নাইটিঙেল পাখির কথা

নাইটিঙেল পাখির কথা

চীন-সম্রাটের প্রাসাদের মতো চমৎকার প্রাসাদ পৃথিবীতে আর একটিও ছিল না। আগাগোড়া মিহি চীনে-মাটির তৈরি, এমনি পাতলা যে, এতটুকু ছুলেই বুঝি ভেঙে পড়ে !

বাগানে ছিল দুনিয়ার যত সেরা ফুল। সব চাইতে সুন্দর ফুলগুলোর গায়ে আবার ছোটো-ছোটো রুপোর ঘন্টি বাঁধা থাকত, তার টুং-টাং শব্দ কানে গেলে ফুলের দিকে একবার না চেয়ে পাশ দিয়ে কারো যাবার উপায় ছিল না। বাস্তবিকই চীন সম্রাটের বাগানের সব কিছু সাজান, গোছান নিখুঁত। তার উপর এত বড়ো বাগান যে মালীরাও জানত না কোথায় তার শেষ। কিন্তু কেউ যদি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে যেত, দেখতে পেত তার পরে ঘন বন, তার গাছগুলি কি উঁচু আর তার পরেই সমুদ্র। বন একেবারে সাগরতীর অবধি নেমে গেছিল, সে সাগরের জল কি গভীর, কি ঘন নীল ! বড়ো-বড়ো জাহাজগুলি বনের গাছতলার কাছ ঘেষে ভেসে যেত। গাছের ডালপালার মধ্যে একটি নাইটিঙেল পাখি থাকত। সে পাখি এমনি মধুর সুরে গান গাইত যে রাতে যখন জেলেরা মাছ ধরার জাল নিয়ে বেরুত, সে স্বরের রেশ কানে গেলেই, হাজার কাজ ফেলে তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে গান শুনত।

পৃথিবীর সব দেশ থেকে ভ্রমণকারীরা সম্রাটের রাজধানীতে আসত, শহর, প্রাসাদ, বাগান, যা দেখত তারই সুখ্যাতি করত। কিন্তু যেই না তারা নাইটিঙেল পাখির গান শুনত, অমনি সবাই একবাক্যে বলত, ‘এই হল সবার সেরা জিনিস। দেশে ফিরে গিয়ে তারা ঐ পাখির গল্প করত আর যে-সমস্ত পণ্ডিতরা শহর, প্রাসাদ, বাগানের গুণগান করে বই লিখত, তারাও বলত ঐ পাখির কোনো তুলনা নেই। সাগরতীরের সেই বনের নাইটিঙেল পাখির বিষয়ে কবির সব অপূর্ব কবিতা রচনা করত।

সে-সব বই পৃথিবীর সব দেশে যেত; এমনি করে একটি বই একবার চীন সম্রাটের হাতেও এল । সম্রাট সে বই পড়ছেন তো পড়ছেন-ই, পড়ছেন আর ঘন ঘন মাথা নাড়ছেন। বইতে তার শহরের, প্রাসাদের, বাগানের যা উচ্ছসিত প্রশংসা, সম্রাট পড়ে আহলাদে আটখানা। কিন্তু শেষের দিকে একটি কথা পড়ে তিনি তো অবাক! বইতে লিখেছে, কিন্তু সেখানকার সব জিনিসের সেরা জিনিস হল ঐ নাইটিঙেল পাখি।”

সম্রাট বললেন, “এ আবার কি মাথা-মুণ্ডু লিখেছে। নাইটিঙেল আবার কি ? এমন কথা তো শুনিও নি, জানিও নি! আমার সাম্রাজ্যে—শুধু তাই কেন, আমারই বাগানে —এমন পাখি আছে, অথচ আমি সে কথা কখনো শুনি নি । বাস্তবিকই বই পড়ে কিছু কিছু শেখা যায় ।”

অতএব প্রধানমন্ত্রীর ডাক পড়ল। তিনি এমনি হোমরাচোমরা ব্যক্তিবিশেষ যে, সাধারণ লোকে তার সঙ্গে কথাই বলতে পেত না। যদি-বা সাহস করে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করত, র্তার একমাত্র উত্তর ছিল, “দুঃস্!” তাকে তো আর কিছু উত্তর বলা চলে না । সম্রাট বললেন, “শুনছি নাকি এখানে নাইটিঙেল নামে এক আশ্চর্য পাখি আছে ; আমার গোটা সাম্রাজ্যে তার গানের মতো মূল্যবান জিনিস নাকি আর কিছু নেই। তার কথা আমাকে বলা হয় নি কেন ?”

প্রধানমন্ত্রী তো অবাক ! “সে কি কথা ! আমি তো কস্মিন কালে তার নামও শুনি নি ; সে তো কখনো রাজসভায় হাজিরা দেয় নি যে জানব।”

সম্রাট বললেন, “আমার ইচ্ছা আজ সন্ধ্যাবেলায় সে আমার কাছে এসে গান শোনাক ! আমার কি আছে না আছে সারা পৃথিবীর লোকে জানে, অথচ আমিই জানি না।” প্রধানমন্ত্রী বললেন, “কি জানি আমি তো তার বিষয়ে কিছুই শুনি নি। খুঁজে দেখব, পাবও নিশ্চয়।”

কিন্তু পাবেটা কোথায় ? প্রধানমন্ত্রী এখানকার সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন, ওখানকার সিঁড়ি বেয়ে নামেন, এখানে সভাঘরে দেখেন, ওখানে দালানে দেখেন, কত লোকের সঙ্গে দেখা হয়, কেউ নাইটিঙেলের নামও শোনে নি। অগত্যা সম্রাটের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, “ঐ লোকটা আগাগোড়া বানিয়ে লিখেছে। বইয়ে যা কিছু লেখে জাঁহাপনা যেন তা সব বিশ্বাস না করেন, কারণ তার অনেকখানিই স্রেফ মন-গড়া।”

সম্রাট বললেন, “তা বললে হবে কেন ? যে বইতে ও কথা লেখা আছে, সে বই মহামান্য জাপান-সম্রাট আমাকে পাঠিয়েছেন, কাজেই কথাটা মিথ্যা হতে পারে না। মোট কথা আমি নাইটিঙেলের গান শুনতে চাই, তাকে আজ সন্ধ্যায় এখানে উপস্থিত হতে হবে, না হলে সভাসুদ্ধ সঙ্কলকে বেত মারা হবে।” বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন, সিঁড়ি বেয়ে নামলেন, সভাঘর দেখলেন, দালান দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সভার অর্ধেক মানুষও দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল, কারণ বেত খাবার শখ একজনেরও ছিল না। সেই আশ্চর্য নাইটিঙেল পাখি সম্বন্ধে কত প্রশ্নই-না করা হল ; আশ্চর্যের বিষয় যে দুনিয়াসুদ্ধ সবাই তার কথা বলে আর সভার কেউ কিছু জানে না !

অবশেষে রান্নাঘরে একটা বেজায় গরিব ছোটো মেয়ের সঙ্গে তাদের দেখা হল। সেই মেয়ে বলল, “আরে হ্যা, হ্যা, ও পাখি আমার খুব চেনা। আহা, কি মিষ্টি গান গায় । রোজ সন্ধেবেলা আমি এখানকার পাত-কুড়ুনি নিয়ে যাই আমার রুগ্ন মায়ের জন্য। মা থাকে সমুদ্রের ধারে। ফেরবার সময় ছোটো বনটাতে একটু জিরিয়ে নিই আর সেই সময় নাইটিঙেল পাখির গান শুনতে পাই, শুনে আমার চোখে জল আসে।”

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “শোন, শোন, পাকশালের দাসী, আমাদের যদি নাইটিঙেল পাখির কাছে নিয়ে যেতে পার, রান্নাঘরে তোমাকে ভালো চাকরি পাইয়ে দেব। ওকে যে আজ সন্ধ্যায় রাজসভায় হাজিরা দিতে হবে।”

তার পর তারা সবাই মিলে যে বনে নিত্যি নাইটিঙেল গান গাইত, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। সঙ্গে গেল রাজসভার অর্ধেক লোক। যাবার পথে একটা গোরুকে হাম্বা-হাম্বা করে ডাকতে শোনা গেল। তাই শুনে রাজসভার ছোকরা অনুচররা বলে উঠল, “ঐ যে ! শেষটা সত্যি পাওয়া গেল! কিন্তু অতটুকু জানোয়ার এমনি জোরে ডাকে ! কোথায় যেন আগে শুনেছি এইরকম ডাক !”

পাকশালের ছোটো দাসী বলল, “না, না, ও তো গোরুর ডাক, এখনো ঢের পথ বাকি।” পুকুরে ব্যাঙ ডাকছিল।

রাজসভার প্রধান পুরোহিত বললেন, “আহা, ঐ তো ! ঠিক যেন মন্দিরে ছোটো-ছোটো ঘণ্টা বাজছে!”

পাকশালের ছোটো দাসী বলল, “আজ্ঞে না, ও তো ব্যাঙ, তবে আর বেশি দেরি নেই।”

তার পর নাইটিঙেল পাখি গানছোটো দাসী বলল, “ঐ তো, শোন, শোন!” গাছের ডালে বসা ছোটো একটা ছাই রঙের পাখিকে দেখিয়ে বলল, “ঐ-যে ঐখানে ৷”

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “এ-ও কি সম্ভব ? এমন আমি ভাবতে পারি নি! কি সাদা-সিধে চেহারা। হোমরা-চোমরা এত লোক দেখে হয়তো রং বদলেছে !”

পাকশালের ছোটো দাসী ডেকে বলল, “ওগো, ছোটো নাইটিঙেল, আমাদের মহানুভব সম্রাটের বড়ো ইচ্ছা তুমি তাকে গান শোনাও।”

নাইটিঙেল বলল, “খুব খুশি হয়েই শোনাব।” এই বলে এমনি মধুর স্বরে গাইতে লাগল যে, শুনে সবাই মুগ্ধ হল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, “শুনে মনে হয় যেন কাচের ঘণ্টা বাজছে । আহা, দেখ দেখ, ঐ অতটুকু গলাটি কেমন নড়ছে! আগে কখনো ওর গান শুনি নি, এ কি অদ্ভুত ব্যাপার! সভা জমাবে ভালো !”

নাইটিঙেল বলল, “সম্রাটকে আরো গান শোনাব ?” ও ভেবেছিল ওঁদের সঙ্গে বুঝি সম্রাটও আছেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, “হে মহিমাময়ী নাইটিঙেল, আমি আপনাকে আজ সন্ধ্যাকালে রাজসভার এক বিশেষ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি, সম্রাট আপনার গান শুনলে বড়োই আনন্দ লাভ করবেন।”

নাইটিঙেল বলল, “কিন্তু সবুজ গাছপালার মধ্যে আমার গান আরো ভালো শোনায়।” তবু সম্রাটের ইচ্ছার কথা শুনে খুশি হয়েই সে ওদের সঙ্গে চলল। সুসজ্জিত প্রকাণ্ড সভাঘরে সম্রাট বসেছেন, ঘরের মাঝখানে নাইটিঙেল পাখির জন্য সোনার দাঁড় প্রস্তুত। সভাসদরা সকলে উপস্থিত। পাকশালের ছোটো দাসীও দরজার পিছনে দাঁড়াবার অনুমতি পেয়েছে ; এখন কি না সে পদ পেয়েছে, উপাধি পেয়েছে, পাক-পরিচারিকা হয়েছে । যে যত ভালো পারে সেজেগুজে এসেছে ; সবার চোখ রয়েছে ছাই রঙের ক্ষুদে পাখিটার উপর। মাথা নেড়ে সম্রাট তাকে গান শুরু করার ইশারা দিলেন ।

অমনি সে যে কি মধুর গান ধরল, সম্রাটের দুচোখ জলে ভরে এল, গাল বেয়ে সে জল গড়িয়ে পড়ল। তার পর পাখি আরো মিষ্টি গলায় গান গাইতে লাগল, যারা শুনল তাদের সকলের মনের মূলে গিয়ে নাড়া দিল। সম্রাট এত খুশি হলেন যে, তখনি হুকুম করলেন, “নাইটিঙেলকে এখনি আমার সোনার চটিজোড়া দেওয়া হোক, গলায় বুলিয়ে রাখুক।” নাইটিঙেল কিন্তু ধন্যবাদ জানিয়ে বলল যে, সম্রাটের কাছ থেকে তার যথেষ্ট পুরস্কার লাভ হয়ে গেছে।

“সম্রাটের চোখে জল দেখলাম, তার চাইতে বেশি আর কি পেতে পারি ? সম্রাটের চোখের জলের যে অনেক দাম।” এই বলে মিষ্টি মধুর স্বরে সে আবার গান ধরল।

সভায় যত মহিলা ছিলেন, তারা বললেন, “বাঃ, দিব্যি খোস্ কায়দা চালল দেখছি!” এই বলে যে যার একগাল করে জল মুখে নিয়ে, কথা বলার সময়, নাইটিঙেলের মতো গলা নাড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। মনের ইচ্ছা তারাও একেকটি নাইটিঙেল বনবেন! এমন-কি, চাকর-দাসীরা পর্যন্ত স্বীকার করল তারা বড়ো খুশি হয়েছে। কে না জানে যে এ কথার অনেক দাম, কারণ তাদের খুশি করা বড়ো শক্ত । বাস্তবিক, নাইটিঙেল পাখির সে কি বোল-বোলা ! স্থির হল এখন থেকে সে রাজসভাতে বাস করবে, তার আলাদা খাঁচা হবে, দিনে দুবার আর

রাতে একবার তাকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে বেড়াতে দেওয়া হবে। বারোজন বান্দা ঠিক হল নাইটিঙেল পাখির পায়ে রেশমি সুতো বেঁধে তার এক মাথা ধরে রাখবে। বলা বাহুল্য সুতো কখনো হাত ফস্কাত না ।

শহরময় কেবল সেই আশ্চর্য পাখির গল্প ! দুজনের দেখা হলেই একজন বলত ‘নাইট’, অন্যজন বলত ইঙেল’ তার পর দুজনেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ত, পরস্পরের মনের কথা বুঝতে তাদের বাকি থাকত না। এমন-কি, নগরবাসীদের এগারোটি ছেলেমেয়ের নাইটিঙেলের নামে নামকরণ পর্যন্ত হয়ে গেল। একদিন সম্রাটের কাছে প্রকাণ্ড এক পার্সেল এল, তার উপরে লেখা নাইটিঙেল’ ।

সম্রাট বললেন, “এই দেখ, আমাদের সুদূর-খ্যাত পাখির বিষয়ে আরেকটা নতুন বই !” কিন্তু পার্সেল খুলে দেখা গেল, বই নয়, একটা বাক্সের মধ্যে একটা ছোটো যন্ত্র। যন্ত্রটি হল ক্ষুদে একটি কলের নাইটিঙেল, সত্যিকার নাইটিঙেলের মতো করেই তাকে গড়বার চেষ্টা হয়েছে, তার সারা গায়ে হীরে, চুনী, নীল বসান। চাবি দিলেই কলের পাখি সত্যিকার নাইটিঙেলেরই একটি গান গায়, আর গাইবার সময় সোনা রুপো দিয়ে তৈরি ঝকঝকে ল্যাজটি একবার ওঠে, একবার নামে।

সবাই একবাক্যে বলল, “খাসা ! চমৎকার! অতুলনীয় ” যে লোকটা পাখি এনেছিল তাকে অমনি উপাধি দেওয়া হল, ‘প্রধান রাজকীয় নাইটিঙেল আনয়ক ।

সম্রাট হুকুম দিলেন সত্যি পাখি আর নকল পাখি একসঙ্গে গাইবে। কিন্তু সে গান ভালো জমল না ; সত্যিকার পাখি গাইল নিজের মনের মতো করে আর নকল পাখি গাইল চাকায় ঘোরা সুরে।

কারিগর বলল, “নকল পাখির কোনো দোষ নেই, ও তো ঠিক তাল রেখে নিয়ম মাফিক গান গায়।”

কাজেই তখন থেকে নকল পাখি একাই গাইত ! সত্যি পাখির মতোই তার গান হত নিখুঁত। তার উপর কি চমৎকার দেখতে! মণি-মানিক্যের মতো পালকগুলি ঝলমল করে।

ঐ একটিমাত্র গান তেত্রিশবার গেয়েও পাখি ক্লান্ত হয় না। সভার সবাই-ও আরো বারে বারে শুনতে রাজি। সম্রাটের ইচ্ছা এবার সত্যিকার নাইটিঙেল কিছু গাক। কিন্তু কোথায় সে ? কেউ খেয়াল করে নি কখন সে খোলা জানলা দিয়ে উড়ে গেছে তার সাধের সবুজ বনে ।

সম্রাট বললেন, “এর মানে কি ?” সভাসদরা পাখিকে গালিমন্দ করতে লাগল, সবাই বলল, “পাখি বড়ো নেমকহারাম।” তার পর বলল, “সে যাই হোক, ভালো পাখিটাই তো থেকে গেছে!” এই বলে তারা চৌত্রিশতম বারের মতো সেই একই গান শুনল। শুনল তবু সুরটি ঠিকমতে শেখা হল না, বড়ো কঠিন। কারিগর নিজের পাখির উচ্ছসিত প্রশংসা করল, বলল, সত্যিকার নাইটিঙেলের চেয়ে তার কলের পাখি সবদিক দিয়ে শত গুণে ভালো ।

কারিগর বলল, “কারণ বুঝলেন, সত্যিকার পাখি কখন কি করে বসে তারই-বা বিশ্বাস কি, কিন্তু আমার এই নকল পাখি ধরা-বাধা নিয়মমাফিক চলে। গাইবেও ঐ একইভাবে, একটুও ইদিক-উদিক হবে না। এ তো সহজেই প্রমাণ করা যায়। যন্ত্রপাতিগুলি সব খুলে ফেলা যায়, কলকব্জা সবাই দেখতে পাবে, কোন চাকা কোথায় থাকে, কে কেমন ঘোরে, এক চাকা লেগে আরেক চাকা কেমন চলে।”

সবাই বলল, “হ্যা, হ্যা, ঠিক তাই, আমাদেরও সেই মত ”

কারিগর তখন পরের রবিবার সাধারণ লোকদের পাখি দেখাবার অনুমতি চাইল। সম্রাট বললেন, “নিশ্চয়ই, ওরাও গান শুনুক ।” তাই শুনল ওরা তার পরের রবিবার, শুনে সবাই সে কি খুশি, যেন সবাই মিলে চা খাচ্ছে ! চা খেতে পেলেই চীন দেশের লোকদের ফুর্তি লাগে। শুধু সেই যে জেলে, যে সবার আগে সত্যিকার নাইটিঙেলের গান শুনেছিল, সে বলল, “হু, শুনতে বেড়ে, প্রায় সত্যিকার পাখিটারই মতো, কিন্তু কি যেন একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না, কি।”

সত্যিকার নাইটিঙেলকে সাম্রাজ্য থেকে নিবাসন দেওয়া হল।

সম্রাটের শয্যার পাশে রেশমি গদীর উপরে নকল পাখির জায়গা হল। পাখির চারিদিকে তার পাওয়া কত উপহার, সোনাদানা, রতন, মণি ! তাকে সম্মানিত পদ আর উপাধি দেওয়া হল, ‘মহামান্য রাজরাজ্যেশ্বর মধুরেণ সমাপয়েং গায়ক”।

কারিগর তার পাখি সম্বন্ধে পচিশ খণ্ডের বই লিখল, তার মধ্যে চীন ভাষার যত দুর্বোধ্য খটমট, লম্বা লম্বা কথা ছিল, সব পুরে দিল। কাজে কাজেই সবাই বলল, তারা বই পড়েছে এবং সব বুঝতে পেরেছে, নইলে যে মুস্কিল, ওরা কত মুখ্যু সব প্রমাণ তো হয়েই যাবে, উপরন্তু হয়তো বেতও খেতে হবে।

এক বছর এইভাবে চলল। সম্রাট, সভাসদরা আর চীন দেশের সব লোকদের নকল পাখির গানের পদ আর স্বর মুখস্থ হয়ে গেল। ঠিক সেইজন্যেই গানটা তারা অমন উপভোগ করত, তারাও যে সঙ্গে গাইতে পারত। রাস্তার ছোকরারাও গান ধরত, ‘চ্চি চ্চি চ্চি চ্চি ক্ক ক্ক ক্ক ক্ক !’ সম্রাটও গাইতেন, ‘চ্চি চ্চি চ্চি চ্চি ক্ক ক্ক ক্ক!’ এমন সময় একদিন সন্ধেবেলায় সম্রাট বিছানায় শুয়ে আছেন, পাখি গলা ছেড়ে গান গাইছে—এমন সময় পাখির পেটের মধ্যে টং করে শব্দ হল, তার পরেই কু-র-র-র করে কি যেন ছেড়ে গেল। চাকাগুলো এলোমেলো ঘুরতে লাগল। পাখি চুপ!

সম্রাট তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে প্রধান বদ্যিকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু সে এসেই-বা করবেটা কি ? তখন এক ঘড়ি-তৈরিওলাকে আনা হল। অনেক শলাপরামর্শ চেষ্টাচরিত্র করে পাখিটাকে তো কোনোমতে সারান হল। কিন্তু ঘড়ি তৈরিওলা বলে গেল পাখিকে যেন বেশি গাওয়ান না হয়, কলকব্জার খুঁটি ক্ষয়ে গেছে, ও আর নতুন করে তৈরিও করা যাবে না, অন্তত ঠিক স্বরে গান গাইবার মতো করে তো নয়ই।

দেশ জুড়ে হাহাকার উঠল। এখন থেকে নকল পাখি সারা বছরে মাত্র একবার গান গায়, তাতেও আবার অসুবিধা কত। অবিশ্যি কারিগর বড়ো-বড়ো কথায় ভরা ছোটোখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে বলল যে, পাখির কিছু হয় নি, আগের মতোই ভালো আছে ; অগত্যা সকলকেই মেনে নিতে হল যে পাখির কিছু হয় নি।

এমনি করে পাঁচ বছর কেটে যাবার পর সমস্ত দেশের উপর শোকের ছায়া নেমে এল । সম্রাটের বড়ো অসুখ, শোনা গেল তার বাঁচার আশা নেই। নতুন সম্রাট নির্বাচিত হল, দেশের লোকাঁ প্রাসাদের বাইরে পথে দাঁড়িয়ে, প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল সম্রাট কেমন আছেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন,“দুঃস্!” বলেই মাথা নাড়লেন। চমৎকার করে সাজান খাটে সম্রাট শুয়ে আছেন, হাত পা ঠাণ্ড, মুখে রক্তের লেশ নেই। সভাসদদের ধারণা হল তিনি ইতিমধ্যে মারাই গিয়েছেন ; সবাই নতুন সম্রাটকে অভিনন্দন জানাতে ছুটল।

সম্রাট কিন্তু মরেন নি। অবিশ্যি নিশ্বাস একরকম বন্ধ হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে বুকের উপর কিসের বোঝা। চোখ খুলে দেখেন, মৃত্যু এসে বুকে চেপে বসেছে। তার মাথায় সম্রাটের মুকুট, এক হাতে সোনার তলোয়ার, অন্য হাতে সম্রাটের কারুকার্য করা পতাকা। খাটের চারধারের পুরু মখমলের পর্দার তলা দিয়ে অদ্ভূত দেখতে কাদের মাথা উঁকি মারছে, কারও মুখ বেজায় বিটকেল, কারও মুখ কি কোমল, কি সুন্দর! সারা জীবন ধরে সম্রাট যত মন্দ কাজ, ভালো কাজ করেছেন, তারাই এখন ওরকম চেহারা ধরেছে । তারা সবাই এখন ওর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আর বুকের উপরে বসে আছে মৃত্যু।

তারা ফিসফিস্ করে কথা বলছিল, এ কথা জানতে ? ‘সে কথা মনে আছে ? তার পর সবাই মিলে তাকে এমনি দোষ দিতে লাগল যে, তার সারা কপালে ঘাম দেখা দিল ।

সম্রাট বলে উঠলেন, “এমন ব্যাপার তো আমার আদৌ জানা ছিল না! কোথায় গেল বাজনদাররা, চীন দেশের বড়ো ঢাক বাজুক, এদের কথা চাপা পড়ে যাক ৷”

তারা কিন্তু থামল না, বলেই চলল আর মৃত্যু চীনে কায়দায় মাথা নেড়ে সব কথায় সায় দিতে লাগল। সম্রাট বললেন, “কোথায় গান-বাজনা? ওগো আমার এত আদরের কলের পাখি, অনুনয় করছি একটি গান কর! তোমাকে কত সোনাদান ধনরত্ন দিয়েছি, তোমার গলায় আমার সোনার চটি ঝুলিয়েছি, একবারটি গাও, গাও একবার ”

কিন্তু পাখি তবু চুপ করে রইল। কাছে পিঠে কেউ নেই কে-বা চাবি ঘোরাবে, আর চাবি না দিলে কেমন করে গাইবে ? কোটরে বসা চোখ দিয়ে মৃত্যু রাজার দিকে চেয়ে রইল । চারদিক চুপচাপ, সে কি ভয়ংকর রকম চুপচাপ।

হঠাৎ জানলা দিয়ে মধুর গান শোনা গেল। সত্যিকার ছোটো নাইটিঙেল বাইরে গাছের ডালে বসে গাইছে! সম্রাটের গুরুতর অসুখের খবর তার কানে গেছে ; সে এসেছে তাকে সাস্তুনার কথা, আশার কথা শোনাতে। যেমন পাখি গাইতে লাগল, ভুতুড়ে চেহারাগুলো ক্রমে মিলিয়ে যেতে লাগল, সম্রাটের ক্ষীণ দেহের শিরায় শিরায় রক্তের স্রোত আরো জোরে বইতে লাগল। স্বয়ং মৃত্যু কান পেতে গান শুনে বলল, “গাও, গাও, ছোটো নাইটিঙেল, আরো গাও।”

“বল, আমাকে ঐ সুন্দর সোনার তলোয়ারটি দেবে ? ঐ রঙচঙে পতাকা দেবে, সম্রাটের মুকুট দেবে ?”

একটা গানের বদলে মৃত্যু তখন তাকে সব দিয়ে দিল। আর নাইটিঙেল পাখি গলা খুলে গাইতে লাগল। কি না গাইল পাখি, নীরব শান্তি ভরা সমাধিস্থানের কথা, সেখানে সাদা গোলাপ ফোটে ; মাধবীফুলের গন্ধ ভুর-ভূর করে ; সেখানকার কচিশ্যামল ঘাস যারা মারা গেছে তাদের প্রিয়জনের চোখের জলে ভেজা। তাই শুনে তার নিজের বাগানের জন্য মৃত্যুর মন কেমন করে উঠল, একটা ঠাণ্ডা সাদা ছায়ার মতো খোলা জানলা দিয়ে সে উড়ে চলে গেল।

সম্রাট বললেন, “ছোটো পাখি, তোমাকে শত-শত ধন্যবাদ। রাজ্য থেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিলাম আর তুমি কি-না গান গেয়ে আমার বিছানার চারপাশ থেকে বিকট মুখগুলো তাড়ালে, বুকের উপর থেকে মৃত্যুকে নামালে। কি দিয়ে তোমাকে পুরস্কৃত করি বল তো !”

নাইটিঙেল বলল, “সম্রাট, আপনি তো আমার পুরস্কার দিয়েইছেন। সেই প্রথমবার যখন আপনাকে গান শুনিয়েছিলাম, ঠিক তখনকার মতো আজ আবার আপনার চোখে জল দেখলাম। ও কি আমি ভুলতে পারি ? গায়কের কাছে ঐ চোখের জল যে অমূল্য রত্বের মতো, তাতে কি আরাম, কি আনন্দ । কিন্তু এখন আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। যখন ঘুম থেকে উঠবেন, শরীর কেমন তাজা, সুস্থ মনে হবে। আমি গান গেয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াচ্ছি।”

পাখি গাইতে লাগল, সম্রাটও মধুর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। কি মৃদু, কি সুন্দর সে ঘুম ; তাতে শরীর সারে।

জানলা দিয়ে ঘরে রোদ এলে, সম্রাটের ঘুম ভাঙল। অনুচররা কেউ ফিরে আসে নি ; সবাই ভেবেছে সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে। শুধু নাইটিঙেল পাখি তখনো বসে বসে গান গাইছে।

সম্রাট বললেন, “পাখি, তুমি সর্বদা আমার কাছে থেকো। যখন ইচ্ছা হবে তখন গান গেও। ঐ নকল পাখিটাকে হাজার টুকরো করে ভেঙে ফেলি।”

নাইটিঙেল বলল, “তা করবেন না, সম্রাট। ওর যথাসাধ্য ও করেছে, ওর যত্ন করুন ! প্রাসাদে আমার থাকা হবে না, কিন্তু যখন খুশি আমাকে আসতে অনুমতি দিন। সন্ধ্যাবেলায় জানলার কাছে গাছের ডালে বসে আপনাকে গান শোনাব, তাতে আপনার আনন্দও হবে, কত বিষয়ে চিন্তাও করবেন। আমি দুঃখের কথা গাইব, সুখের কথাও গাইব ; ভালো মন্দ যে কথা আপনাকে জানতে দেওয়া হয় না, সব আমি গান গেয়ে শোনাব। আপনার এই ছোটো গানের পাখি জেলেদের কুঁড়ে ঘরে যাবে ; চাষীদের কুটিরে যাবে ; তারা আপনার কাছ থেকে আপনার সভাঘর থেকে কত দূরে থাকে তাদের সবার কাছে যাবে। আপনার মুকুটের চেয়েও আপনার হৃদয়টিকে আমি বেশি ভালোবাসি। কিন্তু মুকুটেরও কি সুন্দর পবিত্র ভাব। আমি আসব, এসে গান শোনাব। কিন্তু একটি কথা দিতে হবে সম্রাট ।”

সম্রাট বললেন, “যা চাও তাই হবে।” তার পর তিনিউঠে দাড়িয়ে বহুমূল্য সাজ-আভরণ নিজের হাতে পরে, সম্রাটের গৌরবে দেখা দিলেন, সোনার কাজকরা ভারী তলোয়ারটি বুকের কাছে তুলে ধরলেন।

পাখি বলল, “কথাটি হল, আপনার ছোটো পাখির কথা কাউকে জানতে দেবেন না, তা হলেই সব মঙ্গলমতো চলবে।” এই বলে নাইটিঙেল উড়ে গেল।

তার পর মৃত সম্রাটকে দেখবার জন্য অনুচররা এল। সম্রাট বললেন, “স্বপ্রভাত ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *