টিউটনিক জাতিরা রোমান রাজ্য অধিকার করুক কিন্তু রোমান জাতিদিগের সহিত না মিশিয়া থাকিতে পারে নাই। বিজিত জাতিদিগের সহিত তাহাদের আচার ব্যবহার ভাষা ধর্ম সমস্ত মিশিয়া গিয়াছিল। তাহারা রোমান রাজ্য শাসন করিত, কিন্তু রোমান শাসন-প্রণালী অনুসারে শাসন করিত। রোমান রাজ্যে তাহাদের আধিপত্য বিস্তার হইয়াছিল কিন্তু রোমান স্বভাব রোমান প্রথা তাহাদের জাতীয় স্বভাব, জাতীয় প্রথার উপর আধিপত্য লাভ করিয়াছিল। সেই টিউটনিক জাতি কেবল ইংলন্ডে আপনাদের জাতিত্ব রক্ষা করিতে পারিয়াছিল। যে কেল্টিক জাতিকে তাহারা প্রায় ধ্বংস করিয়াছিল তাহারা টিউটন অর্থাৎ স্যাক্সন জাতিদিগের অপেক্ষা সভ্য ছিল সন্দেহ নাই, সভ্য রোমানদের শাসনে থাকিয়া তাহারা ধর্ম ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক উন্নতি লাভ করিয়াছিল।
আবার দেখো, নর্ম্যানেরা যখন স্যাক্সন-অধিকৃত ইংলন্ডে আধিপত্য বিস্তার করিল, তখন তাহারা আর আপনাদের জাতিত্ব রক্ষা করিতে পারিল না– অল্প দিনেই স্যাক্সনদিগের সহিত মিশিয়া গেল, কিন্তু ইহার প্রচুর কারণ বিদ্যমান আছে। প্রথমত, যখন স্যাক্সনেরা ব্রিটন অধিকার করিতে আইসে, তখন তাহাদের অবস্থা পশুদের অপেক্ষা অল্পই উন্নত ছিল মাত্র, তখন তাহারা স্বার্থের জন্য নহে, রক্ত-পিপাসা-শান্তির জন্যই রক্তপাত করিত, ধ্বংসকার্যই তাহাদের দুর্দমনীয় উদ্যমের ক্রীড়া ছিল। রোমানদিগের অন্তঃক্ষয়কর শাসন-ভারে দুর্বল হতভাগ্য কেল্টজাতি যে তাহাদের ধ্বংসপ্রবৃত্তির সম্মুখে পড়িয়া বিনষ্ট হইবে তাহাতে আশ্চর্য নাই। কিন্তু সভ্যতর নর্ম্যান জাতিরা যখন ব্রিটনে পদার্পণ করিল তখন অকারণে রক্তপাত করা তাহাদের ব্যবসায় ছিল না, তখন তাহারা খৃস্টীয় ধর্মে দীক্ষিত হইয়াছে ও অন্যায় কার্য করিতে হইলেও ন্যায়ের নামে করা তাহাদের প্রথা হইয়াছিল। দ্বিতীয়ত, স্যাক্সন জাতিরা আপনাদের অনুর্বর দেশ পরিত্যাগ করিয়া বাস করিবার নিমিত্ত দলে দলে ব্রিটনে ঝাঁকিয়া পড়িল, কেল্টদিগের উপর আধিপত্য করা তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল না, দেশের অধিবাসী হওয়াই তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল, এরূপ অবস্থায় দেশের প্রাচীন অধিবাসীদিগকে বিনষ্ট করিয়া তাহাদের স্থান অধিকার করাই তাহাদের স্বার্থ ছিল। কিন্তু নর্ম্যানেরা ব্রিটন শাসন করিতে আসিয়াছিল, ব্রিটনের অধিবাসী হওয়া তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল না, ব্রিটনের অধিপতি হওয়াই তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল। তৃতীয়ত, কেল্টদিগের সহিত স্যাক্সনদিগের ধর্ম আচার ব্যবহার নীতি স্বভাব কোনো বিষয়েই ঐক্য ছিল না, কিন্তু স্যাক্সন ও নর্ম্যানদের মধ্যে অনেক ঐক্যস্থল ছিল। ভারতবর্ষ শাসন করিবার জন্য ও এখানে বাণিজ্য করিবার নিমিত্ত যে-সকল অল্প সংখ্যক ইংরাজ বাস করে তাহারা নিয়মিত সময় উত্তীর্ণ হইলেই আবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে, আবার নূতন দল এ দেশে আগমন করে, কিন্তু এরূপ না হইয়া যদি অল্প সংখ্যক শাসয়িতৃদল এ দেশে চিরকাল বাস করিত, তাহা হইলে সেই ক্ষুদ্র দল বিশেষ প্রতিবন্ধক না পাইলে খুব সম্ভবত ভারতবর্ষীয়দের সহিত মিশিয়া যাইত। নর্ম্যানদের সেই অবস্থা হইয়াছিল, নর্ম্যান্ডি হইতে একদল নর্ম্যান ব্রিটিশদিগকে অধীনে রাখিবার নিমিত্ত ব্রিটনে গিয়াছিল, কিন্তু তাহারা আর স্বদেশে ফিরিল না। ব্রিটন-বিজেতা যখন স্বয়ং ব্রিটনে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন তখন জেতা ও জিতদিগের মধ্যে মিলন না হওয়াই আশ্চর্য। হিন্দুজাতি যদি নিতান্ত স্বাতন্ত্র্য-প্রিয় না হইত, তাহা হইলে মুসলমান বিজেতাদিগের সহিত হয়তো মিলিয়া যাইত।
দূর পর্যন্ত দেখিতে গেলে যে জাতিই ইংলন্ড জয় করিয়াছে সকলেই টিউটনিক বংশভূত। স্যাক্সন, ডেনিস ও নর্ম্যান সকলেই এক জাতীয় লোক। টিউটনিক জাতিদিগের জাতিগত স্বভাব অনুসারে নর্ম্যান অর্থাৎ Northman গণ দলে দলে তাহাদের জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া দেশে দেশে দস্যুতা করিয়া ফিরিত। এই মহা দুর্দান্ত সামুদ্রিক দস্যুগণের তরণী দূর হইতে দেখিলে সমস্ত য়ুরোপ কম্পিত হইত, ভূমধ্যস্থ সাগরে এই নর্ম্যান দস্যুদের জাহাজ দেখিয়া মহাবীর শার্লমেন একদিন অশ্রু বিসর্জন করিয়াছিলেন। ইহারা অসাধারণ সামুদ্রিক ছিল, ইহাদের রক্তে Nilson সৃষ্ট হইয়াছিল, ইহাদেরই নিকট হইতে ইংরাজেরা সুনাবিকতার বীজ প্রাপ্ত হইয়াছেন। সত্য মিথ্যা জানি না, প্রবাদ আছে, ইহারা কলম্বসের বহুপূর্বে আটলান্টিক পার হইয়াছে। পূর্বকালে ফিনিসীয়গণ সামুদ্রিক ছিল কিন্তু তাহারা বাণিজ্য করিবার নিমিত্ত দেশ-বিদেশ পর্যটন করিত, অর্থ উপার্জিত হইলে স্বদেশে ফিরিয়া যাইত, কিন্তু নর্ম্যানগণ আপনাদের কুজ্ঝটিকাময় অন্ধকার অনুর্বর দেশ পরিত্যাগ করিয়া উজ্জ্বল, ধনধ্যানশালী ইটালি, ফ্রান্স ও ইংলন্ড প্রভৃতি স্থানে চির-আশ্রয় গ্রহণ করে। আশ্চর্য এই যে, যেখানেই গিয়াছে সেইখানেই তাহাদের জাতিত্ব লোপ পাইয়াছে, এখন আর নর্ম্যান বলিয়া একটি জাতি নাই। যদিও নর্ম্যান জাতি স্যাক্সনদের সঙ্গে মিশিয়া গেল তথাপি ইংরাজ-ইতিহাসে তাহারা ঘোরতর পরিবর্তন বাধাইয়াছিল। নর্ম্যানেরা না মিশিলে ইংরাজেরা এ ইংরাজ হইত কি না সন্দেহস্থল। আমরা ফ্রান্সে নর্ম্যানদের উপনিবেশ হইতে আরম্ভ করিয়া ইংলন্ড পর্যন্ত তাহাদের অনুগমন করিব।
ফ্রান্সে এখন ক্লোভিস (Clovis)-বংশোদ্ভব রাজগণ সিংহাসনচ্যুত হইয়াছেন ও শার্লমেনবংশীয় রাজগণের রাজপ্রভাব জীর্ণপ্রায় হইয়াছে, এমন সময়ে উত্তর দেশীয় ক্ষুধিত পঙ্গপাল ফ্রান্সের উর্বর ক্ষেত্রে ঝাঁকিয়া পড়িল। প্যারিস তখন ফ্রান্সের রাজধানী ছিল না। নর্ম্যানদিগের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ফ্রান্সের দুর্বল অধিপতি, Charles রবট্কে (Roborts the Strong) এক বৃহৎ জায়গীর দিয়া সীমান্ত রাজ্যে অধিষ্ঠিত করেন। রবটের পুত্র ওডোর সময়ে প্যারিস সেই রাজ্যের প্রধান নগরী হয়। ফরাসিরাজ তখন হয়তো সন্দেহ মাত্র করেন নাই যে, তিনি বহিঃশত্রু হইতে রাজ্যরক্ষা করিবার জন্য গৃহের মধ্যে শত্রু পোষণ করিতেছেন। যখন ফ্রান্স-অধিপতির রাজকীয় উপাধি ভিন্ন অন্য বড়ো একটা কিছু অবশিষ্ট ছিল না, তখন বলীয়ান প্যারিসের জায়গীরপতি তাঁহার সিংহাসনের প্রতি এক-একবার কটাক্ষপাত করিতেছিলেন, এমন সময়ে নর্ম্যানগণ প্রকৃত প্রস্তাবে ফ্রান্সের রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইল। তখন ফ্রান্সের বড়ো দুরবস্থা। বলিতে গেলে, তখন বর্তমান ফ্রান্স গঠিত হয় নাই, তখন পুরাতন ফ্রান্স জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল। ফ্রান্স তখন খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হইয়াছিল। ভিন্ন লোক তোমার শত্রু না হইতে পারে, কিন্তু আপনার লোক ভিন্ন হইয়া গেলে সে তোমার শত্রু হইয়া দাঁড়ায়। ফ্রিমেন সাহেব অতি যথার্থ কথা বলিয়াছেন যে, “ফ্রান্সের প্রতি বিভিন্ন খণ্ড যদি বিভিন্ন দেশ হইয়া যাইত, তাহাদের মধ্যে যদি কোনো যোগ না থাকিত, তবে সে বিভাগে ভয়ের কারণ থাকিত না। প্রত্যেক ক্ষুদ্র অধিরাজ্য-স্বামীর ইচ্ছা তাঁহার সীমা বাড়াইয়া লন– বাহিরের শত্রু আক্রমণ করিলে জাতীয়ভাবে সকলে একত্রে মিলিত হইয়া তাহাকে বাধা দেওয়া দূরে থাকুক, সকলেই ভয় করিতে থাকে, পাছে তাহাদের মধ্যে আর কেহ শত্রুর সাহায্য লইয়া তাহার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, অতএব তাহা সহজেই মনে হইতে পারে যে, আগে হইতে আমিই যে কেন শত্রু-সাহায্যের সুবিধা ভোগ না করিয়া লই!’
তখন য়ুরোপের অবস্থা অতি শোচনীয় ছিল। চারি দিক হইতে মুমূর্ষু অথবা মৃত রোমীয় প্রভাবের উপর শকুনি ও গৃধিনীদল ঝাঁকিয়া পড়িতেছিল। তখন দারুণ অরাজকতার কাল। স্যারাসীনগণ সার্ডিনিয়া ও সিসিলি অধিকার করিয়া গ্রীস, ইটালি ও নিকটবর্তী দেশসমূহে উপদ্রব করিতেছিল। দুর্দান্ত সক্ল্যাভোনীয়গণ (Sclavonians) জর্মনির অধিকার হইতে বোহেমিয়া, পোল্যান্ড এবং প্যানোনিয়া (আধুনিক অস্ট্রিয়া) কাড়িয়া লইয়াছিলেন। তাতার জাতীয় দস্যুদল নিদারুণ উপপ্লবে সমস্ত ইটালি, জর্মানি ও দক্ষিণ ফ্রান্স কম্পিত করিয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু সর্বাপেক্ষা এই উত্তর দেশীয় সামুদ্রিক দস্যুগণ এই নর্থম্যান নরশোণিত-পিপাসুগণ প্রচণ্ড ছিল। উপর্যুপরি ইংলন্ড এবং ফ্রান্স তাহারা বিপর্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। তাহারা যখন ইংলন্ড আক্রমণ করিত, তকন ফ্রান্স বিশ্রাম করিত, যকন ফ্রান্স আক্রমণ করিত তখন ইংলন্ড বিশ্রাম করিত। ইবতক্ষরনড় ঢ়বন আতরধ-এর রাজত্বকালে ইহারা ফ্রান্সের অন্তঃপ্রদেশে প্রবেশ করিতে পারিয়াছিল। তখন চার্লস ও তাঁহার পরিবারের মধ্যে গৃহ-বিবাদ ঘটিয়া রক্তপাতে ফ্রান্স দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। ক্ষুদ্র প্রাদেশিক রাজগণ অবাধ্য হইয়া উঠিয়াছিল।
নর্থম্যান দস্যুদল ফ্রান্সে এবং ইংলন্ডে নূতন প্রকার যুদ্ধের প্রথা অবলম্বন করিয়াছিল। নদী বহিয়া তাহারা যে দ্বীপ পাইত, সেইখানেই দুর্গ নির্মাণ করিত। এই দুর্গসকল তাহাদের লোপ্ত্র দ্রব্যের ভাণ্ডার ছিল, তৎসমুদায় তাহাদের রমণী ও শিশুদিগের নিবাস-ভূমি ছিল ও পরাজয়কালে আশ্রয়স্থান ছিল। দুর্বল ফ্রান্স-অধিপতি অস্ত্রের বলে তাহাদের বাধা দিতে অক্ষম ছিলেন, সুতরাং অর্থ দিয়া তাহাদের অত্যাচার নিবারণ করিতে হইত, কিন্তু ইহাতে তাহাদের অর্থতৃষ্ণা বৃদ্ধি করা হইত মাত্র। অবশেষে Charles the Simple নর্ম্যান্ডি দেশ দান করিয়া তাহাদের নিকট শান্তি ক্রয় করিলেন। তাহাতে হানি হইল না, নর্ম্যান্ডি ফ্রান্স হইতে বিচ্ছিন্ন হইল না। নর্ম্যানদের ভাষা ফরাসি হইল, নর্মানদের আচার-ব্যবহার ফরাসি হইল, নর্ম্যান জাতি ফরাসিস্ হইয়া দাঁড়াইল, নর্ম্যানদিগের অধিপতি রলফ (Hrolf) নর্ম্যান্ডির রাজা হইলেন।
ইহার এক শতাব্দী পরে নর্ম্যান্ডির রাজা ইউলিয়ম ইংলন্ড আক্রমণ করিলেন। এক শতাব্দী পূর্বে যে জাত অকারণে ও অন্যায়রূপে ফ্রান্সে পদার্পণ করিয়াছিল আজ তাহারাই পররাষ্ট্র ইংলন্ড আক্রমণ করিতে চলিল। কিন্তু ইতিমধ্যে সেই ডেনিস দস্যুদলের অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। অন্যায় কার্যের উপর একটা ন্যায়ের আবরণ না পরাইতে পারিলে তাহাদের লজ্জা বোধ হয়। ন্যায্যরূপে ইংলন্ডের সিংহাসন তাঁহার প্রাপ্য বলিয়া উইলিয়ম ইংলন্ডের দ্বারে গিয়া আঘাত দিলেন। ন্যায়কে বল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করাই যেন তাঁহার উদ্দেশ্য, এমনি একটা ভান করিলেন। ইংলন্ড-জয়ের কাহিনী আজ আর নূতন করিয়া উল্লেখ করিতে হইবে না, সকলেই তাহা জানেন।
শতাব্দী-পূর্বে নর্ম্যানরা যখন ফ্রান্সে দস্যুতা করিত তখন লোকে তাহাদের দস্যু বলিত, শতাব্দী-পরে যখন তাহারা ইংলন্ডে দস্যুতা করিল, তখন লোকে তাহাদের বিজয়ী কহিল। কিন্তু এই এক শতাব্দীর মধ্যে নর্ম্যান জাতির কী পরিবর্তন হইয়াছে আলোচনা করিয়া দেখো, দেখিবে, তাহারা সেই দুর্দান্ত, বিপদ-অন্বেষী দস্যুই রহিয়াছে, কেবল ফরাসি কথা কহিতে ও ফরাসি জাতির আচার-ব্যবহার অনুকরণ করিতে শিখিয়াছে। যদিও তাহারা ফরাসিদের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল, তথাপি নর্ম্যান জাতি বলিয়া তাহাদের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। সভ্য জাতির উপযোগী শিল্পে তাহাদের সুরুচি জন্মিয়াছে; নর্ম্যান অধিকারের পর হইতে শিল্প-সমাগম-শূন্য ইংলন্ডে শত শত সুশোভন গির্জা ও প্রাসাদ নির্মিত হইল। এক শতাব্দীর মধ্যে এই অসভ্য দুস্যুদিগের হৃদয়ে সৌন্দর্য-জ্ঞান উদ্বোধিত হইল। নর্ম্যান্ডির সমাজে বিদ্যা যথোচিত সমাদর প্রাপ্ত হইল। ল্যান্ফ্র্যেঙ্কের (Lanfrenc) প্রতিষ্ঠিত বেকের বিদ্যালয় (School of Bec) তখনকার প্রধানতম বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে গণ্য হইল। বিজেতা উইলিয়মের পুত্র হেনরির বিদ্বান বলিয়া খ্যাতি ছিল, তাঁহার উপাধি ছিল সুপণ্ডিত, Beanclirk অল্প দিনের মধ্যেই ইহাদের ফরাসি ভাষায় এমন ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছিল যে, এই হঠাৎ-সভ্য দস্যুরা ফরাসিদের মতোই কবিতা ও গদ্য লিখিতে পারিত। কিন্তু তথাপি তাহাদের অন্তরে অন্তরে সেই টিউটনিক ভাব জাজ্বল্যমান ছিল। সভ্যতার মূল তাহাদের হৃদয়ে গাঢ়ভাবে নিহিত হইতে পারে নাই। তাহাদের নিষ্ঠুরতার কাহিনী যদি পাঠ কর, তবে শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিবে। বিজিত ইংলন্ডে তাহারা লোকদের পা বাঁধিয়া ঝুলাইয়া রাখিত, ও সেই নিম্নশির ব্যক্তিদের ধূম সেবন করাইয়া যন্ত্রণা দিত। কখনো বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, কখনো বা মুণ্ড বাঁধিয়া হতভাগ্যদের ঝুলাইয়া দিত ও তাহাদের পায়ে জ্বলন্ত বস্ত্র বাঁধিয়া দেওয়া হইত। মাথায় দড়ি বাঁধিয়া যতক্ষণ না তাহা মস্তিষ্ক ভেদ করিত, ততক্ষণ আকর্ষণ করিত। ভেক ও সরীসৃপসংকুল কারাগারে লোকদের কারাবদ্ধ করিত। ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ, অগভীর ও তীক্ষ্ণ-প্রস্তর-পূর্ণ সিন্দুকে জোর করিয়া মানুষ পুরিত এবং এইরূপে তাহাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চূর্ণ করিত। অনেক ব্যারনদিগের দুর্গে Countess of Albimarle) একটি কোমরবন্ধ দিবার কথা মনে করাইয়া না দেওয়াতে রাজা জন উইঞ্চেস্টরের বিশপকে ১ টন মদিরা দণ্ড দিতে বাধ্য করান। এমন কত সামান্য সামান্য বিষয়ে দণ্ড দিতে হইত। বিশেষ ব্যক্তির নামে নালিশ করিতে বা বিশেষ আদালতে মকদ্দমা উত্থাপন করিতে বা বিচারে ন্যায্য ভূমিখণ্ড পাইলে তাহা দখল করিতে, টাকা দিতে হইত। পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখিলে প্রত্যর্থী বিচারের বিলম্ব করাইতে, কখনো বা অন্যায় বিচারের সাহায্য করিতে রাজাকে টাকা দিত। সুবিচার ও শীঘ্র বিচার পাইবার জন্য ন্যায্য বিচারাকাঙক্ষী অর্থীকে আবার অর্থ দিতে হইত। স্যাক্সন ক্রনিকল-লেখক বিলাপ করিয়া বলিতেছেন, “ঈ্শ্বর জানেন, এই হতভাগ্য ব্যক্তিগণ কী অন্যায়রূপে পীড়িত হইতেছে। প্রথমে তাহাদের ধন-সম্পত্তি কাড়িয়া লওয়া হয়, পরে তাহাদিগকে মৃত্যুমুখে নিক্ষেপ করে। এই বৎসরে (১১২৪) অতি দুষ্কাল পড়িয়াছে। গুরুভার করে ও অন্যায় ডিক্রিতে সকলেই আপনার আপনার সম্পত্তি খোয়াইতেছে।’ “তাহারা (নর্ম্যানরা) করে করে গ্রামের সমস্ত ধন-সম্পত্তি শোষণ করিয়া লইয়া অগ্নি লাগাইয়া দেয়। ভ্রমণ করিতে বাহির হইলে দেখিতে পাইবে গ্রামে একটি লোক নাই, ভূমি আকৃষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে। যদি দেখা যায় দুই-তিনটি মাত্র ব্যক্তি অশ্বারোহণে একত্রে চলিতেছে, অমনি গ্রামসুদ্ধ লোক তাহাদিগকে লুণ্ঠনকারী মনে করিয়া গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যায়। লোকে প্রকাশ্যভাবে বলিত যে, ক্রাইস্ট ও তাঁহার Saint গণ ঘুমাইয়া আছেন।’ টিউটনিক স্যাক্সন বিজেতাগণ পরাজিত শেল্টদিগকে যেরূপ নিষ্পীড়িত করিয়াছিল, এই ফরাসি চাকচিক্য-প্রাপ্ত টিউটনিক জাতিও কি পরাজিত জাতির প্রতি সেইরূপ ব্যবহার করিল না? বিজিতদের দেশে বিজেতার এরূপ অত্যাচার এরূপ অসভ্য ব্যবহার অনেক পরিমাণে স্বাভাবিক বলিয়া গণ্য হইতে পারে, কিন্তু তাহাদের নিজ দেশে, যেখানে চারি দিক হইতে খৃস্টধর্ম-দীক্ষিত সভ্য জাতির নেত্র পড়িয়া আছে, সেখানে তাহাদের কীরূপ ব্যবহার? বালক উইলিয়ম যখন নর্ম্যান্ডির সিংহাসনে আরোহণ করিলেন, তখন বালক-হস্ত-স্থিত রাজদণ্ডের দুর্বলতা প্রযুক্ত নর্ম্যান জাতির অন্তর্গত পশুত্ব কীরূপ প্রকাশ পাইয়া উঠিল একবার আলোচনা করিয়া দেখো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামীগণের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধ-বিগ্রহের তো কথাই ছিল না, কিন্তু প্রকাশ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ যতই অন্যায় হউক-না সচরাচর তাহা বীরত্বের মধ্যে গণ্য হইয়া থাকে, সুতরাং সে বিষয়ে আমরা কিছু বলিব না; কিন্তু গুপ্তহত্যা তখন এমন মুহুর্মুহু অনুষ্ঠিত হইত যে, লোকের চক্ষে তাহার ভীষণত্ব হ্রাস হইয়া গিয়াছিল। তখন ছুরিকা ও বিষ, রোগ বিপত্তি প্রভৃতি পৃথিবীর অনিবার্য আপদের মধ্যে গণ্য হইয়া গিয়াছিল। অনেক সময়ে অজ্ঞাত কারণে অসন্দিগ্ধ-চিত্ত নিরস্ত্র অতিথিকে ভোজের স্থলে হত্যা করা হইত। বেলেমের (Belesme) অধিস্বামী উইলিয়ম ট্যালভ্যাস তাঁহার স্ত্রীর ধর্মিষ্ঠতা ও সচ্চরিত্রতা হেতু বিরক্ত হইয়া গোপনে হত্যাকারী রাখিয়া গির্জায় যাইবার পথে তাহাকে বিনাশ করেন; বিনাশ করিবার এমন দারুণ কারণ শুনি নাই, এমন দারুণ সময় দেখি নাই! এই দুর্বৃত্ত তাহার দ্বিতীয়বার বিবাহকালে বিবাহ-সভাস্থ এক অসংশয়-চিত্ত অতিথির চক্ষু উৎপাটিত ও নাসা কর্ণ ছেদন করে। এইরূপ নীতির ঘোরতর ব্যভিচার দেখিয়া ধর্মযাজকগণ, নীতির সংস্কারের প্রতি মনোযোগ দিলেন। গুপ্ত যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যায় মনুষ্যহত্যা নিবারণের জন্য তাঁহারা যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তাঁহাদের চেষ্টা সফল হইল না। অবশেষে হতাশ হইয়া তাঁহাদের সংস্কারের সীমা সংকীর্ণ করিলেন। কতকগুলি বিশেষ গুরুতর পাপকার্যের অনুষ্ঠান নিষেধ করিলেন, কতকগুলি বিশেষ ব্যক্তিদিগকে সম্মান করার নিয়ম করিলেন, এবং কতকগুলি বিশেষ পুণ্য মাসে বা সময়ে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ রাখার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু নর্ম্যান্ডিতে এ চেষ্টা সফল হইল না। যাজকগণ বুধবার সন্ধ্যা হইতে সোমবার প্রভাত পর্যন্ত সকল প্রকার ভীষণ কার্যের অনুষ্ঠান রহিত করিতে আদেশ দিলেন; কিন্তু নর্ম্যান্ডিতে ছুরিকা এতক্ষণ বিশ্রাম করিতে পারিত না, নর্ম্যান হৃদয়ে নরকের জাগ্রত উপদেবতা এতকাল নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিলে আপনাকে দংশন করিতে থাকিত, সুতরাং ইহাও অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইল। অবশেষে ক্যাম্ব্রের বিশপ জেরাড এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, ভূপালদিগের কার্য রক্তপাত করা ও যাজকদিগের কার্য প্রার্থনা করা। এক দল পাপ করিবে, আর-এক দল তাহাদের হইয়া দেবতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবে! জেরাড অন্যান্য বিশপদিগকে ক্ষান্ত হইতে পরামর্শ দিলেন, তাহাদের কার্য প্রার্থনা করা, তাহাদের অনধিকার চর্চা করিবার আবশ্যক কী? তিনি কহিলেন, সংস্কারের নিয়ম প্রচারিত করিলে লোকের মধ্যে কপটতা প্রশ্রয় পাইবে মাত্র। কাটাকাটির মুখ হইতে নর্ম্যানদিগকে বঞ্চিত করিবার চেষ্টা করা নিতান্ত দুরাশা। নিদারুণ কার্য নহিলে তাহারা আমোদ পাইত না। সিংহ-হৃদয় রিচার্ডকে নর্ম্যান কবি কহিতেছেন, ইহা অপেক্ষা উত্তম নৃপতির কথা কখনো কাব্যে গীত হয় নাই! এই নৃপতি ক্রুসেড যুদ্ধকালে একবার শূকর-মাংস খাইবার অভিলাষ প্রকাশ করেন। পাচক শূকর না পাওয়াতে একজন স্যারাসীনকে কাটিয়া তাহার তাজা ও কোমল মাংস রন্ধন করিয়াছিল। সে মাংস রাজার বড়োই ভালো লাগিল, তিনি শূকরের মুণ্ড দেখিতে চাহিলেন। ভীত-হৃদয় পাচক সভয়ে নরমুণ্ড আনিয়া উপস্থিত করিল। রিচার্ডের বড়োই আমোদ বোধ হইল, তিনি হাসিয়া উঠিলেন, কহিলেন, “খাদ্যের এমন সুবিধা থাকিলে দুর্ভিক্ষের ভয় থাকিবে না।’ জেরুজিলাম বিজিত হইলে সত্তর হাজার (৭০,০০০) অধিবাসী হত হয়। দ্বিতীয় হেনরি একবার ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার বালক ভৃত্যের চক্ষু ছিঁড়িয়া ফেলিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। রিচার্ড নগর অধিকার করিলে পর স্যারাসীন-রাজ স্যারাসীন বন্দীদের মার্জনা প্রার্থনা করিয়া দূত প্রেরণ করিলেন। রিচার্ড ত্রিশ জন স্যারাসীন বন্দীর মাথা কাটিয়া প্রত্যেক মাথায় হত ব্যক্তির নাম লিখিয়া, রন্ধন করিয়া প্রত্যেক দূতের সম্মুখে আহারার্থে রাখিতে অনুমতি দিলেন ও তাঁহার নিজের পাত্রে যে মুণ্ড ছিল তাহা অতি উপভোগ্য পদার্থের ন্যায় খাইতে লাগিলেন। ষাট হাজার বন্দী ক্ষেত্রে আনীত হইলে নর্ম্যান কবি কহিতেছেন–
ক্ষেত্র পুরি দাঁড়াইল বন্দীগণ সবে,
দেবতারা স্বর্গ হতে কহিলেন তবে।
“মারো মারো কাহারেও ছেড়ো না, ছেড়ো না,
কাটো মুণ্ড, এক জনে কোরো না মার্জনা।’
শুনিলা রিচার্ড রাজা বাণী দেবতার,
ঈশে ও পবিত্র ক্রসে কৈলা নমস্কার।
এমন নিদারুণ আদেশ দেবতাদের মুখেই সাজে। এ ঘটনা সত্য না হইতেও পারে, কিন্তু নর্ম্যান কবি রিচার্ডের গৌরব-প্রচার-মানসেই ইহা কীর্তন করিয়াছেন, ইহাতে কি তখনকার লোকের মনোভাব প্রকাশ পাইতেছে না? কীরূপ ঘটনায় তখনকার লোকের হৃদয়ে ভক্তিমিশ্রিত বিস্ময় ও বিস্ময়-মিশ্রিত আনন্দের উদয় হইবে তখনকার কবি তাহা বিলক্ষণ বুঝিতেন। রিচার্ড কোনো নগর অধিকার করিলে সেখানকার শিশু ও অবলাদের পর্যন্ত হত্যা করিতেন। এই রিচার্ডই তখনকার লোকদের নিকট দেবতার স্বরূপ, কবিদের নিকট আদর্শ বীরের স্বরূপ বিখ্যাত ছিলেন। এমন-কি, এই “ঊনবিংশ শতাব্দীর’ ইংরাজি ঐতিহাসিকেরাও হয়তো তাঁহাকে দৈমুর বা জঙ্গিস্ খাঁর সহিত গণ্য করিতে সংকোচ বোধ করিবেন। সেনল্যাকের যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরাজ-সৈন্যের পরাজয়ের পর যেখানে বাণ-বিদ্ধ হ্যারল্ড ভূপতিত হন, সেইখানে বসিয়া উইলিয়ম মৃত দেহরাশির মধ্যে পান ভোজন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
নর্ম্যানেরা যখন ইংলন্ড বিজয় করিতে আইসে, তখন তাহাদের এইরূপ অবস্থা। স্যাক্সনেরা তখন কী করিতেছে? “স্যাক্সনেরা পরস্পর জেদাজেদি করিয়া সর্বদা মদ্যপানে রত আছে; দিবারাত্রি পান ভোজনেই তাহারা অর্থ ব্যয় করিতেছে, অথচ তাহাদের বাসস্থান অতি হীন! কিন্তু ফরাসি ও নর্ম্যানগণ অতি অল্প ব্যয়ে জীবন যাপন করে, অথচ দিব্য বৃহৎ গৃহে বাস করে, তাহাদের আহার্য উত্তম, বস্ত্র অতিশয় পরিপাটি’ অর্থাৎ স্যাক্সনদের এখনো শিল্পে রুচি জন্মে নাই, উত্তেজনাময় হীন আমোদেই তাহাদের জীবন কাটিতেছে। যেদিন নর্ম্যানদের সহিত যুদ্ধ হইবে তাহার পূর্বরাত্রে “তাহারা সমস্ত রাত পান ভোজনে মত্ত আছে। তুমি দেখিতে পাইবে তাহারা মহা যুঝাযুঝি লাফালাফি, অট্টহাস্য ও গান-বাজনায় রত হইয়ছে’। তখন স্যাক্সনরা এমন মূর্খ, অনক্ষর অসভ্য ছিল যে, নর্ম্যানেরা মূর্খ স্যাক্সন যাজকদিগকে ধর্মমঠ হইতে দূর করিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছিল। স্যাক্সনদের এইরূপ অতি হীন অবস্থার সময় অপেক্ষাকৃত সুরুচি ও সুসভ্য নর্ম্যানগণ ইংলন্ডে পদার্পণ করিল। এই উপলক্ষে ইংলন্ডে শুদ্ধ যে কেবল সুশোভন প্রাসাদ উত্থিত ও বিদ্যাধ্যাপনশীল যাজকগণের সমাগম হইল তাহা নহে, নর্ম্যানদের প্রবল প্রতাপে ডেনমার্ক ও নরোয়েবাসী দস্যুদের হস্ত হইতে ইংলন্ড পরিত্রাণ পাইল। নর্ম্যানদের আগমনে ইংলন্ডের আরও অনেক অলক্ষিত উপকার হইয়াছিল, কিন্তু বিজিত জাতি বিজেতাদের হস্ত হইতে ন্যায় ও সুবিচারের আশা করিতে পারে না, বিশেষত বিজিত জাতি যখন বিজেতাদের অপেক্ষা সভ্যতায় হীন, তখন ন্যায়ের আশা হতভাগ্যদের পক্ষে দুরাশা! সমযোগ্য ব্যক্তির প্রতিই ন্যায়াচরণ করাই প্রায় পৃথিবীর নিয়ম, নিকৃস্টতরদিগকে পশুবৎ ব্যবহার করিতে লোকে অন্যায় মনে করেন না; যদি তাহাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করে তবে তাহা অনুগ্রহ মাত্র। পৃথিবীতে ন্যায়ের সীমাও এমন সংকীর্ণ। স্যাক্সনদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠিত হইল। যদি কোনো জেলায় একজন নর্ম্যান হত হইত, তাহা হইলে গ্রামবাসীদের হয় হত্যাকারীকে ধরাইয়া দিতে নয় প্রত্যেককে অর্থদণ্ড দিতে হইত, কিন্তু একজন স্যাক্সন হত হইলে বড়ো একটা গোলযোগ হইত না। নর্ম্যান ধর্মাচার্যগণ আসিয়া স্যাক্সন-রাজা ও তপস্বীদের কবরস্থ অস্থিরাশি অমান্যের সহিত উৎখাত করিয়া ফেলিতেন, ঐৎষ ঝতভররন-থষভড়-এর নিকট তাঁহার প্রজারা যথানির্দিষ্ট বিনতি দেখাইতে প্রাণপণ করিত। এক হাঁটু গাড়িয়া তাঁহাকে সম্ভাষণ করিত। তাঁহাকে যতখানি মান্য ও কর দিবার কথা, তদপেক্ষা অধিক দিয়াও বেচারীরা নিষ্কৃতি পাইত না। তিনি তাহাদিগকে যন্ত্রণা দিতেন, কয়েদ করিতেন, তাহাদের পশুপালের পশ্চাতে কুক্কুর লাগাইয়া দিতেন, তাহাদের বাহনদিগের মেরুদণ্ড পা ভাঙিয়া দিতেন। এই তো অত্যাচারী, উদ্ধত, গর্বিত, সভ্যতাভিমানী, বিজেতা নর্ম্যান জাতি!
আমরা অ্যাংলো-নর্ম্যান সাহিত্য আলোচনা করিবার পূর্বে নর্ম্যান জাতি-চরিত্র ও তাহাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লইয়া আন্দোলন করিলাম। কিন্তু ইহা যেন কেহ অনর্থক মনে না করেন। সাহিত্য মনুষ্য-হৃদয়ের ছায়ামাত্র; যে জাতির সাহিত্য আলোচনা করিবে তাহাদের চরিত্র আলোচনা যদি না কর তবে তাহা দারুণ অঙ্গহীন হইবে। এইখানে বলা কর্তব্য, আমরা যে অ্যাংলো-নর্ম্যান সাহিত্য আলোচনা করিতে বসিয়াছি, তাহার কারণ এমন নয় যে, অ্যাংলো-নর্ম্যান সাহিত্য অতি বিপুল, অ্যাংলো-নর্ম্যান সাহিত্য-ভাণ্ডার বহুমূল্য উজ্জ্বল মণিময়। কীরূপে ইংরাজি সাহিত্য গঠিত হইল তাহা জানিতে কাহার না ইচ্ছা হইবে? ইংরাজি সাহিত্যে ও ইংরাজি চরিত্রে নর্ম্যান প্রভাব স্পষ্ট লক্ষিত হয়– ইংরাজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত জানিবার নিমিত্তই আমরা নর্ম্যান সাহিত্য আলোচনা করিতেছি।
দ্বিতীয় প্রস্তাব
আমরা “স্যাক্সন জাতি ও অ্যাংলো-স্যাক্সন সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে বলিয়াছি যে, অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজত্বের পতনের কিছু পূর্বে অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি ক্রমশই অবনতির গহ্বরে নামিতেছিল। মাহাত্মা অ্যালফ্রেড তাঁহার প্রজাদের মধ্যে বিদ্যাচর্চা বিষয়ে যে উদ্যম উদ্রেক করিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পর তাহা ক্রমশ বিনষ্ট হইয়া গেল। অকর্মণ্যতা অজ্ঞতা ও আলস্যে সমস্ত জাতিই যেন জড়ীভূত ও অভিভূত হইয়া আসিতেছিল। টিউটনিক জাতির শিরায় শিরায় প্রধাবিত যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার জ্বলন্ত-বহ্নি তাহাও যেন ক্রমশই নির্বাপিত ও শীতল হইয়া আসিতেছিল। স্যাক্সনগণ যখন দিগবিদিক লুণ্ঠন করিবার মানসে দলবদ্ধ হইয়া সমুদ্রবক্ষে বিচরণ করিত তখন তাহাদের দলপতি ছিল বটে কিন্তু রাজা ছিল না, তখন তাহারা সর্বতোমুখী প্রভুতার অধীনে গ্রীবা নত করিতে পারিত না, কিন্তু যখন তাহারা ইংলন্ডে উপনিবেশ স্থাপন করিল তখন দলপতি ও দলস্ত ব্যক্তিদিগের মধ্যে ক্রমশ রাজা-প্রজার সম্বন্ধ স্থাপিত হইল, উভয়ের মধ্যে ঐক্যভাব ঘুচিয়া গেল ও সাধারণ ব্যক্তিদের অপেক্ষা দলপতি ক্রমে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত হইল। দলপতির পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও কতকগুলি উচ্চ পদের সৃষ্টি হইল, এইরূপে অধিবাসীগণ উচ্চ ও নীচ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইল। যেখানেই উচ্চ ও নীচ শ্রেণীর বিভাগ আছে, সেইখানেই যে উচ্চ শ্রেণী নীচ শ্রেণীর উপর আধিপত্য বিস্তার করিবে তাহার আর কী কথা আছে; ডেনিস দস্যুদের অত্যাচারে নিবাসীদের ধন প্রাণ এমন সংকটাপন্ন হইয়াছিল যে অ্যালফ্রেডের সময় হইতে ইহা এক প্রকার স্থির হইয়া গিয়াছিল যে, সকলকেই একজন Thign-এর অর্থাৎ প্রভুর আশ্রয়ে থাকিতে হইবে; (Thignঅর্থে ভৃত্য বুঝায় কিন্তু রাজার ভৃত্য হউক প্রজাদের প্রভু।) আশ্রয়দাতা ও আশ্রিতদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ স্থাপিত হইল, এইরূপে সকল অধিবাসীর সমান অধিকার ক্রমশ বিনষ্ট হইয়া গেল। বহিঃশত্রু, ডেনিস দস্যুদের দ্বারা স্যাক্সনেরা যথেষ্ট নিপীড়িত হইয়াছিল, কিন্তু তাহাই তাহাদের একমাত্র দুর্ভাগ্য নয়; তাহাদের আপনাদের মধ্যে ঐক্য ছিল না, ক্ষুদ্র ইংলন্ড তখন খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হইয়াছিল, প্রত্যেক প্রদেশ-স্বামী অপরাপর প্রদেশের উপর আধিপত্য স্থাপনের নিমিত্ত প্রাণ পণ করিতেছিল। এইরূপ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন উপদ্রুত শ্রান্ত দেশে সাহিত্যের যে যথেষ্ট অবনতি হইবে তাহাতে আর আশ্চর্য কী? যাহা সমগ্র জাতির হৃদয়ের কথা প্রকাশ না করে, সমগ্র জাতির হৃদয়ে যাহা প্রতিধ্বনিত না হয় তাহাকে আর জাতীয় সাহিত্য বলিব কী করিয়া? যে বিদ্যা কেবল ধর্মাচার্যগণের অধিকারের মধ্যেই বদ্ধ ছিল ও যে সাহিত্য আশ্রম-গৃহের ধূলিময় গ্রন্থাধারের অন্ধকারের মধ্যেই আচ্ছন্ন ছিল, সে বিদ্যাকে সমগ্র জাতির উন্নতির চিহ্ন ও সে সাহিত্যকে সমস্ত জাতির হৃদয়ের কথা বলিতে পারি না। একে তো বিদ্যাচর্চা অতিশয় সংকীর্ণ শ্রেণীতেই বদ্ধ ছিল, তাহাতে তাহার সীমা আরও ক্রমশ সংকীর্ণতর হইয়া আসিতে লাগিল, ধর্মাচার্যদের মধ্যে ক্রমশ বিদ্যানুশীলন রহিত হইল। এইরূপে অজ্ঞতা-অন্ধকারাচ্ছন্ন ইংলন্ডে রক্তপাত ও অশান্তি রাজত্ব করিতে লাগিল।
এইরূপ অবস্থায় যখন নর্ম্যানেরা ইংলন্ডে আসিল তখন তাহারা সাহিত্যশন্য নিষ্ফল স্যাক্সন ভাষা ও স্যাক্সনভাষীদের প্রাণপণে ঘৃণা করিত লাগিল। সুতরাং স্বভাবতই ফরাসি তখনকার সাধুভাষা, রাজভাষা ও লিখিবার ভাষা হইয়া দাঁড়াইল। পাছে অসভ্য স্যাক্সনদের সহিত মিশিয়া তাহাদের ভাষা ও আচার-ব্যবহার কলুষিত হইয়া যায় এইজন্য নর্ম্যানেরা তাহাদের সন্তানদের ফ্রান্সে পাঠাইয়া দিত। পাঠশালে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলকেই ফরাসি অথবা ল্যাটিন ভাষায় কথা কহিতে হইত। স্যাক্সন ইতর ভাষা হইয়া দাঁড়াইল। সে ভাষায় আর পুস্তক লিখা হয় না। তখন তো মুদ্রাযন্ত্র ছিল না, সুতরাং অতি অল্প লোকেরই পুস্তক প্রাপ্তি ও পাঠের সুবিধা ছিল, সাধারণ লোকদিগের পাঠ করিবার অবসর, সুবিধা ও ক্ষমতা ছিল না; যাহাদের পুস্তক পাঠ করিবার ক্ষমতা ছিল তাহারা সংগতিপন্ন উচ্চ শ্রেণীর লোক, তাহারা ফরাসি বা ল্যাটিন ছাড়িয়া গ্রাম্য স্যাক্সন পুস্তক পড়িতে স্বভাবতই সংকোচ ও অরুচি অনুভব করিত। আমাদের দেশে যখন নূতন ইংরাজি শিক্ষা প্রচলিত হয়, তখন আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ দুইছত্র ইংরাজি লিখিতে পারিলে যেমন বিদ্যাশিক্ষা সফল হইল মনে করিতেন, নর্ম্যান অধিকারে স্যাক্সন যুবাদেরও সেই দশা ঘটিয়াছিল। শুদ্ধ তাহাই নহে, এরূপ অবস্থায় স্যাক্সন ভাষায় লিখিতে চেষ্টা করা হেয় কার্যের মধ্যে গণ্য হওয়াই স্বাভাবিক। স্যাক্সন ভাষায় পুস্তক লিখিতে গেলে পাছে কেহ মনে করে, তবে বুঝি লেখক ফরাসি জানে না, ইহা অপেক্ষা লজ্জার কথা কী আছে বলো। কোনো কোনো কবি কয়েক ছত্র ফরাসি ও কয়েক ছত্র স্যাক্সন লিখিতেন, কেননা, এরূপ করিলে ফরাসি ভাষায় অজ্ঞতার অপবাদ লেখকের নামে পৌঁছাইতে পারে না, তাহা হইলেই তিনি এক প্রকার নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন। নিম্নে একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করিতেছি–
Len puet fere et defere,
Ceo fait-il trop sovent:
It nis nouther wel ne faire;
Therefore England is Shent.
Nostre prince de Englatere
Par le consail de sa gent
At Westministr after the feire
Made a gret parlement.
কেহ কেহ বা ল্যাটিন, ফরাসি ও চলিত ভাষা এই তিন মিশাইয়া কবিতা লিখিতেন–
When mon may mest do
Tunc ville suum manifestat
In donis also si vult tibi
Proemia proestat.
Ingrato benefac, post
Hoec a peyne te verra;
Pur bon vin tibi lac non dat
Nec rem tibi rindra.
দুই-তিনটি বিভিন্ন ভাষার এরূপ ঘোরতর মিশ্রণের ফল হয় এই যে, উহাদের কোনোটা বিশুদ্ধ থাকিতে পারে না, সকলগুলাই বিকৃত হইয়া যায়। ফরাসির মধ্যে স্যাক্সন ভাব ও কথা, স্যাক্সনের মধ্যে ফরাসি ভাব ও কথা প্রবেশ করিয়া ফরাসি ও স্যাক্সন উভয়েই ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে। ইংলন্ডে তাহাই হইয়াছিল। নর্ম্যান আমীর-ওমরাওগণ স্যাক্সনমিশ্রিত ফরাসি কহিতে লাগিল ও সাধারণ অধিবাসীগণ ফরাসিমিশ্রিত স্যাক্সন কহিতে লাগিল। নর্ম্যানেরা যে এত চেষ্টা করিয়াছিল, যাহাতে তাহাদের ভাষা বিশুদ্ধ থাকে, সে চেষ্টা সফল হইল না। যখন নর্ম্যান ও স্যাক্সনদের মধ্যে বিবাহের কোনো বাধা ছিল না, তখন স্যাক্সন ও ফ্রেঞ্চ দুই ভাষার মিশ্রণ নিবারণের কোনো উপায় ছিল না। এইরূপে যখন দুই ভাষা মিশিয়াছিল বা মিশিতেছিল, তখনকার সাহিত্য Semi-Saxonঅর্থাৎ অর্ধ-স্যাক্সন সাহিত্য নামে অভিহিত হইয়াছে।
সেমি-স্যাক্সন সাহিত্য আর কিছুই নহে, তাহা ইংরাজি সাহিত্যের বাল্যাবস্থা– সংগ্রহ, অনুকরণ ও অনুবাদের অবস্থা। ফরাসি সাহিত্যই তাহার আদর্শ। এ সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করিবার পূবে Chivalry-র বিষয় সংক্ষেপে অনুশীলন করা আবশ্যক।
“য়ুরোপীয় ক্ষাত্র ধর্ম’ বলিলে Chivalry-র একপ্রকার বাংলা অনুবাদ করা হয়, কেবল আমাদের ক্ষাত্রধর্মে মহিলা-পূজা ছিল না, Chivalry-তে তাহা ছিল। যদি “ক্ষতাৎ কিল ত্রায়ত ইত্যুদগ্রঃ, ক্ষত্রস্য শব্দো ভুবনেষু রূঢ়’ হয়, তবে Chivalrous- অর্থেও তাহাই বুঝায়। মধ্যযুগে য়ুরোপে যখন বলের নামই ন্যায়, ধর্ম, শক্তি ছিল, তখন সেই নির্দয় বলের হস্ত হইতে দুর্বলকে রক্ষা করাই Chivalry- উদ্দেশ্য ছিল! যদিও ইহাই তাহার উদ্দেশ্য তথাপি ফলে Chivalry সেই উদ্দেশ্য হইতে অনেক দূরে পড়িয়া ছিল– প্রকৃতপক্ষে, যশের ইচ্ছা তৃপ্ত করিবার নিমিত্ত বিজয় সাধন করিয়া বেড়ানোই Chivalry-র কার্য হইয়াছিল। আপনার বলের উপর বিশ্বাস থাকিলে সেই বল পরীক্ষা ও অনুশীলন করিবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী অন্বেষণের বাসনা হয়, এই নিমিত্ত মধ্যযুগের নাইটগণ (Knight) বিপদ অন্বেষণ ও দুঃসাহসিকতা অনুষ্ঠান করিয়া বেড়াইতেন। সমাজের আদিম অবস্থায় রক্তপিপাসা শান্তির নিমিত্তই লোকে রক্তপাত করিত, কিন্তু য়ুরোপের সমাজ যখন অধিকতর উন্নত হইল তখন যশ-ইচ্ছার নিমিত্ত রক্তপাত প্রচলিত হইল। সামাজিকতা বিষয়ে অনেক উন্নত না হইলে কখনো যশের ইচ্ছা জন্মিতে পারে না। সমাজে বিখ্যাত হইবার ইচ্ছাই সমাজের প্রতি অনেক পরিমাণে মমতা জন্মিবার চিহ্ন। Chivalry-র আর-এক ভাগ মহিলা-পূজা। এই মহিলা-পূজা এমন অপরিমিত সীমায় পৌঁছিয়াছিল যে, তাহা সমূহ গর্হিত ও হাস্যজনক। ঈশ্বর ও মহিলা-পূজা এক শ্রেণীর অন্তর্ভূত হইয়াছিল। বুর্বোঁর ডিউক Louis II তাঁহার নাইটদিগকে বলিয়াছিলেন যে, ‘From them (ladies) after God comes all the honour that men can acquire। ‘অ্যারাগনের অধিপতি Chivalry ভাব ইংলন্ডে আনয়ন করিল। Chivalrous কবিতা ও সংগীত Semi-Saxon সাহিত্য পূর্ণ করিল। ইহার পূর্বে অ্যাংলো-স্যাক্সন সাহিত্যে রক্তপাত ও যুদ্ধের বর্ণনা অনেক ছিল, কিন্তু তাহার মধ্যে Chivalry ভাব কিছুমাত্র ছিল ন। এখন বীরত্বের গৌরব কীর্তন, বিজয়-সংগীত ও রমণীদের স্তুতিবাদে ইংরাজি সাহিত্যক্ষেত্র ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। কিন্তু সকলগুলিই প্রায় অনুবাদ, ও তাহাদের মধ্যে কবিত্ব-উচ্ছ্বাস কিছুমাত্র নাই। অতি পরিষ্কারভাবে ছত্রের পর ছত্র আসিতেছে, গল্পের স্রোত অতি নির্বিবাদে চলিয়া যাইতেছে, তাহার মধ্যে ভাব নাই, তুলনা নাই, কবিত্বপূর্ণ বিশেষণ নাই, কতকগুলি কথা ও ঘটনা জোড়া তাড়া দিয়া এক-একটা স্ফীতোদর পুস্তক রচিত হইয়াছে। লেখক অতিশয় বিরক্তিজনক অনর্গল বক্তার মতো বকিয়া বকিয়া, গল্প টানিয়া বুনিয়া, কথা বিনাইয়া পাঠকের নিদ্রাকর্ষণ না করিয়া ক্ষান্ত নহেন। যত প্রকার অলীক অস্বাভাবিক, আশ্চর্যজনক কথা লেখকের কল্পনায় আসিতে পারে সকলেই তিনি তাঁহার গল্পে গাঁথিয়া দিতে চাহেন। Romance of Alexander নামক কাব্যগ্রন্থ হইতে দুই-একটা নমুনা দিতেছি–
মকর নামেতে প্রাণী আশ্চর্য আকার
বলবান প্রাণী বটে, বড়ো জাঁক তার–
কুমীরের ‘পরে যদি পড়ে তার চোখ,
তবে আর রক্ষে নেই, দেখে কেবা রোখ?
দুজনে লড়াই বাধে বড়ো ঘোরতর
প্রহারে দোঁহারে দোঁহে করে জর জর
মকর সেয়ানা বড়ো দোঁহার মাঝারে,
চুপি চুপি অমনি সে জলে ডুব মারে;
মুখে তার তীক্ষ্ণ অস্ত্র, কমীরের পেটে
যেমন বিঁধিয়ে দেয়, মরে পেট ফেটে॥
একটি ypotame-এর বর্ণনা শুনুন–
জলহস্তী বড়োই আশ্চর্য জানোয়ার,
হাতিও তেমন নহে কী কহিব আর!
ঘোড়ার মতন তার ঘাড়, পিঠ, জানি,
লেজ তার বাঁকা আর খাটো শুঁড়খানি!
পিচের মতন তার রঙ বড়ো কালো
যত কিছু ফল খেতে বড়ো বাসে ভালো,
আপেল বাদাম আদি কিছু নাহি ছাড়ে,
কিন্তু সব চেয়ে তৃপ্তি মানুষের হাড়ে!
এই তো কবিতার শ্রী। এরূপ ধৈর্যনাশক শ্লোকসমূহ উদ্ধৃত করিতে আমরা ভয় করিতেছি, সুতরাং নিরস্ত হইতে হইল। কেবল তখনকার Romance নামক গ্রন্থসকলের ভাব বুঝাইবার জন্য Gest of kyng Horn নামক গ্রন্থের মর্ম পাঠকদের কহিতেছি। রাজা “মারে’ যুদ্ধে বিধর্মী স্যারাসীনদের দ্বারা হত হইলে পর তাঁহার পুত্র, গ্রন্থের নায়ক, হর্ন একটি ক্ষুদ্র নৌকায় কতকগুলি সঙ্গীর সহিত রাজা এমারের (Aylmer) দেশে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানকার রাজসভায় তিনি বিদ্যা শিক্ষা করেন। ক্রমে রাজা এমারের একমাত্র কন্যা রিমেন্হিল্ড্ (Rimenhild) তাঁহার প্রেমে পড়িল। রাজকন্যা, হর্নকে একটি মায়াময় অঙ্গুরী উপহার দেন। সেই অঙ্গুরী লইয়া তিনি স্যারাসীনদের সহিত যুদ্ধ করিতে বহির্গত হন, ও অঙ্গুরী প্রভাবে তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া পুনরায় এমারের সভায় ফিরিয়া আসেন। কিন্তু রাজা এমার হর্নের সহিত তাঁহার কন্যার প্রেম বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া হর্নকে নির্বাসিত করিয়া দেন। হর্ন তাঁহার প্রণয়িনীর সহিত বিদায় লইবার সময় বলিয়া গেলেন যে, রাজকন্যা যেন সাত বৎসর তাঁহার জন্য অপেক্ষা করেন– ইতিমধ্যে তিনি যদি না ফিরিয়া আসেন, তবে রাজকুমারী আর কাহাকেও বিবাহ করিতে পারেন। ইতিমধ্যে রাজা মোডি রিমেন্হিল্ড্কে বিবাহ করিবার পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। রাজকুমার হর্ন ঘটনাচক্রের আবর্তনে অনেক বিপদ-আপদ সহিয়া রাজা মোডির মুষ্টি হইতে রাজকন্যাকে মুক্ত করিয়া বিবাহ করিলেন। বিবাহের পর তিনি যুদ্ধ করিয়া তাঁহার মাতৃভূমি সুদনী Suddine শত্রুহস্ত হইতে মুক্ত করেন। যখন তিনি যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন, তখন তাঁহার কপট বন্ধু ফাইক্নিল্ড (Fykenild) সুযোগ পাইয়া রিমেন্হিল্ডকে বলপূর্বক বিবাহ করিতে চেষ্টা করিতেছিল। যুদ্ধাবসানে হর্ন ফাইক্নিল্ডের দুর্গে বীণাবাদকের বেশে প্রবেশ করিয়া তাহাকে নিহত করিলেন ও তাঁহার প্রণয়িনীর সহিত মিলিত হইলেন। গল্প কিছু মন্দ নহে কিন্তু লেখক এমন খুঁটিনাটি লইয়া নাড়াচাড়া করিয়াছেন ও এমন সাদাসিধাভাবে লিখিয়া গিয়াছেন যে, ইহাকে কবিতা বলিতে পারি না।
সেমি-স্যাক্সন ভাষায় অনেক প্রেমের কবিতা আছে, কিন্তু এমন ভাববিহীন অসার কবিতা অনুবাদ করিতে গেলে তাহার আর রসকষ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, এরূপ কবিতা অনুবাদ করিলে পাঠকদের কিছু লাভ নাই, কেবল অনুবাদকের যন্ত্রণাভোগ। একটি অনুবাদ উদ্ধৃত করিতেছি–
কথা মোর রাখো দেখি, একবার দেও সখি
প্রেমের আশ্বাস।
চাহি নাকো আর কারে, যতদিন এ সংসারে
করিতেছি বাস।
নিশ্চয় জানিয়ো প্রিয়ে, এখনি জুড়াবে হিয়ে
তুমি মোরে ভালো বাস’ যদি,
ওই অধরের শুধু– একটি চুম্বন মধু
হবে মোর দুখের ঔষধি।
দুই-একটা স্বভাব-বর্ণনা অনুবাদ-সমেত উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি–
Mury hit is in sonne risyng।
The rose Openith and unspring;
Weyes fairith, the clay’s clyng;
The maidenes flowrith, the foulis syng,
Damosele makith mournyng
When hire leof makith pertyng।
অনুবাদ
অতিশয় সুখকর সূর্য যবে ওঠে
গোলাপ ফুলের কুঁড়ি বাগানেতে ফোটে;
রাস্তা হয় পরিষ্কার কাদা যায় এঁটে;
পাখি গান গায়, ফুল ফোটে মাঠে মাঠে;
প্রণয়ীদিগের সাথে হইয়া বিচ্ছেদ
বিরহিণী রমণীরা করে কত খেদ।
আর-একটি–
Averil is meory, and lengith the day,
Ladies loven solas, and play;
Swaynes, justes; knyghtis, turnay;
Syngith the nyghtyngale, gredeth thes fay;
The hote sunne clyngeth the clay,
As ye will y-sun may।
অনুবাদ
এপ্রেল সুখের মাস, বেড়ে যায় বেলা;
মহিলারা ভালোবাসে আদর ও খেলা;
চাষারা খেলায় জুস্ট্, টূর্নি নাইটেরা;
বুল্বুল্ গান করে, চেঁচায় কাকেরা;
কাদা সব এঁটে যায় খর রৌদ্র বলে
দেখিতেই পাও তাহা, জান তো সকলে।
Chivalry-র সঙ্গে নর্ম্যানেরা রাজসভার আড়ম্বর ও চাকচিক্য, য়ুরোপ হইতে আনয়ন করিয়াছিল। কপট যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ, উৎসব আমোদ নর্ম্যান ব্যারনদিগের দুর্গে দুর্গে অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল। প্রথম এডোয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে স্কট্লন্ড-অধিপতি শত সংখ্যক অশ্বারোহী নাইট সঙ্গে করিয়া লন্ডনে আসিয়াছিলেন, তাহারা প্রত্যেকে অশ্ব হইতে নামিয়া বহুমূল্য আভরণ-সমেত অশ্বগুলি অর্থীদিগকে দান করিয়া গেল। আর্চ্বিশপ এ| বেকেট যখন ফ্রান্সে যান, তাঁহার সঙ্গে বিচিত্র বসন-ভূষিত এক দল ভৃত্য, দুইশত নাইট, বহু সংখ্যক ব্যারন ও আমীর-ওমরাও ছিল, আড়াইশত বালক তাঁহার সম্মুখে জাতীয় সংগীত গাহিতে গাহিতে চলিতেছিল, তদ্ভিন্ন গাড়ি ঘোড়া, প্রত্যেক ঘোড়ার পৃষ্ঠে এক-একটি বানর ও মানুষ, অনুচর, সহচর, পুরোহিত, বন্ধুবান্ধবের আর অন্ত নাই। এইরূপ সকল বিষয়েই ধুমধাম। হাঙ্গারির অধিপতি তাঁহার বিরহবিধুরা দুহিতাকে এইরূপে সান্ত্বনা করিতেছেন–
গাড়ি করে নিয়ে যাব শিকারে তোমায়,
সে গাড়িটি মুড়ে দেব লাল মকমলে;
পদ্ম আঁকা সাটিন ও জরির চাঁদোয়া
ঝলমল করিবেক মাথার উপরে;
পরিবি সোনার হার, সুনীল বসন;
সাথে সাথে যাবে তোর স্পেনের ঘোটক,
মকমল দিয়ে তার পিঠ দিব ঢেকে;
গান বাদ্য হবে কত বিবিধ আমোদ।
নানা মদ্য আনাইব নানা দেশ হতে।
পোড়া হরিণের মাস করিবি আহার,
যত ভালো মুর্গী পাই এনে দেব তোরে।
পাইবি কুকুর কত হরিণ হরিণী,
খেলা করিবি রে বাছা তাহাদের সাথে।
হরিণেরা এমনি মানিবে তোর পোষ,
ডাকিলেই আসিবেক মুঠির কাছেতে।
শিকারের শিঙ্গাধ্বনি করিলে শ্রবণ
মন হতে রোগ তোর যাবে দূর হয়ে।
অবশেষে বাড়ি ফিরে আসিবি যখন
নাচ গান কত হবে নাই তার ঠিক,
ছোট ছোট ছেলে মিলে কোকিলের স্বরে
গান শুনাইবে তোর সে বড়ো মধুর।
অবশেষে আসিবেক সন্ধ্যার ভোজন;
যাইবি হরিত কুঞ্জে তাঁবুটির নীচে,
চুনি হীরে কাজ করা বিচিত্র বসন,
মাটির উপরে পাতা, বসিবি সেথায়;
একশো নাইট মিলি বাজাবে বাজন।
সরোবরে দেখিবি মাছেরা খেলিতেছে,
মন তোর তুষ্ট হবে দেখিলে সে খেলা।
রয়েছে একটি সাঁকো সরসীর ‘পরে,
আধেক পাথর তার আধেক কাঠের।
নৌকা এক আসিবেক চব্বিশটি দাঁড়
বাজিবে বাজনা কত ভিতরে তাহার,
চড়ি সে নৌকার ‘পরে যাবি হেথা হোথা,
জ্বলিবে সাঁকোর ‘পরে চল্লিশটি বাতি,
গৃহে তোর ফিরে যাবি চড়ি সে নৌকায়।
বিছানাটি হবে তোর হীরা মণি গাঁথা,
সে কোমল বিছানায় শুইবি যখন
সোনার প্রদীপাধারে জ্বলিবেক আলো।
তবু যদি ঘুম তোর নাহি হয় বাছা
গায়কেরা গাবে গান সারারাত জেগে।
অসভ্য, মদ্যপানরত, কোলাহলপর, অপরিষ্কার, শিল্পজ্ঞানশূন্য স্যাক্সনদের সাহিত্যে এরূপ কবিতা নাই ও থাকিতে পারে না। স্যাক্সনদের আমোদের সহিত নর্ম্যানদের আমোদের অনেক প্রভেদ। নর্ম্যানদের আমোদের মধ্যে বিলাসের ভাব অধিকতর পরিস্ফুট। ব্রিটন-অধিপতি ভটিজরন যখন স্যাক্সন দলপতি হেঞ্জিস্টের শিবিরে নিমন্ত্রিত হইয়া হেঞ্জিস্টের পরম রূপবতী কন্যা রোয়ানকে দেখিলেন, একজন নর্ম্যান কবি তখনকার বর্ণনা করিতেছে–
হেঞ্জিস্ট করিল চেষ্টা প্রাণপণ করি
রাজা ও নাইটগণ সুখী হয় যাতে।
আমোদে উন্মত্ত হইল সকলে,
গৃহমধ্যে প্রবেশিলা রোয়েন সুন্দরী;
করে মদিরার পাত্র, সুচারুবসনা;
জানু পাতি বসিল সে রাজার সমুখে,
মদিরা করিল পান, চুম্বিলা রাজারে;
কেমন সুন্দর বপু, গৌর কান্তি তার,
কেমন সুন্দর ভূষা, নয়নরঞ্জন!
দেখিয়া উন্মত্ত হইল নৃপতির মন,
মদ্যপানে ভ্রংশ-বুদ্ধি, মাগিলা ভূপতি,
বিধর্মী সে রমণীরে বিবাহের তরে।
স্যাক্সনদের কঠোর লেখনী হইতে এরূপ মৃদু বিলাসময়ী কবিতা বাহির হইতে পারিত না।
কুমারী মেরীই মধ্যযুগের দেবতা ছিলেন। মহিলা-পূজার উৎকর্ষ তাঁহাতে গিয়াই পৌঁছিয়াছিল। প্রথমত তিনি খৃস্টের জননী ছিলেন, দ্বিতীয়ত সাধারণ মহিলাদের তিনিই পূর্ণ প্রতিমাস্বরূপ ছিলেন। তখনকার লোকের রমণী-ভক্তি হইতেই তাঁহার স্তব উত্থিত হইত। একটি মেরীর স্তব উদ্ধৃত করিতেছি–
দেবী, তব হোক জয়, স্বর্গীয় আনন্দময়,
স্বর্গের মধুর পুষ্ট তুমি!
মৃদুতার তুমি জন্ম-ভূমি!
দেবী, তব হোক জয়, উজ্জ্বল সৌন্দর্যময়!
সব মম আশা তোমা-‘পরি,
কিবা দিবা কিবা বিভাবরী!
নক্ষত্রের রানী তুমি উজ্জ্বল বরন,
দেখাও গো পথ মোরে দাও গো কিরণ,
দেবী, এই বসুন্ধরা মিথ্যা কপটতা ভরা
তুমিই আমারে হেথা করো গো চালন!
রমণী-ভক্তির চর্চা করিয়া করিয়া সে ভাব লোকের মনে সত্য সত্যই এমন বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, এরূপ স্তব হৃদয় হইতে না বাহির হইয়া থাকিতে পারে না।
সেমি-স্যাক্সন সাহিত্যের উপদেশ অংশ হইতে উদাহরণস্বরূপ দুই-একটা উদ্ধৃত করিতেছি। মৃতদেহের প্রতি দেহমুক্ত আত্মার উক্তি–
একদা শীতের রাত্রে আছিনু নিদ্রিত;
দেখিনু আশ্চর্য দৃশ্য; ভূমির উপরে
গর্বিত ধনীর এক দেহ আছে পড়ি।
দেহ ছাড়ি আত্মা তার আসিল বাহিরে
ফিরিয়া দেখিল চাহি মৃত দেহ পানে।
কহিল সে, “ধিক্ রক্ত মাংস কলুষিত!
হতভাগ্য দেহ, কেন এমন অসাড়,
আগে যে বড়োই ছিল উন্মত্ত, অধীর!
অশ্বে চড়ি হেথা হোথা বেড়াতিস ছুটি;
ছিলি সুগঠন, যশ ছিল দেশব্যাপী!
কোথা গেল গর্ব তোর স্বর্গভেদী স্বর?
কেন পড়ি ভূমিতলে, বস্ত্র আচ্ছাদিত?
কোথা তোর দুর্গ, তোর গৃহ সুসজ্জিত?’
ইত্যাদি–
ইত্যাদি– পুরানো কথা লইয়া অনেক বকাবকি করা হইয়াছে। আনক্রেন রিউল নামক গদ্যগ্রন্থ হইতে কতকটা উপদেশ-দায়ক বিভীষিকা অনুবাদ করিয়া দিতেছি। ইহাতে পাঠকেরা সেমি-স্যাক্সন গদ্য রচনা ও তখনকার লোকের অজ্ঞান কু-সংস্কারের ভাব কতকটা বুঝিতে পারিবেন–
অলস ব্যক্তিরা ডেভিলের (Devil) বুকে তাহার প্রিয় শিশুটির ন্যায় ঘুমাইতে থাকে এবং ডেভিল তাহার কানে মুখ দিয়া কথা কয় ও তাহার মনের বাসনা ব্যক্ত করে। যাহারা কোনো সৎকর্মে ব্যাপৃত না থাকে তাহাদের এইরূপ ঘটিয়া থাকে, ডেভিল ক্রমাগত কথা কহিতে থাকে, এবং অলস ব্যক্তি অতিশয় ভালোবাসার সহিত তাহার নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ করে। অলস ও নিশ্চিন্ত ব্যক্তিরা ডেভিলের বক্ষশায়ী bosom sleeper। ডুম্স্ডে দিবসে দেবদূতের ভেরীধ্বনিতে তাহারা সহসা চমকিত ও নরকের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিবে।
লোভী ব্যক্তি ডেভিলের ছাই-কুড়্নে Ash-gatherer। সে ছাইয়ের উপর ক্রমাগত শুইয়া থাকে, ছাই রাশীকৃত করিতে মহা ব্যস্ত থাকে, ছাই রাশ করিয়া তাহাতে ফুঁ দিতে থাকে ও ছাই উড়িয়া তাহাকে অন্ধ করিয়া তুলে, ছাইয়েতে খোঁচা মারে ও তাহার উপরে জমা-খরচের আঁক পাড়িতে থাকে। এই মূর্খের ইহাতেই আমোদ, ডেভিল তাহার এই-সমস্ত খেলা দেখিতে থাকে এবং হাসিতে হাসিতে তাহার পেট ফাটিয়া যায়। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সহজেই বুঝিতে পারেন যে, সোনা রূপা ও অন্যান্য পার্থিব ধনসম্পত্তি ছাই আর ধুলার রাশি মাত্র, যে ব্যক্তি তাহাতে ফুঁ দিতে যায় সেই অন্ধ হইয়া যায়, এই ছাইভস্মের জন্য তাহাদের মনে শান্তি থাকে না, ইহাদেরই জন্য তাহারা গর্বিত হইয়া পড়ে, যাহা-কিছু সে রাশীকৃত ও সংগ্রহ করিতে থাকে এবং প্রয়োজনাতীত যাহা-কিছু সঞ্চিত করিয়া রাখে তাহা ছাই ভিন্ন আর কিছুই নয়, নরকে গিয়া সে সমুদয় তাহার কাছে সাপ ও ব্যাঙ হইয়া দাঁড়ায়। ঈশায়া বলেন, যে ব্যক্তি প্রার্থীদিগকে খাদ্য বস্ত্র না দেয় তাহার কাপড়-চোপড় পোকার দ্বারা নির্মিত হইবে।
লোভী পেটুক ডেভিলের খাদ্য জোগাইয়া থাকে এইজন্য তিনি সর্বদাই রান্নাঘর ও ভাঁড়ার ঘরে ঘুর ঘুর করিয়া বেড়ান। তাঁহার মন খাবার থালায়, তাঁহার সমুদয় চিন্তা টেবিলের চাদরে, তাঁহার প্রাণ হাঁড়িতে, তাঁহার আত্মা ঘড়ায় পড়িয়া থাকে। এক হাতে থালা, এক হাতে বাটি লইয়া কাদা-মাখা কালি-মাখা অবস্থায় সে ঈশ্বরের নিকট উপস্থিত হয়। সে কত কী এলোমেলো বকিতে থাকে, মাতালের মতো টলমল করিতে থাকে, আপনার ভুঁড়ির দিকে চাহিয়া থাকে, ও এই-সকল দেখিয়া ডেভিলের এমন হাসি পায় যে তাহার পেট ফাটিয়া যায়। ঈশ্বর ঈশায়ার মুখ দিয়া এরূপ লোকদের এই বলিয়া ভয় দেখাইয়াছেন যে, “আমার ভৃত্যেরা আহার করিতে পাইবে, কিন্তু তোমাদের ক্ষুধা নিবৃত্তি হইবে না।’ তোমরা ডেভিলের খাদ্যস্বরূপ হইবে। “যে ব্যক্তি যত বিলাসে জীবন যাপন করিয়াছে তাহাকে তত যন্ত্রণা দেও।’ “গলানো তাঁবা তাহার গলায় ঢালিয়া দেও।’ ইত্যাদি।
নর্ম্যান ও স্যাক্সন জাতিদ্বয়ের ভাব ও অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখনকার সাহিত্য কেমন পরিবর্তন হইতেছিল। যখন নর্ম্যানগণ প্রথম ইংলন্ড অধিকার করিল, যখন স্যাক্সন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ অধঃকৃত হইল ও নবাগত বিজয়ীগণ তাহাদের ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করিল, যখন স্যাক্সন ধর্মাচার্যগণ ধর্ম-মন্দির হইতে বহিষ্কৃত হইল ও নর্ম্যান পুরোহিতগণ বেদী অধিকার করিল, তখন স্যাক্সন সাহিত্যও ম্রিয়মাণ হইয়া ক্রমশ বিনষ্ট হইয়া গেল ও ফরাসি সাহিত্য তাহার পদে প্রতিষ্ঠিত হইল। যে দুই-একজন লেখক প্রাচীন ভাষা পরিত্যাগ করিতে পারে নাই, নিম্নশ্রেণী লোকদের পাঠের নিমিত্ত কাব্য রচনা করিয়াই তাহাদের আশা তৃপ্ত থাকিত, তাহাদেরও আদর্শ ফরাসি; ফরাসি পুস্তক হইতে অনুবাদ করাই তাহাদের একমাত্র গতি। কবি লেয়ামন Layamonএকটি ল্যাটিন কাব্যের ফরাসি অনুবাদ হইতে এক কাব্য-সংকলন করিয়াছিলেন, তাহার ভাষা বিকৃত ও তাহার ছন্দ রচনায় কোথাও প্রাচীন প্রথানুযায়ী যমক-পদ্ধতি, কোথাও বা ফরাসি-আদর্শ-অনুযায়ী মিলের নিয়ম। লেয়ামনের ভাষা বিকৃত স্যাক্সন বটে কিন্তু তাহাতে ফরাসি প্রবেশ করে নাই, অনভ্যাস ও অপ্রচলিত থাকা প্রযুক্ত তখন স্যাক্সন অনেক পরিমাণে বিকৃত হইয়াছিল কিন্তু তখনো ফরাসি এমন চলিত হইয়া যায় নাই যে, স্যাক্সনের মধ্যে স্থান পাইতে পারে। নর্ম্যানদের যখন নূতন প্রভুত্ব, তখন স্যাক্সন সাহিত্যের এই দশা। যখন নর্ম্যানেরা ইংলন্ডে কিছুদিন বাস করিল, যখন নর্ম্যান ও স্যাক্সনদের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত হইল, যখন স্যাক্সন ভাষার সংস্পর্শে নর্ম্যান ফরাসি বিকৃত হইয়া গেল ও সাধারণ অনক্ষর নর্ম্যানগণ বিশুদ্ধ ফরাসি অনেক পরিমাণে ভূলিয়া গেল, শুদ্ধ তাহাই নহে, হয়তো স্যাক্সনদের সহবাসে স্যাক্সনই তাহাদের ভাষা হইল, তখন স্যাক্সন ও ফরাসি মিশিয়া একটা ভাষা জন্মিতে লাগিল, কিন্তু সেই ভাষায় যে কিছু পুস্তক রচিত হইত, তাহার ভাব ফরাসি, তাহার রচনা-প্রণালী ফরাসি, শুদ্ধ তাহাই নহে, তাহা ফরাসি পুস্তকের অনুবাদ ও অনুকরণ! অবশেষে যখন স্যাক্সন ও নর্ম্যান জাতিদ্বয় সম্পূর্ণরূপে বা অনেক পরিমাণে মিশিয়া গেল, যখন জেতা ও জিত জাতির মধ্যে বিভিন্নতা রহিল না, তখন দেশে নূতন জাতীয় ভাবের সঞ্চার হইল। তখন সকলের ভাষাই অনেক পরিমাণে সমান হইল, তখনকার সাহিত্য সাধারণের সম্পত্তি হইল; তখন শ্রেণীবিশেষের জন্যই গ্রন্থ রচিত হইত না। তখন জাতির চক্ষুর সম্মুখ হইতে ফরাসি আদর্শ অনেক পরিমাণে দূরীভূত হইল, লেখকেরা নিজের বুদ্ধি হইতে ও নিজের হৃদয় হইতে অনেক পরিমাণে লিখিতে লাগিল। এমন-কি, একদল লেখক প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সন আদর্শে লিখিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কবি ল্যাংল্যান্ড (Langland) “পিয়ার্স প্লৌম্যান’ (Piers Ploughman) নামে এক কাব্য লিখিলেন, তাহাতে ছন্দ নাই, মিল নাই, কবি প্রাচীন স্যাক্সন-প্রণালী অনুযায়ী যমক-পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াছেন। নূতন জাতীয় ভাবের সঞ্চার হইলে লোকের পুরাতন সাহিত্যের প্রতি টান পড়ে। “পিয়ার্স প্লৌম্যান’-লেখক প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সন রচনা-প্রণালীর অনুকরণ করিতে লাগিলেন ও একদল লেখক উত্থিত হইল, তাহারা “পিয়ার্স প্লৌম্যান’- লেখকের অনুকরণ করিতে লাগিল। কিন্তু ফরাসি অনুকরণে কাব্যরচনার মিল ও ছন্দের নিয়ম তখনকার সাহিত্যে এমন বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, তাহার মধ্য হইতে বিজাতীয়ত্ব দূর হইয়া গিয়া তাহাই স্বাভাবিক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, এমন অবস্থায় পিছু হঠিয়া অসভ্য অ্যাংলো-স্যাক্সন রীতির অনুসরণ করিতে যাওয়া অনর্থক। ল্যাংল্যান্ডের অনুবর্তী একদল উত্থিত হইল, কিন্তু তাহাদের চেষ্টা সফল হইল না, প্রচলিত রীতি যদিও বিদেশীয় আদর্শ হইতে গৃহীত হইয়াছিল তথাপি তাহারই জয় হইল। ল্যাংল্যান্ডের কাব্য হইতে উদাহরণস্বরূপ দুই-এক শ্লোক উদ্ধৃত করিতেছি–
Hire robe was ful riche,
Of rud searlit engrenyned,
With ribanes of rud gold
And of riche stones
ইহাতে ছন্দ নাই, মিল নাই, কেবল robe, riche, rud, ribanes প্রভৃতি কথায় ছঅক্ষরের যমক আছে মাত্র।
য়ুরোপ হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়াতে ইংলন্ড দ্বীপের একটা বিশেষ উপকার হইয়াছিল। যখন রোমে পোপের আসন অধিকারের জন্য বিবাদ বিদ্বেষ চলিতেছিল, যখন পোপেরা অধর্মাচরণে রত ছিল, তখন ইংলন্ড অমিশ্রভাবে থাকিয়া দূর হইতে অপক্ষপাতের সহিত বিচার করিতে পারিত, পোপের নব-দেবত্ব ভাব তাহাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া যায় নাই। রোমীয় চর্চের চরণে তাহাদের রাশি রাশি মুদ্রা ঢালিতে হইত, তাহাতে তাহারা মনে মনে অসন্তুষ্ট ছিল। ধর্মাচার্যগণের অনেক পরিমাণে স্বাধীনতা থাকায় তাহারা অধর্মাচরণে দারুণ রত ছিল, এই-সকল কারণে তখনকার চর্চের প্রতি ইংরাজদের অভক্তি জন্মিয়াছিল এবং সাধারণ লোকের মুখপাত্র হইয়া ল্যাংল্যান্ড তাঁহার “পিয়ার্স প্লৌম্যান’ কাব্যে তখনকার চর্চ, ধর্মাচার্য ও তখনকার নানা প্রকার কুনীতির প্রতি বিদ্রূপ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাত্মা উইক্লিক্ ইহার পরে যে ধর্ম-সংস্কার করেন, রোমীয় চর্চের শৃঙ্খল হইতে ইংলন্ডকে মুক্ত করেন, এইপ্রকার কবিতা তাহার পথ পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিল। এইপ্রকার কবিতা যখন লিখিত হইয়াছিল তখন স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, তখনকার লোকের মনের ভাব এইরূপ ছিল, ল্যাংল্যান্ড তাহাই কেবল লিখিয়া প্রকাশ করিয়াছেন মাত্র। এই কারণেই এই কাব্য তখন এমন সমাদৃত হইয়াছিল।
“পিয়ার্স প্লৌম্যান’ কাব্যই সেমি-স্যাক্সন সাহিত্যের শেষ সীমাচিহ্নস্বরূপ করা গেল। তাহার পরেই গাউয়ার (Gower) ও চসারের (Chaucer) কাল। তখন হইতে প্রকৃতপক্ষে ইংরাজি সাহিত্য আরম্ভ হইল। এতকাল ইংরাজি ভাষা নির্মিত হইতেছিল, এতক্ষণে তাহা একপ্রকার সমাপ্ত হইল।
সাহিত্যপ্রিয় ব্যক্তিরা সেমি-স্যাক্সন সাহিত্য চর্চা করিয়া বড়ো আমোদ পাইবেন না। অনুবাদ অনুকরণ ভাবহীন কথার স্রোতেই এই সাহিত্যক্ষেত্র পূর্ণ। তবে ভাষা-তত্ত্ব-প্রিয় ব্যক্তি ইহা চর্চা করিলে তাঁহাদের পরিশ্রমের অনেক পুরস্কার পাইবেন। সেমি-স্যাক্সন সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে একটা বিশেষ সাহিত্য নহে, তাহা ইংরাজি সাহিত্যের সূত্রপাত মাত্র। তখন ব্যাকরণ বানান ও ভাষার কিছুই স্থিরতা ছিল না, একটি পুস্তকেই এক কথার নানা প্রকার বানান আছে, তাহাতে বুঝিবার বড়ো গোল পড়ে। একটা স্থির আদর্শ না থাকাতে সকলেই নিজের ব্যাকরণে, নিজের বানানে নিজের ভাষায় পুস্তক লিখিত। নর্ম্যান ও স্যাক্সন জাতিদ্বয়ের অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখনকার ভাষা ও সাহিত্য কেমন পরিবর্তিত হইতে লাগিল। অবশেষে কত প্রকার ঘাত-সংঘাতে ইংরাজি সাহিত্য ও ভাষা নির্মিত হইল। ১০৬৬ খৃষ্টাব্দে নর্ম্যানেরা ইংলন্ডে প্রবেশ করে, তখন হইতে যদি ইংরাজি সাহিত্যের নির্মাণ-কালের আরম্ভ ধরা যায় ও ১৩৪৫ খৃস্টাব্দে চসার জন্মগ্রহণ করেন, তখন যদি তাহার শেষ ধরা যায় তবে ইংরাজি সাহিত্য ও ভাষা নির্মিত হইতে প্রায় তিন শত বৎসর লাগিয়াছে বলিতে হইবে।
ভারতী, জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৬