখা যাক, কেমন করে হয়। কিন্তু হবে তো?

হঠাৎ ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গেল দিপু। যেন ওগুলো নারকোল গাছ হওয়া-না-হওয়ার ওপর তার জীবনমরণ নির্ভর করছে। এমনকী ক্ষতি হবে যদি ওগুলো নারকোল না হয়ে অন্য কোনও নাম-না-জানা গাছ হয়? প্রদীপদা অবশ্য ওকে আসার আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটা সংখ্যা দেখিয়েছিলেন, তাতে অনেক নারকোল গাছের ছবি ছিল। তবে তাতে লাল কী সব ফল ঝুলছে। নারকোলেরই মতো, কিন্তু অনেক বড়। মা চিঠিতে লিখেছিলেন, এখানে একরকম নারকোল হয়, তাকে বলে কিং কোকোনাট। যা সাইজ নারকোলের, রাজাই বটে। সম্ভবত এই ছাতা গাছগুলো তাই।

প্লেনের মধ্যে ততক্ষণে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। নামার সময় হয়ে আসছে। দিপুর মতো নিশ্চয়ই এরা কেউ প্রথমবার শ্রীলঙ্কা যাচ্ছে না। তাই ততটা উত্তেজিত এদের না হবারই কথা। দিপু তো সামনে পরীক্ষার কথা স্রেফ ভুলে মেরে বসে আছে। এখন মনে পড়ে যেতেই মনটা একটু দমে গেল। জোর করে মন থেকে সেই ভাবনাটা সরিয়ে দিল। প্রদীপদা ওর শ্রীলঙ্কা বেড়াতে আসাটা খুব সাপোর্ট করেছিলেন, বলেছিলেন, “দ্যাখো ডাকু, জীবনে আসল পরীক্ষা কি হলঘরে বসে খাতা আর কলম দিয়ে হয়। হয় না। আসল পরীক্ষা হয় বাস্তবের মুখোমুখি।”

প্রদীপদা ওকে দিপু বলে ডাকেন না। বলেন ডাকু। আসলে ছোটবেলায় দিদা এই নামটা চালু করেন। ভাল নাম জয়েন্দ্র, ডাক নাম ডাকু। তাতে কী হয়েছে। দিদিরও তো ভাল নাম জয়নী, ডাকনাম বনি। তবে দিদি যেরকম স্কুলে বন্ধুদের মুখে জেনি হয়ে গিয়েছিল, জয়েন্দ্র নিয়ে তেমন কিছু হয়নি। কেবল বাবা যখন পিলানী গেলেন ওঁর সহকর্মীরা খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, “বেটাকা ইয়ে ক্যায়সা নাম রখ্‌খা ডক্টর মজুমদার?”

বাবা অম্লানবদনে উত্তর দিয়েছিলেন, “কেন, ডাকু তো চমৎকার নাম।”

“আরে রাম রাম, আপকা বেটা ক্যা চম্বলকা ডাকু বনে গা?”

বাবা তাতে ভ্রূক্ষেপও করেননি। কিন্তু মা বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে ডাকুকে দিপু বলে ডাকতে শুরু করলেন। এই নামটাই বেণুমাসি সোনামাসিরা সবাই পছন্দ করল। জেঠু, জেঠি, ঠাকুমা সবাই ওকে দিপুই বলেন। কেবল বাবা এখনও ডাকু বলতে ভালবাসেন। আর ডাকু বলে ডাকেন প্রদীপদা।

দিপু এতক্ষণে চারপাশে তাকাল। এখনও সিট-বেল্টে কেউ হাত দেয়নি। প্লেনের অর্ধের ভরতি, দু’-চারজন বিদেশি ছাড়া মনে হচ্ছে সবাই ভারতীয়। সিংহলিও হতে পারে। এই স্কার্ট-ব্লাউজ পরা মেয়েটি বোধহয় ভারতীয় নয়। নরম চেহারা, গায়ের রং ফরসাও বলা যাবে না, কালোও বলা যাবে না। মাঝামাঝি। নাকটা খুব টিকলো নয়, চোখ দুটো বড় বড়। দিপু ওর নাম জেনে গেছে। একটু আগেই ওর মা ওকে ডাকছিলেন চন্দ্রিকা বলে। চন্দ্রিকা তো ভারতীয়দের নামও হতে পারে। তবে এই বয়সের কোনও ভারতীয় মেয়ে হয়তো শালোয়ার-কামিজ পরত। নাও পরতে পারত। দিদি তো মাঝে মাঝে স্কার্ট-ব্লাউজও পরে।

উঃ, সময় যেন আর কাটতেই চায় না। শেষের কয়েক মিনিটকে মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা। চারদিক দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঘন সবুজ জঙ্গল, একটু আগেই দেখা গিয়েছিল সমুদ্র, কী ঘন নীল জল। জল কিন্তু পুরীর সমুদ্রের মতো আছড়াচ্ছে না। প্লেন থেকে যতটুকু দেখা গেল, তাতে দিপুর মনে হল সি-বিচে কারও হাত ধরে জলে নামার দরকার হবে না।

থামল প্লেন, ক্যাপ্টেন সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। উঠে পড়েছে সবাই। দিপু হাতে ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল, কারা যেন ঘাড়ের কাছে ফিসফাস করে কী বলছে। খুব নিচু গলায় কথা হচ্ছিল। ভাষাটা সম্ভবত সিংহলি। অন্তত তামিল যে নয়, সেটা দিপু বুঝতে পারছিল। যারা কথা বলছিল, তাদের ও দেখতে পাচ্ছিল না, তবে গলার সুরে চাপা উত্তেজনা, যেন স্বাভাবিক কথাবার্তানয়। অন্যের কথাবার্তা যদিও শোনা উচিত নয়, তবু দিপু মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। ভাবল মানে তো বুঝতে পারছি না, শুনলে ক্ষতি কী।

একটা কথা কয়েকবার কানে এল। বেল অব এশিয়া। দিপু ভাবল, শুনেছি শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রতাপ। তা হলে ওদের বৌদ্ধ বিহারে এত বড় ঘন্টা আছে যা এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়? হবেও বা, কিন্তু জাপানিরা কি এসব ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে? এশিয়ার বৃহত্তম ঘণ্টা কোনও জাপানি বুদ্ধ মন্দিরে থাকলেই যেন ভাল হত। যাকগে। অন্তত কলম্বোতে গিয়ে ও বাবাকে বলতে পারবে, এশিয়ার বৃহত্তম ঘণ্টাটা যে এখানে আছে, তা আমি জানি।

লোক দুটোর কথাবার্তার মধ্যে আরও দু’-একটা ইংরেজি শব্দ ছিল। একজন বলল, বিহার মহাদেবী পার্ক। অন্যজন মনে হল সায় দিয়ে কী যেন বলল। এইটুকু শোনার পর প্লেন ল্যান্ড করার উত্তেজনায় বাকি কথা আর দিপুর কানে ঢুকল না।

নামবার সময় মির্চ-মসালা বাবুর কী তাড়া। দিপুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে যেতে উনি একবার পিছনে তাকালেন। আবার সেই চাপা গলা। কী যেন একটা নির্দেশ বিনিময় হল। খুবই সন্দেহজনক। দিপুর আফসোস হল, আসবার আগে সিংহলি ভাষাটা একটু শেখার চেষ্টা কেন করেনি। কার কাছেই বা শিখত। মা চিঠিতে লিখেছিলেন, ভাষা নিয়ে কোনও অসুবিধে হবে না। এখানে সকলেই ইংরেজি বলে। অন্তত কলম্বোতে।

কটুনায়কে এয়ারপোর্টে দিপুর মা আর বাবা হাজির ছিলেন, সঙ্গে আর একজন অচেনা ভদ্রলোক। দিপুকে দেখে মা জড়িয়ে ধরলেন। বাবা হ্যান্ডশেক করে বললেন, “হাউ ওয়াজ দা ট্রিপ?” বাবা সবসময় ওর সঙ্গে সমবয়সির মতো ব্যবহার করেন। কিন্তু দিপু মাকে চমকে দেবে ঠিক করেছিল। তাই মাথা ঝাঁকিয়ে ‘ও কে’ বলে বাবার কথার সংক্ষেপে উত্তর। সেরে নিয়ে মাকে বলল, “মা সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ।”

মা বললেন, “দিপু, এত অবাক হলেন মা যে, তাঁর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল না।

বাবা হো হো করে হাসলেন। “দেখেছ তো, ছেলের বাংলা কতটা উন্নতি করেছে এরই মধ্যে।”

মা বললেন, “ওই চন্দন যার অঙ্গের বাস তাম্বুল-বন কেশ।”

দিপু বলল, “তার পরে?”

“যার উত্তাল তাল-কুঞ্জের বায়-মন্থর নিশ্বাস…”

বাবা বললেন, “খুব হয়েছে, চলো এখন বাড়ি যাওয়া যাক। ভাল কথা, মি. প্রেমদাসা মিট মাই সন।” এটা উনি বললেন সঙ্গের সিংহলি ভদ্রলোককে। তিনি এতক্ষণ মিটিমিটি হাসছিলেন।

॥ ২ ॥

বাড়ি মানে ‘হোটেল জানকী’। সেখানে ইউনেসকো থেকে ব্যবস্থা করা আছে, আলাদা অ্যাপার্টমেন্টের। গত পাঁচ মাস দিপুর মা-বাবা ওখানেই আছেন। ফার্নিচার, প্লেট-কাঁটাচামচ, বিছানার চাদর, সবই ওরা দিয়েছে। শুধু রান্নার কিছু বাসন কিনে নিয়েছেন দিপুর মা। অর্ডার দিলেই হোটেল থেকে খাবার অবশ্য চলে আসে, কিন্তু এ-দেশে সব তরকারিতে এত নারকোল তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে শহরের দিকে। এয়ারপোর্ট শহর থেকে বেশ দূরে। খালের মতো একটা জলের ধারা পেরিয়ে গেল গাড়ি। বাবা বললেন, “শ্রীলঙ্কার নদী কেমন দেখলি? এটাকে কী বলে জানিস? কেলানিয়া গঙ্গা।”

“গঙ্গা! এখানেও?” দিপু তো অবাক।

“গঙ্গা মানেই নদী। যেমন মহাবলী গঙ্গা।”

“বা রে। এটা তো জানতাম না। প্রদীপদা তা হলে ঠিকই বলেছিলেন। বাড়ি থেকে না বেরোলে কিছুই জানা যায় না।”

কথাবার্তা যদিও বাংলায় হচ্ছিল, কিন্তু প্রেমদাসা আন্দাজে বুঝতে পারছিলেন বোধহয়। উনি ইংরেজিতে বললেন, “এখানে অবাক হবার মতো অনেক কিছুই দেখতে পাবে। তোমাদের দেশের সঙ্গে কিছু মিল, কিন্তু অনেক বেশি অমিল।”

বাবা বললেন, “প্রেমদাসা, আপনি যদি দিপুর একজন গাইড ঠিক করে দেন, তা হলে বড় সুবিধে হয়। আমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাকব, ওকে নিয়ে উইক এন্ডে ছাড়া ঘোরার সময় পাব না।”

প্রেমদাসা বললেন, “কেন, মিসেস মজুমদার তো এই পাঁচ মাসে একজন কলম্বোবাসী হয়ে গেছেন।”

বাবা বললেন, “তবেই হয়েছে। ওঁর সঙ্গে পেটায় দোকানে দোকানে ঘুরতে দিপুর কি ভাল লাগবে?”

মা বললেন, “আমি বুঝি খালি পেটার সোনার দোকানে গিয়ে বসে থাকি?”

বাবা বললেন, “পাগল!”

॥ ৩ ॥

সেদিন দিপুর জন্যে অনেকে ওদের হোটেলের ঘরে জমা হলেন। খুব আড্ডা জমে উঠেছিল।

প্রেমদাসা বললেন, “শ্রীলঙ্কার ইতিহাস খুব ঘটনাবহুল, কত জাতি এখানে এসেছে, থেকে গেছে, ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে আসে উত্তর ভারতের রাজা সিংহবাহুর ছেলে বিজয়। সে বিয়ে-থা করে এখানেই থেকে যায়। মারা যাবার আগে সে তার বাবাকে চিঠি লেখে, তিনি যেন তার ছোট ভাইকে এখানে পাঠান রাজ্য সামলাবার জন্য। কিন্তু ততদিনে সিংহবাহু মারা গেছেন, সিংহাসনে বসেছেন তার দ্বিতীয় পুত্র সুমিত্র, তিনি তাঁর ছোট ছেলে পাণ্ডবশকে পাঠালেন। এইভাবে সিংহলের সিংহাসনে বসলেন এক বাঙালি-রাজপুত্র।

“অনেকদিন কাটল, অনেক উত্থান-পতন, ১৫০৫ সালে এল পর্তুগিজরা। ও না, বলতে ভুল হয়েছে। তার আগে এসেছিল মুররা। তাদের তাড়াতে এল পর্তুগিজরা। একশো বছর পরে ওলন্দাজরা তাদের তাড়িয়ে দ্বীপ অধিকার করে। আবার হাত-বদল হয়। এবারে আসে ইংরেজরা। তারাও চলে গেল। এবার এলেন আপনারা,” বলে দিপুর বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপ করলেন প্রেমদাসা।

সকলে হো হো করে হেসে উঠল। মি. ইউকাওয়া বললেন, “এই টানাটানির মধ্যে কোথাও জাপানিরা নেই? মি, প্রেমদাসা, আপনি ইতিহাসটি ঠিকঠাক বলেছেন তো? আমার মনে হয়, আমার দেশ থেকে অনেক আগেই এখানে পাড়ি জমানো উচিত ছিল। কী সুন্দর সবুজে সবুজ দেশ আপনাদের। রাস্তার দু’ধারে মশলা-বাগান, গন্ধে ভুরভুর, আহা। চাঁদনি রাতে বাত্তিকালোয়ার লেগুনের নীল জলে মাছেরা গান গায়, সে কী অনির্বচনীয় সুর। আর আপনাদের সি-বিচ। পৃথিবীতে এরকম কোথাও আছে? নাঃ। আমি ভাবছি, বিজয় সিংহের মতো এখানেই সংসার পেতে থেকে যাই।”

মি. ইউকাওয়া যা মজা করে কথা বলেন, ওঁর ইংরেজিটাও বেশ বাঁকাচোরা। দিপুদের হোটেলের অ্যাপার্টমেন্টে উনি প্রায়ই হাজির হন। ভদ্রলোক পেশায় ফোটোগ্রাফার। বিয়েটিয়ে করেননি, ভবঘুরে টাইপের। সবসময় কাঁধে ক্যামেরা আর মুখে কথার খই ফুটছে। একদিন দিপুর মা ওঁকে লুচি খাইয়েছিলেন, সেদিন ষষ্ঠী না কী ছিল বলে মা সারাদিন উপোস করে ছিলেন। ব্যাপারটা ইউকাওয়াকে বুঝিয়ে বলা হয়েছিল। যেদিন উপোস সেদিন ভাত খাওয়ার কথা নয়। সন্ধেবেলা লুচি। তারপর থেকে ইউকাওয়া এসেই প্রথম কথা জিজ্ঞেস করেন, “কী, আজ আপনার লুচি-ডে নয়?” লুচি খেয়ে খুব পছন্দ হয়েছিল ভদ্রলোকের।

কলম্বোতে এসে দিন ভালই কাটছিল দিপুর, ওর সঙ্গী জুটেছিল বিজয়। ওরই বয়সি ছেলে। বাবার সহকর্মী আপ্পাসিংঘে ওর সঙ্গে দিপুর আলাপ করিয়ে দেন। বিজয়ের বাবা প্রোফেসর, সব সময়েই এদেশ-ওদেশ করেন। আপ্পাসিংঘের ছেলেবেলার বন্ধু, কলম্বোর পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময় বিজয়ই ছিল ওর গাইড।

প্রথম দিকটায় মা একটু আপত্তি করতেন। “হোটেল থেকে একা একা কোথাও যাস না। কী জানি বাবা, শুনছি জনতা বিমুক্তি পেরামুনাদের বিশ্বাস নেই। আর এলটিটিই-এদেরও বিশ্বাস নেই। এই তো সেদিন পার্লামেন্টে বোমা ফাটল—প্রেসিডেন্ট অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন।”

বাবার কাছে এসব কোনও কথাই নয়। উনি বললেন, “তোমার ছেলে তো আর জয়বর্ধনে নয়। তা ছাড়া এলটিটিই-রা কলম্বোতে ঘোরাফেরা করে না। দিপু যদি একটু নিজে নিজে ঘুরেই না বেড়াল, তা হলে আর ওর আসা কেন? তা ছাড়া বিজয় সঙ্গে থাকছে তো। ও তো লোকাল ছেলে, ঠিক জানে, কোথায় যেতে হবে আর কোথায় গন্ডগোল।”

বিজয়ের সঙ্গে টোটো করে ঘুরে বেড়াত দিপু। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয়, পূর্ণিমার দিন কলম্বোতে সব ছুটি। ওরা বলে পোয়া-ডে। সেদিন, এমনকী সিনেমা হলগুলোও বন্ধ। টিভিতে কেবল বুদ্ধের স্তব আর গান হয়।

বিজয় আর দিপু প্রায়ই যেত সমুদ্রের ধারে একটা খোলা জায়গায়। সেখানে সবাই ঘুড়ি ওড়াতে যায়। কতরকম ঘুড়ি। এরকম ঘুড়ি দিপু আগে কখনও দেখেনি। বাক্স ঘুড়ি, বিশাল বিশাল ল্যাজওয়ালা চিনে ঘুড়ি, দেখে তো দিপুর তাক লেগে গেল। গল ফেস জায়গাটার নাম, কারণ পাশ দিয়েই গেছে গল রোড, কলম্বো থেকে গল শহরে যাবার রাস্তা। গল ওলন্দাজদের আমলের শহর, বিরাট একটা পুরনো দুর্গ আছে সেখানে, এটা একেবারে দক্ষিণে। এসব দিকে সবাই বেড়াতে যায়। এখানে কোনও গন্ডগোল নেই।

কলম্বো শহরের মাঝখানে একটা দারুণ পার্ক আছে। অনেকদিন আগে নাকি সেখানে দারচিনি বন ছিল। এখন তা নেই, তবে নামটা রয়ে গেছে সিনামন গার্ডেন। তার মধ্যে শ্রীলঙ্কার এক রানির মূর্তি আছে। সেখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল। দিপু সেটা কাউকে বলে উঠতে পারেনি। শুধু বিজয়কে বলেছিল।

পার্কের দু’পাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা সরু পথ দিয়ে ওরা হাঁটছে। কানে এল উত্তেজিত কথাবার্তা। চেনা গলা। দিপু কান খাড়া করল, কিন্তু দাঁড়িয়ে তো পড়া যায় না। তাই এগিয়ে যেতে যেতে যতটা শুনতে পেল, তাতে ও স্পষ্ট বুঝল এ সেই প্লেনের সন্দেহজনক সহযাত্রী, যিনি বেল অব এশিয়ার কথা বলছিলেন।

রাস্তাটা শেষ হয়েছে যেখানে, সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার রানি বিহার মহাদেবীর মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যায়। দিপু বলল, “চল, আমরা ওদিকে যাই।” ওপাশ থেকে ঠিক সেই সময় বেরিয়ে এল সেই দু’জন। মির্চ মসালা আর কটা চোখ, কটা চুল চেহারার একজন। তারা অবশ্য নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে উলটো দিকে চলে গেল।

বিজয় বলল, “লোকটা বার্গার।”

দিপু বলল, “তার মানে?”

“ওরা ওলন্দাজদের বংশধর। দক্ষিণে গলের আশপাশে বার্গাররা থাকে।”

দিপু প্লেনের কথাবার্তা আর লোকজনের সন্দেহজনক চালচলনের কথা বিজয়কে বলল। বিজয় বলল, “তুই ঠিক শুনেছিলি ওরা বিহার মহাদেবী পার্কে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করছে? সেটা তো যে কেউ করতে পারে।”

“কিন্তু ফিসফিস করে বলছিল।”

“আরে, দূর, দূর।”

“এখানেও দেখলি ওরা জঙ্গলে ঢুকেছিল, কেন বাইরে খোলা জায়গায় বসে কথা বলা যেত না?”

“এটা তুই ঠিক বলেছিস, আর কী বলছিল ওরা?”

“বুঝতে তো পারিনি। কী যেন এশিয়ার ঘণ্টার কথা বলছিল।”

“ঘণ্টা! তুই কী শুনতে কী শুনেছিস।”

হাঁটতে হাঁটতে ওরা পার্ক ছাড়িয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে।

“ওখানে অত সাদা কাগজ ঝোলানো আছে।

“কেউ মারা গেছেন। সাদা কাগজ টাঙানো মানেই তাই।”

“চল, একটু কাছে যাই।”

॥ ৪ ॥

প্রেমদাসা বললেন, “চলো, তোমাকে নোগাম্বো যেতে যেতে শোনাব শ্রীলঙ্কার রত্ন, মণি-মাণিক্যের কথা। পৃথিবীতে মহামূল্য রত্ন উৎপাদনকারী যে পাঁচটি প্রধান দেশ আছে, শ্রীলঙ্কা হল তার মধ্যে একটি।”

দিপু জিজ্ঞেস করল, “উৎপাদন মানে কি এগুলো ম্যানুফ্যাকচার করা হয়, কৃত্রিম ভাবে?”

প্রেমদাসা হো হো করে হাসলেন। “আরে না, না। আমারই বলতে ভুল হয়ে গেছে। রত্ন উৎপাদন নয়, এ দেশের মাটি পাথর আর নদীর বালির মধ্যে আছে দামি দামি রত্নের উৎস। কতরকম শুনবে? শুধু হিরেই পাবে না এখানে। আর পান্না। বাকি সব যেমন নীলা মানে সাফায়ার। কতরকম রঙের নীলা এখানে পাওয়া যায় জানো?”

দিপু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন নীলা তো নীল হয়, তাই না?”

প্রেমদাসা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, “শুধু নীল? শুধু নীল ভাবছ! হ্যাঁ নীল তো আছেই।”

বাবা বললেন, “নীলকান্তমণি।”।

মা বললেন, “কিন্তু আমি যতদূর জানি, নীলা সকলের সহ্য হয় না। কেউ কেউ ধারণ করে খুব উপকার পায়, কারও মারাত্মক অনিষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায়।”

প্রেমদাসা একবার চট করে দিপুর মায়ের হাতের দিকে দেখে নিয়ে বললেন, “তাই বুঝি আপনার হাতে কোনও নীলার আংটি নেই মিসেস মজুমদার? ওটা তো মুক্তো বসানো মনে হচ্ছে।”

মা একটু লজ্জিত হলেন। রত্ন ধারণে ওঁর তেমন বিশ্বাস নেই। মুক্তোটা পরেছিলেন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে। কিন্তু এসব কথা কী করে প্রেমদাসাকে বোঝানো যায়।

দিপু অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, “কিন্তু আপনি বলছিলেন অন্য রঙের নীলার কথা।”

“হ্যাঁ, শোনো। নীলা আছে সাদা, হলদে আর কমলা রঙের। আমরা সিংহলিরা কিন্তু নীলাকে খুব শুভ বলে মনে করি। বুঝলেন মিসেস মজুমদার, বরং হিরে আমাদের কাছে ততটা শুভ নয়। মানে ওই যে আপনি বললেন, আপনাদের নীলা সম্বন্ধে যে মনোভাব, আমাদের হিরে সম্বন্ধেও তাই। কার হিরে সহ্য হবে কার হবে না, এসব জটিল ব্যাপার।”

এইসব আলোচনা শুনে দিপু একবার বাবার দিকে তাকাল। যা ভেবেছিল ঠিক সেইরকম প্রতিক্রিয়া হল বাবার।

“যত সব বাজে গাঁজাখুরি গল্প। যাকগে, আপনি নীলার কী ইতিহাসের কথা বলছিলেন, বরং সেটা হোক।”

প্রেমদাসা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। “হ্যাঁ, শুনুন তবে, এখানকার সব বিখ্যাত নীলার কথা। ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের গয়নাগাঁটিতে, ইরানের শাহের মুকুটে যেসব বড় বড় নীলা শোভা পাচ্ছিল বা এখনও পাচ্ছে, সেগুলি সবই গেছে এদেশ থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নীলা, পাঁচশো তেষটি ক্যারেটের। সেটাও এখানকার। তবে দুঃখের বিষয়, তার নাম স্টার অব ইন্ডিয়া।”

“এটা তো ভারী অন্যায়,” বললেন দিপুর মা।।

“জিনিসটা আছে কোথায়?” জানতে চাইলেন ড. মজুমদার।

“সেটা আছে আমেরিকায়। ওদের ন্যাচারাল হিষ্ট্রি মিউজিয়ামে। আরও নানান জায়গায় আছে, বড় বড় মিউজিয়ামে।”

দিপু জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কি খুব দামি?”

“দামি তো নিশ্চয়ই। দামের যদি আন্দাজ চাও, তা হলে বলি, প্যারিসের মিউজিয়ামে একশো ক্যারেট ওজনের একটা স্বচ্ছ নীলা আছে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে যখন এটা কেনা হয়েছিল, এর দাম ছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা।”

দিপু বলল, “তার মানে ভারতীয় মুদ্রায় দেড় লক্ষ।”

বাবা বললেন, “সেটা তো এখনকার হিসেবে। কিন্তু আপনাদের সব দামি নীলাই কি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে নাকি?”

প্রেমদাসা বললেন, “সব যায়নি। আমাদের জেম কর্পোরেশনের কাছে আছে পাঁচশো ক্যারেটের ব্লু জায়েন্ট, আর চারশো ক্যারেটের ব্লু বেল অব এশিয়া।”

“ভারী সুন্দর নাম তো।” মা বললেন, “এগুলো দেখতে পেলে মন্দ হত না।”

“বলেন তো নিয়ে যেতে পারি। লাকসলোতে বোধহয় এনে রাখা আছে এখন,”বললেন প্রেমদাসা। “আসুন, এবারে নেমে আমাদের নৌকোয় উঠতে হবে।”

নোগাম্বো জায়গাটা সমুদ্র থেকে ঢুকে-আসা লেগুনে ভরতি। নৌকো করে লেগুন পার হয়ে হোটেল। সেখানে আবার এক লম্বা কাঠের বারান্দা চলে গেছে লেগুনের পাশ ঘেঁষে। অনেকখানি যাবার পর ছোট ছোট কুটির। সমস্ত পথটা নিচু সুরে বাজনা শুনতে শুনতে যেতে বেশ ভালই লাগছিল। দিপু কিন্তু ভাবছিল অন্য কথা। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার মতো মন তার ছিল না।

প্রেমদাসা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। মাকে বলছেন, “একদিন রত্নপুরা যাবেন, যেখানে জেম তোলা থেকে কাটা, পালিশ করা সব হয়। একেবারে সাবেকি ধরনের। নদীর বালি ছেঁকে ছেঁকে মণি মাণিক্য আলাদা করা হচ্ছে। সাধারণত এগুলো অনেক কাটাছাঁটা ও শোধন-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, তবে এদের চেনা যায়। কিন্তু এক-একটা খালি চোখেও চেনা যায়। সে বেশ মজার ব্যাপার।”

বাবা আর মা নানারকম মন্তব্য করছিলেন, কিন্তু দিপুর কানে ভাল করে কিছুই ঢুকছিল না। তার মাথার মধ্যে কেবল প্রতিধ্বনি হচ্ছে—ব্লু বেল অব এশিয়া। ব্লু বেল অব এশিয়া। প্লেনের সেই সন্দেহজনক লোকটা এই নামটাই তো করেছিল মির্চ-মসালাবাবুর কাছে। তারা কি তা হলে নীলার কথা আলোচনা করছিল? মনটা কেমন খচখচ করতে লাগল। কথাটা কাকে বলা যায়?

॥ ৫ ॥

সেদিন দিপু ঘরে একা বসে বসে টিভি দেখছিল। বাবা-মা গেছেন প্রোফেসর মেন্ডিজের বাড়ি। সেখানে দিপুর বয়সি কেউ নেই বলে সে হোটেলেই থেকে গেছে। ফোন করে বিজয়কে আসতে বলেছিল, কিন্তু ও কোথায় যেন গেছে।

টিভির পরদায় ঘোষিকা তখন সবে উদয় হয়ে হাতজোড় করে বলছে, ‘আইহুয়ান। রূপবাহিনী।’ বাকি কথাগুলো দিপু বুঝতে পারল না। সিংহলি ভাষার মাত্র গোটা কয়েক শব্দই সে বোঝে। আইহুয়ান মানে নমস্কার, রূপবাহিনী হল দূরদর্শন। কয়েকটা কথার আশ্চর্যভাবে বাংলার সঙ্গে মিল আছে। যেমন জলকে ওরা বলে জল, চিনিকে সিনি, তালগাছকে তালগাস। বাবা বলেন, এটা হবার কারণ বিজয় সিংহের সঙ্গে যে দলবল এসেছিল তারা সবাই মেদিনীপুর, ওড়িশা এই সব জায়গার লোক। তাদের বংশধর এরা। তাই চেহারায়ও খানিকটা ওইরকম ভাব আছে। তবে অনেক শব্দ আবার খুব উলটোপালটাভাবে ব্যবহার হয়। হোটেল জানকীর কাছে যে কো-অপারেটিভ স্টোর আছে, তাকে ওরা বলে সালুসালা বিলাসিতা। মা’র কাছে শুনেছে সব ডিপার্টমেন্টাল স্টোরই বিলাসিতা। তারপর আছে নাম। যেমন বিজয়, ললিত, চন্দ্রিকা, গামিনী। সবই সংস্কৃত নাম, কিন্তু ইংরেজি বানানগুলো অন্যরকম। যেমন, বিজয় এরা বানান করে ডাবলিউ দিয়ে। নাম সংস্কৃত হলে কী হবে, তার মধ্যে এতগুলো করে ডাবলিউ আর জেড থাকে যে, দেখলে প্রথমটা বুঝতে পারা মুশকিল। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসে পড়েছে সম্রাট অশোকের ছেলে মহেন্দ্র সিংহলে এসেছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে, এরা তাঁকে বলে মহিন্দ।।

দিপু হঠাৎ চমকে গিয়ে দেখে, টিভির পরদায় যেন চেনা চেনা একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। আরে, আরে, এই তো সেই লাকসালা, যেখানে কালকেই মা আর মিসেস কুলশ্রেষ্ঠের সঙ্গে ও গিয়েছিল। পরক্ষণেই দেখা গেল, সেখানে একজন লম্বামতো লোক, হাতে মাইক্রোফোন। উত্তেজিতভাবে খুব তাড়াতাড়ি কী যেন বলে যাচ্ছে সে। মানে না বুঝলেও দিপু এইটুকু আন্দাজ করতে পারল যে, ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে। সম্ভবত লাকসালা থেকে কোনও মূল্যবান বস্তু চুরি গেছে। লোকটার একটা কথা বুঝতে না পারলেও সে স্পষ্ট শুনল, ব্লু বেল অব এশিয়া। ইশ, বিজয়টা যদি এখানে থাকত। লোকটা একবার ইংরেজিতে বললেই তো পারে।

যেন দিপুর মনোগত বাসনা বুঝতে পেরে পরদায় দেখা দিল শাড়ি-পরা একজন ঘোষিকা। শ্রীলঙ্কার অফিসে, বাজারে, দূরদর্শনে সব জায়গায় মেয়েরা যেমন একরঙা শাড়ি আর সেই রঙেরই ব্লাউজ পরে, এ-মেয়েটিও তাই পরেছে। হালকা সবুজ রঙের। উত্তেজিত মুখে সে বলতে লাগল, “আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি— আজ বিকেল চারটে বেজে চল্লিশ মিনিটে লাকসালার ভেতরের হলঘরে এক দুঃসাহসিক চুরি হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার গর্ব, আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয় নীলা ব্লু বেল অব এশিয়া কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে। বন্ধুগণ, আপনারা জানেন নীলার প্রভাব কত মঙ্গলজনক। পুলিশ এ-বিষয়ে অত্যন্ত বেশিরকম তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। জনসাধারণের বিশ্বাস, এই নীলা দেশের মাটি থেকে উধাও হলে শ্রীলঙ্কার ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসবে। এ-বিষয়ে আমরা বিখ্যাত নীলা-বিশেষজ্ঞ শ্রীঅতুল ফার্নান্দোর কাছে এখন যাচ্ছি।”

এরপরে কথাবার্তা হল সিংহলি ভাষায়। আওয়াজটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল দিপু। এও কি সম্ভব? তা হলে কাল যেটা চোখের ভুল বলে মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা সত্যি। দৃশ্যটা আর-একবার ভাল করে মনে করবার চেষ্টা করল। সরকারি এম্পোরিয়াম লাল। লোকের ভিড়ে ভরতি। মা আর মিসেস কুলশ্রেষ্ঠ বাটিকের জামাকাপড়ের কাউন্টারে। দিপু নিজের মনে বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছিল মুখোশের দিকটায়। কতরকম মুখোশ। এখানকার মুখোশ নাকি খুব বিখ্যাত। দিদিকে ভয় দেখাবার জন্য একটা বিকট ভেংচি-কাটা মুখোশ কিনলে কেমন হয়? কথাটা মাকে বলবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই একঝলক ও দেখতে পেল সেই লোকটাকে। সেই বার্গার যাকে প্লেনে শলা-পরামর্শ করতে শুনেছিল মির্চ-মসালার সঙ্গে। কিন্তু একপলকের জন্য কেবল। তারপর সে ভিড়ের মধ্যে কোথায় মিশে গেল। একটু অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করল ও। যেখানেই যাই সেখানেই ওই লোকটা। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। নাঃ, কী দেখতে কী দেখেছে। দৌড়ে বাটিকের কাউন্টারে পৌঁছে দেখে, ততক্ষণে মা আর মিসেস কুলশ্রেষ্ঠ সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছেন। সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে দিপু ভাবল, বরং এখানেই অপেক্ষা করি। যে-মুখোশটার দিকে ওর নজর ছিল, সেটা আর-কেউ না নিয়ে ফেলে এই চিন্তা তখন তার মাথায়। একটু পরেই অবশ্য মা নেমে এলেন, পিছন পিছন তাঁর বান্ধবী। মুখোশ কিনে ওরা হোটেলে ফিরে দেখে, তার বাবা অপেক্ষা করছেন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। উত্তর ভারতীয় ভদ্রলোক। তিনি ওঁদের নিয়ে যাবেন মাউন্ট ল্যাভিনিয়াতে।

॥ ৬ ॥

আজ দিপু চলে যাবে। সকাল থেকেই মা’র চোখ ছলছল করছে। মা’র যেমন কাণ্ড, সকলের সামনে আবার কান্না না জুড়ে দেন— তা হলে দিপুর প্রেসটিজ একদম চুরমার। সুটকেস অনেকক্ষণ আগেই চেপেচুপে বন্ধ করা হয়ে গেছে, সবাই নীচে নামার উদ্যোগ করছে, এমন সময় ‘হ্যালো, হ্যালো’, বলতে বলতে ইউকাওয়ার আগমন।

“তুমি তা হলে চললে মি, দিপু? তোমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারব না। তাই এখানেই গুডবাই করতে এলাম।”

দিপু তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিল। জোর হ্যান্ডশেকের পর ইউকাওয়া বললেন, “আশাকরি গুণ্ডা-বদমাশদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে। আর স্মাগলারদের থেকেও সাবধান।”

ইউকাওয়ার ওইরকমই কথা। দিপু মুচকি হাসল। মা একটু হতভম্বভাবে তাকালেন। বাবা বললেন, “মি, ইউকাওয়া, ইতিমধ্যেই আমার স্ত্রী হাজাররকম বিপদ কল্পনা করতে শুরু করেছেন, আপনি তো আগুনে ঘি ঢালছেন। কোথায় স্মাগলার? আমি তো এতদিন তাদের নামই শুনেছি, কারও সঙ্গে তো মোলাকাত হবার সুযোগ হল না।”

“ইউ আর লাকি মি. মজুমদার,” গম্ভীর হয়ে বললেন ইউকাওয়া, “আপনি জানেন এখান থেকে কী রেটে জেম আর সোনা বাইরে পাচার হয়? আপনাদের ইন্ডিয়াতেই তো ওদের ঢালাও বাজার।”

“ধরা পড়ে নিশ্চয়ই?”

“কিছু পড়ে। সবটা পড়ে না। এই তো যে-নীলাটা নিয়ে হইচই চলছে, পেয়েছে তার হদিশ? সে এতদিনে মান্নার উপসাগরের ওপরে চলে গেছে।” চোখ মটকে দিপুর দিকে তাকিয়ে ইউকাওয়া বললেন, “তবে বলা যায় না হয়তো মি. দিপুর সঙ্গে এক প্লেনেই টিকিট কেটেছে ডাকাতটা।”

মা বললেন, “মি. ইউকাওয়া, দয়া করে এইসব আজেবাজে কথা বলবেন না।”

হা হা হা। দরাজ গলায় হাসলেন ইউকাওয়া। “কী ভাবছেন আপনার ছেলেকে? সে এখন এত বড় আর সাহসী যে, সেরকম অবস্থা হলে তিন ঘুষি মেরে স্মাগলারকে ঘায়েল করে দেবে। কী দিপু, পারবে না? ইউ আর এ বিগ বয়।”

আবার সেই কটুনায়কে এয়ারপোর্ট। সিকিউরিটি চেকে ঢোকার আগে চট করে প্রণামটা সেরে নিয়ে দিপু বলল, “মা, সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ, ওই চন্দন যার অঙ্গের বাস তাম্বুল-বন

“দীপ,” বলেই মা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের জল আর বাঁধ মানল না।

বাবা বললেন, “ব্যাপারটা কী, তুমি এমন করছ। যেন কতবছর বাদে আবার ওকে দেখবে। এই তো ম্যাটার অব ফোর মান্থস, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। হ্যাভ এ গুড ট্রিপ দিপু।”

ফিরে গিয়ে মাকে চিঠিতে কী কী লিখবে, এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে দিপু প্লেনের দিকে রওনা দিল। আশপাশে কারা ছিল খুব একটা দেখতে ইচ্ছে ছিল না। মনটা কেমন ভার ভার লাগছে। মাথার মধ্যে ঘুরছে, সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ। পুরো কবিতাটা মুখস্থ করার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু প্রথম তিনটে লাইনের পর মা আর ঠিক করে মনে করতে পারলেন না। বাবার সঙ্গে এই বিষয়ে পরামর্শ করতে গিয়ে মা এক ধমক খেয়ে গিয়েছিলেন।

“আচ্ছা সত্যেন দত্তের কাব্যসঞ্চয়ন একটা কোথায় পাওয়া যায়, বলতে পারো?”

“এখানে? শ্রীলঙ্কায়? আর ইউ ম্যাড?”

“কেন, হোটেল তাজ সমুদ্রের মি. ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করলে হয় না?”

“খেপে গেছ? উনি এখানে চাকরি করতে এসেছেন, না কবিতার বই পড়তে?”

ব্যাপারটা ওখানেই শেষ। ওরা পরে একবার তাজ সমুদ্রে গিয়েছিল। কী দারুণ জায়গা। কে সি পন্থ নাকি এসে ওখানেই উঠেছিলেন। মি. ভট্টাচার্যি খুব আলাপী লোক, কিন্তু তাঁর কাছে মা আর সত্যেন দত্তের নাম ভরসা করে করেননি।

তাজ সমুদ্র, গল ফেসে ঘুড়ি ওড়ানো, বিজয়। সকলের জন্যেই মন কেমন করবে। মি, ইউকাওয়ার মজার মজার কথা। আজকে কি আপনার লুচি-ডে? তুমি স্মাগলারদের তিনটে ঘুষিতে কাত করে দিতে পারবে না দিপু? স্মাগলার, রত্ন-চোর, বিখ্যাত নীলা। আচ্ছা, সত্যিই যদি সেই চোরটা এই প্লেনে থাকে, এমনও তো হতে পারে যে, সে দিপুর পাশেই বসেছে।

নাঃ, দীপুর পাশে এক সাদা চামড়ার মহিলা, সঙ্গে গোটাতিনেক নানা সাইজের বাচ্চা। উনি একবার দিপুকে বললেন, “এক্সকিউজে মোয়া।” তা হলে উনি নির্ঘাত ফরাসি। বাচ্চাগুলো সারা প্লেন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে ছোট সোনালি চুল মেয়েটা এক ছুটে তার মায়ের হাত ছাড়িয়ে পিছনের দিকে দৌড়ে গেল, সে কোথায় গিয়ে ঠোক্কর খায় দেখবার জন্যে যেই দিপু ঘাড় ঘুরিয়েছে, ঠিক তখনই পরপর দুটো ঘটনা ঘটল। উলটো দিক থেকে আসা একজন এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাচ্চাটা হুমড়ি খেয়ে। পড়ল আর দিপুর চোখে পড়ল তার তিন সারি পিছনে একজন গম্ভীর মুখ ভদ্রলোকের দিকে। সেই বার্গার। একেই সে মহাদেবী বিহার পার্কে দেখেছিল আর পরে এক ঝলকের জন্য লাসালায়। তা হলে কি… তা হলে কি? উত্তেজনায় টান টান হয়ে ঘুরে বসল দিপু। এত কি ভাগ্য হবে তার? খোদ এক রত্ন-চোরের সঙ্গে একই প্লেনে?

দ্রুত চিন্তা করল সে। ইতিমধ্যে সিট-বেল্ট লাগাবার ডাক পড়েছে—ক্যাপ্টেন আরও কী কী সব বলে চলেছেন, দিপুর সেদিকে কান নেই। সে কেবল ভাবছে চারশো ক্যারেটের নীলা তা হলে ওরই সঙ্গে। ব্লু বেল অব এশিয়া। কিন্তু নীলা হয়তো পাচার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ওর সঙ্গেই যে আছে তার প্রমাণ কী!

দিপুর ভয়ানক রাগ হল, কলম্বো থেকে মাদ্রাজ কেবলমাত্র আধঘণ্টার পথ। এত অল্প সময়ের মধ্যে কী করতে পারে সে। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতেও পারছে না। লোকটার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে, কিন্তু কতবার ঘাড় ঘোরাবে সে? কী ভাববে অন্য সহযাত্রীরা? এই ক্ষেত্রে পেশাদার ডিটেকটিভরা কী করত? সম্ভবত কোনও ছুতোয় লোকটার পাশে গিয়ে বসার চেষ্টা করত। কী ছুতো, আচ্ছা এই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলার ছুতো করে ওদিকে যাওয়া যায় না? ফ্রেঞ্চ জানলে মহিলাকে একটু জিজ্ঞেস করা যেত, আমি কি ওদের সঙ্গে খেলতে পারি? ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু উনি কী ভাববেন? প্লেনটা কি খেলার মাঠ? তিন-চার বছরের ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করলে খারাপ দেখায় না, কিন্তু দিপুর মতো একজন ক্লাস সেভনের ছেলে দু’সারি সিটের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, এটা কল্পনা করাও কষ্টকর।

দিপু আর-একবার দেখে নিল। লোকটার মুখ গোমড়া, কোলের ওপর হ্যান্ডব্যাগ। কেন, কোলে কেন? আর কেউ তো হ্যান্ডব্যাগ কোলে করে বসেনি। লোকটার চোখ বারবার হ্যান্ডব্যাগের দিকে পড়ছে। তা তো পড়বেই। আরে, ফরাসি বাচ্চাটা টলমল করতে করতে ওইদিকে এগোতেই বিরক্ত মুখ করে লোকটা ব্যাগটা সরিয়ে বগলের তলায় করে নিল। বাঃ, বাঃ, দিপুর ইচ্ছে করল, বাচ্চাটাকে আদর করে কোলে তুলে নিতে। দিপু এটাও লক্ষ করল যে, বাচ্চাদের দেখলে সকলের মুখটা কেমন নরম মতো হয়ে যায়, এর কিন্তু তা হল না। বাচ্চাটা ওখান থেকে যেন গেলে বাঁচে, এমন ওর মুখের ভাব।

বাচ্চাটা কি দিপুর মনের কথা বুঝতে পেরেছিল? কারণ লোকটার ব্যাগ সরানো দেখে ও বোধহয় ভাবল এটা একটা খেলা। সে হাসি হাসি মুখে তার ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল। লোকটা অধৈর্য হয়ে এক ধাক্কা দিল বাচ্চাটাকে। ধাক্কাটা একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিল, সত্যি সত্যি বোধহয় ওকে আঘাত করা লোকটার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু চেয়ারের কোণে মাথা ঠুকে বাচ্চাটার কপাল একটু কেটে গেল। সে যা না চিৎকার জুড়ল, তার চেয়ে বেশি চেঁচালেন তার মা। তারপরে এক দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল।

লোকটাকে এগিয়ে এসে মাপ চাইতে বাধ্য করলেন কয়েকজন সহযাত্রী, কেউ কেউ রেগে আগুন হয়ে তাকে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান নানারকম ভাষায় কটুকাটব্য বর্ষণ করতে লাগলেন, অনেকেই সিট ছেড়ে উঠে পড়েছে, এদিক থেকে এয়ার হোস্টেসরা ওদিক থেকে ক্যাপটেন। এই গন্ডগোলের মধ্যে দিপু সুট করে হাতব্যাগের কাছে পৌঁছে গেছে। জিপার খুলে হাত ঢোকালেই যে কিছু পাবে, এমন ভরসা ছিল না। হাতে শক্তমত কী যেন ঠেকল। বার করে দেখে, মোজা। যা থাকে কপালে, শক্ত জিনিস-পোরা মোজাটি নিজের পকেটে পুরে ভাল ছেলের মতো আবার নিজের সিটে এসে বসে পড়ল।

॥ ৭ ॥

প্রদীপদা বললেন, “ব্যাপার কী বল তো ডাকু? এসে অবধি দেখছি তুই গম্ভীরভাবে কীসব চিন্তা করছিস। তুই কি শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলি নাকি? এবারে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী দূত করে তোকেই পাঠাবেন।”

দিপু তখন নিবিষ্ট মনে একটা ছোট কার্ডবোর্ডের বাক্সের চারপাশে আচ্ছা করে সেলোটেপ আটকাছে।

প্রদীপদা বললেন, “এটা তো দেখছি একটা স্লাইডের বাক্স। কী করছিস এটা নিয়ে?”

দিপু ছোট্ট করে বলল, “পাঠাব।”

“কী পাঠাবি? কোথায়?”

“কলম্বোয়, আমার বন্ধু বিজয়কে কিছু স্লাইড।”

এটা অবশ্য মিথ্যে কথা হয়ে গেল। দিপু কখনও মিথ্যে কথা বলে না। কিন্তু ও যতই প্রদীপদাকে ভালবাসুক, তাঁকে কী করে বলে এর মধ্যে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার সেই বিখ্যাত চুরি যাওয়া ব্লু বেল অব এশিয়া। ভেতরে ছোট্ট করে একটা কাগজে লিখে দিয়েছে, একজন নাম-না-জানা বন্ধুর কাছ থেকে। পার্সেলটা সে বিজয়কে করছে না, করছে কলম্বোর সরকারি এম্পোরিয়াম লাকসালাকে। প্রেরকের নাম হিসেবে যা-হোক একটা-কিছু নাম লিখে দিলেই হবে।

মানসচক্ষে দেখতে পেল দিপু কিং কোকোনাটের ছাতা মাথায় সবুজ মুক্তোর মতো দ্বীপ শ্রীলঙ্কা। ঝলমলে নীল জল এসে আঁচড়াচ্ছে মাউন্ট ল্যাভিনিয়া বিচে। দূরে গল রোড। সেখান দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটছে গাড়ি। আর হোটেল জানকীর গোল বারান্দায় বসে মা সেলাই করছেন। বসার ঘরে টিভির সামনে বাবা। ঘোষিকা বলছেন, “আইহুয়ান, রূপবাহিনী। আজ আপনাদের কাছে একটা সুসংবাদ পরিবেশন করছি। গত সাত দিন ধরে সমস্ত জনসাধারণ যে নীলার শোকে মুহ্যমান ছিলেন, সেই নীলা, আমাদের পরম প্রিয় ব্লু বেল অব এশিয়া আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছে। পাঠিয়েছেন অজানা কোনও বন্ধু। আমরা শ্রীলঙ্কার এই বন্ধুকে আমাদের নমস্কার জানাচ্ছি। তিনি আয়ুষ্মান হোন। আইহুয়ান।” আবার হাতজোড় করল মেয়েটি।

দিপু মুচকি হেসে স্লাইডের বাক্সে কাগজ সাঁটতে লাগল।

১৫ জুন ১৯৮৮

অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *