নষ্ট ছেলে
২৩/৮/৫০
চরিত্র
এরতাজুল করিম
জাহাংগীর
এম্রাণ
আমিন
খোকা
পুলিশ কয়েকজন
মা
আপা
প্রথম দৃশ্য
কাল : ১৯৫০ ইং
স্থান : রাজধানী।
দৃশ্য: (বেশি পাকা কম কাঁচা বড় এলোমেলো চুল। লম্বা সাধারণ শরীর। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক এম্রাণ, আমিনের চাচা, বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় মোটা একটা বইয়ের ভোলা পাতায় ডুবে আছেন। কোমর অবধি একটা পুরু শালে ঢাকা রয়েছে। মেঝেয় উপুড় হয়ে বসে ইংরেজি খবরের কাগজের ছবি দেখছে হা-প্যান্ট পরা আমিন, বয়স বার তের। রোগা ঢ্যাংগা। চোখে চশমা। বয়সের তুলনায় ওর চোখ মুখের রেখা পেশী অদ্ভুত রকম অচঞ্চল স্থির গাঢ়)
আমিন : চাচা!
এম্রাণ : উঁ।
আমিন : মার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে চাচা।
এম্রাণ : হুঁ।
আমিন : আচ্ছা চাচা, মাকে বলে বুঝিয়ে কিছুতেই কি থামান যায় না?
এম্রাণ : না।
আমিন : মা সেই সকাল থেকে কেবল কাঁদছে কাঁদছে! ঈদের চাঁদ দেখে সন্ধে বেলা মা যখন মোনাজাত করছিল, আমি দেখেছি, মার চোখের পানি কনুই পর্যন্ত গড়িয়ে নামছে। কাঁদছে আর কেবল আল্লাহকে ডাকছে।
এম্রাণ : (একটু বিরক্ত) আল্লাহকে ডাকবে না তো কাকে ডাকবে? কাউকে ডাকতে হবে তো। আল্লাহকে ডাকে বেশ করে। পুলিশ সাহেবকে ডাকলে তিনি কি তোমার বুনো আপাকে তোমার মায়ের কোলে তুলে দিয়ে যাবেন। তারা তো খবরের কাগজে ইস্তাহার দিয়েছে, তোমার আপার ফাপানো কালো চুলের ঝুটি ধরে যে ওকে কয়েদখানার দুয়োরে পৌঁছে দেবে তার এনাম মিলবে দু’হাজার টাকা। তোমার মার বন্দুক আছে যে আল্লাহকে ডাকবে না?
আমিন : মার কান্না দেখলে যে আমারও কান্না পায়।
এম্রাণ : কাঁদতে তোমাকে বারণ করেছে কে।
আমিন : আপা। বলেছে, কাঁদলে মানুষ বোকা হয়ে যায়। না বুঝলেই কান্না পায়। বুঝলে চোখের পানি নাকি শুকিয়ে যায়। চোখের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে, দাউ দাউ করে।
এম্রাণ : আপার কথা দেখছি সব একেবারে হেফজ করে মুখস্থ করে রেখেছে। তা আমাকে কেন, মাকে শোনাতে পার না এগুলো থামাতে পারো না মার কান্না!
আমিন : মা বোঝে না, বুঝতে চায় না।
এম্রাণ : হুঁ। কেউ কিছু বোঝে না। শুধু বোঝ তোমরা আর তোমাদের আপা। এই রাত শেষ হলে কাল সকালে ঈদ। তোমার আপা তোমার মায়ের বড় মেয়ে, প্রথম সন্তান। পুলিশের তাড়া খেয়ে হয়তো কোনো জোলে জংলা ডোবার পাশে বসে শীতে কাঁপছে, মাথায় তেল পড়েনি তিনদিন, হাত খালি হয়ত দুপুরের খাওয়াই হয়নি, হয়ত এতক্ষণে ধরা পড়ে মার খাচ্ছে, কত কিছুই হতে পারে। ঈদের দিনেও তোর মা সে মেয়ের মুখ দেখতে পাবে না–
আমিন : পাবে না যে তার কি মনে আছে? আগে থেকে কাঁদবে কেন?
এম্রাণ : কি বললি?
আমিন : কিছু না।
এম্রাণ : হুঁ। শয়তান কোথাকার। কোথাথেকে, মানে কখন আসবে- তুই কি করে থাক থাক। দরকার নেই এসব কথা শুনে। আহাম্মক কোথাকার, ঢ্যাডড়া পিটিয়ে এগুলো রাজ্যশুদ্ধ লোক ডেকে শোনান হচ্ছে। কে শুনতে চাইছে এগুলো তোর কাছে? চলে যা চলে যা এখান থেকে।
আমিন : আচ্ছা।
এম্রাণ : আর শোন। যদি অনেক রাতে আসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিস। একটু দেখব। থাক থাক দরকার নেই। তুলতে হবে না আমাকে। ঘুম কি ছাই আসবে?
(জাহাংগীরের প্রবেশ। স্বাস্থ্যবান বেঁটে যুবক। পরনে কাবুলী পায়জামা, গরম শেরওয়ানী! মাথায় পশমের টুপী।)
জাহাঙ্গীর : আলামো আলাইকুম, খালুজান কোথায়?
এম্রাণ : আরে জাহাংগীর যে! গত সাত আট দিন একেবারে দেখাই নেই, ছিলে কোথায়?
জাহাঙ্গীর : একটা জরুরী কাজে কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম।
এম্রাণ : কেন ওয়াজ করতে না কি? দেখো তোমাদের কিন্তু আমি বড় ভয় করি। মোল্লারা দেশশুদ্ধো চাঁচামেচি করেও আজকাল আর আমাদের বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। সববাই ওদের আলখাল্লা আল্লা করে ভেতরের ন্যাংটা চেহারাটা দেখে নিয়েছে। কিন্তু তোমাদের এই নতুন আক্রমণ, বি এ; এম এ শানানো নতুন কলাকৌশল, দেশটাকে ঘায়েল না করে ছাড়বে না।
জাহাঙ্গীর : ছেলেপুলের সামনে আপনি এগুলো কি বলছেন?
এম্রাণ : কাকে ছেলেমানুষ বলছ? আমাকে না নিজেকে? আমিনকে ছেলেমানুষ বোলো না। ওর বয়স কত জান? আমার বাহান্ন বৎসর এটা ওর, তোমার আটাশ সেটাও ওর, নতুন পৃথিবীর কয়েক হাজার বছরের অতীত তাও ওর, সেই সংগে ওর নিজের বার বছর। সব যোগ করে তবে ওর বয়স। ছেলে মানুষ কি আর এ দুনিয়াতে আছে? সব বুড়ো, বুড়ো হয়ে গেছে। ছোটো বেলায় আমরা শেখানো বুলি গলা ফাটিয়ে কেরাত করে পড়তাম। এরা আজকাল সব এত লায়েক হয়ে গেছে যে শব্দ করতে লজ্জা পায়। মনে মনে পড়ে, মনে মনে ভাবে, মনে মনে বোঝে। সববাইকে সব কথা বলে না। চুপি-চুপি নিজের পৃথিবী তৈরি করে তাতে নিঃশব্দে ঘোরা ফেরা করে। বড় সাংঘাতিক এরা।
(এরতাজুল করিম সাহেব, আমিনের বাবা, প্রবেশ করেন। বয়স পঞ্চাশের ওপর। শক্ত শীর্ণ শরীর। দাড়ি ও গোঁফ পরিচ্ছন্ন করে ছাঁটা। পরনে পাঞ্জাবী ও পায়জামা। গায়ে শাল। হাতে একটা প্যাকেট টেবিলের ওপর রাখেন।)
এরতাজ : ওপর থেকে দেখলাম বাইরে কতগুলো খাকী পোশাকপরা লোক ঘোরাফেরা করছে। ওরা কারা জাহাংগীর? তোমার পেছনে পেছনে এল মনে হলো।
জাহাঙ্গীর : ঠিক আমার সংগে আসেনি। তবে দোর গোড়াতে ওদের সংগে আমার দেখা হয়েছে। গোয়েন্দা-পুলিশের লোক। আপনার সংগে দেখা করতে চায়।
এম্রাণ : গুণ্ডাপুলিশ?
জাহাঙ্গীর : রাশেদার কোনো ব্যাপার হয়ত?
এরতাজ : সে খোঁজ আমার কাছে কেন?
জাহাঙ্গীর : আপনি তার বাবা।
এরতাজ : ছিলাম। এখন নেই! আল্লা রসুলের রাহে নয়, বাপ-মায়ের কল্যাণের জন্য নয়, যে মেয়ে কতগুলো বে-শরিয়তী স্বদেশী বুলির মোহে বেহায়া বে-আব্রু হয়ে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, –এরতাজুল করীম তেমন মেয়েকে কন্যা বলে স্বীকার করে না।
জাহাঙ্গীর : ওরা এ বাড়ি খানা তল্লাশ করতে চায়। ওরা সন্দেহ করছে এই মুহূর্তে হয়ত এই বাড়িরই কোনো আনাচে কানাচে ও লুকিয়ে আছে।
(স্তব্ধতা)
এরতাজ : ওদের আসতে বলে দাও গে।
এম্রাণ : হুকুমপত্রটা একবার দেখবে না?
এরতাজ : দরকার নেই। আমিন তুই গিয়ে ওদের আসতে বল। আর অমনি তোর মাকে বলিস বোরখাটা নিয়ে এ-ঘরে চলে আসে যেন।
(আমিন বেরিয়ে যায়)
আমার সারা জীবনের গড়া স্বপ্ন, চৌদ্দ পুরুষের রক্তে তাজা খান্দান- সব এ বাড়ির প্রতি ইটের সংগে গাঁথা হয়ে আছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে খুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আজ সেগুলো ঘাটবে। এত বড় বেইজ্জতীর আগে আমার মৃত্যু হয় নি কেন? বিষ জহর খেয়ে মরে যেতে পারল না মেয়েটা।
এম্রাণ : আবোলতাবোল বোকো না। চালের গুদাম থেকে রোজ তোমার আজকাল যা আয় হচ্ছে তাতে খান্দানে সোনার পাহাড় গড়ে উঠতে আর বেশি দেরী নেই। পুলিশের খানাতল্লাশী হাজার বার ঘুরে ফিরে গেলেও ওর চূড়া ছুঁতে পারবে না। তার জন্য ভয় পেয়ো না।
জাহাঙ্গীর : রাশেদা কি সত্যি বাড়ির মধ্যে রয়েছে নাকি?
(মার প্রবেশ। বোরখা পরা, মুখ খোলা। বয়স তার চেয়ে বেশি চিন্তার রেখায় রেখায় ক্ষতবিক্ষত বিক্ষুব্ধ মুখ্যবয়ব।)
মা : কোথায়? রাশি এসেছে? কোথায়?
আমিন : চুপ করো মা, চুপ করো! আপা এ তল্লাটেও নেই। চিৎকার করে বিপদ ডেকে এনো না।
এরতাজ : কি করবে সে মেয়েকে দিয়ে। আমার টাকা চুরি করে তুমি তাকে পাঠাও সে আমি জানি। আমাকে লুকিয়ে তুমি আজ রাতেও যে খাবার তৈরি করে ওর কাছে পাঠাতে চেষ্টা করবে, সে তোমার চলাফেরা চাহনী দেখে আমার বুঝতে বাকি নেই।
এম্রাণ : আস্তে! আস্তে কথা বলো! দস্যুগুলো সব যে এখন বাড়ির ভেতরে ঘোরাফেরা করছে।
এরতাজ : আমি ফিসফিস করে কথা বললেও আগামীকাল খবরের কাগজে খবর বন্ধ হয়ে থাকবে না। আমার বাড়িতে পুলিশ! আর এখনও রাশেদার মা
মা : আমি মা!
এরতাজ : কিন্তু, কিন্তু সে কি আজ মা বলে তোমার গলা জড়িয়ে তোমাকে চুমু খায়? না, আর কোনোদিন সে তোমাকে আদর করবে? পনের বছর আগে কবে একটু আধ আধ বুলিতে মা বলে ডেকে তোমার মুখ খামচে ধরেছিল সেই স্মৃতিতে এখনও অন্ধ হয়ে আছ, কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যাচ্ছ।
মা : আমি মা!
এরতাজ : ভুলে যাচ্ছ যে রাশেদা তোমার বড় মেয়ে হলেও আমিন তোমার বড় ছেলে। তুমি ওকেও লেলিয়ে দিচ্ছ বড়বোনের জাহান্নামের পথে।
জাহাঙ্গীর : আমিনের এত গুণ তা তো জানতাম না।
এম্রাণ : এরতাজ! মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার! চুপ করে বসে থাকতে পারছ না?
এরতাজ : পাগল হইনি এখনও কিন্তু পাগল হয়ে যাব আমি! হীরের টুকরো ছেলে আমার আমিন। মার খেয়েছে তবু কোনো দিন মিথ্যে কথা বলেনি। অন্ধকারকে কোনোদিন ভালবাসে নি। এক রত্তি শিশু, তবু ও বিশ্বাসের মর্যাদা দান করতে জানে ঋষির মতো! গুদামের টাকা যে রাতে আমার সিন্দুকে তুলে রাখতে ভয় পেয়েছি সে রাতে ওর কাছে টাকা রেখে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে যেতাম। জানতাম ভুলেও চোর ডাকাত ওর ঘরে ঢুকবে না, ঢুকলেও ওর কাছ থেকে টাকা নেয়া সোজা ব্যাপার হবে না!
(আমিনের প্রবেশ। মুখচোখ চঞ্চল)
মা : কি হয়েছে? কি করছে ওরা? খোকা বুবি কোথায়?
আমিন : সব ঘর ওলট-পালট করে দেখছে ওরা। খোকা বুবি ওদের সঙ্গে ঘুরছে। আমি কাঁদতে বারণ করেছি ওদের।
এম্রাণ : ভাল করেছ।
(মা নিচু গলায় আমিনকে কি যেন বলে।)
এরতাজ : আবার নতুন কি শেখাচ্ছো ওকে? মায়ে ঝিয়ে মিলে ছেলেটাকে একেবারে চোর ডাকাত না বানিয়ে এখনই কবর খুঁড়ে পুঁতে ফেল না কেন? আমার আড়ালে অন্ধকারে সুড়ং পথে চলতে ফিরতে শিখেছে। দুদিন পরে মিছে কথা বলতে আটকাবে না। ধোঁকা দেবে, ফাঁকি দেবে, চুরি করবে যেমনটি ঠিক চাইছ সবই হবে। কি নতুন পরামর্শ দিচ্ছিলে?
মা : ক্ষিদে লাগলে রান্নাঘরে গিয়ে যেন খেয়ে নেয়।
(আমিন মার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবা এবং চাচাও। হঠাৎ বাড়ির অন্যপ্রান্ত থেকে একটা কোলাহল। “ধর ধর” চিৎকার করতে করতে দুটো লোক ছুটে আসছে। আমিনের মুখ বেদনায় কুঞ্চিত। খোকা, আমিনের ছোট ভাই, ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকেই মাকে জড়িয়ে ধরে। মা মুখের পর্দা টেনে দেয়। পুলিশের পোশাকে একজন প্রায় সংগে সংগেই প্রবেশ করে।)
পুলিশ : এদিকে এস। হাতে কি তোমার? কি নিয়ে পালাচ্ছিলে? দেখি। এস বলছি এদিকে।
এরতাজ : চমৎকার! বড়বোন দুশ্চরিত্রা! ছোটটা চোর। মা বলে তোমার গর্ব হচ্ছে না ওদের জন্য? আর কাঁদবে না ওদের জন্য? গর্জন করে থোকা! বেরিয়ে আয় এদিকে! (বুবিও ঘরে ঢুকছে। ছ’সাত বছর। ফর্সা মোটা আদুরে মিষ্টি মুখ। ঝাকড়া কোঁকড়ানো চুল। কপালের ওপর পেঁচিয়ে পড়ে থাকে। একটা চোখ প্রায় তার আড়ালে লুকানো থাকে। কাজল কালো বড় বড় টলটলে চোখে সব দেখছে। এক হাতে মায়ের বোরখার প্রান্ত মুঠ করে ধরে রাখে।
পুলিশ : (আমিনকে দেখিয়ে) ঐ খোকাবাবুর বালিশের নিচ থেকে কি যেন নিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।
এরতাজ : হাত দেখি তোমার। দু’হাত দেখাও।
(খোকা মুঠ খুলে সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। হাত খালি।)
পুলিশ : কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই।
এরতাজ : ইন্সপেক্টর সাহেব কোথায়?
পুলিশ : সব তল্লাশী হয়ে গেছে। কিছু নেই হুজুর। উনি বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন।
এরতাজ : (পুলিশের হাত থেকে বেতের ছড়িটা তুলে নিয়ে) এদিকে এস খোকা! আমার বাড়ির ওপর শয়তানের আছর পড়েছে। দুধের ছেলেও রেহাই পায় নি। দেখি চাবুকে শায়েস্তা হয় কি না। বাইরের ঘরে চলো। ইন্সপেক্টর সাহেবের সামনেই তোমার বিচার হবে। জাহাংগীর তুমি তোমার খালাম্মাকে ওপরে নিয়ে যাও।
(জাহাংগীর ও বুবিসহ আম্মার প্রস্থান। অন্যদিক দিয়ে এরতাজুল করিম সাহেব, খোকা ও পুলিশ অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।)
এম্রাণ : খোকা কি জিনিস চুরি করে পালাচ্ছিল?
আমিন : খোকা চুরি করে নি।
এম্রাণ : ওর হাতে কি ছিল?
(নেপথ্যে খোকার পিঠে চাবুক পড়তে শুরু করেছে? দম্কা দম্কা এক একটা চিৎকার কান্নায় ভারী হয়ে উঠে তীক্ষ্ণ রেখায় চারদিক গড়িয়ে পড়ছে। ঘরে স্তব্ধতা। প্রতি চিৎকারে আমিন আর তার চাচা যেন শিটিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে।)
আহাম্মকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছে কেবল! এত চিৎকারই যদি করবি তবে সত্য কথা বলে গায়ের চামড়া বাঁচাস না কেন?
আমিন : তবু কি চামড়া বাঁচতো? ওর বাঁচলেও সকলের বাঁচতো না। আর সেটা সত্য কথাও হতো না। কেউ না শিখিয়ে দিলে এত বড় মিথ্যা কথা খোকা কোনোদিন বলতে পারবে না।
এম্রাণ : চুপ কর। দর্শনতত্ত্ব শেখাসনে আমাকে। এইটুকুন ছোঁড়ার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে, সত্য কি, কোটা বড় আর কোটা ছোট সত্য! মেলা বকেসিস, এখন থাম।
(উত্তেজিত ও ক্লান্ত বাবার প্রবেশ)
এম্রাণ : কি চুরি করে পালাচ্ছিল?
এরতাজ : আমিনের বালিশের নিচ থেকে পয়সা চুরি করে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে এতক্ষণ রা করেনি। ভাল শিক্ষা দিয়েছি। পিঠের এক আধ জায়গা হয়ত একটু কেটে গিয়ে থাকবে। কাটুক। একটু শিক্ষা হওয়া দরকার।
এম্রাণ : (আমিনকে) ডেটল দিয়ে মুছে পরে সারা গায়ে আয়োডেক্স মালিশ করে দিস।
এরতাজ : এই টাকার প্যাকেটটা তোমার কাছেই রেখো আজ রাত। সিন্দুকের ডালাটা কেমন যেন যা হয়ে আটকে গেছে। কিছুতেই খুলতে পারলাম না। তা কাল দিনে দেখা যাবে।
(টাকার প্যাকেটটা আমিনকে দিয়ে বাবার প্রস্থান।)
আমিন : আপনি বিশ্বাস করেন যে খোকা চুরি করেছিল?
এম্রাণ : অন্যের শ্রম চুরি করলেই মুনাফা হয়। এটা হলো অর্থনীতির মূল কথা। আর তোমার বাবার ঐ থলিটার মধ্যে শুধু মুনাফার টাকা, একদিনের মুনাফা, হয়ত কয়েক হাজার। এ ছাড়া অন্যান্য চুরির যে সব রকমফের আছে তার কোনটায় থোকা পড়ে বা পড়ে না তা তুমি সত্য কথা না বললে আমি বুঝতে পারব কি করে?
আমিন : এগুলো হলো মোটা মোটা বইয়ের কথা চাচা, বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। আচ্ছা সত্য কথা না বললে সত্যি মানুষ ছোট হয়ে যায়?
এম্রাণ : (তীক্ষ দৃষ্টিতে আমিনকে দেখে) তোমার জন্য জাবাব- না। শুতে যাও এবার। খোকার পিঠে ওষুধ লাগাতে হবে আবার।
আমিন : কাল সকালে উঠেই আমার ঈদের উপহার চাই কিন্তু। আর যাই দেন খেলনা দেবেন না যেন!
(বলতে বলতে চলে যায়)।
এম্রাণ : প্রস্থানরত আমিনকে লক্ষ্য করে) এই ক্ষুদে মানুষগুলোর সত্যি বয়স কত? মাত্র সাত পাঁচ বার? না সাত পাঁচ বার হাজার হাজার!
(বইটা বন্ধ করে ঘরের বড় আলোটা নিবিয়ে দেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোর নিচে, বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে, কাৎ হয়ে শুয়ে পড়েন।)
পর্দা
.
দ্বিতীয় দৃশ্য
(আমিনের পড়ার ঘর। শোবার ঘরও। টেবিলে বই সাজানো। পাশে দুটো চৌকি। একটা আমিনের অন্যটা খোকার। খোকা টেবিলের ওপর বসে আছে, পিঠের কাপড় তোলা! আমিন তাতে আস্তে আস্তে আয়োডেক্স মাখাচ্ছে। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে কখনও কখনও বেদনায় মুখ কুঁচকে এক আধটু শব্দও করছে। বুবি আয়োডেক্সের কৌটাটা খুলে ধরে আছে। কখনও কখনও আলগোছে খোকার পিঠে আংগুল বুলিয়ে নিচ্ছে।)।
বুবি : খুব লেগেছে খুকু ভাই, না?
খোকা : একটু।
আমিন : কাগজের টুকরোটা লুকোলি কি করে?
খোকা : মার হাতে দিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি বলে দেয়ার পরই আমি ঘুরতে ঘুরতে তোমার ঘরে ঢুকি। ওরা যখন তোমার বই ঘাটছিল আমি তখন তোমার বালিশ উল্টে কাগজের টুকরোটা তুলেই বেরিয়ে পড়ি। কি কাগজ ছিল ওটা?
আমিন : আপনার চিঠি। আজ রাতে আপা একবার আসবে। পুলিশ হয়তো কিছু একটা গন্ধ পেয়েছে।
বুবি : আপা আসবে আজ?
আমিন : আর কেউ জানে না। শুধু আমরা তিনজন। কাল যে ঈদ। আপাকে তো আর গুণ্ডাপুলিশ দিনের বেলায় আসতে দেবে না, আপা তাই রাতে আসবে আমাদের দেখতে।
বুবি : যদি গুণ্ডাপুলিশ কেউ দেখে ফেলে?
আমিন : আমরা পাল্টা পাহারা দেব। হয়ত এতক্ষণে আপা টের পেয়ে গেছে যে গুণ্ডাপুলিশ আশেপাশে মাটি খুঁকে বেড়াচ্ছে।
বুবি : আমিও পাহারা দেব।
খোকা : হ্যাঁ, তাহলেই হয়েছে। অন্ধকারে কিছু নড়তে দেখলেই চিৎকার করে কেঁদে পাড়া মাথায় করে তুলবে, খুব পাহারা দেয়া হবে তখন!
বুবি : আমি ভয় পাবো ভাইয়া? আমি পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। একবার কেঁদেছিও তখন? আমিও পাহারা দেব।
আমিন : বেশ। শোন খোকা। তুমি চুপিচুপি গিয়ে ভেতর থেকে সদর দরজাটা খুলে রাখ, কোনো শব্দ হয় না যেন। তারপর চাচার ঘরে ঢুকে জানালার কাছে। গিয়ে বসে থাক।
খোকা : যদি চাচা কিছু বলেন?
আমিন : কোন শব্দ করবি না। চাচা কিছু বলবেন না। পাশের গলির মুখে গুণ্ডাপুলিশ কাউকে দেখলে ছুটে এসে আমাকে বলবি।
খোকা : (গায়ে গরম কাপড় চড়িয়ে লাফিয়ে টেবিল থেকে নেমে স্যালুট করে) যো হুকুম! উঃ! পিঠ কি রকম চড়চড় করছে এখনও!
(প্রস্থান)
আমিন : (বুবিকে) এই কম্বলটা ধর। এই দরজা দিয়ে আমার পেছনের ঘরের জানালার ওপর কম্বল বিছিয়ে বসে থাক। দরজার শেকল নামিয়ে রাখবি। ঠাণ্ডা লাগাসনে গায়ে। বেশি ভয় করলে আমাকে ডাকিস, আমি এখান থেকেই চারদিকে নজর রাখব।
বুবি : আমি জানালার শিক ধরে বসে থাকব। আমি জানি লোহা ধরে থাকলে ভূত জীন কেউ কিছু করতে পারে না। দেখো আমি একটুও ভয় পাবো না।
(প্রস্থান)
আমিন : (একা, জানালার কাছে, আপন মনে) রাত তো কম হয়নি এখনও এল না? এরপর রাস্তায় বেরুলে আরও বেশি সন্দেহ হবে লোকের? না, আমার ঘরের। আলোটা একেবারে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। আলোটা নিভিয়ে দেয়াই ভাল।
(আলো নিভে যায়। একেবারে অন্ধকার। কিছু বিরতি অন্ধকার ধীরে ধীরে একটু হালকা হবে এবং একটা মৃদু আলোর আভায়। ছায়াছবির মতো দেখা যাবে আমিনের দেহসীমা রেখা, জানালার কাছে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিঃশব্দে ছুটে ঘরে ঢুকে খোকা।)
খোকা : আমি খোকা। উল্টো দিকের পানের দোকানের বন্ধ ডালাটা হঠাৎ খুলে যায়। সংগে সংগে ভেতর থেকে ছায়ার মতো কি একটা যেন লাফিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। তারপর আর কিছুই দেখতে পেলাম না। অন্ধকার আর কুয়াশায় কিছু দেখা গেল না।
(দু’জনেই জানালার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে! নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে একটি ছায়ামূর্তি।)
ছায়ামূর্তি : আলোটা জ্বালো ওকে শুইয়ে দিই।
খোকা : কে?
(আমিন সুইচ টিপতেই ঘরময় আলো ছড়িয়ে পড়ে। দেখা গেল দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘাংগী তম্বি, কালো সিকের বোরখায় শরীর ঢাকা, মুখের কাপড় ওঠান। কোলে গভীর ঘুমে অচেতন বুবি।)
খোকা : আপা! আপা! আপা!
আপা : দুর্গের দরজায় দেখি বাহাদুর পাহারাদার নিজেই ঘুমে অচেতন। কি আর করা, অগত্যা পাহারাদারকে কোলে তুলে চুরি করে নিয়ে এলাম। বিছানাটা ঠিক করে দে, শুইয়ে দিই।
(দু’ভাই এগিয়ে যায়, বিছানা ঠিক করতে থাকে)
এই বিছানাটাও ঠিক করে দে। ঠাণ্ডায় হাত পা জমাট বেঁধে গেল। আমিও একটু লেপ মুড়ে না বসলে জমে বরফ হয়ে যাব।
(বিছানা করা হলে আপা বুবিকে শুইয়ে দেয়। বোরখাটা খুলে পাশের টেবিলের ওপর রাখে। কাঁধের ঝোলাটাও। তারপর চৌকিতে উঠে লেপ টেনে নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে গল্প শুরু করে। কথার ফাঁকে কোনো এক সময় খোকা আপার কোলে মাথা রেখে শোবে এবং ঘুমিয়ে পড়বে।)
খোকা : আজ সন্ধ্যার সময় পুলিশ এসেছিল। আপা : জানি। আমি সব দেখেছি। খোকাকে মারছিল কে? এত চিৎকার করে কাঁদছিল।
আমিন : বাবা।
আপা : কেন?
আমিন : সত্য কথা বলে নি বলে! চুরি করেছিল বলে।
আপা : খুব লেগেছিল তোর না?
খোকা : (আপার কোলে মাথা রেখে) একটু।
আপা : (আমিনকে) আমার ঝোলাটা দে তো। (হাত নিয়ে) খোকা তোর জন্য ঈদের উপহার এনেছি একটা। এই বড় প্যাকেটটার মধ্যে আছে। ঘুম থেকে উঠে কাল দেখিস!
খোকা : উঃ। (আপাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বোজে)
আপা : আর এই লাল পুলোভারটা। বুবি উঠলে কাল সকালে পরিয়ে দিস।
আমিন : কাল সকাল অবধি তুমি থাকবে না?
আপা : পাগল। এত গুণ্ডাপুলিশ দেখেও বাড়িতে ঢুকেছি সেতো কেবল ওদের ঈদের উপহার দিয়ে যেতে। আর, আরেকটা জরুরী কাজেও বটে।
আমিন : আমার জন্য কোনো উপহার আন নি?
আপা : না। তুই এত বড় হয়ে গেছিস যে তোর জন্য উপহার আর খুঁজেই পেলাম না। ভাবতে ভাবতে এক সময় মনে হলো আমি যেন তোর চেয়ে ছোট। তুই আমায় একটা উপহার দিবি? ঠাট্টা নয়। সত্যি বলছি দিবি? আমি তোর কাছে দাবি করছি, ভিক্ষা চাইছি, দিবি? দিবি যা চাইব, দিবি?
আমিন : এসব কি বকছ আপা? আমি দিতে পারি, আমার আছে? এমন জিনিস তুমি চাইলে আমি দেবো না?
আপা : আমার জন্য মিথ্যা কথা বলতে পারবি?
আমিন : সেটা মিথ্যা কথা নয়।
আপা : আমার জন্য ফাঁকি দিতে গিয়ে অন্যের সামনে ছোট হয়ে যেতে পারবি?
আমিন : সেটা ছোট হওয়া নয়।
আপা : আমাকে তাহলে তোর ঈদের রাতের সেরা উপহার দে। এই হাত পাতলাম দে!
আমিন : এই হাত তুললাম বলো কি চাই?
আপা : আগামীকাল ঈদ, হাজার হাজার লাখ লাখ লোক কালও রোজা রাখবে কারণ তাদের ঘরে খাবার নেই! নামাজ পড়তে যেতে পারবে না, কারণ কাপড় নেই। ঘর থেকে বেরুতে পারবে না, ক্ষুধার লজ্জায়। তাদের জন্য লড়াই করবি তুই?
আমিন : করব। কি চাও তুমি?
আপা : দান ছদকা নয়। তোর ঐ ছোট্ট মুঠ দিয়ে ক’জনের ক্ষিদে মেটাবি?
আমিন : তুমি কি চাও?
আপা : শীতের মধ্যে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পেছনে গুণ্ডাপুলিশ। একলা আমার পেছনে নয়। আমার মতো আরও অনেকের পেছনে। ছাপাখানায় গুণ্ডাপুলিশ, রেডিওতে গুণ্ডাপুলিশ আমাদের কথাকে পর্যন্ত গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছে। তুই সাহায্য করবি কিছু? দেখ, তোর আপার হাতটা তুলে ধরে রাখতে রাখতে কি রকম কাঁপছে।
আমিন : অনেক অনেক টাকা চাই আমাদের। চুরি করে, লুট করে, মিথ্যা কথা বলে, যে করে হোক, যে করে পারিস, দে এক্ষুণি আমার হাতে দে, দে, দে।
(বার থেকে দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ হয় এবং শান্ত কণ্ঠে বার থেকে বলতে থাকে)।
জাহাঙ্গীর : আমি জাহাঙ্গীর। পালাবার কোনো চেষ্টা করো না রাশেদা। কোনো ভয় নেই। আমার সংগে অন্য কেউ নেই। দরজা খুলে দাও।
আমিন : এত রাতে। জাহাঙ্গীর ভাই! কি চাই আপনার?
জাহাঙ্গীর : (বার থেকে) কথা বলে দেরী করে ফেলছ। দূরের লোকজনও সন্দেহ করে ফেলতে পারে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দাও, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।
আপা : দরজা খুলে দে আমিন। (দরজা খুলে দেয়)।
(ঘরে প্রবেশ করে জাহাঙ্গীর। মাথায় ফেলট হ্যাট, গায়ে মোটা গ্রেট, কোট ভেতরে গরম স্যুট।)
জাহাঙ্গীর : উঃ, কি শীত বাইরে। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একেবারে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে গেছে।
(দরজা বন্ধ করে চেয়ার টেনে বসে।)
আপা : এত শীতে ঘর থেকে না বার হলেই হতো?
জাহাঙ্গীর : কাজ, কাজ! জরুরী কাজ, না বেরিয়ে কি উপায় আছে? লোকজন টেনে বার করে নিয়ে আসে। তারপর কেমন আছো রাশেদা? শরীর তো তোমার তেমন কিছু খারাপ হয়নি।
আপা : আমার হাতে সময় খুব কম। যা কিছু বলার তাড়তাড়ি শেষ করে চলে যান।
জাহাঙ্গীর : (হ্যাট খোলে) আমারও সময় বেশি নেই। যদি কাজ শেষ হয়ে যায় তবে নিঃশব্দে পনের মিনিটের মধ্যেই যে পথে এসেছিলাম সে পথে চলে যাব। তবে কাজের কথা ছেলেপুলের সামনে আমি সাধারণত ওঠাই না। তোমার চ্যালাটিকে ঘরে চলে যেতে বলো।
আপা : ও ছেলে মানুষ নয়! আপনার আমার মধ্যে কথা শোনার মতো বয়স পেরিয়ে এসেছে অনেকদিন।
জাহাঙ্গীর : তবুও।
আপা : আমিন তুমি ওঘরে চলে যাও।
জাহাঙ্গীর : আড়টাড়ি দিও না যেন।
আমিন : না, দেব না।
(চলে যায়। জাহাংগীর সে দিকে তাকিয়ে থাকে)
আপা : ভয় নেই। ও যখন বলেছে তখন কথায় নড়চড় হবে না।
জাহাঙ্গীর : সে আমি জানি। অবশ্য আড়ি পেতেও যে খুব বদমায়েশী করতে পারবে তা নয়। আমি যদি পনের মিনিটের মধ্যে এ ঘর থেকে বেরিয়ে না যাই তাহলে বাইরে যারা লুকিয়ে আছে তারা ধরে নেবে যে তুমি বাড়ির ভেতরেই আছ এবং মুহূর্তের মধ্যে এ বাড়ি এমন ভাবে ঘেরাও করে রাখা হবে যে, একটা মশাও বার হবার পথ খুঁজে পাবে না।
আপা : সময় তাহলে সত্যি খুব কম। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করুন।
জাহাঙ্গীর : শান্ত হয়ে শোনো। বেশি তাড়াহুড়ো করলে আবার সব কথা বোঝা যাবে না। আর যদি কথাই না বুঝতে পারো তাহলে পনের মিনিট কেন পনের দিনেও আমি এখান থেকে চলে যেতে পারব না! একবার তুমি আমাকে বড় অপমান করেছিলে ভুলে যাও নি নিশ্চয়ই।
আপা : না ভুলি নি। এবং দেখছি সে শিক্ষায় কোনো ফল হয়নি।
জাহাঙ্গীর : সে কথা থাক; সেটা আলোচনা করতে গেলে আবার দেরী হয়ে যাবে। কথাটা হচ্ছে এই যে, পনের মিনিটের মধ্যেই চুপচাপ আমি এ ঘর ছেড়ে আমার বাড়ির পথে পা বাড়াতে পারি। একটা ইঁদুরও কোনোখানে নড়বে না! তবে সে কেবল একটি মাত্র শর্তে।
আপা : কি শর্তে
জাহাঙ্গীর : সেই অপমানের ওজনে কিছু টাকা- এই সামান্য হাজার কয়েক হলেই চলবে। এই মুহূর্তে হাতে তুলে দাও (হাত বাড়িয়ে দেয়) বেরিয়ে চলে যাই। আমাকে চলে যেতে দেখলে এ বাড়ির আশেপাশে অন্য লোক আর কেউ থাকবে না।
আপা : এত টাকা আমি কোথায় পাব?
(জাহাংগীরের অলক্ষ্যে বোকার মতো ঝাঁপসা চোখে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে আমিন। হাতে ভারী কাঁচের একটা বড় পেপার ওয়েট।)
জাহাঙ্গীর : তুমি সত্যি জানো না? আমি বলে দিচ্ছি। আমিনের বালিশের নিচে টাকা রয়েছে। বুবির ঘুম না ভেংগে যায় এমন ভাবে বার করে নেয়া এমন কিছু কষ্টকর নয়।
আপা : কাল সকালে আমিন যখন বাবাকে বলে দেবে, তখন?
জাহাঙ্গীর : সে কি, টাকার প্যাকেট যে আমি নিচ্ছি আমিন তা জানবে কি করে? আমিন ঘরে ঢুকলে তাকে বলবে যে টাকা তুমি নিয়েছ। বাবাকে কাল কি বলতে হবে সে তুমি সারারাত ভেবে একটা কিছু বার করে নাও, ওকে শিখিয়ে দিও!
(আপা বোরখাটা আঁকড়ে ধরে)
দেরী করো না। পাঁচ সাত মিনিট মাত্র সময় আছে। দেখছ না (হাত বাড়িয়ে দেখায়) সেকেণ্ডের লাল কাঁটাটা কি রকম লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
(বাক্য সম্পূর্ণ হবার আগেই আমিনের হাত শূন্যে লাফিয়ে ওঠে এবং পাথুরে পেপার ওয়েট দিয়ে প্রচণ্ড বেগে আঘাত করে জাহাংগীরের মাথার ঠিক মাঝখানে। ক্ষিপ্রহস্তে রাশেদা তার বোরখা দিয়ে জাহাংগীরের মুখ চেপে ধরে। আমিন বোকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের পেপার ওয়েটটাও ধরে রেখেছে।)
আপা : তাড়াতাড়ি কর। তাড়াতাড়ি। দু’তিন মিনিটের বেশি সময় নেই। আমার সঙ্গে ধর ওকে। পাশের গুদাম ঘরে টেনে নিয়ে যেতে হবে। সাবধান। কোন শব্দ হয় না যেন।
(দু’জনে ধরাধরি করে জাহাংগীরের অচেতন দেহটাকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে যায়। এক মিনিট মঞ্চ খালি। শান্ত ধীর পদক্ষেপে আমিন আবার ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকে চারদিক ভাল করে দেখে। আপার ঝোলা, বোরখা, জাহাংগীরের হ্যাট, নিজের বালিশের নিচ থেকে টাকার প্যাকেট নিয়ে আবার চলে যায়। আরও আধ-মিনিটের স্তব্ধতা।
অকস্মাৎ রাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ পুলিশের তীক্ষ্ণ প্রলম্বিত হুইসেল বেজে ওঠে। কয়েকজন বাহির থেকে দরজায় জোরে ধাক্কা দেয়। বাড়ির অন্যান্য দিকেও অনেক পদশব্দ শোনা যায়।
বুবি খোকা চমকে জেগে ওঠে, চোখ কচলাতে থাকে। চিৎকার করে। দরজায় জোরে আঘাত পড়তে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে আসে এক যুবক, মাথায় ফেল্ট হ্যাট, গায়ে গ্রেট কোট, পরণে। স্যুট। এসে দরজাটা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে পুলিশ। যুবক ঘরের কাউকে দেখে এগিয়ে চলে যায়।
অন্য দরজা দিয়েও বাড়িতে পুলিশ ঢুকছে। শব্দ টর্চলাইট। হুংকার চিৎকার। গুদাম ঘরের পাশ থেকে হঠাৎ চিৎকার।
পাকড়ো, পাকড়ো, খবরদার।
দৌড়ে ঘরে ঢোকে ত্রস্তচকিত পলায়ণরতা বোরখামণ্ডি তন্বী। বিপদ নিশ্চিত জেনেও দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে পেছনের দরজা দিয়ে। পুলিশ ইন্সপেক্টর পিস্তলের ঘোড়ার হাত দিয়ে একবার চিৎকার করে হুশিয়ারী জানায়। পলায়ণরতা পরোয়া করে না। একটা গুলির শব্দ। হয়তো পলায়ণরতার পায়ে লেগেছে। তালগোল পাকিয়ে বোরখাটা হুড়মুড় খেয়ে পড়ে যায় চৌকাঠের উপর। আর বোরখার ভেতর থেকে দূরে ছিটকে পড়ে একটা চশমা, গোল কাঁচের।)
১ম পুলিশ : এ কি, এ চশমা কার?
২য় পুলিশ : দেখি, দেখি। একটু আলোর সামনে তুলে ধরো দেখি।
৩য় পুলিশ : (বোরখা সরিয়ে) আরে ইয়ে আওরৎ কাহা?
১ম পুলিশ : বাইরে কে গেল তবে? জাহাঙ্গীর সাহেব নয়? এ্যা।
(ছুটে বেরিয়ে যায়)।
(বাবা মা চাচা সবাই ততক্ষণে ঘরে প্রবেশ করে অজ্ঞান এবং আহত থাকার বোরখাবৃত দেহ কোলে নিয়ে ঘিরে বসেছে। সবার পেছনে টলতে টলতে প্রবেশ করে জাহাঙ্গীর। গায়ে শুধু গেঞ্জী, পরণে ঢোলা জাংগীয়া, পা খালি। দু’হাতে শক্ত করে নিজের মাথা টিপে ধরে আছে।)
জাহাঙ্গীর : শয়তান দুটো আমার কোট নিয়ে গেছে, হ্যাট নিয়ে গেছে, প্যান্ট নিয়ে গেছে, আমায় নাংগা করে-এ্য? (বোরখাবৃতকে দেখে) ধরছে? ধরতে পেরেছে? বেশ, বেশ করেছ।
(তারপর একটু ঝুঁকে পড়ে বোরখায় ঢাকা আমিনকে চিনতে পেরে চমকে উঠে। থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমিনের মাথা চাচার কোলে। বাবার মুখে রা নেই।
বে-বোরখা মা এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।)