নাইটের চাকা

নাইটের চাকা

কিং আর্থার চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্নটা এরকম : তিনি বসে আছেন এমন এক সিংহাসনে যার নীচে চাকা লাগানো আছে, তার গায়ে মহামূল্যবান স্বর্ণখচিত পোশাক…হঠাৎ করে রাজার মনে হলো তার সিংহাসনের চাকা উল্টে যাচ্ছে, তিনি পড়ে গেলেন অসংখ্য বিষাক্ত সাপের মাঝখানে, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সাপগুলো নিজের বিছানায়, ঘুমের মধ্যেই রাজা চিৎকার করে উঠলেন, “বাঁচাও!”

-লে মর্তে দার্থার
স্যার টমাস ম্যালোরি

রিগনাবো, রেগননা, রেগনাভি, সাম সাইন রেগনো।
(আমি রাজত্ব করবো, আমি রাজত্ব করি, আমি রাজত্ব করেছি, আমি রাজত্ববিহীন)।
–হুইল অব ফরচুন-এ খোদিত বাণী
দ্য টারোট

দাবা টুর্নামেন্টের পরদিনটি ছিলো সোমবার। গা ঝাড়া দিয়ে আলস্য দূর করে বিছানা থেকে উঠে চলে গেলাম গোসল করতে। কন এডিসনে আরেকটা দিন অতিবাহিত করার প্রস্তুতি নিতে হবে। গোসল করে ফিরে এসে ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্রের মাঝখানে টেলিফোনটা খুঁজলাম। গতকাল পাম হোটেলে ডিনার করার আগে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে লিলি আর আমি অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমরা দু’জন অন্য কারোর খেলায় দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। এখন নিজের বোর্ডে ক্ষমতাশালী কোনো খুঁটি পেতে চাচ্ছি আমি। ভালো করেই জানি কোত্থেকে আমাকে শুরু করতে হবে।

লিলি আর আমি একমত পোষণ করেছি, আমাকে দেয়া সোলারিনের সতর্কবার্তার সাথে দাবা টুর্নামেন্টের ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। তবে এরপর যা হয়েছে তা নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। লিলির দৃঢ় বিশ্বাস যা কিছুই ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে সোলারিন।

“প্রথমে ফিস্ক মারা গেলেন রহস্যজনকভাবে,” চারপাশে পাম গাছে ঘেরা একটা কাঠের টেবিলে বসে বলেছিলো লিলি। “কিভাবে বুঝবো সোলারিন তাকে হত্যা করে নি? এরপর সল উধাও হয়ে গেলো আমার গাড়ি আর কুকুরটাকে দুষ্কৃতিকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সলকে অবশ্যই অপহরণ করা হয়েছে, তা না হলে সে কখনও এভাবে গাড়ি ফেলে রেখে যেতো না।”

“তা অবশ্য ঠিক, লিলিকে বিশাল এক টুকরো মাংস সাবাড় করতে দেখে হেসে বললাম কথাটা। আমিও জানি বিরাট কোনো ঘটনা না ঘটলে সল এভাবে গাড়ি ফেলে রেখে যেতো না।

খাবার খেতে খেতে লিলি বলতে লাগলো, “তারপর আমাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লো,” আবারো বিরতি দিলো মাংসে কামড় বসানোর জন্যে। “আমরা দু’জনেই জানি গেমিংরুমের জানালা দিয়ে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছে।”

“গাড়িতে দুটো বুলেটের ফুটো ছিলো, তাকে মনে করিয়ে দিলাম। “আমরা গাড়ির কাছে চলে আসার আগে হয়তো কেউ গুলি ছুঁড়ে সলকে ভয় দেখিয়ে গাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য করেছে।”

“কিন্তু আগে ভালো করে খেয়ে নেই,” বললো লিলি। তার মুখভর্তি খাবার। “আমি শুধু পদ্ধতি আর মাধ্যমই আবিষ্কার করি নি, বরং এর উদ্দেশ্যটাও বের করে ফেলেছি!”

“তুমি কী বলছো?”

“আমি জানি সোলারিন কেন এই জঘন্য কাজটা করেছে। গরুর মাংস আর সালাদ খেতে খেতে এটা আমি বের করেছি এখন।”

“শুধু বললে তো হবে না, আমাকে কু দাও,” বললাম তাকে। ক্যারিওকা লিলির ব্যাগের ভেতর থেকে ধারালো নখ দিয়ে খামচাচ্ছে।

“তুমি নিশ্চয় স্পেনের কেলেংকারিটার কথা জানো?” বললো লিলি।

“পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করে সোলারিনকে যখন রাশিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হলো তার কথা বলছো?” সে সায় দিলো আমার কথায়। “তোমার কাছ থেকেই তো এটা শুনেছিলাম।”

“পুরো ঘটনাটি ঘটেছিলো একটা ফর্মুলা নিয়ে,” বললো লিলি। “সোলারিনকে দাবা টুর্নামেন্টের মাঝপথে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মাঝেমধ্যে সে টুর্নামেন্টে খেলে থাকে। একজন গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও পড়াশোনা করেছে পদার্থ বিজ্ঞানে, এটাই তার পেশা। স্পেনের টুনামেন্টে অন্য এক খেলোয়াড়ের সাথে সোলারিন বাজি ধরেছিলো, সে যদি তাকে টুর্নামেন্টে হারাতে পারে তাহলে তাকে একটি সিক্রেট ফর্মুলা দেবে।”

“কিসের ফর্মুলা?”

“আমি জানি না। কিন্তু তার এই বাজির কথাটা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গেলে রাশিয়ানরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এক রাতের মধ্যেই সে উধাও হয়ে যায়। তারপর থেকে ক’দিন আগে এখানে আসার আগপর্যন্ত তার টিকিটাও দেখা যায় নি।”

“এটা কি পদার্থ বিদ্যার কোনো ফর্মুলা?” জানতে চাইলাম আমি।

“সম্ভবত এটা কোনো গোপন অস্ত্রের ফর্মুলা। এটাই সব কিছুর সাথে খাপ খায়, তাই না?” আমি অবশ্য কোনো কিছু খাপ খেতে দেখছি না। তবে তাকে বকবকানি করতে দিলাম।

“এই টুর্নামেন্টেও সোলারিন ঠিক আগের মতোই হয়তো বাজি ধরবে এই ভয়ে ফিস্ককে সরিয়ে দিয়েছে কেজিবি, তারপর আমাকেও ভয় পাইয়ে দেবার জন্য গুলি করেছে তারা। ফিস্ক আর আমি, যেকোনো একজন যদি সোলারিনের সাথে খেলায় জিতে যাই তাহলে সে আমাদের ফর্মুলাটা দিয়ে দেবে!” লিলি নিজের ধারণায় নিজেই রোমাঞ্চিত কিন্তু আমি তাতে পটলাম না।

“এটা দারুণ একটা তত্ত্বই বটে,” বললাম তাকে। তবে কিছু ফাঁক রয়ে গেছে এতে। যেমন, সলের কি হলো? সোলারিন আবারো ঐ একই কাজ করবে। এই সন্দেহটা যদি রাশিয়ানদের থেকেই থাকে তাহলে তাকে কেন দেশের বাইরে পাঠালো তারা? আর সোলারিনই বা কেন ফিস্ক এবং তোমাকে ফর্মুলাটা দিতে। চাইবে?”

“ঠিক আছে, সব কিছু পুরোপুরি খাপ খাচ্ছে না মানছি,” স্বীকার করলো সে। “তবে শুরু তো করা গেলো।”

 “শার্লোক হোমস একবার বলেছিলো, পর্যাপ্ত তথ্য হাতে আসার আগে কোনো তত্ত্ব দাঁড় করানোটা মারাত্মক ভুল, “ তাকে বললাম। “আমি বলি কি, সোলারিনের ব্যাপারে আগাগোড়া একটু স্টাডি করে দেখলে ভালো হয়। তবে। এখনও মনে করছি আমাদের উচিত পুলিশকে সব খুলে বলা। মনে রেখো আমাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বুলেটের দুটো ফুটো আছে।”

“কখনও না,” বিরক্ত হয়ে বললো লিলি, “আমরা দু’জনে মিলেই এই রহস্যটার সমাধান করবো। স্ট্র্যাটেজি হলো আমার আরেক নাম।”

তো অনেক বাকবিতণ্ডা আর গরম গরম মাংস ভুনা খেতে খেতে অবশেষে আমরা দুজন একমত পোষণ করলাম, কয়েক দিনের জন্য আলাদা আলাদাভাবে গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিনের উপর কিছুটা রিসার্চ করবো, তারপর ঠিক করবো আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।

লিলির কোচ নিজেও একজন গ্র্যান্ডমাস্টার। মঙ্গলবার লিলির খেলা আছে, তার আগে প্রচুর প্র্যাকটিস করার কথা, যদিও সে ভাবছে ট্রেইনিংয়ের সময় সে সোলারিনের উপলব্ধি সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে। এরমধ্যে সলকেও খুঁজবে সে। সল যদি অপহৃত হয়ে না থাকে তাহলে তার খবর আছে। লিলির কাছে তাকে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে এভাবে গাড়ি ফেলে চলে যাওয়ার জন্যে।

আমার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা আছে তবে আমি সেটা লিলি র‍্যাডের সাথে শেয়ার করি নি তখন।

ম্যানহাটনে আমার এমন একজন বন্ধু আছে যে সোলারিনের চেয়েও বেশি রহস্যময়। কোনো ফোনবুকে তার নাম নেই, নেই কোনো বাড়িঘরের ঠিকানা। ডাটা প্রসেসিং জগতে সে একজন কিংবদন্তী। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বই লিখে ফেলেছে। তিন বছর আগে যখন আমি নিউইয়র্কে চলে আসি তখন সে-ই আমাকে কম্পিউটারের ব্যাপারে সব কিছু শিখিয়েছিলো। এদিক থেকে সে আমার মেন্টর। অতীতে অনেক খারাপ পরিস্থিতি থেকে আমাকে উদ্ধার করেছে। নাম ব্যবহারের দরকার যখন পড়ে তখন নিজেকে উ. লাডিসলাউস নিম বলে পরিচয় দেয়।

নিম কেবল ডাটা প্রসেসিংয়েরই মাস্টার নয়, দাবা খেলায়ও রয়েছে তার। অসাধারণ দক্ষতা। বিশেভস্কি আর ববি ফিশারের সাথে খেলে তাদেরকে হারিয়েও দিয়েছে। তবে তার আসল এক্সপার্টিস হলো খেলাটার উপর অগাধ জ্ঞান। সে কারণেই তাকে খুঁজে বের করতে চাইছি আমি। ইতিহাসের প্রায় সব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা তার মুখস্ত। গ্র্যান্ডমাস্টারদের জীবনীর ব্যাপারে তাকে জ্বলজ্যান্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবার ইতিহাস বলে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে সে। আমরা যে ঘটনার মধ্যে পড়েছি সেটার রহস্য বের করা তার পক্ষে সম্ভব বলে মনে করি আমি। খালি একবার তার নাগাল পেলেই হয়।

কিন্তু তাকে পেতে চাওয়া আর খুঁজে বের করা একেবারে ভিন্ন দুটো কাজ। তার ফোনের এনসারিং সার্ভিসটি কেজিবি আর সিআইএ’কে নিয়ে নানান ধরণের গালগল্প ছড়িয়ে বেড়ায়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাকে খুঁজে যাচ্ছি আমি।

যখন থেকে জানতে পারলাম দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি তখন থেকেই তাকে গুডবাই বলার জন্যে হন্যে হয়ে ফোন করে যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। লিলির সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছে সেজন্যে তাকে খুঁজছি না এখন, তাকে খুঁজছি অন্য একটা কারণে। ফিস্কের মৃত্যু, সোলারিনের সতর্কবার্তা, সলের উধাও হয়ে যাওয়া-প্রতিটি ঘটনা আপাতত বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক আছে। আর সেগুলো আমার সাথেই সম্পর্কিত বলে মনে করছি আমি।

 আমার এরকম মনে করার কারণ, গতরাতে পাম রেস্টুরেন্ট থেকে লিলিকে বিদায় জানানোর পর থেকে ছোটোখাটো একটা রিসার্চ শুরু করি আমি। সরাসরি নিজের বাসায় ফিরে না এসে একটা ক্যাব নিয়ে ফিফথ এভিনু হোটেলে চলে যাই সেই গণকের খোঁজে যে তিনমাস আগে আমার হাত দেখে এমন একটা একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলো যার সাথে সোলারিনের সতর্কবার্তাটি একদম মিলে যায়। তাদের দু’জনের কথাটাকে আমি মোটেও কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে করছি না এখন। আমি জানতে চাই কেন এটা বলা হলো।

এজন্যেই নিমকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। ফিফথ এভিনু হোটেলে এসে তো আমি বোকা বনে গেলাম। এখানে নাকি কোনো গণক নেই। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। লোকটা পনেরো বছর ধরে ওখানে কাজ করে। বার বার আশ্বস্ত করে আমাকে বলেছে ফিফথ এভিনু হোটেলে কোনো কালেই কোনো গণক ছিলো না।

 হোটেল-বারেও নয়। এমনকি নিউইয়ার্স ইভের দিনেও নয়। যে মহিলা আনতো আমি এই হোটেলে আসবোই, এমনকি আমি যে প্যান অ্যাম-এর ডাটা সেন্টারে আছি সেটাও হ্যারিকে বলেছে, ভবিষ্যৎবাণী করেছে আমার হাত দেখে, সোলারিনের তিন মাস আগেই একই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে-এমন কি, যে মহিলা আমার জন্ম তারিখ পর্যন্ত জানতো-তার কোনো অস্তিত্বই নেই।

.

অবশ্যই তার অস্তিত্ব ছিলো। এটা প্রমাণ করার জন্যে আমার কাছে তিন তিনজন সাক্ষীও আছে। কিন্তু এখন এতো কিছু জানার পর নিজের চোখকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছি আমি।

 তো সোমবার সকালে আমি আমার ভেজা চুলে নিয়ে তোয়ালে গায়ে পেচিয়ে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বসলাম নিমকে খোঁজার আশায়। এবার আমি আরো বেশি অবাক হলাম।

তার এনসারিং সার্ভিসে ফোন করতেই নিউইয়র্ক টেলিফোন কোম্পানির একটা রেকর্ডিং মেসেজ শুনতে পেলাম। নিমের নাম্বারটা নাকি ব্রুকলিন এক্সচেঞ্জে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। সেই নতুন নাম্বারে ডায়াল করলাম। ভাবলাম, নিম এভাবে নাম্বার বদল করবে সেটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার। তার কারণ এই বিশ্বে যে তিনজনের কাছে তার পুরনো নাম্বারটা আছে তার মধ্যে আমি একজন। এতো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করার কোনো মানে বুঝি না।

নতুন নাম্বারটায় ফোন করে আবারো অবাক হলাম।

“রকাওয়ে প্রিন্স হল,” অপ্ররপ্রান্তে এক মহিলা বললো।

“আমি ড. নিমকে চাচ্ছিলাম।”

“আমাদের এখানে ড. নিম নামে কেউ থাকেন না, মিষ্টি করে বললো মহিলা। নিমের এনসারিং মেশিন সব সময়ই এরকম অস্বীকৃতি দিয়ে শুরু করে, তাই আমি একটু খুশিই হলাম। কিন্তু এরপর আবারো অবাক হবার পালা।

“ড. নিম। ড. লাডিসলাউস নিম,” আমি পরিস্কার করে বললাম। “ম্যানহাটনের ইনফর্মেশন সার্ভিস আমাকে এই নাম্বারটা দিয়েছে।”

“এটা কি কোনো পুরুষ মানুষের নাম?” জিজ্ঞেস করলো মহিলা। “হ্যাঁ,” কিছুটা অধৈর্য হয়ে বললাম। “আমি কি একটা মেসেজ রেখে যেতে পারি আপনার কাছে? তার সাথে যোগাযোগ করাটা আমার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

“ম্যাডাম, শীতলকণ্ঠে বললো মহিলা। “এটা কারমেলাইট কনভেন্ট! কেউ হয়তো আপনার সাথে মজা করার জন্যে এই নাম্বারটা দিয়েছে!” মহিলা ফোনটা রেখে দিলো।

আমি জানতাম নিম একজন অসামাজিক মানুষ, কিন্তু এটা তো অ্যাবসার্ড। হেয়ারড্রেসার বের করে চুল শুকাতে শুকাতে ভাবলাম এরপর কি করবো। কিছুক্ষণ পরই একটা আইডিয়া চলে এলো মাথায়।

কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জে কম্পিউটার সিস্টেম ইনস্টল করেছিলো নিম। ওখানে যারা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে তারা নিশ্চয় তাকে চেনে। সম্ভবত মাঝেমধ্যে নিম ওখানে গিয়ে দেখেও আসে তার ইনস্টল করা সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। ওখানকার ডিরেক্টর অব প্রোগ্রামের ম্যানেজারকে ফোন দিলাম।

“ড. নিম?” বললো ভদ্রলোক। “এ নাম তো কখনও শুনি নি। আপনি কি নিশ্চিত তিনি এখানে কাজ করতেন? তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছি, কখনও

এ নাম শুনি নি।”

“ঠিক আছে, ব্যর্থ মনোরথে বললাম। “যথেষ্ট হয়েছে। আমি আপনাদের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাই। তার নামটা কি?”

“নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই!” মনে হলো দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বললো ভদ্রলোক। ধ্যাত?

“তাহলে কি আছে?” অনেকটা চিৎকার করেই বললাম। “কেউ না কেউ তো আপনাদের এই প্রতিষ্ঠানটি চালায়, নাকি?”

 “আমাদের এখানে চেয়ারম্যান আছে,” বিরক্ত হয়ে তার নামটাও বললো সে।

“বেশ, তাহলে কলটা উনার কাছে ফরোয়ার্ড করে দিন, প্লিজ।”

“ঠিক আছে, ম্যাম,” বললো ভদ্রলোক। “আশা করি আপনি জানেন আপনি কি করতে যাচ্ছেন।”

 অবশ্যই জানি। চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি খুবই ভদ্র ব্যবহার করলো। মহিলা যেভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো তাতে করে মনে হলো আমি সঠিক জায়গাতেই ফোন করেছি।

“ড. নিম?” একটু অদ্ভুত কণ্ঠে বললো মহিলা। “না…আমার মনে হয় না এ নামে কাউকে চিনি। এ মুহূর্তে চেয়ারম্যান দেশের বাইরে আছেন। আমি কি আপনার কাছ থেকে একটা মেসেজ রেখে দিতে পারি?”

“তাহলে তো ভালোই হয়,” বললাম তাকে। নিমের মতো রহস্যময় মানুষকে অনেক দিন ধরেই চিনি, সুতরাং মহিলার কথায় আমি আশাবাদী হয়ে উঠলাম। “ড. নিমের সাথে যোগাযোগ হলে দয়া করে তাকে বলবেন মিস ভেলিস রকাওয়ে প্রিন্স কনভেন্টে তার কলের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। আরো বলবেন, রাতের মধ্যে তার কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া না পেলে আমি বাধ্য হবো নানের শপথ নিতে।”

মহিলাকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। এতে কাজ হবে, ভাবলাম আমি।

অবশেষে কন এডিসনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। লিলির মতো আমিও বালি পেটে কিছু কিছু জিনিসের মুখোমুখি হতে অপছন্দ করি, কন এডিসন হলো তার মধ্যে অন্যতম।

আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আধবুক দূরেই লা গালেত্তে নামের ছোটোখাটো একটি ফরাসি রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানকার জানালা দিয়ে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের ভবনটি খুব কাছ থেকে দেখা যায়। কমলার জুস, ব্ল্যাক কফি আর পুন। ডেনিশ অর্ডার দিলাম।

নাস্তা চলে এলে আমি ব্রিফকেস খুলে কিছু নোটপেপার বের করে নিলাম। ওটাতে ঐ দিনের ঘটনাগুলো সময়ানুক্রমে লিখে রেখেছি।

সোলারিনের কাছে একটি সিক্রেট ফর্মুলা আছে, বেশ কিছুদিন তাকে রাশিয়ার বাইরে যেতে দেয়া হয় নি। বিগত পনেরো বছরে ফিস্ক কোনো টুর্নামেন্টে খেলে নি। আমাকে একটা সতর্কবার্তা দিয়েছিলো সোলারিন। তিন মাস আগে ঠিক ঐ গণক যে ভাষায় বলেছিলো সেও একই ভাষায় কথাটা বলেছে। খেলার মাঝখানে সোলারিন আর ফিঙ্কের মধ্যেও কিছু কথাবার্তা হয়েছে, তারপরই তারা একটা বিরতি নেয়। লিলি মনে করছে ফিস্ক প্রতারণা করেছিলো। সন্দেহজনক অবস্থায় ফিস্ককে মৃত পাওয়া গেছে। লিলির গাড়িতে দুটো বুলেট লেগেছে, একটা আমাদের আসার আগেই করা হয়েছিলো। তারপর গাড়ির সামনে আসতেই আরেকটা করা হয়। সল এবং ঐ গণক মহিলা উধাও হয়ে গেছে।

একটার সাথে আরেকটা খাপ খাচ্ছে না। যদিও এসব ঘটনা যে একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত তার প্রচুর কু আর ইঙ্গিত রয়েছে। আমি ভালো করেই জানি অনেক বেশি কাকতালীয় ঘটনার র‍্যান্ডম প্রোব্যাবিলিটি শূন্য হয়ে থাকে।

কফি শেষ করে প্রন ডেনিশ খেতে শুরু করবো ঠিক তখনই তাকে আমি দেখলাম। জানালা দিয়ে জাতিসংঘের সদর দপ্তরটি দেখছিলাম, হঠাৎ আমার চোখে সেটা ধরে পড়ে। বাইরে পুরোপুরি সাদা পোশাকের এক লোক, হুডওয়ালা সোয়েটার, মুখটা নাকের নীচ থেকে সাদা রঙের মাফলার দিয়ে ঢাকা। একটা বাইসাইকেল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে।

খাবার খাওয়া বন্ধ করে বরফের মতো জমে গেলাম আমি। জাতিসংঘ ভবনের সামনে যে স্কয়ারটা আছে তার উল্টো দিকে একটা পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে। বাইসাইকেলটা নিয়ে নামছে সে। তড়িঘড়ি টেবিলের উপর কিছু টাকা রেখে কাগজপত্রগুলো ব্রিফকেসে ভরে কাঁচের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পাথরের সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ পিচ্ছিল, বরফ আর পাথুরে লবনের আস্তরণ। পড়ে গেছে সেগুলোর পৃষ্ঠদেশে। কোট আর ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে। নীচে এলাম আমি। মোড়ের কাছে আসতেই দেখি বাইসাইকেলটা নেই। তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে আমার জুতোর হিল আর্টকে গেলো বরফের মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে হুমরি খেয়ে পড়ে গেলাম দুই তিন ধাপ নীচে। উপরের দিকে চেয়ে দেখি পাথরের দেয়ালে জিওর একটা উক্তি খোদাই করে লেখা :

 জাতির বিরুদ্ধে জাতি তলোয়াড় ধরবে না। যুদ্ধও করবে না।

সম্ভাবনা খুবই কম। উঠে দাঁড়ালাম আমি। মানুষ আর জাতিসমূহ সম্পর্কে জিশুর আরো বেশি ধারণা লাভ করা দরকার ছিলো। বিগত পাঁচ হাজার বছরে যুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীতে একটা দিনও অতিক্রান্ত হয় নি। ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধীরা স্কয়ারে জমায়েত হতে শুরু করেছে। তাদের ঠেলেঠুলে আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আমি দেখতে চাই তারা জিওর বাণীকে স্বার্থক করেছে।

ভাঙা হিল নিয়েই আইবিএম সিস্টেম রিসার্চ ইনস্টিটিউট ভবনটা পেরিয়ে গেলাম। আমার থেকে পুরো এক বুক দূরে আছে লোকটা। এখন সে বাইসাইকেল চালাচ্ছে। ইউএন পুজার সামনে এসে ট্রাফিক সিগন্যালের জন্যে তাকে থামতে হলো কিছুক্ষণ।

আধবুক যেতেই দেখতে পেলাম সিগন্যালটা বদলে গেলো। লোকটা এখন ধীরগতিতে প্যাডেল মারতে মারতে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম কিন্তু মোড়ের কাছে আসতেই আবারো সিগন্যাল পড়ে গেলো। আমার চোখ রাস্তার ওপাশে বাইসাইকেল আরোহীর দিকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সে।

আবারো বাইসাইকেল থেকে নেমে পুজার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। ফাঁদে পড়ে গেছে! ভাস্কর্য উদ্যান থেকে বের হবার কোনো পথ নেই, সুতরাং আমি একটু শান্ত হলাম। সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষা করার সময় বুঝতে পারলাম আমি আসলে কী করছি।

গতকালই আমার চোখের সামনে সম্ভাব্য একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখেছি, তার কিছুক্ষণ পরই মাত্র কয়েক ফিট দূরে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এখন অচেনা এক লোকের পেছনে ছুটে চলেছি শুধুমাত্র এ কারণে যে লোকটা দেখতে হুবহু আমার আঁকা পেইন্টিংয়ের সেই বাইসাইকেল চালকের মতো। কিন্তু এটা কিভাবে হলো? ভেবেও কোনো সদুত্তর। পেলাম না। সিগন্যাল বদল হলে আমি দুদিকের দুটো রাস্তার দিকে তাকালাম, তারপর এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।

ইউএন পুজার রটআয়রনের গেটটা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। সাদা কংক্রিটের চত্বরে পাথরের একটি বেঞ্চে বসে কালো পোশাকের এক বৃদ্ধ মহিলা কবুতরদের দানা খাওয়াচ্ছে। কালো রঙের একটি শাল পেচিয়ে রেখেছে সে। উপুড় হয়ে দানা ছুঁড়ে মারছে কবুতরগুলোর দিকে। তার পাশেই বাইসাইকেল আরোহী লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।

থমকে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখতে লাগলাম আমি। বুঝতে পারছি না কী করবো। কথা বলছে তারা। বৃদ্ধমহিলা আমার দিকে ঘুরে তাকালো, তারপর লোকটাকে কী যেনো বললো। আমার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে। আরো সামনে এগিয়ে গেলো লোকটা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নদী তীরবর্তী এলাকায়। আমি ছুটে গেলাম তার পেছন পেছন। কবুতরগুলো উড়াল দিতে শুরু করলো আমার সামনে। হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে দৌড়াতে লাগলাম।

চত্বরের বাইরে নদীর দিকে মুখ করে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উপহার দেয়া কৃষকের বিশাল একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি। আমার সামনে বরফাচ্ছিদ ইস্ট রিভার, নদীর ওপারে বিশাল কোকা-কোলার সাইনবোর্ড আর কতোগুলো চিমনি। তার ডান দিকে গার্ডেন, এর বিশাল লনের দু’দিকে বৃক্ষের সারি, পুরোটা। এলাকাই বরফে ঢেকে আছে। সেখানে পায়ের কোনো ছাপ নেই। নদীর তীরবর্তী পাথর বিছানো পথ চলে গেছে, গার্ডেন আর এই পথের মাঝখানে রয়েছে ছোটো ছোটো ভাস্কর্য গাছ। ওখানে কেউ নেই।

লোকটা কোথায় গেলো? গার্ডেন থেকে বের হবার তো পথ নেই। আমি আবার ফিরে গেলাম পুজার সিঁড়িতে। চত্বরে গিয়ে দেখি বৃদ্ধমহিলাও নেই। তবে আবছায়া একটি অবয়ব দেখতে পেলাম ভিজিটর এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকছে। বাইরে বাইসাইকেল স্ট্যান্ডে লোকটার সাইকেল রাখা। কিভাবে আমার আগে এখানে চলে এলো সে? তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম আমি। পুরো ফ্লোরটা ফাঁকা, কেবলমাত্র একজন গার্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিসেপশনের ওভাল ডেস্কে বসে থাকা তরুণীর সাথে কথা বলছে।

“এক্সকিউজ মি,” আমি বললাম, “এইমাত্র এখানে কি সাদা সোয়েটার পরা কোনো লোক ঢুকেছে?”

“খেয়াল করি নি,” বিরক্ত হয়ে বললো গার্ড।

“আপনি যদি এখানে কোথাও লুকোতে চান তাহলে কোথায় যাবেন?” জিজ্ঞেস করলাম। নড়েচড়ে উঠলো দু’জনেই। তারা আমাকে ভালো করে দেখতে লাগলো, যেনো আমি একজন সন্ত্রাসী। দ্রুত ব্যাখ্যা করলাম, “মানে, আপনি যদি একা থাকতে চান একটু প্রাইভেসি চান তাহলে কোথায় যাবেন?”

“মেডিটেশন রুমে,” বললো গার্ড। “জায়গাটা খুব নিরিবিলি। ওই তো ওখানে।” বিশাল মার্বেল ফ্লোরের শেষ মাথায় একটি দরজা দেখিয়ে বললো। ফ্লোরটা গোলাপী আর ধূসর বর্ণের চেক-চেক বর্গের। অনেকটা দাবাবোর্ডের মতো। দরজার পাশে স্টেইডগ্লাসের জানালা আছে একটা। গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজার দিকে চলে গেলাম। মেডিটেশন রুমে ঢুকতেই পেছন থেকে দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেলো।

ঘরটা বিশাল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেকটা ভূগর্ভস্থ কবরস্তানের মতো। ভেতরে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো বেঞ্চের সারি। অন্ধকারে তাদের একটার সাথে ধাক্কা খেলাম। ঘরের মাঝখানে কফিন সদৃশ্য পাথরের একটি স্ল্যাব, পেন্সিল আকৃতির একটি স্পটলাইট তার উপরে পতিত হচ্ছে। পুরো ঘরটা স্তব্ধ, হিম-শীতল আর আদ্র। আমাকে চোখ বড় করে তাকাতে হচ্ছে।

একটা বেঞ্চে বসে পড়লে খ্যাচ করে শব্দ হলো। ব্রিফকেসটা বেঞ্চের পাশে রেখে পাথরের স্ল্যাবের দিকে তাকালাম, রহস্যজনকভাবেই আমি কাঁপছি। যেননা মোহাবিষ্টি হয়ে পড়েছি। সম্মোহিত হয়ে গেছি।

দরজাটা আস্তে করে খুলে গেলে সেটার ফাঁক দিয়ে কিছু আলো ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালাম।

“চিৎকার করবে না, আমার পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। “আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না, তবে তোমাকে চুপ থাকতে হবে।”

কণ্ঠটা চিনতে পেরে আমার হৃদস্পন্দন লাফাতে শুরু করলো। ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

ডিম লাইটের মৃদু আলোতে দাঁড়িয়ে আছে সোলারিন, পাথরের স্ল্যাবের উপর যে আলো সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে সোলারিনের সবুজ দু’চোখে। লাফ দিয়ে পিছু হটে পাথরের স্ল্যাবের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সামনে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো সোলারিন। তার গায়ে সেদিনের সেই পোশাক। শুধু কালো রঙের চামড়ার একটি জ্যাকেট চাপিয়েছে তাতে।

“বসো,” নীচুকণ্ঠে বললো সে। “আমার পাশে, এখানে। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই।”

আমার পা দুটো খুব দুর্বল লাগছে। সে যা বললো তাই করলাম, মুখে কিছু বললাম না।

“গতকাল আমি তোমাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার কথা শোনন নি। এখন তো বুঝতে পারছো আমি সত্যি বলেছিলাম। তুমি এবং লিলি র‍্যাড এই টুর্নামেন্ট থেকে দূরে থাকবে। যদি ফিস্কের মতো পরিণতি বরণ করতে চাও।”

“আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন না উনি আত্মহত্যা করেছেন, ফিসফিসিয়ে বললাম আমি।

“বোকার মতো কথা বোলো না। তার ঘাড়টা কোনো এক্সপার্ট ভেঙে দিয়েছে। আমিই তাকে শেষবারের মতো জীবিত দেখেছি। উনার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিলো। অথচ দুই মিনিট পরই মারা গেলেন। সেইসাথে তার সাথে থাকা একটা জিনিসও উধাও হয়ে গেলো—”

“যদি না আপনি তাকে খুন করেন,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললাম। তার হাসিটা একেবারেই দুর্বোধ্য। একটু ঝুঁকে আলতো করে আমার কাঁধে হাত রাখলো সে। এক ধরণের উষ্ণতা যেনো তার হাত থেকে আমার শরীরে বয়ে গেলো।

“আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখে ফেললে আমার খুব বিপদ হবে। সুতরাং আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। আমি তোমার বান্ধবীর গাড়িতে গুলি করি নি। তবে ড্রাইভারের উধাও হয়ে যাওয়াটা কোনো দুর্ঘটনা নয়।”

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। লিলি আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কথাটা কাউকে বলবো না। সোলারিন কিভাবে এটা জানতে পারলো যদি না সে কাজটা করে থাকে?

“আপনি কি জানেন সলের কি হয়েছে? কে গুলি করেছে তাও কি জানেন?”

আমার দিকে তাকালো সোলারিন কিন্তু কিছু বললো না। এখনও আমার কাঁধে তার হাত। আমার দিকে সুন্দর করে হেসে কাঁধটা আরো শক্ত করে ধরলো সে। হাসলে তাকে ছোটো বাচ্চাদের মতো লাগে।

“তারা তোমার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে,” শান্তকণ্ঠে বললো। “তুমিই সেই জন।”

“কারা ঠিক বলেছে? আপনি কিছু জিনিস জানেন কিন্তু আমাকে বলছেন না, বিরক্ত হয়েই বললাম তাকে। আমাকে সাবধান করে দিলেন অথচ তার কারণটা বললেন না। আপনি কি ঐ গণককে চেনেন?”

চট করে আমার কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো সোলারিন। তবে আমি থামলাম না।

“আপনি জানেন,” বললাম তাকে। “বাইসাইকেলের ঐ লোকটা কে? আপনি যদি আমাকে ফলো করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাকে দেখেছেন! আপনি আমাকে সাবধান করে দেবার জন্যে ফলো করে যাচ্ছেন, অথচ কেন করছেন সে ব্যপারে আমাকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছেন? আপনি কি চান? এসবের সাথে আমার কি সম্পর্ক?” নিঃশ্বাস নেবার জন্যে একটু থামলাম। দেখতে পেলাম সোলারিন আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

“আমি জানি না কতোটা তোমাকে বলতে পারবো,” বললো সে। তার কণ্ঠটা খুব কোমল শোনালো। আর প্রথমবারের মতো আমি তার ইংরেজি বাচনভঙ্গিতে স্লাভিচ টান টের পেলাম। “তোমাকে যা-ই বলি না কেন সেটা তোমাকে আরো বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে। আমি শুধু তোমাকে বলবো, আমার কথা বিশ্বাস করো। তোমার সাথে কথা বলে এরইমধ্যে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি।”

আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে সে আমার চুলে হাত বোলাতে লাগলো। যেনো আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে। “এই দাবা টুর্নামেন্ট থেকে তোমাকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। কাউকে বিশ্বাস কোরো না। তোমার পক্ষে ক্ষমতাশালী বন্ধুরা আছে, কিন্তু তুমি জানো না কোন খেলা তুমি খেলছো…”

“কোন সাইডে খেলছি?” আমি বললাম। “আমি তো কোনো খেলা খেলছি না।”

“অবশ্যই খেলছো, আমাকে যেনো জড়িয়ে ধরবে এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো সে। “তুমি দাবা খেলছো। তবে চিন্তা কোরো না। আমি এই খেলার একজন মাস্টার। আমি আছি তোমার পক্ষে।

 উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো সে। আমিও সম্মোহিতের মতো তার পেছন পেছন গেলাম। দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্রই সোলারিন দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, হয়তো মনে করছে কেউ ভেতরে আসছে। তারপর আমার দিকে তাকালো সে। কিছু বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

 জ্যাকেটের ভেতরে একহাত ঢুকিয়ে সোলারিন আমাকে দরজা খুলে বাইরে যাবার ইশারা করলো। এক ঝলক দেখতে পেলাম তার জ্যাকেটের নীচে একটা অস্ত্র আছে। ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম, পেছন ফিরে আর তাকালাম না।

লবির কাঁচের দেয়ালগুলো ভেদ করে বাইরের চকচকে রোদ ঢুকে পড়েছে। বের হবার পথের দিকে এগিয়ে গেলাম দ্রুত। পুজার খোলা চত্বরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম ইস্ট রিভার ড্রাইভের দিকে।

 ডেলিগেট এন্ট্রান্সের কাছে এসে হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি আমার ব্রিফকেসটা মেডিটেশন রুমে ফেলে চলে এসেছি। ওটাতে শুধু আমার লাইব্রেরির বই-ই নেই, আছে গতকালকের ঘটনার নোটগুলোও।

দারুণ। সোলারিন যদি ওটা হাতে পেয়ে যায়, নোটগুলো পড়ে দেখে তাহলে সে বুঝতে পারবে আমি এখনও ঐ ঘটনাটা নিয়ে তদন্ত করে যাচ্ছি। নিজেকে গালি দিলাম মনে মনে। জুতোর ভাঙা হিল নিয়েই ফিরে গেলাম ইউএন প্লাজার দিকে।

 লবিতে ঢুকে দেখি রিসেপশনিস্ট একজন ভিজিটরের সাথে কথা বলছে তবে গার্ড লোকটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। নিজেকে আশ্বস্ত করলাম, ঐ ঘরে একা একা ফিরে যাওয়াটা মোটেও ভয়ের কোনো ব্যাপার হবে না। পুরো লবিটা ফাঁকা-পেচানো সিঁড়িটা দেখতে পেলাম। ওখানেও কেউ নেই।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়লাম মেডিটেশন রুমের ভেতর।

মৃদু আলোর ঘরটায় আমার চোখ সয়ে নিতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। ঘরে সোলারিন নেই। নেই আমার ব্রিফকেসটাও। কিন্তু পাথরের স্ল্যাবের উপর পাড়ে আছে একটা মৃতদেহ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম প্রচণ্ড ভীতি নিয়ে। হাত-পা ছড়িয়ে থাকা বিশাল দেহটার গায়ে শফারের পোশাক। আমার রক্ত হিম হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। কানে ভো ভো শব্দ শুনতে পেলাম। গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে।

স্পটলাইটের আলোতে যে মুখটা দেখতে পেলাম সেটা আর কারোর নয়, লিলির ড্রাইভার সলের! মরে পড়ে আছে সে। এর আগে জীবনে কখনও আমি মৃতদেহ দেখি নি। এমন কি শেষকৃত্যের সময়েও না। বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো আমার।

ঠিক তখনই একটা কথা মাথায় হুট করে চলে এলো : সল তো এখানে নিজে নিজে আসে নি। তাকে অন্য কেউ বয়ে নিয়ে এসেছে। যারা তাকে নিয়ে এসেছে তারা পাঁচ মিনিট আগেও এখানেই ছিলো, এই ঘরে!

দৌড়ে চলে এলাম লবিতে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি এখনও ভিজিটরের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। অল্প সময়ের জন্যে আমার মনে হলো কথাটা তাদেরকে জানাই, কিন্তু পরক্ষণেই মত পাল্টালাম। আমার বান্ধবীর ড্রাইভার ওখানে যখন মরে পড়ে আছে ঠিক তখনই আমি কিভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলাম, এটা সবাইকে বোঝানো কঠিন হয়ে যাবে। আগের দিনই বা কেমন করে, কাকতালীয়ভাবে টুনামেন্টের মৃত্যুর ঘটনায় আমি ছিলাম সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। এই মৃত ড্রাইভারও তখন ওখানে ছিলো, এটাও তারা জেনে যাবে। আমাদের গাড়িতে দুটো গুলি করা হয়েছিলো সেটা কেন আমরা পুলিশকে জানালাম না তাও তো জানতে চাইবে।

অনিচ্ছায় অনেকটা বিপর্যস্ত অবস্থায় ইউএন পুজা থেকে ফিরে এলাম আমি। জানি পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত ছিলো কিন্তু খুব আতঙ্কে আছি। আমি ঐ ঘর থেকে চলে যাবার পর পরই সলকে হত্যা করা হয়েছে। দাবা টুর্নামেন্টে একটা বিরতির সময়ে ফিস্ক মারা গেছেন। দুটো ক্ষেত্রেই ভিকটিম দু’জন পাবলিক প্লেসে ছিলো। তাদের চারপাশে ছিলো অনেক মানুষ। দুটো ঘটনার সময়ই সোলারিন ছিলো তাদের খুব কাছে। তার কাছে একটা অস্ত্রও আছে, আমি নিজে সেটা দেখেছি।

তাহলে আমরা দাবা খেলছি। যদি তাই হয়ে থাকে আমাকে এর নিয়মটাও জেনে নিতে হবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে হেঁটে নিজের উষ্ণ অফিসে ফিরে আসার সময় আমর মধ্যে শুধু ভীতি আর হতবিহ্বলতাই কাজ করে নি, একটা বিষয়ে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ হয়ে উঠলাম আমি। এই খেলাটাকে ঘিরে যে রহস্যময়তার চাদর জড়িয়ে আছে সেটা ভেদ করবো। এই খেলার নিয়ম আর খেলোয়াড়দের চিহ্নিত করবে, খুব জলদি। কারণ দ্রুত চাল দেয়া হচ্ছে। তবে আমার থেকে ত্রিশ বুক দূরে যে চালটা দেয়া হচ্ছে সেটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এই চালটা আমার জীবনের গতিধারা বদলে দিতে যাচ্ছে…

.

“ব্ৰদস্কি তো রেগেমেগে একাকার হয়ে আছেন, নার্ভাস হয়ে বললো গোগল। সোলারিনকে ঢুকতে দেখেই অ্যালগোনকুইন হোটেলের লবির চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। “আপনি কোথায় ছিলেন?” জানতে চাইলো গোগল। তার মুখ। ফ্যাকাশে হয়ে আছে।

 “একটু মুক্ত বাতাস নিতে গেছিলাম,” শান্তকণ্ঠে বললো সোলারিন। “এটা সোভিয়েত রাশিয়া নয়, বুঝলে। নিউইয়র্কের লোকজন নিঃশঙ্কচিত্তে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, তারা জানে সরকারী লোকজন সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে না তাদের গতিবিধি নজরদারি করার জন্য। সে কি মনে করেছে আমি পালিয়ে গেছি?”

গোগল একটুও হাসলো না। “উনি খুব আপসেট হয়ে আছেন।” নার্ভাসভাবে লবির আশেপাশে তাকালো সে, যদিও বেশ দূরে চা পান করতে থাকা এক বয়স্ক মহিলা ছাড়া অন্য কেউ নেই। “হারমানোল্ড আজ সকালে বলেছেন ফিস্কের মৃত্যুর আসল কারণ জানার আগপর্যন্ত টুনামেন্ট বন্ধ থাকবে। ফিস্কের ঘাড় নাকি মটকানো ছিলো।”

“আমি জানি,” গোগলের হাতটা ধরে কাছের একটা টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালো সোলারিন। টেবিলে চা-পাত্র রাখা আছে। তারা সেই চা পান করতে শুরু করলো। মনে রাখবে লাশটা আমি দেখেছি।”

 “এটাই হলো সমস্যা,” বললো গোগল। “দুর্ঘটনাটি ঘটার ঠিক আগ মুহূর্তে আপনি তার সাথেই ছিলেন। এটা খুব খারাপ দেখাচ্ছে। আমাদের দিকে কোনো রকম মনোযোগ তৈরি হোক সেটা আমরা চাই না। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি ইনভেস্টিগেশন শুরু হয় তাহলে সবার আগে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তারা।”

“তুমি কেন আমাকে ভড়কে দিচ্ছো?” বললো সোলারিন।

একটা সুগার কিউব দাঁতের ফাঁকে আটকে রেখে গোগল চা পান করলো। কোনো কথা বললো না সে।

দূরের টেবিলে বসা বৃদ্ধমহিলা হেলেদুলে তাদের টেবিলের কাছে চলে এলো। মহিলার গায়ের পোশাক কালো, হাতে একটা লাঠি। তার দিকে তাকালো গোগল।

“এক্সকিউজ মি,” তাদের দু’জনকে মিষ্টি করে বললো মহিলা। “তারা আমার চায়ে কোনো স্যাকারিন দেয় নি, আর আমি চিনিও খেতে পারছি না ডায়বেটিসের কারণে। আপনাদের কাছে কি স্যাকারিনের প্যাকেট হবে?”

“নিশ্চয়,” বললো সোলারিন। ট্রে’তে থাকা সুগার বোল থেকে কয়েকটি গোলাপি রঙের ছোটো ছোটো প্যাকেট বের করে মহিলার কাছে দিয়ে দিলো। তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো মহিলা।

“খাইছে,” লিফটের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠে বললো গোগল। ওখান থেকে ব্ৰদস্কি ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। “আপনি ফিরে আসলে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নিয়ে যাবার কথা ছিলো।” হুট করে উঠে দাঁড়ালো সে, চায়ের ট্রেটা আরেকটুর জন্যে উল্টে পড়েই যেতো। সোলারিন অবশ্য নিজের চেয়ারেই বসে রইলো।

 ব্ৰদস্কি খুব লম্বা, বেশ পেশীবহুল আর রোদে পোড়া চামড়া। নেভি পিন স্ট্রাইপ সুট আর সিল্কের টাইয়ে তাকে দেখে মনে হয় কোনো ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী। বেশ আগ্রাসীভাবে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। সোলারিনের সামনে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। বসে থেকেই হাতটা মেলানোর পর চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়লো ব্ৰদস্কি।

“তোমার উধাও হয়ে যাবার কথা আমি সেক্রেটারিকে জানাতে বাধ্য হয়েছি,” ব্ৰদস্কি বলতে শুরু করলো।

“আমি তো উধাও হয়ে যায় নি। একটু হাটাহাটি করতে গেছিলাম।”

“মনে হচ্ছে কিছু কেনাকাটাও করেছো?” বললো ব্ৰদস্কি। “ব্রিফকেসটা তো দারুণ সুন্দর। কোত্থেকে কিনলে?” সোলারিনের পাশে থাকা ব্রিফকেসটায় হাত বোলালো সে। গোগল অবশ্য আগে লক্ষ্য করে নি। “ইতালিয়ান চামড়ার। সোভিয়েত দাবা খেলোয়াড়ের জন্যে বেশ মানানসই জিনিস,” পরিহাসের সাথে বললো। এর ভেতরে কি আছে সেটা যদি দেখি তুমি কি কিছু মনে করবে?”

কাঁধ তুললো সোলারিন। ব্রিফকেসটা কোলের উপর রেখে খুলে ফেললো ব্ৰদস্কি। ভেতরের জিনিসপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো সে।

“ভালো কথা, আমি আসার ঠিক আগে তোমাদের টেবিল থেকে যে মহিলাকে চলে যেতে দেখলাম সে কে?”

“এক বুড়ো মহিলা,” বললো গোগল। “চায়ের জন্যে একটু স্যাকারিন নিতে এসেছিলো।”

“তার নিশ্চয় ওটা খুব দরকার ছিলো না,” ব্রিফকেসের কাগজপত্র নাড়তে নাড়তে বললো ব্ৰদস্কি। “আমি আসামাত্রই মহিলা এখান থেকে চলে গেছে।” গোগল চেয়ে দেখলো মহিলা তার টেবিলে নেই, তবে টি-পটটা পড়ে আছে টেবিলে।

ব্ৰদস্কি কাগজপত্রগুলো ব্রিফকেসে রেখে সোলারিনের কাছে সেটা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে তাকালো গোগলের দিকে।

“গোগল, তুমি আস্ত একটা বোকা,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো সে। “এই নিয়ে তিন তিনবার আমাদের মহামূল্যবান গ্র্যান্ডমাস্টার তোমাকে ফাঁকি দিলো। প্রথমত, খুন হবার আগে ফিস্ককে সে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। দ্বিতীয়ত, এই ব্রিফকেসটা তুলে আনার সময়। যেটাতে অপ্রয়োজনীয় কাগজ, বইপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি নিশ্চিত, এরইমধ্যে মূল্যবান জিনিস সে সরিয়ে ফেলেছে। আর এখন, তোমার নাকের ডগার উপর দিয়ে এখানে বসে থেকেই একজন এজেন্টকে চিরকুট চালান করে দিলো!”

আরক্তিম হয়ে উঠলো গোগলের মুখ, নামিয়ে রাখলো চায়ের কাপটা।

“তবে আমি আপনাকে আশ্বস্ত-”

“রাখো তোমার আশ্বস্ত,” কাটাকাটাভাবে বললে ব্ৰদস্কি। সোলারিনের দিকে ফিরলো সে। “সেক্রেটারি বলেছেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে কন্ট্যাক্ট পেতে হবে নইলে ফিরে যেতে হবে রাশিয়ায়। এই টুর্নামেন্টটা যদি বাতিল হয়ে যায় তাহলে আমাদের কভারটা ভেঙে পড়বে, এই ঝুঁকি উনি নিতে পারেন না। আমরা নিউইয়র্কে বসে ইতালিয়ান ব্রিফকেস কেনার জন্যে শপিং করে বেড়াচ্ছি এ কথাটা উনি জানতে পারলে ভালো হবে না,” নাক সিঁটকে বললো সে। “গ্র্যান্ডমাস্টার, তোমার সোর্সদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তোমার হাতে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে।”

 ব্ৰদস্কির চোখে চোখ রাখলো সোলারিন। তারপর শীতল হাসি দিলো সে। “আপনি সেক্রেটারিকে জানাতে পারেন আমরা ইতিমধ্যেই কন্ট্যাক্টের সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছি, মাই ডিয়ার ব্ৰদস্কি,” সে বললো।

কিছুই বললো না ব্ৰদস্কি। সোলারিন এরপর কি বলে সেজন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সোলারিনকে চুপ থাকতে দেখে সে হিসহিসিয়ে বললো, “আমাদেরকে সাসপেন্সের মধ্যে রাখবে না।”

 কোলের উপর রাখা ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে ব্ৰদস্কির দিকে ফিরলো। সোলারিন। তার মুখ নির্বিকার। যেনো মুখোশ পরে আছে।

“ঘুঁটিগুলো আলজেরিয়াতে আছে,” বললো সে।

.

দুপুরের মধ্যে আমার অবস্থা একেবারে যা তা হয়ে গেলো। নিমকে ফোনে পাবার চেষ্টা করে গেলাম উদভ্রান্তের মতো কিন্তু পেলাম না। চোখের সামনে শুধু সলের মৃতদেহটা দেখতে লাগলাম। এইসব ঘটনার মানে কী ভেবে ভেবে আরো বেশি উদভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি।

কন এডিসনে নিজের অফিসের দরজা লক করে জানালা দিয়ে ইউএন ভবনের প্রবেশপথটা দেখতে লাগলাম, রেডিও ছেড়ে প্রায় সব স্টেশনের বর শুনলাম, কিন্তু কোথাও সলের খবরটা পেলাম না। ইউএন ভবনে পুলিশের গাড়ি ছুটে যেতেও দেখলাম না।

লিলিকে ফোন করলাম কিন্তু সে বাইরে বেরিয়ে গেছে। হ্যারির অফিস থেকে আমাকে বলা হলো সে নাকি জরুরি একটা কাজে বাফেলোতে গেছে, রাতের আগে ফিরবে না। পুলিশকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ফোন করার কথাও ভাবলাম কিন্তু ভালো করেই জানি লাশটা খুঁজে পাবার পর তারা আমার উপস্থিতির কথাটাও জেনে যাবে।

দুপুরের পর আমি আমার সেক্রেটারিকে দিয়ে কিছু স্যান্ডউইচ কিনে আনতে পাঠালাম। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। আমার বস লিসেল ফোন করেছে। তাকে খুশি বলে মনে হলো আমার।

 “আপনার টিকেট এসে গেছে, ভেলিস,” বললো সে। “আগামী সোমবার প্যারিসে যাচ্ছেন। ওখানে এক রাত থেকে চলে যাবেন আলজিয়ার্সে। আজ দুপুরে আমি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে টিকেট আর সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক আছে?” তাকে আমি বললাম ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিক।

“আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না খুশি হয়েছেন, ভেলিস। ঐ অন্ধকার। মহাদেশে যাবার ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো চিন্তাভাবনা করবেন নাকি?”

“মোটেই না,” বেশ দৃঢ়তার সাথে বললাম আমি। “এটাকে আমি অবকাশ হিসেবে ব্যবহার করবো। নিউইয়র্কে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি।”

 “বেশ ভালো। তাহলে আপনার যাত্রা শুভ হোক। বন ভয়েজ। পরে আবার বলবেন না আমি আপনাকে সাবধান করে দেই নি।”

ফোনটা রেখে দিলাম মি। কয়েক মিনিট পরই আমার সেক্রেটারি ফিরে এলো স্যান্ডউইচ আর দুধ নিয়ে। দরজা বন্ধ করে স্যান্ডউইচে কয়েক কামড় দেবার পরই খাওয়ার রুচি হলো না। তেল ব্যবসার উপরে বইপুস্তক পড়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেললাম। চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে রইলাম আমি।

 বেলা তিনটার দিকে সেক্রেটারি আবার দরজায় নক করে ঢুকলো। তার হাতে একটা ব্রিফকেস।

“নীচের তলায় গার্ডের কাছে এই ব্রিফকেসটা রেখে গেছে এক লোক, মেয়েটা আমায় বললো। “সাথে একটা নোটও দিয়েছে।” নোটটা আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে সেক্রেটারির চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।

 দরজা বন্ধ করেই পেপার নাইফ দিয়ে এনভেলপটা ছিঁড়ে নোটটা বের করলাম।

“তোমার কিছু কাগজ আমি সরিয়ে রেখেছি,” নোটে বলা আছে। দয়া করে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে একা যেও না। কোনো স্বাক্ষর নেই। তবে আমি বুঝতে পারলাম নোটটা কে পাঠিয়েছে। নোটটা পকেটে রেখে ব্রিফকেসটা খুলে দেখি সব কিছুই ঠিকঠাক আছে শুধু সোলারিনের উপরে যে নোটটা লিখেছিলাম সেটা নেই।

.

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার সময়ও আমি অফিসে বসে রইলাম। সেক্রেটারি টাইপরাইটারের সামনে বসে আছে, যদিও অফিসের প্রায় সবাই চলে গেছে এ সময়। মেয়েটাকে খামোখা একটা কাজ দিয়ে বসিয়ে রেখেছি যাতে করে আমি একা না হয়ে যাই। ভাবছি আমার অ্যাপার্টমেন্টে কিভাবে যাবো। এখান থেকে মাত্র এক বুক দূরে ওটা। মনে হচ্ছে ক্যাব ডাকাটা বোকামি হবে।

সুইপার এসে গেছে অফিসঘরগুলো পরিস্কার করার জন্য। একটা অ্যাস্ট্রে যখন আমার ওয়েস্টবাস্কেটে ফেলছে সে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি ফোনটা তুলতে গিয়ে সেটা ডেস্ক থেকে প্রায় ফেলেই দিতে যাচ্ছিলাম।

 “অনেক কাজ করছে মনে হয়, তাই না?” পরিচিত একটা কণ্ঠ বললো। কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে যারপরনাই স্বস্তি পেলাম।

“এটা যদি সিস্টার নিম না হয়ে থাকে, নিজের কণ্ঠটা নিয়ন্ত্রনে এনে বললাম, “তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি একটু দেরিতে ফোন করেছে। অফিস থেকে এইমাত্র বের হতে যাচ্ছিলাম। আমি এখন জিওর একজন নান হয়ে গেছি।”

“এটা নির্ঘাত একই সাথে করুণা আর অপচয় বলে মনে হচ্ছে,” খুশি হয়ে বললো নিম।

“তুমি কি করে জানলে এতো দেরি করে আমি অফিসে থাকবো আজ?” জানতে চাইলাম।

“তোমার মতো কাজপাগল মেয়ে এই শীতের দিনে আর কোথায় যাবে?” বললো সে। “এতোক্ষণে তুমি নিশ্চয় বিশ্বের তেল সরবরাহ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছিলে…এখন বলো কেমন আছো, মাই ডিয়ার? বুঝতে পারছি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছো।” সুইপার লোকটা চলে যাবার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি।

“কী আর বলবো, ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি,” বলতে শুরু করলাম।

“এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি সব সময়ই সমস্যার মধ্যে থাকো,” শীতলকণ্ঠে বললো নিম। “এ কারণেই তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে।”

আমার অফিসের কাঁচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে সেক্রেটারি মেয়েটাকে দেখলাম।

“আমি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি,” চাপা কণ্ঠে বললাম তাকে। “বিগত দু’দিনে বলতে গেলে আমার চোখের সামনে দু দু’জন লোক খুন হয়ে গেছে! আমাকে সাবধান করে বলা হয়েছে এর সাথে নাকি আমার দাবা খেলা দেখতে যাওয়া সম্পর্ক রয়েছে

“ওয়াও,” বললো নিম। “তুমি করছোটা কি, মোটা কাপড়ের মধ্য দিয়ে কথা বলছো নাকি? তোমার কথা তো শুনতেই পাচ্ছি না। তোমাকে কে সাবধান করেছে? জোরে বলো।”

“এক গণক আমাকে বলেছিলো আমি বিপদে পড়বো,” তাকে বললাম। “আর এখন সেটাই সত্যি হয়ে গেছে। এইসব খুনখারাবি

“মাই ডিয়ার ক্যাট,” হাসতে হাসতে বললো নিম। “একজন গণক?”

“কেবল ঐ মহিলাই নয়,” বললাম আমি। “তুমি কি আলেক্সান্ডার সোলারিনের নাম শুনেছো?” কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো নিম।

“দাবা খেলোয়াড়?” অবশেষে বললো সে।

“সে আমাকে বলেছে…” আমার গলা ধরে এলো, ভালো করেই জানি এখন যা বলবো সেটা যেকোনো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। আষাঢ়ের গল্প বলে মনে হবে।

“তুমি কি করে আলেক্সান্ডার সোলারিনকে চেনো?” জানতে চাইলো নিম।

“গতকাল আমি একটা দাবা টুনামেন্টে গেছিলাম। সেখানেই সোলারিন আমার কাছে এসে বলেছে আমি বিপদের মধ্যে আছি। কথাটা খুব জোর দিয়ে বলেছিলো সে।

“সম্ভবত তোমাকে অন্য কেউ ভেবে এটা বলেছে,” বললো নিম। তবে তার কথা শুনে মনে হলো কেমন জানি উদাস হয়ে গেছে।

“হয়তো,” স্বীকার করলাম আমি। “কিন্তু আজ সকালে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে সে আমাকে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে

“একটু দাঁড়াও,” বাধা দিয়ে বললো নিম। “আমার মনে হয় আমি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছি। গণক আর রাশিয়ান দাবা খেলোয়াড় তোমাকে রহস্যময় সতর্কবাণী দিয়েছে। তোমার চোখের সামনে লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। আজ তুমি কি খেয়েছো?”

“উম। স্যান্ডউইচ আর কিছু দুধ।”

“খাদ্যাভাব প্যারানইয়াকে উসকে দেয়,” খুশিমনে বললো নিম। “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নীচে চলে আসো, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমার অফিসের নীচে গাড়ি নিয়ে আসছি। আমরা দু’জন পেট ভরে ভালো কিছু খাবার খাবো তারপর দেখবে এইসব ফ্যান্টাসি উধাও হয়ে গেছে।”

“ওগুলো কোনো ফ্যান্টাসি নয়,” বললাম আমি। যদিও নিম আসছে বলে বেশ স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। নিদেনপক্ষে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো।”

“এটার বিচার করবো আমি,” জবাবে বললো সে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে। আছি সেখান থেকে তোমাকে খুব হালকাঁপাতলা দেখাচ্ছে। তবে যে লাল রঙের সুটটা পরে আছে সেটাতে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে তোমাকে।

অফিসের চারপাশে তাকালাম, তারপর জানালা দিয়ে নীচের রাস্তার দিকে। অন্ধকার হয়ে আসছে। সবেমাত্র জ্বলে উঠেছে স্টটল্যাম্পগুলো। তবে ফুটপাতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাসস্ট্যান্ডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেটার পাশে একটা ফোনবুথের ভেতর থেকে একজন আমার দিকে হাত নাড়াচ্ছে।

“ভালো কথা, মাই ডিয়ার,” ফোনে বললো নিম, “তুমি যদি বিপদ-আপদ নিয়ে এতোটাই চিন্তিত থাকো তাহলে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালিয়ে জানালার সামনে এভাবে না দাঁড়ানোই ভালো। এটা নিছক সাজেশন, অন্য কিছু না।” কথাটা বলেই সে ফোন রেখে দিলো।

.

নিমের গাঢ় সবুজ রঙের মরগান গাড়িটা কন এডিসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে উঠে পড়লাম তাতে।

নিম পরে আছে রঙচটা জিন্স আর দামি ইতালিয়ান লেদার জ্যাকেট। গলায় সাদা রঙের একটা সিল্কের স্কার্ফ পেচাননা। তার মাথার চুলগুলো ছোটো ছোটো করে ছাটা।

“আমরা তোমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামবো যাতে করে তুমি গরম কোনো কিছু পরে নিতে পারো,” বললো নিম। “তাছাড়া ভেতরে কেউ ঢুকেছে কিনা সেটাও দেখে আসা যাবে।” তার চোখ দুটো অদ্ভুত জেনেটিক স্বাক্ষর বহন করছে। দুটোর রঙ দুরকম। একটা ধূসর আরেকটা নীল। সেই চোখে আমার দিকে যখন তাকায় একটু অস্বস্তি বোধ করি।

আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়িটা থামলে নিম গাড়ি থেকে নেমে এসে দাড়োয়ান বসওয়েলের হাতে বিশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দিলো।

“আমরা খুব অল্প সময় থাকবো, গুডফেলল,” বললো নিম। “গাড়িটা একটু দেখে রেখো, কেমন? এটা নিছক কোনো গাড়ি নয়, এটা আমার পারিবারিক ঐতিহ্য।”

“অবশ্যই স্যার,” ভদ্রভাবে বললো বসওয়েল।

ডেস্ক থেকে আমার মেইলটা নিয়ে নিলাম। ফুঘ্রাইট কোন থেকে পাঠানো হয়েছে সেটা। এর ভেতরেই আছে প্লেনের টিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র। নিম আর আমি লিফটে করে চলে এলাম আমার অ্যাপার্টমেন্টে।

নিম আমার দরজার দিকে তাকিয়ে বললো ভেতরে কেউ ঢোকে নি। কেউ যদি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতো তাহলে চাবি ছাড়া ঢুকতে পারতো না। নিউইয়র্কের অন্যসব অ্যাপার্টমেন্টের মতো আমার দরজা দুই ইঞ্চির স্টিলের আর একটি ডাবল ডেড বোল্টের।

আমাকে নিয়ে ভেতরে লিভিংরুমে চলে এলো নিম।

“আমি বলি কি, মাসে একবার কাজের লোক দিয়ে ঝাড়ামোছা করে নিতে পারো,” বললো সে। “তোমার ঘরে এতো বিশাল কালেকশান আছে অথচ ধুলোয় মলিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।” বইয়ের স্তূপ থেকে একটা বই তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো সে।

ক্লোজেট হাতরিয়ে একটা খাকি প্যান্ট, আইরিশ ফিশারম্যান সোয়েটার বের করে নিলাম। জামা পাল্টানোর জন্য যখন বাথরুমে যাবো দেখতে পেলাম পিয়ানোর সামনে বসে আনমনে টুংটাং করছে নিম।

“তুমি কি এটা বাজাতে পারো?” আমার উদ্দেশ্যে বললো সে। “আমি দেখতে পাচ্ছি কি-গুলো একদম পরিস্কার।”

 “আমি সঙ্গিতের উপর মেজর করেছি,” বাথরুম থেকে বললাম। “ইঞ্জিনিয়ার আর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের তুলনায় মিউজিশিয়ানরা ভালো কম্পিউটার এক্সপার্ট হয়ে থাকে। নিমের রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পদার্থবিজ্ঞানের ডিগ্রি। জামা পাল্টাচ্ছি যখন তখন লিভিংরুম থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। জামা পাল্টে এসে দেখি নিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বাইসাইকেল আরোহী পেইন্টিংটা দেখছে। ওটা আমি দেয়ালে উল্টে রেখে গেছিলাম।

“সাবধানে ধোরো,” তাকে বললাম। “এখনও ভেজা আছে।

“তুমি এঁকেছো?” ছবিটার দিকে চেয়ে থেকেই বললো সে।

“এটাই তো আমাকে এইসব সমস্যায় ফেলেছে,” তাকে বললাম। “ছবিটা আঁকার পর ঠিক এরকমই এক লোককে আমি দেখেছি। তাই তাকে অনুসরণ করি আমি…”

“তুমি কি করেছো?” চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো নিম।

পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পুরো গল্পটা বললাম তাকে। শুরু করলাম লিলি তার কুকুর নিয়ে আমার এখানে আসা থেকে। এবার নিম আমাকে কথার মাঝখানে বাধা দিলো না। কথা শোনার ফাঁকে ফাঁকে পেইন্টিংটার দিকে চকিতে তাকালো সে। শেষ করলাম গণক আর গতরাতে ফিফথ এভিনু হোটেলে গিয়ে কী শুনেছি তা বলে। মহিলার কোনো অস্তিত্বই নাকি নেই। আমার কথা বলা শেষ হলে নিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। আমি ক্লোজেট থেকে রাইডিং বুট বের করে পরতে শুরু করলাম।

“তুমি যদি কিছু মনে না করো, কী ভেবে যেনো বললো নিম, “আমি এই পেইন্টিংটা কয়েক দিনের জন্য ধার নিতে চাচ্ছি।”. ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে নিলো সে। “গণকের কাছ থেকে শোনা ঐ কবিতাটি কি তোমার কাছে আছে?”

“এখানেই আশেপাশে কোথাও আছে,” ঘরের জঞ্জালের দিকে চেয়ে বললাম।

“চলো সেটা খুঁজে দেখি,” বললো সে।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর লিউলিনের লেখা ককটেইল রুমালটি খুঁজে পেলাম।

আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিজের পকেটে রেখে দিলো নিম। এক হাতে ভেজা পেইন্টিং আর অন্য হাতে আমার কাঁধটা ধরে আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।

“পেইন্টিংটা নিয়ে চিন্তা কোরো না,” যেতে যেতে বললো সে। “এক সপ্তাহের মধ্যে আমি এটা ফিরিয়ে দেবো।”

“তুমি এটা রেখেই দাও,” বললাম তাকে। শুক্রবার আমার সব কিছু। গোছগাছ করা হবে। তোমাকে কল করার এটাই ছিলো প্রথম কারণ। এই সপ্তাহেই আমি দেশ ছাড়ছি। এক বছরের জন্যে যাবো। আমার কোম্পানি আমাকে বাইরে পাঠাচ্ছে একটা কাজে।”

“ঐ বানচোতদের ফার্মটা,” বললো নিম। “তারা তোমাকে কোথায়। পাঠাচ্ছে?”

“আলজেরিয়ায়,” দরজা লাগাতে লাগাতে বললাম।

নিম আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। তারপরই ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। “তুমি মেয়েটা সব সময়ই আমাকে বিস্মিত করো,” বললো নিম। “একঘণ্টা ধরে তুমি আমাকে হত্যা, রাহাজানি আর রহস্যময় ঘটনার গল্প বললে। তারপর এখন বলছো এটা! এটাই তো আসল পয়েন্ট।”

 আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। “আলজেরিয়া? বললাম তাকে। “এটার সাথে ঐসব ঘটনার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?”

“আমাকে বলল, আমার থুতনিটা একহাতে ধরে সরাসরি তাকালো আমার দিকে। “তুমি কি কখনও মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কথা শুনেছো?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *