নানাসাহেব – প্রমথনাথ বিশী
সিপাহি বিদ্রোহ মিটিয়া গিয়াছে কিন্তু এখনও তাহার জের চলিতেছে৷ বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে এখনও অনেকে ধরা পড়ে নাই, ভারতময় তাহাদের সন্ধান চলিতেছে, জের বলিতে ইহাই৷ দিল্লির বাদশাহ নির্বাসিত, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই সম্মুখ-সমরে নিহত, তাঁতিয়া টোপির ফাঁসি হইয়া গিয়াছে, ফৈজিবাদের মৌলবিও নিহত৷ নানাসাহেব ও তাহার দক্ষিণহস্ত আজিমুল্লা খাঁ এখনও ধরা পড়ে নাই৷ আরও একজন ধরা পড়ে নাই, সে বিখ্যাত নয়৷ কিন্তু বিবিঘরের হত্যাকাণ্ডের প্রধান দায়িত্ব নাকি তাহারই, সে নানাসাহেবের হারেমের একজন ক্রীতদাসী, নাম জুবেদি বিবি৷
নানাসাহেবকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য দিকে দিকে প্রদেশে প্রদেশে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রেরিত হইয়াছে, প্রচুর অর্থমূল্যও ঘোষিত হইয়াছে, কিন্তু এখনও তাহাকে পাওয়া যায় নাই৷ তবে পুরাদমে সন্ধান এখনও চলিতেছে, দক্ষিণে মাদ্রাজ, উত্তরে নেপাল, পূর্বে আসাম আর পশ্চিমে সীমান্ত প্রদেশ চষিয়া ফেলা হইতেছে, নানাসাহেবকে ধরিতেই হইবে৷
মাঝে মাঝে রব ওঠে নানাসাহেব ধরা পড়িল৷ ধৃত ব্যক্তিকে কানপুরে আনা হইলে পরীক্ষা ও প্রশ্ন করিয়া দেখা যায় যে, সে নিরীহ সন্ন্যাসী বা ফকির মাত্র৷ নানা দেশ হইতে গুপ্তচরেরা আসিয়া বলে যে, নানাসাহেবকে দেখা গিয়াছে, কখনো মন্দিরে, কখনো মসজিদে, কখনো হাটে-বাজারে গঞ্জে গ্রামে বা কোনো রেলস্টেশনে৷ কিন্তু ‘ওই বাঘ, ওই বাঘ’ রব এতবার উঠিয়াছে যে ওইরূপ সংবাদে এখন আর কেহ বিচলিত হয় না৷ বস্তুত এখন অনেকেই বিশ্বাস করিতে শুরু করিয়াছে যে, নানাসাহেব মারা গিয়াছে৷ নানাসাহেবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তিনটি মত দাঁড়াইয়াছে৷ কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির ধারণা যে নানাসাহেব ১৮৬০ সালে নেপাল বা নেপালের তরাই অঞ্চলে মারা গিয়াছে৷ তাহারা বলে যে, ওই সময়ে নানার যে সঙ্গীগণ নেপাল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে, তাহাদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই সিদ্ধান্ত পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের মিথ্যা বলিবার কী হেতু থাকিতে পারে? এই সব সঙ্গীর মধ্যে নানার নাপিত অন্যতম৷ তাহাকে নানার মৃত্যু বিষয়ে প্রশ্ন করিলে এইরূপ উত্তর পাওয়া যাইত :
-‘তুমি নানাকে কামাতে?’
-‘কাকে কামাতাম?’
-‘নানাকে?’
-‘ওঃ সেই বাটপাড়কে! হাঁ বাটপাড়কে কামাতাম বটে!’
-‘সপ্তাহে ক-বার?’
-‘সপ্তাহে দু-বার৷ বাটপাড়!’
-‘এখন আর নিশ্চয় তার কামাবার দরকার নেই৷ সে নিশ্চয় মরেছে, কী বলো?’
-‘মরছে বলে মরেছে, এক-শোবার মরেছে৷ খুব ভালো হয়েছে৷ বাটপাড়টা!’
নানা মারা পড়িয়াছে কি না তবু সংশয়ের রাজ্যে থাকিয়া যায়, কিন্তু কৃতজ্ঞতা যে মারা পড়িয়াছে সে বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না৷ মানুষ এমনি বটে!
আর এক দলের লোক বলে নানা মরুক আর বাঁচিয়াই থাকুক তাহাতে এখন আর আশঙ্কার কিছুই নাই, সে পলাতক আসামি, দেশে তাহার আর প্রভাব নাই৷ অতএব তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য এত প্রচুর খরচ করিবার প্রয়োজন কী?
তৃতীয় দলটিই সংখ্যায় ও প্রভাবে প্রবল৷ তাহাদের অধিকাংশই সরকারি কর্মচারী৷ এই উপলক্ষে তাহারা প্রচুর বেহিসাবি টাকা ও রাহা-খরচ পায়৷ তাহাদের বিশ্বাসের অনুকূলে এ মস্ত একটা যুক্তি৷ তার উপরে আবার বিলাত হইতে একদল মোটা-বেতনের বিশেযজ্ঞ আসিয়াছে, তাহাদের কেহ হাতের অক্ষরে বিশেযজ্ঞ, কেহ নাকের আকৃতিতে, কেহ চোখের দৃষ্টিতে, কেহ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে, কেহ বা পদচিহ্নে বিষেষজ্ঞ৷ এখন সরকার ভাবে, ‘নানা মরিয়াছে’ স্বীকার করিলে ইহাদের বিদায় করিয়া দিতে হয়, যে প্রচুর পুলিশ ও গুপ্তচর ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে তাহাদের দল ভাঙিয়া দিতে হয়, সে এক হাঙ্গামা, হয় তো বা পার্লামেন্টে প্রশ্নোত্তরে ভারত সরকারের অকর্মণ্যতা ঘোষিত হইবে; তাই সরকার নীরব, ভাবে ‘অশুভস্য কাল হরণং’, নানা মরুক আর বাঁচিয়া থাকুক তাহারা না মরিলেই যথেষ্ট৷
ভারতের নানা স্থানে নানাকে ধরিবার জন্য বিদেশি ঘাঁটি বসিয়াছে, কোনো লোক ধরা পড়িবামাত্র সে কানপুরে আনীত হয়; দেশময় যে শত শত নানাসাহেব ধৃত হইয়াছে তাহাদের আসল-নকল বিচার করিয়া মুক্তি দানের বা হাজতবাসের আজ্ঞা দানের একটি ক্লিয়ারিং হাউসে পরিণত হইয়াছে কানপুর শহর৷ এত শহর থাকিতে কানপুর শহর নির্বাচিত হইবার বিশেষ কারণ আছে৷ কানপুরের কাছে বিঠুরে নানা দীর্ঘকাল ছিল, এ অঞ্চলের বহু লোকের কাছে নানা পরিচিত, তা ছাড়া কানপুর শহরটা বিদ্রোহ-পীড়িত অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত, সেটাও একটা কারণ বটে৷
কানপুর শহরের প্রকাণ্ড জেলখানা যেমন নানা শ্রেণির নানাসাহেবে ভরিয়া গিয়াছে তেমনি মামুদের হোটেল নামে শৌখিন হোটেলটিও বিশেষজ্ঞ, উচ্চ শ্রেণির কর্মচারী, কৌতূহলী ইংরাজ অতিথি অভ্যাগতে পূর্ণ৷ হোটেলের মালিক মামুদ আলি হাসিখুশি মুখ, গোলগাল সুপুরুষ নানাকে বেশ চিনিত, কেননা বিদ্রোহের সময়ে নানা কয়েক মাস এই হোটেলেই আশ্রয় লইয়াছিল৷
কোনো বিদেশি অতিথি যদি শুধাইত,’নানা কি হোটেলের খানা খেত?’
‘বিসমিল্লা,’ বলিয়া মামুদ আলি কপালে হাত ঠেকাইয়া বলিত, ‘হোটেলের খানা! সর্বনাশ ও-কথা মুখেও আনবেন না, কে কোথায় শুনতে পাবে!’
-‘তবে খেত কী?’
-‘এই ঘরটায় আসুন৷ এখানে নানার জন্য চুল্লি প্রস্তুত হয়েছিল, তাতে হাঁড়ি চাপিয়ে হাঁড়ি মানে earthen pot . . .’
-‘ঃও৷ তার প্রিয় খাদ্য কী ছিল?’
-‘ঘি, মানে clarified butter; আর এই ঘরটায় একটা চারপায়া পেতে নানা শুত৷’
-‘ঘরে আর কোনো আসবাব ছিল?’
-‘আসবাব? না৷ হাঁ, তবে একটা বাছুর ঘরময় অবাধে ঘুরে বেড়াত, আর একটা চাকর সোনার বাটিতে করে তার চোনা, মানে-‘
মানে শুনিয়া সাহেবরা বলিয়া উঠিত, how horrible! তারপরে শুধাইত, ‘সেটা কী করত?’
-‘খেত৷’
সাহেবগণ চমকিয়া উঠিত, ইংরাজি ভাষায় মনোভাব প্রকাশের যোগ্য শব্দ না পাইয়া তাহারা অবিলম্বে গৃহত্যাগ বরিত৷ কেহ কেহ আবার মনে মনে যুক্তিজাল বুনিয়া স্থির করিত উক্ত বস্তু যখন খায় তখন উক্ত বস্তুর আধারটিকেও অবশ্য খাইত৷ কোনো কোনো দুঃসাহসী ভাবিত একবার গোপনে উক্ত বস্তুটা চাখিয়া দেখিতে হইবে৷ নানা কি খামোকা খাইত, তাহার তো অভাব ছিল না, সে ভাবিত দেশে ফিরিয়া এ বিষয়ে একখানা বই লিখিয়া ফেলিবে, প্রকাশকের অভাব হইবে না, এখন নানাসাহেবের বাজার-দর চড়া৷
নানান সম্বন্ধে সাহেবগণের মনোভাব যেমনি হোক, হোটেলের মালিক মামুদ সম্বন্ধে তাহাদের অনুকম্পার অন্ত ছিল না৷ সে প্রত্যেকের রুচি অনুযায়ী খানা জোগাইত, মদ জোগাইত ‘অমুক জিনিসটা পাওয়া গেল না’ এ কথা কেহ তাহার মুখে শোনে নাই, বিল আদায় করিতে, ফাইফরমাস খাটিতে সে সর্বদাই প্রস্তুত, আর তার সবচেয়ে বড়ো গুণ, সে সময়মতো হাসিতে পারে৷ এ গুণটি যার আয়ত্ত, সংসারে সে সর্বজয়ী৷ সর্বজয়ী এই গুণটির বলেই বেতসীবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে কোম্পানির আমলে হোটেল চালাইয়াছে, নানার আমলে চালাইয়াছে এবং খাস মহারানির আমলে চালাইতেছে, কেহ কখনো তাহার সততায় সন্দেহ মাত্র প্রকাশ করে নাই৷ মামুদ হাসিয়া বলে, ‘হোটেলওয়ালা, জল্লাদ ও টেবিল-খানসামা বা waiter-এর সম্বন্ধে বাছবিচার করলে চলে না৷’
হোটেলের হেড ওয়েটারটি সম্বন্ধে মামুদ সার্থক গর্ব অনুভব করিত, বলিত, ওই যে বিঠুরের ইঁদারার মধ্যে নানাসাহেবের একরাশ সোনার তৈজসপত্র পাওয়া গিয়াছে, সেগুলোর বদলেও সে ইসাককে ছাড়িতে নারাজ৷ ইসাক তাহার প্রখ্যাত হেডওয়েটার৷ সে যে কোথা হইতে আসিল, কী তাহার পূর্বেতিহাস কেহ জানিত না, কেহ জিজ্ঞাসাও করিত না, যাহারা জিজ্ঞাসা করিবার মালিক তাহারা সকলেই ইসাকের গুণে মুগ্ধ৷ মুখ খুলিবার আগেই সে মনের কথা বুঝিতে পারে, আবার এমন মনের কথা আছে কন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই ইসাক তাহা তামিল করিয়া বসে৷ দিন এবং রাত্রির যাবতীয় পরিচর্যায় ইসাক এমনি পারঙ্গম যে, সাহেব-বিবি অতিথি-অভ্যাগত দেশি-বিদেশি সকলেরই মুখে এক কথা, ইসাক, ইসাক৷ খানসামাসুলভ চাপকানে সজ্জিত, মাথায় টুপি, খা খালি এবং মুখে হোটেলের মালিকের মতোই সর্বজয়ী হাসি৷ তবে মামুদের ও ইসাকের হাসিতে কিছু প্রভেদ ছিল৷ মামুদ সকলকে দেখিয়া সমান হাসি হাসিত, কিন্তু ইসাকের হাসিতে তারতম্য ছিল, লোকের পদমর্যাদা বিচার করিয়া সে হাসত; কাহারও জন্য তাহার ওষ্ঠাধরে হাসির মোহর, কাহারও জন্য হাসির টাকা; কাহারো জন্য বা হাসির আধুলি বা সিকি দুয়ানি, নিতান্ত হীনমর্যাদার জন্য পয়সা বা পাই, কেহই একেবারে বঞ্চিত হইত না৷
মামুদের হাসি বলিত, তোমরা সকলেই আমার অতিথি, আমার চোখে তোমরা সবাই সমান, আর ইসাকের হাসি বলিত সকলকে সমান করিলে আমার চলে না, কে বেশি দামের খদ্দের, কে কম দামের, কে জেনারেল, কে কর্নেল, কে মেজর আমার জানা চাই; বস্তুত মামুদের হাসি ও ইসাকের হাসি পরস্পর পরিপূরক৷
আরও একটি কারণে সরকারি মহলে ইসাকের খুব প্রতিপত্তি ছিল৷ সে নানাসাহেবকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনিত, সে ছিল সরকারি সনাক্তকারী৷ এই যে নানাদেশ হইতে শত শত নানা আসিয়া জেলখানা ভরিয়া তুলিতেছে কে তাহাদের সনাক্ত করিবে? নানাকে যাহারা ঘনিষ্ঠভাবে জানিত তাহারা হয় মরিয়াছে, নয় পালাইয়াছে, নয় অন্য কারণে সনাক্তকার্যে অসম্মত৷ এই সংকটে ইসাক একমাত্র রক্ষাকর্তা৷ সে দীর্ঘকাল বিঠুরে ছিল, কানপুর শহরেও সে কতবার নানাকে দেখিয়াছে, কাজেই সে-ই যোগ্যতম ব্যক্তি৷ খানা ও মদ রুচিমতো যে ব্যক্তি জোগান দিতে সক্ষম, সে বিশ্বাসভাজন না হইয়া যায় না, আর বিশ্বাসভাজনের সব কথাই সমান বিশ্বাসযোগ্য৷ সপ্তাহে একদিন ইসাকের ডাক পড়িত জেলখানায় সনাক্তকরণের প্যারেডে৷ সে গিয়া দেখিত এমন হাজার দুই নানা সারিবদ্ধ দণ্ডায়মান; বয়স বাইশ হইতে বিরাশি, মাথায় চার ফুট হইতে সাত ফুট, জাতিতে বাঙালি হইতে পাঠান-আর সবচেয়ে বেশি সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকিরের সংখ্যা৷ যে গেরুয়া এবং যে আলখাল্লায় জীবনের অনেক দুষ্কৃতি ঢাকা পড়ে, চিত্রগুপ্তের চোখে ধুলি দেওয়া যায়, সেই পোশাকেই তো আত্মগোপনের শ্রেষ্ঠ উপায়, তাই সম্ভবতই সাধু-সন্ন্যাসী আর পির-ফকিরের সংখ্যাই কিছু অধিক৷ ইসাক সারিবদ্ধ নানাদের সম্মুখ দিয়া সবেগে চলিয়া যাইত, তারপরে অদূরে দণ্ডায়মমান জেনারেল সাহেবের নিকটে আসিয়া সেলাম করিয়া বলিত, ‘হুজুর তামাম ঝুটা৷’
সাহেব জেলারের প্রতি ইঙ্গিত করিত, বলিত ‘খালাস দো৷’
নানার দল ছুটি পাইত৷ কিন্তু জেলখানা কখনো খালি হইত না, কারণ বাল্যকালে যাহারা চৌবাচ্চার অঙ্ক কষিয়াছে তাহারা জানে এক নলে জল বাহির হইতেছে, আর এক নলে জল ঢুকিতেছে, ফলে চৌবাচ্চা যেমন পূর্ণ তেমনি পূর্ণই থাকিত৷ আর একদল নূতন নানা আসিয়া জেলখানা ভরিয়া তুলিত৷
আর এক কারণে সাহেব-মহলে ইসাকের ডাক পড়িত৷ বিদেশি আসিয়া নানার কাহিনি শুনিতে চাহিলে ইসাক ছাড়া আর কে শুনাইবে? একদিনের কথা বলি৷ সেদিন দুই জন বিদেশি অতিথি আসিল, একজনের নাম মঁশিয়ে লুবলিন, সে ফরাসি; আর একজনের নাম মিস্টার জর্জ৷ সে ইংরাজ৷ দু-জনেই দেশে থাকিতে পুস্তকে ও পত্রিকায় নানার কাহিনি পড়িয়াছে৷
ড্রয়িংরুমে বসিয়া লুবলিন ও জর্জে নানার বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল, অদূরে বিনীতভাবে ইসাক দণ্ডায়মান৷ সে একবার মঁশিয়ের দিকে তাকাইয়া হাসে, আর একবার মিস্টারের দিকে তাকাইয়া হাসে, মিস্টারের প্রতি প্রযুক্ত হাসিটি প্রশস্ততর, কারণ যদিচ হোটেলের অতিথি হিসাবে দু-জনেই সমান আদরণীয়, তবু মিস্টার যে রাজবংশীয়, তাহার রাজপ্রাপ্য তো মঁশিয়ের সমান হইতে পারে না৷
মঁশিয়ে বলিতেছে, ‘মিস্টার, নানা সম্বন্ধে আমার ধারণা কী জানেন? কাশ্মীরি ঢিলা পোশাক গায়ে, পার্শিয়ান চটি পায়ে গদির উপরে গড়াচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে দু-জন খাপসুরৎ মেয়ে ময়ূরপুচ্ছের পাখা দুলিয়ে বাতাস করছে, আর বালজাকের Droll Stories পড়বার ফাঁকে ফাঁকে পায়ের কাছে অর্ধশায়িত অর্ধনগ্ন ইরানি মেয়ে দুটোকে মাঝে মাঝে সে চিমটি কাটছে৷ এমন সময়ে একজন সিপাহি সঙিনের ডগায় বিঁধিয়ে নিয়ে এল একটা ইংরাজ শিশুকে, সেটাকে দেখবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই তাঁর কোলের মধ্যে থেকে একটা মিশরীয় বেড়াল লাফিয়ে পড়ল, ছেলেটাকে ভালো করে দেখবার জন্যে সে নাক-টেপা চশমাটা পরে নিল, তাড়াতাড়ি উঠবার সময়ে সেটা খুলে পড়ে গিয়েছিল৷’
মঁশিয়ে ইসাকের দিকে তাকাল, ইসাক মাথা নত করে একবার হাসল৷
কিন্তু জর্জের সেরকম মনোভাব নয়৷ সে বলল, ‘মঁশিয়ে, নরকের সেই কীটটা সম্বন্ধে আমার ধারণা অন্যরকম৷ কীরকম বলব!-Guy Fawke’s Dayতে Guy Fawkes-এর যে মূর্তিটা আমরা দাহ করে থাকি অনেকটা তারই মতো Nana-র (মিস্টার কৃত উচ্চারণ ন্যান্যা) চেহারা, তবে আরও ভীষণ কেননা, প্রাচ্যদেশের চেহারা স্বভাবতই কুৎসিৎ৷ তার মাথাটা প্রকাণ্ড একটা হাঁড়ির মতন, লেখাপড়া কিছুই জানে না, কোনো অনুচরের উপরে রেগে গেলে তখনই পদাঘাতে তাকে নিকেশ করে ফেলে, আর তার প্রিয় খাদ্য শিশুদের লিভার৷ আর রোজ রাত্রিবেলা সে কুমারী মেয়ের হৃৎপিণ্ডের চাটনি খায় স্বাভাবিক শক্তি অর্জনের আশায়! Oh, a veritable monster!’
মিস্টার ইসাকের দিকে তাকাইবামাত্র ইসাক মাথা আরও একটু নত করিয়া প্রশস্ততর একটি হাসি হাসিল৷
কিন্তু মিস্টার মঁশিয়ে নয়, হাসির প্রকৃত মূল্য না দিয়াই সে বলিয়া উঠিল, ‘a peg!’
মিস্টার নিজের বর্ণনার চাপে নিজেই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল৷
দু-টি পেগ মিস্টার ও মঁশিয়ের যথাস্থানে গমন করিলে মঁশিয়ে বলিল, ‘ইসাক, তুমি তো জানতে নানাকে, বলো তো সে কেমন ছিল!’
ইসাক দু-জনের দিকে তাকাইয়া দু-বার হাসি লইয়া আরম্ভ করিল, ‘সাহেব, আপনাদের কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাস্তব পারবে কেন? যেসব গুণের আপনারা উল্লেখ করলেন হতভাগ্য নানার সে-সব কিছুই ছিল না৷ সে নিতান্ত সাদামাঠা লোক, বেঁচে থাকলে বয়স এতদিন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝে হত, রং কালো, কারণ যেসব লোক ইউরোপের বাইরে জন্মেছে আপনাদের চোখে তারা সবাই কালো, মোটাসোটা দোহারা চেহারা৷ খেত চাপাটি আর ডাল, তা-ও আবার অনেক সময় স্বহস্তে তৈরি করে৷ তার হারেমে অবশ্য অনেক স্ত্রীলোক ছিল, কিন্তু সেটা তাদের অন্যত্র যাবার ইচ্ছার অভাবে৷ ফরাসি ভাষা দূরে থাক, ইংরাজি ভাষাও জানত না বললেই হয়৷ আর নাক-টেপা চশমা! তার এজেন্ট আজিমুল্লা খাঁর একজোড়া কানে পরানো চশমা ছিল বটে!’
এই বলিয়া সে মিস্টার ও মঁশিরেয় দিকে তাকাইয়া হাসিল, ভাবটা এমন যে, আপনাদের বর্ণনাই ঠিক৷
মঁশিয়ে বলিল, ‘হাউ ট্রুথফুল অর্থাৎ, তোমার বর্ণনা শুনে মনে হয়, সে ছিল তোমার মতোই দেখতে৷’
মিস্টার বলিল, ‘All orientals are liars অর্থাৎ নিশ্চয় সত্য গোপন করবার চেষ্টা করছ৷’
ইসাক দু-জনের কথাতেই এমনভাবে হাসিল, যেন বলিল, আপনারা দুজনেই সমান সত্য কথা বলিয়াছেন৷
এমন অপরিসীম ধৈর্য, কৌশল, মানব-চরিত্রজ্ঞান ও বুদ্ধি ইসাকের, মামুদের কথাই ঠিক, তুচ্ছ সোনার দামে ইসাকের দাম! সত্যই ইসাকের তুলনা হয় না৷
২
১৮৬৭ সালে উত্তর ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল৷ তাহার একটি বাস্তব ফল হইল যে, নানাসাহেবের সংখ্যা অনেক গুণ বাড়িয়া গেল৷ আগে আসামি খুঁজিয়া বেড়াইতে হইত, এখন আসামি সরকারি লোক খুঁজিয়া বাহির করিয়া ধরা দেয়৷ আগে সাধু-ফকিরের সংখ্যাই বেশি ছিল, এখন গৃহীর সংখ্যাও বাড়িয়া উঠিল৷ গৃহীর খাদ্যাভাব, সাধু-ফকিরের ভিক্ষার অভাব৷ সকলেই জানে যে হাজতে রাখিলে খাইতে দেয়, আরও শুনিয়াছে যে, একবার আসামি বলিয়া সনাক্ত হইতে পারিলে পুলিপোলাও চালান হইবে তখন আর খাওয়া-পরার চিন্তা করিতে হইবে না৷ সকলেই ভাবে, আহা সৌভাগ্য কি হইবে, যে পোড়া কপাল!
একদিন সকালে সীতাপুর থানায় জনকয়েক নানা আসিয়া উপস্থিত হইল, হাঁকিল, ‘কইগো দারোগা সাহেব, আমাকে গ্রেপ্তার করো, আমি নানাসাহেব,’ দারোগা আসিয়া দেখিল অনেকগুলি উমেদার৷ সে বলিল, ‘একসঙ্গে এতজন তো নানা হতে পারে না৷’
‘নইলে নানা বলেছে কেন? একজন হলে তো একখানা বলিত৷’
দারোগা খোঁজ করিয়া জানিল যে, লোকটা পাঠশালার পণ্ডিত৷ বলিল, ‘নইলে আর অমন বুদ্ধি হয়!’
-‘তোমার অত বিচারের কাজ কী! তুমি সকলকে চালান দাও, যার ভাগ্যে আছে নানাসাহেব হবে৷’
দারোগা বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘গ্রেপ্তার করতে নিষেধ আছে৷’
পাঠশালার পণ্ডিত বলিল, ‘ও বুঝেছি, কেউ বুঝি দু-পয়সা খাইয়েছে৷’
-‘দেখো ও-সব কথা বললে আইনে পড়বে৷’
-‘আরে সেই ভরসাতেই তো বলছি৷ যেকোনো একটা ধারায় গ্রেপ্তার করো৷’
দারোগা কী করিবে ভাবিতেছে এমন সময়ে এক দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বিশুদ্ধ দেবভাষায় বলিল, ‘অয়ম অহম ভো’-অর্থাৎ ‘আমি নানাসাহেব, গ্রেপ্তার করো৷’
-‘বটে? সন্ন্যাসীর কি এমন হাতের গুলি হয়?’
এই বলিয়া বাহুর গুলি পাকাইয়া দারোগার দিকে অগ্রসর হইয়া গেল, বলিল, ‘টিপিয়া দেখো, হাতের গুলি, না লোহার গুলি৷’
দারোগা বলিল, ‘আমি কী করব ঠাকুর, এরাও যে উমেদার,’ এই বলিয়া গৃহীদের দেখাইয়া দিল৷
তখন ‘তবে রে শালে বুরবক,’ বলিয়া সেই বলিষ্ঠ সন্ন্যাসী লাঠি তুলিয়া গৃহীদের তাড়া করিল, তাহারা সামান্য গৃহী মাত্র, প্রাণের দায়ে নানাসাহেব পদের উমেদার, প্রাণের মায়া এখনও সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে পারে নাই৷ তাহারা পলাইল৷
তখন সন্ন্যাসীর অনুকূলে নানাসাহেবের পদ সাব্যস্ত হইয়া গেল৷ থানার বারান্দায় সে দিব্য জমাইয়া বসিয়া গম্ভীরভাবে দারোগাকে আদেশ করিল, ‘এ বেটা আভি নানাসাহেবকো খিলাও৷’
উত্তর ভারতের প্রায় প্রত্যেক পুলিশ থানাতেই প্রত্যহ এমন দৃশ্যের অভিনয় হইত৷ আর এই সব নানার ধারা যে মহাসমুদ্রে গিয়া মিলিত হইত সেই কানপুর শহরের দৃশ্য উপভোগ করা সহজ হইলেও বর্ণনা করা সহজ নয়৷ জেলখানার নিকটবর্তী পাঁচ-সাতটি বড়ো বড়ো বাড়ি ভরতি হইয়া গিয়া এখন মাঠে তারের বেড়া খাটাইবার ব্যবস্থা হইয়াছে৷ তাহা দেখিয়া নানার দল জেনারেল সাহেবকে বলিয়া পাঠাইয়াছে, ‘ও খরচাটা নাই করিলেন, আমরা পলাইবার জন্য আসি নাই৷’ তাহারা আরও বলিয়া পাঠাইয়াছে যে তাহারা মহারাষ্ট্র রাজ্যের পেশবা, কাজেই আহারাদির সেই অনুপাতে ব্যবস্থা করা ব্রিটিশ রাজ্যের পক্ষে উচিত হইবে, পেশবা এখন গদিচ্যুত হইলেও এক সময়ে রাজা তো ছিল বটে৷
জেনারেল সাহেব জেলারকে ডাকিয়া শুধাইল, হঠাৎ নানার সংখ্যা বেড়ে উঠবার হেতু কী?
জেলায় বলিল, ‘এতদিন সরকারি মেশিন বেশ চালু হয়েছে কিনা?’
জেনারেল সাহেব বলিল, ‘হুম!’ জেলারের খাস মুন্সি মুখুজ্জে বলিল, ‘সাহেব, খানা বন্ধ করে দিন, নানার দল পালাবে৷’
জেলার বলিল, ‘তা কেমন করে হয়? সনাক্তকরণ না হলে কাউকে ছাড়তে পারিনে৷’
পরিবর্তিত অবস্থায় এক সপ্তাহে তিন দিন সনাক্তকরণ হয়, ইসাকের কাজ খুব বাড়িয়া গিয়াছে৷
সেদিন ভোর বেলা সনাক্তকরণ আরম্ভ হইয়াছে৷ জেনারেল সিভিল সার্জেন্ট, ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ সুপার ও বিশেষজ্ঞগণ হাজির আছে৷ জেলার ও ইসাক সনাক্তকরণে অগ্রসর হইয়াছে৷
ইসাক একটা লোকের কাছে একটু থামিতেই তাহার মুখ আশায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল৷ সে বলিল, ‘আমিই, মিয়া সাহেব, আমি৷’
-‘তুমি কি বিবিদের হত্যা করেছিলে?’
-‘নিশ্চয়ই৷ এখন চালান না দিলে অঃতপর বাবাদেরও সাবাড় করব৷’
-‘না! তুমি নও৷’
তাহার দাবি অগ্রাহ্য হইল জানিবামাত্র লোকটি বুক চাপড়াইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া-‘মহারানির দোহাই লাগে জেলার সাহেব আমি সেই বাংলা মুল্লুক থেকে আসছি৷ মামলায় আর বন্যায় আমি সর্বস্বান্ত হয়েছি৷ রেলগাড়িতে টিকিট কিনবার পয়সা অবধি ছিল না, নানা বলতেই চেকারবাবু ছেড়ে দিলে৷ বড়ো ভরসা করে এসেছি সাহেব, এখন তোমরা ঠেললে দাঁড়াই কোথায়?’
পাশেই জনকতক বরখাস্ত বাঙালি উমেদার ছিল৷ তাহারা বলিল, ‘কান্নাকাটির যুগ নয় ভাই, সঙ্গে সঙ্গে গণবিক্ষোভ করি, অমনি ঢোলের সঙ্গে কাঁসির মতো দু-চারজনের প্রায়োপবেশন করাও সংগত হবে৷’
একজন বলিল, ‘আহা, আর কাঁসির সঙ্গে সানাইয়ের মতো একখানা সংবাদপত্র থাকলে আজ কী দু-শো মজাই না হত৷’
অপর একজন বলিল, ‘দেখতাম কেমন ওরা বাংলাদেশের দাবি অগ্রাহ্য করে৷’ তখন তাহারা সকলে মিলিয়া, ‘বাংলার দাবি মানতে হবে, অবাঙালি নানা চলবে না,’ প্রভৃতি আওয়াজ করিতে করিতে প্রস্থান করিল৷ ইতিমধ্যে সনাক্তকরণ অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছে, যাহাদের দাবি অগ্রাহ্য হইতেছে তাহারা নীরবে বিষণ্ণভাবে চলিয়া যাইতেছে, বাঙালি নয় বলিয়া গণবিক্ষোভ বাধাইতে না৷
এমন সময় একজায়গায় গোলমাল বাধিয়া উঠিয়াছে দেখিয়া ইসাক অগ্রসর হইয়া দেখিল যে, একজন মুসলমান ফকির ও একজন হিন্দু সন্ন্যাসীতে দাঙ্গা বাধিয়া গিয়াছে৷ ফকির বলিতেছে যে, সে নানাসাহেব আর হিন্দু বলিতেছে যে, সে নানাসাহেব৷ আর উভয়পক্ষে কিল, ঘুসি চলিতেছে৷ ভাগ্যে তখন সমাজচৈতন্য এখনকার মতো প্রবল হইয়া ওঠে নাই নতুবা একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়া যাইত৷
ইসাক বলিল, ‘বাপু তোমরা কেহই তো নানাসাহেব নও৷’
-‘বলি চোখের মাথা কি খেয়েছ? দেখতে পাও না?’
-‘আমি নানাসাহেব নই বলে কি তোমার বাপ নানাসাহেব?’
ইসাক বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘স্বীকার করছি বাপু আমিই নানাসাহেব৷ এবার হল তো?’
-‘চাঁদ আর কি! নানাসাহেব তো হয়ে এসেছ সনাক্ত করতে৷’
-‘সে বিষয়ে নানাসাহেবই তো সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি৷’
জেলার সাহেব কাছেই ছিল৷ সে ‘ডেশি বাষা উট্টমরূপে শিকসা’ করিয়াছে; ইসাকের wit দেখিয়া তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘বহুৎ আচ্ছা৷’
-‘তবে রে বেটা অলপ্পেয়ে৷ দাবিদার দুইজনেও ইসাকের পিঠ চাপড়াইতে অগ্রসর হইল, তবে তাহার রকমটা ভিন্ন৷’
তাহারা দুই জনে একসঙ্গে আক্রমণ করিল৷
-‘বল আমি নানাসাহেব৷ দেশে ভাত ভিক্ষে মেলে না আবার বলে কিনা নানাসাহেব নই৷ ‘ অপরে বলিল, ‘আমার চোদ্দোপুরুষ নানাসাহেব৷’
ইসাক প্রহৃত হইয়া পলায়ন করিল৷ সেদিনের মতো সনাক্তকরণ প্যারেড শেষ হইয়া গেল৷
সন্ধ্যা বেলায় ইসাক জেনারেল সাহেবকে বলিল, ‘হুজুর আমাকে এবার ছুটি দিন৷ এমন করে মার খেতে আর পারিনে৷’
-‘বল কী ইসাক! তুমি না থাকলে নানাকে ধরব কী করে? দেখছ তো সরকার কত খরচা করছে৷ না, না, তোমাকে কিছুতেই ছুটি দেওয়া চলবে না, তারচেয়ে তোমার সঙ্গে দু-জন পাঠান বডিগার্ড দেব৷’
এই ঘটনার কয়েক দিন পরে একদিন সন্ধ্যার সময় একজন ভদ্রলোক ও একজন স্ত্রীলোক মামুদের হোটেলে ঢুকিয়া ডাইনিং কক্ষে গিয়া বসিল৷ ভদ্রলোকটির পরনে সাহেবি পোশাক, আর স্ত্রীলোকটির পরনে মেম সাহেবের পোশাক৷ গায়ের রং দেখিলে তাহাদের পুরা ইংরাজ মনে হয় না, হয়তো-বা ইউরোপিয়ান হইবে৷
ভদ্রলোক বলিল, ‘তোমার পরামর্শে এলাম, এখন বিপদে না পড়ি৷’ স্ত্রীলোকটি বলিল, ‘ইসাকের চোখে পরীক্ষা না হলে বুঝব কেমন করে? এ বিষয়ে ওই লোকটাই তো বিশেষজ্ঞ৷ দেখো না সরকার ওকে কত যত্ন করে পুষছে৷’
-‘যদি ধরে ফেলে?’
-‘পাগল নাকি৷ আমি বলছি ধরতে পারবে না৷ মেয়েদের অশিক্ষিতপটুত্বের খ্যাতি শোনোনি কি? তা ছাড়া বিপদের ভয় তো আমারও আছে৷’
-‘আচ্ছা তাহলে ওকে ডাকি৷’
পুরুষটির আহ্বানে ইসাক আসিলে দু-জনের মতো খাবার আনিতে হুকুম করা হইল৷
ইসাক সেলাম করিয়া খাবার আনিতে গেল৷
-‘দেখলে তো ধরতে পারেনি৷’
-‘তাইতো মনে হচ্ছে৷’
ইসাক খাবার আনিল৷ দু-জনে হৃষ্ট মনে খাইল৷ তারপরে দাম চুকাইয়া দিয়া কিছু বখশিশ দিল পুরুষটি৷
ইসাক সেলাম করিয়া বলিল, ‘সেলাম আজিমুল্লা খাঁ৷’
বলে কী৷ শুনিবামাত্র পুরুষ ও স্ত্রীলোকটির মুখ শুকাইয়া গেল৷
পুরুষটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেও স্ত্রীলোকটি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বলিল, ‘যাও দু-পেগ মদ নিয়ে এসো৷’
সে চলিয়া যাইবামাত্র পুরুষটি বলিল, ‘বলেছিলাম ধরে ফেলবে৷ চলো এখুনি পালাই৷’
স্ত্রীলোকটি বলিল, ‘লোকটা সারাদিন ওইসব নাম ভাবছে, তাই ভুলে বলে ফেলেছে৷ দেখব এর পরে হয়তো নানাসাহেব বলেই সেলাম করে ফেলবে৷ তা ছাড়া পালাবেই-বা কোথায়? হোটেলের বাইরেও তো ইংরাজের রাজত্ব৷’
এমন সময় ইসাক দু-পেগ মদ লইয়া আসিল৷
দু-জনে পান করিল৷ এবারে মেয়েটি দাম চুকাইয়া দিয়া বখশিশ দিল৷
ইসাক সেলাম করিয়া বলিল, ‘সেলাম জুবেদি বিবি৷’
নাঃ, আর সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নাই৷ ইসাক দু-জনকেই চিনিয়া ফেলিয়াছে৷ ভয়ে তাহাদের মুখ পাংশু ও জিহ্বা শুষ্ক হইয়া গেল, তাহারা একটি কথাও বলিতে পারিল না৷
তাহাদের অবস্থা দেখিয়া ইসাক মুখে সেই সর্বজয়ী হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল ‘আজিমুল্লা খাঁ, জুবেদি বিবি, আপনারা ভয় পাবেন না৷ সব চেয়ে নিরাপদ স্থানে এসেছেন, এখানে নির্ভয়ে থাকুন, কেউ আপনাদের চিনতে পারবে না৷’
মেয়েটি বলিল, ‘তুমি চিনলে কী করে?’
ইসাক বলিল, ‘আমার চোখে ধুলো দেওয়া কি আপনার কাজ? আমি যে নানাসাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত৷’
পুরুষ ও রমণী যুগপৎ শুধাইল, ‘কিন্তু তুমি কে?’
এবারে ইসাক তাহাদের কাছে আসিয়া, কন্ঠের স্বর অনেকখানি নামাইয়া আনিয়া একবার এদিকে-ওদিকে তাকাইয়া লইয়া মৃদুস্বরে বলিল, ‘আমিই নানাসাহেব৷’