নাদির শাহের অভ্যুদয়
দেশের দুর্দ্দশার দিন
পারস্য দেশ প্রাচীনকালে পশ্চিম এশিয়াখণ্ডে সভ্যতার কেন্দ্র ছিল- যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের ভারতবর্ষ, তেমনি। এই দুই দেশেই আর্য্যজাতির বাস; দুই দেশের মধ্যেই তখন ভাষা ও ধর্মের অনেক সাদৃশ্য ছিল। পরে মুসলমান বিজয়ের ফলে পারস্য দেশ ভারত হইতে বড় বিভিন্ন হইয়া পড়িল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে যখন ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর আসিয়া নূতন রাজ্য স্থাপন করিয়া দেশে শান্তি সুখ ধন আনয়ন করিলেন, ভারত আবার সভ্যতার কেন্দ্র হইল,–ঠিক তখনই পারস্য দেশ সফবী রাজবংশ স্থাপনের ফলে জাগিয়া উঠিল; ধনে বলে সভ্যতায় আবার এশিয়ার প্রদীপ হইয়া দাঁড়াইল।
আবার এদিকে যেমন আওরংজীবের সঙ্গে সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরব- রবি দ্রুত অস্তগামী হইল, তেমনি ঐ সম্রাটের জীবনকালে পারস্য দেশেও রাজশক্তির অবনতি এবং দেশের অধঃপতন স্পষ্ট দেখা দিল। পারস্যের নবীন শাহরা আর যুদ্ধ শিখেন না, বাল্যকাল অবধি অন্তঃপুরে স্ত্রীলোক ও খোঁজার মধ্যে প্রতিপালিত হন এবং সিংহাসন লাভ করিবার পর রাজ্যভার উজীরের হাতে সঁপিয়া দিয়া নিজে ইন্দ্রিয় সুখ ও সুরাপানে অকালমৃত্যু ডাকিয়া আনেন। এই সফবী বংশের শেষ রাজা শাহ সুলতান হুসেন (রাজ্যকাল ১৬৯৪-১৭২২ খ্রিস্টাব্দ) নেশা করিতেন না বটে, কিন্তু মুল্লা ও খোঁজাদের হাতে সমস্ত শাসনকাৰ্য্য ছাড়িয়া দিয়া নিজে মালাজপ করিতেন এবং হারেমে অসংখ্য রমণী লইয়া সময় কাটাইতেন। মুল্লাদের পরামর্শে তিনি দেশ হইতে সমস্ত দার্শনিক, সুফী এবং শিয়া ভিন্ন অপর সব সম্প্রদায়ের মুসলমানকে নির্যাতন করিয়া তাড়াইতে লাগিলেন। ইহাতে দেশে জ্ঞান-চর্চ্চা বিদ্যাবুদ্ধি লোপ পাইল। সৈন্যগণ এবং প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশগুলি রাগে অপমানে এহেন রাজাকে পরিত্যাগ করিল। অবশেষে শাসনকার্য্যের বিশৃঙ্খলা ও অবহেলার অনিবার্য্য ফল ফলিল সীমান্ত প্রদেশগুলি স্বাধীন হইতে আরম্ভ করিল। উত্তর-পূর্ব্ব কোণে হিরাট জেলায় আবদালি জাতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব্ব কোণে কান্দাহার প্রদেশে ঘিলজাই জাতি পারসিক সৈন্যকে পরাস্ত করিয়া পারসিক শাসনকর্তাকে তাড়াইয়া দিয়া বা মারিয়া ফেলিয়া দেশ দখল করিল, স্বজাতির প্রভুত্ব স্থাপন করিল। ইহারা আফগান এবং সুন্নি, সুতরাং শিয়া পারসিকদের মহাশত্রু।
তাহার পর ঘিজাই রাজা মাহমুদ গিয়া পারস্য দেশ আক্রমণ করিলেন রাজধানী ইস্ফাহানের নিকট দুই পক্ষে যুদ্ধ হইল। পারসিক সৈন্য পঞ্চাশ হাজার, সঙ্গে চব্বিশটি বড় কামান। আফঘানেরা সংখ্যায় মাত্র বিশ হাজার আর সঙ্গে উটের পিঠে চাপান এক শত জম্বুরক বা লম্বা বড় বন্দুকবিশেষ; অথচ পারসিকেরা পরাস্ত হইয়া পলায়ন করিল। শাহ ইস্ফাহানে অবরুদ্ধ হইয়া অন্নাভাবে আত্মসমর্পণ করিলেন (২১ অক্টোবর, ১৭২২), পারস্য দেশে আফঘানরা রাজত্ব আরম্ভ করিল এবং সাত বৎসর ধরিয়া দেশ উৎসন্ন করিল। এই সাত বৎসরে দশলক্ষ প্রজার প্রাণ গেল, সুন্দর সুন্দর প্রদেশগুলি মরুভূমিতে পরিণত হইল, আর কত মহামূল্য অট্টালিকা ভূমিসাৎ হইল।
কিন্তু ইতিমধ্যে ভীরু অকর্ম্মণ্য হৃতরাজ্য শাহ হুসেনের পুত্র মির্জা তহমাস্প সুদূর উত্তরে মাজেন্দ্রান প্রদেশে পলাইয়া গিয়া সেখানে নিজকে রাজা ঘোষণা করিয়া দেশ দখলের চেষ্টায় ছিলেন। পারস্যের বিপদ দেখিয়া পুরাতন শত্রু রুষ এবং তুর্কী উত্তরে ও পশ্চিমে নানা স্থান জয় করিয়া ফেলিল। তহমাস্প যুবক, বুদ্ধি বা চরিত্রের বল নাই, তাহার উপর ইন্দ্রিয়সুখে মগ্ন। দেশের চারিদিকে এই বিপদের দিনে জাতীয় উদ্ধার কার্য্য তাঁহার দ্বারা সম্পন্ন হইবার নহে। এবার পারস্য চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয় হয়।
জাতীয় ত্রাণকর্তা নাদির
এমন সময় পারস্যের সৌভাগ্যে উদ্ধারের এক অভাবনীয় পথ খুলিয়া গেল, জাতীয় দলে এক অপূৰ্ব্ব শক্তিমান পুরুষসিংহ দেখা দিলেন। তিনিই পরে নাদির শাহ নামে বিখ্যাত হন।
খুরাসান প্রদেশে একটি সামান্য গ্রামে আফশার নামক তুর্কমান জাতির দলভুক্ত কির্কলু বংশে এক গরিব মেষপালক ও চামড়ার জামাটুপী প্রস্তুতকারী দর্জির ঘরে নাদিরের জন্ম (১৬৮৮)। তাঁহার বয়স যখন আঠার সেই সময় একদল উজবেগ দস্যু আসিয়া তাঁহাকে ও তাঁহার মাতাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া তাতার দেশের দাস করিয়া রাখে। সেখানে মাতার মৃত্যু হইল, কিন্তু নাদির চারি বৎসর পরে পলাইয়া আসিয়া, খুরাসান প্রদেশের একটি ছোট জেলার প্রধান সহর অবিভার্দ নগরে শাসনকর্তার অধীনে চাকরী লইলেন এবং তাঁহার কন্যাকে বিবাহ করিয়া তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পদ পাইলেন।
নাদিরের ঈশ্বর-দত্ত প্রতিভা যুদ্ধে ও লোকশাসনে প্রকাশ পাইল। খুরাসানের পাঠান-রাজার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় তিনি দস্যুদল জুটাইয়া দেশ লুঠ ও জয় করিয়া নিজ বল বাড়াইলেন, এবং ক্রমে কিলাৎ-ই-নাদিরি দুর্গ এবং খুরাসানের রাজধানী নীশাপুর দখল করিলেন, এবং তাহার পরেই স্বদেশের রাজা মির্জা তহমাস্পের সঙ্গে যোগ দিয়া (১৭২৭) দেশ উদ্ধারের কেন্দ্র ও নেতা হইয়া দাঁড়াইলেন। দুই বৎসরের মধ্যে নাদির যুদ্ধের পর যুদ্ধে আফঘানদের হারাইয়া পারস্য দেশ হইতে তাড়াইয়া দিলেন এবং এরূপ কঠোরভাবে পশ্চাদ্ধাবন করিলেন যে, কান্দাহারে যাইবার সমস্ত পথ হত আফঘান স্ত্রী-পুরুষ বালক-বৃদ্ধের মৃতদেহে ভরিয়া গেল। একজন বিলজাইও প্রাণ লইয়া দেশে ফিরিতে পারিল না। পারস্যে তাহারা যে সাত বৎসর ধরিয়া অত্যাচার করিয়াছিল তাহার পূর্ণ প্রতিশোধ হইল, আবার পারসিকেরা মাথা তুলিতে পারিল, নাদির স্বদেশবাসীর আহ্লাদের ও গর্ব্বের বস্তু হইলেন।
কৃতজ্ঞ রাজা শাহ তহমাস্প অর্দ্ধেক পারস্য দেশ নাদিরের হাতে দিয়া তাঁহাকে সুলতান উপাধি এবং নিজ নামে টাকা বাহির করিবার অধিকার দান করিলেন। আফগানরা বিতাড়িত হইল বটে, কিন্তু এখনও তুর্ক হইতে পারস্যের পশ্চিম প্রদেশগুলি উদ্ধার করিতে বাকী। নাদির সেই কার্য্য আরম্ভ করিলেন এবং তুর্কী সৈন্যদলকে কয়েকবার যুদ্ধে হারাইয়া দিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ পূর্ব্বপ্রান্তে হিরাট অধিকার করিতে যাওয়ায় তাঁহার অনুপস্থিতিতে শাহ তহমাস্প তুর্কী সৈন্য আক্রমণ করিতে গিয়া বুদ্ধি ও বীরত্বের অভাবে পরাপ্ত হইয়া নাদিরের উদ্ধার-করা সমস্ত পশ্চিম প্রদেশগুলি হারাইলেন। দেশের লোক তাঁহাকে ধিক্কার দিতে লাগিল, পারসিক সেনানায়কেরা একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন যে, তহমাস্পকে দেশের নেতা করিয়া রাখিলে আবার জাতীয় পরাধীনতা ও দুর্দ্দশা ফিরিয়া আসিবে। তাঁহারা নাদিরকে রাজা করিতে চাহিলেন। কিন্তু নাদির সম্মত হইলেন না। ২৬ আগস্ট ১৭৩২ তহমাস্পকে রাজ্যচ্যুত করিয়া তাঁহার আট মাসের শিশুপুত্র আব্বাসকে শাহ বলিয়া ঘোষণা করা হইল, নাদির হইলেন তাহার অভিভাবক ও প্রতিনিধি, অর্থাৎ দেশের প্রকৃত শাসক। চারি বৎসর পরে বালক-রাজা মারা যাওয়ায় নাদির প্রকাশ্যভাবে সিংহাসনে বসিলেন (২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৭৩৬); তাঁহার উপাধি হইল শাহান্-শাহ নাদির শাহ; পূৰ্ব্ব উপাধি ছিল তহমাস্প কুলী খাঁ।
নাদিরের প্রতিভা সর্ব্বতোমুখী, একদিকে রাজনীতির চাল চালিতে সন্ধি ও ভেদের বন্দোবস্ত করিতে তিনি যেমন দক্ষ, তেমনি অপরদিকে যুদ্ধবিদ্যায় সে যুগে কেন, সমগ্র ইতিহাসে এশিয়াখণ্ডে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিল না। ঠিক কোনদিকে সৈন্য চালনা করা দরকার, কখন যুদ্ধ করিতে হইবে এবং কখন হটিয়া আসা বা অপেক্ষা করা উচিত, কামানের ব্যবহার ও উন্নতি এবং ঠিক পরিমাণে বন্দুকচী ও অশ্বারোহী সৈন্য সমাবেশ করা, ইউরোপীয় (ফরাসী) গোলন্দাজদিগকে নিযুক্ত করা অথচ তাহাদের নিজ আজ্ঞায় চালনা করা, স্বয়ং সেনাদলের সঙ্গে থাকিয়া যুদ্ধে নেতৃত্ব করিয়া তাহাদের মধ্যে প্রতিপত্তি ও খ্যাতির বলে তাহাদের পূজ্য দেবতা হওয়া– এসব গুণই তাঁহার ছিল। এজন্য পারস্য দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ইংরাজ ইতিহাস-লেখক (তিনি নিজে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) নাদিরকে ‘এশিয়ার নেপোলিয়ন’ বলিয়াছিলেন।
রাজা হইয়াই নাদিরের প্রথম কাজ হইল পারস্যের হৃত প্রদেশগুলি উদ্ধার করা। তুর্কীদের হারাইয়া দিয়া তাহাদের হাত হইতে আর্মেনিয়া ও জর্জিয়া কাড়িয়া লইলেন; রুষের সঙ্গে সন্ধিবিগ্রহের ফলে কাস্পিয়ান হ্রদের তীরের প্রদেশগুলি ফিরাইয়া পাইলেন; আরবদের হাত হইতে পারস্য উপসাগরের দ্বীপগুলি পুনরুদ্ধার করিলেন। দেশস্থ দস্যুজাতিগুলিকে খুব হারাইবার পর নিজ সৈন্যদলে ভর্তি করিয়া নেতার শাসনে রাখিয়া তাহাদের অত্যাচারের পথ বন্ধ করিলেন। অবশেষে ১৭৩৭ সালে একমাত্র অবশিষ্ট প্রদেশ, কান্দাহার জয় করিতে নাদির রওনা হইলেন। সেখানে আফঘান শাসন বজায় থাকিলে পারস্যের ভবিষ্যৎ বিপদের কারণ রহিবে। আর, ভারতের অগণিত ধনরত্ন লুণ্ঠন করিতে হইলে কান্দাহারের পথ দিয়াই যাইতে হইবে। এক বৎসর অবরোধের পর, ১২ মার্চ ১৭৩৮ কান্দাহার দুর্গ তাঁহার হাতে আসিল। তিনি উহা সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া উহার দুই মাইল পূর্ব্বদিকে ময়দানের মধ্যে এক নূতন কান্দাহার স্থাপন করিলেন এবং তাহা প্রাচীর দিয়া ঘিরিয়া দিলেন। ইহার নাম হইল ‘নাদির-আবাদ’।
অতুলনীয় যোদ্ধা নাদির শাহ রাজনীতিতেও অতি গভীর বুদ্ধিশালী ও দক্ষ ছিলেন। কান্দাহার আফঘানদের দেশ, সুতরাং উহা জয় করিবার পর পরাজিত আফগান শাখাদিগকে কোনরূপ শাস্তি দিলেন না, লুণ্ঠন করিলেন না, সমস্ত বন্দীদিগকে ছাড়িয়া দিয়া, তাহাদের প্রধানদিগের বার্ষিক বৃত্তি নির্দ্দিষ্ট করিয়া, নানাপ্রকারে দয়া ও সৌজন্য দেখাইয়া, তাহাদের যোদ্ধাদিগকে নিজ সৈন্যদলে চাকরী দিয়া, এই সমস্ত আজন্মযোদ্ধার জাতিকে বশ করিয়া ফেলিলেন, নিজের ভবিষ্যৎ দেশবিজয়ের ভৃত্য করিলেন। অথচ পাঠানদের সংযত রাখিবার জন্য আবদালী বংশকে তাহাদের আদিবাসস্থান খুরাসান হইতে আনিয়া কান্দাহার প্রদেশের রক্ষার ভার দিলেন এবং কান্দাহারের আদিম ঘিলজাইদের উঠাইয়া লইয়া খুরাসানে বসতি করাইলেন। এই দুই শাখা আফঘান হইলেও পরস্পর চির-বিরোধী।
নাদির নিজে পারস্যদেশীয় হইলেও জাতিতে পারসিক অর্থাৎ আৰ্য্য নহেন, তিনি তুর্কমান। আসল পারসিকেরা খুব বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পকলায় লেখনী চালনে জগদ্বিখ্যাত, কিন্তু যুদ্ধে প্রায়ই দুর্ব্বল এবং ভীরু। পারস্যরাজের প্রধান সম্বল কিজিল্াশ্ (‘লালমাথা’ অর্থাৎ লালটুপী পরা) সৈন্য; ইহারা তুর্কস্থান হইতে পারস্যে আনিয়া স্থাপিত করা সাতটি তুর্কী শাখার বংশধর, অদম্য বীর। কিন্তু ধর্ম্মে শিয়া হওয়ায় সফবী রাজগণের এবং পরে নাদিরের, অতি ভক্ত অনুচর হয়।
ইহার পর নাদিরের ভারতবিজয়। সে এক অতি রোমাঞ্চকর, কিন্তু শিক্ষাপ্রদ কাহিনী।
[প্রবাসী, ভাগ ৩০, খণ্ড ১, সংখ্যা ৪, শ্রাবণ, ১৩৩৭। ]