তেরো বছর বয়স। মেয়ে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। কাঁদছে। কেন কাঁদছে? বাড়িতে দু’বছর হলো প্রতিদিন তাকে ধর্ষণ করছে তার বাবা, দাদা আর দুই কাকা। এ তো সবে সেদিন ঘটলো, কেরালায়। গতবছর ওই রাজ্যেই ধরা পড়েছিল এক লোক, যে তার ষোলো বছরের কন্যাকে নিজে তো ধর্ষণ করেইছে, একশ লোককে দিয়েও ধর্ষণ করিয়েছে। এমন কোনও দেশ নেই, সমাজ নেই, যেখানে পিতৃদেবের শিশু-ধর্ষণ কস্মিনকালেও ঘটে না। জরিপে দেখা যায়, শিশু-ধর্ষণের সত্তরভাগই ঘটায় পরিবারের পুরুষ, নিকটাত্দীয়। দ্বিতীয় কাতারে আছে চেনা, মুখচেনা, পাড়াতুতো কাকা-জ্যাঠা-ঠাকুরদা। অচেনা লোক ধর্ষণ করে, কিন্তু খুব কম। মনে পড়ে আমেরিকার লেখক জেন স্মাইলির উপন্যাসটির কথা,‘A Thousand Acres’! বাবার ছিল তিন কন্যার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক! কন্যা তেরোয় পড়লে শুরু করতো সম্পর্ক, ষোলো হলে রেহাই দিত, দিয়ে ষোলোর চেয়ে কম বয়সী কন্যার দিকে হাত বাড়াতো। রক্ষকরা কী যে অনায়াসে ভক্ষক বনে যেতে পারে! ঘরে পিতা ধর্ষণ করছে, বাইরে পুলিশ ধর্ষণ করছে। মেয়েদের জন্য সম্ভবত ‘নিরাপত্তা’ এখন আর অধিকার নয়, নেহাতই লাক্সারি।
বালিকা বা সাবালিকা বা নাবালিকা সব ধর্ষণই জঘন্য। বালক-ধর্ষণও ইয়াক থু। আজকাল যারা ধর্ষণ করে তারা ধর্ষণ করাটা অন্যায় জেনেই ধর্ষণ করে। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ধর্ষণের সংজ্ঞা তত পাল্টেছে। একসময় ধর্ষণকে কোনও অপরাধই বলে মনে করা হত না। শিশুর সঙ্গে বয়স্কদের যৌনসম্পর্কও ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আদিকালে ঘরে ঘরে বাল্যবিবাহ হত। অত আদিতে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই তো ন’ বছর বয়সী শিশুকে বিয়ে করেছিলেন! রাজস্থানে ধুমধাম করে প্রতিবছরই বাল্যবিবাহ হচ্ছে। কার সাধ্য বন্ধ করে? শিশু-সঙ্গমে আর শিশু-ধর্ষণে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। শরীরে যৌনতার বোধ শুরু না হতেই, নিতান্তই কৌতূহলে বা বাধ্য হয়ে শিশুরা সঙ্গমে রাজি হতেই পারে, কিন্তু সে রাজি হওয়া সত্যিকার রাজি হওয়া নয়। শিশু-পর্নো নিষিদ্ধ প্রায় সব সভ্য দেশে। কিন্তু শিশু-পর্নোর চাহিদা কিন্তু সব দেশেই প্রচণ্ড। শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, শিশুরা যন্ত্রণায় কাঁদবে, তা নয় হাসছে। একটা নকল হাসি ঝুলে আছে শিশুদের ঠোঁটে। এসব পর্নো-ছবি দেখে শিশু-ধর্ষণ করার শখ হয় পুরুষের। শিশু-ধর্ষণে ইওরোপ পিছিয়ে আছে, কিন্তু আমেরিকা আর এশিয়া অতটা পিছিয়ে নেই, দক্ষিণ-আফ্রিকায় এটি মহামারীর আকার ধারণ করায় এখন সবার ওপরে আফ্রিকা।
‘চৌদ্দ বছরের কম বয়সী, ঋতুবতী হয়নি এমন মেয়েদের প্রতি যাদের যৌন আকর্ষণ, তারা মানসিক রোগী’- এ কথা ভিয়েনার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ক্রাফ্টএবিং বলেছিলেন ১৮৮৬ সালে। তারপর নানা দেশের নানা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নানা সময়ে ক্রাফ্টএবিংএর মতকে সমর্থন করেছেন। দু’রকম শিশু ধর্ষক দুনিয়ায়। প্রথম রকম হল, সত্যিকারের শিশু ধর্ষক, শিশু ছাড়া আর কারও জন্য তাদের কোনও যৌন আকর্ষণ নেই। আরেক রকম ধর্ষকরা শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক দুজনের প্রতিই যৌন আকর্ষণ বোধ করে, যখন যাকে হাতের কাছে পায়, তখন তাকে দিয়েই কাজ চালায়। এরা ধাক্কা খেলে বা থেরাপি পেলে সোজা হয়ে যায়। তবে সত্যিকারের শিশু-ধর্ষককে সুস্থ করা সহজ নয়, তার চেয়ে ওদের মাথার খুলি খুলে মস্তিষ্কের আনাচেকানাচে লুকিয়ে থাকা দু’শ কিড়ে বার করা সহজ। নাহ, বাড়িয়ে বললাম, আসলে প্রজেস্টারন হরমোন গিলিয়ে পিডোফাইলদের যৌন আকাঙ্ক্ষার বারোটা বাজানো এমন কোনও কঠিন কাজ নয়।
‘১২ বছর বয়সী এক মেয়েকে এক পাল পুরুষ বীভৎসভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেলেছে’। -এই খবরটি ভারতীয় উপমহাদেশের নানা বয়সের, নানা শ্রেণির অর্ধলক্ষ লোককে জানাবার পর শতকরা সত্তর ভাগ বলল, ‘পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলো’। বাইশ ভাগ বলল, ‘মৃত্যুদণ্ড দাও’। আট ভাগ ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলল, ‘what about the menz?’, ‘পুরুষদেরও তো মেয়েরা ধর্ষণ করে, তার বেলা?’, ‘মেয়েটা নিশ্চয়ই পুরুষদের প্রভোক করার জন্য গায়ে কিছু পড়েছিল, বা কিছু মেখেছিল’। এদের কাছে ধর্ষণের সমাধান মূলত দুটো,- মেরে ফেলো, বা কেটে ফেলো। এ দুটো শাস্তি ধর্ষকদের দিলেই নাকি নাবালিকা ধর্ষণের ইতি ঘটে। ইতি তো ঘটেইনি, বরং আকাশ ছুঁয়েছে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হওয়ার পর পর ধর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল, মনে নেই?
যে সব দেশে নাবালিকা বা শিশু-ধর্ষণ সবচেয়ে কম, সেসব দেশে পুরুষাঙ্গ কর্তন বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নেই। তবে সেসব দেশে মেয়েদের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকার সেসব দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, সেসব দেশে মেয়েরা শিক্ষিত, মেয়েরা স্বনির্ভর, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ ছাড়াই সংসদ সদস্যের পঞ্চাশ ভাগই মেয়ে।
নাবালিকা-সাবালিকা সব ধর্ষণই বহাল তবিয়তে চলে সেসব দেশে, যেসব দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের ভোগের বস্তু, দাসি-বাঁদি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন প্রাণী, নিচুজাতের জীব ইত্যাদি হিসেবে বিচার করে; যেসব দেশে পতিতালয় গিজগিজ করছে, শত শত বাচ্চা-মেয়েকে যৌনপাচারের শিকার করা হচ্ছে; যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, স্বামীর অত্যাচার, পণের অত্যাচার, পণ অনাদায়ে খুন- এই দুর্ঘটনাগুলো প্রতিদিন ঘটছে, ঘটেই চলছে।
ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌন সঙ্গম নয়। ধর্ষণ কেউ যৌন-ক্ষুধা মেটানোর জন্য করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আরেক নাম ধর্ষণ।
ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে অথবা কী করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নটির সবচেয়ে ভালো উত্তর, ‘যেদিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সেদিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ’। কবে কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এইসব নির্যাতন তারা আর করবে না।
পিডোফাইল বা শিশু-ধর্ষক মানসিক রোগী। ওদের মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আর বাদবাকিদের আগপাস্তলা সংশোধন করার চেষ্টা করো। কী কারণে নাবালিকা ধর্ষণ করেছে, তার কারণ বার করো, সেই কারণকে নির্মূল করো। আর এদিকে সরকারবাবু তুমি যে মেয়েদের নিতান্তই যৌনবস্তু মনে করছো না, তার প্রমাণ দাও। প্রসটিটিউশান বন্ধ করো, জানোই তো যে প্রতিদিনই ওখানে অগুনতি শিশু ধর্ষিতা হচ্ছে। শিশু-পর্নো বন্ধ করো, যেহেতু এসব পর্নো লোককে শিশু-ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। রাস্তাঘাটে অফিসে আদালতে দোকান-পাটে মেয়েদের যৌন হয়রানি বন্ধ করো, বাল্যবিবাহ বন্ধ করো, পণপ্রথা বন্ধ করো, জাতপাত বন্ধ করো, মেয়েদের শিক্ষিত করো, স্বনির্ভর করো। ইস্কুলের শুরু থেকেই নারীপুরুষের সমানাধিকারের শিক্ষা সব শিশুকে দাও, দিতে থাকো। শিশুরা ভালো শিক্ষা আর ভালো পরিবেশ পেলে মানুষ ভালো হয়। ধর্ষকদের জীবন-কাহিনী ঘাঁটলে দেখা যায় বেশির ভাগেরই বিচ্ছিরি একটা শৈশব ছিল, ভালো শিক্ষা দীক্ষা বলতে কিছুই ছিল না, মারামারি দেখতে দেখতে, ঘৃণা দেখতে দেখতে, পৌরুষিক পাষণ্ডতা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। এগুলোই শিখেছে। শেখা সহজ, না-শেখা সহজ নয়। শিখে ফেলা তন্ত্র-মন্ত্র-পুরুষতন্ত্র আর নারীবিরোধী-কুসংস্কারগুলো যে করেই হোক ‘না-শেখা’ বা ‘আনলার্ন’এর ট্র্যাশক্যানে ফেলতে হবে।
দেশকে ধর্ষণমুক্ত করতে গেলে সরকারকে প্রচুর কাজ করতে হয়। প্রচুর পরিশ্রম। তার চেয়ে ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই। জনগণও খুশি হয়। তখনকার মতো সব সমস্যাকে চমৎকার ধামাচাপা দেওয়া যায়। সরকার এভাবেই মানুষকে বোকা বানায়। মানুষ বুদ্ধিমান হয়ে গেলে বেজায় মুশকিল! তখন যে কাজগুলো করলে সমাজের সত্যিকার ভালো হয়, সে কাজগুলোর দাবি সরাসরি সরকারের কাছে করে বসবে বুদ্ধিমান মানুষেরা। ওদের দাবি মেনে সমাজকে সবার জন্য নিরাপদ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে ভোট জোটানোর মতলব অাঁটবে কে? একে ল্যাং মারা, ওকে দেশছাড়া করা, গণ্ডা গণ্ডা গুণ্ডা পোষা আর যুগের পর যুগ গদিতে বসে থাকার ফন্দি অাঁটার সময় কোথায় তখন সরকারের?