নাইটগার্ড

নাইটগার্ড

মধ্য জুলাইয়ের এক রাত। বেশ গরম পড়েছে। স্থির হয়ে আছে বাতাস। পরিষ্কার আকাশে নির্মল চাঁদ। তরুণ পুলিশ কনস্টেবল মিটফোর্ড নির্জন রাস্তায় কেবল নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এ ছাড়া চুপচাপ রেনার স্ট্রিট। কোনো বাড়ির জানালায় আলো জ্বলছে না। বাসিন্দারা সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

তরুণ কনস্টেবল তার ঘড়ি দেখল। রাত আড়াইটা। নিজেকে হঠাৎ সুখী সুখী লাগল তার। খুব বেশিদিন হয়নি সে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছে। আর রাস্তায় টহল দেয়া এবারই প্রথম। এর আগে অবশ্য এক বয়সী পুলিশম্যান তার সঙ্গে ডিউটি করেছে। এখন পি.সি.মিটফোর্ডকে একাকী টহল দিতে পাঠানো হয়েছে। যাক, অবশেষে সে সত্যিকারের পুলিশম্যান হতে পারল।

রাত বাজে দুটো ত্রিশ। তিনটার সময় তার থানায় গিয়ে রিপোর্ট করার কথা। এরপরে মিটফোর্ডের ডিউটি শেষ। সে বাড়ি যেতে পারবে। সত্যিকারের পুলিশম্যানের ভূমিকায় তার কাজ শেষ হতে চলেছে আধঘণ্টার মধ্যে।

ধীরে ধীরে হাঁটছে মিটফোর্ড, সতর্ক নজর বুলাচ্ছে রাস্তায়। নিজের চোখজোড়া ব্যবহার করার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তাকে। একজন ভালো পুলিশম্যান, সবসময় চোখ কান খোেলা রাখে। তারা শিখিয়েছে ওকে। পি.সি. মিটফোর্ড একজন ভালো পুলিশম্যান হতে চায়। আজ রাতে কোনোকিছুই তার সতর্ক নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। ২৬ নং বাড়ির নিচতলার জানালা দেখা যাচ্ছে খোলা। ২১ নং বাড়ির সদর দরজার বাইরে বাগান করার কিছু যন্ত্রপাতি পড়ে রয়েছে।

যত্তসব কেয়ারলেস মানুষজন! আপন মনে বলল পি.সি. মিটফোর্ড। ভাবে নির্জন রাস্তা বলে নিরাপদেই আছে। তারা চিন্তাই করছে না যে রেনার স্ট্রীটে চুরি ডাকাতি হতে পারে।

একটা মস্ত কালো বিড়াল রাস্তা পার হয়ে ১৩ নং বাড়ির দেয়ালে উঠে পড়ল লাফ মেরে। তারপর দোরগোড়ায় বসে মিটফোর্ডকে টহল দিতে দেখল। পি.সি. মিটফোর্ড মৃদু হাসল। তুমি বাড়ি চলে এসেছ, তাই না? বলল সে। আমিও শিগগির বাড়ি ফিরব। বিদায়, বিড়াল!

মনটা ভারি খুশি লাগছে মিটফোর্ডের। তার রাতের পাহারা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার মোড়ে এসেছে সে, দেখল ৩ নং বাড়ির বাইরে বিরাট একটি সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির নম্বর টুক নিল মিটফোর্ড-44B777X। গাড়ির দরজা বন্ধ এবং ঠিকঠাক জায়গাতেই পার্ক করেছে।

গুড, মনে মনে বলল সে, অন্তত একজন সাবধানী মানুষ বাস করেন রেনার স্ট্রিটে।

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকাল ৩ নম্বর বাড়িটির দিকে। বেশ বড়ো বাড়ি তবে বাগানের যত্ন নেয়া হয় না বলে আগাছা জন্মেছে এবং দরজায় রঙ লাগানোও দরকার।

আশ্চর্য! ভাবছে মিটফোর্ড। দেখে তো এটাকে বড়ো লোকের বাড়ি বলেই মনে হয়। অথচ ঘরদোর-বাগান এমন অবহেলায় ফেলে রেখেছে কেন মালিক?

মিটফোর্ড হাঁটছে লাগল। ৩নং বাড়ি পার হয়ে কিছুদূর এগিয়েছে, একটা শব্দ শুনতে পেল পেছনে। পাঁই করে ঘুরল সে। বাড়িটির সদর দরজা খোলা। এক লোক বাগানের রাস্তা ধরে গাড়িটির দিকে ছুটে যাচ্ছে। লোকটা বেশ লম্বা, পরনে কালো সুট, হাতে একটা কেস। তার চেহারা চকের মতো সাদা। দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। চোখজোড়া বিস্ফোরিত এবং কেমন উদ্ৰান্ত চাহনি। মুখের তুলনায় চোখ দুটো ড্যাবড়েবে।

এক মুহূর্তের জন্য সে বড়ো গাড়িটির পাশে থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল।

কনস্টেবল দৌড়াল তার পেছন পেছন। থামুন! বলল সে। থামুন! কে আপনি? আপনি কি এখানে থাকেন?

লোকটি কোনো জবাব দিল না। মিটফোর্ড ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল। জানে লোকটা ওর সঙ্গে দৌড়ে পারবে না।

কিন্তু রেনার স্ট্রিটের মাথায় এসে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। এক মুহূর্ত আগেও সে ওখানে ছিল। তরুণ কনস্টেবলের কয়েক হাত দূরে। পরের মুহূর্তে সে নেই হয়ে গেল। চাঁদের ঝলমলে আলোয় যতদূর দৃষ্টি যায় জনমনিষ্যির চিহ্নমাত্র নেই।

৩ নং বাড়িটির দিকে ফিরে তাকাল মিটফোর্ড। গাড়িটি এখনও ওখানে আছে। বাগানে গাছ-গাছালির ছায়া বাড়ির সদর দরজা খোলা।

মিটফোর্ড জানে তার করণীয় কী। বাড়ির ভেতরে ঢুকবে সে। ৩ নং বাড়িতে নিশ্চয়ই অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। হঠাৎ ওর ভয় লাগল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে সায় দিচ্ছে না মন। গভীর দম নিল সে। পা বাড়াল বাগান পথে। কর্তব্য পালন তাকে করতেই হবে।

সদর দরজার পরেই বড় একটা হলঘর। পুলিসি টর্চের জোরালো আলো ফেলল মিটফোর্ড হলঘরে। কয়েকখানা চেয়ার টেবিল দেখতে পেল। ধুলো পড়া। বিদ্যুত্বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করল সে। জ্বলল না। ইলেকট্রিকের লাইন কাটা।

কেউ এখানে থাকে না, ভাবল মিটফোর্ড। অনেক দিন ধরেই কেউ এখানে বাস করে না।

তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল। বাড়ির ভেতরে কোথাও কাঁদছে এক মহিলা। শ্বাস চেপে রেখে কান্নার আওয়াজ শুনল মিটফোর্ড। কান্নার রোল ওপরে উঠছে এবং নামছে তবে থামছে না। দোতলার একটা ঘর থেকে আসছে কান্নার শব্দ।

হলঘরের চারপাশে আবারও টর্চের আলো বুলাল মিটফোর্ড। হলঘরের শেষপ্রান্তে সিঁড়ি। মন্থর গতিতে ওদিকে এগোল সে। বাইতে লাগল সিঁড়ি। ধাপগুলোয় ধুলো মাখা

ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়েছে। ওর জুতোর ছাপ পরিষ্কার পড়তে লাগল ধুলোর গায়ে। পেছন ফিরে হলঘর দেখল মিটফোর্ড। টর্চ মারল মেঝেয়। ওখানেও তার জুতোর ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। ধুলোমাখা মেঝেয় শুধু ওর পায়ের ছাপ।

একটা কথা মনে পড়তেই মিটফোর্ডের কলজেটা তড়াক করে লাফ মারল। ওই লোকটা, ভাবছে সে, ওই লোকটা কয়েক মিনিট আগে এ বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়েছিল

তার পায়ের ছাপ পড়ল না হলঘরের মেঝেতে? ধুলোয় কেন শুধু আমার পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি?

ফিরে যেতে মনস্থ করল মিটফোর্ড। মনে মনে বলল, বাইরে থেকেও বাড়ির ওপর নজর রাখতে পারব আমি। রেডিও ব্যবহার করে যোগাযোগ করব থানার সঙ্গে। ডিউটি অফিসারের কাছে সাহায্য চাইব। সাহায্য না আসা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটির দিকে নজর রাখতে পারব। সার্জেন্ট টমাস বুঝতে পারবেন যে আমার সাহায্যের দরকার। আমি কী দেখেছি, তা তাকে রিপোর্ট করব। ছুটে পালানো অদ্ভুত লোকটার ব্যাপারে বলব তাকে। বলব ৩ নং বাড়ির সদর দরজা খোলা। বলব আমার মনে হলো এ বাড়িতে আরও কেউ আছে। আমি–

তবে সে চলে যেতে পারল না। মহিলার কান্না হঠাই থেমে গেছে। দোতলার বেডরুম থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার ভেসে এল।

না! না! প্লিজ, না! জোনাথন, প্লিজ ডোন্ট! প্লিজ… প্লিজ!

ভয়ানক চিৎকারটার জায়গা দখল করল এক বিকট আর্তনাদ, আআআ!

পি.সি. মিটফোর্ড ভালোই ট্রেনিং পেয়েছে। সার্জেন্ট টমাস তাকে ভালো ট্রেনিং দিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন বিপদ দেখলে কোনো পুলিশম্যানের উচিত নয় সেখান থেকে ছুটে পালানো। মিটফোর্ড জানে তার করণীয় কী। বিকট চিৎকারটি ছিল সাহায্যের জন্য আকুল আর্তনাদ।

কয়েক লাফে সিঁড়ি টপকাল কনস্টেবল। বেডরুমের দরজা বন্ধ। সে জোরে লাথি কষাল দরজায়। একবার…দুইবার… তিনবার। ঝড়াং করে খুলে গেল কপাট।

বেগে ভেতরে ঢুকল মিটফোর্ড। কামরার সর্বত্র দ্রুত বুলাল টর্চের আলো। একটি খালি চেয়ার একটি ড্রেসিং টেবিল

উল্টানো একটি বেডসাইড টেবিল এবং একটি বিছানা চোখে পড়ল। বিছানায় স্কুপ হয়ে আছে বেডক্লথ। মিটফোর্ড ধীরপায়ে হেঁটে গেল ওদিকে। হয়তো কেউ ভারী বেডকুথের স্কুপের নিচে ঘাপটি মেরে আছে।

ডান হাত থেকে বাম হাতে টর্চ নিল মিটফোর্ড। বিছানার ওপর ফেলে রাখল আলো। তারপর বেডক্লথগুলো টান মেরে সরিয়ে ফেলল।

এক মহিলার লাশ তাকিয়ে আছে মিটফোর্ডের দিকে। মহিলার খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আছে কালো কুচকুচে জিভ। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে যাচ্ছে। মহিলার হলুদ রঙের চামড়া থেকে বিশ্রী, গা গোলানো একটা গন্ধ আসছে।

মাই গড! চেঁচিয়ে উঠল মিটফোর্ড। আমার প্রথম রাতের পেট্রলের দিনেই হত্যাকাণ্ড। আর আমি কিনা খুনিকে পাকড়াও করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম!

বেডক্লথ দিয়ে বীভৎস চেহারার মরা মুখটা ঢেকে দিল সে। বেডরুমের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল মিটফোর্ড। ৩ নম্বর বাড়ির বাইরে এসে রেডিওতে ডিউটি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করল সে।

পি.সি. মিটফোর্ড বলছি, সার্জেন্ট। আমি রেনার স্ট্রিটে ৩ নং বাড়ির সামনে রয়েছি। এখানে একটি মার্ডার হয়েছে। আমি নিশ্চিত এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আমি খুনিকে দেখেছি তবে ধরতে পারিনি। সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা। ষাটের কাছাকাছি বয়স। পরনে ছিল কালো সুট। হাতে ছোটো একটি ডাক্তারি ব্যাগ। মৃতজন একজন মহিলা। সে–

সার্জেন্ট টমাস ওকে বাধা দিলেন। এখুনি থানায় রিপোর্ট করো, মিটফোর্ড। তোমার পেট্রল রাত তিনটায় শেষ হওয়ার কথা। এখন প্রায় তিনটা বাজে।

কিন্তু, সার্জেন্ট, এ বাড়িতে একজন মৃত মহিলা পড়ে আছেন আর খুনি পালিয়ে যাচ্ছে। আমার দরকার–

কথার মধ্যে কথা বোলো না, মিটফোর্ড। যা করতে বললাম করো। ৩ নম্বর বাড়ির দরজা বন্ধ করো। তারপর এখানে এসে রিপোর্ট করো। তোমার মেসেজ আমরা পেলাম এবং গ্রহণ করলাম।

রেডিওর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সার্জেন্ট টমাসের কথা শেষ হতেই। পি.সি. মিটফোর্ড ৩ নম্বর বাড়ির দরজা বন্ধ করল। তালা লাগাল। তারপর পরীক্ষা করে দেখল ঠিকঠাক লেগেছে কিনা। নাহ, ঠিক আছে। তারপর অস্থির চিত্তে সে পা বাড়াল থানায়।

.

বসো, মিটফোর্ড। নাও, চা খাও, টেবিলের ওপর দিয়ে চায়ের কাপ কনস্টেবলের দিকে ঠেলে দিলেন সার্জেন্ট টমাস। এখন তুমি আমাকে বললো কী ঘটেছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমি তোমাকে বাধা দেব না।

তিনি চুপচাপ শুনে গেলেন কনস্টেবলের গল্প। তারপর বললেন, ঠিক আছে। এখন কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দাও। সবার আগে বলো আজ কতারিখ?

১৩ জুলাই, সার্জেন্ট। কিন্তু কেন–?

স্রেফ আমার প্রশ্নের জবাব দাও, মিটফোর্ড। আজ রাতে অনেক কিছু ঘটেছে যা তুমি বুঝতে পারেনি। অনেক কিছু আমারও বোধগম্যের বাইরে। তবে তোমার চেয়ে কিছু জিনিস আমি বেশি জানি।

কিন্তু ওই লোকটা, সার্জেন্ট। আমি রেনার স্ট্রিট ধরে লোকটাকে পালিয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের পুলিশ কার নিয়ে ওর খোঁজ নেয়া উচিত।

পুলিশ ওর খোঁজ পাবে না, মিটফোর্ড। কেউই ওর সন্ধান পাবে না।

কিন্তু সার্জেন্ট–

একটু চুপ করে আমার কথা শুনবে? এ গল্পটা খুব সহজ সরল নয়। তুমি বারবার বাধা দিলে আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না সবটা।

সরি, সার্জেন্ট।

এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখো মহিলার চিৎকার যখন শুনলে লোকটা তখন কোথায় ছিল?

সে… সে … রাস্তার কোথাও ছিল। ওখানেই তাকে আমি দেখি। সে বাড়িতে ছিল না।

আর যে মহিলাকে তুমি দেখেছ বলে ভেবেছ, মিটফোর্ড, সে–?

ভেবেছি, সার্জেন্ট! ভাবব কেন? ওকে স্বচক্ষে দেখলাম তো!

ঠিক আছে, মিটফোর্ড। উত্তেজিত হয়ো না। তুমি বলছ মহিলা ছিল মৃত?

হ্যাঁ, শান্ত গলায় বলল মিটফোর্ড। তাকে দেখাচ্ছিল…দেখাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ভয় পেয়ে যাই, সার্জেন্ট।… তার জিভ বার হয়ে ছিল…আর ওই বিকট গন্ধ…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি। বলেছ তো তুমি। সে কতক্ষণ আগে মারা গেছে বলে তোমার ধারণা?

তরুণ পুলিশ কনস্টেবল জবাব দিল না। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।

বলো, মিটফোর্ড। তোমার নিশ্চয়ই কোনো ধারণা আছে। তুমি যখন তাকে দেখলে সে কি ওই সময়েই মারা গিয়েছিল? রাস্তায় যে লোকটাকে তুমি দেখেছ সে কি ঠিক ওই সময়েই মহিলাকে হত্যা করেছিল?

না, সার্জেন্ট, মিটফোর্ড আবার শিরদাঁড়া খাড়া করল চেয়ারে। না, মহিলা তখন মারা যায়নি। আর আমি মহিলাকে দেখার আগে আগেও লোকটা তাকে হত্যা করেনি।

তুমি কী করে জানো?

কারণ… কারণ মহিলা যখন কাঁদছিল আর চিৎকার করছিল তখন সে ওই বাড়িতে ছিল না। আর- ওহ, মাই গড–মহিলা তো মারা গেছে বহু দিন। আগে। আমি যে জিনিসটা দেখেছি–

ঠিক আছে, মিটফোর্ড। ঠিক আছে। আজ রাতটা তোমার খুব খারাপ গেছে। তবু বাকি ঘটনা তোমার জানা থাকা উচিত। রেনার স্ট্রিটে তুমি যে লোককে দেখেছ সে-ও বহুবছর আগে মারা গেছে। না, প্রশ্ন কোরো না। আমি সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারব না। আমি শুধু তোমাকে যা ঘটেছে তা-ই বলতে পারব। তুমিই প্রথম পুলিশম্যান নও যে এ ঘটনা দেখেছ। আজকের এই দিনে আগেও এমনটি ঘটেছে। শুনে কিছু বোধগম্য হলো?

মাথা ঝাঁকাল মিটফোর্ড। অন্তত বুঝতে পারলাম আমি পাগল হয়ে যাইনি, সার্জেন্ট। অন্যান্য পুলিশরাও যদি একই ঘটনা দেখে থাকে–

দেখেছে! এখন শোনো। জনৈক ডাক্তার–ডা. জোনাথন টেনিসন এবং তাঁর স্ত্রী রেনার স্ট্রিটে ৩ নম্বর বাড়িতে বাস করতেন। ডাক্তার হিসেবে সুখ্যাতি ছিল তাঁর। সবাই তাকে পছন্দ করত। তবে তাঁর স্ত্রী ছিল খুবই ঝগড়াটে স্বভাবের। আর প্রচুর মদ খেত। মাতাল হয়ে প্রায়ই ডাক্তারের গায়ে হাত তুলত। একবার সে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করে। এক গভীর রাতে ডাক্তার এক অসুস্থ লোককে দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। মহিলা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়েছিল। সে কান্নাকাটি করছিল, চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। ডাক্তার ছিলেন বেজায় ক্লান্ত এবং রোগীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্ত্রীর মাতলামি তাঁকে ক্রুদ্ধ এবং হিংস্র করে তোলে। তিনি মোটেই হিংস্র স্বভাবের ছিলেন না, মিটফোর্ড। কিন্তু সেবার তিনি খুবই ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন। মহিলা বিছানায় শুয়ে তাঁর স্বামীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল। সহ্য করতে না পেরে ডাক্তার তার গলা টিপে ধরেন। শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায় মহিলা। স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন বুঝতে পেরে উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান ডাক্তার।

দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব রইল।

ডাক্তারের কী হলো, সার্জেন্ট? অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ হলো মিটফোর্ডের প্রশ্নে।

তিনি পাগলের মতো ছুটছিলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে লণ্ডন রোডে চলে আসেন। রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পড়ে যান গাড়িঘোড়ার মাঝখানে। একটি ভারী লরি তাকে চাপা দেয়।

আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল মিটফোর্ড।

এসব কবে ঘটেছে, সার্জেন্ট? জিজ্ঞেস করল সে একসময়।

দশ বছর আগে। জুলাইয়ের ১৩ তারিখ, রাত আড়াইটার দিকে।

আর একটা সাদা গাড়ি যে দেখলাম? গল্পের সঙ্গে ওটার কী সম্পর্ক?

কোনো সম্পর্ক নেই। ওটা ২২ নম্বর বাড়ির মালিকের গাড়ি। সে গাড়িটি ৩ নম্বর বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ওখানকার রাস্তা চওড়া, তাই। ডাক্তার এবং তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িতে আর কেউ বাস করে না।

চুপ করে গেলেন সার্জেন্ট টমাস। তারপর বললেন, তুমি ডিউটি বুকে তোমার রিপোর্ট লিখে যাও, মিটফোর্ড। তারপর বাড়ি যাও। তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে।

একটি কলম নিল মিটফোর্ড। ৩ নম্বর বাড়িতে যা দেখেছি তা নিয়ে কি রিপোর্ট লিখব, সার্জেন্ট?

না, বললেন সার্জেন্ট টমাস। ও নিয়ে তোমাকে কিছু লিখতে হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *