নষ্টচরিত্র
এখন রাত বারোটার কিছু বেশিই হবে। আমি হাঁটছি। হাঁটছি একটা সরু গলি দিয়ে। নির্জন গলি। কোনো আলো নেই। আশপাশে বাড়িও কম। যে কটা আছে, সেখানে মনে হয়, সবাই শুয়ে পড়েছে। বাড়িগুলোও থমথমে অন্ধকার। একটু মাঠ, একটু ঝোপঝাড়। অন্ধকারে হাঁটতে অসুবিধে হওয়ার কথা, আমার হচ্ছে না। খানিক আগে কুকুর ডাকছিল। আমি গলিতে ঢুকতেই চুপ মেরে গেল। কেন? নিজের ডান হাতটা তুলে দেখলাম। না, দেখা যাচ্ছে না। আজ কি অমাবস্যা? নাকি আমার চোখের সমস্যা হয়েছে? এখনও বেশ খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। এটা একটা মুশকিল। অন্যসময়ে মুশকিল নয়, আজ মুশকিল। কারণ আজ আমার ডানদিকের বুকে ব্যথা। আমি বুকে হাত চেপে চলেছি। একটা রিকশা পাওয়া গেলে ভাল হতো। রিকশা করে যেতে পারতাম। এত রাতে রিকশা পাওয়া যাবে কোথায়?
আমার নাম গৌর
গৌর নামের লোকের গায়ের রং হয় ফর্সা। আমার গায়ের রং কালো। অর্ডিনারি কালো নয়, তিনফুটানি কালো। তিনফুটানি কালো হল, চা তিনবার ফুটোনোর পর চায়ের রং যেমন কালো হয় তেমন কালো। এমন কালো ছেলের নাম কে ‘গৌর’ রেখেছিল?
রেখেছিল আমার বাবা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, গৌর নাম রাখলে, কালো সন্তান একদিন ফর্সা হবে। সময় লাগবে, কিন্তু হবে। বাবা নাকি ছোটবেলায় গ্রামে এমন ঘটনা দেখেছে। বেঁটে সন্তানকে ‘ঢেঙা’ এবং বোকাকে ‘চালাকচন্দর’ ডেকে ফল পাওয়া গেছে। গ্রামদেশে একে বলা হতো ‘নাম টিটমেন্ট’। তবে নিজের সন্তানের বেলায় বাবার এই ‘টিমেন্ট’ কাজ দেয়নি। ঘটনা ঘটেছে অন্যরকম। বাবার ছেলে ফর্সা তো হয়ইনি, উলটে যতদিন গেছে, তার শরীরের কালো ভাব বেড়েছে। এখন তো অবস্থা খুবই খারাপ। ভাগ্যিস বাবা বেঁচে নেই। নইলে আমায় দেখলে চোখ কপালে উঠত। দুঃখও পেতেন।
‘গৌর, এ কী অবস্থা হয়েছে তোর!’
‘কী অবস্থা বাবা? ভালোই তো আছি।’
‘ভালো কী বলিস! একবার আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? দেখেছিস ভাল করে?’
‘আমার বাসায় বড় আয়না নেই। ছোট একটা রয়েছে, দেয়ালে ঝোলে। ওই আয়নায় মুখের একটা গাল দেখা যায় শুধু। আমি দাড়ি কামবার সময় এক গালে কাজ সেরে তবে আরেকটা গালে সাবান ঘষি।’
‘এত বড় হলি, বাড়িতে একটা আয়না কিনতে পারলি নে? ছ্যা ছ্যা। তুই চিরকালের নির্বোধ হয়ে রইলি। চরিত্রে কোনো জোর নেই। ফ্যানফ্যানা চরিত্র। ফ্যানফ্যানা কী জানিস? বাতাস দিলে গাছের নষ্ট পাতার মতো ফনফন করে কাঁপে। এই চরিত্রও নষ্ট।’
বাবার ধমক খেয়ে আমি বলতাম, ‘বাবা, আয়নার সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক কী? রোজগারপাতির অবস্থা ভালো নয়। শখ আহ্লাদের পিছনে পয়সা ঢালতে পারব না।’
বাবা দাঁত কিসমিস করে বলত, ‘অবশ্যই চরিত্রের যোগ আছে। যার চরিত্র জোরালো, নির্ভীক সেই পারে প্রয়োজন অপ্রয়োজন বুঝতে। আয়না কোনো শখের জিনিস হল? নির্বোধ একটা।’
আমি মিনমিন করে বলতাম, ‘ভাত রুটি ছাড়া সবই শখের জিনিস বাবা।’
বাবা বলত, ‘বড় বড় কথা বলিস না। তুই এখন করিসটা কী?’
আমি বলতাম, ‘নিজেই ব্যবসা করি।’
বাবা চোখ কপালে তুলে বলত, ‘ব্যবসা! ফ্যানফ্যানা চরিত্রের নির্বোধ, তুই ব্যবসার বুঝিস কী! চাষির ছেলে। তুই বুঝবি বীজতলা, ধনঞ্চা, খরালি— বর্ষালি। লাভ ক্ষতির হিসেব রাখা কি তোর কম্ম?’
আমি বলতাম, ‘অমন করে বোলো না বাবা। লোকে শুনলে হাসবে। চাষির ছেলে নয়, বলো ভাগচাষি ছেলে। তাও তোমার ভাগের জমিজমা অনেকদিন গেছে। গত দশ বৎসর তুমি বেকার। এখানে ওখানে জনমজুর খাটো। ফুসফুসে অসুখ বাধিয়ে ঘরে বসা। আয় রোজগার কিছু নাই। তুমি আর চাষি কই?’
বাবা আবার চিৎকার দেবে। আমার চরিত্র নিয়ে চিৎকার। ফুসফুস কাণ্ডে গলায় নেই জোর, তাই চিৎকার জমবে না। শুধু গলার শিরা ফুলবে। আমার বাবার এই এক গুণ ছিল। পরিবারকে খাওয়া পরা দিতে পারেননি কিন্তু ধমক দিয়েছে প্রচুর।
এবার আমার পরিচয়।
আমার বয়স ছত্রিশ। ছত্রিশ বছর কয়েক মাস। বাড়ি নদীয়া জেলা, গ্রাম গোপালপুর। স্ত্রীর নাম বীণা। তার বয়স ছাব্বিশ। না, ছাব্বিশ নয় সাতাশ। প্রেম করে বিয়ে। কৃষ্ণনগর লোকালে প্রেম। সেই প্রেমের গল্প মজার।
একবার তাড়াহুড়ো করে লেডিজ কামরায় উঠে পড়েছিলাম। মাঝেমধ্যেই উঠি। কামরা হালকা থাকে। অতগুলো মেয়েদের সঙ্গে থাকতেও মজা লাগে। সেদিন মেয়েরা ধরল ঘিরে। চড়-থাপ্পড় শুরু হয় হয় অবস্থা। একজন কানও মুলে দিল। সঙ্গে গালিগালাজ তো আছেই। এক ষণ্ডামার্কা মহিলা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে এসে বললে, ‘এভাবে হবে না, বেটাকে ধাক্কা মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দে। মেয়েছেলের কামরায় উঠে গায়ের গন্ধ শোঁকার শখ বেরিয়ে যাবে।’ সত্যি সত্যি কজন মিলে আমাকে দরজার ধারে নিয়েও গেল। শুরু হল টানামানি। আমি রড ধরে পরিত্রাহী চেঁচাতে থাকি। আমি অতি ভীতু স্বভাবের এক পুরুষ মানুষ। বাবার ভাষায় ফ্যানফ্যানা চরিত্রের নির্বোধ। মেয়েদের কামরায় ওঠবার লোভ রয়েছে, কিন্তু গোলমাল সামলানোর মনের জোর নেই। তাই চিৎকার দিলাম।
‘বাঁচাও, বাঁচাও।’
একটি তরুণী সত্যি সত্যি বসার আসন ছেড়ে উঠে এলো।
‘অ্যাই, তোমরা ওকে ছাড়ো। আমিই ওকে এই কামরায় উঠতে বলেছি।’ সবাই বলল, ‘তুমি কে?’
‘যেই হই, ছাড়ো ওকে।’
একজন বলল, ‘তোমাকেও ফেলে দেব।’
‘সাহস থাকলে দাও দেখি।’
কথাটা বলে শালোয়ার কামিজ পরা সেই মেয়েও ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে আরো এগিয়ে এল। বলল, ‘লেডিজ কামরা থেকে মেয়েছেলেকে ফেলবার হিম্মৎ কত আছে দেখি তোমাদের। সবাইকে হাজতে পুরব।’
এই হুমকিতে মেয়েরা থতমত খেল। কথাটা ঠিক। মামলা গড়বড়ে হবে। আমাকে ছেড়ে তারা এদিক ওদিক সরেও পড়ল। পরের স্টেশনে সেই ওড়না- মেয়ে নেমে পড়লে, আমিও নামলাম। মেয়েটি হনহন হেঁটে গেলে আমি পিছু নিলাম। একটা ধন্যবাদ তো জানাতে হয়। একটু এগিয়ে থমকে পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল মেয়েটি। কালোর ওপর সুশ্রী। সবথেকে বড় কথা শরীরকে টানার ক্ষমতা রয়েছে। পুরুষমানুষ টানবার ‘টান।’ দেখলে মনে হয় না, ভিতরে তেজ।
‘কী চাই?’
‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
‘ঠিক আছে।’
‘আপনাকে চা খাওয়াতে পারি?’
‘না, পারেন না।’
‘তাহলে অন্য কিছু? অমলেট?’
‘না।’
‘তাহলে একটু কোথাও বসে কথা বলি?’
‘দেখুন, আমি ট্রেন থেকে ফেলা যেমন আটকাতে পারি, তেমন বদ ছেলেদের মেঝেতে ফেলে দু’ঘা দিতেও পারি। পিছন পিছন আসবেন না।’
এই ঘটনার এক বৎসরের মাথায় এই মেয়েকে বিয়ে করলাম। আজ আট মাস হল সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে পালিয়ে যায়নি, বলে কয়ে গেছে। যার সঙ্গে গেছে সেই লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। নাম বাবলু পাল। কাপড়ের ব্যবসা। গাঁটরি নিয়ে ঘোরে। কলকাতার বড়বাজার থেকে ছিটকাপড় এনে হাটে সাপ্লাই দেয়। আমার সঙ্গে আলাপ হতে একদিন বাড়িতে এলো। বীণা চা বিস্কুট দিয়ে গেল। দুদিন পর আবার এলো। বীণা চায়ের সঙ্গে ঘুগনি দিল। তিনদিন পরে আবার হাজির। বীণা চায়ের সঙ্গে মাছ ভাজা দিল। আমার তখন টাকা পয়সার বিরাট টানাটানি। বাল্ব বানানোর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম, সেটা গেছে বন্ধ হয়ে। বাবলু পাল বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে ব্যবসা করতে তো পারো।’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে ব্যবসা! আমার টাকা কই?’
বাবুল পাল বলল, ‘প্রথমে টাকা দিতে হবে না। তুমি আমার মাল নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেচবে। লাভের ওপর কমিশন পাবে। তবে খাটতে হবে। দূরের হাটে, গঞ্জে যেতে হবে। যদি রাজি থাকো বলবে।’
বাড়িতে গিয়ে বীণাকে বললাম। বীণা বিয়ের আগে ছিল রোগা। বিয়ের পর আরও গায়েগতরে হয়েছে। গালগুলো হয়েছে টসটসে। টসটসে গাল নেড়ে সে বলল, অবশ্যই করবে। ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করবে। যত ঘুরবে তত ব্যবসা, তত লাভ। বেটাছেলে দুপুরে ঘরে থাকবে কেন? ছি।’
আমি বাবুল পালের কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে দুপুরে হাটেমাঠে বেরিয়ে পড়লাম। বাবলু পাল দুপুরে আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ল। একদিন দুম করে বাড়ি ফিরে এসে দেখি দরজা বন্ধ। বাইরে স্কুটার। বাবলু পালের স্কুটার। আমি রোয়াকে শুয়েই দিলাম ঘুম। বিকেলে দরজা খুলে বীণা ঘরে ডেকে নিল। বলল, ‘জোরে কথা বল না। বাবলুদা ঘুমোচ্ছে।’
‘বাবলুদা’র ঘুম ভাঙলে বীণা দুজনকে চা দিল। একসঙ্গে চা খেলাম। বাবলু পাল আমার কাছ থেকে ব্যবসার হিসেবপত্র বুঝল। ব্যবসা ভালো হয়েছে বলে পিঠ চাপড়ে দিল। বলল, ‘তুমি পারবে।’
রাতে বীণা এসে পাশে শুয়ে বলল, ‘এদিকে ফেরো।’
আমি বললাম, ‘খুব খাটনি গেছে। ঘুম পাচ্ছে।’
বীণা বলল, ‘না, এখনই আমার দিকে ফিরবে।’
আমি কী আর করব? বীণাকে আমি ভয় পাই। বাধ্য হয়ে পাশ ফিরলাম।
বীণা বলল, ‘তুমি আমাকে কিছু বললে না কেন?’
আমি বললাম,’কী বলব?’
বীণা বলল, ‘বাঃ, একটা বাইরের লোকের সঙ্গে দরজা দিয়েছি, আর তুমি কিছু বলবে না! দুটো চড় তো মারবে।’
আমি হেসে বললাম, ‘কী যে বল। তোমার গায়ে হাত তুলব? ছিছি।’
বীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোমার বাবা ঠিকই বলত, তোমার চরিত্র নষ্টচরিত্র। ফ্যানফ্যানা চরিত্র তো নষ্টই হল? হল না? বেটাছেলের চরিত্র গাছের পাতার মতো কাঁপে? নাও এবার আমার জামা খোলো। খুলে আদর করো।’
পরদিন সকালে বীণা সুটকেস গুছিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলল, ‘সাবধানে থাকবে। ফ্যানফ্যানা চরিত্রের পুরুষমানুষের সঙ্গে থাকায় মজা নেই। সিকিওরিটিও নাই। যে কেউ ঘরে ঢুকে আসে। তাই বাবলু পালের কাছে চললাম।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা যাও। খবর দিও।’
দরজা পর্যন্ত বীণাকে এগিয়েও দিলাম। মনটা খুবই খারাপ হল। তা হোক, মেয়েটা তো এবার মজায় থাকবে। তবে বাবলুদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হল না। বরং বাবলুদা আমাকে আদর করে ‘তুই তোকারি’ করতে শুরু করল। একদিন আমাকে ওর গোডাউনের খুপরি অফিসে বসে বলল, ‘দুঃখ করিস না গৌর, সবাই চিরকাল কাছে থাকে না। যাঃ তোর ব্যবসা আমি ডবল করে দিলাম। এতদিন ছিল দশদিন ধার, এবার কুড়ি দিন ধারে মাল পাবি।’
আমি ব্যবসায় মন দিলাম। গোলমাল বাধল মাস কয়েক পরে। আবার একদিন লোকাল ট্রেনের লেডিজ কামরায় উঠেছি। সঙ্গে কাপড়ের গাঁটরি। লেডিজ কামরা কম ভিড় বলে মাল নিয়ে উঠতে সুবিধা। দেখেছি, বেশিরভাগ সময়েই গোলমাল হয় না। মাঝেমধ্যে এক-দু’বার ধরা পড়তে হয়। এইটুকু ঝামেলা তো নিতেই হবে। সেদিন ঝামেলা হল বেশি। মেয়েরা ‘রে রে’ করে তেড়ে এলো। আমাকে দেখে যতটা না, তার থেকে বেশি কাপড়ের গাঁটরি দেখে। তবে এবার আর আমাকে ট্রেন থেকে ফেলতে চায় না। কাপড়ের গাঁটরি ফেলবে। একবারে তিন হাজার টাকার মাল গচ্চা যাবে। আমি তো গাঁটরি জড়িয়ে বসে রইলাম। সেদিনও শুরু হল টানা হেঁচড়া। অবাক কাণ্ড সেদিনও জানলার ধার থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল, ‘আপনারা ওকে ছাড়ুন। ওকে আমি উঠতে বলেছি।’
এক মহিলা তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘তুমি উঠতে বলার কে? এ লোক তোমার কে হয়?’
মেয়েটি সিট ছেড়ে উঠে কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘উনি আমার স্বামী হন।’
স্টেশনে নেমে বীণা বলল, ‘এই কাগজের টুকরোটা রাখো। আমার বাড়ির ঠিকানা রয়েছে। জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। মোবাইল নম্বর তো জানো। ফোন করে চলে আসবে।’
আমি কাপড়ের গাঁটরি ঘাড়ে তুলে হাঁটতে হাঁটতে অবাক হয়ে বললাম, ‘বাবলুদা? বাবলুদা থাকবে না?’
বীণার চেহারায় অনেক জেল্লা বেড়েছে। কাপড়-চোপড়ও ঝলমলে। মুখে পাউডার, রং মেখেছে। বেশ ঢলঢলে লাগছে। নিজের বউকে চিনতেই পারছি না।
‘ভয়ের কিছু নেই, বাবুলদা রোজ থাকে না। তার নিজের বউ বাচ্চা আছে না? রক্ষিতার ঘরে রাতদিন পড়ে থাকলে হবে?’ কথা শেষ করে ঠোঁটের ফাঁকে হাসল বীণা। ঠোঁটে বেশি করে রং দিয়েছে। গলা নামিয়ে বলল, ‘লোকটা মেদামেরা। আগেও বুঝেছিলাম। টাকার জন্য আছি। ফুরোলেই লাথি মেরে চলে আসব।’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমার কি লুকিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে?’
বীণা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘বোকার মরণ। কেন হবে না? তুমি আমার স্বামী না? তোমাকে কি আমি ডিভোর্স দিয়েছি? যেদিন আসবে কিছু টাকা নিয়ে যাবে।’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘কীসের টাকা?’
বীণা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘ন্যাকা। বোঝ না? তোমার জন্য সরিয়ে রেখেছি, বাবলুদার খপ্পর থেকে বেরিয়ে আলাদা ব্যবসা করতে হলে টাকা লাগবে না? সেই টাকা। অ্যাই, চা খাওয়াবে?’
আমি বললাম, ‘না, গোডাউনে মাল ফেলতে হবে।’
বীণা ফট করে আমার হাত ধরে বলল, ‘পরে ফেলবে। চলো খুব খিদে পেয়েছে। অমলেট খাওয়াবে।’
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘দেরি হয়ে যাবে বীণা। হাত ছাড়ো।’ বীণা আমার হাত তো ছাড়লই না উলটে আরো জোরে চেপে ধরল। বলল, ‘চলো তো কোথাও একটু বসি। কতদিন তোমার সঙ্গে দুটো কথা হয় না।’ আমি বললাম, ‘কথা বলবার দরকার কী? তুমিই তো চলে গেছ। ‘ বীণা হেসে বলল, ‘ছেলেমানুষ একটা। তুমিও তো আটকাওনি। নষ্টচরিত্রের পুরুষ কোথাকারে।’
আমি চুপ করে রইলাম। বীণা মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমি ভুল করেছি। মানুষ ভুল করে না?’
আমি বললাম, ‘ভালোই করেছ। আমার সঙ্গে থাকলে কষ্টে থাকতে হত। এখন কত ভালো রয়েছ।’
বীণা হাতে চাপ দিয়ে বলল, আবার ছেলেমানুষের মতো রাগ দেখায়। বলছি তো আমি একট খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। করেছি বলেই বুঝতে পেরেছি, মানুষের কষ্টে থাকার থেকে ভালো থাকাটা বেশি জরুরি। যা করেছি তোমার ওপর রাগ করে করেছি। তুমি যদি শক্ত হতে, আমাকে কটা চড় দিতে…পরদিন আমাকে আটকাতে পারতে। বাবলু পালকে গিয়ে চেপে ধরতে পারতে। কেন যাওনি?’
আমি মাথা নামিয়ে বললাম, ‘বীণা, জান তো আমার মনে জোর নেই।’
বীণা বলল, ‘যাক, এসব পরে হবে, আগে আমায় খাওয়াবে চলো। খুব খিদে পেয়েছে।’
বীণার ঠিকানা দেওয়া বাড়িতে যেতে শুরু করলাম। একদিন, দুদিন, তিনদিন। তিনদিনের মাথায় ধরাও পড়লাম। আমার হল, ধরা পড়া ভাগ্য। তবে এটা ঠিক ট্রেনের লেডিজ কামরায় ধরা পড়বার মতো নয়। বীণার ওখান থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। হনহন করেই হাঁটছিলাম। এই গলি থেকে বড় রাস্তা বেশ খানিকটা। রাত তখন এগারোটা। গলির মুখে পৌছোতে আমার মুখে আলো পড়ল। আমি বাঁ হাত তুলে চোখ ঢাকলাম। ব্রেক কষার আওয়াজে হাত সরিয়ে বুঝতে পারলাম স্কুটারের আলো।
‘গৌর, তুই! এখানে কোথায় এসেছিস’
আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘একজনের বাড়িতে কাপড় দিতে এসেছিলাম। তুমি এ পাড়ায় থাকো বাবলুদা?’
বাবলু পাল কোনো কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অন্ধকার ছিল বলে ওর মুখটাও দেখতে পেলাম না। রাতে বীণাকে ফোন করতে ভরসা হল না। পরদিন দুপুরে মাল নিতে গিয়ে দেখি বাবলু পাল বসে। আমাকে খুপরি ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। ছোট কাগজ। আমারই হাতে লেখা কাপড়ের হিসেব। গুচিমুচি করে লেখা।
‘নে ধর। কাল ওই বাড়িতে ফেলে এসেছিলি।’
কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আমার মনে হল সব রক্ত আমার শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। বাবলু পাল স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাগজটা কোথায় ফেলেছিলি জানিস? খাটের নিচে। নির্বোধ।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘ভুল হয়ে গেছে।’
বাবলু পাল শান্ত গলায় বলল, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন গৌর? নিজের বউয়ের কাছে গিয়েছিলি, এতে ভয়ের কী আছে?’
‘আর যাব না।’
বাবলু পাল দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘নিশ্চয় যাবি, তবে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে যাবি। বউয়ের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করবার পর, ওই টাকা বালিশের নিচে রেখে আসবি। আমি হিসেব করে দেখেছি, এখন পর্যন্ত তোকে আমি বাহান্ন হাজার টাকার মাল দিয়েছি। দু’হাজার টাকা ছেড়ে দিচ্ছি। মাল বেচে পয়সা কিছু ফেরত দিয়েছিস ঠিকই, কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট তো আমারই। আমি কাপড় না দিলে কী নিয়ে ব্যবসা করতিস? টাকা ফেরত দিবি।’
আমি নিচু হয়ে বাবলু পালের পা ধরলাম।
‘এই কাজ আর করব না বাবলুদা। মাইরি বলছি, আমি যেতে চাইনি, বীণা আমাকে যেতে বলেছিল…। ওই যত নষ্টের গোড়া। জোর করল। আমি বলেছিলাম, যাব না।’
বাবলু পাল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বীণাকে আমি বুঝে নেব। তুই শুনলি কেন? একটা নষ্টচরিত্রের মেয়েছেলে। স্বামীকে ছেড়ে চলে আসে, তার কথা তোকে শুনতে হবে?’
আমি বললাম, ‘আর শুনব না।’
‘মনে থাকবে?’
আমি দু’হাতে কান ধরে বললাম, ‘মনে থাকবে। আর কোনোদিন যাব না। দোহাই আমাকে ব্যবসা থেকে তাড়িও না। না খেতে পেয়ে মরে যাব।’
বাবলু পাল স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আমার ওঠবোস দেখল। তারপর হাত বাড়িয়ে পাশের লোহার টেবিলের ড্রয়ার খুলল। একটা কালো রঙের রিভলবার। আমার গায়ের মতো কালো। তিনফুটানি। বাবলু পাল সেটা হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল, ‘যদি মনে না থাকে একদম মেরে দেব।’
আমি প্রায় কেঁদে ফেলে বললাম, ‘হ্যাঁ, মেরে দিও।’
এই পর্যন্ত জানবার পর নিশ্চয় মনে হচ্ছে, গৌর নামে লোকটার গালে কষিয়ে দুটো চড় মারি। তারপর মারি টেনে একটা লাথি। ভীতু, মেরুদণ্ড না থাকা, লোভী, ফ্যানফ্যানা চরিত্রের কোনো লোকের জন্য এটা হবে কম শাস্তি। নিজের বউয়ের কাছে গেছে বলে একজন খারাপ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবোস করলে তার শাস্তি অনেক বেশি হওয়া উচিত। তার ওপর আবার হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে! শুধু তাই নয়, মেয়েটার ঘাড়ে কেমন দোষ চাপাল! এটা কি মানুষ? এই লোককে আচ্ছা করে পিটুনি দেওয়াই উচিত। হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিলেও অন্যায় হবে না। আমার মনে জোর থাকলে, আমি তাই করতাম।
তবে সমস্যা হয়েছে। আজ একটা কাণ্ড করে ফেলেছি। করেছি সন্ধের দিকে। এমন নয় ঝোঁকের মাথায় করেছি। করেছি ভেবেচিন্তেই।
বাবলু পালের গোডাউনের খুপরি অফিসে যাই। কাপড়ের গাঁটরি জমা দিই।
‘বাবলুদা, আমি ঠিক করেছি, টাকাটা ফেরত দিয়ে দেব।’
বাবলু পাল অবাক হয়ে বলল, ‘মানে! কীসের টাকা?’
আমি বললাম, ‘তোমার ব্যবসার টাকা। এই নাও কিছুটা এখনই রাখো বাকিটা ভাগে ভাগে দেব।’
আমি টেবিলের ওপর টাকার বান্ডিল রাখলাম। বাবলুদা টাকায় হাত না দিয়ে রাগে গরগর আওয়াজ করে বলল, ‘তুই কী চাস?’
আমি শান্ত ভাবে বললাম, ‘আমি কী চাইব? ভীতু মানুষ। আমি কিছু চাই না, বীণা চায়।’
বাবলুদা চোখ সরু করে বলল, ‘বীণা! সে কী চায়?’
আমি বললাম, ‘সে আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। এই টাকা সে দিয়েছে। তোমার দেওয়া টাকা।
বাবলুদা বিড়বিড় করে বলল, ‘হারামজাদি নষ্ট মেয়েছেলে। তাকে পিষে মারব। তার আগে মারব তোকে…।’
বলতে বলতে টেবিলের ড্রয়ার টেনে রিভলবার বের করে ফেলে বাবলুদা। আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই গুলি চালিয়ে দেয়। গুলি লাগল আমার ডানদিকে। বুকের একটু ওপরে। অত কাছ থেকে তো, জোর খুব ছিল। আমি ছিটকে পড়লাম। এত তাড়াতাড়ি লোকটা এরকম একটা কাজ করে বসবে আমি ভাবতেও পারিনি। কিন্তু এখন কী হবে? আমি মরে যাব আর বীণা এই পশুটার কাছে আটকে থাকবে? হতেই পারে না। কিছুতেই না। আমি বাবলু পালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টেনে নিলাম পাশে পড়ে থাকা কাপড়ের বড় গাঁটরিটা। ধরলাম চেপে বাবলু পালের মুখের ওপর।
ধস্তাধস্তি বড়জোড় তিন কী চার মিনিট। বাবলু পাল আমার আগে মরল। বেচারি। যে কাপড়ের জোরে এত কিছু করছে সেই কাপড়ের হাতেই মৃত্যু। আমি মরেছি, আরও খানিকক্ষণ পর। বাবলু পালের গোডাউনের ছেলেটা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে। ততক্ষণে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে।
আমি এখন গলি পেরিয়ে বীণার বাড়ির দরজায়। তাকে সব ঘটনা খুলে বলব। বুকের রক্তও দেখাব। আমি জানি মরে গেলেও সে আমাকে ভয় পাবে না। সে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে, আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে।
আমি বলব, ‘তোমার ভয় করছে না বীণা? আমি একজন মরা মানুষ।’
সে বলবে, ‘তাতে কী হয়েছে? তোমাকে তো আমি ভালোবাসি। ভালোবাসার আবার বাঁচা মরা কী?’
আমার বাবা যদি বেঁচে থাকত আর এই দৃশ্য দেখতে পেত, আমি জানি খুব বকা দিত। বলত, ‘নির্বোধ ছেলে, ফ্যানফ্যানা চরিত্র। আজ একটু ফুল আনতে পারলি না? এমন দিনে মেয়ের কাছে ফুল ছাড়া কেউ আসে? তুই একটা চাষির ছেলে, তোর ফুলের অভাব?’
আমি বলতাম, ‘আমাকে বকছ কেন বাবা! মরা মানুষ কখনো হাতে করে ফুল আনে?’
বাবা হুংকার দিত, ‘আলবাত আনে।’
আমি বুকের রক্ত মুছে বলব, ‘ভুল হয়ে গেছে বাবা।’
এই সময় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বীণা বলবে, ‘কী এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছ, এসো, ভিতরে এসো।’