নাকুশা
শুনেছি মহারাষ্ট্রে অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদের নাকুশা বলে ডাকা হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু তো মেয়েরাই। অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই গর্ভাবস্থাতেই তাদের হত্যা করা হয়। যদি তা না করা যায়, তবে জন্মের পর তাদের পুঁতে ফেলা হয়। মেয়েদের জ্যান্ত পুঁতে ফেলার সংস্কৃতি বহু পুরনো।
মহারাষ্ট্র সরকার এখন মেয়ে শিশুদের পক্ষে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন, নাকুশা নামে ডাকার বদলে সত্যিকার কোনও একটি নামে যেন অনাকাঙ্খিত মেয়ে শিশুদের ডাকা হয় তার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু জোর জবরদস্তিতে কি হাজার বছরের সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব? আইন করে না-হয় নাকূশাদের কোনও নাম দেওয়ার বন্দোবস্ত হল, কিন্তু সমাজে মেয়ে শিশুরা যে কারণে অনাকাঞ্ছিত- সে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে কি?
সমাজে এবং পরিবারে মেয়েরা যে ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হচ্ছে– তা গোটা নারীজাতিকে অনাকাঙ্ক্ষিত করে রাখার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ। মেয়েদের নিতান্তই যৌন সামগ্রী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং পুরুষের দাসী হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়। মেয়েরা এখনও স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শুধু তাই নয়, এখনও তাদের সমাজের সম্পত্তি হিসেবে ভাবা হয়। সে কারণে একটি মেয়ে কোথায় গেল, কার সঙ্গে গেল, কার সঙ্গে শুলো, কী পোশাক পরলো, কী খেলো, কী পান করলো– তালক্ষ্য রাখে সমাজের সবাই। শুধু লক্ষ্যই রাখে না, উপদেশ বিতরণ করে, বিচার করে, শাস্তির ব্যবস্থা করে।
একটি মেয়ে পরিবারে, সমাজে, রাজনীতিতে– সব জায়গায় অনাকাঙ্খিত। একটি মেয়ে নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাস করে। যৌন নির্যাতনের শিকার তাদের হতে হয় জন্মের পর থেকেই। আজকাল মেয়েদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। মেয়েরা বাসে-ট্রেনে-স্কুলে-কলেজে-অফিসে আদালতে কোথাও নিরাপদ নয়। মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক বা পণ দিতে হয়, তারপরও নিরাপদ নয় মেয়েরা। স্বামীরা আরও পণের লোভে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার করে চলে। বধূহত্যা হামেশাই হচ্ছে। স্বামী শাশুড়িরা পুড়িয়ে মারছে বধূকে।
মেয়েদের জীবন জন্মের পর থেকেই দুঃসহ। কোন মা চাইবে জেনেশুনে কষ্ট যন্ত্রণা পোহাতে মেয়েদের এই বিশ্বে আমন্ত্রণ জানাতে? অনেক মা-ই কন্যাভ্রণের গর্ভপাত করায়। গর্ভপাতের অধিকার প্রত্যেক মেয়েরই আছে। মেয়েরা যদি মনে করে এই পৃথিবী, এই দেশ, এই সমাজ মেয়েদের বাসযোগ্য নয়– তবে তারা গর্ভপাত করাতেই পারে। গর্ভপাত করানোর অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা মানবাধিকার লঙ্খন করা। শুধু অনাগত কন্যার জন্য দুশ্চিন্তাই গর্ভবতীদের গর্ভপাতে বাধ্য করছে তা নয়, নিজের জীবনও কন্যা শিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে দুঃসহ হয়ে ওঠে।
সমাজে যে লিঙ্গ অনাকাঙ্ক্ষিত, সেই লিঙ্গকে জন্ম দিয়ে সেই লিঙ্গের ভোগান্তি বাড়াতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা তাদের নির্যাতিত, অত্যাচারিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত হতে অনেকে চাইছে না তাদের না-চাওয়া অযৌক্তিক কোনও না-চাওয়া নয়। রাষ্ট্র চাইছে তাদের ওপর নারী-পুরুষের রেশিও ঠিক করানোর দায়িত্ব চাপানো ঠিক নয়। আজ যদি পুরুষরা এই সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত হতো, আজ যদি পুরুষরা নির্যাতিত হতো পুরুষ হওয়ার কারণে, সমাজ যদি পুরুষবিদ্বেষী হতো, তাহলে কিন্তু মায়েরা ছেলে-শিশু জন্ম দিতে আপত্তি করতো।
শিক্ষিত মেয়েরা যে সমাজে নারীবিরোধী আচার পালন করে সে সমাজে মেয়েরা খুব শীঘ্র সমানাধিকার পাবে এ আমার বিশ্বাস হয় না। আজ করভা চৌত, ভাই ফোঁটা, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি নানা পুরুষতান্ত্রিক উৎসবে মেয়েরা অংশ নিচ্ছে। স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য স্ত্রীরা উপোস করছে। স্বামীর মঙ্গলের জন্য মঙ্গলসূত্র পরছে, শাঁখা-সিঁদুর পরছে। পুরুষদের কিন্তু কোনও ব্রত পালন করতে হচ্ছে না স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য। স্ত্রী মরে গেলে পুরুষরা নতুন স্ত্রী পাবে। নতুন স্ত্রী পাওয়া মানে নতুন করে টাকা পাওয়া। প্রবাদ আছে; অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। বটে, কিন্তু ভিন্ন নামে সতীদাহ আজও টিকে আছে, সতীদাহের মানসিকতা তো সমাজে ভীষণভাবেই টিকে আছে। বিধবাদের কী করে ভুগতে হয়, বিশেষ করে বাংলায়, তা কারও অজানা নয়।
প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই। নারীরা নির্যাতিত, যেহেতু তারা নারী। পুরুষও নির্যাতিত হয়, কিন্তু তারা পুরুষ বলে নির্যাতিত হয় না। এই যখন সমাজের বাস্তবতা, তখন নারীরা নারী-জন্ম দেখতে চায় না। তারা নিজেরা ভুগেছে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে–তাই তারা কন্যা-জন্ম দিতে চায় না। আমি যদি কোনও শিশু জন্ম দিতাম– আমি হয়তো কন্যা শিশু জন্ম দিতে গেলে দুবার ভাবতাম। হ্যাঁ, এই আমিও ভাবতাম, যে আমি একজন নারীবাদী– সেই আমিও চাইতাম না আমার কন্যাকে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, বধূ নির্যাতনের শিকার হতে হবে এমন পরিবেশে চলতে।
কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার চাপ নারীর ওপর না দিয়ে বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজটাকে মানবতান্ত্রিক সমাজ বা ইকুয়াল সোসাইটি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা হোক। প্রতিটি ইস্কুলে মেয়েদের সমানাধিকারের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। প্রতিটি শিশু যেন শেখে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। পরিবারে যেন শিশুরা দেখে বাবা ও মা কোনও প্রভু ও দাসীর রোল প্লে করছে না, বরং দুজনে দুজনকে শ্রদ্ধা করছে–মানুষ হিসেবে, সঙ্গী হিসেবে, সহযাত্রী হিসেবে।
আমি তো মনে করি, নারী-বিরোধী সমাজে মেয়েদের শিশু জন্ম দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ছেলে-শিশু জন্ম দেওয়ার মানে ভবিষ্যতের নির্যাতক জন্ম দেওয়া–আর মেয়েশিশু জন্ম দেওয়ার মানে ভবিষ্যতের ভিকটিম জন্ম দেওয়া। নারী বিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস না করে বরং রেভলিউশান করা উচিত নারীদের। রেভুলিউশানের নাম হোক– নাজন্ম।