নামকরণ ও বাঙলা
নামকরণের বিশাল এলাকাটিতে বাঙলা ভাষা অনেকটা অন্তজের মতো পরিত্যক্ত। নাম থাকে ব্যক্তি বস্তু দল সংগঠন পণ্য সড়ক শহর, ও আরো বিপুল পরিমাণ বস্তুর; কিন্তু ওই সব নামে বাঙলা ভাষা ও বর্ণমালা স্থান পায় কম। মুসলমানদের নাম আরবি ফারসি তুর্কিতে রাখার একটি রীতি চ’লে আসছে কয়েক শতক ধ’রে; তবে গ্রামগঞ্জে এখনো এমন নাম— কালু মিয়া বা সোনা বিবি- পাওয়া যায়, যাতে বোঝা যায় সুমলমান নিজের নামের জন্য সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে যায় নি। ডাকনাম রাখার একটি রীতি আছে আমাদের, যাতে বাঙলা নাম- মানিক, নীলু- প্রিয় নামরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনকে দিন ধ’রেই। পাকিস্তানকালের প্রথম দিকে ডাক নামেও ঢুকে পড়ে উর্দু ও ইংরেজি; যেমন : নাজ, শেলি। কিন্তু ভাষা-আন্দোলনের পরে ডাকনামে ব্যাপকভাবে বাঙলা ব্যবহৃত হ’তে থাকে; এখন সম্পূর্ণ বাঙলা নামও পাওয়া যায়। মৌলি, উপমা, সূচনা, তৃষার, লোপা, রচনা, প্রতীক, অভীক, সেতু, মৃদুল, শোভন, জয়, রাতুল, মিথুন, কাঁকন, কণক, শৈলীর মতো অজস্র ডাকনাম পাওয়া যায়, যা আধুনিক বাঙালি পিতামাতারা সংগ্রহ করেন অভিধান, নন্দনতত্ত্ব, উদ্ভিদশাস্ত্র, সংগীতবিদ্যা, এমনকি ভারতীয় পুরাণ ঘেঁটে। ডাকনামের কোনো ব্যাকরণ নেই, সুশ্রী হ’লেই হলো। সম্ভবত পশু ও পতঙ্গ ছাড়া আর সব কিছুরই নাম মিলবে শিশুদের ডাকনামে। কিন্তু প্রধান নাম রাখতে গেলেই আসে সানিয়া গফুর, ফারহিন ইসলাম, লায়লা রহমানের মতো নাম। তবে ‘প্রজ্ঞালাবণী’র মতো সুদূর রহস্যময় নামও দুর্লভ নয়। বাঙলা ও আরবি – – ফারসি মিশিয়ে নাম রাখার প্রবণতা এখন বাড়ছে : মৌলি আজাদ, সুস্মিতা আহমেদ, উপমা আহসান-এর মতো নাম এখন পাওয়া যায়। তবে এখনো ‘অত্যাবশ্যক আহমেদ, চমকপ্রদ চৌধুরী, নন্দনতত্ত্ব রহমান, ছন্দোবদ্ধ সালাম বা দ্বান্দ্বিক হায়দার’-এর মতো ভবিষ্যদ্বাদী নাম শুরু হয় নি। মনে হচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের এক গোত্রের নামে আধখানি বাঙলা আর আধখানি আরবি-ফারসি অনেক দিন চলবে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অবস্থা কেমন : সে-সব স্থানে ইংরেজিরই প্রাধান্য। কোনো রাস্তার নামকরণ করতে গেলে আমাদের কর্তৃপক্ষের মনে পড়ে কোনো ‘নেতা’র নাম ও ‘রোড’, ‘স্ট্রিট’, ‘এ্যাভিনিউ’ শব্দ। প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে গেলেই ইংরেজি আসে; যেমন : ‘ওয়াপদা, ওয়াসা, প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি, স্টাফ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মডার্ন একাডেমি, এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেণ্ট অথরিটি, হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন, পটেটো প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন’।
বিদ্যাদানের নামে ব্যবসা শুরু করলে দরকার ইংরেজি : ‘মেরিগোল্ড কিন্ডারগার্টেন, ব্লু বার্ড কিন্ডারগার্টেন, সেইন্ট জুড টিউটরিয়াল, ল্যাবরটরি হাইস্কুল’। দোকানপাটের নামে ইংরেজিরই প্রাধান্য; তবে এ-এলাকা ব্যক্তিনামের মতোই প্রক্রিয়া চলছে। আদার দোকান থেকে জাহাজ কোম্পানির নাম হয় সাধারণত ইংরেজিতে; তবে কিছু নামে প্রথমাংশে স্থান পায় বাঙলা শেষাংশে ইংরেজি। যেমন : ‘বলাকা জুয়েলার্স, স্মরনিকা টেইলার্স, বিরতি হোটেল, শতরূপা কসমেটিকস, নীহারিকা গারমেন্টস, ছায়ানীড় কনফেকশনারি, কল্লোল ইলেকট্রনিক্স, সাগরিকা টেইলার্স, ধ্রুবতারা গ্যাস কর্ণার’। কেউ কেউ বাঙলা ভাষায়ও ইংরেজি ব্যাকরণের সূত্র চালাচ্ছে; যেমন : ‘উত্তম’স, উজ্বল’স’। পুরোপুরি বাঙলা নামও মেলে : ‘মৌসুমী বস্ত্ৰালয়, বস্ত্রবিতান, সুরপিপাসা, বৈদ্যুতিক বিতান, দেশপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, প্রজ্ঞানী সংসদ, বা কবিতা কাষ্ঠালয়’! দোকানপাটের বাঙলা নাম রাখার প্রবণতা এক সময় প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিলো, এখন ওই প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে।