১১.
কী হল অরিন্দমদা, শ্যাওড়াফুলি ইসটিশান থেকে হেঁটে এলে নাকি গো, অমন হাঁপ ছাড়চ? জিভে জড়ানো উত্তর আগে জানিয়ে তার প্রশ্নটা পরে বলে সবচে ছোটো পিসতুতো ভাই পল্টু, থলথলে তাঁমাটে, খালি গায়ে নেয়াপাতি ভুঁড়ির ওপর পৈতে, ডানবাহুতে রুপোর চেনে তাঁমার ডুগডুগি-মাদুলি, মুখের মধ্যে ভেটকি বৃদ্ধের লাশের ঝালঝাল টুকরো। সামনে কাঁচের গেলাসে মদের আদরে বিগলিত-চিত্ত বরফ-টুকরো। বলল, সময় লাগল বলতে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ক্লাস টু ফাইভ এইট, ওঃ, কত যে ধকল গেল, নাঃ, বুঝবে না তুমি ; আগে বিয়ে করো, ছেলেপুলে হোক। মাদুলির চেন বাজিয়ে এক চুমুকে শেষ করে। দাঁতে বরফ ভাঙার কড়মড়।
পল্টুর বউটাই কেবল হাঁটুমুড়ে টিভিতে নাক ঠেকিয়ে হিন্দি মারপিটে উৎকর্ণ। ছাপাশাড়ি, এলোখোঁপা, ছোট্ট কপালে মেরুন টিপ, পায়ের কাছে ফাঁকা গেলাস। বাদবাকি ননদ ভাজ ভাসুর ননদাই মদের পলু থেকে কথার মাকড়সার ঘরকুনো জাল বুনছে। গোল হয়ে সবাই। সামনে একাধিক কাঁসার থালায় আস্ত পারসে ভাজা, আরামবাগি মুরগি-ঠ্যাঙের সুস্বাদু পাহাড়, হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার ভুষিমাল, দুফাঁক ডিমসেদ্ধ, মাছের ডিমের বড়া, শশা পেঁয়াজ গাজর। ভাইরা, জামাইরা, সবাই খালিগা, কারুর চেহারাই ব্যায়াম করা পেশল নয়, মোদো থলথলে। পায়জামার ওপর একটা করে বিশাল তাঁমাটে কুমড়ো। বউরা, বোনরা মোটার ধাতে এগুচ্ছে। বোধহয় মাঝে-মাঝেই হুইস্কির ক্যালরিতে তনু ভেজে।
শতরঞ্চিতে বসে মাছের ডিমের একটা বড়া মুখে পুরে অরিন্দম যখন চিবিয়ে অবাক ওর মধ্যেকার কাজু কিসমিস রসুনকোয়া সাদা-তিলের উপস্হিতিতে, বড়ো বউদি, যার আজকে জন্মদিন, চেঁচিয়ে হুকুম জারি করে, এই অরিকেও একটা গেলাস দাও, দাও,দাও,দাও, কতদিন পরে আমাদের বাড়ি এল, তাও আবার রাত্তিবেলা।
অরিন্দম স্পষ্টত বিচলিত। বলল, আরে না-না, আমি এসব খাই না, ককখুনো খাইনি ; সিগারেট ওব্দি খাই না।
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফরসা ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে, আর বাঁহাতে অরিন্দমের গলা আঁকড়ে নিজের কানা-ভরা গেলাস দাঁতেদাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উল্টে দিলে। খাবিনে মানে? তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী। বিশাল বুকের খাঁজের মাঝে অরিন্দমের মাথা ঠাসা।
তোমার বুকে চেতল মাছের গন্ধ, বলতে, বড়ো বউদি চাপা গলায়, মাছটা কুরে রেখেছিলুম রে, হয়ে উঠল না। অরিন্দমের ফাঁস আলগা হয় না। জামা ভিজে গেছে। ফাঁসের দরুন কষ্ট হচ্ছে। আবার ভালোও লাগছে। নারীর বুকটুকুর এক পৃথক মাতৃত্ব আ্ছে মনে হয়।
অ্যাই, দামি স্কচ বলে ভাবচ ওতে চান করলে নেশা হবে? দুপাটি দাঁত ভিজছে গেলাসের হুইস্কিতে, ওয়ালরাসের হিলহিলে ঠোঁট নেড়ে বলল বড়ো জামাই। অরিন্দম, তার চেয়ে তুই বরং কিছু ভালগার জোক শোনা। গ্রামীণ বিকাশের অনুদান লোটা মাংসল জামাইয়ের কন্ঠস্বর।
জাপটানো অবস্হাতেই বড়ো বউদির হুকুম, হ্যাঃ, তাই শোনাহ। বুজলি অরি, আমরা হলুমগে শান্ডিল্য গোত্রের মাতাল ; গোত্রের ভেতরেই শুঁড়িখানা। বিয়ের আগে তোর মতন ভারজিন কাশ্যপ গোত্র ছিলুম। নেশার কুয়াশায় ক্রমশ ঝিমোনো বউদির কন্ঠস্বর। জাপট আলগা হলেও অরিন্দম মাথা সরায় না। পাফ দিয়ে গুঁড়ো দুধ মাখানো বুক হলে ভালো হতো।
আমি একটা বলছি। টিভি থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা করেছে ছোটো বউ। স্বতঃপ্রণোদিত মাতাল। একবার না, অ্যাঁ, হি-হি, একজন না, অ্যাঁ, রাস্তার ধারে নর্দমায় হিসি করছিল, হি-হি। অশ্লীল নয়, অশ্লীল নয়, অ্যাঁ, নালির ধারে তোমরা যেমন হিসি করো। লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের বোতাম লাগায়, অ্যাঁ, তখন জিপ ছিল না, বোতাম ছিল, বোতাম লাগিয়ে, অ্যাঁ, টের পেল ওর ঘাড় বেঁকে গেছে, হি-হি, একদম সোজা হচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে গেলো, ওষুদ খেলো, মালিশ লাগাল, ইনজেকশান নিলে, অ্যাঁ, হি-হি, কিন্ত কিছুতেই কিছু হল না, ঘাড় সোজা হল না। মহাবিপদ। কী করে বেচারা। বেঁকা ঘাড় নিয়েই কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি গেল, বউকে বলল। বউ বললে, তা এই কতা, দাঁড়াও এক সেকেণ্ডে ঘাড় সোজা করে দিচ্চি। বলে, হি-হি, প্যান্টের বোতাম খুলে দিতেই ঘাড় সোজা হয়ে গেল। উউউউফ। লোকটা কোটের বোতাম প্যান্টের বোতামঘরে লাগিয়ে নিয়েছিল।
সবাই, মাতাল ভাজ ননদ ননদাই ভাসুর হাসবে বলে উদগ্রীব করে তুলেছিল নিজেদের, কিন্তু নিরুৎসাহিত হল। অরিন্দমের হাসি পেয়েছিল, ছোটোবউ তার স্বামীকে তির্যক আক্রমণটি করল অনুমান করে। কিন্তু হাসার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে গিয়ে টের পেল, বড়ো বউদি আবার জাপটকে আঁট করে ফেলেছে ; হয়তো নিজের চেয়ে বেশ ছোটো একজন যুবকের গ্রন্হিসুগন্ধের মাদকতা মদের সঙ্গে মিশে জরুরি আহ্লাদ এনে দিচ্ছে। অবহেলিত নারীর মাতৃত্বের গোপন যৌনতা।
নোংরা চুটকি না হলে কেউ হাসবে না রে, সেজো বউদির বিজ্ঞ মন্তব্য। নোংরা মানে সেক্স!
ছোটো জামাই তলানিটা চুমুক মারে। আঁচ্ছা আমারটা শোনো। তেমন নোংরা নয় যদিও। ওই সেক্স-টেক্স নিয়ে নয়। আমাদের রাজনীতিকদের নিয়ে। সো-সো। একজন মাঝারি নেতা, ভাষণ শেষ করে যখুন চেঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল, ওমনি কোঁৎ করে নকল দাঁতের পাটি গিলে ফেলেছে। এক্সরে হল, সোনোগ্রাফি হল, গু পরীক্ষা হল, নিউক্লিয়ার মেডিসিন টেস্ট হল, দাঁতের পাটি-জোড়ার কোনো হদিস পাওয়া গেল না। একদোম যেন উবে গেচে। কলকাতায় কিছু হল না বলে ভেলোর, অ্যাপোলো, রামমনোহর লোহিয়া, হিন্দুজা, যশলোক, এ আই এম এস কত জায়গায় দেখালে, ব্রেন স্ক্যান হল, রাজনীতিক তো, হয়তো ব্রেনে চলে গিয়ে থাকবে দাঁত-জোড়া, এই ভেবে। দাঁত পাওয়া গেল না। শেষে বিদেশে নেতাদের একটা দল যাচ্ছিল মৌমাছির চাষ কী ভাবে করে দেখার জন্যে, তা একে-তাকে, মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকে ধরে প্রতিনিধি হয়ে ঢুকে গেল তাতে। উদ্দেশ্য হুসটনে গিয়ে রাষ্ট্রের খরচে ডাক্তার দেখাবে। দলটা আমেরিকায় পৌঁছোল। নানান পরীক্ষার পর যখুন ল্যাংটো উপুড় করে বডি চেক করছে, ডাক্তার অবাক। বললে, ইন্ডিয়ার রোপট্রিক শুনেছি বটে, কিন্তু এরকুম হাসিমুখ গুহ্যদ্বার এর আগে দেখিনি। ইন্ডিয়ার সব পলিটিশিয়ানদেরই কি এরকুম হাসি? কয়েক মুহূর্ত থেমে ছোটো জামাই বললে, হয়েছে কী, দুপাটি দাঁত ওইখানে, পোঁদে গিয়ে আটকে গিয়েছিল।
সমবেত হোঃ হোঃ হয় বটে, তবে অভিপ্রেত অট্টহাস্য হয় না। অরিন্দম হাসতে পারে না। বড়ো বউদির ঢাউস বুকের মাঝে মাথা আটক। হাঁসতে গেলে যদি আটক আলগা হয়ে যায়, তাই। সেজো বউদির মন্তব্য, নিজেকে ছাড়াচ্চিস না যে বড়ো? মজা নিচ্ছিস, বুঝেছি, আমরা কি ফ্যালনা!
অরিন্দম নিশ্চুপ, নিরাবেগ, নিরুত্তেজ।
আঁচ্ছা, আমি একটা আসল অশ্লীল নোংরা অবসিন জোক বলছি। বড়ো জামায়ের প্রস্তাব সমর্থিত হবার মুহূর্তে অরিন্দম আঁৎকায়, জোকের জন্যে নয়, মহিলাদের সামনে অমন জোক শোনার অভিজ্ঞতা ওর নেই। না না না না, আমি তাহলে উঠে পড়ব, ধ্যাৎ।
অরিন্দমের গলা আঁকড়ে রেখেই বড়ো বউদি, কেনওওওরে? এখনও বে-থা করিসনি বলে? কবে আর করবি? আমার কাচে অনেক ছাত্রী-পাত্রী আচে। ফিগার-চটকে ভালো চাস? না পড়াশুনোয়? বলিস তো দেকি কচিমতন। পার্টির মেয়েদের চাস তো আমার কাছে সপিয়েম, কংরেস, বিজেপি, তৃণমূল সব রকমের মেয়ে আছে, তুই একবার রাজি হলেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেবো তাদের। যতোই রাজনীতি করুক, বাপেরা জানে যে সোমথ্থ মেয়েকে একদিন পাত্রস্হ করতেই হবে।
মেজো বউদি : তোর সেই মাইকাটা শুদদুর প্রেমিকাটার কী হল রে? আমাদের এদিকেও সব খবরাখবর আসে। খুব ঝুলোঝুলি করেছিলি নাকি বে করার জন্যে। তা কেঁচে গেল কেন?
বড়ো জামাই : অশ্লীল অঙ্গ দুটো নেই বলে।
সমবেত মহিলা আর পুরুষের অট্টহাস্যের দমবন্ধ দমকা বোমাটা এবার ফাটে। হেসেই সামলে নেয় সবাই, ভাই বোন ভাজ ভাসুর ভাদ্দরবউ দেওর জামাই ননদ শালা ননদাই। চোখাচুখিতে ঝটিতি ইশারা বদল হয়। সবাই জানে, পাটনায় থাকতে অরিন্দম ওর চেয়ে বিশি বয়সের বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর কিছুটা-খোলা হৃদয়ের গবাক্ষের নরম মাংসে করাঘাতের সাঁঝবিহান সম্পর্ক গড়ে তুলতে-তুলতে পাগল হয়ে চিকিৎসাধীন ছিল। পাড়াতুতো দিদিটার বর টাকা জমাবার ধান্দায় নিত্যিদিন ট্যুরে।
কলকাতায় এসে ক্যানসারে এক-স্তন তুলি জোয়ারদারকে বিয়ে করার প্রস্তাবে, অরিন্দমের মায়ের, কিন্তু-কিন্তু বলতে যা বোঝায়, সে দুশ্চিন্তা ছিল। ছেলেটার আবার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে আধখ্যাঁচড়া মেয়ের পাল্লায়। তবু, অন্য কাউকে না করলে ওকেই করুক, কাউকে করুক, স্হির হোক জীবন। তুলি এগিয়ে এসে পিছিয়ে গিয়েছে, কেননা মৃত্যুর আহ্বান বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, উচিত সময়ে লজ্জাবশত চিকিৎসা না করাবার দরুণ। ছোটো ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে বলে বড়ো ভায়ের মা এখন যাহোক একটা বউ চায়। এজাত বেজাত কালো ধলা কানা খোঁড়া মুখু বিধবা বর-পালানো বাচ্চাসুদ্দু যাকেই চাস আমি বাড়ির বউ করে আনব, গত দশ বছরে মা ওকে একা পেলেই বলেছে। কয়েকজন ঘটককেও বলে রেখেছে মা, যোটক-ফোটক কিচ্ছু চাই না, এককাপড়ে হলেও চলবে। ঘটকরা প্রতিদিন একজন-দুজন বিবাহযোগ্যাকে এনে ছুতোনাতায় বসিয়ে দিয়েছে ওর চেয়ারের সামনে, অফিসে এনে। ওফ, কী কেলেংকারি। চলকে ওঠার মতন নয়কো তারা কেউ। মেয়েগুলোরও অমন ডেসপারেট অবস্হা? অপমান সহ্য করেও একটি মেয়ের একজন স্বামী চাই। মেজোবউদি এক্ষুনি প্রতিশোধ নিল এগারো বছর আগে ওনার ছোটো বোনকে প্রশ্রয় দেয়নি বলে।
আবার মেজবউদির খচানে উক্তি : মেয়েটা কোন জাতের রে? কুলিকামিন? নাকি?
বড়দা সর্বাধিক চুর। বুড়ো আঙুলে সুতো-ছেঁড়া পৈতে জড়িয়ে তরলীকরণের সরলীকরণ করে। এতঃ ন শুদ্রং ব্রাহ্মণাদি জাতি বিশেষং ভবতি সিদ্ধং, সর্বে লোকা একজাতি নিবদ্ধাশ্চ সহজ মেবিতি ভবঃ।
মোনতোর-টোনতোর নিয়েচেন নাকি বড়দা? আমাকে জানাতেন যদি তো আমিও নিতুম। বড্ডো অশান্ত থাকে মনটা। কার মোনতোর? অনুকুল ঠাকুর না রামঠাকুর? অ্যাঁ? নাকি বাবা লোকনাথ? বালক ব্রহ্মচারীর জপ শুনিচি বেশ কাজে দ্যায়। বড়ো জামায়ের কন্ঠে অকৃত্রিম আপশোশ।
সেজো বউদি : আরে বামুনরা আবার মোনতোর নেয় নাকি? ওসব কায়েত সুদদুরদের ব্যাপার। বামুনদের তো গায়িৎরি মনতোর আচেই। তাই-ই জপ করুন না দুবেলা মন দিয়ে।
বড়ো জামাই : অঅঅঅঅ।
অরিন্দম ভাবছিল, জোয়ারদার কোনো জাত হয়? কেটলিউলি কোন জাত? জাতিপ্রথার জন্মের সময়ে তো চা খাবার ব্যাপার ছিল না। দেখতে কেমন? নাম কী? কোথায় থাকে? একদিন গেলে হয় মহাকরণে। কিন্তু সেখানে তো অনেক কেটলিউলি আছে। চিনতে পারবে নিশ্চই ও। চলকে ওঠা থেকে ঠিক টের পেয়ে যাবে।
প্রধানশিক্ষিকা নিজের পুরো সুরাসক্ত ওজন ঢেলে রেখেছিল অরিন্দমের ওপর।
বড়দি, তোমার ব্লাউজের বোতাম খুলে অরির ঘাড়টা এবার সোজা হতে দাও। মেজোবউদির কথায় অরিন্দম ছাড়া পায়।
আগে লোকে সমাজের চাপে বাড়ির বাইরে মদ খেত। এখন সমাজের ভয়ে বাড়ির মধ্যে বাড়িসুদ্দু সবাই খায়। তার কারণ আগে সমাজ বলতে যা বোঝাত তা আর নেই। সবাই সবাইকে ভয় পায় আজকাল। অন্যে কী করছে-করবে সবাই আঁচ করে টের পায়। কেউ বিশ্বাস করে না অথচ গালভরা কথা বলে। আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি। কোনো বিশেষ তীর্থ নেই। কত গোঁড়া ছিল এই বাড়িটা, পিসিমা-পিসেমশায় বেঁচে থাকতে। মুরগির মাংস তো নিষিদ্ধ ছিলই, মুরগির ডিমেরও বাড়িতে প্রবেশাধিকার ছিল না। খেতে বসে গণ্ডুষ না করা অপরাধ ছিল।
পিসেমশায়ের বাস্তুভিটে ছিল হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের ফুলতলা গ্রামে। সেসব ছেড়েছুড়ে বেচেবুচে এখন শ্যাওড়াফুলিতে। এই বাড়িটায় অরিন্দম যখন শেষ এসেছিল, টালির চালের দুটো মাত্র ঘর ছিল, সামনে-পেছনে ফুলের উচ্ছৃঙ্খল জঙ্গল। বলাগড়ের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিল, মনে আছে। পিসেমশায় টাকমাথা, মোটা কাঁচের ভারিক্কি চশমা।
ফুলতলার বসতবাড়ি, ভাগচাষ দেওয়া জমিজিরেত, সব ভেঙে-ভেঙে বিস্কুটের টুকরোর মতন তারিয়ে খেয়ে ফেলেছে গঙ্গা। কলকারখানার ফেনানো পাঁক আর পূণ্যার্থীর গু-মুত, গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে, বাঁকবদল ঘটেছিল নদীর।
মাঝরাতে, চাঁদনি আলোর অগোচরে, কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে, গ্রামবাসীদের চোখের সামনে, ডাঙাজমিন, ভরাখেত, কুরেকুরে শেষ করেছে নদীটা। অরিন্দম গিয়েছিল স্কুলে পড়ার সময়। গঙ্গা বয়ে গেছে জিরাট, শ্রীপুর-বলাগড়, চরকৃষ্ণবাটি, গুপ্তিপাড়া, সোমড়া, খামারগাছি আর ডুমুরদহ-নিত্যানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর দিয়ে।
সুলতাপুর, গুপ্তিপাড়া, রিফিউজিবাজার, ভরপাড়া, বেনালি, চররামপুর, গোঁসাইডাঙা, রসুলপুর, সুন্দরপুর, চাঁদরা, ভবানীপুর, চরখয়রামারি, রুবেশপুর, রামনগর গ্রামগুলোর অনেক ঘরদালান, রাস্তাঘাট, দেউড়িদেউল, দোকানবাজার, ইশকুল, শিবের থান, মেটে মসজিদ, ফকিরের কবর, রঙেশ্বরীর একচুড়ো গর্ভগৃহ, তিনফসলি জমি, সব সঅঅঅঅব, গিলেছে গঙ্গা।
ইঁট আর শালবল্লা পুঁতে থামানো যায়নি নদীটার বেয়াড়াপনা। সেসব ইঁট-কাঠ নিজেদের বসতকে অহেতুক ঠেকনো দিতে যে যার তুলে নিয়ে গেছে। কারোর চেষ্টাই টেকেনি বেশিদিন। বাঁধাগাছি আর পালপাড়ার বামুনরা শ্যাওড়াফুলিতে চলে যাচ্ছে খবর পেয়ে পিসেমশায়ও কিনেছিল চারকাঠা জমি। ছেলেরা নিজেদের অবস্হামতন খুপরি তুলেছে।
এই ঘরটা সর্বজনীন।
ফুলতলায় থাকতে আলতাপাতার ব্যবসা ছিল পিসেমশায়ের। ওনার বাবার আরম্ভ করা ব্যবসা। অনেক ঘর রংবেনে মণিবণিক ছিল তল্লাটে। লাক্ষা গালা আলতার কাজ করত। রাসায়নিক আলতা বেরোবার পর দুবেলা দুমুঠোর ওপর চোট সামলাতে রংবণিকরা স্যাকরার কাজ ধরে একে-একে চলে গেল সুরাট, মুম্বাই, বাঙ্গালোর, কিংবা ঘড়িকোম্পানির জহুরি হয়ে গেল।
পিসেমশায় রংবেনেদের কুলদেবতা রঙেশ্বরীদেবীর পার্টটাইম সেবাইত হয়ে চালিয়েছিল কিছুদিন। আজকে দেয়ালের খুঁতখুঁতে টিউবলাইটের তলায় ফ্যাকাসে রঙেশ্বরীদেবীর উদাসীন দৃষ্টিবলয়ে বসে নোংরা-নোংরা মোদো চুটকি চলছে।
তোমরা কেউ আলতা পরো না? বলে ফেলেছিল অরিন্দম।
অ্যাই ছুটকি, তোর কাছে আলতা আছে তো? নিয়ায়, নিয়ায়, শিগগিরি আন দিকিনি। ফ্লোর লিডার মেজবউদির গম্ভীর অনুচ্চস্বর আদেশে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় ছোটো বউ, এক রাশ চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। অত চুল দেখে হঠাৎ ভয় করে ওঠে অরিন্দমের। অবাক হয় নিজেই। আজগে অরি আমাদের সবাইকে আলতা পরাবে। মেজবউদির দ্বিতীয় আদেশে ধাতস্হ হয়।
ছুটকি দেয়াল, দরোজার কপাট, জানলার গ্রিল, বাকসোর থাক ধরে-ধরে নিজেকে সামলে ঘর থেকে বেরোয়, আর ফিরে আসে বাঁ হাতে আলতার শিশি, তুলোকাঠি আর ছোট্ট কাঁসার বাটি নিয়ে। যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই মাতাল দেহবল্লরীকে সামাল দিয়ে। অরিন্দমের পাশে বসে। শাড়ি সামান্য তুলে পা বাড়িয়ে নিভৃত আবদার, আগে আমাকে পরাও। আলতাটা আমার বিয়ের, ক’বছর যাবত পড়ে আছে। সময়ই হয় না। প্রফেসারির ঝকমারি, একটা তো মোটে রোব্বার, শাড়ি কেচে ইসতিরি করতেই সময় চলে যায়।
ছুটকির বাঁ পা কোলের ওপর তুলে নিয়েছে অরিন্দম। প্রায় নিঃশব্দে বউটি বলে, তাড়াহুড়ো কোরো না, রয়ে-সয়ে সময় নিয়ে ভালো করে পরাও। অরিন্দম গলা নাবিয়ে বলল, তাহলে নেলকাটার আনো, নখ অনেক বেড়ে গেছে। নখ পালিশ লাগাও না বুঝি? ছুটকি ঝটিতি উঠে দাঁড়াতে, মদ টলমল করে ওঠে ওর দেহ জুড়ে, বাতাসের ওপর দিয়ে হেঁটে নেলকাটার আর নখপালিশ আনে। কোলের ওপর পা তুলে নিয়ে অরিন্দম টের পায়, পা ধুয়ে মুছে এসেছে, আগের চে ঠাণ্ডা।
মেয়েদের পা অপরিমেয় শ্রদ্ধার। তোমার পায়ে ছন্দ লেগে আছে। নখকাটার কুটকাট শব্দের চে আস্তে বলল অরিন্দম।
ছন্দ? কী ছন্দ?
অরিন্দম বিপাকে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ভাষাটা মন দিয়ে পড়েনি। দ্রুত মনে করার চেষ্টা করেবলল, মুক্তক।
যাঃ। ও তো বাংলা।
হলেই বা। এই তো গোড়ালিতে তিল হয়ে লেগে রয়েছে অনুষ্টুপ।
আবার সেই। না না। আমার পায়ে আছে আয়ামবাস, এই দ্যাখো, ট্রোকি।
ওওওওওহ। ইংরেজি। ইংরেজি পড়াও।
হ্যাঁ। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলুম। ব্লেকের ম্যারেজ অব হেভেন অ্যান্ড হেল মুখস্ত। বলো তো এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যাণ্ড শোনাতে পারি, আমাদের লাইফ তো ওয়েস্ট ল্যাণ্ড।
বুঝেছি। অমন বিয়েই করেছ। এখন তো আর কিছু করার নেই।
কে বললে? সাহস থাকলে ভাসুরের কোলে পা তুলে সবায়ের সামনে বসা যায়। সাহস থাকলে, মরনিং আফটার ওষুধের জোরে, অনেক কিছু করা যায়। কটা বউ পারে? তুমি তৈরি তো? আমি তৈরি, ফেলে পালিও না, আমি কাউকে ভয় পাই না, ছাত্রদের সঙ্গেও প্রেম করি। ছাত্ররা আমার গাড়ির বনেটে লিখে রাখে ‘আই লাভ ইউ’।
এখন তুমি মাতাল। মাতাল গৃহবধু। কী বলছ, না বলছ, তার হুঁশ নেই।
মাতাল? ঠিকাছে, আমি না হয় মাতাল। তোমার তো হুঁশ আছে। মুক্তক আর অনুষ্টুপ ছন্দে ঠোঁট রাখতে পারো? ছন্দ তো শুধু চরণেই থাকে না। থাকে সবখানে। ভালো করে চোখ মেলে দ্যাখো। বউটি ঠোঁট এগিয়ে দিলে ভয় করে ওঠে অরিন্দমের।
বড়োবউদি কাৎ হয়ে শুয়ে পড়েছিল। ওদের দিকে পাশ ফেরে। তোদের গুজগুজ ফিসফিস সঅঅঅব শুনতে পাচ্ছি আমি। অরিকে চেনো না। চুপচাপ জাল বিছিয়ে দেবে, টেরটি পাবে না। ভয়ংকর চিজ। অ্যাগবারে কাপালিক। ছু-মন্তর এড়াতে পারবি না। মাতন লেগে যাবে।
ছুটকি বড়োবউদিকে, তুমি তো ওর জালে ছিলে এতক্ষুণ, মাইতে চেপটে ধরেছিলে ওকে। এবার আমি না হয় থাকি। কাল থেকে তো আবার জাঁতা পেষা। তারপর অরিন্দমকে, কই দেখালে না কী রকম তোমার হুঁশ। আমি একজন স্বঘোষিত আদেখলে, কাওয়ার্ড, চুমু খাবার সাহস পর্যন্ত নেই।
শব্দবধির হওয়া সত্ত্বেও, সাপ যেভাবে তার চোয়ালের মাধ্যমে জমির সূক্ষ্ম স্পন্দন অনুভব করতে পারে, অনুভব করে শিকারের উষ্ণতার সংবাদ পায়, সেই গোপন অনুভুতি নিয়ে, বেশ যত্নে, নখপালিশ লাগায় আর আলতা পরায় অরিন্দম। এত কাছ থেকে, এভাবে কোনো যুবতীর কেবল পাটুকু এর আগে খুঁটিয়ে দেখেনি অরিন্দম। মুখ নিচু, ঠোঁটে ধূর্ত হাসি, ছুটকির চোরাস্রোত-চাউনি অরিন্দমের উদ্দেশে।
ফিসফিস কন্ঠে অরিন্দম বলল, বেশ কয়েক বছর মদ খাচ্ছ তাহলে, অধ্যাপিকা?
মাথা নাড়ে ছুটকি, হ্যাঁ, এট্টুখানি, নমাসে-ছমাসে, ভাললাগে, এটারচে কোকাকোলার সঙ্গে রাম ভাল্লাগে, কিন্তু বড়ো আর সেজোর যে শুগার। স্নায়ুসুখে আপ্যায়িত দেহকে পাশ ফিরিয়ে, বাঁ পা নাবিয়ে, ডান পা অরিন্দমের কোলে তুলে দিলে ছুটকি।
তোমার জামায় মদ, প্যান্টে আলতা, বাড়ি যাবে কী করে?
এমনি করেই। আমার তো পায়ে কবকব নেই, ছন্দ নেই, লোকলজ্জার ভয় নেই।
শুধুই বকবক। পথিক তুমি পথ হারাইতে ভুলিয়া গেছ। যাও, গিয়া দেয়ালে পোস্টার সাঁটো, ইনক্লাব জিন্দাবাদ করো, কিন্তু প্রেমাপ্রেমি কোরো না।
হুঁ।
রেখেছ বাঙালি করে, পুরুষ করোনি, পথিক তোমার টেসটোসটেরন নাই ।
হুঁ।
আচমকা ওপরতলা থেকে বিলিতি বাজনার তারস্বর আসে।
ওপরেও ঘর আছে বুঝি? জানতে চায় অরিন্দম, স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে। আগেরবার যখন এসেছিল তখন ছিল না ওপরতলায় কোনো ঘর। ফাঁকা ছাদ ছিল। আলসেতে গোলাপফুলের টব।
এইটে যেমন আমাদের কমনরুম, ওপরেরটা বাচ্চাদের। ছাদের ওপর ওই একটাই ঘর। একটু থেমে, ছুটকি বলে, অরিভাসুর, প্রেম না থাকলে প্রাণটা বড্ডো খাঁ-খাঁ করে, না গো? তোমার প্রেমের গল্প অনেক শুনেছি। প্রেম ছাড়া তুমি অসুস্হ হয়ে পড়ো, শুনেছি। তোমাকে আমার হিংসে হয়। জানাই হল না প্রেমে পাগল হওয়া কাকে বলে। তোমার মতন আমিও প্রেমে পাগল হয়ে যেতে চাই, বদ্ধ উন্মাদিনী।
ছুটকির পর গরমমশলার গন্ধের মতন স্বাস্হ্যবতী, ভূমিসংস্কার দপ্তরের করণিক সেজো বউদি এগিয়ে আসে পাছা ঘষে। হাঁটুর ওপর ওব্দি সাড়ি উঠিয়ে মেদনরম পা জোড়া তুলে দিলে অরিন্দমের কোলে। নে, সেবাযত্ন কর। শাড়ির পাড়ে আঁকা ফুলের গোছা ধরে পা ওব্দি নামিয়ে এনে অরিন্দম বলল, অমন কোরো না, এখুনও অটুট আছ তুমি ; উলটে মাঝখান থেকে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
শুনে, আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কেঁপে-কেঁপে হাসে সেজো বউদি। বলল, আমার পায়ের ওপর রাজহাঁস এঁকে দে, ছোটোবেলায় ঠাকমা একবার এঁকে দিসলো, আমি তখন পানিশ্যাওলার ইসকুলে পড়তুম। তারপর তো বাবা বদ্যিবাটিতে চলে এলো।
প্রতিদিন সবাই মিলে কলকাতা ঠ্যাঙাও, ওদিকেই ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনে নাও না কেন?
কীইইই যে বলিস। এখেনে একসঙ্গে আছি সবাই, বিপদে-আপদে দেখি। এরম তো বসা হবে না আজগের মতন। কলকাতায় সবাইকে আলাদা-আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে হবে, পুকুর-বাগান থাকবে না, দম বন্ধ হয়ে যাবে।
অ্যাই, অরিকে আমাদের বাড়ির জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা দিয়ে দিস। থালে ফি-মাসে আসতে পারবে। ছুটকির ঠেঙে নিয়ে নিস অরি।
মনে পড়ে গেল, অরি, বাড়ি ফেরার আগে কালকে আমার আয়কর রিটার্নটা ভরে দিস। মদঘুমের জগতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে বড়োবউদির আদেশ। শতরঞ্চিতে মেদবহুল গতর এলিয়ে কৃতবিদ্য প্রধানশিক্ষিকা। অজস্র ছাত্রীর প্রণাম সংগ্রহকারী পদযুগল। শোয়া অবস্হাতেই মাতাল চরণে আলতা পরায় অরিন্দম। গোড়ালি ফাটা। নখ বড়ো হয়ে গেছে। বাড়িটার জীবননাট্যে বোধয় পারস্পরিক যত্নের সময় নেই। সবাই মগ্ন জীবিকায় আর ফাঁক পেলেই এক চিলতে যৌথ সীমালঙ্ঘনের মৌতাত।
তর্জনীতে গণ্ডারের শিঙের আংটি, ছোটো জামাই বলল, যেন মদের বুদবুদ ফেটে স্মৃতি ফিরে পেয়েছে, বলল, সেনসেক্স চারশো পয়েন্ট উঠেছে, বড়দা, তেমন-তেমন স্ক্রিপস থাকলে এই বেলা ঝেড়ে দাও।
একে-একে বউদের, তারপর দুই ধুমড়ি বোনের নখ কাটে অরিন্দম, নখপালিশ লাগায়, আর আলতা পরিয়ে দেয়।
ওদের পরানো শেষ হতে বড়দা আচমকা এগিয়ে দিয়েছে নিত্যযাত্রীর ট্রেনে ওঠায় রপ্ত হাড়প্যাংলা ঠ্যাং, শিরাপাকানো, যেভাবে পুরোনো শ্যাওলাধরা মন্দিরকে দুমড়ে জড়িয়ে থাকে অশ্বথ্থ গাছের শেকড়। অরি, আমাকেও লাগিয়ে দে দিকিনি, ভাবিসনে যে মাতাল হয়ে গেচি, আপিসে তো বুট জুতো পরে যাই। অরিন্দম তাকায় বাদামি কুয়াশামোড়া নতোদর প্রৌঢ়ের মুখের পানে। পুরসভার স্বাধিকারপ্রমত্ত অ্যাসেসমেন্ট ইন্সপেক্টর। বাঙালির, পশ্চিমবাংলার বাঙালির, স্বাধীনতা-উত্তর খাঁটি প্রতিনিধি। ছেলে মণিপুরে মোইরাঙে পোস্টেড। মোটা টাকা দিয়ে মণিপুর রেভলিউশানারি পিপলস ফ্রন্টের কাছ থেকে ইমিগ্র্যান্ট পারমিট নিতে হয়েছিল থাকার জন্যে। কালকে বিপ্লবীরা ওকে বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিয়েছে মোইরাঙ ছাড়ার জন্যে, উদ্বিগ্ন মুখে বললেন বড়দা। অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভের ভালো সরকারি চাকরি ছেড়ে ফিরে চলে আসছে।
শত্রুতা না বাড়ালে বিপ্লব সফল হয় না। বিপ্লব ছাড়া বিদেশি অস্ত্র কারখানা লাভে চলবে না।
বড়দার একপায়ে কাস্তে-হাতুড়ি, আরেক পায়ে পদ্মফুল আঁকে অরিন্দম।
ছাদের ঘর থেকে আরেকবার ষাঁড়াষাঁড়ি ডেসিবল আচমকা এঘরের মদ সিগারেট মাংস মাছ চানাচুর ডিমসেদ্ধর মাথাভার বাতাসে কুচি-কুচি আছড়ে পড়তে, ছাদে যাবার সিঁড়িতে ওঠে অরিন্দম। এঘরে আর কেউ কথা কইবার অবস্হায় নেই।
প্রশস্ত ছাদ। টবের গাছে ছোটো-ছোটো ফুলকপি ক্যাপসিকাম লংকা। আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে। অরিন্দমের মনে হল, অজানা কোনও কিছুর জন্যে ওর মর্মমূল ধ্বনিত হচ্ছে। ছন্দের বোধহয় নিজস্ব ধর্ম হয়। চৈতন্যের পায়ে ছিল একরকম, রামকৃষ্ণের আরেকরকম। বুদ্ধের ছিল। যিশুখ্রিস্টের ছিল। কেটলিউলির আছে কি? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আছে, থাকতেই হবে।
.
১২.
ছাদের ঘরের দিকে ছাইরঙের দরোজা ঠেলে অরিন্দম দেখল, কুচোকাঁচা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাশেষ ছেলেমেয়ের দল, যে যার মতন নেচে যাচ্ছে, হাত তুলে কোমর বেঁকিয়ে। একজন ফ্রক উড়িয়ে শাস্ত্রীয় নাচের অঙ্গভঙ্গী করছে ইউরোপীয় বাজনার তালেতালে, বোধয় শাস্ত্রীয় ভারতীয় নাচ শেখে, কুচিপুড়ি ভারতনাট্যম কোনো-একটা হবে।
ঘরে ঢুকতেই অরিন্দমকে ঘিরে ধরে সবাই। বড়দা-মেজদার মেয়ে দুটো অরিন্দমের হাত ধরে অরিকাকু অরিকাকু বলে হাঁক পাড়ে। এদের দুজনকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না অরিন্দম। কেউ গিয়ে বাজনা বন্ধ করে। জামায় তীব্র হুইস্কির গন্ধ আর প্যান্টময় খাপচা লাল রং যে এরা কেউই অনুমোদন করছে না, ভুরু কোঁচকানো অনুসন্ধিৎসা দেখে আঁচ করে অরিন্দম।
অরিন্দম বলল, যেন বাবা-মায়ের কাছে মার্জনা চাইছে, খাইনি আমি, বমি পায়, ওদের গেলাস থেকে চলকে পড়েছে। এই কচিকাঁচাদের কাছে নিজের দুর্বলতা মেলে ধরে কিছুটা ভারমুক্ত বোধ করল অরিন্দম। বয়সের সাহায্যে নিচের তলায় আর ওপর তলায় আনন্দের মুহূর্ত গড়ে নিয়েছে এই বাড়ির সদস্যেরা। ওই বা কেন যে বঞ্চিত হয় আনন্দের পরিসর থেকে! কেন যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না!
বালক-বালিকাদের মাঝে ভালো লাগে ওর, অরিন্দমের। আশ্বস্ত বোধ করে। পাটনায়, অফিসের লাঞ্চটাইমে পাশের নার্সারি স্কুলের ছুটি হত। ছোটো-ছোটো খোকা-খুকুর ছুটির হইচইয়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত অরিন্দম, দাঁড়িয়ে থাকত বেশ কিছুক্ষণ। চারিদিকে অজস্র কচি ছেলেমেয়ের ছোটাছুটি আর কোলাহলের মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত ও। পুজো আর গ্রীষ্মে যখন ইশকুলটা বন্ধ থাকত তখন মন খারাপ লাগত অরিন্দমের।
এখানে, কলকাতায় বি-বা-দী বাগে ওর অফিসের কাছে ইশকুল নেই। এই অফিস পাড়াটায় বালক-বালিকাদের প্রবেশাধিকার নেই। আজ পর্যন্ত কোনও ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের এই এলাকায় দেখতে পায়নি ও, অরিন্দম।
ওর সামনে অনুসন্ধিৎসু ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে বুঝতে পারছিল অরিন্দম, ওকে বিশ্বাস করছে না এরা। শিশু কিশোর তরুণদের চোখে এখন আগের প্রজন্ম সন্দেহজনক। জনকেরা সন্দেহজনক।
মেজদার বড়ো মেয়ে এই ফাঁকে বাবার জামা-প্যান্ট এনে দিয়েছে। যাও, নিচে বাথরুমে চান করে পাউডার মেখে পালটে এসো, গিজার আছে।
চান করে, জামা-প্যান্ট পালটে এসে বসলে, কাছে এসে মুখ থেকে গন্ধ শুঁকে আশ্বস্ত করে নিজেদের, শাড়ি-পরা উচ্চ-মাধ্যমিক, চুড়িদার মাধ্যমিক। এদের মধ্যে সবচে ছোটোটা, তুলতুলে বছর তিনেকের, পায়ে রুপোর মল, বিস্ফারিত তাকায়। কোলে চাপতে চাইছে। তুলে নিলে, কাঁধে মাথা রাখে। ঘুমের গন্ধ আসছে শিশুটির মুখ থেকে। কত ভালো লাগে এই গন্ধ।
তোদের খাওয়া হয়েছে তো?
সমস্বরে, হ্যাঁ আ্য আ্য আ্য আ্য আ্য, সন্ধেতেই। আজ তো ভুরিভোজ ছিল।
জানলা দিয়ে দেখা যায়, বাতিস্তম্ভের আলোয়, বাড়ির পেছনের থমথমে পানাপুকুর। একগাল হাসিমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে ঝাঁকড়া স্হলপদ্ম। পুকুরের দক্ষিণে বৈদগ্ধ্যে ভারাক্রান্ত আমগাছ, স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে থাকবে, ফলহীন।
পুকুরের এদিকে জানলার তলায়, গোলাপ ঝাড় দুহাত তুলে খরচ করছে মোলায়েম সুগন্ধ। গাছগুলোর পাতাকে ফুঁ দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে অন্ধকার। লাস্যময়ী বাদলাপোকারা ঘরে ঢুকেই, ডানার ওড়না ফেলে দিচ্ছে পার্ক হোটেলের ক্যাটওয়াকে মডেলখুকিদের ঢঙে। অন্ধকারে তিরতির কাঁপা কৃষ্ণপক্ষের কনকনে আকাশে ভিজেভিজে বিদ্যুতের শব্দহীন আলো। কোনও প্রতিবেশির বাড়িতে উদাত্তকন্ঠ অ্যালসেশিয়ানের রোমশ ডাকের তরঙ্গ।
পাঁচ-সাত বছরের গালে-টোল ফরসা দুঝুঁটি এগিয়ে আসে। তুমি কে গো ও ও ও?
আমি? আমি হ্যামেলিনের কেটলিওলা। অরিন্দম কথাটা বলেই থ। এখনও তো কেটলিউলি অদেখা। তবে?
তুমি বাঁশি বাজাতে জানো?
বাঁশি? উঁহু, জানি না।
তবে কেটলড্রাম বাজাও?
না, তাও জানি না।
লিটলুটা ঘুমিয়ে পড়েছে কেটলিকাকুর কোলে ; টুম্পা ওকে শুইয়ে দিয়ায়। আলো জ্বেলে মশারি টাঙিয়ে দিস। পিগটেল ফ্রকপরার হুকুম মান্য করে ববছাঁট ফ্রকপরা।
কেটলিকাকু, তুমি গান জানো? জানতে চায় ক্লাস নাইনের পরীক্ষামুক্ত কিশোর।
গান? মমমমমমম, ভেবে দেখি।
গানের কিছুই জানে না অরিন্দম। কী করে লোকে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্র নজরুলের গানের সুরের তফাত বোঝে, ঠাহর করতে পারে না ও, পারেনি। গানের আলোচনায় কুন্ঠিত বোধ করে। ওর সামনের ফ্ল্যাটে লরেটোতে পাঠরতা কিশোরী তিনচারটে গান কতকাল যাবৎ সেধে যাচ্ছে, সকালের আলো ফুটলেই, অবিরাম। শুনে-শুনে সুর আবছা মুখস্হ হয়ে গেছে অরিন্দমের। খোকাখুকু শ্রোতার মাঝে চেষ্টা করা যেতে পারে। শ্রোতাদের সামনে নিজেকে গান শোনানোর ভালই সুযোগ। শ্রোতারা যখুন অত্যুৎসাহী।
কই গাও।
গাইছি।
মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কল্লে না যে। ঠাকুর পাপ দেবে। গাইবার আগে, নাচবার আগে, পড়তে বসে, মা রঙেশ্বরীকে হাত জোড় কত্তে হয়। বিদেশী বাজনার তালে স্বদেশী নাচছিল যে কিশোরী, তার উপদেশ।
অরিন্দম চোখ বুজে হাতজোড় করেছে। মগজের মধ্যে একাগ্র ভগবদভক্তি কী করে জোটায় কেউ-কেউ? ব্যাপারটা ঠিক কী? কোন উপায়ে অমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘটে! আমি কেন ওই বোধ থেকে বঞ্চিত?
জীবনে প্রথমবার ও, অরিন্দম, সিরিয়াসলি গান ধরে :
II { স..সপা…T পা…পধা…ধপহ্ম-T হ্ম…হ্মা…গসাঃ… I সগঃ…সপা…TI
সাঁ….ঝে০….রপা….খি….রা০০…০…ফি…রি…ল০….০কু…লা০…য়
I গহ্ম…ক্ষণা…নর্সা…ধনা…পাঃ I পহ্মগঃ…হ্মপা-T – T গমাগমা…গরসা }I
তু০…মি০…ফি০…রি০…লে০…না ০০০ ঘরে ০ ০ ০০০০ ০০০
I প…পনা—TI না….সর্ণা….র্সর্সনধা I ধনা…পধর্নারা…র্সনধা I ধনা…ধপা–TI
আঁ….ধা০….র…ভ…ব০….০০০ন…জ্ব০…লে০০০…নি০০…প্র০…দী০…প
I সা….রা….রা….I রা…গহ্মপধা….গহ্ম I – T হ্মপা- TI গমা…গগা…রসা I
ম…ন…যে…কে…ম০০০…০ন….০করে…০….০০…০০…০০
ভুল ভুল ভুল ভুল, জানোওওওওনা, হলোওওওনা। হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শাড়িপরা উচ্চমাধ্যমিক।
অরিন্দম স্তম্ভিত। ঠাহর করতে পারে না গানের হওয়া না হওয়া। অথচ গাইতে-গাইতে বিভোর আত্ম্রপ্রীতিতে আক্রান্ত হয়েছিল। কোকিল যেভাবে কাককে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, ও-ও নিজেকে ফুসলিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল অচেনা আনন্দের পরিসরে।
হ্যাঁ, তুই বড়ো কুমার শানুর মা এসচিস। মাধ্যমিক অরিন্দমের পক্ষে।
তুমি তো মিশ্র ইমনে গাইছিলে। গানটা তো নজরুলের, মিশ্র মল্লারে হবে।
তুই গেয়ে শোনা দেখি। মাধ্যমিক চ্যালেঞ্জ জানায়।
উচ্চমাধ্যমিক বসে পড়ে মেঝেতে। চোখ বোজে। কোলে হাত। প্রথমে গুনগুন। তারপর গান ধরে।
II { সামরা মা I পা ধা ণা I ণা ধপা মপধাঃ I পঃ মজ্ঞা রসা I
সাঁ ঝে০ রাপা খিরা ফি রি০ ল০০০ কু লা০ ০য়
I সসরজ্ঞারা I সা ণা ধ পা I পনা নাসা Iসা সা র্সা }
তু মি০০ফি রিলে নাঘ ০ ০ রে ০ ০
I মা মরা মা I মপাপাধ মপাঃ I মঃ পা সর্ণা I ধা পা পা I
আঁ ধা০ রভ ব ন জ্ব লে নি প্র দী প
I পধা পধাপমা I গা মগা রসাণ I না সা গা Iরগা মা মা I
মা০ ০ন যেকে ম০ ০ন ক রে০ ০০ ০ ০
কেটলিকাকু, আমিও গান জানি। নাদুস কিশোরের প্রস্তাব।
গাও তাহলে, শুনি।
আমমি চিন্নিগো চিন্নি তোমাআআড়ে ওগ্গো বিদেশিন্নি, তুমি থাআআআকো শিনধু পাআআআড়ে….
অরিন্দমের হাসি পেয়ে যায়। দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকাদের কী সর্বব্যাপী প্রভাব। অত্যন্ত জোরে হেসে ফ্যালে ও, কিশোরটিকে জড়িয়ে ধরে। অট্টহাস্য। দিলখোলা হাসি। হাসতেই থাকে। এভাবে খোলামেলা হাসেনি বহুকাল। হাসতে-হাসতে ভালো লাগে ওর। ওর দেখাদেখি সবাই হাসতে থাকে। সব্বাই।
অতর্কিতে, বাইরে থেকে, বাঁদিকের বন্ধ জানলার ফুলকারি ঘষাকাচের শার্শির ওপর ভারি একটা ঢিল পড়তে, থমকে থেমে যায় হাসি। সবায়ের মুখমণ্ডলে আতঙ্কিত অনুসন্ধিৎসা। শার্শির ঠিক মাঝখানে, যেখানে ইঁটটা পড়ল, সেখানে ঘাপটি-মারা ছোট্টো মাকড়সাটা সেই মুহূর্তে, তক্ষুনি, কাচের বুক জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের আলোকিত তন্তুজাল, শার্শির ফ্রেমের কোণে-কোণে।
কে রে হারামজাদার বাচ্চা। গালাগালটা অরিন্দমের নিজেরই ভয় কাটাবার উপায় হিসাবে আরেকটু হলেই, এতগুলো কচিকাঁচা কিশোর-কিশোরীর সামনে বেরিয়ে যেত। ঠিক তখনই, খোলা জানলাটা দিয়ে, ওরা দেখতে পেল, হ্যালোজেনের আলোয়, মাছরাঙার ঢঙে ছোঁ মেরে, ছোটো-ছোটো অগুনতি সাদা বরফের ছররা, ঝেঁপে নামছে পানা-পুকুরের দাম সরিয়ে, মটকা-মেরে ঘুমোবার ভানরত কালবোস-কাতলার ওপর। জলতলের ওপরে লাফিয়ে উঠল কয়েকটা সোমথ্থ রুই।
সাদা বরফ টুকরোর টিমটিমে প্রভায় উদ্ভাসিত হয় খোকাখুকুদের কচি-তুলতুলে মুখগুলো। পৃথিবীর মাটিতে নামার আহ্লাদ-মাখানো শিলাবৃষ্টির খই খাবার নেমন্তন্নে, ছাদের দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে আগত টুকরো মুখে পোরে মিনি টিঙ্কু টুম্পা তাতাই বুবুন খোকন বাবাই টুঙ্কা হাবলু গাবলু।
অরিন্দম জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ফুঁ-এর মতন মুখময় বিচরণকারী আরামপ্রদ হাওয়ার আদর। গাছের পাতাদের গা শিরশির করছে ঠাণ্ডায়। বরফ-পাথরের টুকরো মেরে-মেরে ভ্যাপসা গরমকে তাড়িয়েছে বৃষ্টি। শিলাদের নাচের তাল ক্রমশ বিলম্বিত হয়ে থেমে যায়। বিদ্যুচ্চমকে, পুকুরের জলকে সর্পিল করল হেলে সাপ।
দুকানে দুহাত চাপা দিয়ে তাতাই বলে ওঠে, যাআআআআআ।
কেন? কী হল?
এবার আর হিমসাগর খাওয়া হবে না। সঅঅঅঅঅব ঝরে গেল।
.
১৩.
পেঁকো জলজমা তপসিয়া সেকেন্ড লেন, নানান মাপের আধোডোবা ইঁটের ওপর দিয়ে যিশুর পেছন-পেছন বস্তির একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল অপ্রস্তুত অরিন্দম, এ জায়গায় অন্য জুতো পরে আসা উচিত ছিল। ফুলপ্যান্টের গোড়া ভিজেছে নর্দমা-ওপচানো এঁদো গলির বিষাক্ত দুর্গন্ধ জলে।
ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে খালি-গা লেংটি-লুঙ্গি পরা কয়েকজন প্যাংলা মানুষ জমা জল খোঁচালেও, ঘূর্ণি খেয়ে নালির গু-গোলা জল উগরে উঠে গলির ভেতর সেঁদোচ্ছে।
সামলে-সামলে যেতে হবে, গোলাম জিলানি রোডে মসজিদে জল ঢোকা নিয়ে হ্যাঙ্গাম হয়েছে। আসার সময়ে হুঁশিয়ার করেছিল যিশু। খেয়াল করেনি তখন। হতদরিদ্র মুসলমান পাড়া। গলির বেহালে, অপুষ্টিতে লালিত লোকগুলোকে, আগত মহরমের পতাকা দেখে, ভয় করছিল অরিন্দমের। নাকে রুমাল চাপা দিলে হাসবে এরা। টিটকিরি মারবে। পেটের ভেতর ওব্দি ঢুকে পড়ছে দুর্গন্ধ। এমনকী রি-রি করছে, নোংরা জলের ওপর চলকে-পড়া রোদের গা। নর্দমাটা ডাকাবুকো।
বাসার সামনে টাঙানো বাঁশে ছাপা-শাড়ি, কালো শায়া, লাল ব্লাউজ, হাতাঅলা গেঞ্জি, সিড়িঙে ফুলপ্যান্ট শুকোচ্ছে। ডিজেল ড্রামের ঢাকনার ওপর হলদেটে রবারের পাকানো ক্লান্ত পাইপ। আলকাতরা-রাঙানো করুগেটেড টিনের দরোজার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে ঝুলমাখা টিউবলাইট। শালের কালো খুঁটিতে পেরেকে ঝোলানো আংটায় গাঁথা কাগজপত্র ; শিকেতে চালকুমড়ো। দেয়াল দেখা যাচ্ছে যেটুকু, কালচে কাঠের তাকে শিশি-বোতল-কৌটো-ডিবে। মেঝের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের বিশাল গামলা আর কয়েকটা তেল-চটচটে কালচে ট্রে।
খাইয়াঁ-খাইয়াঁ পেট ভরাবার মতলব রহেছেঁ, আঁ। গলা জড়াই ধরি মুহে চুম খালেক। তাঁয় উড়াই ফেল্লেক তামাম। মজাদারি পাহিছেঁক। আঁচতা ধাকালি দিবঁ একটা। মেয়েলি কন্ঠে বকুনি ঘরের মধ্যে।
সাদা কেঁদো বেড়াল বেরিয়ে, আধডোবা ইঁটের ওপর লাফিয়ে-লাফিয়ে ওদের পায়ের কাছ দিয়ে দৌড়োতে, অরিন্দমের ডান পা জলের মধ্যে পড়ে, নোংরা জল ঢুকে যায় জুতোয়।
এই কেটলি। হাঁক পাড়ার পর, অরিন্দমের দিকে ফিরে যিশুর আবেগহীন কন্ঠ, গতবছর জলের মধ্যে খোলা ম্যানহোলে একটা আড়াই বছরের মেয়ে পড়ে গিয়েছিলো। দমকলের লোক এসে, শেষকালে হুক নামিয়ে, বডি তুললে। ময়না তদন্ত হয়েছিল। তা এরা গরিব লোক, বুঝতেই পারছ, রিপোর্ট-ফিপোর্ট নিয়ে কীই বা করবে। হুক দিয়ে না তুলে কেউ নিচে নেমে চেষ্টা করলে বেঁচে যেত বোধহয়। কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে এতো বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে মানুষ যে সুযোগ পেলেই খপ করে ধরে নেবে পৃথিবী।
অরিন্দম ভয় পাচ্ছে দেখে যিশু কথাগুলো বলে গেল চিউইংগাম খাবার ঢঙে। তারপর অভ্যস্ত কাঁধ নাচিয়ে হাসে।
আড়হল্যা লাগ্যে নেঁও ; জলটো অধন হল্যে মেরায়েঁ দে। কথ্যভাষার মধ্যেকার জলতরঙ্গে অরিন্দম মুগ্ধ। বাঙালির জিভ থেকে এই সমস্ত স্হানিক বুলি ক্রমশ মুছে যাবে। হারিয়ে যাবে বাংলার মাটি থেকে। শহর গিলে খেয়ে নেবে বাংলা বুলিগুলোকেও।
আসছি কাকুদা, মোড়ে গিয়ে দাঁড়াও। খুকুস্বর তরুণী-কন্ঠের ভেতর থেকে আসা আশ্বাসে ভারমুক্ত হয়েছে অরিন্দম। কাকা আর দাদা মিলিয়ে নতুনতম এক সম্পর্ক পাতিয়েছে বটে মেয়েটা।
কাকুদা! বেশ লাগল শুনতে। কলকাতায় বেগুনউলিকে লোকে বলে মাসি, অথচ নিজের মাসিকে পাত্তা দেয় না। বাসযাত্রী বা পথচারীকে যুবকেরা বলে দাদু, কিন্তু নিজের দাদুকে দুমুঠো খেতে দেয় না। কলকাতায় শব্দের মধ্যে সম্পর্কগুলো আর নেই।
অতর্কিতে এক ঝলক ভ্যানিলা গন্ধের ঝাপটা। এই নোংরা পেঁকো দুর্গন্ধের সমুদ্রে কোথ্থেকে এই সুগন্ধ! যিশু বলল, কেটলির বাপ দিশি বিস্কুট আর কাপ-কেক বানায়, তারই গন্ধ। কেটলির পা-দুখানার দিকে তাকিয়ে দেখো তুমি, সদ্য ধানচারা রোয়া হাতের চেটোর মতন পরিষ্কার। ওই অ্যালুমিনিয়াম গামলাটা দেখলে তো? ওর মধ্যে পা দিয়ে কেক-বিস্কুট বানাবার ময়দা-টয়দা মাখে। পুজো করার যুগ্যি। ভারজিন মেরির মতন। সত্যি, কলকাতার রাস্তায় হাঁটাচলার পরও যে অমন পা থাকতে পারে কারোর, ধারণা ছিল না আগে। রাইটার্সে ভালোই বিক্রি হয় ওর কেক-বিস্কুট।
বাপরে! কলকাতায় এরকম গা-সওয়া জায়গা আছে জানতুম না। কী করে থাকে লোকে? প্রশ্ন তোলে অরিন্দম, উত্তর নেই জেনেও। ফেরার পথে টের পায় জমা জল বাড়ছে। প্রায় পুরো ডুবে গেছে ইঁটগুলো। অন্য জুতোটাও চপচপে জলে ঢুকে মোজা ভেজাচ্ছে।
গলি থেকে জলটা বেরোচ্ছে না-ই বা কেন? আবার প্রশ্ন তোলে অরিন্দম।
এখন তো অবস্হা তবু ভালো। বর্ষাকালে এলে দেখবে যতরকম প্রজাতি আর ভাষার মানুষ কলকাতায় আছে, এই গলিটা তাদের সব্বায়ের গুয়ের মিলনমেলা। এখানে আন্ত্রিকের টিশু কালচার হয়। কড়াইডাঙার চামড়া টাউনশিপের জন্যে এগারোশো একর নিচু জমি ভরাটের কাজ চলছে ডি ডাবলু খালের বুকে বাঁধ বেঁধে মাটি কাটার জন্যে। তুমি ওদিকটায় যাওনি বোধয়। এখন বেশ কিছুদিন বেরোবার উপায় নেই। জল বেরোচ্ছে না বলে বানতলার ভেড়িগুলো চোতমাসের গরমে ভেপসে উঠে মাছ মরছে। ভেড়িগুলো এখানকার নোংরা জল খাল থেকে টানে। এখন তো চারাপোনা ছাড়ার মরশুম।
ওফ, যিশু বিশ্বাস তো মগজের মধ্যে খবরের ব্যাংক বানিয়ে ফেলেছে। এর জন্যেও কনসালটেনসি পাবার তালে আছেন নাকি? প্রশংসা জানায় অরিন্দম।
নিজের যোগাড়-করা তথ্য ঝালাবার কাজ চালিয়ে যায় যিশু। বালিগঞ্জে, পামার বাজার, চৌবাগায় পাম্পং স্টেশানগুনো কলকাতার মাটির তলাকার নর্দমার জল ওই খালটায় পাঠায়। তিলজলার ট্যানারির চামড়াধোয়া জলও মেশে। অতএব বুঝতেই পাচ্ছ, এই গলির কলকাতা বহুকাল এই গলিতেই থাকবে। গুয়ের ভেনিস। সিগারেটের প্যাকেট সামান্য খুলে অরিন্দমের দিকে বাঁহাত বাড়িয়ে, ও তুমি তো খাও না।
তোমরাদের বললুম না মোড়ে গিয়া দাঁড়াও। একটু আগেই শ্রুত কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফেরে অরিন্দম। কালচে টেরাকোটা রঙের মেদুর-ত্বক স্বাস্হ্যবতী। কৈশোর আর যৌবনের সেই নিদারুণ সংযোগ-মুহূর্তে, যখন আজেবাজে চেহারাও হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। ভ্যানিলা-সুগন্ধের জেল্লা। নিজেকে হতবাক করার জন্য আরেকবার ফিরে চাইতে হয়।
অরিন্দমের এভাবে তাকাবার বাধ্যবাধকতাকে উপভোগ করছিল যিশু। এখানে আসার আগেই সতর্ক করেছিল যিশু, এ তোমার বিশুদ্ধ বাঙালি পাড়ার কলকেতিয়া লাফড়াউলি নয় যে দশবছর বয়েসেই দুলুর-দুলুর বুক নাচিয়ে ঘুরবে।
নর্দমার নোংরা জল-জমা গলিটার ঢোকার মুখেই, বিতৃষ্ণা, কুন্ঠা ও সার্বিক ভয় যখন ওকে পেড়ে ফেলতে চাইছিল, মনে-মনে মনে হয়েছিল অরিন্দমের, এই পেঁকো ছমছমে ঘুঁজির বাসায় ভালো কি সত্যিই থাকা সম্ভব, সৎ থাকা? অত্যন্ত ধনী আর ভীষণ গরিবের পক্ষে সৎ থাকা বেশ কঠিন। সেরকম সৎ-টাকাকড়ি রোজগার করে বাঁচা যায় কি এখানে, এই এঁদো এলাকায়? পরিচ্ছন্ন কোনো পাড়ায় চলে গেলেই তো হয়। মহাকরণে চা আর সস্তা বাটি-কেক বেচে দু-তিনজন লোকের কুলিয়ে যায় হয়তো।
এরকম একটা পাড়ায় থেকেও কেটলিউলির স্বাস্হ্য নিখুঁত, সূর্যকরোজ্জ্বল। হাত দুটো শ্রম-সুডোল। চকচকে ত্বকের স্নেহপরবশ মসৃণতায় পিছলে যায় অরিন্দমের মুগ্ধ দৃষ্টি। দ্রুত বেঁধে ফেলেছে ঘনকালো কমনীয়-উজ্জ্বল কোঁকড়াচুল হাতখোঁপা। প্রিন্টেড শাড়ির বেগনে-নীল-হলুদ কল্পরাজ্যের ফুলগুলো শাড়িটাকে সহজে নোংরা হতে দিতে চায় না বলে বেশ কিছুদিন সযত্নে না-কেচে চলে যায়।
মেয়েটা লম্বায় কত? পাঁচ ফিট? তাই হবে। যিশুর চেয়ে কয়েক ইঞ্চি বেঁটে। প্লাসটিকের স্ট্র্যাপবাঁধা বর্ষাকালের কালো জুতো, নোংরা জলে উঠছে-নামছে। জুতোর গোড়ালিটা নরম নিশ্চই, নইলে মহাকরণে হরেক ধরণের হাওয়ায় চেপে-থাকা রাজনীতিবিদ, আমলা, কেরানি, আর কৃপাপ্রার্থী নাগরিকদের সামনে দিয়ে কাঁচের গেলাস আর কেটলি হাতে গটগটিয়ে হাঁটলে তো বারান্দা থেকে ঠেলে বিনয়-বাদল-দীনেশের কাছে পাঠিয়ে দেবে আদিত্য বারিকের ভুঁড়ি-ভোম্বোল সহকর্মীরা, যারা বারান্দায় বসে সারাদিন হাই তোলে আর মুখের কাছে টুসকি বাজায়।
পা দুখানা সত্যই প্রতিভাদীপ্ত। সকাল-দুপুর সংগৃহীত প্রতিদিনের সূক্ষ্ম নোংরা সন্ধ্যাকালে চালান হয়ে যায় কেকগুলোয়। অরিন্দমের মগজে নির্বাক হইচই। প্রাকগ্রীষ্মেও মেয়েটা ঠান্ডা হাওয়ায় মোড়া। মেদহীন নারীত্ব বোধহয় হয় না। মোড়ে পৌঁছে, কলের মুখহীন সতত বহমান জলে, জুতোসুদ্দু পা এগিয়ে প্রথমে ডান তারপর বাঁ হাঁটু ওব্দি শাড়ি তুলে ধুয়ে নিল মেয়েটি নির্দ্বিধায়। বোঝা যায়, রোজকার, যেদিন মহাকরণ খোলা থাকে, অভ্যাস।
যিশু চাপা গলায়, কীইইইইরে, তোর এই একটাই শাড়ি, বলতে ততোধিক নামানো গলায় মেয়েটি জানায়, অন্য দুটা কাচার সময় হয়নি, পরে কেচে নিবো।
কেটলিউলির গিঁটপড়া ভুরুর তলায় ঝলমলে চাউনিতে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছিল, এই লোকটা আবার কে, কাকুদার সঙ্গে জুটেছে সাতসকালে।
ওর নাম অরি, অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। খুব ভালো লোক। তোকে রেস খেলা দেখতে নিয়ে যাবে। প্রস্তাব আর আদেশ একসঙ্গে মিশিয়ে, মাথা পেছনে হেলিয়ে, থুতনি দিয়ে অরিন্দমের দিকে নির্দেশ করে যিশু।কেটলিউলি ঝটিতি জরিপ করে ওকে, যেন এই কচি বয়সেও, মানুষের দিকে স্রেফ একটি বার তাকিয়ে, তার চরিত্রের ভালোমন্দ বুঝে ফেলবে।
ভুরুর গিঁট বজায় থাকে। মাঝখান থেকে এই লোকটা আবার কেন? কাকুদা তো নিজেই নিয়ে যাবে বলেছিল ঘুড়ার দৌড়ানো দেখতে। তা নয়, একজন অচেনা উটকো লোকের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এ কি ঘুড়ার পিঠে বসে?
যিশু নিজের সাফাইকে সাফসুতরো করে। আমি যেতুম, কিন্তু আমার দুদুটো রিপোর্ট ফাইনাল করা হয়নি এখনও। একটা তো আজকে স্পাইরাল বাইন্ডিং করতে পাঠাব, যাতে রাত্তিরে কুরিয়ার করতে পারি। তার ওপর আবার কমপিউটারের প্রিন্টারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। ফ্লপিতে তুলে দেখতে হবে কাছেপিঠে কোথাও যদি প্রিন্টআউট নেয়া যায়। লাইটও থাকছে না সন্ধের দিকে। হাতের কাজ দু-এক দিনের মধ্যে শেষ করতেই হবে, নইলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। অরিন্দম অনেক ভালো লোক। বাড়িয়ে বলছি না। সত্যি। আলাপ করলেই টের পাবি। তোর অফিসের পাশেই ওর অফিস। ওই ডানদিকে যে তেরোতলা বাড়িটা। অফিসে এসকালেটার আছে, মেট্রোরেলের মতন। তোর অফিসে তো শ্রমিকদের সরকার তোকে চাপতেই দেয় না লিফ্টে, দিনে পঁচিশবার একতলা, তিনতলা করিস। ওর অফিসে ও অনেক বড়ো অফিসার। ওর গাড়িও আছে নিজের, তোকে চাপাবে। ওই তো, ওই যে, ওই ঘিয়ে রঙের গাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস, ওইটে।
কেটলিউলিকে কমপিউটারের বিশদ কেন? ও কি কমপিউটার শিখছে? কিন্তু অরিন্দম সম্পর্কে কথা বলার বদলে ওর অফিস, অফিসারি, তেরোতলা, এসকালেটর, গাড়ি এসমস্ত ওর সচ্চরিত্র হবার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মেয়েটির এজলাসে পেশ হল। কেটলিউলির চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, যিশুর প্রয়াস দিব্বি সফল। মসৃণ তেলালো ত্বকে আভা দেখা যায়। ভুরুর গিঁট খোলে।
তুইতোকারি করা বা তুমি বলা উচিত হবে কিনা নিশ্চিত হতে না পারায়, বিব্রত অরিন্দম বলল, আমাকে কাকুদা-অরিদা গোছের কিছু বলবেন না। স্রেফ অরি কিংবা অরিন্দম বলে ডাকবেন।
যিশু কাঁধ নাচায়। ওহ হাসালে বটে। তুমিই বোধহয় প্রথম আপনি-আজ্ঞে করছ ওর জীবনে। মহাকরণে সবাই তুইতোকারি করে। অত তোল্লাই না দিয়ে ওকে তুমি বলেই ডেকো। ঠিক, না রে কেটলি?
কেটলি বেশ বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে, মাসখানেক আগে একবার বলে ফেলেছিল যিশু। ওর দাদু, মানে ওর মায়ের বাবা, নামকরা লোক ছিল, খাঁটি ডাকসাইটে। কুচকুচ করছে চুল। থমথম করছে মুখ। কুতকুত করছে চোখ। টনটন করছে জ্ঞান। খসখস করছে কন্ঠস্বর। তিরতির করছে চাউনি। গটগট করছে চলন। কনকন করছে আঙুল। দশাসই। পিস্তল রাখত। ভালো জামা-কাপড় পরার শখ ছিল। দু-দুটো বডিগার্ড থাকত সব সময়। স্বাধীনতার আগের বছর তো জান লড়িয়ে দিয়েছিল। আদিত্যকে জিগেস কোরো। যিশু আদিত্যর কথা পাড়ায় নিজের ক্ষুন্নতায় আশ্চর্য হয়েছিল অরিন্দম। আদিত্য তো বোধহয় ওরচেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোটো। যিশু আদিত্যর চেয়ে কুড়ি বছরের বড়ো।
আদিত্যর দেওয়া তথ্যে বিস্মিত আর আকৃষ্ট হয়েছিল অরিন্দম। সত্যি। অফিসের মহাফেজখানা থেকে ধুলোপড়া পুরোনো খড়খড়ে ফাইল এনে দিয়েছিল আদিত্য। ফাইল খুঁটিয়ে পড়ে, অবিচল অস্হিরতায় আক্রান্ত, ভেবেছিল অরিন্দম, বিকেলের বর্ষীয়ান আলোয় নিজের বিছানায় শুয়ে, টেবিলে রাখা চায়ে কখন সর পড়ে গেছে খেয়াল নেই, ভেবেছিল ও, কলকাতার বিখ্যাত পরিবার বলতে ঠাকুর পরিবার মল্লিক পরিবারের মতন কয়েকটা উচ্চবিত্ত পরিবার বোঝায় কেন! কত বাঙালি আছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পঞ্চম ষষ্ঠ পুরুষ ওব্দি বংশলতিকা জানে বলে গৌরব বোধ করে। তারপর একদিন তারা মরে হাওয়া হয়ে যায়। সেই গৌরববোধটা কি তখন হাওয়ায় ঈথারে ভেসে বেড়ায়? বিখ্যাত গরিব বাঙালি পরিবারও আছে তো কতো!
আরও গোটাকতক ফাইল লুকিয়ে এনে দিয়েছিল আদিত্য। বর্ণময় সব চরিত্র।
কেটলিউলির দাদুর নাম কেষ্টবাহাদুর জহোর্বাদি। দার্জিলিঙের বাঙালি। মা-বাপ অজানা। একজন চিনে মুটিয়া লালন-পালন করেছিল। তাকেই বাপ বলে জানত। দার্জিলিঙ থেকে কলকাতায় পৌঁছে, বছর ফুরোবার আগেই, পটল তুলল চিনে বাপ। কারা যে ওর মা-বাপ, চিনে বাপ সাঙ্গ হতে, জানা হল না আর। সব বাবারাই তখন ওর চিনে বাপ। ফেকলু ছেলেটাকে শুয়োর মাংসের এক কসাই পুষ্যি নিলে। পাড়ার বজ্জাতগুলোর সাকরেদিতে শিখে ফেলল চুরি-বাটপাড়ি, চাকুবাজি, হার ছিনতাই, ব্লেডমারা, পার্স তুলে চিতাবাঘ দৌড়। চোদ্দ বছর বয়সে রেফরমেটরি-জেলখানায়। কলকাতার আর আশেপাশের জেলখানায় যা হয়, গাঁজা, চরস, হেরোইন, আফিম, কোকেন, সমকাম, ঝাড়পিট, অসুখ, অখাদ্য, অপুষ্টি। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো পোড়-খাওয়া ঘ্যাঁচড়া। তারপর অবিরাম ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে, ভেতরে-বাইরে…।
ছেচল্লিশের প্রাকস্বাধীনতা আর মানুষ-জবাই উৎসবে, মুসলমানদের পাড়া টেরিটিবাজার ছেড়ে পালাল মলঙ্গা লেন, আর সেখানে গিয়ে গোপাল মুকুজ্জের হিন্দু বাঁচাও দলের ঠ্যাঙাড়ে সদস্যে পদোন্নতি পাওয়া কেষ্টকে তখন দ্যাখে কে! যত খুন করে ততো প্রতিষ্ঠা বাড়ে। শার্টের কলার, গোপাল মুকুজ্জের দেওয়া হলেও, গাধার কানের মতন উঁচু। ও দার্জিলিঙের লোক ছিল বলে ওর নাম সেই থেকে হয়ে গেছে ন্যাপলা। অন্তত শ’খানেক মুসলমানকে নুলো খোঁড়া কানা করেছিল, পাঞ্জাবি পুলিশের নজর এড়িয়ে। কচুকাটা কন্দকাটা হেঁটেকাটাও করেছিল দাদু।
ওই ফাঁকেই, দেশ স্বাধীন হব-হব, একজন তাগড়া হেলে কৈবর্তের মেয়ের সঙ্গে থাকতে লাগল। ফাইলের মার্জিনে লেখা, ইংরেজিতে, বিয়ে হয়নি। বাচ্চা হতেই জিনহা আর জহোরলাল যে যার আঁতুড়ে যখন স্বাধীনতার বিগুল বাজাচ্ছে, বউটা কাঁখে বাচ্চা নিয়ে এক গাঁট্টাগোঁট্টা তেঁতুলে বাগদির সঙ্গে পালাল পুরুলিয়ার আরসা ব্লকের হেঁসলা গ্রামে।
দেশ স্বাধীন হতে, হাত-পা ছড়াবার অনেকটা জায়গা দিয়ে অনেক মুসলমান তো ডানদিকের আর বাঁদিকের পাকিস্তানে পালাল। গোপাল মুকুজ্জেরা আর তাই কেষ্টটেষ্টদের পুষতে চাইল না। তখন সংবিধান লেখালিখি হবে, দিশি বুড়ো-হাবড়ারা চেয়ার-কুর্সি পাইক-পেয়াদা পাবে, ফলে কেষ্ট গিয়ে সমাজের বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে চিৎপটং। তারপর কখনও পটুয়াটোলার সত্যেন বিশ্বাস, ভূবন সরকার লেনের ব্রজেন সরকারের কাজে, কিংবা ফ্রিল্যান্স ঠ্যাঙাড়ে। সাতচল্লিশে টালিগঞ্জ থানার বন্দুক-কার্তুজ লুট, আটচল্লিশের নভেম্বরে মহরমে মারপিট। পঞ্চাশের ফেবরারি-মার্চের দাঙ্গায় গোপালবাবু-সুধাংশুবাবুদের স্যাঙাত হয়ে আবার দেশপ্রেমিকে উন্নীত।
কেষ্টোবাহাদুর জহোর্বাদি বাঙালি-সমাজের প্রথম মস্তান। তারপর থেকে মস্তান ছাড়া সরকারি দল অচল। পশ্চিমবাংলার রাজনীতি অচল। পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতিতে তার অবদানের আলোচনা কেন যে হয় না, আশ্চর্য!
কেষ্ট তারপর আরম্ভ করে দিল ডাকাতি। খুল্লমখুল্লা ঘুরে বেড়াত স্টেনগান নিয়ে। গড়িয়াহাটের গিনি ম্যানসনের ডাকাতিটা ওই করেছিল। তখনকার দিনে মুখোশ পরে মুখ লুকিয়ে ডাকাতির চল হয়নি। তবুও প্রমাণ করা যায়নি। কে আর সাক্ষী হয়। মানুষের ভয়ডরের শরীর। তার ওপর দেশ স্বাধীন হতেই পুলিশকেও একই রকম ভয় পেতে আরম্ভ করেছে লোকে। ছাড়া পেয়ে কেষ্ট দিনকতকের জন্যে পালাল মুম্বাই। ফিরে আসতে, একদিন রাস্তায় হঠাৎ, ছেচল্লিশের প্রতিরোধ সমিতির পাণ্ডা শিবপ্রসাদ সাহার সঙ্গে কেষ্টবাহাদুরের দেখা। বউবাজারে সাহার চালডালের দোকান। চলছিল না। একদিন বউবাজারের বড়ো ব্যাপারি শ্যামলাল গুপ্তর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যবসার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল শ্যামলাল। কেষ্ট তো ওকে গুলি মেরে খুন করে বোমার ধোঁয়া উড়িয়ে ব্যাগ হাতিয়ে পালাল। কিন্তু পাবলিকের তাড়া খেয়ে সেঁদিয়েছে গিয়ে রূপম সিনেমাহলে। ধরা পড়তে রাগি জনগণের হাতে দেম্মার, পেড়ে ফেলে আড়ং ধোলাই।
স্বাধীনতার পর সেই প্রথম বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ আর রাজনীতি-নিরপেক্ষ গণপ্রহার, কেননা মাত্র ক’বছরেই পুলিশের ওপর থেকে ভরসা উবে গিয়েছে নাগরিকদের। বলেছিল যিশু।
মাউনব্যাটোন যাবার সময়ে জহোরর্লালকে বলে গিসলো, এই স্বজন-ঠ্যাঙাড়েদের ভার তোমার হাতে সঁপে যাচ্ছি, এরা অনেক কাজে দেবে, তোমার মেয়ে যখন বড়ো হবে তখন, এমনকী তোমার নাতি আর তাদের ছেলেমেয়েদেরও কাজে দেবে। তুমি আবার বাহাদুরি মেরে মানবতাবাদ ফলাতে গিয়ে খোলনলচে পালটে ফেলো না যেন। জিনহাকেও একই কথা বলিচি। তা কথাটা অমান্য করেনি দুজনে। বলেছিল যিশু।
জহোর্লালের মেয়ে জহোর্লালের চেয়ে এককাঠি বাড়া। কেরলের কমিউনিস্ট সরকারকে পছন্দ হয়নি বলে, কথা নেই বার্তা নেই, বরখাস্ত করে দিলে। কংরেসের তাথই নাচ দ্যাখে কে!
অনেকদিন চলেছিল কেষ্টর মকদ্দমা। জেল হাজতে তো ওর দাড়ির চুল সাদা হয়ে গেল। স্বাধীনতার পর বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখার সেই শুরু, ফউজদারি হোক বা দেওয়ানি। সাতান্ন সনের কলমের নিব ভেঙে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল কেষ্টর। সে নিব পালটে নতুন নিব লাগালে, রাষ্ট্রপতির দয়ায় যাবজ্জীবনের পর কেষ্ট বেরিয়ে এল একেবারে লোলচাম বুডঢা, ভুরু আর কানের চুল পেকে দঙ্কাদড়ি। মেয়ের কাছে তপসিয়ায় বেঁচেছিল, অথর্ব। নাতনির টেরাকোটা হামাগুড়ি শেষ হবার আগেই, বাটিকেকের সদ্য নামানো গরম ডালার মধ্যে পড়ে ঝলসে মরে গিয়েছিল।
চিতায় ক্রিমিনালের লাশ থেকে ভ্যানিলার ভুরভুরে সুগন্ধ নিমতলার ঘাটকে শোকমুক্ত করে দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। বলেছিল যিশু।
কেটলি ওর মায়ের কাছ থেকেই শিখেছে পা দিয়ে ময়দা চটকানো। ডালহাউসিতে ওর বাপ ফিরি করত সেসব কেক। উদবাস্তুরা তখন সবে বড়োদিন, নিউ ইয়ার, হ্যাপি বার্থডে, পিকনিক করতে শিখছে।
নিয়মিত বিক্রিবাটা তো কেটলি মহাকরণে ঢোকার পর আরম্ভ হয়েছে। ঢোকার জন্যেও পুরুলিয়ায় গিয়ে ঝাড়খন্ড দলের বিরুদ্ধে বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে হয়েছিল ওর বাপকে, নির্বাচনের সময়। বলেছিল যিশু।
তাহলে মেনকা, আই মিন ম্যানকা পাইক, ওর বুইন নয়? জিগেস করেছিল অরিন্দম।
না-না। ও-ও তিলজলা বা বাইপাসের দিকে জবরদখল বস্তিতে থাকে কোথায় যেন। মস্তান ট্যাক্স আর পার্টি ট্যাক্স দিতে হয়।
ওর নাম কী? কেটলির?
নাম? নাম দিয়ে কী করবে?
নিজের কাছে রাখব।
ফাইলটার মার্জিনে একগাদা বানান ভুল সম্পর্কে মন্তব্য ছিল, পেনসিলে। মন্তব্যগুলোতেও বানান ভুল ছিল উদবাস্তুরা এসে কমিউনিস্ট পার্টিটাকে দখল করে নিয়ে প্রাইমারি স্তরে ইংরিজি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, যাতে বাঙালিদের একঘরে করে রাখা যায়। ফল ভুগছে। আন্দামানকে বাঙালিদের উপনিবেশ করতে দেয়নি জ্যোতি বসুর দল, এখন পাঞ্জাবি আর মালায়ালিরা দখল করে ফেলেছে। বাঙালি লেখকদের সেসব কথা বললে পোঁদ কুটকুট করে।
মন্দ বলোনি।
আরেকটা ফাইল থেকে তো জেরক্স তুলে নিয়েছে অরিন্দম, আদিত্যকে খ্যাপাবে বলে। খেপছেও আদিত্য। প্রসঙ্গ তুললেই, এমনকী ওর ভুঁড়িদাস খাকি সহবেতনভূকরাও। একজন কন্সটেবল, ব্যাটা কেবলমাত্র কন্সটেবল, মেদিনীপুরের পাণ্ডে, অ্যাঁ, সে তো রেগে কাঁই। আসলে, মেছুয়াপট্টির ফলবাজারে ব্যাটার একটা ম্যাটাডর ভ্যান খাটতো ; পুরসভা সেটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সতেরোটা হাতে-টানা রিকশা খাটে ওর। সবকটা রিকশা একটা লাইসেন্সেই চলে।
কলকাতা থেকে হাতেটানা রিকশা কেন তুলে দেয়া হচ্ছে না জানো তো? সব রিকশাই হয় পুলিশের নয়তো পলিটিকাল মাফিয়ার।
ওই ফাইলটা, যেটার জেরক্স রেখেছে অরিন্দম, গৌরীবাড়ি লেনের হেমন্তকুমার মণ্ডল ওরফে হেমেন মণ্ডল ওরফে হেমা এজেন্টের। লুম্পেন কলকাতার জনকরাজা। ফাইলে, নামের আগায় ‘শ্রী’ জুড়ে দিয়েছিল কেউ সবুজ কালিতে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় পড়েছিল অরিন্দম, মনে আছে, হেমেন মণ্ডলটা ছিল রুণু গুহনিয়োগীর স্যাঙাত ঠ্যাঙাড়ে। বোঝো তাহলে। শেষে এই রুণু কিনা আদিত্যর রোল মডেল!
স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস নাইন ওব্দি পড়েছিল হেমেন মণ্ডল। ক্লাস টেনে যাবার মুখে চলে গেল অন্যলোকের মালকড়ি-টানার ইশকুলে। গড়ে ফেলল হাড়-বজ্জাতদের হাড়হাভাতে হাড়গিলে দল। ভাড়াটে তুলতে হেমেন। চটকলে ভর্তি করাতে হেমেন। বানতলার ইঁট-বালি-লোহা কিনতে হেমেন। অবরোধকারীদের প্যাঁদাতে হেমেন। পুজোর চাঁদা তুলতে হেমেন। হেমেন রক্তদান ক্যাম্প করলে রোগাপটকা বুড়ো বাচ্চা সব্বাইকে দিতে হত ওর পাতা ফোলডিং খাটে কাঠ হয়ে শুয়ে। নইলে নয়ছয় লণ্ডভণ্ড খিস্তিখেউড় আড়ংধোলাই। লাশ লোপাট। নকশাল খুনের রেকর্ড করেছিল ও।
রাষ্ট্র তখন মহাকরণে কাগজ-কলম নিয়ে নাজেহাল। গৌরীবাড়িকে ভারতীয় সংবিধানের বাইরে নিয়ে যেতে সফল হয়েছিল হেমেন মণ্ডল। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল। পঞ্চান্ন হাজার লোকের ঘাড়ের ওপর সন্ত্রাসের ছত্রপতি হেমেনজি। ফি হপ্তায় কে কত তোলা দেবে তা বেঁধে দিয়েছিল হেমেন। খেরোর খাতায় হিসেব রাখত। চাইলেই গাড়ি টিভি ফ্রিজ চেয়ার টেবিল বাসন-কোসন বিছানা-মশারি তক্ষুনি দিয়ে দিতে হবে হেমেনজিকে। তক্ষুনি। বাড়ি বা ফ্ল্যাট চাইলে, তাও। তক্ষুনি।
অনিতা দত্তর ভায়ের ফ্ল্যাট দখল করে থাকতে লাগল হেমেন আর ওর ল্যাংবোট সেনা। অনিতার কাজ ওদের জন্যে রান্না করা, বাসন মাজা, জলতোলা, কাপড় কাচা, ঘরমোছা, জামাপ্যান্ট ইস্তিরি। অন্ধকার ভাঁড়ার ঘরটা অনিতার ভায়ের জন্য বরাদ্দ। পাড়ার লোকেরা তো ভয়ে লেংটু গুটিয়ে কেঁচো। রাষ্ট্র তখন মহাকরণে বৈপ্লবিক ফাইলবাজি শিখছে। দুনিয়ার মজদুর এক হও, কমরেড লেনিন জিন্দাবাদ, কাঁধে কাঁধ ভাইসব।
হেমেন কি আর ধরা পড়ে না? পড়ে বইকি। ধরে রাখা যেত না। উকিলরা ছাড়িয়ে এনে আবার ছেড়ে দিত সমাজে। হেমেন সমাজের ভেতর। পুলিশ সমাজের বাইরে হাই তুলছে। হেমেন যতবার ছাড়া পায় ততবার ওর ইজ্জত বাড়ে। এরকম হতে-হতে আলটপকা একদিন খেলাচ্ছলে শ্যামপুকুর থানার পরশুরাম রায়কে খুন করে ফেলেছিল। যাবজ্জীবন হল।
কিন্তু হেমেন মণ্ডল বলে কথা। দিব্বি ছাড়া পেয়ে গিসলো হাইকোর্টে। বুকের পাটা ফুলে হিমালয়। বড়োতলার গুণ্ডা হারু আদককে গিয়ে খুন করে দিলে, তারই পাড়ায়, হিন্দি সিনেমার সংলাপ বলতে-বলতে। হিন্দি ফিলমে তখন সবে ক্রিমিনালরা নায়কের পিঁড়িতে বসছে। অমিতাভ বচ্চনের দিওয়ার। শোলের গব্বর সিং। কিতনে আদমি থে? শুয়রকে বচ্চে, ওয়হ দো আউর তুম তিন। আরে ও সাম্ভা।
বাড়ির ছেলে-ছোকরা আর বউঝিরা বাংলা ফিল্ম ছেড়ে হিন্দির দিকে ভিড়ছে তখন। পাড়ার কচি কিশোররা হিন্দি সিনেমার ঢঙে কথা বলে আহ্লাদে আটখানা হতে শিখছে।
কংরেসের সিদ্ধার্থ রায় বিদেয় নিলে কী হবে, জনদরদী বামপন্হী সরকার সেশন আদালত থেকে হারু আদকের খুনের মামলা চুপিচুপি তুলে নিলে। ইনকেলাব জিন্দাবাদ। কমরেড মাও যুগ যুগ জিও, কমরেড ফিদেল যুগ যুগ জিও।
এদিকে হেয়ার স্ট্রিটে, মানিকতলায়, উল্টোডাঙায়, শ্যামপুকুরে, পার্ক স্ট্রিট, বড়োতলা আর চব্বিশ পরগণার থানায়-থানায় হেমেনের নামে শ’খানেক কেস ঝোলানো। ঝোলানো মকদ্দমার দড়ি আপনা থেকেই পচে যায়। হেমেনের খাতিরে বিশেষ আদালত হল। হতেই, নাকচ করে দিলে হাইকোর্ট। জনদরদী সরকার জানতো যে হাইকোর্ট নাকচ করে দেবে। আইন বলে কথা। তা-ও আবার ইংরেজদের বানানো।
শুধুমাত্র তিনটে কেসের তল্লাশিতেই হেমেনের বৈভবে পাওয়া গিসলো লাখের বেশি কাঁচা টাকা, বিলিতি মটোরগাড়ি, অনেকগুলো ব্যাংকের মোটা ফিক্সড ডিপোজিট, লকার, গয়নাগাটি, ট্রাক, এমনকী ওর পাঁচ-পাঁচটা লাইফ ইন্সিয়োরেন্স। বিদেশি ইনসিয়োরেন্স কোম্পানিরা এসে যাতে না ব্যবসায় ভাগ বসায় তাই অনেক কাল আগে থাকতেই খুনি-ডাকাত-মস্তানদের জীবনবীমা আরম্ভ হয়ে গিসলো। পরে তো খুনি ধর্ষক আর ডাকাতরা বিধায়ক আর সাংসদ হয়ে যেতে লাগলো, খাদি-খদ্দরে ধবধবে।
হেমেনকে শেষে শায়েস্তা করলে গৌরীবাড়ি পাড়ার মেয়েরা। পাড়ায় বিনে পয়সায় কোচিং চালাত লাবু স্যার, একটু খোঁড়া। সবাইকে নানা রকমের কাজে সাহায্য করত লাবুবাবু। সবচে শ্রদ্ধেয় লোক ছিল পাড়ায়। লোকে লাবুকে এতো ভালোবাসছে শ্রদ্ধা করছে দেখে হেমেন আর ওর কেল্টে-খ্যাংরাটে সাঙ্গো-পাঙ্গোরা একদিন লাবুবাবুর ছেঁড়া কলার ধরে হুমকি দিলে, কোচিং-ফোচিং বন্দ করো, যথেষ্ট ল্যাখাপড়া শিখিয়েচো পাবলিককে। লাবুবাবু তাতে কান দিলে না। না শোনার ফলে একদিন ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের সামনেই ফাইট-মাস্টার হাফ-কমরেড হেমেন মণ্ডলের হাতে কোচিং ভাঙচুর আর লাবুস্যারকে লাথি ঘুষি চেন সোঁটা মেরে-মেরে বেধড়ক হল। থ্যাঁতা লাবুবাবুকে দেখতে গলায় স্টেথোঝোলানো ডাক্তার এলে তারও হল রামপ্যাঁদানি আড়ংধোলাই। শেষে থাকতে না পেরে একজন গেরস্ত বউ জোর করে ডেকে নিয়ে এল আরেক ডাক্তারকে। হেমেনরা আবার ট্যাঁ-ফোঁ করতেই পাড়ার সমস্ত বউ মেয়ে বুড়িরা হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে গাছকোমরে নামল রাস্তায়। জনদরদী সরকারের বরকন্দাজরা হেমেনকে বাঁচাতে গেলে তাদেরও জুটল চটিপেটা আর গুঁড়োলংকা। কমরেডরা পোঁদে গু নিয়ে দেদ্দৌড়। হেমেন-রাজ ফুরোলো।
পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের বোধ আর সংবেদনকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়ে গেছে রুণু গুহনিয়োগী-হেমেন মণ্ডলের দলবল। মর্গের আর ভাগাড়ের বেওয়ারিশ লাশের কংকাল বিদেশে চলে যাচ্ছে বিক্কিরির জন্যে। গঙ্গায় নৌকো ভাসিয়ে দিয়ারায় নিয়ে গেলেই হল। ওই তো, নিজের চোখেই দেখেছে অরিন্দম, মুর্শিদাবাদের ট্যুরে গিয়ে। হরিহরপাড়ার স্বরূপপুরে জমির খেয়োখেয়ির ছোরাছুরিতে কাঙালি শেখের বারো বছরের ছেলে হাবল শেখের হাত কেটে দিলে কংরেসিরা। সেই কাটা হাতটা বাজারের থলেতে পুরে জেলা আর মহকুমা আধিকারিকদের দেখিয়ে বেড়াচ্ছিল এসিউসির ছেলেরা। ওই কাটা হাতটা দিয়েই একজন অনুসন্ধিৎসুর গালে চড় কষিয়ে দিলে।
.
১৪.
অভিনয়ের অ আ ক খ শিখছে এমন এক নিরক্ষর নোংরা আজীবন চান করেনি নাকে পোঁটা খয়েরি-চুল বালিকা ওদের দিকে নখপালিশ-ওঠা হাত বাড়িয়ে আনুনাসিক প্রার্থনা জানাতে আরম্ভ করলে, অরিন্দমের হুঁশ হয়, আবোল-তাবোল ভাবছিল ও, ছি-ছি!
আমরা কি তাহলে মাঝপথে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্ব পাতানোর অনুষ্ঠান করব? যিশুর কথায় অরিন্দম বিব্রত। কেটলিউলি নিজের থুতনি একবার বাঁ-কাঁধে আরেকবার ডান-কাঁধে ঠেকায়।
পাশ দিয়ে চটাং-চটাং কথা বলতে-বলতে একজোড়া হাওয়াই চপ্পল চলে যায়। সামনের দোকানটায় ন্যাতানো জিলিপির ওপর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ভিমরুল পরিবারের বালক-বালিকা। শালপাতার ওপর মাছি-সমাজের ভনভন গ্রাম পঞ্চায়েতের বখরা নিয়ে ঝগড়া। একটা সাদা-বাদামি কুকুর আস্তাকুঁড়ে চর্বিত চর্বনে একাগ্র। সাদা লংক্লথে জড়ানো শিশু আর গোটানো শীতলপাটিসহ গোটা তিরিশেক উদাসীন টুপি-লুঙ্গি দল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে অরিন্দমের কোমরে ডান বেড় আর কেটলির হাত বাঁ-হাতে নিয়ে পার্ক-করা গাড়ির দিকে এগোয় যিশু।
মুলমানদের নীরব শবযাত্রার শোক বড্ড ছোঁয়াচে। আর শবযাত্রায় নেতৃত্ব সব সময়ে এক মৃতদেহের। মৃত্যুর কি যাত্রা সম্ভব? আমাদের এই কালখণ্ডটা শবযাত্রার। দাদু-ঠাকুমার কাল ছিল তীর্থযাত্রার। আমরা মডার্ন হবার যোগ্য নই। ওদের দুজনকে নিয়ে যেতে-যেতে ভাবছিল যিশু।
ধুৎ, ভাললাগেনা। কেটলিউলির কথাগুলো কাঁপে থরথর। ঝটকায় হাত ছাড়ায়।
পায়ের কাছ থেকে জিলিপি-ভেজা ঠোঙা তুলে নিয়ে যায় কাগজ-কুড়ানিয়া বাতাস। মেয়েটির উক্তিতে অরিন্দম একশা, হকচকায়। বাচনভঙ্গীর সঙ্গে মানানসই পুরু তাঁমাটে ঠোঁট। ওপরের ঠোঁটের ওপর, নাকের তলায়, কয়েক ফোঁটা ঘাম। হয়তো কেকের ময়দা ঠাসার পরিশ্রম।
ভ্যানিলার ভারাতুর গন্ধের আদর কাটিয়ে, গাড়ির ডিকি তুলে জুতো-মোজা খুলে ঢোকায় অরিন্দম, আর কোলহাপুরি বের করে পরে।
রাস্তার কলে ও, অরিন্দম, হাত-পা ধুতে গেলে, কেটলিকে যিশুর ফিসফিস। কী ভাবছে, বলতো, অরিন্দমটা। নির্ঘাত চটবে আমার ওপর। তোর কথা শুনেই এসেছে ও। বলছি তো, ওর মতন লোক আজকাল দেখা যায় না। তুই-ও অনেক লক্ষ্মী মেয়ে, বলেছি ওকে।
ভালো লোক বললে চরিত্রের ওপর অসহ্য চাপ পড়ে। অরিন্দম নীল বর্ডার দেয়া ধবধবে রুমালে হাত মুছতে-মুছতে এসে, ওদের কাছ-ঘেঁসে দাঁড়াতে, কেটলিউলি অরিন্দমের মুখে কনকনে চাউনি ফেলে জানতে চায়, কেনই বা যাব তোমার সঙ্গে?
কথাগুলো একযোগে অরিন্দমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরে ফেলতে চায় ওর সযত্নলালিত সততাকে। দৃষ্টি স্হির রাখে অরিন্দম। সরাসরি তাকায়। একবারও পড়তে দেয় না চোখের পাতা। ওদের দুজনকে তো বটেই, নিজেকেও স্তম্ভিত করে ওর অনুচ্চস্বর ঘোষণা: তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই।
কেটলিউলি ভাবার সময় নেয় না। যেন প্রস্তাবের উত্তর আগে থাকতে নির্ণীত। কিংবা চিন্তার দ্বারা কলুষিত হবার আগেই প্রশ্ন তোলে। কুতো দিনের জন্য?
অরিন্দমের কানে কালো, মসৃণ-ডানা, ঝিঁঝির অদৃশ্য কলতান আটকে যায়। ওকে চাপা না দিয়ে একটা বেসরকারি বাস চলে গেল পাশ কাটিয়ে। টের পায় মগজের মঞ্চে অস্হিরতার ঝিঁকা নাচ। ফুসফুসের মধ্যে কোথাও নিজের ডাকের পুনরুক্তি দিয়ে আবহকে উত্তেজিত করছে কোকিল।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ও, অরিন্দম, বাতাসের অদৃশ্য মৃগশিশুরা দুধ খেতে নামছে কেটলিউলির সদ্যোদ্ভিন্ন হৃদ্যতায়। ওর মনে হল, কেটলিউলির মেরুতে বার্তা পৌঁছে দেবার ভাষা ওর আয়ত্বে নেই। হিন্দি আর বাংলা সিনেমা-ও কেটলিউলির কাছে প্রেম-ভালোবাসাকে হাস্যকর আর ফালতু করে দিয়ে থাকবে।
প্রেমের সমস্ত অভিব্যক্তিকে ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে আধুনিকতা।
ওই অশথ্থ গাছটা যতদিন বাঁচবে, বলল ও, অরিন্দম, মেরুন-সবুজ স্বচ্ছ নৃত্যপটিয়সী অশথ্থপাতায় খেলতে-থাকা নিরুচ্চার রোদ্দুরের দিকে আঙুল দেখিয়ে, বলল ও, আমি আজকে, এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই, বলল ও, বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই, বলল ও, আমি যে-কোনো প্রথায় বিয়ে করতে রাজি, বলল ও, আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তেই এসব কথা বলছি, বলল ও, আমি সব রকম ঝড়ঝাপটা পোয়াতে তৈরি, বলল ও, আমাদের বাড়িতে কেউই আপত্তি করবে না, বলল ও, মায়ের বরং আনন্দই হবে, বলল ও, তুমি তোমার মহাকরণের কাজ ইচ্ছে করলে বজায় রাখতে পারো, বলল অরিন্দম।
যিশু থ, বোধহয় মুগ্ধ। যৌন সম্পর্কের শ্রেণিবিভাজন কি সত্যিই মুছে ফেলা যায়? আবেগকে এতকাল বারংবার অবজ্ঞা করার দরুন ওর নিজের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণয়গুলো মুলতুবি থেকে গেছে, তামাদি হয়ে গেছে। অরিন্দমের এক্ষুনি বিয়ে করতে চাই আর কেটলিউলির ‘কুতো দিনের জন্য’, আত্মসমর্পনের এই আঘাত-প্রত্যাঘাত ওকে তীব্র চোট দিয়েছে। কপালে বরফের থান ইঁটের মতন। প্রতিভা তো সকলেরই থাকে, কিন্তু যে নির্বোধ অজানার আহ্লাদে টেনে নিয়ে গিয়ে মানুষের টুঁটি চেপে ধরতে চায় তার প্রতিভা, সেখানে একা ঢোকার সাহস, সবায়ের হয় না।
গটগটিয়ে গাড়িতে বসতে গিয়ে দরোজা বন্ধ পায় কেটলিউলি। বিড়ম্বিত মুখশ্রী দেখে অরিন্দম দ্রুত তালা খুলে সামনের সিটে বসতে আহ্বান জানায় দুজনকে।
কেটলিউলি বসেছে চালক অরিন্দমের পাশে।
যিশু বলল, আমি পেছনে বসছি। অরিন্দম গাড়ি ঘোরায়।
বাবুরা দিনদুপুরে চললেন পিগনিগ কত্তে, শালা মটোরগাড়ির রোয়াব দেকাচ্চে। মন্তব্য ঝাড়ে রোগাটে কালচে ধুতি-পাঞ্জাবি, কটমট। যিশু বলল, ইনিও গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো ইত্যাদি ইশকুলের সদস্য।
অরিন্দম পালটা মন্তব্য করে, কলকাতায় বাঙালির গাড়ি থাকাটা গণশত্রুতা।
যিশু: আমরা কি তাহলে এখন বিয়ে কত্তে যাবো?
কেটলি : হ্যাঁঅ্যাঅ্যঅ্যা। কুথায় যাবো?
যিশু : খ্রিস্টান হলে আমি আজই চার্চে ব্যবস্হা করে ফেলতুম। ব্যাপটাইজ করতেও সময় দরকার। রেজেস্ট্রি করতে চাইলেও তো নোটিশ দিতে হবে। যাবার পথে না হয় নোটিশটা দিয়ে যাওয়া যাক, কী বলো? তোমার হিন্দু মতে তো পাঁজি-পুরুতের ঝক্কি। মহারাষ্ট্র মণ্ডল কিংবা তামিল সমাজমকে খর্চা-খরচ দিলে ওরা ইন্সট্যান্ট ব্যবস্হা করে শুনেছি। তোমার মুসলমান বা বৌদ্ধ বন্ধুবান্ধবদের নক করে দেখা যেতে পারে। তার চেয়ে আমিই না হয় পুরুত হয়ে যাই, এক সঙ্গে বাঁচা নিয়ে তো কথা। ও, না, আজকে অনেক কাজ আছে আমার; পরশু আমার কার্ডামম রিপোর্টের প্রেজেন্টেশান। গিয়ে ইকুইপমেন্টগুলো চেক করে রাখতে হবে।
যিশুর ফ্ল্যাটে ছোটো ঘরটায় টেবিলে আর দেয়ালে বসানো আছে নানা যন্ত্রপাতি, দেখেছে অরিন্দম। বাঙালি কর্মীদের চেয়ে যন্ত্রপাতিকে বেশি বিশ্বাস করে ও। ঘরটায় একা বসে নিজের রিপোর্টের বিশ্লেষণ করে শোনায় জাপান বা আমেরিকার কোনো কোম্পানির বোর্ড সদস্যদের, যারা কাজটার ঠিকে দিয়েছে। তারা প্রশ্ন তোলে। যিশু উত্তর দেয়। প্রকল্প বা প্রস্তাব তক্ষুনি অনুমোদিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়, কিংবা আবার বাড়তি তথ্য যোগাড়ে বেরোতে হয়, নতুনভাবে অনুমোদনের জন্যে। হলে ওর মোটা লাভ। না হলে মন খারাপ। প্রচণ্ড খাটে। নিয়ন্ত্রণ না করলে কাজ সবসময় দক্ষের দিকে, মানুষের দক্ষযজ্ঞের সক্ষমতার দিকে আকৃষ্ট হয়ে মানুষকে ঘিরে রাখে। যারা নিকৃষ্ট আর ফাঁকিবাজ তারা তাদের অক্ষমতার কর্মসংস্কৃতি গড়ে তোলে আর ক্রমশ রূপান্তরিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠে।
অ।। আমি তো ধর্মহীন আস্তিক।
যি।। কেটলি তুই কী বলিস?
কে।। ঘুড়ার দৌড় দেখতে যাবো।
যি।। তুই দৌড় দেখতে চাস, না রেস খেলতে চাস? মাঠে না গিয়েই রেস খেলা যায় রাসেল স্ট্রিটে টার্ফ ক্লাবের কাউন্টারে।
কে।। ঘুড়াও দেখে নিবো, রেসও খেলে নিবো।
যি।। আমাকে তাহলে পার্কস্ট্রিটে নামিয়ে দাও অরিন্দম। পার্ক সার্কাস বা ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে ঢোকার সময় আছে এখনও। টাইমে পৌঁছোতে পারলে কাজ হয়। নইলে সেই আবার ঘুরপথে চৌরঙ্গি দিয়ে ঢুকতে হবে।
কে।। চলো না কাকুদা, আমরাদের সঙ্গে। খেলা জিতে নিবো আর চলে যাবো শশুরবাড়ি। হি-হি।
যি।। আগে তো জিতগে যা। আজকে আমার সত্যিই অনেক কাজ আছে। তার ওপর আমার ম্যান ফ্রাইডেটা বাড়ি যাচ্ছে। ওদের গ্রামে টেনশান শুরু হয়েছে আবার। বেচারা কীর্তনিয়া।
অ।। সেই বাঙাল ছেলেটা? কী হল ওর? এইজন্যেই আপনার পুরোদস্তুর অফিস খোলা উচিত ছিল। ক্লার্ক, অ্যাকাউন্টেন্ট, ডাটা এনট্রি অপারেটর এসব রেখে। অঢেল টাকা তো রোজগার করেন।
কিছুক্ষণ থম মেরে যায় যিশু। তারপর আরম্ভ করে পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতাউত্তর পল্লিসমাজের অকথ্য রূপকথা। শোনার জন্যে গাড়ির গতি কমায় অরিন্দম।
উত্তর দিনাজপুরের অন্ত্যজ উদবাস্তু গ্রাম ভাঙাপাড়ায় ওর বাড়ি। উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলোর নামও স্ট্রেঞ্জ। ভাঙাপাড়া, মাথাভাঙা, ফাটাপুকুর, রাজাভাতখাওয়া। ওদের গ্রাম থেকে আমিই এনেছিলুম ছেলেটাকে। একদম রঅঅঅ। এখন তো ও আর থাকতে পারে না গ্রামে গিয়ে। গ্রামটা একেবারে অজ পাড়াগাঁ, অলমোস্ট এইটিন্হ সেঞ্চুরিতে। পার্টির দলাদলি ছাড়া অন্য কোনও রকম আধুনিকতা নেই।
গত বছর ওদের গ্রামের চালকলটায় আর সেখানকার শদেড়েক কুঁড়েঘরে আগুন ধরিয়ে আটজনকে পিটিয়ে গলাকেটে খুন করেছিল পাশের টুনিভিটা গ্রামের মাহাতোরা। পাঁচশো মাহাতো, হাতে মশাল নিয়ে দৌড়ে আসছে, কী ভয়াবহ। তোমাদের বিহারের খুনোখুনি তো এর কাছে নস্যি। পাঁআআআচ শোওওও লোক হাতে মশাল নিয়ে চ্যাঁচ্যাতে-চ্যাঁচাতে এগোচ্ছে একটা গ্রামের দিকে, ভাবতে পারো? শরৎ চাটুজ্জে তো এই সিনারিও নিয়ে এপিক লিখে ফেলতেন, একশট আফিম মেরে। বিগ বাজেট হিন্দি ফিল্মও হতে পারে; পাঁচশো গব্বর সিং দাঁত বের করে ছুটে আসছে।
বুঝলে? একটা কোলের বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আগুনে। পড়পড় করে পুড়ে ঝামসে কালো হয়ে গেল জলজ্যান্ত তুলতুলে বাচ্চাটা। বুঝলে? টুনিভিটার মহাজন সুরেন মাহাতোর লাশ আগের দিন পাওয়া গিয়েছিলো ভাঙাপাড়া গ্রামে। গ্রামে-গ্রামে ব্যাংক খুলে মহাজনদের খুব সুবিধে হয়েছে। কী বলছিলুম? হ্যাঁ। অজিত বালা নামে একজন চালকল মালিকের কাছে মোটা টাকা পাওনা ছিল সুরেনের।
আমার কাজের ছেলেটার বাবা-মা আর বোন এসে ছিল আমার ফ্ল্যাটে। বিহারের বলরামপুর থেকে লাঠিয়াল এনেছিল মাহাতোরা। তাদের হাতে লাঠি, বল্লম, সড়কি, টাঙি, বাঁশ, শাবল, জেরিক্যানে পেটরল। ওই সমস্ত অস্ত্র নিয়ে পাঁচশো লোক, ছুটে আসছে, হই-হই করতে-করতে, বুঝলে? জাস্ট ভিজুয়ালাইজ। ভাঙাপাড়ার জোতদার বুধন মাহাতোর হাজার খানেক বিঘে জমির বেশিটাই খাস হয়ে গিয়েছিলো। ভাঙাপাড়ার রিফিউজিরা কেউ-কেউ পাট্টা পেয়েছিল। গোলমালের পাণ্ডা ওই বুধনটাই। ওর ছেলে ব্রহ্মদেবকে ধরেছিল পুলিশ। আরে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তো সব আদিত্যর কার্বন কপি।
ভাঙাপাড়ার পরিবারগুকো ধান থেকে চাল বানিয়ে বিক্কিরি করে। ধান কোটে বলে ওদের বলে কুটনি। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন ছাড়া ওদের চলে না। কবে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই সাতচল্লিশ সালে। অনেক কুটনির অবস্হা সামান্য ফিরেছে। অনেকে আবার রয়ে গেছে উদবাস্তু, অলমোস্ট কাঙালি। এদিকে জমির দামও বেড়েছে তরতর করে। মাহাতোরা তো ব্রিটিশ আমলের জোতদার। ধার দিয়ে, লোভে ফেলে, ভয় দেখিয়ে, আবার হাতাবার তালে ছিল জমিজমা। মাহাতোদের দলে ভিড়েছিল পলিয়া জাতের লোকেরা, ওরাও ল্যান্ডেড ক্লাস। এরা ঝাড়খণ্ডিদের মতন উপজাতি নয়। ভাঙাপাড়ার নমঃশুদ্র উদবাস্তুদের চেয়ে উঁচু জাতের লোক এই চাষাগুলো, আমার মনে হয় বিহারের কুর্মি।
জমিদারি আমলের মতন ধার-দাদনের কাগজে টিপছাপ আজও চলছে। পঞ্চায়েতেও তো জোতদার, মহাজন, মাহাতোদের দখলে। খুনোখুনির পর ব্রহ্মদেবটা তো হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। আর ধরাটরা পড়েনি বোধহয়। ওদিকে সমবায়-টমবায় বলে কিছু নেই। মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়ার মতন সমবায় ব্যাপারটা মাটি পায়নি উত্তরবঙ্গে। এনজিও নেই বলেই মনে হয়, জেলা সদরে যা জেনেছি। এনজিও গঠন করতে গেলেই খুন হবে, আসামে মাজুলি দ্বীপে সঞ্জয় ঘোষের মতন। বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাবুদের কথা তোমায় আর কী বলব। তোমরা তো ওদের মালিক। লাইসেন্স দাও, ইন্সপেক্ট করো।
দেশভাগের পর বামুন, কায়েত, বদ্যি যারা এসছিল, কেউ আর পড়ে নেই। সব্বাই দিব্বি গুছিয়ে নিয়েছে। উদবাস্তুদের নেতা হয়েছে। রাজনীতিরও দখল নিয়েছে। কিন্তু মার খেয়ে গেল অন্ত্যজরা। উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চলে তো ওদের জমিজমা সব শিখ সরদাররা হাতিয়ে নিয়েছে ; আন্দামানে গিয়েও উপনিবেশ গড়তে দেয়া হয়নি।
আচমকা ওদের সঙ্গিনী জিগ্যেস করে ফ্যালে, কুন দেশ গো?
এই নিষ্পাপ অজ্ঞানতা বজায় থাকুক। আধুনিকতার কলুষমুক্ত থাকুক, ভেবে, অরিন্দম বলল, কোন দেশ আবার, তোমার দেশ।
না-না, আমরাদের দেশ নয়। আমরা ঝগড়া করি না। মেয়েটির দুচোখে ড্যাবড্যাবে গরিমা।
তাই জন্যে তোর বিয়ে দিচ্ছি অরিন্দমের সঙ্গে, ও-ও মহাক্যাবলা, ঝগড়া-ফগড়া করতে পারে না, বলল যিশু, প্যাকেটে সিগারেট ঠুকতে-ঠুকতে।
তুমি সিগ্রেট খাও না? অরিন্দমের কাছে জানতে চায় বাগদত্তা।
না, আমি পান সিগারেট মদ গাঁজা কিচ্ছু খাই না।
ঠিক, তুমি বোকা। অরিন্দম সম্পর্কে বাগদত্তার মূল্যায়ন।
যিশু ওর পল্লিকথার পরবর্তী পর্ব শুরু করে।
গ্রামটায় থেকেছি আমি। প্রাইমারি ডাটাবেসের লোভ আমি সামলাতে পারি না, জানোই। কুটনিদের পুরো তথ্য আছে আমার কাছে। আনবিলিভেবলি গরিব এই লোকগুলো। একচালা, হোগলা, চ্যাঁচারি, ডিগডিগে, ক্যাঁতরা-কানি, লালচাল, জলেতে তেলের গন্ধ, পানাপুকুরে চান, নোংরা ছোটোছোটো মাছ আর শাকশেকড়। আমার তো পেট খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। বুঝলে! তাও আবার পায়খানা নেই। মাঠে হাগতে যাও।
হি-হি।
এই, হাসিসনি।
লোকাল রাজনীতিকরা মাথা গলায়নি? জানতে চেয়েছিল অরিন্দম।
আরে তা আর বলতে। প্রান্তিকের সংঘর্ষ মানেই রাজনীতি, আই মিন পার্টি-পলিটিক্স। সিটুর কুটনি ইউনিয়ানের বিবেকানন্দ কীর্তনিয়া বলেছিল, গণহত্যার পুরো ছকটা সিপিয়েম নেতা হরেরাম মাহাতোর। সিপিয়ের সাংসদ সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিল, হরেরাম নির্দোষ, আসলে জোতদাররা জমি কাড়তে চাইছে। জেলা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বীরেশ্বর লাহিড়ি বলেছিল, জোতদার-মহাজনদের কথায় ওঠবোস করি না আমরা। বিজেপির শ্রীধর মল্লিক বলেছিল, পেটরল এসেছে মাহাতোদের চালকল থেকে। কলকাতায় তখনকার কংরেসের মানস ভুঁইয়া বলেছিল, যারা খুন হয়েছে তারা সবাই কংরেসের। আরেসপির জেলা সম্পাদক জ্যোতিষ সরকার বলেছিল, আরেসপির প্রভাবশালী নেতা ছিল টুনিভিটা গ্রামের সুরেন মাহাতো। কারামন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরি ভাঙাপাড়ায় গণশ্রাদ্ধের দিন বলেছিল, পুনর্বাসনের ব্যবস্হা করা হচ্ছে। ব্লক আধিকারিক অশোক সাহা বলেছিল, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্যে তেরপল আর কাপড় কেনা হচ্ছে। দিনাজপুর-মালদা রেঞ্জের ডি আই জি অশোক সেন বলেছিল, হত্যাকারীদের খোঁজ চলছে। জেলার পুলিশ সুপার দেবেন্দ্র সুকুল বলেছিল, অবস্হা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। জেলাশাসক পবন আগরওয়াল বলেছিল, গ্রামবাসীদের মাথাপিছু ষাট টাকা নগদ, শুকনো খাবার আর জামাকাপড় দেয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিল, শোকমিছিল বার করলে অশান্তি হবে। আরেসপির স্হানীয় নেতা রমণীচন্দ্র ঘোষ বলেছিল, বুধনের ছেলে ব্রহ্মদেব তো কংরেসের লোক….
তুমি কী বলেছিলে? সঙ্গিনীর রাগি প্রশ্নে দুজনেই স্তম্ভিত।
যাক বাবা, আমার বাড়ি এসে গেল। জবাব এড়াবার সুযোগ পেয়ে সত্যিই প্রীত হয় যিশু। দোর খুলে, বাঁ পা বাড়িয়ে, চুলের টেরি বাঁচিয়ে নামে। নেমে, সামনের জানালায় ঝুঁকে, মেয়েটি ওর কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারবে না জেনেও বলে, বুঝলি, আমরা সাধারণ লোকেরা মহলায় প্রক্সি দিই, কিন্তু আসল নাটকটা করে অন্য লোকেরা। আমাদের এই পাড়ায়, পার্ক স্ট্রিটে, বুঝলি, সক্কালবেলা একজন লোক কাক আর কুকুরদের আও আও আও আও, কানি আও, লেংড়ি আও, ডাক পেড়ে-পেড়ে রুটির গোছা খাওয়ায়।
হি-হি।
একদঙ্গল মেট্রোপলিটান কিশোরী রাস্তা দিয়ে ঢলঢলে বুক ফুলিয়ে যেতে-যেতে, হাই আংকল, চেঁচিয়ে হাত নাড়ায় যিশুকে। নজর ওদের কেটলিউলির দিকে।
অরিন্দম : আমিও কাল থেকে আপনাকে কাকুদা বলে ডাকব।
যিশু : কালকে কেন? এখন থেকেই বলো।
অরিন্দম : আগে বিয়েটা করি।
যিশু : সত্যি? না খাঁটি সত্যি? কোনটা? আচ্ছা চলি।
গাড়ি থেকে নেমে, শনিবারে প্রাক-দুপুরে, সওদাগরি পাড়ায়, হঠাৎই দরাজ হয় যিশুর গলা। মোন মোর উড়াং বইরং করে রেএএএএ….। উত্তর দিনাজপুরে শোনা।
ইশ রে, আবার গান!
.
১৫.
তপসিয়া সাউথ রোড, বাইপাস, তিলজলা রোড, দিলখুশা স্ট্রিট, পার্কসার্কাসের মোড়ে পাক খেয়ে পার্ক স্ট্রিটে যিশুকে নামাবার পর আউটরাম রোডে বাঁক নিয়ে ক্যাসুরিনা অ্যাভেনিউতে পড়ে গাড়ি।
সদ্য-পরিচিতির আগল ভাঙার আগের নিশ্চুপ মুহূর্ত। কে কী কথা বলবে। আবার অভিব্যক্তির সমস্যা হয় অরিন্দমের।
দু’পাশ জুড়ে পান্নাসবুজ। পিঠের ওপর থেকে রোদ্দুরকে ঘাসে ফেলে দিয়ে ছায়ায় দাঁড়ায় অরিন্দমের অ্যামবাসাডর গাড়ি। টুলবক্স খুলে একটা ছোট্ট হলুদ বই কেটলিউলির দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার স্টার্ট দেয় গাড়িতে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ি বেগবান।
পাতা উলটিয়ে ঘুড়ার ছবিগুনো দ্যাখে মেয়েটি। দেখে, রেসের বইটা রেখে দ্যায় টুলবক্সে। শরীর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে নিঃশব্দে। উপভোগ করে নিজের হাসি।
অরিন্দমের মনে হল, শরীর থিরকিয়ে এই যে হাসি, এভাবে দেহময় প্রতিভাদীপ্ত হয়ে ওঠা হাসি, দেহকে দেহাতীত করে দিচ্ছে, যেন ভরসন্ধ্যারআহামরি জোনাকিরা অন্ধকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঝরে-ঝরে পড়ছে। ও, অরিন্দম, বলল, কী হল? ঘোড়া পছন্দ করো।
পড়তে জানি না।
কেন? ইশকুলে ইংরেজি শেখায়নি?
বাংলাও পড়তে পারি না। কুনো ইশকুলে পড়ি নাই গো। আমি লিখাপড়া জানি না।
অরিন্দম টের পায় ও সজোরে গাড়িতে ব্রেক মেরেছে। কিঁইইইচ। হসপিটাল রোডে ঘাসের কিনারে থামে গাড়ি। ভীত শঙ্কিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, অ আ হসসোই দিরঘোই কিচ্ছু জানো না?
মেয়েটি আলতো মাথা নাড়ায়।
দিকে-দিকে সাক্ষরতার এতো গল্প, গ্রাম-শহরের দেয়ালে-দেয়ালে সাক্ষরতা সফল হবার ছড়া, অথচ কলকাতা শহরে একজন তরতাজা তরুণীর সঙ্গে বাংলা অক্ষরের পরিচয় হয়নি। শিলেট-পেনসিল নিয়ে কেউ সঙ্গে বসেনি কোনওদিন। হাতেখড়ি হয়নি। হাজার -হাজার বাংলা শব্দের মানেই জানে না। অবিশ্বাস্য। টেরাকোটা রঙের ওই পুরু ঠোঁট উচ্চারণ করেনি আজ ওব্দি কোনো লিখিত অক্ষর। অবহেলা অনাদর অভাবে স্ফূরিত অজ্ঞান নিরক্ষর ঠোঁট।
কী দেখছ গো?
তোমার কানের লতি পাটিসাপটার মতন তুলতুলে।
লিখাপড়া শিখে নিবো।
আমার মাও লেখাপড়া জানত না। পরে শিখেছে।
আজকা একটা সিনেমা দেকবো, কেমন? বালকুনিতে?
আমাদের বাড়িতে টিভি-ভিসিআর আছে। বাড়িতে বসে যত ইচ্ছে সিনেমা দেখতে পারবে।
অরন্দম দেখল, ওর সামনের দুটো চোখের জলাশয়ের ওপর জোনাকি উড়ছে। গাড়ির কাচে সানফিল্ম লাগানো ; পিছনের দরোজাদুটোর কাচ তোলা ছিল। ড্রাইভারের দিকের কাচ দ্রুত তুলে দিয়ে অনুসন্ধিৎসু মেয়েটির দিকে নিষ্পলক তাকায় অরিন্দম। সামনের দিক থেকে যে গাড়িটা আসছে, সেটা এখনও অনেক দূরে। ছোট্ট পুরু ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট একবার আলতো ছুঁইয়ে নিয়েছে অরিন্দম।
মেয়েটি চোখ বুজে জড়িয়ে ধরেছে ওকে, আর বলে উঠেছে, আমার আচকা লজ্জা হয়।
অরিন্দমের কনুই লেগে হর্ন বেজে ওঠে। বাতাসের পরতে লুকিয়ে-থাকা অদৃশ্য প্রতিধ্বনিরা হর্নের শব্দে কেঁপে ওঠে আচমকা। মেয়েটির হাঁ-মুখ থেকে বিকিরিত খুদের জাউয়ের পান্তার অচেনা সোঁদা গন্ধে অরিন্দম মুগ্ধ, সন্মোহিত। শিহরণ চাউর হয় রোঁয়ায়-রোঁয়ায়।
স্টার্ট দেয় গাড়ি। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে দৃশ্যমান আকাশে সপারিষদ উড়ছে চিলপুরুষ।
রেসকোর্সে পৌঁছে, গাড়ি থেকে নামার আগে, রেসের গাইডবইটা আবার বের করে টুকিটাকি পরিচয় করায় অরিন্দম। ফিলি, জকি, ঘোড়ার মালিক, দূরত্ব, চাম্পয়ান কাপ, ট্রেবল, টানালা, জ্যাকপট, আউটার সাউন্ড। মাদি ঘোড়াগুলোকে ট্রেনিং দিয়েছে কারা। ঘোড়ার জাত। ঘোড়ার বংশতালিকা।
কেটলিউলি হতবাক।
দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরে বারোশো মিটার জিতেছে, এই ঘোড়াটার নাম জ্বলন্ত চুমু।
হি-হি।
এর নাম তোপের গোলা, ঘোড়সওয়ার রুবেন, ওজন ষাট কেজি, কলকাতায় চোদ্দোশো মিটার জিতেছে। সব নামই রেজিস্ট্রি-করা, অন্য কেউ দৌড়ের ঘোড়াকে এই নাম দিতে পারবে না। অনেক ঘোড়া আছে, নাম শোনো। ক্লাসিক অ্যাফেয়ার, অ্যাপোলোনিও, হার্ডিলা, ডানসিং কুইন, ইয়েনা, ফ্ল্যাশ গর্ডন, সান শ্যাক, অলস্টার, জেরিজ ফ্লেম, ওকহিল, সানফ্ল্যাগ, কিং র্যাট, টলারেন্স, কোপাকাবানা, কার্নিশ প্রিন্স। কোন ঘোড়াটার টিকিট কিনব?
আমি কী জানি! বাংলা ঘুড়া নাই?
ওদের পাশে একটা ঠাসাঠাসি ট্যাক্সি এসে থামে। তর্করত পাঁচজন জুয়াড়ির কথা শোনা যায়। মফসসল থেকে বোধয়। শ্যালদায় নেমেই ট্যাক্সি ধরেছে। হয়তো ফি-হপ্তা ট্রিপ মারে। মোটা লোকটার হাতে রেসের বই। রেসুড়েদের চেহারাটা তেলচোয়াড়ে হয় কেন কে জানে! নিজেকে এদের সমগোত্রীয় ভেবে বিসদৃশ লাগল অরিন্দমের।
প্রথম জুয়াড়ি: অ্যাপোলোনিয়ারের মা ব্রিটিশ। ডার্বি জিতেছিল, জানেন তো গোরাদা।
দ্বিতীয় জুয়াড়ি: তোদের বাঞ্চোৎ মা-বাপের সদবংশে না হলে চলে না, না রে শশী? জুয়া হল একটা জীবনদর্শন, বুজলি। জেতার ঘোড়ার শ্রেণিই আলাদা, খুব উঁচু জাতের হয়। এ তোর পার্টিবাজির শ্রেণি নয়, বুজলি। আমি শালা হেরো হতে চাই না। জিদবো, তবে ছাড়বো।
তৃতীয় জুয়াড়ি : আসার সময়ে প্রতাপবাবু এই অ্যাপোলোনিয়ারের টিপস দিয়েছে সুখেনকে। গৌরাঙ্গ, অমরনাথ, কুমুদবাবু, বিরেন সিংহি সবাই একটা কতা বারবার করে বলে দিয়েচে। ঘোড়াটার আঁত্তা একেবারে ঝড় দিয়ে গড়া। সালা যেন জেলাধিপতি। মাথা বাঁয়ে কিন্তু দেকচে সামনেদিকে।
চতুর্থ জুয়াড়ি : অমর প্রেম জকির সিক্স টু ওয়ান যাচ্চে, জানিস তো ব্রহ্মানন্দ।
পঞ্চম জুয়াড়ি : সবাই আলাদা-আলাদা ঘোড়ায় লাগাই, সেইটেই ভালো, যারটা লাগে লাগবে। কে যে জিদবে বলা যায় না।
লোকগুলো চলে গেলে, গাইডবই খুলে অরিন্দম বলল, হ্যাঁ, জকি অমর প্রেমের ঘোড়াটার নাম অ্যাপোলোনিয়ো। আরও সব জকি আছে। ব্রিজশা, কুমার, আলি, কামিল, প্রসাদ, রাবানি, যাদব, সুনীল সিং, খান, শ্রফ, প্যাটেল, রাজ্জাক, আলফ্রেড। তোমার কোন ঘোড়সওয়ার পছন্দ?
কে জেতে গো? ঘুড়া, না ঘুড়ার পিঠে যে বসে?
জিতি আমরা, যারা খেলতে এসেছি।
আমরাদের কুন ঘুড়া?
তুমি তো বললে না। তুমি গাড়িতে বোসথাকো, আমি বুকির ঠেঙে টিকিট আনছি।
না না না না। একলা-একলা থাকবো না।
কাচ তুলে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিচ্ছি, ভয়ের কী!
রেসুড়েদের নমুনা দেখে কেটলিউলির এখানে আসা সম্পর্কে যে দ্বিধা জেগেছে তা উপভোগ করতে-করতে অরিন্দম প্রথম রেসের সবকটা ঘোড়ার টিকিট কাটে।
ঘোড়েল প্রৌঢ় বুকিক্লার্ক ওর দিকে অভিসন্ধির হাসি হাসে। প্রেমিকার সঙ্গে প্রথমবার? নাকি হনিমুন লাক-ট্রাই?
ফিরে এসে, গাড়ি খুলে, বন্ধ করে, কেটলিউলির ঘর্মাক্ত হাত ধরে ও, অরিন্দম। বন্ধ গাড়িতে ঘেমেছে। দিনভর কেটলি বয়ে-বয়ে কড়া পড়ে গেছে হাতে। বলে, আমার হাত ছেড়ো না, ঠেলাঠেলিতে হারিয়ে যাবে। অরিন্দমের মনে হল, হাত ধরে না থাকলে কোনও মহাকরণবাসী বিরক্ত করতে পারে। ভাববে আস্পদ্দা তো কম নয়। স্রেফ হাত ধরে থেকেও তো শ্রেণিবদল ঘটানো যাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ে চাপা স্বরে বলল ও, অরিন্দম, আমিও খেলিনি কখনো, আজ প্রথমবার, প্রথম জুয়ায় সবাই জেতে।
জুয়া?
জুয়াই তো।
ভিড়ের মধ্যে ওর অফিসের প্রোটোকল আধিকারিক রাঘব সান্যালকে দেখতে পেল অরিন্দম। শুনল, ওর বউ রমাকে বলছে, অরিটা ঝি-চাকরানিদেরও ছাড়চে না আজগাল, শালা বিয়ে কল্লে না কেন আজ ওব্দি কে জানে। রমার কষ্টার্জিত মুখাবয়বে প্রত্যুত্তর ফোটে না। পাটনায় থাকতে, রাঘব যখন অফিসে কেয়ারটেকার আর অরিন্দম মামুলি কেরানি, টেলিফোন অপারেটর রমার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকটা এগিয়েছিল অভিসন্ধির অনুপযুক্ত অরিন্দম। জিতে-জিততে দান ছেড়ে দিয়েছিল, কেননা পাশের ফ্ল্যাটের অতসি বউঠানের মধ্যদুপুর বুকের সুরভিত স্নিগ্ধতা তখন অফিস পালাতে উৎসাহিত করছে অনভিজ্ঞ অরিন্দমকে। সমাজের আজ্ঞায় অসফল প্রেমিকের গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক।
প্রথম খেলার ঘোষণা হয়। ভ্যানিলার গন্ধ হারিয়ে গেছে এখানকার নারীদের দামি আর বিদেশি সুগন্ধে। কেটলিউলি দৃশ্যত কুন্ঠিত। ঘোষিত হয় ঘোড়াগুলোর পরিচয়, জকিদের পরিচয়, ঘোড়া-মালিকের পরিচয়। জেতবার চাপা উত্তেজনা সবায়ের চোখে-মুখে।
আমরাদের কুন ঘুড়া?
যে ঘোড়া ওড়ে কিন্তু ডানা নেই।
পুলরুম থেকে এসে দাঁড়িয়েছে ঘোড়ারা। হালকানীল জিনস-পরা নাশপাতি-নিতম্ব একজন মহিলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। কিলবিলে আনন্দে স্পন্দমান তার গেঞ্জিঢাকা বুক। পাকাচুল সঙ্গীর মুখে অনুমোদনের হাসি। রেসুড়ে ধনীদুহিতারা তাদের যৌবন ধরে রাখে বহুকাল।
কেটলিউলির পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ভ্যানিলা। এতকালের সংস্পর্শে শরীরের গ্রন্হি থেকেই হয়তো নির্গত হয় ভ্যানিলা, ইচ্ছামতন।
ভ্যানিলা কী করে হয় জানো। মাথা নামিয়ে উড়ন্ত চূর্ণকুন্তলকে জিগ্যেস করে অরিন্দম।
কী করে? অপলক জানতে চায় মেয়েটি।
আলকাতরা থেকে।
ইশ রে। তোমায় বলেছে।
হ্যাঁ সত্যি। আলকাতরা থেকে পাওয়া যায় এথিল ভ্যানিলিন নামে একটা রস। তাকে স্টোক মেশিনে পরিষ্কার করে ভ্যানিলা হয়। সে ভ্যানিলা আমরা খাই।
কেটলিউলির চোখে অবিশ্বাস আর শ্রদ্ধা।
অরিন্দম শুনতে পায় চরাচর জুড়ে ধামসা, মাদল, ঝাঁঝ, শিঙা, চ্যাড়াপেটি, মদনভেরি, বাঁশি বাজছে। কলরোল তুলেছে হেঁতাল, গবান, গর্জন, গেঁওয়া, গোলপাতা, রাইন, পশুল, খলসি গাছের দল।
ছাড়া পেয়েই ছুটতে আরম্ভ করেছে ঘোড়াগুলো, ছোটাচ্ছে ঘোড়সওয়ার, রঠিন টুপি, চকরা-বকরা পোশাক। দাঁড়িয়ে পড়েছে দর্শকরা, কয়েকজনের চোখে দূরবিন, নিজের ঘোড়াকে ইংরেজি ভাষায় উৎসাহিত করতে থাকে।
বাতাসের ছোটো-ছোটো বাদামি টুকরোর ওপর লাগাম হাতে অর্ধেক উবু হয়ে বসে আছে ঘোড়সওয়ার। দর্শকরা নিজের গ্রীবাকে দীর্ঘ, দীর্ঘতর করছে, চ্যাঁচাচ্ছে।
সবুজ ঘাসের ওপর ছুটছে ঘোড়াগুলো। হাওয়ার দুর্গপ্রাকার ডিঙোবে বলে ছুটছে। খুরের ডুগডুগি বাজিয়ে ছিৎরে দিচ্ছে আধভেজা ঘাস। ছুটছে গা ঘেঁষাঘেঁষি। রোদ্দুরের চিলতেকে এক মুহূর্তের জন্যেও বসতে দিচ্ছে না চামড়ায়। স্বমহিমায় উজ্জ্বল একের পর এক বাদামি ঢেউ উঠছে আর নামছে। ঢেউগুলোর ওপর রঙিন পলকা ঘোড়সওয়ার। সাংগীতিক মূর্ছনায় খুরধ্বনির শব্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর। ছুটছে ঘোড়াগুলো। ছুটছে ঘোড়াগুলো। ঝুরো ঝুরো হয়ে ভেঙে পড়ছে অদৃশ্য বাতাসের গমগমে প্রতিরোধ।
ছুটছে ঘোড়াগুলো। অজস্র মানুষের দ্রুতশ্বাস চিৎকারের অনধিগম্য প্রতিধ্বনি চিরে কালোবরণ বিদ্যুৎ। পৃথিবীতে যেন অর্গল বলে কিছু নেই। ওরা ছুটছে। ভাসমান বেতারকণার সঙ্গে সংঘর্ষে দেদীপ্যমান সূর্যলোক চলকে পড়ছে ওদের ঝকমকে বেগবান পেশি থেকে। চারটে পায়ের কোনোটা মাটিতে পড়ার আগেই বাতাস ওদের টেনে নিচ্ছে সামনে। গ্রীবা প্রসারিত। ছুটছে রূপসীরা। রঙিন পালকে গড়া ওজনহীন ঘোড়সওয়ার, লাল-নীল, চৌখুপি জামা, হলুদ ডেনিম-টুপি, বাঁধভাঙা ঝরনার ধাক্কায় ছিটকে এগোচ্ছে, কালচে-বাদামি নদীতে রূপান্তরিত ঘোড়াগুলো বাঁক নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে না ওদের দ্রুত ধাবমান পা। ছুটচে ঘোড়াগুলো। কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব কবকব……
সবকটা ঘোড়া একাকার হয়ে বিশাল একটিমাত্র ঘোড়া হয়ে গেছে। উড়ে যেতে চাইছে আকাশে। বাদামি কুয়াশায় পালটে গেছে বিশাল ঘোড়াদের আদল। এদিকে আসার জন্য বাঁক নিচ্ছে উড়ন্ত নদীটা। স্পষ্ট কুচি-কুচি খুরধ্বনি। অমোঘ উদবেগের দিকে ধেয়ে আসছে। অজস্র পায়ের বিশাল ঘোড়া ছিঁড়ে-ছিঁড়ে অনেক ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক স্পর্শের পেশল বিদ্যুৎ বাঁচিয়ে ছিটকে চলে আসছে ঘোড়াগুলো। সামনে ঝুঁকে রয়েছে দোমড়ানো-পিঠ লাল নীল সবুজ ঘোড়সওয়ার। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার একটিমাত্র ঝড়ের টুকরো। এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে।
পুরুষ আর মহিলা জুয়াড়িদের উন্মত্ত বাহবায় দৌড়ে এগিয়ে আসছে একের পর আরেক ঘোড়া। যত জোরে চ্যাঁচাতে পারে উত্তেজিত অগুন্তি মানুষ-মানুষি, উৎসাহিত করছে বাজিধরা ঘোড়াকে। শেষতম ঘোড়া আর তার ঘোড়সওয়ারের নাম করেও লোকে চিৎকার করছে, বাকাপ, বাকাপ,বাকাআআআপ। অরবিটিনো, বাকাপ, শলিশ গোল্ড, বাকাপ, বাকাআআপ, লরেনজো, চাং ফা, অ্যাকোয়া মেরিন, কানসাই, স্যান্ড ডান্সার, বাকাপ, বাকাপ, মডেস্টি ব্লেজ, শিনজুকু, টিকোরিয়া, গোল্ড লাইট, বাকাপ, বাকাপ, বাকাপ, বাকাআআপ, অ্যাপোলোনিয়ো, জোরে, আরও জোরে, অ্যাপোলোনিও, অ্যাপোলোনিও…ও…ওওওও….
চিৎকারের ঢেউ স্তিমিত হয়ে ফোঁপানি আর অট্টহাসিতে পালটে যেতে থাকে। ডবকাবুক কালো গগলস খুলে টিশ্যু দিয়ে চোখ মোছে।হাততালি ক্ষীণবল।
বিজয়ী ঘোড়ার নাম ঘোষিত হচ্ছে। অরিন্দম অ্যাপোলোনোয়োর টিকিটটা গোছা থেকে আলাদা করেছে। দ্বিতীয় সলিড গোল্ড। সেটাও আলাদা করে। জ্যাকপট ঘোষিত হয় আর প্রথমটিকিটটার নম্বর মিলিয়ে অরিন্দম স্তম্ভিত, তলপেট থেকে জলোচ্ছ্বাস উঠে কন্ঠরুদ্ধ করে।
কুন ঘুড়া? অরিন্দমের কবজি-খেমচানো তরুণী-আঙুল আলগা হয়।
যেটা জিতল।
সত্যি?
সত্যি।
সত্যি বলছ?
সত্যি।
বলো না, সত্যি কিনা। কেটলিউলির কন্ঠস্বরে কিশোরী।
সত্যি। ড্যাবড্যাবে অবিশ্বাস আর উতলা বিশ্বাসে আক্রান্ত দ্বিধাগ্রস্ত মেয়েটির তাকলাগা ঘোরের দিকে তাকিয়ে অরিন্দমের আশ্বাস। কবজি ধরে থাকা আলগা আঙুলগুলো সজোড়ে আঁকড়ে ধরে আবার। মেয়েটির কোমরে হাতের বেড় দেবার আবেগ সামলাল অরিন্দম। এই মেয়েটা ওর থেকে বয়সে অনেক ছোটো। যত তাড়াতাড়ি হোক বিয়ে করে নিতে হবে। আজ হলে আজই। এর আগে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অথচ ব্যাখ্যাহীন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
ছোটোভাই আর ওর বউটা বিয়ের আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে রেখেছে, কনে আর কনের বাবার নাম ফাঁকা রেখে। অরিন্দম জুয়াড়িদের ওই ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মেয়েটির উদ্দেশে বলল, আজই আমরা বিয়ে করব।
বাড়ি গিয়া বাবাকে খবর দিব আর জামাকাপড় গুছিয়ে নিবো।
না-না। আর বাড়ি যাবার দরকার নেই। সোজা আমার বাড়ি যাব।
সিনেমার মতন?
খুব সিনেমা দ্যাখো? ম্যানকার সঙ্গে?
হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা।
চলো, টাকাটা নিয়ে নিই। ভিড় হবে কাউন্টারে।
দামি বিদেশি সুগন্ধ একেবারে মিইয়ে গেছে উত্তেজিত সুন্দরীদের দেহগ্রন্হির বিলোড়িত গন্ধে। পার্স থেকে ছোটো স্প্রে বের করে সুগন্ধের নবীকরণ করে নিচ্ছে কেউ-কেউ, পরবর্তী ঘোড়দৌড়ের আগে।
কাউন্টার থেকে টাকাগুলো সংগ্রহে সময় লাগে। নতুন নোটের প্যাকেটগুলোর রোদে প্রতিফলিত আলোয় উদ্ভাসিত ওদের মুখমন্ডল। এটাই ব্যাধি, এটাই ওষুধ। বিব্রত হলে হাসে মানুষ। আগাম আশঙ্কায় হাসে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেসকর্মী বকশিশ প্রার্থনা করলে, কয়েকটা নোট দিয়ে দিলে অরিন্দম, নিজের উদ্বেগ উপশমের জন্যে।
অ্যাতো টাকা দিয়ে দিলে? কথা না বলে বলল মেয়েটি। ক্ষতের কষ্টের মতন গোপন আনন্দ পায় আরিন্দম।
গাড়ি স্টার্ট করে অরিন্দম বলল, এবার জুতো খুলে পা তুলে বোসো। কেটলিউলি তা-ই করে। আয়নিত বিকিরণ-মাখানো পায়ের তলা থেকে আভাসিত হচ্ছে ধানচারা রোয়ার হিমেল গরিমা। নিঃশঙ্কচিত্ত তকতকে গোড়ালি।
প্রতিদিন, কেকের ময়দামাখার সময়ে, ভ্যানিলা-সুগন্ধের অভিনন্দন পায় এই পা জোড়া। আমলা, কেরানি, পিয়োনরা, হয়তো মন্ত্রীও, সেই অভিনন্দনের স্বাদ পায়। দিনের বেলাতেও নৈশভোজের আলো লেগে আছে আঙুলগুলোয়। শাড়ির ফলের সেলাই খুলে গেছে। ধুলো-ময়লার কালচে কিনার শুকোয়নি এখনও।
ল্যাজধরা মরা ইঁদুরের মতন দু আঙুলে প্লাস্টিকের কালো জুতো জোড়া তুলে গাড়ির বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল অরিন্দম। ওই পায়ের জন্যে এই জুতো নয়, অন্য জুতো কিনব চৌরঙ্গি থেকে। তরুণী অবাক হয় না। অধিকারে শিকড় অস্তিত্বের অতল ওব্দি চারিয়ে দিচ্ছে অরিন্দম। শিরশির করে ওঠে আর্জি। মুখের ওপর এসে পড়েছে সোমথ্থ দুপুরের হিমসিম রোদ।
অ।। কেটলি।
কে।। অ্যাঁ।
অ।। এই নামে সাড়া দিতে তোমার ভাল্লাগে, তাই না?
কে।। আমার কাজই তো তাই। এই দ্যাখো, কড়া পড়ে গেছে হাতে।
অ।। জানি। এখন আমরা পিয়ারলেস ইন-এ যাব।
কে।। তুমিও পিয়ারলেস করো?
অ।। না-না। ওটা একটা হোটেল। সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের বিয়ের আইবুড়ো-ভাত খাব। কলাপাতায়।
কে।। আইবুড়া কেমুন ভাত গো? সিদ্ধ না আতপ?
অ।। আইবুড়ো চালের নাম নয়। বিয়ের আগে আমার আর তোমার নাম।
কে।। হি-হি…আমি আই আর তুমি বুড়া।
অ।। আমরা খাব আতপচালের ভাত, শুক্তো, পটলের ঝালসাজ, হিঞ্চেশাকের বড়া, ভাজামুগের ডাল, রুই মাছের কালিয়া, দইতে রাঁধা মুরগি, পাঁপড়, শশা-আঙুরের চাটনি, মিষ্টি দই, ছানার পায়েস, কালাকাঁদ। হাতপাখার বাতাস। চাবিবাঁধা আঁচল কাঁধে ফেলে পানের খিলি এগিয়ে দেবে হোটেলের ওয়েটার বউদি। কেমন?
কে।। অত খাবার? সব একই দিনে খেয়ে নিবো কেন? আমরাদের জন্য রেখে দিবো। আজ ডাল খাবো, কাল শুক্তো খাবো, পরশু মাছ খাবো, তাপপরদিন মাংস খাবো। ছানার পায়েস কেমুন হয়গো? বড়ো খিদা পেয়েছে আমার। নিমবেগুন হয় না? নিমবেগুন খাওয়া ভালো। আমি সঅঅঅঅব শাগ ভাজতে জানি। কলমি, কুলাখাড়া, সেপুন্না, নিসিন্দা, পুঁই, নটে, কুমড়া, বাথুয়া, লাউ সব সব সব সব পারি।
অ।। মাংস?
কে।। জানি। কলকাতায় পাখির মাংস নাই। ময়ূরের মাংস নাই। বয়লার আর বয়লার। তারচে বাবা ডালভাত ভালো।
মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন, মনে হচ্ছিল অরিন্দমের। এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল। চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামলিনী। অত্যন্ত সাদামাঠা। কালো মেয়েদের সুশ্রী বলতে যা বোঝায়, এর তেমন কিছুই নেই। এর প্রাণশক্তির জোরের বখরাটুকু আজীবন চায়, আজীবন চায় অরিন্দম। হঠা্ৎ-ই, এই ভেবে যে মেয়েটা নাবালিকা নয়তো, ধ্বক করে ওঠে হৃৎপিন্ড। সব চুরমার হয়ে যেতে পারে তাহলে।
তুমি এবার ভোট দিয়েছিলে? কেটলিউলির অন্তস্হালের দখল নিতে জিগেস করে অরিন্দম।
হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা। এবার আবার একটা সাদা আর একটা গোলাপি দুটা-দুটা ভোট ছিল। ম্যানকা বলছিল লোকগুলার মাথা খারাপ। অন্যবার তো একটাই কাগজ হয়। আমি বলেছি, এবার আমি ভোট দিলুম কিনা, তাই আমার জন্য দুটা-দুটা। হি-হি।
কেন্দ্র সরকারের নির্বাচন, রাজ্যসরকারের নির্বাচন, এসমস্ত আলোচনা অবান্তর। সাদা আর গোলাপি কাগজ থেকে পাওয়া রাজনীতিহীন আহ্লাদটুকুই যথেষ্ট। মেয়েটির দুচোখে ধানখেতের সবুজ অতিশয়োক্তি অরিন্দমকে আশ্বস্ত করে। হৃৎপিণ্ডে, বর্ষারাতের ঝিলমিলে মেরুণ অন্ধকার, কানে আসে আনন্দের অঙ্কুরোদ্গমের রিনরিন।
আরেকটা জিনিস রাঁধতে জানি। বলব? কাসুন্দির সুন্দি ছাড়া, পাঁঠার পা, লবঙ্গর বঙ্গ ছাড়া, কিনে আনগে তা। বলো তো কী?
মহোল্লাস ছেঁকে ধরে অরিন্দমকে কাঁটা দ্যায় গায়ে। বলবার ছিল কাঁঠাল, বলল এঁচোড়।
হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা। হ্যাঁ শব্দের রণন হতে থাকে অরিন্দমের মস্তিষ্কে। বলবার মতন ধাঁধা বা ছড়া মনে করার চেষ্টা করে। মাথায় আসে না। বোধহয় জানেই না আদপে কোনও।
হসপিটাল রোড থেকে ক্যাসুরিনা অ্যাভেনিউতে গাড়ি বাঁক নিলে কেটলিউলি সজোরে বলে ওঠে, আবার ওই রাস্তায়, ইদিকে কাকুদা বলছিল তুমি ভালোলোক। আর মটোর থামাবে না কিন্তু। মেয়েটির মুখাবয়াবে অপ্রতিভ শঙ্কা।
পথের দুধারে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে রোদ্দুরের সবুজ ঠাঠা। ব্রিটিশ আমল থেকে নিজের গায়ে রোদ বসতে দিচ্ছে না ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। কিন্তু স্বাধীনতারপর সরকারি বাসের ভেজাল-দেয়া পোড়া ডিজেলের ভাসমান গুঁড়োর দাঁত জোরজবরদস্তি বসে যাচ্ছে ওর মার্বেলে।
কলকাতার এই ডিজেলগুঁড়োর আতঙ্ক ছাদে আলসেতে বারান্দায় বড়ি শুকোবার রেওয়াজ উঠে গেছে।তুলি জোয়ারদার শনিবার অফিস ছুটির মধ্যাহ্ণে অরিন্দমের সঙ্গে এখানে এসে এখানের ঘাসে বসে থাকতে ভালোবাসত। এই মেয়েটি, কেটলিউলি সম্পর্কে আরও জানতে ইচ্ছে করে অরিন্দমের।
প্রশ্ন।। অত দূর থেকে রোজ কেমন করে যাও?
উত্তর।। কুথায়? আমার আপিসে?
প্রশ্ন।। হ্যাঁ, কী ভাবে মহাকরণে পৌঁছোও?
উত্তর।। বাইপাস গিয়া এসপালানেড যাই। তাপপর ওইটুকু হাঁটা দেই। আর ডালাউসির বাস পেলে তাতে যাই। বড়ো আঁইশটানি গন্ধ ওই ঠিন, আমরাদের পাড়ায়।
প্রশ্ন।। সারাদিন বড়ো বেশি কাজ, না? দুতলা-তিনতলা?
উত্তর।। লোকগুলা বড়ো আগলটাপড়া।
মেয়েটার কথাগুলো চিনচিন করে।
অন্যান্য বছর চৈত্রাকাশে রাগ পুষে রাখে সূর্য। এবছর রোদ্দুরের হাবভাব নিরুত্তাপ। জহোর্লাল নেহেরু রোডে লাল রঙের শতছিন্ন বাস ধুঁকছে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে। হয়তো জহোর্লালের প্রথম কি দ্বিতীয় পাঁচসালা ফেবিয়ানি আমলে হাসিমুখে চশমা পরে কিনেছিলেন বিধান রায়।
দুপুরের রাজপথে বাতাসের বুকে থেকে-থেকে হাঁপানির টান। ফুটপাতের কিনারে কয়েকটা দেশোয়ালি দাঁড়কাক, দেশোয়ালি পথ-হোটেলের ফেলে-দায়া হলদেটে ভাত খুঁটছে তিড়িক-তিড়িক। এ-অঞ্চলে, চৌরঙ্গিতে, জীবনের অবলম্বন বলতে বোঝায় জীবিকা। কেজো চোয়ালের হন্তদন্ত যুবকেরা বেতনভূক ভিড়ের স্বাধীনতা-উত্তর তেলচিটে আলস্যকে বাঁ-হাতে একপাশে ঠেলে-ঠেলে এগোচ্ছে।
পার্কিঙের জায়গা খুঁজছিল অরিন্দম। শাড়ি আর একজোড়া জুতো কিনতে হবে। বাটা, উডল্যান্ডস, মেসকো রয়েছে ওফুটে। দামি জুতো কেনা দরকার। জুতো দেখে লোকে চরিত্র নির্ণয় করে। গোড়তোলা ডার্কট্যান ব্যালেরিনা? স্ট্র্যাপ-দেয়া গ্রিক স্যানডাল? শাড়ি কোনটা? তাঁতের। হালকা নীল বা ফিকে বেগুনি জমি। বেগমবাহার বা কটকি হলে কেমন মানাবে। সিল্ক বোধহয় এই গরমে অচল। নয়তো কাতান বা তাঞ্চোই। নাঃ, সুতির ফিকে সবুজ ভয়েল কেমন? দোকানের কাউন্টারে যে মেয়েগুলো থাকে, তারাই বলতে পারবে, কেননা ম্যাচিং ব্লাউজ, শায়া চাই ; ওরাই সাহায্য করবে নিশ্চই।
পাপহীনতার আঁচে-মোড়া মেয়েটির বাঁ পায়ের তলায় একটা তিল নজরে পড়ে। অরিন্দমের আছে ডানপায়ে। বার্ধক্যে বেড়াতে যাবে অনেক জায়গায়। চতুর্দিক জুড়ে নিঃশব্দ রাগসঙ্গীত লাউডগার সবুজ ঘুঙুরালি শুঁড়ের মতন গজিয়ে উঠতে থাকে অরিন্দমের চারিপাশে। সিন্ধু ভৈরবী, আহিরললিত, গান্ধারি-টোড়ি, শুক্লবিলাওল, মধুমাধবী সারং, বারোয়াঁ, পলাশকাফি, তিলকশ্যাম, পটকঞ্জরি, চাঁদনিকেদার, শিবরঞ্জনী, হংসকিংকিনি, জয়ন্তীমল্লার, দুর্গাবাহার, মধুমাধবী। ভালোলাগার এই মনস্হিতির বর্ণনা নেই।
ওই দ্যাখো। তেলেঙ্গি, না?
মোটাসোটা বউ আর ব্লাউজ-শায়া পরা মেয়ের সঙ্গে, বোধহয় কেরালার, সাদা লুঙ্গি শার্ট-পরা লোকটা হকারের সাথে দরদস্তুরে ব্যস্ত। তেলেগু নয়, বলল অরিন্দম। এখন তো অন্ধ্রের উগাদি উৎসব হয়। হতেও পারে। চৈত্রমাসেই তো হয় উগাদি। অন্ধ্রের একজন মুসলমান অফিসার কাজ করত পাটনায় আমার সঙ্গে। ওর মা আর দিদি ঘাগরা আর ফতুয়া-ব্লাউজ পরত বলে, লজ্জা পেত ওর বাড়ি গেলে। সজনেপাতা দিয়ে মাংস রাঁধত।
আমিও সজিনাপাতা রাঁধতে পারি। তোমার ডিপাটে তেলেঙ্গি আছে? কুন আপিস?
ওই যে, তোমার অফিসের পাশে, এসকালেটার আছে।
কাটা ট্যাকার ব্যবসা?
হ্যাঁ, নোটের আর পয়সার ব্যবসা আমাদের। নোট ছাপি, করকরে নোট বাজারে ছাড়ি, নোংরা পচা নোট গুঁড়ো করে কাগজ বানাই। পাঁচ কিলো দশ কিলো ওজন করে ব্যাগভর্তি পয়সা বেচি।
ইশ-রে। অনেক-অনেক পাওনা পাও। আমার আপিসে লরির কাগজ বের করতে পাওনা লাগে, ওই ঠিনে বাইরের লোকজন চাপাচাপি আসে সারাদিন, কাগজ বের করার জন্য বোসথাকে, দাঁড়িয়ে থাকে একঠায়, গেলাস গেলাস চা খায়।
জানে অরিন্দম। পায়ে-মাখা ময়দার কেক খায়। বহুদূর শহর-গঞ্জ থেকে এসে খেয়ে যায় চরণামৃত। কিছুদিন আগে বেশ হইচই হয়েছিল দশ কোটি টাকার ব্যাংক ড্রাফ্ট আর এক কোটি টাকার পোস্টাল অর্ডার ওই বিভাগের আলমারিতে গুঁজড়ে রাখা ছিল বলে। সরকারি তহবিলে জমা করার জন্যে পাঠানো হয়নি। বছরের পর বছর পড়ে-পড়ে খড়খড়ে, রং-ওঠা, দোমড়ানো, ওগুলোর কথা মনে ছিল না কারোর, আশ্চর্য। কাজই করতে চায় না কেউ। অলস শুক্রকীটের ফসল বলে কিছু হয় কি? ওই নির্মম হৃদয়হীন পরিবেশে মেয়েটা কাপ আর কেটলি ঝুলিয়ে কতবার এঘর-ওঘর পাক খায় কে জানে!
অরিন্দম দেখতে পেল, ওফুটের কিনারে, বাটার দোকানের সামনে কেরালার নাম্বারপ্লেট লাগানো হলুদ মারুতি জেন গাড়িকে টো করে থানায় নিয়ে যাবার জন্যে পুলিশের লালরঙা রেকারট্রাক থেকে কয়েকজন নামল। গাড়িটার তলায় ঢুকল একজন। গিয়ারকে নিউট্রাল করে ক্রেনে ঝোলাবে।
ওরেব্বাপ। এখানে পার্ক করলে ওই গাড়িটার দশা হবে। আগেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে অরিন্দমের। সেটুকুই যথেষ্ট। প্রথম পনেরো মিনিটে ব্যাটারি আর ওয়াইপার লোপাট। তারপর এক-এক করে স্টেপনি, কার্বুরেটার, রেডিয়েটার, ফিউজ বক্স, স্টিয়ারিং বক্স, প্রপেলার শ্যাফ্ট আর তার কদিন পরে তো মেশিনটাই হাপিস। ব্যাস। শ্যাশিটাকে ঠ্যালায় চাপিয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাও। আদিত্য তো বলেই দিয়েছে, এসব ব্যাপারে ও নাচার।
রেকার-লরির পেছনে নিজের প্রিয় গাড়ির উর্ধ্বমুখী দুরবস্হা দেখে কেরালীয় লোকটা, ওর থপথপে বউ আর শায়া-ব্লাউজ পরা ঢ্যাঙা মেয়ে, তিনজনই দুহাত ওপরে তুলে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে দৌড় লাগায় ধাবমান রেকারের দিকে।
কেটলিউলির কি হাসি কি হাসি। মেয়েটির দিকে নয়, অরিন্দম তাকিয়ে থাকে ওর হাসির দিকে। অপার্থিব, অপার্থিব,অপার্থিব। দ্রুতগামী যানের মাঝে পড়ে রাস্তা পেরোতে পারছে না মালায়ালি পরিবারটা, আর তা দেখে হাসছে তো হাসছেই মেয়েটা। বিদ্যুৎবাহী হাসির অদৃশ্য প্রজাপতিরা উড়ছে গাড়ির মধ্যে। অরিন্দমের মাথা থেকে পায়ের আঙুল ওব্দি বইতে থাকে মহাজাগতিক রশ্মিতরঙ্গ।
রাস্তা পেরোতে থাকা পরিবারটিকে বাঁচিয়ে, পাশ কাটিয়ে বেরোতে গিয়ে, দ্রুতবেগে ছুটে-আসা আলুর বস্তা বোঝাই হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার মিনি ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারল অরিন্দমের গাড়ির পেছনে। প্রচণ্ড অট্টহাস্য করে ওঠে ধাতব সংঘর্ষ। আলুর চটের বস্তা ছিঁড়ে রাস্তাময় গড়ায় এলা-মাটি মাখা আলু। আরম্ভ হয় জনগণের আলু কুড়োবার উৎসব। হকার-ভিকিরি-কেরানি-দোকানি-গৃহবধু-দারোয়ান-পকেটমার-ট্যাক্সিচালক সবাই মেতে ওঠে আধ-পচা আলু সংগ্রহে।
তীব্র ধাক্কা খেয়ে অরিন্দমের গাড়ি ওদের দুজনকে সুদ্দু কিছুটা ছুটে গিয়ে রাস্তায় পড়ে-থাকা পাথরে তুলে দিয়েছে বাঁ দিকের চাকা, আর তারপরেই কাৎ হয়ে উলটে গেল। আকাশের দিকে চারটে ঘুরন্ত চাকা। গুবরে পোকার মতন দুবার পাক খেয়ে আগুন ধরে গেল গাড়িটায়। সশব্দে বিদীর্ণ হয় ডিজেল ট্যাঙ্ক আর গাড়িটা আগাপাশতলা ঢাকা পড়ে যায় তরল দগদগে আগুনে। আগুনের টোপর পরে ওলটানো গাড়ির ওপর নাচতে থাকে শিখা।