নানারকম

নানারকম

ইতিহাসের সূচনা

চাণক্য চিন্তিত মুখে বাতায়নের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুদিন আগে সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত থেকে যে খবর এসেছে— সেটাই তাঁর উদবেগের কারণ। পাটলিপুত্র নগরের ওপর তখন দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। মন্দিরে মন্দিরে সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি আর বৌদ্ধবিহার ও সংঘারাম থেকে ঢক্কার শব্দ শোনা যচ্ছে। চারিদিকে দোতলা বা তিনতলা সুরম্য কাঠের বাড়িগুলোর একতলায় জ্বলে উঠেছে প্রদীপ। নগরপালিকার লোকেরা জ্বলন্ত মশাল হাতে পথের দু-ধারে দীপাধারগুলি জ্বালিয়ে দিতে শুরু করেছে। মালিনীরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ফুল আর মালা বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছে। বন্দর আর বিভিন্ন কর্মশালা থেকে কর্মীরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। আদিত্যদেবের সঙ্গে এবার তাদেরও বিশ্রাম নেবার সময় হল।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সুখাসনে বসে তাঁর গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাতে ঠিক সাহস পাচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত না-বলে পারলেন না, ‘কেন আপনি এত চিন্তা করছেন, গুরুদেব? সেলুকাস সিন্ধু নদ পার হবার তোড়জোড় করছে, করতে দিন। আমার সৈন্যবাহিনী সিন্ধুর এপারে তার ক্ষত্রপদের একের-পর-এক পরাজিত করে নদী পার করে দিয়েছে। সেলুকাসকেও সেই পথেই যেতে হবে, যদি সে পূর্ব তীরে এসে উঠতে পারে।’

চাণক্য ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্রদৃষ্টিতে চন্দ্রগুপ্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নির্বোধের মতো কথা বোলো না। কতকগুলো সামান্য ম্যাসিডনীয় ক্ষত্রপ আর সেলুকাস এক পদার্থ নয়। সে দস্যু আলেকজান্ডারের সবচেয়ে প্রিয় সৈন্যাধ্যক্ষ। সে শয়তানিতে তার প্রভুর চেয়ে কিছু কম যায় না। ভুলে যাচ্ছ কেন যে এই বিদেশি দস্যুরা ভারতীয় নয়? ভারতের ন্যায়যুদ্ধ এদের কাছে হাস্যকর নির্বুদ্ধিতামাত্র। এই ম্যাসিডনীয়দের কাছে যুদ্ধে জেতার জন্য যেকোনো রকমের জঘন্য নীচতার আশ্রয় নেওয়া শুধু নীতি নয়, পরম ধর্ম। পুরুরাজকে বা পারস্যসম্রাট দারায়ুসকে কীভাবে পরাজিত করা হয়েছিল, সে নৃশংসতার কথা তুমি জানো না?’

‘জানি, গুরুদেব। তবে, এও জানি যে যত কূটকৌশলই সেলুকাস করুক না কেন, মগধের সৈন্যবাহিনীর সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না। আমি ইতিমধ্যে উত্তরদেশ থেকে একটি অশ্বারোহী আর দক্ষিণাঞ্চল থেকে একটি পদাতিকবাহিনী সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছি। সম্প্রতি গঙ্গাহৃদি রাজ্য থেকে কেনা পাঁচ-শো রণহস্তীর মধ্যে দু-শোটির একটি দলও পাটলিপুত্র থেকে রওনা হয়ে গেছে। তারা আমাদের ওখানে বর্তমান সৈন্যবাহিনীর শক্তি তো বাড়াবেই আর দেখবেন, তাদের আক্রমণের সামনে সেলুকাসের সৈন্যরা ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতো উড়ে যাবে।’

‘মূর্খ, মূর্খ! কে তোমাকে বলেছে যে সে তোমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? শোনো চন্দ্রগুপ্ত, আমি তোমাকে যে রণনীতি শিক্ষা দিয়েছিলাম যে যখনই তুমি শত্রুকে হেয় জ্ঞান করবে, তখনই তোমার সর্বনাশ অনিবার্য হয়ে উঠবে— সে কথা তুমি ভুলে গেছ। পুরুর সঙ্গে আলেকজান্ডারের একটিমাত্র যুদ্ধের রণকৌশল পর্যালোচনা করে আর ইউডেমাস বা পেইথনের মতো কতকগুলো অপদার্থ ক্ষত্রপকে যুদ্ধে হারিয়ে তুমি ভাবছ যে ম্যাসিডনীয়দের কূটযুদ্ধের সবকিছু তুমি শিখে ফেলেছ, তাই না? জেনে রাখো যে, আসলে তুমি শেখোনি কিছুই!’

চন্দ্রগুপ্ত মাথা চুলকিয়ে বললেন, ‘সত্যিই আমি কিছুই শিখে উঠতে পারিনি, গুরুদেব। আপনি আমাকে বলে দিন যে, সেলুকাস কী ধরনের শঠতার আশ্রয় নিতে পারে তা জানতে হলে আমাকে কী করতে হবে।’

চাণক্য পিঞ্জরবদ্ধ সিংহের মতো ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত পদচারণা করতে করতে বললেন, ‘সেখানেই তো আসল সমস্যা, চন্দ্রগুপ্ত, আর তাই নিয়েই আমার যত উদবেগ। যেকোনো যুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলে বাহুবল অবশ্যই প্রয়োজন; তবে তার চেয়েও বোধ হয় বেশি প্রয়োজন বুদ্ধির। সেলুকাসের প্রতিটি গতিবিধির, প্রতিটি পদক্ষেপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া না-গেলে তার উদ্দেশ্য বা কৌশল কিছুই সঠিকভাবে জানা সম্ভব হবে না। তার জন্যে চাই— একটি পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তী আর বুদ্ধিমান গুপ্তচরবাহিনী, যারা এইসব সংবাদ পাঠাবে বিশদ, দ্ব্যর্থহীন, স্বচ্ছ ভাষায়, ছোটোখাটো কোনো বিবরণ বাদ না-দিয়ে। যুদ্ধে এই গুপ্তচরদের প্রয়োজন সৈন্যবাহিনীর চেয়ে কম তো নয়ই, বরং বেশি।’

‘আমাদের গুপ্তচররা কি এই কাজ করতে পারে না, গুরুদেব?’

‘পারে, কিন্তু তারা কোথায়? তোমার সাম্রাজ্য এখন সমগ্র উত্তর ভারতে বিস্তৃত, পূর্বে গঙ্গাহৃদি রাজ্যের প্রত্যন্ত সীমা থেকে পশ্চিমে সিন্ধু নদ, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে গোদাবরী পর্যন্ত। এর সঙ্গে স্বভাবতই বেড়েছে তোমার শত্রুসংখ্যা। এই ঘরের শত্রুদের ওপর নজর রাখবার জন্যে আমাদের প্রায় সমস্ত গুপ্তচরেরাই ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তারা এই মুহূর্তে কে যে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে তার সমস্ত সংবাদও আমাদের কাছে এসে পৌঁছোয়নি। পাটলিপুত্র থেকে খবর পাঠিয়ে, তাদের খুঁজে বের করে, পশ্চিম সীমান্তে পাঠানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেলুকাস সে সময় আমাদের দেবে বলে মনে হয় না। ওখানে যে ক-জন আছে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য আরও দু-চারজনকে পাঠানো হয়তো যায়, কিন্তু যে বিশালায়তন পরিসরে তাদের কাজ করতে হবে, তার পক্ষে তারা পর্যাপ্ত হবে না।’

‘একটা উপায় করা যেতে পারে কি? ধরুন, ম্যাসিডনীয় বাহিনী পুরোপুরি সংগঠিত হবার আগেই যদি আমরা সিন্ধু পার হয়ে তাদের আক্রমণ করি?’

‘তুমি পিপ্পলিবনের পরাক্রান্ত মৌর্যবংশের সন্তান। তোমার মাথায় এ ধরনের চিন্তা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু বৎস, সেটা এখানে বসে গোপনে করতে পারবি কি? ও পক্ষের গুপ্তচরেরা কেউ চুপ করে বসে নেই। তারা ঠিক খবর পেয়ে যাবে আর তোমার আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত হয়ে থাকবে।’

চন্দ্রগুপ্ত হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘পিপ্পলিবনের মৌর্যদের হঠকারী বলে বদনাম আছে ঠিকই; কিন্তু আপনি যখন আমাদের শীর্ষে আছেন, তখন আর চিন্তা কী? হঠকারিতা আর কূটবুদ্ধি একত্র হলে তবেই তো ইতিহাস রচিত হয়, গুরুদেব। তাই না?’

চাণক্যের মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে এল। বললেন, ‘ইতিহাস সেদিনই স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে, চন্দ্রগুপ্ত, যেদিন ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হাতে আদ্যন্ত পর্যুদস্ত হয়ে নৃশংস বিদেশি লুণ্ঠকশক্তি পথকুক্কুরের মতো আমাদের দেশ থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবে। যাক গে, আমার সন্ধ্যাহ্নিকের সময় হল। আজ মধ্যরাত্রে আবার এই মন্ত্রণাগারে পরামর্শ করতে বসব। এর মধ্যে কোনো একটা উপায় হয়তো বেরিয়ে আসবে।’

চন্দ্রগুপ্ত প্রণাম করে বললেন, ‘যথা আজ্ঞা, গুরুদেব।’

.

পরামর্শ চলছিল, হঠাৎ প্রতিহারিণী ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়াল।

চন্দ্রগুপ্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার? কোনো প্রয়োজনীয় সংবাদ আছে কি যে এইসময়ে তোমাকে আসতে হল?’

প্রতিহারিণী করজোড়ে সন্ত্রস্ত গলায় বলল, ‘অপরাধ মার্জনা করবেন, সম্রাট। একটি ঘটনা ঘটেছে, সেটা আপনাদের গোচরে আনা প্রয়োজন বলে মনে হল আমার।’

চাণক্য বললেন, ‘এত রাতে কী এমন ঘটনা ঘটল, প্রতিহারিণী?’

‘একটি যুবক সম্রাটের দর্শনপ্রার্থী, গুরুদেব। তাকে কিছুতেই বিতাড়িত করা যাচ্ছে না। মেরেও না। সে প্রাসাদের সিংহদ্বারের স্তম্ভ আঁকড়ে পড়ে রয়েছে আর অনবরত বলে যাচ্ছে যে তাকে এই মুহূর্তে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতেই হবে, নইলে অত্যন্ত দেরি হয়ে যাবে। সে দ্বাররক্ষীদের প্রহার সহ্য করছে কিন্তু কিছুতেই চলে যাচ্ছে না। তার সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অভুক্ত আর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসছে।’

‘হু, তোমার কথায় বুঝতে পারছি ছেলেটি বলশালী এবং সে ভিক্ষুক নয়। সে কোথা থেকে আসছে কিছু বলেছে?’

‘হ্যাঁ, সে বলছে যে সিন্ধু নদের পূর্ব তীরবর্তী কোনো গ্রাম থেকে আসছে, তবে গ্রামের নামটি আমার এখন ঠিক মনে পড়ছে না, গুরুদেব—’

চাণক্য বাধা দিয়ে সংহত গলায় বললেন, ‘সিন্ধু নদের পূর্ব তীরবর্তী গ্রাম থেকে? তাকে এই মুহূর্তে এখানে নিয়ে এসো। আর সেইসঙ্গে তার জন্যে কিছু খাবারও এনো। প্রতিহারিণী, তুমি অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করছ ঠিকই, কিন্তু বুঝতে পারছি যে সেই বিদ্যা তোমার মাতৃহৃদয়কে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কাজেই, একটি ক্ষুধার্ত বলশালী ক্লান্ত যুবকের যতটা খাবারের প্রয়োজন বলে তোমার মায়ের মন বলবে ততটাই নিয়ে এসো।’

প্রতিহারিণী আভূমি প্রণত হয়ে স্মিতমুখে বলল, ‘যথা আজ্ঞা, গুরুদেব।’

.

যুবক সত্যিই স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, গৌরবর্ণ, মাথায় একরাশ উশকোখুশকো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। তার সর্বাঙ্গে ধুলো আর রক্তের দাগ। নগ্ন পায়ে অসংখ্য রক্তাক্ত ক্ষতের চিহ্ন। সে ঘরে ঢুকেই চন্দ্রগুপ্তকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, ‘আমি এক ভয়ংকর সংবাদ নিয়ে এসেছি সম্রাট। কিছুদিন আগে হিমালয়ের গিরিপথ দিয়ে এক বিশাল বিদেশি সৈন্যদল সিন্ধু নদের পশ্চিমাঞ্চলে নেমে আসছে। জনশ্রুতি এই যে, রাক্ষস আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও উত্তরাধিকারী সেলুকাস এই সৈন্যদল নিয়ে আসছে। তার উদ্দেশ্য সিন্ধু পার হয়ে আপনার সাম্রাজ্য আক্রমণ করা।

চন্দ্রগুপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। চাণক্য তাকে হাত নেড়ে বাধা দিয়ে বললেন, ‘আগে বলো, তুমি কে এবং কোথা থেকে আসছ?’

যুবক চাণক্যকে দেখতে পায়নি। তাঁর গলা শুনে তাঁর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ কৌটিল্য। আমার প্রণাম নেবেন।’— বলে সে চাণক্যকে আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, ‘আমার নাম কর্ণ। সিন্ধু নদের ধারে করঞ্জ গ্রামে আমার নিবাস। আমি মেষপালক।’

‘তুমি যে সৈন্যদলের কথা বললে, তাদের তুমি নিজে দেখেছ? তারা যে সেলুকাসের বাহিনী, তা তুমি জানলে কী করে?’

‘পাহাড়ের ওপর ভেড়া চরাতে গিয়ে আমি এই বাহিনীর অগ্রবর্তী দলটিকে দেখি। সেই দিনই গান্ধার থেকে আসা একদল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, তারা তক্ষশীলায় যাচ্ছিল। তাদের কাছেই সেলুকাসের খবর পাই। আমি সঙ্গেসঙ্গে করঞ্জে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই রাত্রেই পাটলিপুত্রের উদ্দেশে রওনা হই।’

‘যে সৈন্যদলটিকে তুমি দেখেছ, তার বিষয়ে কিছু বলো দেখি।’

‘এরা সংখ্যায় দুই সহস্রের বেশি হবে না। অশ্ব-শকটের ওপরে স্তূপাকার বস্ত্রাবাস নিয়ে এরা একটি পাহাড়ের পেছনে শিলাময় উপত্যকায় জড়ো করছে, যাতে সিন্ধুর পূর্ব তীর থেকে তাদের দেখা না-যায়। বস্ত্রাবাসগুলির পরিমাণ দেখে মনে হয় যে তাদের সংখ্যা দশ সহস্র মতন হবে। হয়তো, আরও আসবে। ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে পেরেছি যে তারা একটি বিশাল সৈন্যবাহিনীকে গিরিবর্ত্মে ঢুকতে দেখেছে। তবে, তাদের সংখ্যা কত তা বলতে পারেনি। তারা তো টাকা গুনতে অভ্যস্ত কাজেই— তারা আর কী করেই বা বলবে।’

চাণক্য কিছুক্ষণ সপ্রশংস দৃষ্টিতে কর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার পায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে তোমার গ্রাম থেকে এতটা পথ তুমি দৌড়ে এসেছ। তাই কি?’

‘হ্যাঁ, গুরুদেব। সারাদিন দৌড়েছি, রাত্রে কোনো মন্দিরে বা বৌদ্ধবিহারে শুয়ে থেকেছি। তা না-করলে যে ভীষণ দেরি হয়ে যেত।’

‘কেন? তোমার কি ধারণা যে মগধের রাজকর্মচারীরা এতই অপদার্থ, যে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ তারা যথাসময়ে সম্রাটের গোচরে আনবে না?’

‘না গুরুদেব। আমি খুব ভালো করেই জানি যে সম্রাটের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে গেছে।’

চাণক্য ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ‘তাহলে তাড়াটা কোথায় যে তোমাকে এই দীর্ঘ পথ দৌড়ে আসতে হল?’

‘আমি সম্রাটের সৈন্যদলে যোগ দিতে চাই, যদি দেরি হয়ে গিয়ে না-থাকে।’

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে তোমার এত উৎসাহের কারণ কী?’

‘যুদ্ধে যদি আমার মৃত্যুও হয়, তবু মরবার আগে আমি অন্তত একটা ম্যাসিডনীয়র শিরচ্ছেদ করে তার রক্তে আমার প্রিয়জনদের তর্পণ করে যেতে চাই। তাহলেই আমার আট বছরের প্রতীক্ষা শেষ হয়।’

‘কেন? ম্যাসিডনীয়দের ওপর তোমার এত রাগের কারণ? এরা কী ক্ষতি করেছে তোমার?’

চাণক্য চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি তো জানো বৎস যে, পুরুরাজের পরাজয়ের পর, ম্যাসিডনীয়রা সিন্ধুর পূর্ব তীরে যে অকল্পনীয়পূর্ব নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, আজ সমগ্র ভারত একযোগে সেটা ভোলবার চেষ্টা করছে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সংস্কৃত ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় যত কাব্য, নাটক বা গাথা রচিত হয়েছে, তাদের কোথাও আলেকজান্ডারের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। যে কথা সমস্ত জাতি ভুলতে চাইছে, এই বালককে দিয়ে কেন সেই যন্ত্রণার স্মৃতিকে টেনে আনতে চাইছ?’

কর্ণ বলল, ‘গুরুদেব, আর সকলে ভোলবার চেষ্টা করলেও, আমরা করছি না। আমরা যে দেখেছি, প্রথম দিনের যুদ্ধে সম্পূর্ণ পরাজিত আলেকজান্ডার পালিয়ে গিয়ে পরদিন ঘুরপথে এসে পুরুরাজের সৈন্যবাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল। সেই অবিশ্বাস্য কাপুরুষতায় হতভম্ব ভারতীয়রা সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি। সেই রক্তাক্ত দিনের শেষে ম্যাসিডনীয়রা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সিন্ধুর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। যারা পালাতে পেরেছিল তারা বেঁচে গিয়েছিল। যারা পারেনি, সেই নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের ওপরে তারা যে অত্যাচার করেছিল, তা আমরা ভুলতে চাই না। বৃদ্ধবৃদ্ধা ও শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে, সবল নারী ও পুরুষদের গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। শুনেছি, তাদের দেশে নাকি ওদের গোরুছাগলের মতো বিক্রি করা হবে। এরা কি মানুষ? পৃথিবীর এই ভয়ংকর অভিশাপগুলোর একটিকেও যদি মারতে পারি— তবেই আমি নিজেকে কৃতার্থ মনে করব।’

চাণক্য কর্ণের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘বৎস, দুঃখ কোরো না, আমরা কিন্তু তোমাকে সৈন্যদলে নিতে পারি না। তবে, তুমি চাইলে সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের সাহায্য করতে পারো। সেই সাহায্য আমাদের বিশেষ প্রয়োজন।’

‘কেন আমি সৈন্যদলে যোগ দিতে পারি না, গুরুদেব?’

‘কারণ, আমাদের সৈন্যরা বেতনভোগী যোদ্ধা। যুদ্ধই তাদের জীবিকা, যেমন তোমার পশুপালন। মহাভারতের যুগ থেকে ভারতবর্ষে এই নিয়মই চলে আসছে। তোমাকে যোদ্ধা হতে গেলে তোমাকে প্রথমে শস্ত্রবিদ্যা শিখতে হবে, তারপর কোনো একটি সেনাগোষ্ঠীতে যোগ দিতে হবে যেখানে সৈন্যদের অন্যান্য কর্তব্য আর বস্ত্রাবাসের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। তাতে সময় লাগবে। কিন্তু সে সময় তো নেই। তার পরিবর্তে, আমরা তোমাকে এখনই এমন কাজ দিতে পারি যার মূল্য যুদ্ধ করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়— হয়তো-বা বেশি। শুধু একটাই সমস্যা। আমি জানি তুমি বুদ্ধিমান, তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং বিশ্লেষণশক্তি খুব ভালো। কিন্তু যে কাজ তোমাকে দিতে যাচ্ছি, সেটা তুমি একা কতটা করে উঠতে পারবে জানি না।’

‘আমি একা নই, গুরুদেব। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সহস্রাধিক আবালবৃদ্ধবনিতা। সেলুকাস নামক নরকের কীটটাকে ধ্বংস করতে যেকোনো কাজে তারা সম্রাটকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।’

চাণক্য দীপ্তচোখে কর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চমৎকার। তাহলে, কাল সকালে আমি তোমাকে কী কী করতে হবে তা ব্যাখ্যা করে দেব। তারপর, অপরাহ্নে তুমি আমাদের দ্রুতগামী রথে ফিরে গিয়ে সিন্ধুর পূর্ব তীরে আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষের সঙ্গে সম্রাটের অভিজ্ঞান নিয়ে গোপনে দেখা করবে। তিনি তোমাকে আরও কিছু উপদেশ দেবেন। নিজের গ্রামে ফিরে যাবে পদব্রজে যাতে কারও মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না-হয়। এখন প্রতিহারিণী তোমার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। খেয়ে নিয়ে তুমি তার বাসস্থানে গিয়ে রাত্রিযাপন করবে। সবাইকে বলবে যে, তুমি প্রতিহারিণীর দৌহিত্র। কাল ভোর হবার এক দণ্ডের মধ্যে প্রাসাদ দেখবার নাম করে এখানে চলে আসবে। এখন যাও আর প্রতিহারিণীকে একবার এখানে আসতে বলো।’

কর্ণ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘এই অনভিজ্ঞ গ্রাম্য যুবকের হাতে এত বড়ো একটা দায়িত্ব দেবেন, গুরুদেব? সে পারবে তো?’

চাণক্য দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘এই যুবক তার সমস্ত অন্তর দিয়ে, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তার কর্তব্য পালন করবে। পারলে, সে-ই পারবে। জানো চন্দ্রগুপ্ত, প্রজাপুঞ্জ যখন রাজশক্তির পেছনে এসে দাঁড়ায়, তখন বিশ্বের কারও ক্ষমতা নেই যে সেই জাতিকে পদানত করতে পারে। তা সে যতই নৃশংস দানবিক হোক না-কেন।’

.

প্রতিহারিণী চলে যাওয়ার পর চাণক্য পুনরায় বাতায়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আকাশে এখনও উষার আলোর ছোঁয়া লাগেনি, অন্ধকার সামান্য কেটেছে মাত্র। নগরপথ জনহীন, দীপাধারগুলির আগুন নিবে যাওয়ার মুখে। শোন নদী থেকে শীতল কোমল বাতাস বইছে, ক্কচিৎ একটি-দু-টি পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে— একটি নতুন দিনের জন্যে প্রস্তুত হয়ে উঠছে পাটলিপুত্র।

চাণক্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো চন্দ্রগুপ্ত, আমরা নীচে যাই। আপাতত একটু বিশ্রাম করে নাও। কাল তোমার অনেক কাজ। মগধ আর গঙ্গাহৃদির মিলিত শক্তির কথা শুনে আলেকজান্ডার ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। সেলুকাস তা করবে না, যুদ্ধই করবে এবং তার উপযুক্ত প্রতিফলও সে পাবে। এসো, এইবার স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাস রচনার সময় উপস্থিত হয়েছে।’

 হঠাৎ দেখা

কানুবাবু আর ভোলাবাবু অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন যদিও দু-জনের স্বভাবে মিল প্রায় ছিল না বললেই চলে। কানুবাবু চটপটে, হাসিখুশি, মজাদার লোক এবং ভোলাবাবু ছিলেন গম্ভীর, শান্ত আর সুযোগ পেলেই যত্রতত্র ঘুমিয়ে পড়তেন। দু-জনেই কলকাতার কাছেই একটা কারখানায় চাকরি করতেন। কানুবাবু ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে আর ভোলাবাবু অ্যাকাউন্টসে। কানুবাবুর একটা পুরোনো বড়ো ফোর্ড গাড়ি ছিল। দুই বন্ধু সেই গাড়ি নিয়ে ছুটিছাটা হলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়তেন আর প্রায় প্রত্যেকবার একটা না-একটা অদ্ভুত বা বিপদজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসতেন। একবার ওঁরা যাচ্ছিলেন আগ্রা থেকে রওনা হয়ে রাজস্থানের সনকপুর বলে একটা শহরে। সেখানে একটা অতি প্রাচীন মন্দির আছে, সেটা দেখাই উদ্দেশ্য ছিল। সনকপুর বিখ্যাত জায়গা কিছু নয়, একটাই শুধু মন্দির। টুরিস্ট বড়ো একটা আসে না এদিকে। দুই বন্ধু ভোর বেলা বেরিয়েছেন, দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা।

আগ্রা থেকে উদয়পুর যাওয়ার বড়ো রাস্তা থেকে বেরিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা চলে গেছে সনকপুরের দিকে। বড়ো রাস্তায় যদি বা বাস বা লরি চলে, সনকপুরের রাস্তা একেবারে নির্জন। প্রকৃতি এখানে অদ্ভুত রকমের নিষ্প্রাণ গাছপালা, লোকজন, জন্তুজানোয়ার, কিচ্ছু নেই। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু বড়ো বড়ো সাদা পাথরের স্তূপ অথবা ছোটো বড়ো পাথরের চাঁই-এ ঢাকা ছোটো ছোটো পাহাড়। মনে হয় যেন একটা অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক সরিসৃপের ফসিল হয়ে যাওয়া কঙ্কালের ভেতরে রাস্তাটা মড়ার মতো পড়ে রয়েছে।

এরকম একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো সহজ ব্যাপার নয়। চারদিকের ক্লান্তিকর একঘেয়েমির ফলে গাড়িচালকের ঘুম পেতে থাকে, সেটি খুবই বিপদজনক। সেই ঘুম ঠেকানোর জন্য কানুবাবু চিৎকার করে বেসুরো গলায়, শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে পথের, গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ভোলাবাবু অবশ্য এসব কিছু জানেন না। তিনি পরমানন্দে ঘুমিয়ে যাচ্ছিলেন।

দিব্যি চলছিল গাড়িটা। হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই, চলতে চলতে সেই জনহীন প্রান্তরের মাঝখানে দুম করে গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর, আপন মনে গড়াতে গড়াতে গিয়ে সেটা একটা মস্ত পাথরের চাঁই-এর পাশে দাঁড়িয়ে গেল। মোটরগাড়ির কলকব্জা সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান ছিল কানুবাবুর, কাজেই এরকম অবস্থায় গাড়িটাকে আবার চালু করার যত পদ্ধতি আর টোটকা জানা ছিল সেগুলো সব কটাই প্রয়োগ করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। দেখা গেল, গাড়িটার আলো জ্বলছে না, ব্রেক কাজ করছে না, কিছুই হচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার। এরকম কেন যে হল, সেটা কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলেন না কানুবাবু। তবে এটা বুঝতে পারলেন যে তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে গাড়িটা কখনোই চালু করতে পারবেন না। এখন একজন অভিজ্ঞ মিস্ত্রির দরকার।

এটাই বাকি ছিল। এই তেপান্তরের মধ্যিখানে মিস্ত্রি কোথায় পাওয়া যাবে। কোনো লরি বা বাস পেলে হয়তো কাছেপিঠে কোনো জনবসতি থেকে লোকটাকে নিয়ে আসা যেত, কিন্তু সেসব কোথায়। ম্যাপ দেখে মনে হয় সনকপুর ওখান থেকে অন্তত দশ কিলোমিটার দূরে। হেঁটে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং, গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে হাঁ করে সাহায্যের আশায় বসে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই।

অতএব, বনেট বন্ধ করে গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসবার জন্য তৈরি হলেন কানুবাবু। হঠাৎ দেখেন, পাথরের চাঁইটার পেছন থেকে একটা লোক বেরিয়ে আসছে। লোকটির পরনে ঠিক তাঁরই মতো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে সাদা ক্যাম্বিসের জুতো। লোকটিকে দেখে কানুবাবুর ভীষণ চেনাচেনা বলে মনে হল। কোথায় যেন দেখছেন, কিন্তু কোথায় যে দেখেছেন সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।

লোকটি গুটিগুটি কানুবাবুর কাছে এগিয়ে এল। হাতজোড় করে পরিষ্কার বাংলায় বলল— নমস্কার। আপনার গাড়িতে কি যন্ত্রপাতি কিছু আছে?

অত্যন্ত খুশি আর আশান্বিত হয়ে কানুবাবু বললেন— আপনি বাঙালি? অবশ্য, এরকম বিদেশ বিভুঁয়ে, বিপদের সময় বাঙালি ছাড়া আর কে-ই বা এগিয়ে আসবে। হ্যাঁ, কী বলছিলেন, যন্ত্রপাতি? আছে বইকি। আপনি কি মেকানিক? দেখুন না একবার গাড়িটা। কেন যে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

লোকটি কানুবাবুর সংবর্ধনায় আদৌ অভিভূত হয়েছে বলে মনে হল না। মাথা নেড়ে বলল— আপনার জন্যে নয়, আমি চাইছি আমার জন্য।

কানুবাবু একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন— আপনার জন্য? তার মানে? আপনারও গাড়ি খারাপ হয়েছে না কি? কোথায় আপনার গাড়ি?

হাত নেড়ে লোকটি বলল— ওইখানে, ওই পাথরের ঢিবিটার আড়ালে। খারাপই হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আমি আবার তাড়াহুড়োতে যন্ত্রপাতিগুলো বাড়িতে ফেলে এসেছি।

—বলেন কী? তা, ওখানে আপনার গাড়ি গেল কী করে? ওখানে যাবার তো কোনো রাস্তাই নেই। চারদিকে পাথর।

—রাস্তা দিয়ে যায়নি।

—রাস্তা দিয়ে যায়নি তো কি আকাশ থেকে পড়ল?

লোকটি মাথা চুলকে বলল— ইয়ে, মানে, হ্যাঁ, তা-ই বলতে পারেন।

কানুবাবু মনে মনে ভাবলেন, এই রে, এ যে দেখছি পাগল। মুখে হাসি টেনে বললেন— বলেন কী, আকাশ থেকে পড়েছে? তা, কী গাড়ি আপনার?

—গাড়ি ঠিক নয়। যান বলতে পারেন।

—যান। তার মানে?

—তার মানে, যাতে চড়ে লোকে এদিক-সেদিক যায়— সেই যান। এই যেমন ধরুন, জলযান।

—জলযান! বটে! তা আপনারটা কী যান? আকাশযান?

লোকটি ম্লান হেসে বলল— প্রায় ঠিকই বলেছেন। আকাশযান নয়, মহাকাশযান।

শুনে কানুবাবু বসে পড়তে পড়তে সামলে নিলেন। ভাবলেন, সর্বনাশ করেছে রে! এ তো পাগল নয়, বদ্ধ পাগল! এখন এই জনহীন মাঠের মধ্যিখানে একে সামলাই কী করে। কোনোরকমে মুখটা ভাবলেশহীন রেখে কানুবাবু বললেন— অ। মহাকাশযান। সেটা খারাপ হয়ে পড়েছে ওই ঢিবিটার পেছনে আর আপনি সেটা আমার এই ঝ্যাঝঝেড়ে ফোর্ড গাড়ির যন্ত্রপাতি দিয়ে সারাবেন?

—সারাতে পারব কিনা জানি না। চেষ্টা করে দেখব।

—আমি কি একবার আপনার মহাকাশযানটা দেখতে পারি?

—পারবেন না। কারণ, আলোর যেসব তরঙ্গ আপনার চোখ ধরতে পারে, তা দিয়ে মহাকাযানটা দেখা সম্ভব নয়।

—তা আপনি দেখছেন কী করে?

আমার দেখবার ক্ষমতা আপনার চেয়ে অনেক গুণ বেশি, কারণ আমার চোখে বর্ণালীর যে পরিসর ধরা পড়ে, তা আপনার মতো সঙ্কীর্ণ নয়, অনেক বড়ো। মানে, বেগুনি থেকে লালের মধ্যে যে কটা রং শুধু সে কটাই আপনি দেখতে পান, আমি দেখতে পাই তাদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যার রং। ফলে, যেমন ধরুন, অন্ধকারে আপনার কিছুই নজরে পড়ে না, আমার পড়ে।

—তাই নাকি? আপনি কি বলতে চান যে আপনি আর পাঁচটা লোকের মতো সাধারণ মানুষ নন?

লোকটি আবার ম্লান হেসে বলল— আমি অসাধারণ নই, তবে মানুষও নই। আমি গ্রহান্তর থেকে আসছি। আপনাদের ছায়াপথ নক্ষত্রপুঞ্জের বাইরে এইরকমই অন্য একটি নক্ষত্রপুঞ্জের একটি তারার একটি গ্রহে আমার বাড়ি। আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জকে আপনাদের জ্যোতির্বিদরা নাম দিয়েছেন আলফা-২৭৫। আমি সেখান থেকেই আপনাদের গ্রহে আসছিলুম। মাঝপথে হতভাগা মহাকাশযানটা এমন গোলমাল শুরু করলে যে এখানে নেমে পড়তে বাধ্য হলুম।

কানুবাবুর মনে হল হাত-পা ছুড়ে দৌড় মারেন। কিন্তু এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে পালাবেন কোথায়? তা ছাড়া, উন্মাদ হলেও, লোকটিকে বিপদজনক বলে মনে হল না। তার পাগলামির মধ্যে কোথায় যেন একটা পদ্ধতি আছে। কথাগুলো যা বলছে সেগুলো অবাস্তব কিন্তু উলটোপালটা নয়। একে ক্ষেপানো ঠিক নয়। কখন যে কী মূর্তি ধারণ করবে বলা তো যায় না। তাই, কাষ্ঠ হেসে বললেন— হেঁ হেঁ, আপনি গ্রহান্তর থেকে এলে কী হবে, আপনার চেহারা কিন্তু ঠিক মানুষেরই মতো।

লোকটি মুখ বেঁকিয়ে বলল— দূর মশাই, একি আমার আসল চেহারা নাকি? আপনাদের জন্য আমাকে এই বিকট চেহারা ধারণ করতে হয়েছে।

এইবার একটু চটে গেলেন কানুবাবু। বললেন— বিকট চেহারা! কেন, আপনার চেহারা তো বেশ ভালোই দেখছি।

—আর বলবেন না মশাই। ভালো চেহারাই বটে। আমাকে যখন প্রথম মানুষের চেহারা দেখিয়েছিল, আমারই পিলে চমকে গিয়েছিল, আমাদের কোনো বাচ্চা ছেলেকে দেখালে সে তো নির্ঘাৎ ভিরমি যেত। গোল একটা মুণ্ডু, তার ওপরে বিরিবিরি চুল,দেখবার জন্য ড্যাবাড্যাবা দুটো চোখ, পটপটে কান, লুড়লুড়ে দুটো হাত, আর চলবার জন্যে দুটো ফঙফঙে ঠ্যাং। দেখে হেসে আর বাঁচিনে।

কানুবাবু ভয়ানক রেগে গেলেন। গোমড়া মুখে বললেন— ঠিক আছে, ঠিক আছে। তা, আপনি এই পৃথিবীতে কী মনে করে।

—আমি এসেছিলুম আপনাদের দলপতির সঙ্গে দেখা করবার জন্য।

—দলপতি? সে আবার কে?

—বাঃ, আপনাদের কোনো দলপতি নেই? অন্যান্য সমস্ত গ্রহে অনুন্নত অথচ বুদ্ধিমান প্রাণীদের একজন দলপতি থাকে। আপনাদের সেরকম কেউ নেই। তার সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল।

অনুন্নত অথচ বুদ্ধিমান প্রাণী শুনে কানুবাবু রাগে প্রায় বাক্যহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললেন— না আমাদের সেরকম কোনো দলপতি নেই। তবে, আপনার দরকারটা কী তা যদি আমাকে বলেন, হয়তো আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি। বলছেন আর মনে মনে ভাবছেন, এই বদ্ধ উন্মাদ লোকটার হাত থেকে উদ্ধার পাই কী করে। একটা গাড়িও ছাই আসছে না এদিকে।

লোকটি বলল— দরকারটা হল, আমি যে সংস্থায় চাকরি করি, তারা আমাকে আপনাদের দলপতির কাছে পাঠিয়েছে একটা প্রস্তাব দিয়ে। প্রস্তাবটি হল, আপনাদের উপগ্রহ, যাকে আপনারা চাঁদ বলে থাকেন, সেখানে আমরা একটা মহাকাশযানে জ্বালানি ভরবার কেন্দ্র খুলতে চাই। আপনাদের সৌরজগতের ঠিক বাইরে দিয়ে আমাদের আন্তর্নক্ষত্র মহাকাশযানের যাতায়াতের পথ কিনা। মহাজাগতিক সংঘের নিয়মানুযায়ী আপনাদের অনুমতি ছাড়া সে কাজ আমরা করতে পারি না।

কানুবাবু আর সহ্য করতে পারছিলেন না। বললেন— দাদা, আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এ ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারলুম না। আমাদের জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বা হিউস্টনে নাসার প্রধান হয়তো এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন। ওই আমার গাড়ির সামনে রাস্তার ওপরে যন্ত্রপাতির বাক্সটা রয়েছে। ওটা নিয়ে যান। আর, আপনার মহাকাশযানটা সারানো হলে, দয়া করে ফেরত দিয়ে যাবেন। ওটা নিয়ে যদি মহাকাশে প্রস্থান করেন, তাহলে আমার গাড়িটা আর সারাতে পারব না।

—ধন্যবাদ, বলে লোকটা বাক্সটা নিয়ে ঢিবির পেছনে যেতে যেতে ফিক করে হেসে বলল— চিন্তা করবেন না। আপনার গাড়ির কিচ্ছু হয়নি।

দাঁত কিড়মিড় করে কানুবাবু মনে মনে বললেন— হ্যাঁ, তুমি তো সব জেনে বসে আছো।

দশ মিনিটের মধ্যে লোকটি বেরিয়ে এল। দন্তবিকাশ করে বলল— ধন্যবাদ। সব ঠিক হয়ে গেছে। বিশেষ কিছু হয়নি, বুঝলেন।

কানুবাবু বললেন— তা তো বুঝলুম, এখন আমার গাড়ির কী হবে?

—কী আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি আপনার গাড়ির। কলকবজা বন্ধ করার রশ্মি চালিয়ে আমিই ওটা বন্ধ করে দিয়েছিলুম। নইলে এই সাহায্যটা তো পেতুম না, বুঝলেন না? এখন, রশ্মিটা বন্ধ করে দিয়েছি। আপনি নিশ্চিন্তে গাড়ি চালু করতে পারেন। বলে পেছনের দরজা খুলে যন্ত্রপাতির বাক্সটা রাখতে গিয়ে ভোলাবাবুকে দেখে বললেন— এ আবার কে? মরে গেছে নাকি?

কানুবাবু বললেন— না ঘুমুচ্ছে।

এই সময়ে কেউ ঘুমোয়? বলে লোকটি ভোলাবাবুর নাকটা ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন— এই যে মশায়, উঠে পড়ুন এবার। যাত্রা করার সময় উপস্থিত।

চমকে ঘুম ভেঙে উঠে ভোলাবাবু লোকটিকে বললেন— ব্যাপারটা কী? তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেল নাকি? আমার নাক মুলে দিলি যে? গাধা কোথাকার।

ভোলাবাবুর কথা শুনে হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে গাড়ির দরজা বন্ধ করে লোকটি একদৌড়ে পাথরের ঢিবিটার পেছনে চলে গেল।

কানুবাবু গাড়িতে উঠে বললেন— কে রে লোকটা? তুই তো চিনিস দেখছি। আমারও ভীষণ চেনাচেনা লাগছিল, কোথায় যেন দেখেছি। বদ্ধ পাগল একটা।

ভোলাবাবু অবাক হয়ে বললেন— কোন লোকটা?

—এই যে যাকে তুই গাধাটাধা বললি।

এইবার ভোলাবাবু ঘুম ছুটে গেল। বললেন— তোর হয়েছে কী, বলবি? মাথাটাথা খারাপ হল নাকি? আমি তো তোকেই গালাগাল করলুম। আবার কাকে করব?

হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতো কানুবাবুর মনে হল, আরে লোকটা যে ঠিক তাঁরই মতন দেখতে। তাঁর গায়ের লোম খড়খড় করে খাড়া হয়ে উঠল।

ঠিক তখুনি, পাথরের ঢিবির পেছনে গোঁ গোঁ করে একটা যন্ত্র চালু হবার শব্দ উঠল। তার পরমুহূর্তেই ধুলোর প্রচণ্ড ঝড় তুলে কী যেন একটা উল্কার মতো আকাশে উঠে গেল। চেষ্টা করেও সেটাকে দেখতে পেলেন না কানুবাবু।

 পাণ্ডারবাজারের মানুষখেকো বাঘ

সেবছরটা ছিল বোধ হয় উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হওয়ার মুখে। ইয়লটা কনফারেন্স হয়ে গেছে, হিটলার তখনও আত্মহত্যা করেননি, অ্যাটম বোমাও ফাটেনি জাপানে। অথচ এরকমই একটা সময়ে, কোথাও কিছু নেই, আমার জীবনে এমন একটা বোমা ফেটেছিল যে আমার একেবারে দফারফা হওয়ার জোগাড় হয়েছিল।

আমি তখন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র ওভারসিয়ার। কাজকর্ম তেমন কিছু নেই। দিনের বেশিরভাগ সময়ই যুদ্ধের বিশদ আলোচনা আর চুলচেরা বিশ্লেষণে কাটে। বেশ একটা গনগনে উত্তেজনা। এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ বড়োসাহেবের ঘরে আমার ডাক পড়ল।

আমার তো আত্মারাম খাঁচা! বড়োসাহেব ক্রিস্টফার গ্রে ছিলেন একজন অতিশয় বিপজ্জনক চরিত্র। আমরা তাঁর নামের পেছনে একটা হাউন্ড জুড়ে দিয়েছিলুম। তাঁর ঘরে ডাক পড়া মানে সর্বনাশ।

আমি তো কাঁপতে-কাঁপতে গ্রে সাহেবের ঘরে ঢুকলাম। সাহেব প্রচণ্ড ভ্রূকুটি করে কী একটা ফাইল দেখছিলেন। আমাকে দেখে মুখ তুলে বললেন— মিস্টার টলাপাট্র, তুমি কি গাড়ি চালাইটে পাড়ো?

গাড়ি। এহেন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের উত্তরে মিনমিন করো বললুম— ইয়েস, স্যার।

—নন্ডডুলাল টাহা হইলে ঠিকই বলিয়াছে। কোঠায় শিখিলে?

অফিসে অড্ডা মারতে মারতে একটু চাল মেরেছি কী মারিনি, অমনি সাহেবের কানে কথাটি তুলে দিয়েছে! মনে মনে নন্দদুলালের বাপান্ত করতে করতে বললুম— ইন বারাসাত, স্যার। মাই ম্যাটার্নাল আঙ্কেল হ্যাজ এ কার। হি টট মি, স্যার।

—লাইসেন্স আছে?

—নো, স্যার।

—ডাসন্ট ম্যাটার। টোমাকে একটা কাজ কড়িটে হইবে। খুবই গোপনীয় কাজ। কালই টোমাকে নর্থ বেঙ্গলে যাইটে হইবে। কাজ শেষ কড়িয়া ফিড়িবে। সব ব্যবসটা আমড়া কড়িয়া ডিব। আর, কাহাড়ও সহিট ইহা লইয়া আলোচনা কড়িবে না।

ভয়ে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। বুঝলুম, যুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো কাজ। জাপানিরা এতদূর এসে গেছে না কি? নাঃ, সাধের প্রাণটা শেষপর্যন্ত জাপানিদের হাতেই গেল। যাব না বলে লাভ নেই, রাইফেলের গুঁতো মেরে পাঠাবে। পালালে ঠিক ক্যাঁক করে ধরে এনে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে। কাজেই বশংবদের মতো ঘাড় নেড়ে কম্পিতকক্ষে কাজটা কী সেটা জানবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলুম।

ব্যাপারটা যখন জানা গেল তখন দেখলুম খুব একটা ভীত হওয়ার মতো কিছু নয়। ফলসাগুড়ি চা-বাগানের থেকে মাইলদশেক দূরে পাণ্ডারবাজার বলে একটা গ্রামের কাছে রংকি বলে একটা পাহাড়ি নদী আছে। তার ওপরে নাকি একটা ব্রিজ আছে। পূর্বরণাঙ্গনে রসদ সরবরাহের জন্য মণিপুর পর্যন্ত একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য ফলসাগুড়ি থেকে একটা রাস্তা বানাচ্ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সেনাবাহিনী। তারা কোনো একটা মান্ধাতার আমলের ম্যাপ থেকে এই ব্রিজটার কথা জানতে পেরে তার ওপর দিয়ে রাস্তাটা নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। অথচ আমাদের ডিপার্টমেন্ট এই ব্রিজটার রক্ষণাবেক্ষণ করা তো দূরের কথা, তার অস্তিত্বের কথাই জানত না। এখন, আমার কাজ হল, এই ব্রিজটা আদৌ আছে কি না বা থাকলে সেটা কী ধরনের আর তার কী দশা তার তত্ত্বতালাশ করা।

আমাকে প্রথমে যেতে হবে ফলসাগুড়ি চা-বাগানে। সেখানকার ম্যানেজার জন রিঙ্গার সাহেবকে বলে দেওয়া আছে। তিনি আমাকে একটা গাড়ি দেবেন। সেটা নিয়ে ভোররাত্রে বেরিয়ে আমাকে যেতে হবে পাণ্ডারবাজারে। পথে যদি কোনো ব্রিজ দেখা যায় তো ভালো, নইলে পাণ্ডারবাজারের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে তার খোঁজখবর নিতে হবে। তারপর, রাতের অন্ধকারে ফলসাগুড়িতে ফিরে আসতে হবে।

রিঙ্গার সাহেব ব্যাপারটা জানেন। তিনি তাঁর ড্রাইভারকে পাঠিয়ে খবরটা নিতে পারতেন কিন্তু সে লোকটাকে তিনি একেবারেই বিশ্বাস করেন না। তাই তিনি তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে আমাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। গাড়ি চালাতে পারে অথচ বিশ্বাসযোগ্য এরকম কাউকে না কি আর আমাদের ডিপার্টমেন্টে পাওয়া যায়নি।

.

রিঙ্গার সাহেব যে গাড়িটা দিলেন সেটা ১৯৪০ সালের অস্টিন। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, প্রায় একটা ট্যাঙ্কের মতো শক্তপোক্ত বাহন। সে-যুগে পাহাড়ি অঞ্চলে এই গাড়িটাই বেশি ব্যবহৃত হত।

রওনা হওয়ার সময়, রিঙ্গার সাহেব আমকে একটা দু-নলা বন্দুক দিলেন। আমি বন্দুক চালাতে জানি না শুনে বললেন যে তাতে কিছু যায় আসে না, হাতে বন্দুক আছে দেখলে নেটিভরা সম্ভ্রম করবে, ভয় পাবে আর ইচ্ছে থাকলেও কোনো ক্ষতি করতে সাহস পাবে না।

সেটাই হল যত গণ্ডগোলের মূল।

.

পাণ্ডারবাজার পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যাওয়া গেল। রংকি নদীর ধার দিয়ে-দিয়েই রাস্তা। চারদিকে গভীর জঙ্গল, একপাশে রংকি, সব মিলে মনোরম সব দৃশ্য। পথে ব্রিজ-ট্রিজ কিছুই নজরে পড়ল না। বেলা বারোটা নাগাদ পাণ্ডারবাজারে গিয়ে পৌঁছলুম।

পৌঁছনো মাত্র একদল গ্রামের লোক আমার গাড়িটা ঘিরে ফেলল। সবাই মিলে চ্যাঁচাচ্ছে, কী বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাদের যে কোনো একটা ব্যাপারে ভয়ানক ক্ষোভ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ক্ষোভটা যে কীসের সেটা বোঝে কার সাধ্যি! আমি তখন বন্দুকটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলুম।

বন্দুক দেখে ভয় পাওয়া তো দূরস্থান, লোকগুলো অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠল। আমি তো অবাক।

যাই হোক, কিছুক্ষণ বাদে যা জানতে পারলুম, তাতে আমার আক্কেলগুড়ুম।

ঘটনাটা হচ্ছে সম্প্রতি একটা বাঘ ওই অঞ্চলে ভয়ানক অত্যাচার শুরু করেছে। মানুষ এখনও মারতে আরম্ভ করেনি বটে, কিন্তু তার বেশি দেরি নেই। এইতো কিছুদিন আগে একটি রাখাল ছেলে বনের কাছে একপাল মহিষ চরাচ্ছিল। বাঘটা হঠাৎ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঘটা অবশ্য বিশেষ কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, কারণ মহিষগুলো শিং বাগিয়ে তাকে তাড়া করতেই সে ল্যাজ তুলে পালায়।

গ্রামের মোড়ল বললেন— সেদিন পালিয়েছে বলে যে ভবিষ্যতেও পালাবে, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানুষকে যে আক্রমণ করেছে, সেটাই বড়ো কথা। তাই আমরা বনদপ্তরকে চিঠি দিয়েছিলুম যাতে তারা শিকারি পাঠিয়ে বাঘটার একটা ব্যবস্থা করে। আপনিই তো সেই শিকারি?

আমি জিজ্ঞাসা করলুম— শিকারির কী দরকার? আপনারা তো নিজেরাই ফাঁদটাঁদ পেতে বাঘটাকে ধরে ফেলতে পারেন।

মোড়ল মাথা নেড়ে বললেন— আজ্ঞে না। তা করলে বনদপ্তরের সাহেবরা এসে আমাদের হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে। সাহেবরা এদেশে আসবার আগে, আদ্যিকাল থেকে আমাদের বাপঠাকুরদাদারা তাই করে এসেছেন বটে, কিন্তু এখন তা আর করা যায় না। শোনেননি, এক-একটা বাঘ আড়াইশো-তিনশো করে মানুষ মারছে, আর গাঁয়ের লোকেরা মাইলের-পর-মাইল পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সাহেব শিকারির পায়ে ধরে তাকে ডেকে আনছে বাঘ মেরে তাদের বাঁচাতে? ভাগ্যিস সাহেবরা আছে, নইলে আমাদের গ্রামের-পর-গ্রাম উজাড় হয়ে কবেই বাঘের পেটে চলে যেত সবাই। কাজেই আমরা কিছুতেই আপনাকে ছাড়ব না। আপনাকেই বাঘ মেরে দিয়ে যেতে হবে।

আমি বললুম— মশায়, আমি শিকারি-টিকারি নই। সাহেবও নই। আমি পি ডব্লিউ ডি-র ওভারসিয়ার, এসেছি একটা ব্রিজের খোঁজে। আমার পক্ষে বাঘ মারা অসম্ভব ব্যাপার। জীবনে কোনোদিন একটা ইঁদুরও মারিনি তো বাঘ! আমি এখন ফিরে যাই। ফলসাগুড়িতে পৌঁছিয়েই একজন নির্ভেজাল সাহেব শিকারি পাঠিয়ে দেব। শুনেছি, রিঙ্গার সাহেব মস্ত শিকারি। গণ্ডা গণ্ডা বাঘ মেরেছেন। তাঁকে বললে, মহা খুশি হয়ে তিনিই হয়তো চলে আসবেন।

মোড়ল পুনরায় মাথা নেড়ে বললেন— তা হবে না। আপনি শিকারি কী শিকারি না, তা আমরা জানি না। আপনি যখন গাড়ি করে এসেছেন, আর হাতে বন্দুক রয়েছে, তখন আপনিই আমাদের সাহেব শিকারি। আপনাকেই বাঘ মারতে হবে।

আমি বললুম— কী মুশকিল! আমার গায়ের রংটা দেখেছেন? আমি কখনো সাহেব হতে পারি? আর, হাতে বন্দুক রয়েছে, তো কী হয়েছে? আমি কোনোদিন বন্দুক চালাইনি। বন্দুকের কোন দিক দিয়ে গুলি বেরোয়, তাই ভালো করে জানি না। কাজেই আমি এখনই ফিরে যাব।

তখন ভিড়ের ভেতর থেকে একটা ষণ্ডামতন লোক একটা দা হাতে এগিয়ে এল। চোখ পাকিয়ে বলল— আপনি যদি বাঘ মেরে দিয়ে না-যান, তাহলে আপনার গাড়িতে আমরা আগুন লাগিয়ে দেব আর আপনাকে কুচিকুচি করে কেটে ওই রংকিরা জলে ভাসিয়ে দেব।

আমি কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম— না, না, অত কিছু করবার কোনো দরকার নেই। বাঘ মারতে হবে তো? এ আর এমন কী বেশি কথা?

মনে মনে বললুম— এই আমার কপালে ছিল শেষপর্যন্ত।

আমার কথা শুনে সবাই একসঙ্গে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। বললুম— তা বাঘটা কোথায় আছে? কোথায় মারতে হবে?

মোড়ল বললেন— বাঘ তো আর আমাদের কাছে তার ঠিকানা রেখে যায়নি। তবে সে আসবে। রাত্রি বেলা আমরা গাঁয়ের ভেতরে একটা ছাগল বেঁধে রাখব। তাকে খেতে বাঘ আসবে। আপনি তখন তাকে গুলি করবেন। সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। এখন আমাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করুন। চাই কী দুপুরে একটু গড়িয়েও নিতে পারেন।

রাত্রি বেলা? বলে কী? আমাকে তো আজ রাত্রের মধ্যেই ফলসাগুড়ি পৌঁছতে হবে। না-হলে চাকরি নট। কিন্তু সে কথা বলি কাকে? এগুলে রামে মারবে, পেছুলে রাবণে মারবে। আপাতত প্রাণটা তো বাঁচাই। আমি আড়চোখে দা-ওয়ালা লোকটার দিকে চেয়ে বললুম— ঠিক আছে, তাই হবে।

.

দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা মন্দ ছিল না। কিন্তু খাওয়া কী যায়? আমার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে এমন ধড়ফড় করছিল যে প্রায় কিছুই সেখানে দিয়ে আর নামল না। যাই হোক, ভোজনপর্বটা শেষ হলে মোড়লের দাওয়ায় এসে বসলুম।

মোড়ল একটা ছোকরা ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। বললেন— এর নাম রাজু, এ আপনাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করবে। ওর তিনকুলে কেউ নেই, পড়াশুনোয় লবডঙ্কা, দিনরাত জঙ্গলের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। তাই জঙ্গলের হাড়হদ্দ ওর নখদর্পণে। বাঘ কখন কোন রাস্তায় চলে তা ওর চেয়ে ভালো এ-তল্লাটে কেউ জানে না। আপনার ওই রিঙ্গার সাহেব শিকার করতে এলে রাজুই ওঁকে জঙ্গলে নিয়ে যায়, মাচা বেঁধে দেয়, ঠিক জায়গায় টোপ বেঁধে রাখে। রিঙ্গার সাহেব তো পায়ের শব্দ শুনে বাঘ আসছে না হাতি আসছে তার কিছুই বুঝতে পারেন না। রাজুই ওঁকে সব বলে-টলে দেয়। কোনদিকে বন্দুক তাক করতে হবে, তাও বলে দেয়। কাজেই ও সঙ্গে থাকলে আপনার বিশেষ চিন্তা করবার দরকার নেই।

রাজুকে দেখে আমার কিন্তু চিন্তা বেড়েই গেল। এই কাটা হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা রোগা ছেলেটা আমার যে কী কাজে লাগবে আমি তো বুঝে উঠতে পারলুম না। ঠিক তখনি আর-একটা ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে মোড়লমশাই-এর পায়ের কাছে ধড়াস করে পড়ে গেল। আমি আঁতকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম।

ব্যাপারটা কী? জানা গেল, ব্যাপার অত্যন্ত গুরুতর। আজ সকালে ছেলেটি শহর থেকে কিনে আনা সবুজ গুঁড়ো সাবান দিয়ে রংকি নদীতে পাথরের ওপর আছড়ে-আছড়ে কাপড় কাচছিল। হঠাৎ বাঘটা হালুম করে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে অবশ্য তার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তার কারণ, সাবানের ফেনায় পেছল পাথরের ওপর পড়ে পা পিছলে সেটা হুড়মুড় করে রংকির ভেতরে পড়ে যায়। কোনোরকমে সাঁতরে নদীর অন্য পাড়ে উঠে সে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যায়। তারপরে আর তাকে দেখা যায়নি।

আহত বাঘ এইভাবেই নরখাদকে পরিণত হয়। অতএব, আমি ছেলেটিকে ভবিষ্যতে সাবানের ব্যবহার সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করার ব্যাপারে একটা ছোটোখাটো লেকচার দিয়ে ফেললুম। ছেলেটি হাঁ করে শুনল, কী বুঝল তা সে-ই জানে।

মোড়লমশাই বললেন— দেখেছেন তো, কী অবস্থায় আছি আমরা? বলে, নবাগত ছেলেটিকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। রাজু তখন আমার পাশে বসে আমার মুখের দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসতে শুরু করল।

মহা অস্বস্তিকর ব্যাপার। একটু বাদে বললুম— অ্যাই, হাসছিলি কেন রে?

শুনে ছেলেটা হিহি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। বলল— তুমি গনাকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলে, তাই না? গনার চেহারাটাই ওরকম, আসলে ও কিন্তু বেজায় ভীতু। ছাগল দেখলে হাঁটু বেঁকে যায় আর দিনের বেলাতেও ভূতের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে।

আমি বেজার হয়ে বললুম— যেরকম দা হাতে তেড়ে এসেছিল, তাতে ভয় পাব না?

রাজু বলল— সে যাকগে। এখন বলোতো তোমার মতো দিশি সাহেব নয়, আসল সাহেবদের দেশে কি মেলা বাঘ? তারা শুনি, মাটিতে দাঁড়িয়ে তেড়ে আসা বাঘকে এক গুলিতে মেরে ফেলে। আমরা যারা চোদ্দোপুরুষ বাঘের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করছি, সেই আমরাই বাঘের সামনে পড়লে নড়তে পারি না। তাবড়-তাবড় সাহসী লোকও বাঘের গর্জন শুনলে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেখানে সাহেবরা এত বড়ো বাঘশিকারি হয় কী করে? ওদের নিশ্চয়ই ছোটোবেলা থেকে বাঘ মেরে-মেরে হাত পাকানো, তাই না?

বললুম— সাহেবদের দেশে বাঘের একটা ন্যাজও দেখতে পাবিনে তুই। ওখানে আছে ছোটো-ছোটো লাল-লাল শেয়াল। সেই একটা শেয়াল মারতে বিশ-পঁচিশজন সাহেব, ষাট-সত্তরটা ডালকুততা নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বন্দুক বাগিয়ে শিঙে ফুঁকতে-ফুঁকতে শিকার করতে যায়। তবে কি না, ওরা হলগে সাহেব। তাই আমাদের দেশে এসে ওরা মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ মারে আর তাই নিয়ে মোটা মোটা বই লেখে। রিঙ্গার সাহেবও লিখেছেন, তবে তোর কথা কোথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করেননি। দ্যাখ, বাঘগুলোও তো আসলে নেটিভ, ভীতুর ডিম, তাই সাহেব দেখলে ওরাও নেতিয়ে পড়ে। আমাকে দেখলে তো তা হবে না, বরং হাঁউমাউ করে তেড়ে আসবে।

শুনে ছেলেটা আবার হাসতে শুরু করল। বলল— কোনো ভয় নেই। কী করতে হবে তা আমি সব বলে দেব।

পাণ্ডারবাজার গ্রামটার মাঝখানে একটা বড়ো ফাঁকা জমি, তার চারদিকে কুঁড়েঘর। রংকি নদীর ধার দিয়ে চলা মূল রাস্তা থেকে একটা পথ এসে সেই জমিতে পড়েছে। বিকেল বেলা ওই জমির ওপরে একটা খোঁটা পুঁতে মোড়লমশাই-এর একটা ছাগল বাঁধা হল। তার সামনে একগাদা পাতাসুদ্ধু ডালপালা রাখা হল। ছাগলটা পরমানন্দে শুয়ে শুয়ে সেই পাতা খেতে লাগল। সব ব্যবস্থা করে দিনের আলো থাকতে-থাকতেই যে যার ঘরে চলে গেল।

আমি মোড়লমশাই-এর দাওয়ার ওপরে বন্দুক নিয়ে বসলুম। রাজু একটা বড়োসড়ো দা দিয়ে অনেকগুলো কাঁটাঝোপ কেটে নিয়ে দাওয়ার চারদিকে পেতে দিল যাতে চট করে বাঘ এসে আমার ঘাড়ে না পড়তে পারে। পেছনের একটা দরজা খুলে রাখল যাতে বিপদ বুঝলে টুক করে ভেতরে ঢুকে পাল্লা বন্ধ করে দেওয়া যায়। এইসব কাজ শেষ করে দা হাতে আমার পাশে বসে পড়ল। বলল— সিগারেট খাবে না আর বকরবকর করবে না।

সন্ধে গড়িয়ে নিস্তব্ধ গ্রামের ওপর নিকষ কালো রাত নামল। চারদিকে কোনো শব্দ নেই, মাঝে মাঝে শুধু জঙ্গল থেকে ভেসে আসা কোনো নিশাচর পাখির কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছিল। দু-একটা জন্তু-জানোয়ারের ডাকও শোনা গেল তবে তারা যে কী জন্তু তা আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না। খানিক বাদে দ্বাদশীর চাঁদ উঠল। তাতে করে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারটা কিছুটা কেটে গেল। তখন দেখি, ছাগলটা খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে আর ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

রাজু আমার কানে ফিসফিস করে বলল— বাঘ চলতে শুরু করেছে।

শুনেই আমার বুক আর পেটের মধ্যে কেমন যেন গুড়গুড় করে উঠল আর তৎক্ষণাৎ খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছে হল। কিন্তু রাজু বসে থাকবে আর আমি পালিয়ে যাব, এতে আমার বিবেক সায় দিল না। ভাবলুম, যা হয় হবে। হয় এস্পার নয়তো ওস্পার।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ছাগলটা তারস্বরে ভ্যা ভ্যা করে ডাকতে আরম্ভ করল। সে কী ভয়ংকর ভ্যাভ্যাকার। কান ফেটে যায় আর কী! থামেই না। মোড়লমশাই-এর ছাগল তো, আর তেমনি গলা। কিছুক্ষণ বাদে আমার কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। গ্রামের ভেতর থেকেও কয়েকটা উঃ আঃ শুনতে পেলুম।

তারও কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ দেখি কালো ছায়ার মতন কী একটা গুড়ি মেরে ছাগলটার দিকে এগিয়ে চলেছে। হলদেটে চাঁদের মরা আলোয় সেটা যে কী তা বুঝতে পারলুম না। কোত্থেকে যে তার উদয় হল, তাও বোঝা গেল না। সেটা যখন ছাগলটার বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে, আমি কম্পিত হস্তে বন্দুক তুলে দড়াম করে গুলি চালিয়ে দিলুম।

তৎক্ষণাৎ অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল। ছাগলটার ভ্যাভ্যাকার বন্ধ হয়ে গেল, কালোছায়াটা আকাশ সমান লাফ দিয়ে উঠে দু-পায়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গ্রামের ভেতরে চলে গেল আর আমি বন্দুকের ধাক্কায় চিতপাত হয়ে পড়ে গেলুম।

ঘোর যখন কাটল, দেখি রাজু মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে আর গ্রামের ভেতর থেকে একদল লোক উত্তেজিতভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে মশাল-টশাল জ্বেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হল, তাদের উদ্দেশ্য ওই লাঠিসোঁটাগুলো আমার পিঠেই প্রয়োগ করা।

ইতিমধ্যে মোড়লমশাই বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি জনতার দিকে এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন কয়েক জন বয়স্ক গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে। আমি ততক্ষণে ধুলোটুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। মোড়ল মশাই বললেন— করেছেন কী? আপনাকে বলা হল বাঘ মারতে আর আপনি কালুয়ার ঠাকুমাকেই গুলি করে বসলেন! ভাগ্যিস গুলিটা তালগাছের মগডালে লেগেছিল। তা না-হলে যে কী হত কে জানে! রিঙ্গার সাহেব একবার বাঘ মারতে গিয়ে বনবেড়াল মেরেছিলেন। আপনি তো দেখছি রিঙ্গার সাহেবের চেয়েও ওঁচা। এখন যান, ওদের সামলান।

বয়স্ক গ্রামবাসীদের একজন বললেন— একটা ব্যাপার কিন্তু ভারি আশ্চর্য। কালুয়ার ঠাকুমা তো বাতের ব্যথায় বেঁকে গেছে, ভালো করে হাঁটতেই পারে না। সে যে অমন একটা লাফ মেরে অত জোরে দৌড়তে পারে, সেটা কোনোদিনই কল্পনাই করিনি!

আর একজন বললেন— যা বলেছেন। আর একটা কথা। কালুয়ার ঠাকুমা তো জানতুম বন্ধ কালা. আমি যখনই আমার সাড়ে পাঁচটাকা ফেরত দিতে বলি, কিছুই শুনতে পায় না। অথচ ওই হতচ্ছাড়া ছাগলের ডাকে নাস্তানাবুদ হয়ে তার মুখ বাঁধবার জন্যে এখানে চলে এল।

এই কথার মধ্যে হঠাৎ জনতার কোলাহল বন্ধ হয়ে গেল। দেখি, সকলে স্তব্ধ হয়ে গ্রামে ঢোকার পথটার দিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। আমি, রাজু, মোড়লমশাই আর বাকি সকলে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালুম। দেখা গেল, পথ দিয়ে একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘ একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে গ্রামের দিকেই আসছে। এতগুলো লোক যে মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সে ব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই।

কে যেন আমার কানে কানে বলল— হাঁ করে দেখছেন কী? বাঘটাকে মারবেন তো।

আমি তাড়াতাড়ি আবার কাঁপতে কাঁপতে বন্দুকটা তুলতেই রাজু হুংকার দিয়ে উঠল— খবরদার! এক্ষুনি বন্দুক নামাও। গুলি চালালে দা দিয়ে তোমার মুণ্ডুটা কেটে ধড় থেকে নামিয়ে দেব।

এরকম ভয়ংকর কথা শুনে আমি তক্ষুনি বন্দুক নামিয়ে নিলুম। রাজু তখন রাখাল ছেলেটা আর কাপড়কাচা ছেলেটাকে চিৎকার করে ডেকে বলল— তোরা কী গাধা না কি রে? পিকপিক কে চিনতে পারলি না? ওটা তো পিকপিক। তোদের সঙ্গে খেলতে এসেছিল!

বলামাত্র তিনজনে তিরবেগে ছুটে বাঘটার কাছে চলে গেল। তারপরে যা শুরু হল। তিনটে ছেলে আর বাঘটা মিলে জড়াজড়ি করে মাটির ওপরে গড়িয়ে পড়ল। তাই দেখে গ্রামের লোকেরা মাটিতে মশালগুলো পুঁতে লাঠিসোঁটা ছুড়ে ফেলে দৌড়ে গিয়ে ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।।

মোড়লমশাইও যাচ্ছিলেন। আমি ওঁর হাত ধরে আটকে জিজ্ঞাসা করলুম— এসব কী হচ্ছে বলুন তো?

মোড়লমশাই বললেন— আরে, ওটাতো আমাদের চেনা বাঘ। ওর জন্মের কয়েক দিন বাদেই ওর মা এক সাহেবের গুলিতে মারা যায়। সে আজ থেকে বছরছয়েক আগেকার ঘটনা। ও তখন খাবারের সন্ধানে আমাদের এই গাঁয়ে এসে ঢোকে। ছোট্ট একটা বেড়ালছানার মতো বাচ্চা। রাজুর তখন বছরদশেক বয়েস। সে ওকে পালতে শুরু করে। ওর তখন গলা দিয়ে পিকপিক করে আওয়াজ বেরুত, তাই ওর নাম রাখা হয়েছিল পিকপিক। ভারি মজার ছিল, সব্বার সঙ্গে খেলে বেড়াত। যখন বছরতিনেকের হল, তখন রাজু ওকে কাঁদতে কাঁদতে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এল। তারপর যে কোথায় চলে গিয়েছিল জানি না। আজ আবার ফিরে এসেছে।

আমি বললুম— ওটা কিন্তু আহত বাঘ। দেখছেন না খোঁড়াচ্ছে? আহত বাঘ কিন্তু ভীষণ মারাত্মক।

—দূর মশাই! মারাত্মক না কচু। আজ সকালে আছাড় খেয়েছিল, তাই একটু খোঁড়াচ্ছে।

—ওটা যে পিকপিকই তা বুঝলেন কী করে? ওর গায়ে কী নাম লেখা আছে? অন্য বাঘও তো হতে পারে।

—শোনো কথা। আপনি তো দেখছি রিঙ্গার সাহেবের চেয়েও… সে যাকগে। আপনার গায়ে কী নাম লেখা আছে না কি? তাহলে আপনার গিন্নি আপনাকে চেনেন কী করে? আমরা বনের মধ্যে থাকি। বাঘ তো দূরের কথা, আমরা প্রত্যেকটা কাঠবিড়ালীকে আলাদা আলাদা করে চিনি। আপনার যেমন নাক-চোখ-মুখ-কান আছে, ওদেরও তাই আছে, বুঝলেন? রাজুর চোখের জোর খুব বেশি তাই এত দূর থেকে পিকপিককে চিনতে পেরেছে। ও আর একটু কাছে এলে আমরাও পারতুম।

আমি বললুম— ভাগ্যিস গুলিটা চালাইনি। চালালে যে কী হত, কে জানে।

মোড়ল বললেন— কিছুই হত না। বড়োজোর, ওই বাদামগাছটার ওপরে ঘুমিয়ে থাকা একটা বাঁদরের ন্যাজ ফুটো হয়ে যেত। তার বেশি কিছু নয়। এখন যাই, আমিও পিকপিককে আদর করে আসি।

.

মোড়লমশাই চলে গেলেন। হলদে চাঁদের মরা আলোয় ফাঁকা জমির ওপরে আমি আর ছাগলটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।

 একটি প্রজাপতির অকালমৃত্যু

সকাল বেলা জানলা খুলে যথারীতি মুখ বেঁকালেন ইন্দ্রজিৎবাবু। গত কয়েক দিন ধরেই এই চলেছে। ইন্দ্রজিৎবাবুর উষ্মার কারণ তাঁর জানলার ঠিক সামনে, রাস্তার উলটো দিকে, একটা অতিকায় বিজ্ঞাপন। তাতে আগামী মাসের সাত তারিখে কলকাতার মহানগর রঙ্গমঞ্চে ফাল্গুন মিত্র আর গগন চৌধুরির যুগ্ম সংগীতের ফেনিল সুধা পান করবার জন্যে কলকাতাবাসীদের সাদর আহ্বান জানানো হয়েছে, প্রবেশমূল্য মাত্র দশ হাজার টাকা।

বিজ্ঞাপনটা দেখলেই ইন্দ্রজিৎবাবুর ছেলেবেলায় তাঁর স্কুলের সংস্কৃত ক্লাসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রায়ই পণ্ডিতমশায় বলতেন, ‘ব্যাকরণে বলেছে ফাল্গুনে গগনে ফেনে ণত্বমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ। অর্থাৎ, ফাল্গুন, গগন আর ফেনে একমাত্র বর্বরেরাই মূর্ধন্য ণ বসায়।’

এই বিজ্ঞাপনটায় সেই তিনটে শব্দই বিরাট আকারে উপস্থিত। কাজেই, প্রখরমূর্তি অগ্নিশর্মা পণ্ডিতমশায়ের কথা যে ইন্দ্রজিৎবাবুর মনে পড়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

পল্লবী এক কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন— কী দেখছ বাইরে?

ইন্দ্রজিৎবাবু বললেন— দেখছি না, ভাবছি। আমাদের স্কুলের পণ্ডিতমশাই বলতেন যে আমাদের বর্বর হয়ে যেতে আর বেশি দেরি নেই। আমরা কী এতদিনে বর্বর হয়ে গেছি না আরও একটু বাকি আছে— সে কথাই ভাবছিলাম।

পল্লবী ঠক করে কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন— রিটায়ার করেছ বলে কী আর কোনে কাজ নেই তোমার? সকাল থেকে এইসব হিজিবিজি চিন্তা না-করে, সেই যে সময়সরণি না কোথায় যাবে বলছ কয়েক দিন ধরে, সেখানেই যাও না।

—ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। বিজ্ঞানবিক্ষণ কেন্দ্রে সময়সরণি বলে একটা টাইমমেশিন বসিয়েছে। তাতে চড়ে অতীত থেকে ঘুরে আসা যায়। কলকাতায় এই প্রথম। ভাবছি, ব্যাপারটা কী সেটা একবার দেখা দরকার। তুমিও যাবে না কি?

—কক্ষনো না। আমি এই বর্তমানেই ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি নিয়ে বেশ আছি। তোমাদের ওই অতীতে গিয়ে যদি আটকে যাই আর ফিরে আসতে না-পারি, তখন কী হবে? কোনো দরকার নেই। তোমার যেতে হয়, তুমি যাও। আর, আসার সময় কিছু মিষ্টি কিনে এন। কাল মেয়ে-জামাই আসছে, মনে আছে তো?

—কিন্তু অতীত থেকে তো কিছু আনা যায় না বলে শুনেছি।

—অতীত থেকে তোমাকে কে আনতে বলেছে? বর্তমানেই রাস্তার মোড়ে যে দোকানটা আছে, ওখান থেকে আনলেই হবে। মনে থাকবে তো?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে থাকবে।

—কিচ্ছু বলা যায় না। অতীত থেকে ঘুরে এসে আমাদের কথাই মনে থাকবে না হয়তো।

.

বিজ্ঞানবিক্ষণ কেন্দ্র ইন্দ্রজিৎবাবুর বাড়ির থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে পৌঁছে ইন্দ্রজিৎবাবু দেখলেন কেন্দ্র তখন সবে খুলেছে। লোকজন বেশি নেই। সময়সরণির ঘরে তখনও কোনো দর্শক আসেননি, ইন্দ্রজিৎবাবুই প্রথম।

নীলরঙের কাপড়ের ওপরে ছোটো ছোটো তারা বসানো ইউনিফর্ম পরে একজন মহিলা দর্শকদের আপ্যায়ন করবার জন্য বসে ছিলেন। তিনি ইন্দ্রজিৎবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন— কোথায় যেতে চান?

ইন্দ্রজিৎবাবু বললেন— কীরকম খরচ পড়বে তার ওপরে সেটা নির্ভর করছে।

—যদি কাছেপিঠে যেতে চান, মানে ধরুন এক-শো কী দু-শো বছর পেছনে, তবে খরচা সামান্যই পড়বে। যত বেশি দূরে যাবেন, খরচা তাতেই বেড়ে যাবে।

—সবাই কী করেন? ধারেকাছেই যান?

—আবার কী? কেউই খুব একটা পেছনে যেতে চান না। শ-দুয়েক বছরের মধ্যে গেলেই আপনি স্বশরীরে রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ বা ১৫ আগস্টের উৎসব দেখতে পাবেন। আর একটু পেছলে রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা ওয়ায়েন হেস্টিংসকে দেখবেন। তার থেকে একটু বেশি পেছনে গেলে আর তেমন কিছু পাবেন না। এই অঞ্চলটা তো তখন জঙ্গল, কলকাতা আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে। সেই সময় এখানে বাঘ-টাঘ ঘুরে বেড়াত। সে সব দেখতে আর কে চায় বলুন?

—যদি আরও পেছনে যাই?

—আরও পেছনে? আপনি কি সৃষ্টির গোড়ায় যেতে চান না কি? বিগ ব্যাং? অতদূর আপনাকে নিয়ে যেতে পারব না, সেটা গোড়াতেই বলে দিচ্ছি। আমাদের রেঞ্জ অতটা নয়।

—সবচেয়ে বেশি কতদূর যাওয়া যাবে?

—সবচেয়ে দূরে। আমাদের রেঞ্জের সবচেয়ে পেছনে আছে মেসোজোয়িক যুগ। সেখানে যাবেন না কি?

ইন্দ্রজিৎবাবু কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। অন্যমনস্কভাবে বললেন— মেসোজয়িক যুগ? তখন প্রথম পৃথিবীতে ফুল ফুটেছিল। একদিকে দেখা দিয়েছিল অতিকায় সরীসৃপের দল— ব্রন্টোসরাস, টাইরানোসরাস, ডিপলোডকাস, ট্রাইসেরাটপস, প্টেরোডক্টিল। আবার এই যুগেই তাদের দানবিক অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গিয়েছিল। অন্যদিকে খুব ছোটো ছোটো পোকার আবির্ভাব হয়েছিল। তারা সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলেছিল।

—ঠিক বলেছেন। যাবেন না কি ওই সব দানবাকৃতি সরিসৃপ আর ছোটো ছোটো পোকা দেখতে?

—যাওয়া যাবে? ইন্দ্রজিৎবাবুর গলাটা কেঁপে গেল।

—তা যাবে। তবে ঝামেলা আছে। প্রথমত খরচ খুব বেশি, দ্বিতীয়ত অত দূরের যুগে থাকবার সময় খুব কম, আর তৃতীয়ত আমাদের মনস্তত্ববিদ আপনাকে পরীক্ষা করে আপনি মানসিকভাবে সুস্থ বললে তবেই আপনাকে যেতে দেওয়া হবে।

—সে আবার কী? প্রথম দুটো তো বুঝলুম, শেষ নিয়মটা কেন?

—তার কারণ, জীবনের বিবর্তনে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা যাতে না-হয়, সেটা আমরা সুনিশ্চিত করতে চাই। বুঝিয়ে বলি। পৃথিবীর বুকে যখন থেকে প্রাণ এসেছে, তখন থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত জীবজগতের পশুপাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ একের পর এক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এই পরিবর্তগুলো পশুপাখির আলাদা, গাছপালার আলাদা বা কীটপতঙ্গের আলাদা— এরকম নয়। এদের প্রত্যেকটার সঙ্গে প্রত্যেকটার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে। এই যোগসূত্রটা যদি কোথাও ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে বিবর্তন চলতে থাকলেও সেটা একটু পালটে যাবে। দু-পাঁচশো বছরে তার ফলটা হয়তো বোঝা যাবে না, কিন্তু পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ বছরে সেটা যথেষ্ট বোধগম্য হবে।

যেমন ধরুন, আজ থেকে এক লক্ষ বছর পেছনে চলে গিয়ে আপনি একটা পাখি মারলেন যেটার সে সময় মরবার কথা নয়। সেটা বেঁচে থাকলে যা হত, এবার তা হবে না। কিছু অন্যরকম হবে। আবার তার প্রভাব পড়বে অন্য প্রাণীদের ওপর। ফলে, আপনি যখন এক লক্ষ বছর পেরিয়ে ফিরে আসবেন বর্তমান সময়ে, তখন দেখবেন আপনার চারপাশে কোথাও না-কোথাও কিছু না-কিছু পালটে গেছে। আপনার আশেপাশে যারা আছে, তারা সেটা বুঝতে পারবে না, কারণ আপনার বিবর্তন আর বাকি সকলের বিবর্তন একরকম হয়নি।

ইন্দ্রজিৎবাবু একটু উদবিগ্ন হয়ে বললেন— সেটা কীরকম হবে?

—সেটা তো সঠিক বলা যায় না। বিবর্তন তো কোনো ধরাবাঁধা পথ দিয়ে চলে না। এটা কীভাবে হয়, তা এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। হয়তো, আপনি ফিরে এসে দেখলেন মানুষের একটা কান বড়ো আর একটা কান ছোটো হয়ে গিয়েছে। আপনার একই মাপের দুটো কান দেখে সবাই হাসাহাসি করছে। অথবা দেখলেন যে গোরুর ডাক পালটে গেছে। তারা কোঁকরকোঁ করছে আর মুগরিরা হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। তাতে একমাত্র আপনিই আশ্চর্য হচ্ছেন, আর কেউই হচ্ছে না। কাজেই, বিবর্তনের ধারা অপরিবর্তিত রেখে এইসব হাঁসজারু মার্কা গণ্ডগোল এড়ানোর জন্যেই আমাদের এই সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আপনি যদি বোকা বা পাগল বা একগুঁয়ে হন তখন আপনাকে আমরা যেতে দেব না; কোটি টাকা দিলেও না। আমাদের সব উপদেশ আপনাকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে, মানতে হবে। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেওয়া চলবে না।

এই যে আপনি মেসোজোয়িক যুগে যেতে চাইছেন, সেখানে গিয়ে একটা বাচ্চা ট্রাইসেরাটপস দেখে হয়তো আপনার খুব পছন্দ হল। ভাবলেন, কী মিষ্টি দেখতে! এটাকে নিয়ে যাই, পুষব। কেউ টের পাবে না, কিচ্ছু হবে না। তা করলে চলবে না। আমাদের সমস্ত উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার মতো স্বভাব আর মনের জোর যদি আপনার থাকে, তাহলেই আপনি যেতে পারবেন।

ইন্দ্রজিৎবাবু একটু চিন্তা করে বললেন— ঠিক আছে। আমি যাব। এই আমার কার্ড। আপনি আমার ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে যা করবার করে ফেলুন। ইতিমধ্যে আপনাদের মনস্তত্ববিদদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা যা হবার হয়ে যাক।

.

সময়সরণি যন্ত্রটা একটা চকচকে ধাতুর তৈরি ছোটো ঘরের মতো। ভেতরে নানারকমের যন্ত্রপাতি, তাতে লাল নীল সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে। ঘরের মাঝখানে একটা মস্ত গদিমোড়া চেয়ার, অনেকটা যেমন সেলুনে দেখা যায় তেমনি। ঘরের একপাশে ভেতরে ঢোকার ধাতব দরজা। জানলা-টানলা কিছু নেই।

একজন আপ্যায়ন বিভাগের মহিলার মতোই ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোক ইন্দ্রজিৎবাবুকে নিয়ে এসে চেয়ার বসিয়ে দিলেন। বললেন— যা বলছি, খুব মন দিয়ে শুনুন। আমরা সময়সরণিকে মেসোজোয়িক যুগের শেষদিকের কোনো এক সময়ে সেট করে দিয়েছি। আপনি এই সবুজ বোতামটা টিপলে চোখের নিমেষে সেখানে পৌঁছে যাবেন। এই হলদে আলোটা জ্বললে বুঝবেন যে আপনি পৌঁছে গেছেন তখন আপনি চেয়ার ছেড়ে উঠবেন আর সঙ্গেসঙ্গে এই দরজাটা খুলে যাবে। আপনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দরজার তলা থেকে একটা তীব্র নীল আলোর এক মিটার চওড়া পথ সামনের দিকে প্রায় তিরিশ মিটার পর্যন্ত চলে যাবে। এই আলোটা গাছপালা বাড়িঘর সব কিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে। আপনি এই আলোর পথ দিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে যাবেন। এই পথের ওপরে থাকলে কেউ আপনাকে দেখতে পাবে না বা স্পর্শ করতে পারবে না, আর আপনিও এই পথের ওপরে কোনো কঠিন বস্তুর বাধা থাকলেও তা ভেদ করে চলে যেতে পারবেন।

ভুলেও এই পথের বাইরে যাবেন না। গেলে আপনার নিরাপত্তার কোনো দায়িত্ব আমাদের থাকবে না। আপনি ওখানে থাকবার সময় পাবেন দশ মিনিট। তার মধ্যে আপনাকে সময়সারণিতে ফিরে আসতে হবে। আট মিনিট পার হলে দরজার ওপরে একটা ঘণ্টা বাজবে আর একটা লাল আলো জ্বলে উঠবে যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে ফেরার সময় হয়েছে। সাড়ে দশ মিনিট বাদে নীল আলোর পথটা নিভে যাবে। কাজেই, সে ব্যাপারে খুব সাবধান।

সময়সারণিতে ফিরে চেয়ারে বসে আবার সবুজ বোতামটা টিপবেন। দরজা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে। আর, তৎক্ষণাৎ আপনি বর্তমান সময়ে পৌঁছে যাবেন।… সব বুঝতে পেরেছেন তো? কোনো প্রশ্ন আছে?

ইন্দ্রজিৎবাবু মাথা নাড়লেন।

.

দরজার বাইরে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎবাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। এ কী দেখছেন? কোথায় কলকাতা শহর? তার জায়গায় বিশাল বিশাল মহীরুহের গভীর জঙ্গল, তাদের ডালপালায় মাথার ওপরে আকাশ প্রায় দেখাই যায় না। গাছের নীচে এক মানুষ উঁচু নিশ্চিদ্র ঝোপঝাড়। যেটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে তা অন্ধকার করে রেখেছে ঘন মেঘের স্তূপ, বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। মাঝে মাঝে তীব্র চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের আলো আর কান ফাটানো মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলের ভেতর থেকে নানা রকমের অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে— সেগুলো শুনলে আনন্দ হয় না, বুকের রক্ত জল হয়ে যায়। কখনো কখনো আশেপাশে ধুপ ধুপ করে শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন ভীষণ ভারী কিছু চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।

দরজার বাইরে বেরিয়ে এলেন ইন্দ্রজিৎবাবু। তাঁর পায়ের তলায় নীল পথটা আলোর বটে তবে তার ওপর দিয়ে হাঁটা যায়। তিনি দেখলেন যে পথটা সত্যি সত্যিই গাছপালা বা মাটির ঢিবি ভেদ করে চলে গেছে। বৃষ্টি যে পড়ছে তা তাঁর গায়ে লাগছে না। আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে যে আশেপাশে জীবন্ত কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের পক্ষে তাঁর কোনো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে যে তারা সময়সরণি বা ইন্দ্রজিৎবাবুকে দেখতেই পাচ্ছে না। দেখতে পেলে এতক্ষণে সামনে চলে আসত।

বেশ খোশমেজাতেই সামনে এগিয়ে চললেন ইন্দ্রজিৎবাবু আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন— কোথায় বাবা ব্রন্টসরাস, একবার দেখা দে বাবা! আর, টাইরানোসরাস রেক্স ব্যাটাচ্ছলেই বা গেল কোথায়? এত টাকাপয়সা খরচ করে এলুম, তোদের না দেখেই চলে যাব না কি? আয় বাবারা।

হঠাৎ একজায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেলেন ইন্দ্রজিৎবাবু। তাঁর পাশে ঝোপের ভেতরে ফুটে রয়েছে একগুচ্ছ ফুল। প্রায় দশ সেন্টিমিটার ব্যাসের গাঢ় কমলারঙের ফুল, পাপড়ির ওপরে বেগুনি রঙের ছিটে। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন ইন্দ্রজিৎবাবু।

—পৃথিবীর প্রথম ফুল! অসাধারণ! বিড়বিড় করে বললেন ইন্দ্রজিৎবাবু। তোলা তো যাবে না, তাহলে আবার কোথায় কী গণ্ডগোল হয়ে যাবে কে জানে! কিন্তু প্রথম ফুলের সুগন্ধ না-শুঁকে ফিরে যাব? গন্ধ শুঁকতে তা কোনো বাধা নেই। মুখটা না-হয় রুমাল বেঁধে ঢেকে রাখব যাতে কোনো পোকামাকড় নাকে-মুখে ঢুকতে না-পারে।

সেইভাবে মুখ ঢেকে ইন্দ্রজিৎবাবু আলোর রাস্তা থেকে গলা বাড়িয়ে দিলেন ফুলগাছের দিকে। কোথায় সুগন্ধ? একটা বিকট পচা দুর্গন্ধে চমকে মুখ তুলে ইন্দ্রজিৎবাবু দেখলেন যে তাঁর থেকে কুড়ি মিটার দূরে দুটো অতিকায় গাছের ফাঁক দিয়ে প্রায় চারতলা বাড়ির উচ্চতা থেকে একজোড়া নৃশংস ক্রুর চোখ তাঁর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। সে তো ইন্দ্রজিৎবাবুর শরীরটা দেখতে পাচ্ছে না তাই বোধ হয় বোঝবার চেষ্টা করছে যে দেহহীন মুণ্ডুটা খাদ্যবস্তু কি না। তার এবড়ো-খেবড়ো দাঁতওয়ালা প্রকাণ্ড কদাকার মুখের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

টাইরানোসরাস রেক্স! বেশিক্ষণ অবাক হয়ে চিন্তা করবার মতো মগজের ক্ষমতা এর নেই। এক্ষুনি আক্রমণ করবে। ভাবলেন ইন্দ্রজিৎবাবু। আর তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথাটা ঢুকিয়ে আনলেন আলোর পথের ভেতরে। ঠিক সেই মুহূর্তে টাইরানোসরাসটার প্রকাণ্ড বিভৎস মুখটা অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ফুলগাছটার ওপরে এসে পড়ল। ভয়ংকর আতঙ্কে দিশেহারা ইন্দ্রজিৎবাবু লাফিয়ে উঠে ধপাস করে পড়ে গেলেন। তারপর কোনোরকমে নিজেকে অজ্ঞান হতে না-দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে সময়সরণির দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলেন।

দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে দেখলেন সেই চারতলা সমান উঁচু ভয়ংকর প্রাণীটা তার পেছনের পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর তার প্রকাণ্ড ল্যাজটা এপাশে-ওপাশে আছড়াচ্ছে। তার পায়ের নীচে মরে পড়ে আছে একটা রঙিন বড়োসড়ো প্রজাপতি। সে বেচারি বোধ হয় ওই ফুলটার মধু খাওয়ার লোভেই ওখানে এসেছিল।

সময়সরণির চেয়ারে বসে ইন্দ্রজিৎবাবু ভাবলেন, প্রজাপতিটা যে মরল, তাতে কি বিবর্তনে কোনো অদলবদল হবে? প্রজাপতিটাকে তো আমি মারিনি, মেরেছে ওই ব্যাটা দাঁত-না-মাজা টাইরানোসরাস রেক্স। তবে কি না, প্রজাপতিটার তখন মরবার কথা ছিল না। প্রত্যক্ষভাবে না-হোক, পরোক্ষভাবে আমিই কিন্তু তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী। যাক গে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ওই একটা তুচ্ছ প্রজাপতির জন্যে কী আর এমন মহামারি পরিবর্তন হবে?

বিজ্ঞানবিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে চারদিকে দেখতে দেখতে ইন্দ্রজিৎবাবু মিষ্টির দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। লোকজন, গাড়িঘোড়া, বাড়িঘর, কোথাও কোনো পরিবর্তন নজরে পড়ল না।

বাড়ি ফিরে মিষ্টির বাক্সটা পল্লবীর হাতে দিলেন ইন্দ্রজিৎবাবু।

পল্লবী জিজ্ঞেস করলেন— সময়সরণিতে গিয়েছিলে না কি? কীরকম অভিজ্ঞতা হল?

ইন্দ্রজিৎবাবু বললেন— আর বোলো না। সে অতি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। শুনবে?

—তুমি ঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসো। আমি চা নিয়ে আসছি। তা খেতে খেতে শুনব।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ইন্দ্রজিৎবাবু তাঁর ঘরে ঢুকে জানলাটা খুলে দিলেন। সামনে বিশাল বিজ্ঞাপনটার দিকে নজর পড়ল। অমনি ওঁর গান বন্ধ হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে খাটের ওপর বসে পড়লেন।

বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল আগামী মাসের সাত তারিখে কলকাতার মহানগর রঙ্গমঞ্চে ফাল্গুণ মিত্র আর গগণ চৌধুরির যুগ্মসংগীতের ফেণিল সুধা পান করবার জন্যে কলকাতাবাসীদের সাদর আহ্বান জানানো হয়েছে, প্রবেশমূল্য দশ হাজার টাকা।

.

চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন পল্লবী। বললেন— বলো, কী অভিজ্ঞতা হল তোমার?

ইন্দ্রজিৎবাবু মাথা নীচু করে বিছানার ওপর বসে ছিলেন। আচ্ছন্নের মতো বললেন— না, সে তেমন বলবার মতো কিছু নয়। আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে কী সংস্কৃত ব্যাকরণ আছে?

—সংস্কৃত ব্যাকরণ? সংস্কৃত ব্যাকরণ দিয়ে কী করবে?

—কিছু না। দেখব যে ফাল্গুনে গগনে ফেনে ণত্বমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ সূত্রটা এখনও সেখানে আছে, না আমারই জন্যে আজ তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে

 ডাক্তার গুপ্তের বরাত

ডাক্তার শ্রীকান্ত গুপ্ত মুম্বই-এর লব্ধপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। কলকাতাতেও তাঁর নাম অনেকেই জানেন। বান্দ্রার এক সমৃদ্ধ পাড়ায় তাঁর নার্সিং হোম আর চেম্বার। তাঁকে দেখাতে গেলে এক মাসের আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না।

এঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মুম্বই থেকে কলকাতায় ফেরার পথে, প্লেনে। আমি কোম্পানির কাজে পুনেতে গিয়েছিলুম। ফিরছিলুম সেখান থেকে। আমার পাশেই সিট পড়েছিল ডাক্তার গুপ্তের।

আমি তো গোড়াতে বুঝতেই পারিনি যে আমার সহযাত্রীটি একজন অতবড়ো বিখ্যাত ডাক্তার। একেবারে নিরহংকার, সাদাসিধে ভদ্রলোক আর খুব গল্পে। সিটে বসতে না-বসতেই আড্ডা জুড়ে দিলেন। ভাবলুম, ভালোই হল। আড়াই ঘণ্টার পথ, সময়টা ভালোই কাটবে।

ডাক্তার গুপ্তের পরিচয় পাবার পর আমি একটু সংকুচিতই হয়েছিলুম। উনি দেখলুম নির্বিকার। উলটে আমাকেই বললেন— গল্প করার সময় তো পাইনে। তাই এই অবসরগুলো সেই ফাঁক পূরণের কাজে লাগাই। আপনি বিরক্ত হবেন হয়তো।

আমি তো লজ্জায় মরি। তারপর একথা সেকথায় জানতে পারলুম যে ভদ্রলোক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছেন। জিজ্ঞেস করলুম, মুম্বইতে গেলেন কবে? পশ্চিমবাংলা ছাড়লেনই বা কেন?

তখন ডাক্তার গুপ্ত বেশ জমিয়ে সেই কাহিনি শোনালেন আমাকে।

.

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন শ্রীকান্ত। তাঁর বাবা তার বছর দুয়েক আগে মারা যান। তাঁর সামান্য পেনশনে সংসার চলত। তার ফলে যদিও পরীক্ষায় তাঁর ফল অত্যন্ত ভালো হয়েছিল, বিলেতে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষার আশা ত্যাগ করে তাঁকে সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়তে হল।

তাঁর প্রথম পোস্টিং হল বাঁকুড়া জেলার এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কিন্তু তখন আর তার চেয়ে উচ্চতর কোনো চাকরির সন্ধান করার উপায় বা সামর্থ্য ছিল না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ামাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাকরিতে যোগ দিলেন।

সেটাই কাল হল। এরপর দশ বছর ধরে বাঁকুড়া, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি বা পুরুলিয়ার এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অন্য এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বদলি হতে লাগলেন। এমনকী কোনো মহকুমা শহরের হাসপাতালেও তাঁর স্থান হল না। তিনি দেখলেন পরীক্ষায় তাঁর চেয়ে অনেক নীচে স্থান পাওয়া তাঁর সহপাঠীরা বদলি হয়ে কলকাতায় চলে গেল অথচ তিনি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন।

এরকম হবার অবশ্য কারণ ছিল।

প্রথমত, তাঁর মামার জোর বলে কিছু ছিল না। এমন কোনো নিকটাত্মীয় ছিলেন না যিনি তাঁর হয়ে সরকারি দপ্তরে তদ্বির করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, কোনো রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর কোনো ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি তাঁর ছিল না। একাধিক বার তাঁর কাছে টোপ ফেলা হয়েছে বা কিছু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রস্তাব এসেছে, তিনি সাড়া দেননি।

তৃতীয়ত, তাঁর ব্যক্তিত্বটা এরকম নয় যে টেবিল চাপড়ে, চিৎকার করে বা ভয় দেখিয়ে নিজের পাওনাগণ্ডা আদায় করে নেবেন। তাঁর রুচিবোধেও এর সায় ছিল না।

ফলে, যা হবার তাই হল। ডাক্তার শ্রীকান্ত গুপ্ত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দশ বছর ধরে অনেক চিঠিপত্র লিখলেন, অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন কিন্তু সরকারি দপ্তর অনড় হয়ে রইল।

এই দশ বছরে ডাক্তার গুপ্তের মনে একটা ধারণা দৃঢ়মূল হয়ে উঠল। তাঁর মনে হতে লাগল, উচ্চতর শিক্ষা তো পরেকার কথা, আপাতত যেটুকু শিক্ষা তিনি পেয়েছেন তাও আর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে ভুলে যেতে হবে। আস্তে আস্তে তাঁর ভেতরে একটা গভীর নৈরাশ্য দানা বেঁধে উঠতে লাগল।

এইসময় একমাসের ছুটি নিয়ে ডাক্তার গুপ্ত মুম্বই গেলেন বেড়াতে। সেখানে তাঁর এক দূরসম্পর্কের কাকা থাকতেন। তাঁর বাড়িতেই উঠলেন। সেই ভদ্রলোক থাকতেন ক্যান্ডিভিলি বলে একটা জায়গায়। মুম্বই শহরের কেন্দ্র থেকে ট্রেনে করে সেখানে যেতে লাগে এক ঘণ্টার ওপর।

কাকার কাছে তাঁর দুঃখের কথা বললেন ডাক্তার গুপ্ত। কাকা বললেন, তুই এক কাজ কর। চার্চগেট স্টেশনের কাছে আমার এক বন্ধুর একটা দোকান আছে। তার গুদোমঘরটা কিছুদিন হল খালি পড়ে আছে। বেড়ানো আপাতত বন্ধ রেখে তুই সেখানে নেমপ্লেট ঝুলিয়ে চেম্বার খুলে বোস। বাঙালি ডাক্তার দেখলে রুগিপত্র আসতে পারে। এক মাস চেষ্টা করে দ্যাখ। যদি পসার হয়ে যায় তবে আর ফিরে যাস না, এখানেই থেকে যাস। তখন যত পারিস বেড়াস।

সেইরকমই করা হল। পরের দিনই চেম্বার খোলা হল। ডাক্তার গুপ্তের কাকার বন্ধু শিবেন্দ্র দেশাই অসাধ্যসাধন করলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘরটা পরিষ্কার হয়ে গেল, দরজা জানলায় পর্দা লাগল। একটা ছোটো টেবিল, গোটা চারেক চেয়ার আর একটা লম্বা টেবিল পর্যন্ত পাতা হয়ে গেল।

সবই হল কিন্তু রুগির সন্ধান মিলল না। ডাক্তার গুপ্ত সকাল আটটায় চেম্বার খোলেন, সারাদিন গালে হাত দিয়ে টেবিলে বসে থাকেন আর সামনে দিনকর শা মার্গ দিয়ে লোকজনের যাতায়াত দেখেন। সবাই সুস্থ সবল, গটমট করে হেঁটে যায়। ডাক্তার গুপ্ত দেখেন আর মনে মনে তাদের পিণ্ডি চটকান। মাঝে মাঝে দলছুট এক-আধজন আসে। তাদের অনেকক্ষণ ধরে দেখেন। মাথা ধরার রুগি এলে তাকে লম্বা টেবিলের ওপর ফেলে তার আগাপাস্তলা পরীক্ষা করেন। কিছুটা সময় তো কাটে। রাত আটটায় দোকান বন্ধ করেন। কান্ডিভিলি পৌঁছতে রাত দশটা।

এই চলে দিনের পর দিন। মনে মনে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন ডাক্তার গুপ্ত। তাঁর চেম্বারের ঠিক উলটো দিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা প্রকাণ্ড বাড়ি, গেটে দুটো মুশকো দরওয়ান, ভেতরে সুন্দর ফুলের বাগান। তিনি ওই দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।

এমনি করে প্রায় পনেরো দিন কেটে গেল। সেদিন রাত আটটায় দরজা তালা দিয়ে পেছন ফিরে ডাক্তার গুপ্ত দেখেন সামনের বাড়ির দুই দরোওয়ান লাঠি হাতে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা বলল— মাইজি আপকো বুলাতি হ্যয়।

সর্বনাশ করেছে! মাইজি আবার বুলাতি কেনরে বাবা! ডাক্তার গুপ্ত মনে মনে ভাবলেন, কই আমি তো কোনোরকম বেচাল ব্যবহার করিনি! আমি যে মাঝে মাঝে ওই বাড়ির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, তাতেই নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা ক্ষেপে গেছেন। তখন ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে যদি কেটে পুঁতেও রাখেন, কাকপক্ষীও টের পাবে না। কিন্তু, যেতেই হবে। পালাবার কোনো রাস্তাই নেই।

কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তার গুপ্ত। নেমপ্লেটে দেখলেন শেঠ হরিরাম মীরচান্দানীর নাম। শ্রীমতী মীরচান্দানী পর্দানশীন মহিলা। নীচের তলায় পর্দার আড়াল থেকে কথা বললেন। গলা শুনে বোঝা গেল ভদ্রমহিলার অনেক বয়েস।

ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি আমার স্বামীকে একবার দেখবে বাবা? গত দশ-এগারো মাস ধরে কী এক অসুখে ভুগছেন। কোনো ডাক্তার সারাতে পারছে না। এখানকার হেন বড়ো স্পেশালিস্ট নেই যাঁকে ডাকা হয়নি। তাঁদের কেউ কিচ্ছু করতে পারেননি। ইদানীং উনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। আমি লক্ষ করেছি কিছুদিন আগে তুমি আমাদের বাড়ির সামনে চেম্বার খুলেছ। তোমার মুখ দেখে আমার কী রকম মনে হয়েছে যে ওঁকে যদি কেউ সুস্থ করে তুলতে পারে তো সে তুমি। আমি আমার স্বামীকে বলেছি যে বাচ্চাকে একবার ডাকি। উনি রাজি হয়েছেন। তুমি ওঁকে একটু দ্যাখো, বাবা।

ভদ্রমহিলার কথা শুনে ডাক্তার গুপ্ত আরও নার্ভাস হয়ে পড়লেন। বললেন— বড়ো বড়ো স্পেশালিস্টরা যা পারেননি, সে কি আমি পারব? তবে আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই দেখব। আর রুগি পরীক্ষা করবার আগে আমি একবার ওঁর অসুখের ফাইলটা দেখতে চাই।

একটু বাদে একজন লোক ফাইলটা দিয়ে গেল। ফাইল দেখে তো ডাক্তার গুপ্তের চক্ষুস্থির। মুম্বই-এর তাবড় তাবড় ডাক্তাররা হেন অসুখ নেই যা নির্ণয় করেননি। তাদের মধ্যে এমন সব অসুখও আছে যাদের নামই কোনোদিন শোনেননি ডাক্তার গুপ্ত।

কী আর করেন! কম্পিত পদে রুগির ঘরে গেলেন ডাক্তার গুপ্ত। শেঠ হরিরাম মীরচান্দানীর বয়েস ষাটের উপর। কঙ্কালসার শরীর, গাল ভাঙা, চোখগুলো গর্তে বসা, পেটটা কেবল উঁচু হয়ে রয়েছে, বাকি সবটা বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েছে।

রুগিকে পরীক্ষা করে ডাক্তার গুপ্তের মনে হল রোগটি ম্যালেরিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দশ বছর পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, আর কিছু না-হোক ম্যালেরিয়ার লক্ষণগুলো বিলক্ষণ চেনেন। ম্যালেরিয়া আর আমাশা— এদের যতরকম বিভিন্ন রূপ আর ব্যতিক্রম আছে, তাদের সবগুলোই তাঁর পরিচিত। মুম্বই শহরে এই অসুখটা বড়ো একটা হয় না। কাজেই, এখানকার ডাক্তারদের একে চিনতে অসুবিধে হবারই কথা। বিশেষত বিশেষজ্ঞদের।

ডাক্তার গুপ্তের ব্যাগে তখনও একগাদা কুইনিনের বড়ি পড়ে ছিল। তা থেকে পাঁচদিনের মতো বড়ি বিছানার পাশে টেবিলের ওপর রেখে পর্দার আড়ালে মিসেস মীরচান্দানীকে সম্বোধন করে বললেন— এই পাঁচ দিনের মতো ওষুধ রেখে গেলুম। কীভাবে খেতে হবে আর পথ্য কী হবে তা প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি। যদি কিছু হয় তো এতেই হবে। নইলে আমার আর কিছু করবার নেই।

.

দু-দিন পরে ডাক্তার গুপ্ত যথারীতি রাত আটটায় চেম্বারের দরজায় তালা লাগিয়ে পেছন ফিরে দেখেন সেই দুই মুশকো দরওয়ান দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা বলল— মাইজি আপকো আভি বুলাতি হ্যয়।

এবার আবার ‘আভি’! আর রক্ষে নেই। ডাক্তার গুপ্ত ভাবলেন যে বুড়ো নির্ঘাৎ পটল তুলেছে আর তার মানে তাঁর কপালে এখন অনেক দুঃখ। তাঁর হাড় একদিকে আর মাস একদিকে হল বলে।

পুনরায় কাঁপতে কাঁপতে শেঠ মীরচান্দানীর বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন ডাক্তার গুপ্ত। ঢুকে দেখেন অপূর্ব দৃশ্য। শ্রীমতী মীরচান্দানী পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর হাতে একথালা মিষ্টি আর মুখে একগাল হাসি। বললেন— মুখ মিঠা করো বাচ্চা! তুমি অসাধ্যসাধন করেছ। মুম্বইসুদ্ধু ডাক্তার যা করতে পারল না তুমি তাই করেছ। এত মাস বাদে আমার স্বামীর এই প্রথম সারাদিনে একবারও জ্বর আসেনি। আজ সকাল থেকে ছেলেমানুষের মতো কেবল খাই-খাই করছেন। অথচ ক-দিন আগেও খাবার দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। চলো, ওঁর সঙ্গে দেখা করবে চলো। উনি তোমার সঙ্গে কথা বলবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

রুগির ঘরে ঢুকে ডাক্তার গুপ্ত দেখেন শেঠ মীরচান্দানী দিব্যি আসনপিঁড়ি হয়ে খাটের ওপর বসে আছেন। ডাক্তারকে দেখে সহাস্যে বললেন— এসো এসো! দ্যাখো আমি ভালো হয়ে গেছি।

ডাক্তার গুপ্ত বললেন— আপনার ভালো হতে এখনও অনেক দেরি। অনেক নিয়ম মেনে আপনাকে চলতে হবে, তবেই সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন। এজন্য যা যা করতে হবে তা আমি লিখে দিয়ে যাব।

—সে তুমি যা বলবে, আমি তাই করব। এখন তো তোমাকে একটা ভিজিট দিতে হয়। কত দেব তোমাকে?

—আমার ভিজিট চেম্বারে পনেরো টাকা আর বাড়িতে এলে তিরিশ টাকা। আপনি আমাকে ষাট টাকা দেবেন।

ষাট টাকা শুনে শেঠ মীরচান্দানী অনেকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার গুপ্তের দিকে। তারপর বললেন— ডাক্তার, তুমি শুধু মুম্বই-এর সবচেয়ে বড়ো চিকিৎসকই নও, সবচেয়ে বড়ো ইমানদার লোকও। তুমি যেখানে ষাট হাজার টাকা চাইলেও তা আমি সানন্দে দিতুম, সেখানে তুমি মাত্র ষাট টাকা চাইছ! শোনো বাচ্চা! তোমাকে আমি ষাট টাকাই দেব, নইলে তুমি হয়তো চটে যাবে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু দেব। আমার স্ত্রী বললেন, তুমি নাকি সারাদিন চুপটি করে বসে থাক, রুগিটুগি আসে না। আমি তোমাকে সেই রুগি দেবো।

ডাক্তার গুপ্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন— রুগি দেবেন? কী করে?

—দ্যাখো, মুম্বই শহরে আর তার আশেপাশে আমার পাঁচটা ফ্যাক্টরি আছে। এ ছাড়া শহরে অনেকগুলো শোরুম আর গোডাউন আছে। আমাদের পে-রোলেই রয়েছে প্রায় ষোলো হাজার লোক। আমি কালই নোটিশ দিয়ে দিচ্ছি যে এখান থেকে যারই অসুখ করবে তাকে তোমার কাছে আসতে হবে। তোমার সার্টিফিকেট ছাড়া কারুর মেডিক্যাল বিল পাশ হবে না বা ছুটি মঞ্জুর হবে না। তুমি তাদের কাছ থেকে যেরকম উপযুক্ত মনে করবে সেরকম ফি নেবে। আর, আমি বলি কী, ফি-টা একটু বাড়াও। যে ডাক্তার যত বেশি দামি তার কদরও তত বেশি।

.

ডাক্তার গুপ্ত বললেন— এরপর আমাকে আর কোনোদিন পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বলে আমাকে চোখ টিপে বললেন, বুঝলেন তো, জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই কখনো ফেলা যায় না। কখনো না কখনো ঠিক কাজে লেগে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *