নাত্যুচ্চশিক্ষা
এদেশে ছেলেদের প্রায় সবাই ম্যাট্রিক পাসের পর কলেজ পানে ধাওয়া করে। তার কারণ কি এদেশের গুণীজ্ঞানীরা উচ্চশিক্ষা চাই উচ্চশিক্ষা চাই বলে বড্ডবেশি চেঁচামেচি করেছেন বলে! তারা তো আরও বেশি হট্টগোল করে বলেন, সিনেমা ফুটবলে অত বেশি যাসনি, রকবাজি কমা, পরীক্ষার হলে আসবাব-পত্র ভাঙিসনি, কই, কেউ তো শোনে না। উচ্চশিক্ষার বেলাতেই হঠাৎ তাদের অত্যধিক মুরুব্বি-মহব্বৎ বেড়ে যাবে একথা তো চট করে বিশ্বাস করা যায় না। আসলে তারা কলেজ পানে ধাওয়া করে দুই কারণে,
(ক) ম্যাট্রিক পাস করার পর অন্য কিছু করার নেই বলে, এবং
(খ) চাকরি পেতে হলে বিএ-টা অন্তত থাকা চাই-ই।
এ অবস্থাটা আমাদের দেশের একচেটে নয়। অন্যান্য দেশেও এটা মধ্যে মধ্যে হয়ে থাকে। একটা উদাহরণ দিই।
আশা করি, একথা কেউ বলবেন না, জর্মনি অশিক্ষিত দেশ। সেখানে আমি যখন ১৯২৯ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি, তখন দেখি দুই পিরিয়ডের মধ্যে করিডরে করিডরে এত ভিড় যে চলাফেরা করা রীতিমতো কষ্টের ব্যাপার।
আমি আশ্চর্য হইনি। ভেবেছিলুম, জর্মনি উচ্চশিক্ষিতদের দেশ, ভিড় হবে না কেন? কিছুদিন পরে কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো, যখন শুনলুম, এক অধ্যাপক দুঃখ করে বলেছেন, এত বেশি ছেলেমেয়ে এসে ভিড় জমিয়েছে যে পড়াই কী করে? আমি তাকে জিজ্ঞেসবাদ করে জানতে পারলুম, জৰ্মনিতে ছেলেমেয়েরা ১৭/১৮/১৯ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ে বা পাস করে সচরাচর কাজকর্মে চাকরি-বাকরিতে ঢুকে যায়; মাত্র কিছু সংখ্যক (ক) মেধাবী ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষার প্রতি যাদের একটা প্রাণের টান আছে তারা, (খ) যেসব অধ্যাপক, জজ ব্যারিস্টারের পরিবারে অনেক পুরুষ ধরে উচ্চশিক্ষার ঐতিহ্য আছে তাদের ছেলেমেয়ে (কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেধাবী হয়েও) এবং (গ) উচ্চশিক্ষার পালিশ লোভী হঠাৎ-নবাবদের দু-একটা ছেলেমেয়ে– এই তিন শ্রেণির ছাত্রই পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। মেধাবী ছেলেদের প্রায় সবাই স্কলারশিপ পায় এবং আর গাধাদের উঁচু মাইনে দিতে হয়, নাকের ভিতর দিয়ে এবং অধিকাংশই সেই কারণে উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসুক এবং শাস্ত্রাধিকারী। এখন অর্থাৎ ১৯২৯ সাল বেকারের সংখ্যা এত অসম্ভব রকমে বেড়ে গিয়েছে যে ছেলে-ছোকরারা, এমনকি মেয়েরাও কাজকর্মে চাকরি-বাকরিতে কোনওরকম ওনিং পেয়ে জলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে।
এই তো গেল ১৯২৯-এর কথা। ৩০/৩১/৩২ ক্রমাগত এদের সংখ্যা বেড়েই চলল। ১৯৩৩-এ হিটলার জর্মনির চ্যানসেলর হলেন। আমি দেশে ফিরেছিলুম ৩২-এ।
১৯৩৮-এ ফের জমনি বেড়াতে গিয়ে আমার এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথমটায় ভেবেছিলুম, ছুটির দিন বুঝি, না হলে করিডরগুলো অত ফাঁকা কেন। অধ্যাপক বুঝিয়ে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়টাই ফাঁকা;- হিটলার বেকার সমস্যা সমাধান করে দেওয়াতে ছেলেরা এখন ম্যাট্রিক পাস না-পাস, করেই কাজে ঢুকে যায়, পয়সা কামাচ্ছে বলে বিয়ে করছে তাই মেয়েরাও কলেজে আসছে না, এমনকি মেধাবী ছেলেদের অনেকেই বলে, কলেজে ৬/৭ বছর ঘষ্টে ঘষ্টে পাস করে যখন কাজে ঢুকব তখন দেখব যারা ৬/৭ বছর আগে ঢুকেছিল তারা কামাচ্ছে বেশি লাভ? বেনোজল এখন ভাটার টানে খাবার জলও টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমার আশ্চর্য বোধ হল। আমার বিশ্বাস ছিল ধনী দেশে (যেখানে বেকার নেই) বুঝি উচ্চশিক্ষার তৃষ্ণা বেশি, গরিব দেশে কম। এখন দেখি উল্টো!
এ বিষয় নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি। ফলস্বরূপ আমার যে ধারণা হয়েছে সেটা যে আমি সপ্রমাণ করতে পারব তা নয়। তবে সেটা আপনারা চিন্তা করে দেখতে পারেন।
মানুষ যা চায় পারতপক্ষে সেই দিকেই ধায় ১৮/১৯/২০ বৎসরে মানুষ আপন হাতে কিছু একটা করতে চায়, গড়তে চায়, ওই সময়ে তার স্বাধীনতা প্রবৃত্তিটা প্রখরতর হয় বলে কিছু-একটা অর্থকরী করতে চায়, এবং তৃতীয়ত সে তখন সঙ্গিনী খুঁজতে আরম্ভ করে। মোদ্দা কথা, সে তখন আপন বাড়ি বেঁধে, বউ এনে পয়সাকড়ি কামিয়ে ছা-পোষা গেরস্ত হতে চায়।
প্রাচীন ভারতে কী ব্যবস্থা ছিল?– ধরে নিচ্ছি আমরা তখন এতখানি বেকার গরিব ছিলুম। গুণীজ্ঞানীরা আমাকে বললেন, ওই ১৭/১৮/১৯-এ শুরুগৃহে ব্রহ্মচর্য সমাপন– অর্থাৎ লেখাপড়া শেষ করে গৃহস্থাশ্রমে ঢুকত, অর্থাৎ বিয়ে-শাদি করে টাকা-পয়সা কামিয়ে সংসার চালাত। তবে হ্যাঁ, দীর্ঘতম ব্রহ্মচর্যের ব্যবস্থাও ছিল; ২৬/২৮/৩০-এ সংসার-ধর্মে প্রবেশ করছে, এ.ও হয়। বুঝলুম, এই শেষের দল, আমাদের আজকের দিনের বি.এ.; এম.এ.; পি.এইচ.ডি. কিংবা তারও সুপার পি.এইচ.ডি.-র দল।
লেখাপড়া করাটা কি খুব স্বাভাবিক, না সকলের পক্ষে আনন্দের বিষয়? দিনের পর দিন ৩০/৪০/৫০ বছর পর্যন্ত একটা লোক বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে বসে আছে, মাঝে মাঝে কাগজে খসখস করছে এইটে স্বাভাবিক, না ফসল ফলানো, খাল কাটা, এমারত তোলা, দোকান-পাট চালানো, ওইসব কর্মে দৌড়ঝাঁপ করা, শরীরের অবাধ চলাচল চালু রাখা– এসব স্বাভাবিক? অবশ্য ভাববেন না, এই দ্বিতীয় শ্রেণির লোক বুঝি সংসারে ঢুকে সবরকম লেখা-পড়া একদম বন্ধ করে দেয়। অবসর সময় যার যেরকম রুচি সেরকম করে। বস্তুত ইয়োরোপে প্রায়ই দেখতে পাবেন, ম্যাট্রিক পাস পাদ্রি (পরে কিছু ধর্মশিক্ষা করেছে মাত্র) অবসর সময়ে অধ্যয়নের ফলে ভূতত্ত্ব, পুরাতত্ত্বে নাম করেছে– টমাস মানের মতো প্রচুর সাহিত্যিক আছেন যারা কখনও কলেজে যাননি। আর লেখালেখি করে নাম করাটাই তো সবচেয়ে বড় কথা নয়। কাজে-কর্মে, লোকসেবার মাধ্যমে, পরিবার পালন করে, অবসর সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার ভিতর দিয়ে মানুষ জীবনকে যতখানি সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারে কর্ম অভিজ্ঞতা-জ্ঞান দিয়ে জীবনকে যতখানি মধুময় এবং ঐশর্যশালী করতে পারে সেইটেই তো বড় কথা। পক্ষান্তরে পাণ্ডিত্যে যাদের স্বাভাবিক অনুরাগ তারা উচ্চশিক্ষা লাভ করে ওই কর্মে লিপ্ত হবে।
অবশ্য মনে রাখতে হবে কন্টিনেন্টে ১৭/১৮-এর পূর্বে কেউ ম্যাট্রিক পাস করে না। এবং তাদের ওই সময়ের ভিতর এমনই নিবিড় (intenes) শিক্ষা দেওয়া হয় যে ওরই কল্যাণে পরবর্তী জীবনে সে অনেক কিছু আপন চেষ্টাতেই শিখতে পারে, রস নিতে পারে।
এদেশের ছেলেমেয়েকে ১৭/১৮ অবধি ইস্কুলে রাখুন আর না-ই রাখুন, উত্তম পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করুন আর না-ই করুন, প্রশ্ন এই তারা বেরিয়ে এসে করবে কী? কৃষি, বাণিজ্য, কলকজা বানানো, ম্যাট্রিকে তাকে যা-ই শেখান না কেন, বাইরে এসে তার ওপনিং কোথায়? যত ভালো কৃষিই সে শিখুক না কেন, গ্রামে যেটুকু জমি সে যোগাড় করতে পারবে তাতে সে জাপানের ড্রাই-ফার্মিংই করুক আর আইল্যান্ডের কো-অপারেটিভই করুক, ওই দিয়ে আণ্ডা-বাচ্চা পুষতে পারবে? আমি সাধারণ প্রতিভাবান ছেলেকে তিন বছরে তিনটে বিদেশি ভাষা শিখিয়ে দিতে পারি, যার জোরে সে ইয়োরোপে ভালো কাজ পাবে। এখানে?
কাজেই বাইরের অনুকূল পরিস্থিতি, আবহাওয়া, ওপেনিংও সৃষ্টি করতে হবে।
তা সে দেশকে ইন্ডাসট্রিয়ালাইজ এবং এগ্রিকালচারাইজ বা অন্যান্য যা-কিছু হোক সেসব আইজ করে, কিংবা অন্য কিছু করে। সেটা কী করে করতে হয় আমি জানিনে।
ততদিন কলেজে কলেজে ভিড়। অনিচ্ছুক লেখাপড়া করবে– আখেরে যার কোনও মূল্যই নেই। দেশের অর্থক্ষয়, শক্তিক্ষয়। সর্ব অপচয়।
কথায় বলে, ওরে পাগল, কাপড় পরিসনে কেন? পাগল বললে, পাড় পছন্দ হয় না। আমাদের হয়েছে উল্টোটা। ভাবছি, উচ্চশিক্ষার যত বস্তা বস্তা কাপড় ছেলের পিঠে বাঁধব ততই সে সুবেশ নটবর হবে।
.