নাইটের ভ্রমণ
নাইট : তুমি দাবা খেলো, তাই না?
যম : তুমি কি করে জানলে?
নাইট : আমি এটা পেইন্টিংয়ে দেখেছি, ব্যালাডে গাইতে শুনেছি।
যম : হ্যাঁ, সত্যি বলতে কি আমি বেশ ভালো দাবাড়ু।
নাইট : তবে তুমি আমার চেয়ে ভালো খেলতে পারো না।
-দ্য সেভেন্থ সিল (প্রখ্যাত সুইডিশ চলচ্চিত্র)
ইঙ্গমার বার্গম্যান
.
মিডলটন টানেলটা প্রায় ফাঁকা। এখন বাজে সন্ধ্য সাড়ে সাতটা। “আমি ভেবেছিলাম আমরা ডিনার করতে যাচ্ছি,” ইঞ্জিনের শব্দের কারণে চিৎকার করে বললাম।
“ডিনার করতেই তো যাচ্ছি,” রহস্যময় ভঙ্গি করে বললো নিম। “লং আইল্যান্ডে আমার বাড়িতে, ওখানে আমি একজন কৃষক হবার প্র্যাকটিস করছি। যদিও বছরের এ সময়টাতে ওখানে কোনো ফসল হয় না।”
“লং আইল্যান্ডে তোমার ফার্ম আছে?” বললাম তাকে। খুবই অদ্ভুত কথা। আমি কখনই ভাবি নি নিমের কোনো বাড়ি-ঘর আছে। অনেকটা ভুতের মতোই সে উদয় হয় আবার সেভাবেই হাওয়া হয়ে যায়।
“অবশ্যই আছে,” দুইরঙা চোখ দিয়ে অন্ধকারে আমার দিকে পিটপিট করে তাকালো সে। “তুমি একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে এটা স্বচক্ষে দেখবে। তুমি তো জানোই আমি আমার প্রাইভেসি কতোটা সুরক্ষা করে চলি। আমি নিজে তোমার জন্য রান্না করে খাওয়াবো বলে ঠিক করেছি। ডিনারের পর তুমি আমার ওখানেই রাতটা থেকে যাবে।”
“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও…”
“অবশ্যই যুক্তি আর কারণ দিয়ে তোমাকে কনফিউজ করাটা কঠিন কাজ, বললো নিম। “এইমাত্র বললে তুমি ভয়ঙ্কর বিপদে আছে। বিগত আটচল্লিশ ঘণ্টায় তুমি দু দু’জন লোককে খুন হতে দেখেছো, তোমাকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, এসবের সাথে তুমিও জড়িত। তোমার অ্যাপার্টমেন্টে একা একা রাত কাটানোর কথা নিশ্চয় বলতে পারো না?”
“সকালবেলায় আমাকে কাজে যেতে হবে,” বললাম তাকে।
“তুমি কাজে যাবে না, দৃঢ়ভাবে বললো নিম। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত না জানা পর্যন্ত তোমার পেছনে লেগে থাকা লোকগুলো থেকে তোমাকে দূরে থাকতে হবে। এ বিষয়ে তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার।”
গাড়িটা গ্রাম্য এলাকায় ঢুকে পড়লে বাতাস আরো ঠাণ্ডা অনুভূত হলো। তবে মন দিয়ে নিমের কথা নিতে লাগলাম।
“প্রথমে তোমাকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস সম্পর্কে বলবো,” বলতে শুরু করলো সে। “গল্পটা অনেক বড়, তবে জেনে রেখো, এটা আসলে শার্লেমেইনের দাবাবোর্ড…”
“ওহ!” চমকে উঠে আমি সোজা হয়ে বসলাম। এ সম্পর্কে আমি শুনেছি কিন্তু নামটা জানতাম না। আমি আলজেরিয়াতে যাবো শুনেই লিলির মামা লিউলিন আমাকে এর কথা বলেছিলো। সে বলেছে আমাকে দিয়ে সে এই দাবাবোর্ডের একটা খুঁটি সংগ্রহ করতে চায়।”
“সে যে এরকমটি চাইবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” হেসে বললো নিম। “ওগুলো একেবারেই দুপ্রাপ্য, আর মূল্যের কথা বলতে গেলে অপরিসীম। বেশিরভাগ লোকে বিশ্বাসই করে না ওগুলোর অস্তিত্ত্ব আছে। লিউলিন ওগুলোর সম্পর্কে কিভাবে জানতে পারলো? ওগুলো যে আলজেরিয়াতে আছে সেটাই বা বুঝলো কি করে?” নিম খুব স্বাভাবিক চালে কথাগুলো বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম আমার জবাবের আশায় উন্মুখ হয়ে আছে সে।
“লিউলিন একজন অ্যান্টিক ডিলার, তাকে বললাম। “তার একজন কাস্টমার যেকোনো মূল্যে এর খুঁটিগুলো সংগ্রহ করতে চাইছে। আলজেরিয়াতে তাদের একজন লোক আছে, সে-ই বলেছে ঠিক কোথায় ওগুলো আছে।”
“আমার তাতে সন্দেহ আছে,” বললো নিম। “কিংবদন্তী বলে, ওগুলো শত বছরেরও বেশি আগে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো, তারও এক হাজার বছর আগে থেকেই ওগুলোর কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।”
রাতের অন্ধকারে আমাদের গাড়িটা চলতে শুরু করলে নিম আমাকে মুরিশ রাজা-বাদশাহ্ আর ফরাসি নানদের উদ্ভট গল্প বলে গেলো। এক রহস্যময় শক্তির খোঁজে শত শত বছর ধরেই অনেকে এটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে কিভাবে পুরো সার্ভিসটা মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলা হলে আর কখনই সেটা দেখা যায় নি, সবই বললো সে। নিম আমাকে এও বললো বিশ্বাস করা হয় ওটা আলজেরিয়ার কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও সে বললো না এরকম বিশ্বাস করার কারণ। কি।
তার গল্প বলা শেষ হলে আমাদের গাড়িটা চলে এলো গভীর বনজঙ্গল সদৃশ্য একটি জায়গায়। সেই বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা ক্রমশ বেশ নীচু হয়ে আবার উপরে উঠতে শুরু করলে দেখতে পেলাম আমাদের চোখের সামনে কালচে সাগরের উপরে সাদা ধবধবে চাঁদ। বনের ভেতর থেকে পেঁচার ডাকও শুনতে পেলাম। নিউইয়র্ক থেকে জায়গাটা অবশ্যই অনেক দূরে হবে।
“আমি অবশ্য লিউলিনকে বলে দিয়েছি এসবের মধ্যে আমি নেই,” বললাম তাকে। “স্বর্ণ আর হীরা-জহরত খচিত নক্সা করা দাবার খুঁটিগুলো সংগ্রহ করা তো চোরাকারবারের মধ্যেই পড়ে”।
আমরা প্রায় সাগরের উপরে গিয়ে পড়তাম আরেকটু হলে, নিম দ্রুত আচমকা মোড় নিয়ে নিলো। গতি কমিয়ে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলো গাড়িটা।
“তার কাছে কি একটা খুঁটি আছে নাকি?” বললো সে। “তোমাকে সেরকম কিছু দেখিয়েছে?”
“আরে না,” বললাম তাকে। “তুমি নিজেই না বললে ওগুলো শত শত বছর ধারে লাপাত্তা হয়ে আছে। সে আমাকে একটা ফটোগ্রাফ দেখিয়েছে। মনে হয়। বিবলিওথেক ন্যাশনেইলে রাখা কোনো খুঁটির ছবি।”
“আচ্ছা,” বললো নিম, মনে হলো কিছুটা শান্ত হয়ে উঠলো সে।
“আমি তো বুঝতে পারছি না সোলারিন আর দু দুটো খুনের সাথে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে,” তাকে বললাম।
বুঝিয়ে বলছি, নিম বললো। “তবে ওয়াদা করতে হবে কথাটা অন্য কাউকে বলতে পারবে না।”
“ঠিক এ কথাটা লিউলিনও আমাকে বলেছিলো।”
আমার দিকে মুখ বিকৃত করে তাকালো নিম। “সোলারিন কেন তোমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো, তোমাকে হুমকি দিয়েছিলো সেটা যদি বলি তাহলে হয়তো তুমি আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে। মনে রেখো, এসবই সে করেছে দাবার খুঁটিগুলোর জন্য।”
“অসম্ভব,” আমি বললাম। “আমি এ জীবনেও ওগুলোর কথা শুনি নি। এখনও বলতে গেলে ওগুলোর সম্পর্কে কিছুই জানি না। এই ফালতু গেমের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।”
“তবে সম্ভবত,” গাড়িটা সাগরতীর ধরে ছুটে যাচ্ছে এখন, “কেউ মনে করছে এর সাথে তোমার সম্পর্ক রয়েছে।”
.
রাস্তাটা ধীরে ধীরে সাগরতীর থেকে সরে বেশ খানিকটা বেঁকে গেছে। এখন দু’ধারে দেখা যাচ্ছে সুন্দর করে ছাটা গাছ, দশ ফিট উঁচু হবে সেগুলো। সীমানার ভেতরে বিশাল একটি এস্টেট। মাঝেমাঝেই বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে ভেতরের বরাফাচ্ছিদ লনের পেছনে চমৎকার একটি ম্যানশন দেখতে পাচ্ছি। নিউইয়র্কের তাছাকছি এরকম কোনো জায়গা আমি কখনও দেখি নি। এটা আমাকে স্কট ফিটজারেল্ডের কথা মনে করিয়ে দিলো।
সোলারিন সম্পর্কে বলতে লাগলো নিম।
“দাবা সংক্রান্ত ম্যাগাজিন আর জার্নাল পড়া ছাড়া তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না,” বললো সে। “আলেক্সান্ডার সোলারিন ছাব্বিশ বছর বয়সী সোভিয়ে ইউনিয়নের একজন নাগরিক, জন্মেছিলো ক্রিমিয়াতে, জায়গাটাকে সভ্যতার পাঠস্থান বলা যায়, অবশ্য বর্তমান সময়ে ওটা চরম অসভ্য আর বর্বর এলাকা হিসেবে পরিচিত। একজন এতিম ছিলো সে, ফলে সরকারী পষ্ঠপোষকতায় বাচ্চাদের আশ্রমে বড় হয়েছে। নয় কি দশ বছর বয়সে স্থানীয় দাবা খেলার একজন হেডমাস্টারকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। এই খেলাটা সে চার বছর বয়স থেকে খেলতে শুরু করে। কৃষ্ণসাগরের এক জেলের কাছ থেকে এটা শিখেছিলো। দ্রুতই সে ঠাঁই পায় পাইওনিয়ার্স প্যালাস-এ।”
আমি এটা জানি। পাইওনিয়ার্স প্যালাস তরুণ প্রতিভাবান দাবা খেলোয়াড়দের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেবার কাজ করে। সেখান থেকেই ভবিষ্যত দাবা মাস্টারদের আর্বিভাব ঘটে থাকে। রাশিয়াতে দাবা খেলা নিছক জাতীয় খেলা নয়। এটা তাদের কাছে এ বিশ্বের সবচাইতে মস্তিষ্কপ্রসূত খেলা বিশ্বরাজনীতিরই একটি বর্ধিত রূপ। রাশিয়ানরা মনে করে এটা তাদের সুদীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখে।
“সোলারিন যদি পাইওনিয়ার্স প্যালাসে থেকে থাকে তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়। খুব শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন তার রয়েছে?” বললাম আমি।
“তাই তো থাকার কথা,” জবাবে বললো নিম। গাড়িটা পথের শেষ সীমানায় এসে পড়লো। আমাদের সামনে এখন বিশাল রট আয়রনের একটা গেট। নিম গেটের কাছে থেমে ড্যাশবোর্ডে একটা সুইচ টিপলে গেটটা খুলে গেলো। আমরা প্রবেশ করলাম তার এস্টেটে। মনে হলো আমি বুঝি কোনো স্নো কুইনদের। জগতে ঢুকে পড়ছি।
“সত্যি বলতে কি,” নিম বললো, “কর্তৃপক্ষের পছন্দের খেলোয়াড়দের সাথে ইচ্ছে করে হেরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সোলারিন। রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা খুবই কড়া একটি নিয়ম। তাদের কথামতো না চললে কোনো টুনামেন্টে স্থান পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বে কঠোর সমালোচনার শিকার হলেও তারা এখনও এ কাজ করা থেকে বিরত থাকে নি।”।
ড্রাইভওয়েটা একেবারেই পরিস্কার, দীর্ঘদিন এ পথ দিয়ে কোনো গাড়ি ঢুকেছে বলে মনে হলো না। বাগানের সামনে বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে আমরা বৃত্তাকারের একটি চত্বরে এসে পড়লাম, ওটার মাঝখানে বিশাল একটি ফোয়ারা। আমাদের সামনে ম্যানশনটা চাঁদের আলোয় স্নাত। ছাদের উপরে বেশ কয়েকটি চিমনি।
“সেজন্যেই, গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো নিম। “আমাদের বন্ধু সোলারিন দাবা ছেড়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়। বিশ বছর বয়স থেকেই মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো কিছু টুনামেন্ট বাদে বড় কোনো টুর্নামেন্টে সে আর খেলে নি।”
আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। একহাতে পেইন্টিং আর অন্যহাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলে আমরা ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
বিশাল এন্ট্রান্স হলে দাঁড়িয়ে আছি। সুইচ টিপে বিশাল আকারের একটি ঝারবাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। মেঝেটা স্লেটের হলেও এমনভাবে পলিশ করা হয়েছে দেখে মার্বেল বলে মনে হয়। বাড়ির ভেতরটা এতো ঠাণ্ডা যে আমার নাক-মুখ দিয়ে নির্গত বাতাস জমে যাচ্ছে। মেঝেতেও দেখতে পেলাম বরফের পাতলা আস্তর পড়ে আছে। বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে এলো নিম। এটা বাড়ির একেবারে পেছন দিকে অবস্থিত। জায়গাটা দারুণ। পেইন্টিংটা নামিয়ে রেখে দেয়ালে থাকা কিছু ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো সে। সোনালি আলোয় ছেয়ে গেলো পুরো ঘরটা।
রান্নাঘরটা বিশাল, সম্ভবত ত্রিশ বাই পঞ্চাশ ফিটের মতো হবে। পেছনের দেয়ালে কতোগুলো ফ্রেঞ্চ জানালা, সেটা দিয়ে বরাফাচ্ছিত লন আর ফেনিল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে মায়াবি চাঁদের আলোয়। দেয়ালের একপাশে বিশাল একটি ওভেন। তার বিপরীতে আরো বিশাল একটি ফায়ারপ্লেস। তার সামনে রয়েছে। ওক কাঠের একটি গোলটেবিল আর আট-দশটি চেয়ার। ঘরের চারপাশে আরো কিছু চেয়ার আর আরামদায়ক সোফা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ফায়ারপ্লেসটায় আগুন ধরিয়ে দিলো নিম, সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা আরো বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো। নিম যখন শেরি মদের একটি বোতল খুলতে ব্যস্ত আমি তখন বুট জুতো খুলে আরাম করে সোফায় বসে পড়লাম। নিজের জন্যে একগ্লাসে মদ ঢেলে আমার জন্যেও এক গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে পাশে এসে বসলো সে। আমি আমার গায়ের কোটটা খুলে ফেলার পর সে তার গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো চিয়ার্স করার জন্য।
মন্তগ্লেইন সার্ভিস এবং এরফলে যতো অ্যাডভেঞ্চার তোমার জীবনে বয়ে আনবে তার উদ্দেশ্যে,” বলেই এক চুমুক পান করলো সে।
“হুম। জিনিসটা দারুণ,” আমি বললাম।
“এটা স্পেনের শেরি মদ,” বললো নিম। “লোকজন এটা পান করার জন্যে পাগল হয়ে থাকে। সাধারণ শেরি এর সামনে কিছুই না।”
“আশা করি তুমি আমার জন্যে এ ধরণের কোনো অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করো নি, তাকে বললাম। “আগামীকাল সকালে আমাকে অবশ্যই কাজে যেতে হবে।”
“আমি সুন্দরের জন্যে মরিতে পারি, মরিতে পারি সত্যের জন্য, একটা কবিতার লাইন আওড়ালো নিম। “প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন কিছু হিনি থাকে যার জন্যে সে জীবনও দিতে পারে। আমি এ জীবনে এমন কোনো প্রাণীর দেখা পাই নি যে অপ্রয়োজনীয় একটা কাজে ঐ জঘন্য এডিসনে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে আগ্রহী!”
“এখন কিন্তু তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।”
“মোটেই না, চামড়ার জ্যাকেট আর সিল্কের স্কাটা খুলে ফেললো নিম। জ্যাকেটের ভেতরে লাল টকটকে একটি সোয়েটার পরা, দেখতে দারুণ লাগছে তাকে। হাত-পা ছড়িয়ে বসলো এবার। “তবে রহস্যময় কোনো আগন্তুক যদি ফাঁকা ইউএন ভবনে আমাকে অনুসরণ করে চলে আসে তাহলে আমি আরেকটু বেশি মনোযোগ দেবো। বিশেষ করে তার সতর্ক করে দেবার পর পরই যদি কিছু মানুষ খুন হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।”
“সোলারিন কেন আমাকে বেছে নিয়েছে বলে মনে করো তুমি?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
“আমি তো ভেবেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছ থেকেই পাবো, শেরিতে চুমুক দিয়ে ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকালো সে।
“স্পেনে যে সিক্রেট ফর্মুলার কথা সে বলেছিলো সেটার ব্যাপারে কি বলবে?” বললাম তাকে।
“এটা হলো লাল টকটকে একটি হেরিং মাছ,” ঠাট্টা করে নিম বললো। “গাণিতিক খেলার ব্যাপারে সোলারিন একজন ম্যানিয়াক হিসেবে পরিচিত। নাইট টুরের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে সে, সেটা নিয়েই বাজি ধরে, কেউ যদি তাকে হারাতে পারে তাহলে সেটা নাকি তাকে দিয়ে দেবে। তুমি কি নাইট টুর সম্পর্কে কিছু জানো?” আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বললো নিম। মাথা নেড়ে জানালাম আমি জানি না।
“এটি একটি গাণিতিক ধাঁধা। নাইটের সাধারণ নিয়ম মেনেই দাবাবোর্ডে কোনো বর্গে একবারের বেশি ল্যান্ড না করিয়ে সবগুলো বর্গে নাইটকে ঘুরিয়ে আনা। বহুকাল আগে থেকেই গণিতবিদেরা একটা ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করে গেছেন এটা করার জন্য। ইউলার এরকম একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন। পরে করেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। একটি ক্লোজ টুর মানে যে বর্গ থেকে তুমি শুরু করেছিলে সেখানে এসেই থামা।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওভেনের সামনে চলে গেলো নিম। স্টোভের উপর কিছু পাত্র আর প্যান রাখতে রাখতে কথা বললো সে।
“স্পেনে ইতালিয়ান সাংবাদিকেরা মনে করেছিলো নাইট টুর নিয়ে আরেকটা ফর্মুলা সোলারিন নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছে। অনেক স্তর আর অর্থের সাথে খেলতে পছন্দ করে সোলারিন। ভালো করেই জানে সে যেহেতু একজন পদার্থবিদ সংবাদপত্রগুলো তা লুফে নেবেই।”
“ঠিক। সে একজন পদার্থবিদ,” স্টোভের কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসে বললাম আমি। সঙ্গে করে শেরি মদের বোতলটাও নিয়ে এলাম। তার কাছে যে ফর্মুলাটি আছে সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না-ই হয়ে থাকে তাহলে রাশিয়ানরা তাকে স্পেন থেকে তড়িঘড়ি তুলে নিয়ে গেলো কেন?”
“পাপারাজ্জি হলে তুমি খুব ভালো করতে,” বললো নিম। “ঠিক এটাই ছিলো তাদের যুক্তি। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সোলারিন অ্যাকুস্টিক্স পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি নিয়েছিলো। এটা রহস্যময়, অজনপ্রিয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার সাথে একদম সম্পর্কহীন। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে কোনো ডিগ্রি পর্যন্ত দেয়া হয় না। সম্ভবত রাশিয়াতে সে মিউজিক হল ডিজাইন করে, যদি তারা সেরকম কিছু বানাতে চায় তো।”
প্যান্ট্রি থেকে একগাদা শাকসজি আর মাংস নিয়ে স্টোভের কাছে ফিরে এলো নিম।
“তোমার ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার কোনো দাগ দেখি নি,” বললাম আমি। “কয়েক দিনের মধ্যে কিন্তু নতুন করে তুষারপাতও হয় নি। তাহলে টাটকা স্পিনাচ আর মাশরুম এলো কোত্থেকে?”
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো নিম, যেনো আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। “তোমার ইনভেস্টিগেশন করার ভালো যোগ্যতা আছে।” সিঙ্কে শাকসজিগুলো রেখে ধুতে শুরু করলো সে। “আমার একজন কেয়ারটেকার আছে, শপিংয়ের কাজটা সে-ই করে। লোকটা আসা যাওয়া করে পেছনের একটা দরজা দিয়ে।”
প্যাকেট থেকে রাইয়ের পাউরুটি আর মাখন বের করলো নিম। বড় একটা ইসে মাখন মেখে তুলে দিলো আমার হাতে। সকালের নাস্তা পুরো শেষ করি নি, লাঞ্চও করা হয় নি সুতরাং আমার কাছে এটা দারুণ সুস্বাদু লাগলো। আর ডিনারের কথা কী বলবো। সেটার কোনো জুড়ি নেই। খাওয়া শেষে আমরা দু’জনে মিলে ডিশগুলো ধুয়ে মুছে রেখে দিলাম। নিম কফি নিয়ে এলো আমার জন্য। এবার আমরা বসলাম ফায়ারপ্লেসের কাছে দুটো চেয়ারে। অন্য একটা চেয়ারে রাখা জ্যাকেটের পকেট থেকে গণকের কথা লেখা ককটেইল রুমালটা নিয়ে এলো সে। দীর্ঘ সময় ধরে ওটা পড়ে গেলো একমনে। পড়া শেষ করে। রুমালটা আমাকে দিয়ে উঠে গেলো ফায়ারপ্লেসের আগুন বাড়িয়ে দেবার জন্য।
“এই কবিতায় বেখাপ্পা এমন কি আছে যা তোমার চোখে পড়েছে?” জানতে চাইলো সে। আমি লেখাটার দিকে তাকালাম, বেখাপ্পা কিছু চোখে পড়লো না।
“তুমি নিশ্চয় জানো চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন হলো আমার জন্মদিন,” বললাম তাকে। মাথা নেড়ে সায় দিলো নিম। ছায়ারপ্লেসের আগুন বেড়ে গেলো এখন।
গণক আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলো এ কথাটা যেনো কাউকে না বলি।
যথারীতি তুমি তোমার কথা রেখেছে, ফায়ারপ্লেসে কিছু কাঠ রাখতে রাখতে বললো নিম। এককোণে থাকা একটি টেবিলের কাছে গিয়ে কাগজ আর কলম নিয়ে ফিরে এলো আমার কাছে।
“এটা দেখো,” বললো সে। বড় বড় করে ক্যাপিটাল লেটারে কিছু লেখা। কবিতাটা কপি করেছে সে আলাদা আলাদা লাইনে। আগে এটা বিক্ষিপ্তভাবে ককটেইল রুমালে লেখা ছিলো। কবিতাটি এরকম:
এইসব লাইনগুলোর মতোই এটা একত্রিত হয়ে একটা চাবির আকার ধারণ করবে।
দাবার বর্গের মতো, যখন মাস আর থাকবে চারের ঘরে।
চেক হওয়া রাজাকে সরাতে আরেকটা সুযোগ নেবার ঝুঁকি নিও না।
একটা খেলা রূপকার্ধে আর অন্যটি বাস্তবিক।
অকথিত সময়ের এই প্রজ্ঞা এসেছে বিলম্বে।
সাদার যুদ্ধ চলেছে বিরামহীন।
সর্বত্রই কালো তার ভাগ্য নিশ্চিত করতে মরিয়া হবে।
অব্যাহত রাখো তেত্রিশ আর তিনের অনুসন্ধান।
চিরন্তন আড়াল হলো গোপন দরজা।
“তুমি এখানে কি দেখছো?” আমি কাগজে লেখা তার কবিতাটা যখন পড়ছি তখন জানতে চাইলো নিম।
“কবিতাটার গঠনের দিকে একটু খেয়াল করো,” কিছুটা অধৈর্য হয়ে বললো সে। “তোমার কিন্তু গণিতের মাথা, সেটা একটু ব্যবহার করো।”
কবিতাটা ভালো করে আবারো পড়ে জিনিসটা ধরতে পারলাম।
“ছন্দের ধরণটা অদ্ভুত,” গর্বিতভাবেই বললাম তাকে।
ভুরু কুচকে ফেললো নিম। আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কবিতাটা পড়েই হেসে ফেললো সে। “তাই তো,” আমার কাছে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো। “আমি অবশ্য এটা ধরতে পারি নি। কলমটা নিয়ে এটা লেখো।”
আমি তাই করলাম :
Key-Four-Mate (A-B-C),
Metaphor-Late-Endlessly (B-C-A),
Fate-Three-Door (C-A-B)
“তাহলে ছন্দের ধরণটা এরকম,” বললো নিম। আমার লেখার নীচে কলি করলো সেটা। “এবার অক্ষরের বদলে সংখ্যা ব্যবহার করে সেগুলো যোগ করো।” ও যেখানে অক্ষরগুলো লিখেছে তার পাশে আমি সংখ্যাগুলো লিখে যোগ করলাম :
ABC ১২৩
BCA ২৩১
CAB ৩১২
মোট ৬৬৬
“এটা তো অ্যাপোক্যালিপসে বর্ণিত সেই প্রাণীটার সংখ্যা : ৬৬৬!” আমি বললাম।
“সেটাই,” বললো নিম। “তুমি যদি প্রতি রো-এর সংখ্যাগুলো পাশাপাশিও যোগ করো একই যোগফল পাবে। এটাকে কি বলে জানো, মাই ডিয়ার?…এটাকে বলে ম্যাজিক স্কয়ার’। আরেকটা গাণিতিক খেলা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যে ক’টা নাইট টুর ডেভেলপ করিছলেন তার মধ্যে সিক্রেট ম্যাজিকস্কয়ার লুক্কায়িত ছিলো। এ ব্যাপারে তোমার বেশ ভালো আগ্রহই আছে। তুমি প্রথম দেখাতেই এরকম একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছে যা আমি নিজেও দেখতে পাই নি।”
“তুমি দেখতে পাও নি?” মনে মনে একটু খুশিই হলাম। “তাহলে তুমি আমাকে কি খুঁজতে বলেছিলে?” আবারো কাগজটা পড়ে দেখলাম ওখানে আরো কিছু বিষয় লুকিয়ে আছে কিনা।
“শেষ দুটো লাইন বাদে প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষরটা খেয়াল করো, বললো নিম।
কবিতাটির দিকে চোখ বুলাতেই আমার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
“কি হয়েছে?” আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বললো নিম। কাগজটার দিকে নির্বাক চেয়ে রইলাম। তারপর আস্তে করে কলমটা নিয়ে লিখলাম সেটা।
“J-A-D-0-U-B-E/C-V।”
“অবশ্যই, নিমের পাশে মূর্তির মতো বসে পড়লে সে বললো, Jadoube, এই ফরাসি দাবা টার্মটির মানে হলো আমি স্পর্শ করি, আমি ঠিক করি। সোজা ভাষায় বললে স্পর্শ করে ঠিক করা। বেলার মাঝখানে দাবা খেলোয়াড় যদি তার কোনো খুঁটির অবস্থান বদলাতে চায় তাহলে এটা বলে সে। আর C.V. অক্ষর দুটো তোমার নামের আদ্যাক্ষর। তার মানে ঐ গণক তোমাকে একটা মেসেজ দিয়েছে। সে হয়তো তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। আমি বুঝতে পারছি…কিসের জন্যে তোমাকে এতোটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে,” বললো সে।
“তুমি বুঝতে পারছো না,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম তাকে। “ফিস্ক মারা যাবার আগে জনসম্মুখে শেষ যে কথাটা বলেছিলো সেটা হলো Jadotube।”
.
বলার দরকার নেই রাতে আমার দুঃস্বপ্ন হলো। একটা খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমি বাইসাইকেল আরোহীকে অনুসরণ করছি। চারপাশে ভবনগুলো এতোটাই কাছাকাছি যে আকাশ দেখতে পাচ্ছি না। পথটা আরো সরু হতে শুরু করলো, অন্ধকার বাড়তে লাগলো ক্রমশ। প্রতিটি মোড়ে এসেই আমি বাইসাইকেলটা হারিয়ে ফেলছি, দেখতে পাচ্ছি অন্য একটা খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ওটা ছুটে চলেছে। অবশেষে একটা কানাগলিতে তাকে কোণঠাসা করে ফেললাম। মাকড়। যেমন তার জালে শিকার ধরার জন্য অপেক্ষায় থাকে লোকটা ঠিক সেভাবে আমার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ঘুরে লোকটা তার মুখ থেকে মাফলারটা সরিয়ে ফেলতেই দেখতে পেলাম একটা নরকঙ্কালের মুণ্ড, চোখের কোটর একেবারে ফাঁকা। আমার চোখের সামনে সেই কঙ্কাল মুখটায় মাংস জন্মাতে শুরু করলো, শেষপর্যন্ত যে চেহারাটা ফুটে উঠলো সেটা ঐ মহিলা গণকের।
ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারলাম ঘেমেটেমে একাকার, বিছানায় উঠে বসলাম। সারা শরীর কাঁপছে। আমার ঘরে যে ফায়ারপ্লেসটা আছে তাতে এখনও নিভু নিভু করে আগুন জ্বলছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে নীচের তুষারাবৃত লনটা দেখতে পেলাম। সেটার মাঝখানে ফোয়ারার মতো বিশাল মার্বেলের একটি বেসিন, সেটার নীচে একটি সুইমিংপুল। লনটার পরেই আছে সমুদ্র। সকালের আলোয় সেটা ধূসর রঙের দেখাচ্ছে।
আগের দিন কি হয়েছিলো সেটা পুরোপুরি মনে করতে পারলাম না। নিম আমাকে অনেক বেশি মদ দিয়েছিলো। এখন মাথা ধরে আছে। পা টেনে টেনে বাথরুমে গিয়ে গরম পানির ট্যাপটা ছেড়ে বাথটাবে কিছু বাবলবাথ দিয়ে ফেনা তৈরি করে ওটাতে সারা শরীর এলিয়ে দিলাম। সাবানের গন্ধটা ভালো লাগলো না আমার কাছে। বাথটাবে শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিলো সেগুলো একটু একটু করে মনে পড়তে লাগলো, ফলে আবারো সুতীব্র ভীতি জেঁকে বসলো আমার মধ্যে।
আমার শোবার ঘরের দরজার বাইরে কিছু জামা-কাপড় রাখা : উলের সোয়েটার আর হলুদ রঙের রাবারবুট। সেগুলো পরে নিলাম। নীচের তলায় নামার সময়ই আমার নাকে চমৎকার গন্ধ এসে লাগলো। এরইমধ্যে নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে।
স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিম, মোটা কাপড়ের শার্ট, জিন্স আর ঠিক আমারই মতোন হলুদ রঙের বুট পরে আছে সে।
“আমি আমার অফিসে কিভাবে ফোন করতে পারি?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
“এখানে তো কোনো ফোন নেই,” পেছন ফিরে বললো সে। “তবে আজ সকালে আমার কেয়ারটেকার কালোস যখন সবকিছু পরিস্কার করতে এসেছিলো। তখন তাকে বলে দিয়েছি তোমার অফিসে ফোন করে যেনো বলে দেয় আজ তুমি আসতে পারবে না। আজ দুপুরে তোমাকে আমি নিজে গাড়িতে করে শহরে। পৌঁছে দিয়ে আসবো, সেইসাথে তোমার অ্যাপার্টমেন্টটা কিভাবে আরো সুরক্ষিত করা যায় সেটাও দেখিয়ে দেবো। এইফাঁকে চলো ভালো কিছু খাওয়াদাওয়া করি, পাখি দেখি। এখানে একটা পক্ষিশালা আছে, বুঝলে।”
মদ মিশিয়ে ডিম পোচ, কানাডিয়ান বেকন, আলু ভাজা আর কফি বানিয়ে রেখেছে নিম। নাস্তার সময় খুব কমই কথাবার্তা হলো আমাদের মধ্যে। এরপর ফ্রেঞ্চ জানালা খুলে নিমের এস্টেটটা দেখলাম।
প্রায় একশ’ গজ দূরেই সমুদ্রতীর। পুরোটাই ভোলা, শুধু একদিকে উঁচু হেজের বেড়া দেয়া। ডিম্বাকৃতির ফোরার বেসিন আর সেটার নীচে যে সুইমিংপুলটা আছে তাতে এখনও কিছু পানি দেখা যাচ্ছে।
বাড়ি সংলগ্ন বিশাল একটি পক্ষিশালা আছে, মোটা তারে তৈরি এই পক্ষিশালাটির একটা গম্বুজও আছে, তারগুলোতে সাদা রঙ করা। বাইরের তুষার তারের জাল ভেদ করে ভেতরের ছোটো ছোটো গাছগুলোর উপর পড়েছে। গাছের শাখা-প্রশাখায় ওড়াওড়ি করছে নানান ধরণের পাখি। বিশাল আকারের বেশ কয়েকটি ময়ূর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মনে হলো কোনো মেয়েকে ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে বুঝি। একেবারে নার্ভে আঘাত করে সেটা।
পক্ষিশালার দরজা খুলে নিম আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বিভিন্ন জাতের পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমাকে।
“পাখিরা প্রায়শই মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, আমাকে বললো সে। আমি এখানে ফ্যালকনও রেখেছি, তবে অন্য একটি জায়গায়। কালোস তাদেরকে দিনে দু’বার মাংস খাওয়ায়। তাদের মধ্যে পেরিগ্রিন আমার সবচাইতে প্রিয়। অন্য অনেক প্রাণীর মতোই পাখিদের মধ্যে স্ত্রী পাখিগুলোই শিকারের কাজ করে থাকে।”
“তাই নাকি?” আমি এটা জানতাম না।
“আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো নিম, “তোমার মধ্যে কিলার ইন্সটিংক্ট রয়েছে।”
“আমার মধ্যে? ঠাট্টা করছো?”
“সেটার যথাযথ প্রকাশ ঘটে নি এখনও,” সে বললো। “তবে সেটা জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করছি আমি। আমার মতে, এটা তোমার ভেতরে পুরোপুরি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।”
“কিন্তু আমাকেই লোকজন খুন করার চেষ্টা করছে, তাকে মনে করিয়ে দিলাম।
“যেকোনো খেলার মতোই,” আমার দিকে আবারো তাকালো নিম, গ্লাভ পরা হাতে আমার চুল স্পর্শ করলো সে, “তোমাকে বেছে নিতে হবে তুমি রক্ষণাত্মক খেলবে নাকি আক্রমনাত্মক খেলবে। আমি অবশ্য পরেরটার কথাই বলবো। তুমি কেন তোমার প্রতিপক্ষকে পাল্টা হুমকি দিচ্ছো না?”
“আমি তো জানিই না আমার প্রতিপক্ষ কে!” একেবারে উদভ্রান্ত হয়ে বললাম।
“আহ, তুমি কিন্তু জানো, রহস্যময়ভাবে জবাব দিলো নিম। “প্রথম থেকেই তুমি জানতে। আমি কি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাবো এটা?”
“দেখাও।” পক্ষিশালা থেকে আমরা বের হয়ে ফিরে এলাম বাড়ির ভেতরে।
কোট খুলে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসলাম। আমার পা থেকে বুট জোড়া খুলে রাখলো নিম। তারপর দেয়াল থেকে আমার আঁকা বাইসাইকেল আরোহীর। পেইন্টিংটা খুলে আমার কাছে নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলো।
“কাল রাতে তুমি ঘুমাতে যাবার পর,” বললো নিম, “এই পেইন্টিংটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। আমার মধ্যে দেজা-ভু অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো। দেজা-ভুর অর্থ তো জানোই, মানে আগে দেখেছি বলে মনে হওয়া, আমি হ্যাঁ-না বলার আগেই সে বলে ফেললো। “এটা আমার মধ্যে একটা খচখচানি তৈরি করলো। তুমি তো জানোই সমস্যাটা নিয়ে কতোটা ভেবেছি। আজ সকালেই সেটা সমাধান করতে পেরেছি আমি।”
ওভেনের পাশে একটা কাঠের কাউন্টারের কাছে গেলো সে, একটা ড্রয়ার থেকে কয়েক পেটি খেলার তাস নিয়ে চলে এলো আমার কাছে। প্রতিটি পেটি থেকে জোকার বের করে টেবিলের উপর রাখলো। আমার সামনে রাখা তাসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
একটা জোকারের মাথায় ক্যাপ পর, হাতে বেল, বসে আছে সাইকেলের উপর। সে ঠিক আমার আঁকা পেইন্টিংটার মতোই পোজ দিয়ে আছে। তার সাইকেলের পেছনে একটা কবরের ফলক, তাতে লেখা আছে আর.আই.পি। দ্বিতীয় তাসের ছবিটাতেও একই জোকার, তবে আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া দুটো ছবি। আমার ছবিটার মতোই তবে এখানে সাইকেলের উপর উল্টো করে বসে আছে একটি কঙ্কাল। তৃতীয়টা টারোট কার্ডের একটি বোকা, হাসিখুশি মেজাজে একটা খাদের উপর থেকে লাফ দিতে উদ্যত।
নিমের দিকে তাকাতেই সে হেসে ফেললো।
“তাসের যে জোকারটা আছে সেটা ঐতিহ্যগতভাবেই মৃত্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট,” বললো সে। “তবে এটা পুণর্জন্মেরও প্রতীক, এবং পতিত হবার আগে মানবজাতির নিষ্কলুষতার। আমি তাকে হলি গ্রেইলের নাইট বলে ভাবতে পছন্দ করি। যাকে সহজ-সরল আর অপরিপক্ক হতে হবে, যে সৌভাগ্য সে খুঁজে বেড়াচ্ছে আচমকা সেটার মুখোমুখি হবার জন্য। মনে রেখো, তার মিশন হলো মানবজাতিকে রক্ষা করা।”
“তো?” বললাম আমি, যদিও আমার সামনে যে কার্ডগুলো রাখা আছে তার সাথে আমার আঁকা ছবিটার মিল দেখতে পেয়ে খানিকটা ভড়কে আছি। এখন সাইকেলে চড়া লোকটার অবিকল ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছি আমি।
“তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমার প্রতিপক্ষ কে,” খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো নিম। “আমার মনে হয় এই কার্ডগুলো আর তোমার পেইন্টিংয়ের সাইকেল আরোহী একই সাথে তোমার প্রতিপক্ষ এবং মিত্র।”
“তুমি সত্যিকারের কোনো লোকের কথা নিশ্চয় বলছো না?”
নিম ধীরে ধীরে মাথা দোলালো। “তুমি তো তাকে দেখেছোই, তাই না?”
“কিন্তু সেটা নিছকই কাকতালীয় ঘটনা।”
“হয়তো,” একমত পোষণ করলো সে। “কাকতালীয় ব্যাপারগুলো অনেক ধরণের হতে পারে। একটার কথা বলি, তোমার পেইন্টিংটা সম্পর্কে অবগত আছে এরকম কেউ প্রলুব্ধও করতে পারে তোমাকে। অথবা এটা অন্য কোনো ধরণের কাকতালীয় ঘটনা,” হেসে বললো সে।
“ওহ্ না,” এরপর কি বলবে সেটা বুঝতে পেরে বললাম আমি। “তুমি ভালো করেই জানো আমি ভবিষ্যত দেখা আর সাইকিক ক্ষমতার মতো আজগুবি জিনিসে বিশ্বাস করি না।”
“করো না?” হাসতে হাসতেই বললো নিম। “তুমি এইসব কার্ড না দেখেই যেভাবে ছবিটা এঁকেছো তাতে করে বাধ্য হয়ে আমাকে অন্য একটা ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। তোমার কাছে আমি একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই। তোমার বন্ধ লিউলিন, লোলানি আর ঐ গণকের মতো আমিও মনে করি মণ্ডগেইন সার্ভিসের রহস্যের সাথে তোমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে তোমার জড়িত হবার ব্যাপারে? হতে পারে নিয়তি তোমাকে আগে থেকেই মনোনীত করে রেখেছে প্রধান ভূমিকা পালন-”
“ভুলে যাও এটা,” ঝট করে বললাম। আমি এই রূপকথার দাবা সেটের পেছনে ছুটছি না! লোকজন আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে, কিংবা নিদেনপক্ষে আমাকে হত্যাকাণ্ডে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে, এটা কি তুমি বুঝতে পারছে না?” প্রায় চিৎকার করেই বললাম কথাটা।
“অবশ্যই বুঝতে পেরেছি,” বললো নিম। কিন্তু তুমি একটা বিষয় মিস করে গেছে। সেরা রক্ষণাত্মক কৌশল হলো সবচাইতে ভালো আক্রমণ।”
“কোনোভাবেই না, তাকে বললাম। “এটা নিশ্চিত তুমি আমাকে বলির পাঠা বানানোর ধান্দা করছো। তুমি ঐ দাবাবোর্ডটি পেতে চাও, সেজন্যে আমাকে ব্যবহার করতে চাইছে। ইতিমধ্যেই এটা আমার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে, এই নিউইয়র্ক শহরেই। যেখানে আমি কাউকে চিনি না, জানি না, কাউকে সাহায্যের জন্যে পাবো না সেই বিদেশ বিভূইয়ে গিয়ে এইসব ফালতু জিনিস খুঁজে বেড়াবো না। হয়তো তুমি একঘেয়েমীতে আক্রান্ত হয়ে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে মেতে থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু একবারও ভাবছো না ওখানে আমি সমস্যায় পড়লে কি হবে? তোমার তো কোনো ফোন নাম্বারও নেই যে কল করে সাহায্য চাইবো। হয়তো ভাবছো এরপর আমি গুলি খেলে তোমার ঐ কারমেলাইট নানেরা এসে আমার সেবা করবে? কিংবা নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এসে মৃতদেহ কুড়াতে শুরু করে দেবে?”
“হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয় না,” বললো নিম। সে সব সময়ই শান্ত থাকে। “কোনো মহাদেশেই আমার কন্ট্যাক্ট নেই এ কথাটা সত্য নয়, অবশ্য তুমি এটা জানো না কারণ এতোটাই ব্যস্ত যে এই ইসুটা এড়িয়ে যাচ্ছো। তুমি আমাকে ঐ তিন বানরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো, যারা নিজেদের চোখ-কান বন্ধ রেখে শয়তানের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করে।”
“আলজেরিয়াতে আমেরিকার কোনো দূতাবাস পর্যন্ত নেই,” দাঁতে দাঁত পিষে বললাম। “সম্ভবত রাশিয়ান অ্যাম্বাসিতে তোমার কন্ট্যাক্ট আছে, তারা অবশ্য খুশিমনেই আমাকে সাহায্য করতে চাইবে?” সত্যি বলতে এটা পুরোপুরি অসম্ভবও নয়, কারণ নিম আংশিক রাশিয়ান এবং গ্রিক। তবে আমি যতোটুকু জানি তার পূর্বপুরুষের দেশ দুটোতে কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে তার কোনো যোগাযোগই নেই।
“সত্যি বলতে কি, তুমি যে দেশে যাচ্ছে সেখানকার কিছু অ্যাম্বাসিতে আমার কন্ট্যাক্ট আছে,” একটু ঠাট্টাচ্ছলেই বললো কথাটা। “তবে সে কথায়, আসছি। তুমি আমার সাথে একমত হবে যে, পছন্দ করো আর না করোক এই ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছে। এই হলিগ্রেইল অশেষ মারাত্মক হয়ে উঠেছে। এর হাত থেকে বাঁচার মতো কোনো শক্তি তোমার ক নেই যদি না তুমি আগেভাগে এটায় জড়িয়ে পড়ো।”
“আমাকে পার্সিফল বলে ডাকো,” তিক্তভাবে বললাম আমি। “তোমার কাছে সাহায্য চাইবার আগে আমার আরো ভালো করে ভেবে দেখা উচিত ছিলো। সমস্যা সমাধানের বেলায় তোমার পদ্ধতিগুলো সব সময় এরকমই হয়।”
নিম উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে টেনে দাঁড় করালো। চোখে চোখ রাখলে আমার। তার ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি। আমার কাঁধে দু’হাত রাখলো সে।
“J’adoube,” বললো সে।