নাইন ইলেভেনের বিস্মৃতি
বুধবার। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১। অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের তুলনায় এই দিনটির তাৎপর্য অন্য রকম। আগামী ছয় মাসের জন্য রসদপাতি জোগাড়ের চিন্তা মাথায় থাকলেও মনে হচ্ছিল একটা শান্তিময় ভ্রমণ অপেক্ষা করছে। রবিবাসরীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সপ্তাহের বুধবারই যা একটু ফুরসত মিলে। নতুন বা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আইভি বা কোয়াংলিনোতে ভরপেট খাওয়ার পরে গলির মুখে ছোট ছোট বারগুলোতে ওয়াইনের বোতলে সুখ দুঃখের গল্পে গল্পে সময় কেটে যায়।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবেও এই বুধবার আমাকে অফিসে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। হিসাবরক্ষকের বিশ্লেষণী চিন্তা আর হাতির মস্ত মাথার বুদ্ধি নিয়ে পাই পাই হিসাব মেলাতে হবে। অথচ কিছুদিন আগেও সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে হিসাব মেলানোর দরকারই পড়েনি। নির্ধারিত খরচের বাইরে এক-দুই বেলা ঘুরে বেড়ানো কিংবা অভিজাত হোটেলে খাওয়া-এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কেউ। কিন্তু কৃঞ্ছতার যুগে এসে চালাক হিসাবরক্ষকেরা বড় বড় টেবিল দখল করে বসে আছে। এ নিয়ে আমার দুঃখ হয়। বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া কতো প্রতিবেদন বা অন্তরালের খবরের জন্মই তো হয়েছে। অলস দুপুরে কোনো রেস্তোরাঁর বেহিসাবি খাবারের পাত্রে।
বিনা বিচারে বন্দী একজনকে কথা দিয়েছি, তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করবো। বেচারা দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা অভিযোগে কারাগারের চার দেয়ালে পচে মরছে। না, জেফরি আর্চার নয়। সত্যি সত্যি এমন একজন নিরপরাধ মানুষের সঙ্গে দেখা করব বলে কথা দিয়েছি।
প্রতিবেদকের কাজ করা সত্ত্বেও ঘড়ির কাঁটা ধরে আমার একদম কাজ এগোয় না। এই সপ্তাহেও দু-দুটি অবশ্যপালনীয় কাজের ভার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম চেয়ার-টেবিলে বসে থাকতে। কাগজ কলমে নিমগ্ন চোখজোড়ায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সময় পর্যন্ত পাইনি। হায় দুপুরের খাবার! আচার আর পনির মাখানো স্যান্ডউইচে স্রেফ একটা কামড় বসাতে পারলেই খুশি হতাম।
তবে কাজে আমি একদমই ফাকি দিই না। এর জন্য অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে হালকা রসিকতার সময়গুলো উপভোগ করা সম্ভব হয় না। সন্ধ্যা হলেই সহকর্মীরা এক এক করে চলে গেলেও চাপিয়ে দেওয়া কাজ সম্পন্ন করতে একা একাই বসে থাকতে হয়।
ডেইলি এক্সপ্রেস-এর (লন্ডন) বার্তাকক্ষটা বিশাল হলঘরে অবস্থিত। সারি বেঁধে কাজে নিমগ্ন সবাই। এক কোনায় আমাদের কয়েকজন সহকর্মীর ডেস্ক অবস্থিত। সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক, প্রতিবেদক, শিল্পী সব ধরনের লোকের বিশাল বাজার এই হলঘরে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরিয়ে প্রতি সপ্তাহে ব্ল্যাকফ্রায়ার ব্রিজের অদূরে ভোরবেলা প্রকাশিত হয় খবরের কাগজ। আমাদের সহকর্মীরা একে আদর করে ধূসর লুবায়েঙ্কা বলে ডাকে।
দুপুর কেবল মাথার ওপর চড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বার্তাকক্ষের টিভি সেটগুলোর সামনে একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করল। ঘাড় ঘুরিয়ে টিভির পর্দায় জ্বলন্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে উত্তর দিকের টাওয়ারটায়।
লন্ডনে ঘড়ির কাঁটা তখনো দুইটায় পৌঁছায়নি। অস্থির হয়ে তখনই ফোন দিলাম ছোট বোন ভিভকে। নিউক্যাসলে একটা দোকানে কাজ করে ভিভ। তখনই টিভি পর্দায় তাকাতে বললাম ওকে।
মাত্র তিন সপ্তাহ আগেই আমরা নিউ ইয়র্কে ছিলাম। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে ভিভের একটা চাকরি হয়েছিল তখন। তবে ভিভের কাছে উঁচু দালানের হাওয়া থেকে ফুলের ঘ্রাণ বেশি ভালো লাগে বলে আর বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রমুখী হয়নি সে।
যা-ই হোক, ভিভকে ফোনে বলছিলাম, বিমানের পাইলট হয়তো হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মাথায় অন্য কিছু আর আসছিল না। পরে অবশ্য এ রকম ভাবনার জন্য আফসোেস হয়েছিল। উচিত ছিল চেয়ার থেকে উঠে পর্যবেক্ষণ কক্ষে গিয়ে সব সংবাদ চ্যানেলে একবার করে চোখ বোলানো।
নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন আমি আর ভিভ ওয়াল স্ট্রিটের চাকচিক্যে বুদ হয়ে ছিলাম। আমরা উঠেছিলাম অভিজাত রিজেন্ট হোটেলে। পাঁচ তারকা হোটেলে অভিজাত চালচলন, রাজকীয় হালচালের মুখোশে নিজেদের প্রকাশ করতে খুব ভালো লাগত। বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র পাঁচ তারকা মানের হোটেল। এককালে শেয়ারবাজারের বেচাকেনা চললেও বেশ কয়েকবার রিজেন্ট হোটেলের দালানটির খোলনলচে বদলে ফেলা হয়। এখন নিউ ইয়র্ক শহরের সবচেয়ে বড় বাথটাব এতে অবস্থিত। কী কপাল আমার, বোন ছাড়া সঙ্গ দেওয়ার মতো আর কেউই ছিল না সঙ্গে!
আমি আর ভিভ আমার ছোট মেয়ে ডেইজিকেও দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়ের স্কুলের সামার ক্যাম্প চলছিল তখন। জায়গাটা নিউ ইয়র্ক থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। ওখানে ডেইজি অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। প্রতিদিনই সে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছিল। ছয় সপ্তাহ ধরে চলে গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প। গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে আমরা দুজন ছুটি কাটানোর চিন্তা করলেও এখানেই ডেইজি বেশি আনন্দে ছিল।
ওহ খোদা! ডেইজির চিন্তা আমাকে সবসময় একটা অজানা ভীতির মধ্যে রাখে। অথচ ও এখন আর কচি খুকি নয়। আটে পা দিয়েছে। আমিও চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই করছি। ডেইজি খুবই চমৎকার খুকি এবং নিজের যথেষ্ট যত্ন নিতে পারঙ্গম। কপালে থাকলে ওর সঙ্গে আরও সময় কাটাতাম। কিন্তু একক মা (সিঙ্গেল মাদার) বলে তা সম্ভব নয়। উপরম্ভ সাংবাদিকতার চাকরি আমাকে একদমই অবসর নিতে দেয় না।
নিউ ইয়র্কের সুখকর স্মৃতির সঙ্গে টিভির পর্দার ভয়ংকর দৃশ্যগুলো একেবারেই যাচ্ছে না। ভিভ তো একদমই চমকে যায় আমার ধারাবিবরণী শুনে। কিছুক্ষণ পরই ওর স্বামীকে কল দেবে বলে ফোনটা রেখে দেয় ও। ভিভের স্বামী বিল ব্রাউনের অনেক সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব টুইন টাওয়ার বলে খ্যাত বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রে কর্মরত।
আমি অতিনাটকীয় দৃশ্য দেখেই যাচ্ছিলাম। তখনো টের পাইনি যে, বোস্টন বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসা ১১ নং ফ্লাইটের বিমানটি, যেটি লস অ্যাঞ্জেলেসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটিকে জোর করে উত্তর টাওয়ারে আঘাত করা হয়। তখন নিউ ইয়র্কের ঘড়িতে বাজে ৮টা ৪৮।
১০ মিনিট পরে আমি আবারও ভিভকে ডায়াল করি। এইমাত্র আমার চোখের সামনে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নং ১৭৫, একটি বোয়িং ৭৬৭ বিশাল বিমান বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রের দক্ষিণ টাওয়ারেও আছড়ে পড়েছে। কথা বলার সময় লক্ষ করলাম ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছি। ভিভ সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে বিলকে ফোন দেয়।
হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম। বার্তাকক্ষের অনেকেই তখন দুপুরের খাবারের বিরতিতে বাইরে গেছে। আমাকে বের হয়ে নিউ ইয়র্ক যেতে হবে। এটা ভয়াবহ নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলা। প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের পরে আমেরিকার ইতিহাসে এত বড় সন্ত্রাসী হামলার নজির নেই।
দ্রুতই নিউ ইয়র্ক শহরতলির চিত্র বদলে যায়। বেলা ২টা ২৫-এর মধ্যেই সব রাস্তা আর সুড়ঙ্গপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট বুশ এক বার্তায় একে আমেরিকার মাটিতে জঘন্য সন্ত্রাসী হামলা বলে ঘোষণা করেন।
নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সব লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। আমেরিকার বিমানবন্দরগুলোতে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। কেউ একজন আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অনেকেই একে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার পার্ল হারবারে রক্তক্ষয়ী হামলার সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছে।
এরই মধ্যে টিভি পর্দায়, টেবিলে রাখা ল্যান্ডফোন ও মোবাইলে আমার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। বার্তা প্রতিবেদক জিম মুরেকে বারবার ফোন। করতে লাগলাম। সম্পাদক মার্টিনকেও কল দিলাম। আমি জানি, আমাকে এখনই ঊধ্বশ্বাসে নিউ ইয়র্কে ছুটতে হবে।
পৌনে তিনটার দিকে ফ্লাইট-৭৭ পেন্টাগনে অবস্থিত সামরিক সদর দপ্তরের পঞ্চবাহুর একটিতে আঘাত হানে। এই সময়ের মধ্যে হোয়াইট হাউস খালি করে ফেলা হয়। চারপাশে মানুষজন চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে চতুর্থ আঘাতের ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করছে। ইতিমধ্যেই আরও একটি নিখোঁজ বিমানের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সবাই ভাবছে এটি হোয়াইট হাউসেই আঘাত হানবে।
দুর্ভাগ্য, আমি এখনো প্রতিবেদককে ফোনে পাইনি। কিন্তু সহকারী প্রতিবেদক আমাকে শান্ত হতে বললেন। কারণ আজ মাত্র মঙ্গলবার। কিন্তু কী অদ্ভুত কথা, শতাব্দীর অন্যতম স্মরণীয় দুর্ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলে কী করে শান্ত হয়ে বসে থাকা যায়?
আমি করুণ নয়নে দেখলাম, বাণিজ্য কেন্দ্রের ওপর হতে অফিসের কর্মীরা লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হায় খোদা! ওখানে নাকি ভয়ংকর দোজখের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যখন বেঁচে থাকার উপায় হলো উঁচু দালান থেকে নিচে লাফ দেওয়া। আমি এই দৃশ্য দেখতে চাইছিলাম না। আবার ঘটনার ভয়াবহতাকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছিলাম না। এটা আমাকে বাধ্য হয়েই দেখতে হচ্ছে। সরাসরি ধ্বংসলীলা দেখানো হচ্ছে এবং এটি ভয়ংকর দৃশ্য। তা কল্পনার চেয়েও বেশি রক্ত হিমকারক।
একটু পরে জিম মুরে হন্তদন্ত হয়ে বার্তাকক্ষে প্রবেশ করলেন। তার পিছু পিছু এলেন সম্পাদক মার্টিন। ঘটনার বিবরণ শোনার পর মার্টিন আমাকে নিউ ইয়র্কে পাঠানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। কিন্তু জিম ভাবছিলেন, আমার এখনই মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া উচিত। তিনি মনে করছেন, আমেরিকার মাটিতে ঘটে যাওয়া এই পাশবিকতার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি দামেস্ক বা লেবাননে যেতে চেয়েছিলাম। ওখানে বেশ কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু রয়েছে, যারা আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারবে। ১৯৯২ সালে দামেস্কের এক গোপন পরিখায় তল্কালীন জনপ্রিয় দল ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের প্রধান আহমেদ জিবরিলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন ডেইজি আমার গর্ভে সাত মাস ধরে অবস্থান করছে। এই গ্রুপকে লকারবির আকাশে প্যানঅ্যাম বিমানে হামলার জন্য অনেকে দায়ী করে থাকেন। সে যাত্রায় মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্দার অন্তরালের দৃশ্য দেখার প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছিলাম।
আমার মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক অভিজ্ঞতা আরও শাণিত হয় যখন দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগঠনের সাবেক কর্নেল দাউদ জারোরার সঙ্গে একত্রে থেকেছিলাম। এই ব্যক্তি ১৯৭২ সাল থেকে দক্ষিণ লেবাননের ফাতাহ ভূমিতে কিংবদন্তি কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি প্রয়াত ইয়াসির আরাফাতের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। আমার অনাগত সন্তানের পিতা হিসেবে তিনি নিউক্যাসলে আমার ফ্ল্যাটে উঠে আসেন রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আবেদন জানানোর পর। ইয়াসির আরাফাত আমার সঙ্গে সম্পর্ক মেনে না নিয়ে তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সেটা অন্য গল্প। যা-ই হোক, উনি এখনো আমার অনেক ভালো বন্ধু।
অন্যদিকে অফিসে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পরে বার্তা প্রতিবেদক ও জিম আমাকে নিউ ইয়র্কে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমি যখন নিউ ইয়র্ক যাওয়ার জন্য গোছগাছ করছিলাম ততোক্ষণে দক্ষিণ টাওয়ার ছাইয়ের স্থূপ ও ধ্বংসাবশেষ রেখে ধসে পড়েছে। নিউ জার্সি থেকে ছেড়ে আসা সান ফ্রান্সিসকোগামী ফ্লাইট-৯৩ সমারসেট বিমানবন্দরের দক্ষিণে বিধ্বস্ত হয়।
লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দ্রুত বাসা থেকে কাপড়চোপড় বোঝাই কিছু ব্যাগ নিয়ে এলাম। আমি বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পৌছাতে আটলান্টিকগামী সমস্ত ফ্লাইটের গন্তব্য বদলে কানাডায় অবতরণের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে উত্তর টাওয়ারও ততোক্ষণে ধসে পড়েছে।
ব্রিটিশ বিমানের কাউন্টারে তখন বিশাল দীর্ঘ সারি। বিমানবন্দরজুড়ে হইচই আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে খবর পেলাম আগামী এক দিনের মধ্যে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে কোনো বিমান উড্ডয়নের সম্ভাবনা নেই। তবে ব্রাজিলগামী বিমানে চাইলে আমার টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমাকে জানানো হলো। আমেরিকা যাওয়ার বিকল্প কোনো উপায় সন্ধান করতে করতে খবর পেলাম, কানাডা আর মেক্সিকো সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে। জন্মগতভাবে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ হওয়ায় ১৩ তারিখের নিউ ইয়র্কগামী বিমানে একটি টিকিট কেটে ফেলি। ততোদিনে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসবে, এই আশার পালে দোলা দিতে থাকি।
একরাশ হতাশা নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসে ফিরে এলেও বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কগামী বিমানের টিকিট আমার হস্তগত। তাই মুখে একটা বিজয়ের ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্রত ছিলাম। নিউ ইয়র্কের মেয়র রুডলফ ম্যানহাটানের দক্ষিণ এলাকা খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ৫৫ নং ওয়াল স্ট্রিটের হোটেলে থাকাকালীন আশপাশের যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম তাদের অশুভ পরিণতির আশঙ্কায় মনটা কেমন করে ওঠে। কারও খবর পাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না তখন। যোগাযোগের সব মাধ্যম ততোক্ষণে বিচ্ছিন্ন।
নিউ ইয়র্কের ভয়াবহ হামলার পরবর্তী দুরবস্থার খবর জানতে পারি, এই আশায় ডেইজির বোর্ডিং স্কুলে ফোন করলাম। কণ্ঠস্বরটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠলেও এই ঘটনায় ভয় পায়নি, এটা প্রমাণে ডেইজি যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল। নিউ ইয়র্কেই যাচ্ছি, এ কথা ডেইজিকে বলার মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খবরটা জানানোর পর ডেইজির মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, টেলিফোনের এ পাশ থেকে সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারলাম। সুন্দর উপহার নিয়ে ফেরত আসার প্রতিজ্ঞা করতে হলো মেয়ের কাছে।
তবে এ যুগের বাচ্চারা খুব বুদ্ধিমান হয়। অল্পতেই তারা সবকিছু সহজভাবে নিতে পারে। ডেইজিকেও স্বাভাবিক করতে আমার খুব কষ্ট করতে হলো না। সাধারণত আমি আর ডেইজি প্রচুর ঘুরে বেড়াই। তাই ওকে ছাড়া কোথাও যেতে হলে ও অনেক কষ্ট পায় আর আমারও খারাপ লাগে। আমাদের অল্প সময়ের ছোট ছোট ভ্রমণগুলো মজার মজার অভিজ্ঞতায় ভরপুর। ফোনে ডেইজি আমাকে মনে করিয়ে দিল ওর মাসিক পরীক্ষার পরই আমস্টারডাম যাওয়ার জন্য টিকিট বুক করা আছে। তাই আমি যেন নিউ ইয়র্কে অযথা কালক্ষেপণ না করি। ডেইজি দ্রুতই ফোন কেটে দেয়। অনেক দূরে বসে আমি ওর টেলিফোনের প্রতীক্ষায় মন খারাপ করি, ও কখনোই তা চায় না। তবে আমার মনে হয়, ছেলেবেলায় আমিও এমন করেছি।
বিমানবন্দর থেকে অফিসে ফেরত আসার সময় স্টামফোর্ডের ওয়াইন বারে একটা চুঁ মেরেছিলাম। ওখানকার ম্যানেজার লিনা দারুন একটা পানীয় তৈরি করে, যা তুমুল জনপ্রিয় এবং স্বাদেও দারুণ। আমার মতে পৃথিবীর অন্যতম সেরা পানীয়গুলো এখানেই পাওয়া যায়। স্টামফোর্ডের বারগুলো আমার অনেক পছন্দের। এখানকার সবাই খুব অতিথিপরায়ণ। টেবিলের পেছনের মেয়েগুলো সদা হাসিমুখেই থাকে। পরিবেশনকারীদের পানীয় মিশিয়ে ককটেল বানানোর ক্ষমতা অসাধারণ। সারাক্ষণ আনন্দ আর হাসি ঠাট্টায় ভরপুর থাকে কৃত্রিম আলোয় উজ্জ্বল জায়গাগুলো। তবে আজকের পরিস্থিতি ছিল কেমন থমথমে। খুব একটা মানুষের উপস্থিতি ছিল না। যারা ছিল, তারাও কেমন যেন বিষাদে চুপ মেরে ছিল। ওখান থেকে একটা ক্যাব ডেকে সহোতে জেরির ক্লাবে চলে গেলাম।
সাধারণত, শেষ রাতে মাঝেমধ্যে জেরির ক্লাব হয়ে বাড়ি ফিরি। প্রকৃতপক্ষে প্রায় প্রতি রাতেই জেরির ক্লাবে যাওয়া হয়। এসব রাতের নীল পানির আকর্ষণ ঠেকাতে আমার উচিত হবে ডিন স্ট্রিট ও অক্সফোর্ড স্ট্রিটের নিরিবিলি রাস্তা পেরিয়ে সোজা বাড়ি পৌছানো। কিন্তু রাত তিনটার দিকে কোথাও গিয়ে এক বোতল পানীয় মিলবে, দু-চারটে গালি দিয়ে অফিসের রাগ ঝাড়া যাবে, এমনকি পকেটে কানাকড়ি না থাকলেও অসুবিধে নেই, এমন সুযোগ আমার জন্য কেবল জেরিতেই মিলবে।
কার্ডিফে একটা দৈনিকে কাজ করার সময় আট বছর আগে আমি এই ক্লাবের সদস্যপদ পাই। তখন কোনো এক কাজে লন্ডনে এসে পুরোনো বন্ধু কেভিনের সঙ্গে দেখা হয়। বন্ধু তখন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। দুজনের পেশা একই হওয়ায় গল্প জমতে বেশি সময় লাগে না। জেরিতে বসে বসেই তিন বোতল খালি হয়ে যায়। আমাদের গল্প সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দীর্ঘতর হচ্ছিল। তাই আমরা আরও কয়েক বোতল অর্ডার করি। দ্রুতই আমাদের পকেট খালি হয়ে আসে। তবে এখানকার বিচক্ষণ মালিক আমাদের ভাবগতিক দেখে বুঝতে পারে, জায়গাটা আমাদের পছন্দ হয়েছে।
তাই আমাদের সে সদস্যপদ অফার করে বসে এবং বাকি হিসাব খোলার অনুমতি দেয়। সেই থেকে জায়গাটা আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতো।
১১ তারিখ রাতে ক্লাবে আসার পর আমি হতভম্ব হয়ে যাই। চিরচেনা হইহুল্লোড়ের বদলে মাত্র কয়েকজন চুপচাপ বসে আছে। পরিচিত এক দম্পতিকে পেয়ে আমি ওই দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। মেয়েটা দুঃখের সঙ্গে জানায়, তার সঙ্গীর জন্মদিন হওয়া সত্ত্বেও ওই দিন সে কিছুই করতে পারেনি। আমেরিকায় ঘটা সন্ত্রাসী হামলার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মদদ আছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পশ্চিমের যুদ্ধ শুরু হচ্ছে কি না এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিতর্ক হয়। লন্ডনে যেখানে দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলমান, সেখানে এই যুদ্ধের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা নিয়ে সবাইকে বেশ চিন্তিত মনে হলো।
বাড়ি ফিরেই আমি পোর্টেবল টিভিটা অন করি। এটা বেশ কিছুদিন ধরেই যন্ত্রণা দিচ্ছে। তবে ক্ষণিক বাদেই ওই দিনের সংবাদ দেখতে পেলাম। কয়েক ঘন্টা আগে বিশ্ব বাণিজ্য ভবন ধসে পড়েছে। ২০০ অগ্নিনির্বাপন কর্মী ও ৭৮ জন পুলিশ অফিসারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লুইজিয়ানায় বাকসভিলে বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেসিডেন্ট বুশ দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, যে বা যারাই হামলা করে থাকুক না কেন, তাদের নিশ্চিতভাবে খুঁজে বের করা হবে এবং আমেরিকা এর শক্ত জবাব দেবে। বলিষ্ঠ, কঠোর ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কণ্ঠস্বর।
তবে বক্তব্য প্রদানের পরই তিনি দ্রুত ব্রোসকার বিমানঘাঁটিতে সটকে পড়েন। ব্রোকাতে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনার সদর দপ্তর অবস্থিত। ব্যাপারটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলো। উচিত ছিল, তিনি প্রথমে নিউ ইয়র্ক যাবেন এবং পরে ওয়াশিংটনের সদর দপ্তরে গিয়ে সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন। যদিও আমি রাজনীতিবিদদের নীতি ও আনুগত্য নিয়ে সংশয়বাদী, তৰু এটা উচিত নয় যে, কোনো দুর্ঘটনা বা জাতীয় দুর্যোগের সময় নেতারা মাটির তলায় সুড়ঙ্গে গিয়ে লুকিয়ে থাকবেন।
পরদিন মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো। দ্রুতই আমার প্রিয় গ্রিজি শুন ক্যাফেতে গিয়ে একটা ল্যাটে ও বেকন স্যান্ডউইচের অর্ডার করলাম। সংবাদপত্রের প্রথম পাতাগুলো ছিল নাটকীয় শিরোনাম ও বিষাদময় ছবিতে ভরপুর।
অফিসে যাওয়ার পর কাজ শেষ করতে করতে রাত দুইটা বেজে গেল। প্রচুর সংবাদ ও প্রতিবেদন তৈরি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হলো। অফিসের একজন কর্মীরও বেকার বসে থাকার সুযোগ ছিল না। সবাইকেই ব্যস্ত হয়ে কাজ করতে হলো।
নিউ ইয়র্কে বন্ধু, সহকর্মী ও পরিচিত অনেককেই সারা দিন ফোন করেছি। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অনেক পরিচিত মানুষকেও ফোন করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে ভাবগম্ভীর, রাশভারী ধরনের কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককেও চেষ্টা করেছি কিছু তথ্য লাভের আশায়। হাতে নিকোলসে আগে থেকেই রূপচর্চার সময় ঠিক করা থাকলেও তা বাতিল করতে হয়। প্রথমবারের মতো সানডে টেলিগ্রাফ-এর সহকারী সম্পাদক ক্রিস বোফের সঙ্গে বসতে হলো। নিউক্যাসলের পুরোনো বন্ধু ও সানডে টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক আমাকে যাওয়ার জন্য খোচাতে থাকলে আমিও যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাই। তবে তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে গেলেও আমার অনেক কাজ বাকি পড়ে ছিল।
এই কাজের জন্য নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব নয়। এমনকি উদার মনের স্বামী বা প্রেমিকেরাও এ রকম ব্যস্ততা দেখলে বিরক্ত হবে, যা খুবই হতাশাজনক। তবে সময়সাপেক্ষ চাকরি হলেও ঘটনার আকস্মিকতা ও উত্তেজনা নিমেষেই সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। সংবাদমাধ্যমের চাকরি আসলে সেই পুরোনো প্রবাদকেই মনে করিয়ে দেয়, সত্য সব সময় কল্পনার চেয়েও শিহরণ জাগানিয়া।
বাস্তবে আমার জীবনটা যেকোনো রহস্য গল্পের চেয়েও রহস্যময়। মানুষ কেমন বাঁকা চোখে তাকায় যখন জানতে পারে যে আমার তিনবার বিয়ে হয়েছিল এবং ডেইজির বাবা এই তিন স্বামীর কেউ নন। আমি বুঝতে পারি না, মানুষ পরকীয়া অথবা একের পর এক প্রেমের সম্পর্ককে খারাপ মনে করে না। কিন্তু একাধিক স্বামীর কথা শুনলেই তারা ভ্রু কুঁচকায়।
আমার কাছে আমার জীবনটা এতোগুলো সম্পর্ক আর জেরির ক্লাবে কাটানো সময়গুলো মিলিয়ে অনেক বেশি আনন্দের। বন্ধুরা আমার শক্তি দেখে অবাক হয়। দিনে মাত্র তিন বা চার ঘণ্টা ঘুমানোর সময় পাই। তবে একাকিত আমার বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। তাই নিয়মিতই আমি ক্লাবে যাই।
মৃত্যুর সুধা পান করার আগে একজন মানুষ গড়ে ২৭ বছর শুধু ঘুমিয়েই পার করে দেয়, এ কথা জানার পর আমি আঁতকে উঠেছিলাম। ২৭ বছর, ওরেব্বাস! দীর্ঘ সময় একবার চিন্তা করে দেখুন, এই সময়টুকুর মধ্যে না জানি আপনি কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারিয়ে ফেলছেন। এর বাইরেও একটু তথ্য দিয়ে রাখি, অধিকাংশ মানুষ নাকি ঘুমের মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করে। তাই, ঘুম খুব ভয়ংকর, যতোটা পারি আমি দ্রিাদেবীর থেকে অন্তরালে থাকার চেষ্টা করি।
বৃহস্পতিবার একটি ব্যস্ত দিন কাটিয়ে রাত তিনটায় বাড়ি ফিরলাম। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে প্যাডিংটন স্টেশনে গিয়ে হিথরো এক্সপ্রেসের অপেক্ষায় থাকলাম। নিউ ইয়র্কগামী ফ্লাইট অবশেষে ধরতে পারবো। তবে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারলাম ভোর পাঁচটার আগে কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা কনকনে ঠাণ্ডায় স্টেশনেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিমানে ওঠার পরে বাকি থাকা ঘুম পূরণ করা যাবে। একলা বসে থাকতে দেখেই কিনা স্টেশন মাস্টারের মনে দয়ার উদ্রেক হলো। তিনি নিজ উদ্যোগেই স্টেশনের একটা কক্ষে বসার সুযোগ করে দিলেন। কক্ষে ঢুকেই ঘুমে ঢলে পড়লাম। কী দুর্ভাগা আমি!
ভোর পাঁচটায় স্টেশন মাস্টার এসে জাগিয়ে দিয়ে গেলেন। হিথরো যাওয়ার পথে শীত একদম জেঁকে বসলো। আমার চামড়ার মোটা জ্যাকেটটা একদমই শীত তাড়াতে পারছে না। কাঁপতে কাঁপতে বিমানবন্দরে এসে টের পেলাম নিউ ইয়র্ক যাওয়া হচ্ছে না। নিউ ইয়র্কগামী ফ্লাইট বাতিল। মনে মনে দুঃখিত হলেও ভাগ্যের পরিহাসে হেসে দিলাম। যা-ই হোক, কুয়াশাঢাকা ভোর। অতএব, পছন্দের বেকন স্যান্ডউইচ খেতে খেতে কফির পেয়ালায় একটা চুমুক তো দেওয়াই যায়।
আমেরিকা যখন স্তম্ভিত ও শশাকে মুহ্যমান, তখন কোনো ব্রিটিশ সাংবাদিকের পক্ষেই নিউ ইয়র্ক যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমেরিকার উড্ডয়ন সীমান্ত তখন পর্যন্ত চালু হয়নি। অফিসের আরও কিছু কাজ করতে করতে সম্পাদক জিমকে বললাম, পরদিন সকালে নিউ ইয়র্কগামী বিমানে চেপে বসার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি একটু বেশিই আশাবাদী হলাম। কারণ, ১১ সেপ্টেম্বরেই আমি টিকিট কেটেছিলাম।
এমন মুহূর্তেই কম্পিউটারের স্ক্রিনে নতুন ই-মেইলের বার্তা ভেসে উঠলো। মিনোপলিস থেকে আমার চাচাতো ভাই মাইক মেইলটা পাঠিয়েছে। ও ছিল ভীতসন্ত্রস্ত এবং কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না কেন আমেরিকার ওপর হামলা করা হলো। আমি অনেকগুলো কারণ দর্শাতে পারতাম কিন্তু কোনোটিই পরিপূর্ণ যুক্তিসংগত নয় বলে চুপ রইলাম। মাইককে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে খুব ইচ্ছা হলো। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, এত বড় হামলার পরে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।
আমি আমেরিকাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। খাবার কেনার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে না, দ্রুতই সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে, এ ধরনের জায়গা আমার খুব প্রিয়। লন্ডনের অধিকাংশ জায়গায় তা অনুপস্থিত। আমেরিকান লোকেরা ব্রিটিশদের মতো এত কঠিন মনের অধিকারী নয়। বহির্বিশ্বের কেউ তাদের অপছন্দ বা ঘৃণা করতে পারে, এটা জানার পর তারা সত্যিই খুব অবাক হবে। অন্যদিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্রিটিশদের গায়ের চামড়া শুধু মোটাই হয়েছে। কেনইবা হবে না? ইংরেজরা এক হাতে বাইবেল ও অন্য হাতে তলোয়ার ধরে সারা পৃথিবী শাসন করেছে। ৩০ বছর ধরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই চলমান থাকায় সন্ত্রাসী হামলাকে ব্রিটিশরা স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে আমেরিকার জনগণের পক্ষে এই শোক কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যাবে।
সারা দিন আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ই-মেইলে কথা চালাচালি করলাম। ওর অসহায়ত্ব দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অথচ ১১ তারিখের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ও শুধু পরবর্তী অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অন্য কিছু ভাবার ফুরসত ছিল না।
সন্ধ্যা আটটার সময় নগর সংস্করণের সম্পাদক রিচার্ড ফিলিপস ও আমার খুব কাছের বন্ধু মাইককে সঙ্গে নিয়ে অফিস ত্যাগ করলাম। মার্ক বর্তমানে ব্যবসা ও পত্রিকা নিয়ে খুবই সক্রিয়।
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। থেমে থাকা এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে। গিয়ে মিথ্যা ভয় দেখালাম যে ট্যাক্সি কোম্পানিতে আমরা ফোন করেছি। তবে এত কিছুর দরকার ছিল না, সে এমনিতেই আমাদের তিনজনকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিল। এমন সময় মার্টিনকে দেখে আমরা প্রায় পালিয়ে চলে গেলাম। মার্টিন লুডগেট থেকে বের হয়ে দ্রুত একটি ট্যাক্সি খুঁজছিল।
কিন্তু বিধিবাম! পালানোর চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। মার্টিনের হাতে একেবারে হাতেনাতে ধরা খেলাম। ও খুব রেগে গিয়ে আমাদের ডাকাত বলে সম্বোধন করল। রাগে গজরাতে গজরাতে মার্টিন বলল, যাদের ও চাকরি দিয়েছে তাদের থেকে এর বেশি কিছু সে আশাই করে না।
ভয়ে ভয়ে আমরা মার্টিনকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে নিলাম। পথে ফ্লিট স্ট্রিটে পিজ্জা খাওয়া ও সস্তা ড্রিংকসের পর্ব চলল।
মার্টিন ততোক্ষণে আমাদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়েছে। ও জানাল, এটা খুবই বিব্রতকর বিষয়। তবে যা-ই হোক, সারা দিন অনেক ধকল যাওয়ায় সময়টা ভালোই কাটল। পরিস্থিতি সহজ করতে আমি বললাম, ছোটবেলায় বিস্কুট খাওয়ার জন্য যখনই বয়ামে হাত দিতাম, তখনই মার কাছে ধরা খেতাম।
সবাই বাড়ি চলে গেলে আমিও জেরিতে চলে এলাম। এটা দারুণ সুন্দর ও ভদ্র জায়গা। যতোই চিৎকার-চেঁচামেচি অথবা কান্নাকাটি করা হোক না কেন, উপস্থিত কেউই একবারের জন্যও ভ্রু কুঁচকে তাকাবে না।
পরদিন শুক্রবার সকাল সকাল হিথরো চলে এলাম। এখানে একজন বেশ দৃঢ় চরিত্রের আমেরিকান মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো। ভদ্রমহিলা আমেরিকার পশ্চিম দিকের এক রাজ্যে বাস করেন। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিলেন। ওদের দেখে আমার নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ে গেল। জয়েস, আমি, দুই বোন ভিভ ও জিল। কত সুন্দর সময়ই না আমরা পার করে এসেছি।
এই আমেরিকান পরিবার আটলান্টিকের ওপর দিয়ে সব বিমানপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও হিথরো বিমানবন্দর ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। চালু হওয়ার পর প্রথম ফ্লাইটেই নিউ ইয়র্ক যাওয়ার জন্য তারা সীমাহীন ধৈর্য নিয়ে বিমানবন্দরেই অপেক্ষা করছেন। কর্তৃপক্ষও যথাসাধ্য কেক ও কফি দিয়ে তাঁদের যথাসাধ্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে।
অবস্থা লক্ষ করে আমি তাঁদের এক বেলা খাবার নিমন্ত্রণ করলাম। ভদ্রমহিলা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। খেতে খেতে আমি তাঁদের ব্রিটেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম। তবে খুব একটা অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাওয়া গেল না। হামলার পর থেকেই তাঁরা নিউ ইয়র্কে স্বজনদের নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন এবং কখন প্রিয়জনদের মুখগুলো দেখতে পাবেন, সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
অথচ ১১ সেপ্টেম্বর ঘটনার সময় তাঁরা নিউ ইয়র্কের পথে আকাশেই ছিলেন। মাঝপথেই তাঁদের বিমান ঘুরিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। হিথরোতে নামার আগে তারা পুরো ঘটনা আঁচ করতে পারেননি।
এরই মধ্যে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার টিকিটের কাউন্টারে বিশাল লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে গেল। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা প্রত্যেককেই নিউ ইয়র্ক যাওয়ার কারণ বিস্তারিত জানতে চাইছেন। অতীব গুরুত্বপূর্ণ না হলে অনেককেই তারা এ যাত্রা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। প্রচুর আমেরিকান নাগরিক হিথরো বিমানবন্দরে আশঙ্কায় সময় কাটাচ্ছেন, তাই এ ব্যবস্থা। আমি একটু ভয় পেলাম। কারণ, অনেক আমেরিকান দুর্ভাগা নাগরিক আমার সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে, যারা তখনো জানতেন না তাদের স্বজনদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।
মা কিছুক্ষণ পরপর ফোন করে টিকিট পেলাম কি না জানতে চাইছেন। আমার মা খুবই ইতিবাচক ধরনের এবং সব সময় উৎসাহ দিয়ে থাকেন। এই দুর্দিনে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি শুনে তিনি একবারও না করেননি বরং অন্য সবার মতো সেখানে আসলে কী ঘটেছে তা জানতে তিনিও উদগ্রীব ছিলেন।
মাকে শান্ত থাকতে বললাম। এদিকে ডেইজির ছুটি হবে কয়েক দিন পরই। তাই আমার আসতে দেরি হলেও মা-বাবা যেন ডেইজিকে বাড়ি নিয়ে আসেন, এর জন্য অনুরোধ জানালাম। মা-বাবার ওপর ডেইজির দায়িত্ব দিয়ে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার জন্য একটু সাহস পেলাম।
অপেক্ষার পালা যেন আর শেষ হচ্ছিল না। যখন কাউন্টারের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছি, ঠিক তখনই আমার বস জিম ফোন করল। জিমের কথা শুনে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম। নিউ ইয়র্কগামী বিমানের টিকিট কাটার আগ মুহূর্তে জিম আমাকে টিকিট কাটতে নিষেধ করল। পরিবর্তে তক্ষুনি ইসলামাবাদের ফ্লাইট ধরার প্রস্তুতি নিতে বলল। আমার মাথা যেন কাজ করছিল না। নিউ ইয়র্ক যাওয়ার জন্য আমি ব্যাগ গুছিয়েছি, এশিয়ার কোনো বিশ্রী বাজে শহরে সময় কাটানোর জন্য নয়। মনে মনে পরিস্থিতিকে গালি না দিয়ে থাকতে পারলাম না।
ওই মুহূর্তটায় জিমকে খুব অপরিচিত লাগছিল। যদিও জিমের সঙ্গে পরিচয় বেশি দিনের নয়, তবে ও অনেক গুছিয়ে কাজ করে। আজকাল নারী প্রতিবেদকদের সঙ্গে কাজ করতে অনেক সম্পাদক অস্বস্তিতে ভোগে। অথচ জিম মোটেই এমন নয়।
কথা বলতে বলতে জিমের বিচারবুদ্ধি নিয়ে আমার সন্দেহ হতে শুরু করল। ইসলামাবাদ যেতে আমি অনিচ্ছুক-টের পেয়ে জিম জানাল, নিউ ইয়র্কে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের যোগসূত্র রয়েছে বলে ইতিমধ্যেই খবর বেরিয়েছে। তাই পরবর্তী সংবাদ সংগ্রহের জন্য এশিয়ার দিকে ধাবিত হওয়াই একজন বুদ্ধিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজ। প্রচণ্ড অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসের আদেশ শিরোধার্য বলে কোনো রকমে ইসলামাবাদ যেতে রাজি হলাম। তবে ওই দিন ব্রিটিশ বিমান পাকিস্তানগামী সব ফ্লাইট বাতিল করেছিল। কেউ একজন সামনের টার্মিনালে গিয়ে এমিরেটসে টিকিট কাটার পরামর্শ দিল।
গোমড়া মুখে এমিরেটসের কাউন্টারের দিকে ধাবিত হলাম। সেখানকার একজন কর্মকর্তা আমাকে দুবাই হয়ে লাহোর যাওয়ার টিকিট ক্রয়ের পরামর্শ দিলেন। লাহোর থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ধরে আমি ইসলামাবাদ যেতে পারবো বলে তাঁরা জানালেন। গজরাতে গজরাতে বিমানবন্দরের মেঝেতে হিল জুতো ঠুকে ঠুকে এমিরেটসের বিমানে ওঠার জন্য এগিয়ে গেলাম। চতুর জিমকে ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদ যাচ্ছি বলে জানিয়ে দিলাম। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে বিমানটা ছিল বিলাসবহুল ও আরামদায়ক। সিটে বসে জোনসের সিনেমা দেখতে লাগলাম। সাধারণত, যাত্রাপথে আমি বই পড়ি। তবে তখন কিছুই ভালো লাগছিল না।
মুভি শেষ হয়ে এলে সামনের কম্পিউটার পর্দায় দাবা খেলতে শুরু করলাম। কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যখন প্রায় হারিয়ে দিয়েছি, তখন বিমানের চাকা দুবাইয়ের মাটি ছুঁয়েছে।
দুবাই আমার পছন্দের শহর। অনেক সুখস্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহর। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আমি নিউক্যাসলের সানডে সান-এ কাজ করি। তখন চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করত মাইক স্কট। যুদ্ধের ছবি তুলতে গিয়ে আমি আর মাইক তখন ছোটখাটো হারকিউলিস বিমানে করে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আকাশে রুদ্ধশ্বাসে চক্কর দিয়েছি।
বুদ্ধিটা তখন ভালোই কাজে দিয়েছিল এবং প্রায়ই আমরা হরমুজ প্রণালিতে অবস্থান করা রাজকীয় যুদ্ধজাহাজের বহরের বিভিন্ন রণতরিতে ঘুমিয়েছি। সবকিছুই হিসাবমতো এগোচ্ছিল, শুধু শেষ ফ্লাইটের আগে আমরা হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাওয়ায় দুবাইতে আটকা পড়ে গেলাম।
আমার কাছে তখনো আমার দ্বিতীয় স্বামীর ক্রেডিট কার্ড ছিল। তাই দুবাইতে অবরুদ্ধ থাকার এক সপ্তাহ ক্রেডিট কার্ডটির সদ্ব্যবহার করলাম। ওখানকার বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করেছিলাম আর পুরো শহর চষে বেড়িয়েছি।
আমি আমার বস জনের নিকট ভ্রমণ খরচ বাবদ দুই হাজার পাউন্ড দাবি করতেই আমার বস প্রায় হার্ট অ্যাটাক করে বসলেন। এত টাকা বাজেটে নেই বলে তিনি আমাকে দিতে অক্ষমতা ব্যক্ত করলেন। এতে দমে না গিয়ে আমি বসকে সোজাসাপটা জানিয়ে দিলাম-আমি আমার স্বামীর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সব খরচ মিটিয়েছি এবং যদি তাকে আমার উপসাগরীয় অঞ্চলে ভ্রমণের খরচ মেটাতে হয়, তাহলে তিনি যেন নিজ দায়িত্বে আমাকে তা জানিয়ে দেন।
তবে কিছুদিন পরই জিম ও তাঁর সহকারী প্রতিবেদন বাজেট তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে টাকাটা বের করতে সমর্থ হলেন। নির্ধারিত বাজেট বরাদ্দে কিছু টাকা অতিরিক্ত পড়ে ছিল এবং তা দিয়েই তারা আমার খরচ মেটালেন। তবে খরচটা মোটেই বেহুদা ছিল না। আমি আর মাইক প্রচুর ছবি ও গল্প নিয়ে ফিরে আসি, যা সানডে সান-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পুরোটা সময়ের সংবাদ ছাপানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
জন এরপর ডেইলি রেকর্ড ও স্কটল্যান্ডে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি এডিনবার্গভিত্তিক স্কটমিডিয়ার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
তবে যা-ই হোক, নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে ২০০১ সালে আবার দুবাই এসে আমি ইসলামাবাদে কাজ করার পরিকল্পনা সাজাতে লাগলাম। কাজটা আমার কাছে একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের মতো। যদিও আমি নিউ ইয়র্কে যেতে চেয়েছিলাম, তবে ওখানকার পরিস্থিতি ও মানুষের কষ্ট দেখে শহরটাকে ঘিরে আমার সুখস্মৃতিগুলো মুছে যেতো।
হ্যা, ওই সময় জিম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিউ ইয়র্কে যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। এই দৃশ্যের পরবর্তী অংশগুলো ইসলামাবাদকে ঘিরেই বাস্তবায়িত হবে। ভয়ংকর মর্মস্পর্শী এই হামলার পরবর্তী ইতিহাস নিউ ইয়র্কেই লেখা হবে।
ওই মুহূর্তে আমার মায়ের ফোন এলো। চিন্তা করে দেখুন, মা কী পরিমাণ অবাকই না হয়েছিলেন, যখন তিনি আমি নিউ ইয়র্ক পৌছেছি কি না জানতে চাইলেন আর আমি বললাম যে আমি ইসলামাবাদ! তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-কেন আমি ইসলামাবাদ যাচ্ছি? আমি অভয় দিয়ে মাকে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করলাম। আমার বলা উচিত ছিল, যেন শয়তানের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করতে যাচ্ছি।
আমার বয়স ৪৩ (এখন পুরো পৃথিবী জানে আমার বয়স) হলেও মা আমাকে এখনো কোলের শিশুই মনে করেন। আমি যেন পরিবারের সেই ছোট্ট মেয়েটি। আমি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলেও তার উদ্বেগ বেড়েই যাচ্ছিল। যখনই আমি আকণ্ঠ বিপদে নিমজ্জিত হই এবং এর পেছনে কোনো পুরুষের দায় থাকে, তখনই জয়েস জিম মুরের প্রতি বন্দুক তাক করেন। মা তখন পারলে সেই ব্যক্তিকে একরকম খেয়েই ফেলবেন। তিনি ভাবেন, ওই পুরুষ ব্যক্তি আমাকে রাশিয়ার পতিতালয়ে বিক্রি করে দেবেন এবং তিনি কখনোই আর আমার দেখা পাবেন না।
এরই মধ্যে বাবাও ফোনে চলে এলেন এবং তিনি আমাকে ফিরতি ফ্লাইট ধরেই লন্ডন চলে আসার আদেশ দিলেন। আমার আরও দায়িত্বশীল চাকরি খোঁজা উচিত বলেও তিনি জানালেন। যদিও মা-বাবার চিন্তা করাটা যৌক্তিক, তবে একই সঙ্গে ভয়ও লাগছিল, নতুন বসের কাছে আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে। আমি মাকে উল্টাপাল্টা কিছু না করতে অনুরোধ জানালাম এবং সতর্ক করে দিলাম, যদি আমার অফিসে মা ফোন দেন, তাহলে আমি সবার কাছে হাসির পাত্র হয়ে যাবো।
মনে পড়ে গেল শেষ যখন তারা আমাকে একটা উপযুক্ত চাকরি খুঁজতে বলেছিলেন। আমি তখন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ কাজ করতাম। এক সপ্তাহ বাবা-মা আমার সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন। রাত দুইটার দিকে এক পার্টি শেষে বাসায় ফিরেছিলাম। পরনে ছিল টাইট জামা, পিভিসি স্কার্ট, উদ্ভট একটা গলাবন্ধনী ও কতগুলো রং-বেরঙের রুমাল ঝুলছিল কোমরের বেল্ট থেকে।
আমি প্রায় লুকিয়ে বাসায় ঢুকেছিলাম। একটু পরই মা একটা গরম চকলেট ড্রিংকস নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার সাজপোশাক দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মা যেন আবার আমাকে পতিতা ভাবতে শুরু না করেন তাই বললাম, সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছদ্মবেশে একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। মা এরপরও আমাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্মানের চাকরি বেছে নিতে বললেন।
আমি জানি, কাঁধে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ঘুরি। বিশেষ করে, ডেইজির জন্য আমার অনেক কিছু করতে হবে। তবে আমি মেয়ে ও চাকরি দুটোকেই সমান ভালোবাসি। আমার মতে, দায়িত্ব কখনোই কাজের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। বিশেষ করে, কন্যাসন্তানের মা হওয়া মানে এই নয় যে, আমি আমার ভালোবাসার পেশাটাকে বিসর্জন দেবো। সাংবাদিক ছাড়া সাংবাদিকদের দুঃখ কেউ বোঝে না। তাই একজন সাংবাদিকের পক্ষে অন্য পেশার কারও সঙ্গে ঘরসংসার টিকিয়ে রাখা দুরূহ ব্যাপার।
আমার প্রথম স্বামী কিম ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। সে সাংবাদিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখত। তার মতে, এটা একেবারেই অসম্মানের এবং এর জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত। নয়টা-পাঁচটার নির্ধারিত অফিসে কাজ করলে ও আরও খুশি হতো বলে আমি নিশ্চিত। বিয়ের পরপরই আমি ফ্লিট স্ট্রিটে ডেইলি মেইল-এর চাকরি ছেড়ে নন্দার্ন ইকোতে যোগ দিই। অথচ, কিমের গলা যেন টাইনে ব্রিজের সঙ্গে বাঁধা ছিল। আমার সঙ্গে দেখা করার সময়ই পেত না সে।
এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই আমাদের সংসার নরকে পরিণত হলো। আট বছরের একটা সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে এল। প্রায় দুই বছর পর আমি পুলিশের আঞ্চলিক অপরাধ বিভাগের সার্জেন্ট জিম ম্যাকিন্টোশকে বিয়ে করি। আমার চেয়ে ২০ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও সে খুবই সুদর্শন ছিল। তার চাকরিতে সে ভালোই সুনাম অর্জন করেছিল। আমার দিনও বেশ চলে যাচ্ছিল। ওই সময় আমি প্রথমে নিউক্যাসল জার্নাল-এ কাজ করতাম। পরে সাপ্তাহিক সানডে সান-এ যোগ দিই। সেখানে আমার প্রথম রবিবারের সাপ্তাহিকে কাজ করার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়।
আবারও ফ্লিট স্ট্রিট ঝামেলা পাকায়। এই সড়কে প্রচুর সংবাদপত্রের অফিস রয়েছে। কিম কিছুতেই লন্ডনে আসতে চাইত না। কিম টাইনে ব্রিজের সঙ্গে আঠা দিয়ে লেগে থাকলেও জিম যেন আসন পেতে বসে ছিল সেখানে।
আমি অবশ্যই ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস করি। তাই জিমকে যতই উগ্রবাদী বলে গালি দিতাম না কেন, তাতে করে ঝগড়ার সুতা টানা সম্ভব হয়নি। বোকার স্বর্গে থাকাটা সুখকর হলো না। এর পরের কয়েক বছর এখানে-সেখানে স্থানীয় পত্রিকার অফিসে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ালাম। তবে প্রতিটা অফিস থেকেই একটু একটু করে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করে বের হতাম। নিজস্ব সাংবাদিকতার জগতে একটু একটু করে পরিচিতি বাড়তে লাগল। ১৯৯০ সালের দিকে আমি আর জিম বহুদূরে চলে গেলাম। এর পরই মনে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বোধ হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম। দুই বছর পর হঠাৎ ডেইজির বাবা দাউদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। চার বছর আমরা সুখে-দুঃখে কাটিয়েছি। এর পরে ইসরায়েলি রনি হেমশের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধি। দুই বছর পর আবার পুরোনো চক্রেই আমার বিয়ের ভাগ্য ঘুরপাক খেতে লাগল। আবার পৃথক হয়ে গেলাম। তবে দাউদের সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। কিন্তু রনির সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে কোনো দিন যোগাযোগ হয়নি।
যা-ই হোক, দুবাই বিমানবন্দরের বিশাল চত্বরে দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনটা অস্থির হয়ে গেল । লাইনটা কেটে দিয়ে একটু সামনে এগোতেই সুন্দর একটা সামুদ্রিক খাবারের দোকান চোখে পড়ল। মায়ের ওপর রাগ ঝারতে একটা মাছের ডিম, লবস্টার ও আরও কিছু সামুদ্রিক মাছের অর্ডার করলাম। মা আমার ছোটখাটো অপব্যয়গুলো একদমই সহ্য করেন না। আজ টাকা একটু বেশি খরচ হলে হোক। খাবারটা বেশ সুস্বাদু ছিল এবং চেটেপুটেই সব শেষ করলাম। পাকিস্তান যাওয়ার পর এভাবে ইচ্ছামতো আরাম করে খাওয়ার সুযোগ মিলবে না, তা আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম।
গরম ও মসলাদার খাবার আমার একদমই পছন্দ নয়। ফলমূল ও সবজিও আমার পেটে সয় না। পাকিস্তানের অখাদ্য খাবার দিয়ে ক্ষুধা মিটবে কি না তা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, ক্ষুধা মেটাতে সিগারেটই যথেষ্ট।
ওয়াইনের শেষ ফোঁটাটুকু পেটে চালান করে দিলাম। মুখে একটা বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল। মায়ের সঙ্গে এ যাত্রা জিতে গেলেও যুদ্ধক্ষেত্রে এখনো জেতা হয়নি। আমি খোদার কাছে মিনতি জানালাম, মা যেন আমার সম্পাদককে ফোন না দেন। কবে জানি মা আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগান। অথবা আমার লেখার কাগজে বিষ মিশিয়ে রাখেন, মা সম্পাদককে ফোন দিয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবেদক সন্তানকে দূরে পাঠানোর জন্য তিরস্কার করছেন, দৃশ্যটা আমার জন্য কতোটা অপমানের।
আমি মা ও বাবাকে যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসি। তবে আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা আমার পছন্দ নয়। মাঝেমধ্যে ভয় লাগে, ডেইজি বড় হলে আমিও কি এমন অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ হয়ে যাব? তবে ডেইজি মোটেও হেঁয়ালি মেয়ে নয়। ও অনেকটা শক্ত ধাতুতে গড়া। ও জীবনেও যা-ই করুক না কেন, আমার বিশ্বাস তা কখনোই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। এতো বিশ্বাস আমার ওর বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই জন্মেছে।
সামার কেনিয়ার মরুভূমিতে সাফারির কথা মনে পড়ে গেল। আমি আর ডেইজি বিশালাকৃতির কচ্ছপের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। কচ্ছপের মালিক ডেইজিকে কচ্ছপের পিঠে ওঠার আমন্ত্রণ জানিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
আমি পুরোনো অভ্যাসের মতোই ওর কানে কানে বললাম, সুযোগের সদ্ব্যবহার করা মেয়ে, কিন্তু সে একবারও রাজি হলো না। একসময় কেনিয়ান কর্মীরা একরকম জোর করেই ওকে প্রাণীদের পিঠে তুলে দিল। কয়েক সেকেন্ড পর ডেইজির ভয়ার্ত চেহারাটা বদলে গিয়ে মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটে ওঠে। ও ছবি তোলার জন্য আমাকে চিকার করে বলতে থাকে। পরে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন ও প্রথমবার উঠতে চায়নি। ডেইজি ভেবেছিল, এটা ওকে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাবে। আমরা দুজনই হেসে দিই কথা শুনে। এরপর আমি আরও একবার ওকে বলি, সব সময় সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হয়। কোনো কোনো সুযোেগ দ্বিতীয়বার আসে না।
দুবাই থেকে উড়োজাহাজ উড়াল দেওয়ার পর থেকেই পূর্ব দিকে সময়ের ব্যবধান কমতে লাগল এবং লাহোরে নামার আগ পর্যন্ত আমি ঝিম মেরে বসে রইলাম। বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ বিমান ধরার জন্য দুই ঘণ্টা বসে থাকি। বিমানবন্দরেই দুজন সাংবাদিককে ইতস্তত পায়চারি করতে দেখলাম। তাদের চলন-বলন ও জিনিসপত্র দেখেই বুঝে ফেলি আমরা একই পথের পথিক। এগিয়ে এসে আমিই তাঁদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। দুজনই চেক টেলিভিশনের কর্মী। তারা আমার থেকেও দুঃসাহসী। উত্তর পাকিস্তানের পেশোয়র সীমান্ত পেরিয়ে তাঁদের আফগানিস্তানে ঢোকার অভিপ্রায়। আমি তাঁদের শুভকামনা জানালাম। আমরা একই বিমানে ইসলামাবাদ পর্যন্ত গেলাম।
ইসলামাবাদে নামার পরই এক্সপ্রেস পত্রিকার অফিস থেকে খুদে বার্তা পেলাম। তারা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো পশ্চিমা ধাঁচের হোটেলেই একটি রুম ঠিক করে রেখেছে। সেই সঙ্গে ভাড়ায় চালিত একটি গাড়ির দোকানের নাম্বারও পাঠিয়েছে। অথচ আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে গাড়িচালক। আমার মতে, মেয়েরা ভালো গাড়ি চালাতে পারে না। আমি একরকম কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছিলাম যে, আর যা-ই হোক, পাকিস্তানে আমি নিজ হাতে গাড়ি চালাতে যাচ্ছি না।
একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আমি হোটেলে চলে এলাম। টানা ৩৬ ঘণ্টা শুধু আকাশপথেই ভ্রমণ করেছি এই কদিন। এর মাঝে হিথরো বিমানবন্দরেই থাকতে হয়েছে বেশ কয়েক ঘন্টা। এতো দীর্ঘ ভ্রমণে গা থেকে উটচালকের পোশাকের মতো দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। দ্রুতই আমাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হতে হবে। আমার মেজাজও একই সঙ্গে বিগড়ে গেছে ক্লান্তিকর ভ্রমণে।
অভ্যর্থনা ডেস্কের লোকটা আমার কথা শুনে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। আমার নামের বুকিং নাকি বাতিল হয়ে গেছে এবং হোটেলে নাকি কোনো সিট খালি নেই। খুব সম্ভব কোনো একজন সাংবাদিক এই চালাকিটা করেছে। কোনো প্রতিবেদক হয়তো হোটেলে এসে রুম খালি না পেয়ে আমার নামের বুকিং বাতিল করে দিয়েছে। আমি যে পাকিস্তানে এসেছি, তা ততোক্ষণে সাংবাদিকমহলে রটে গেছে।
দুর্ঘটনা যতোই ভয়াবহ বা দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, অনেক কনিষ্ঠ সাংবাদিক পেশাদারির ধারেকাছ দিয়েও হাঁটে না। এরা সবসময়ই নিজের ধান্দায় ব্যস্ত থাকে এবং সবার আগে নিজের পত্রিকা বা চ্যানেলে খবর প্রচারের জন্য নৈতিকতার ধার ধারে না। আমার মনে আছে, ১৯৮৮ সালের দিকে যখন লকারবির আকাশে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, তখন থাকার জায়গা ও খাবার নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে কতত অপেশাদার আচরণ ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল।
বিশেষ করে, ডেইলি স্টার-এর একজন প্রতিবেদক সকালের নাশতা খেতে সবাই যখন হোটেলের নিচে গেছে, তখন একজন টেলিভিশন কর্মীর ব্যাগ গুছিয়ে করিডরে ঠেলে দিয়ে হোটেলকক্ষ দখলে নিয়ে নেয়। খবরটি শুনে হোটেল ব্যবস্থাপকও ভিরমি খেয়ে পড়েন। কারণ, ডেইলি স্টার-এর ওই প্রতিবেদক আসার একটু আগেই তিনি নাকি একটা ফোন কল পেয়েছিলেন, যাতে টেলিভিশন কর্মীর ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত নিচে নিয়ে যেতে বলা হয়।
তাই বুঝতেই পারলাম, এই সস্তা প্রতারণা করে কোনো বদমাশ আমার রুমটার দখল নিয়েছে। আমিও ওই নচ্ছার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারতাম। কিন্তু ক্লান্তিতে আমার শরীর বিদ্রোহ করে বসে। একই সময় আরেকটা ট্যাক্সি এসে আমাকে ম্যারিয়টে নিয়ে যায়, যেখানেও আমি কোনো কক্ষই খালি পেলাম না। মনে হচ্ছিল, দুনিয়ার সব পত্রিকা, টেলিভিশন ও বেতারের কর্মীরা ইসলামাবাদে এসে জড়ো হয়েছেন।
ম্যারিয়টের অভ্যর্থনাকর্মী হয়তো সত্যিই আমার জন্য সমবেদনা দেখিয়েছিল অথবা আমাকে দ্রুতই হোটেল লবি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। কারণ, কয়েকটা ফোন করেই সে আমাকে ক্রাউন প্লাজায় পাঠিয়ে দেয়।
ক্রাউন প্লাজায় পৌছেই যখন দেখলাম হোটেলে দুনিয়ার নানা প্রান্তের সাংবাদিক গিজগিজ করছে এবং যুক্তরাজ্যের কেউই সেখানে নেই, তখন ভাবলাম, এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারত না। আমি একটু নিভৃতচারী এবং ব্যাগ নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে সংকোচ কাজ করে। পরিচিত কোনো সহকর্মী না থাকায় আমি একাই কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই কাজ করতে পারব। কারণ, পরিচিত কাউকে পেলেই সাংবাদিকেরা গল্পের ছলে আরেকজনের প্রতিবেদন বা অনুসন্ধান সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করে।
তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ কাজ করার সময় কেউই তার পাশের ডেস্কের সহকর্মীকে তার কাজ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেত না। সেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল এতোই কঠোর। এখানকার অফিসের পরিবেশে পেশাদারির অসাধারণ ছাপ ছিল, যা দুনিয়ার অন্যতম সেরা। যদিও এদের বিরুদ্ধে গল্প ফাঁদার অভিযোগ রয়েছে, তবে তা সত্যি নয়।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক মূল খবরের ২০ শতাংশ তথ্য হাতে রেখেই খবর ছাপাতেন, যাতে করে অপরাধী বা নির্যাতিত ব্যক্তি অভিযোগ জানালে অথবা মামলা করলে তার জবাব দেওয়া সম্ভব হয়। কেউ এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই অবশিষ্ট খবর পরবর্তী সপ্তাহে আকর্ষণীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে ছাপিয়ে দেওয়া হতো।
এখান থেকেই আমি সানডে টাইমস-এ যোগদান করি, যেখানে অনুসন্ধানী খবরের দলে ডেভিডের অধীনে কাজ করি। ডেভিড পরে বার্তাকক্ষের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিল। ডেভিডের সঙ্গে কাজ করার সময়টা খুব আনন্দে কাটত। ও ছিল সব গোপন খবরের সিন্দুক। তবে কখনো কোনো গোপন সূত্রের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেলে ও ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। আমি সর্বদাই ডেভিডের কাজের প্রশংসা করতাম এবং ওর সঙ্গে অনুসন্ধানী দলে থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আগাগোড়া সব শিখে ফেলি। আজকের পরিস্থিতিতে থাকলে ডেভিডও একা কাজ করা পছন্দ করত।
এবং তা-ই হলো। ক্রাউন প্লাজায় আমি নিরিবিলি একটা কক্ষ পেয়ে গেলাম। জিমকে ফোন করে ওকে বেশ হাসিখুশিই মনে হলো। তার মানে, মা ওকে ফোন দিয়ে আমাকে ফেরত নিয়ে টেবিলে বসে করা কাজের চাকরি দিতে বলেননি।
জিমকে বললাম, আমি ঘেমে নেয়ে একাকার, গা দিয়ে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। গোসল করাটা অতীব জরুরি। খুব স্বাভাবিক ও নির্বিকার ভঙ্গিতে জিম আমাকে বলল, খুব তাড়াহুড়ো নেই। তবে আমি যেন বিকেল তিনটার মধ্যে এক হাজার শব্দের একটা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিই। কীভাবে গেলাম, কোথায় নামলাম, কোথায় উঠলাম-এসব ছোটখাটো ব্যাপার। মাত্র তিন ঘণ্টা বাকি, রাগে জিমের মাথার চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করল।
আমি আমার দামি ও পছন্দের লুইস ভিটনের স্যুটকেসটা খুলতে গিয়েই দেখি, কোন হতচ্ছাড়া চেইনের মাঝের একটা সেলাই কেটে ফেলেছে। সব বের করার পর খুঁজে দেখলাম, মাত্র তিনটা জিনিস নেই। বাবার এক জোড়া মোজা (এখন বাবা বুঝতে পারবেন কেন তিনি কখনোই মোজা খুঁজে পান না। সব তো তাঁর আদরের মেয়েই লুকিয়ে মেরে দেয়) এবং অর্ধেক খালি একটা টুথপেস্টের টিউব। দুনিয়া কত বিচিত্র!
যা-ই হোক, উৎকট দুর্গন্ধ তাড়াতে সময় নিয়ে গোসল সেরে নিলাম। কোথায় যাব, কী করব এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। আর মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে জিমকে একটা এক হাজার শব্দের বিরক্তিকর প্রতিবেদন পাঠাতে হবে।
চমৎকার সম্পূর্ণ অপরিচিত এক শহরে উঠেছি, যেখানে আমি তিনটি হোটেলের অভ্যর্থনাকারীদের ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। এবং এদের কারও সঙ্গেই আমার বেশি কথাবার্তা হয়নি। এখানকার ভিন্ন সংস্কৃতির উপযোগী গায়ে দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। চুলগুলোও কেমন জট পাকিয়ে আছে। আমার আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু সে সময় পেলাম কোথায়? একই সঙ্গে চুলের দুঃখে কান্না পেল আমার। কেন যেন আমার ছুটির দিন সোমবারে কোনো চুলের রূপচর্চাকারী কাজ করে না। পৃথিবীর দুটি রহস্যের অন্যতম একটি রহস্য এটা। আরেকটি হলো, কেন ছেলেদের স্তনগ্রন্থি থাকে। এসব উদ্ভট অর্থহীন চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। ভীষণ ক্লান্তি এসে ভর করলেও কাজে মনোনিবেশ করলাম। বার্তাকক্ষ আমার অপেক্ষায় বসে আছে।