৯
মার্চ ১৯৩৩
এই সময়ে জার্মানির সবচেয়ে বেশি আলোচিত খবরের কাগজগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘স্ট্রেট পাথ’। আগে এই কাগজের অফিস থেকে ‘সানডে ইলাস্ট্রেটেড’ নামে একটা কাগজ বেরোত, ফ্রিৎজ গার্লিকের মতো পো—খাওয়া সাংবাদিক সেই অফিসটাকে কিনে সেখানেই তাঁর এই নতুন সাপ্তাহিক কাগজের পত্তন করেছেন। আর মাত্র সাড়ে দিন বছরেই এর সার্কুলেশন অন্যান্য কাগজকে টেক্কা দিতে শুরু করেছে।
ইতিহাস নিয়ে ডক্টরেট করলে কী হবে, জার্নালিস্ট হিসেবে ফ্রিৎজ গার্লিকের উত্থান প্রায় উল্কার গতিতে বলা চলে। অবশ্য প্রথম জীবনে অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন তিনি লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন একসময়, তারপর এম এন এন কাগজের চিফ এডিটর থাকার সময় কলমের তুখোড় ধারের জন্য তাঁর নাম সারা জার্মানিতে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এই মুহূর্তে ফ্রিৎজ গার্লিকের বড়ো রাস্তার ওপরের একটা বহু পুরোনো বাড়ির দুটো তলা নিয়ে তৈরি খবরের কাগজের ছোট্ট অফিসটার উপর যেন সারা বার্লিন শহরের মানুষজনের ক্ষোভ এসে জমা হয়েছে। এরকম কিছু হতে পারে ফ্রিৎজ যে একেবারেই আন্দাজ করেননি তা নয়, তাই আগেভাগেই দুটো নতুন সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন করেছিলেন নীচে।
কিন্তু এতটা জনরোষ তিনি নিজেই কল্পনা করতে পারেননি।
যাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিখে চলেছেন, তুলে ধরতে চাইছেন অদূর ভবিষ্যতের সাংঘাতিক খারাপ কিছু ঘটার পূর্বাভাস, সেই সাধারণ মানুষই তাঁর বিপক্ষে?
নাকি এরা সবাই পার্টির ওয়ার্কার!
একতলার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে যে দরজাটা, সেটাকে শক্ত করে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, গার্ড দুটো ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের হাতে বন্দুক থাকায় কেউ জোর করার সাহস না পেলেও রাস্তা থেকে দোতলার জানলা লক্ষ করে তারা পাথরের টুকরো, পচা ডিম ছুড়ে চলেছে ক্রমাগত।
‘লোকজন কি সব পাগল হয়ে গেল নাকি?’ জানলার কাচ দিয়ে একঝলক মুখ বাড়িয়ে দেখতে গিয়ে কোনোরকমে একটা বড়ো পাথরের টুকরোর থেকে মাথাটা বাঁচালেন ফ্রিৎজ, ‘এইরকম করছে কেন?’
সাব—এডিটর কার্ল পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিল, আশপাশে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীরাও চলে এসেছে। একতলায় এই কাগজের ছাপাখানা, সেখানকার শ্রমিকদেরও এখন এই ঘরেই নিয়ে আসা হয়েছে। মেশিন সব বন্ধ করে দেওয়া—হয়েছে আপাতত। কার্ল বলল, ‘তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম ফ্রিৎজ, এখন নয়, বছর তিনেক আগে থেকেই। শোনোনি কিছুতেই। এখন কি ভাবছ যার বিরুদ্ধে এতদিন আজেবাজে লিখলে, এখন সে চ্যান্সেলর হওয়ার পর তোমায় ছেড়ে দেবে? এখন তো শুধু ওর পার্টির ওয়ার্কাররা এরকম হুজ্জুতি করছে, যে কোনোদিন সে পুলিশ পাঠাল বলে!’
ফ্রিৎজ আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না রাগে, ‘আজেবাজে লিখে চলেছি? তুমি এই কথা বলছ কার্ল?’
কার্ল বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে বাবা, আমি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি ফ্রিৎজ! এটা তো স্বীকার করবে যে, আমাদের কাগজের সেল হোক আর লোকে যতই কিনুক, ওকে জার্মানির মানুষজন চায়। না হলে অ্যাডলফ এত বিপুল ভোটে জিতল কী করে!’
ফ্রিৎজ টেবিলের উপর আক্রোশে একটা ঘুসি মারলেন, ‘মানুষ যদি চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যায় আর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কাউকে ভোট দেয়, সেটাকে কি জনসমর্থন বলে? অ্যাডলফ একটা মনস্টার, যে মানুষের মধ্যে শুধু সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তৈরি করছে তাই নয়, ও জার্মান ছাড়া অন্য প্রতিটা জাতিকে কার্যত লুপ্ত করে দিতে চায়, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, লুপ্ত করে দিতে চায়! ও একটা সাইকোপ্যাথ! ওর নিজের দিদির মেয়েকে নিজের বিকৃতির জন্য সুইসাইড করতে বাধ্য করেছে। ওর দিদি ভিয়েনায় ইহুদি বাচ্চাদের নিয়ে একটা একটা অনাথ—আশ্রম চালাত, সেটা পর্যন্ত ধ্বংস করেছে। কেন, ইহুদিরা মানুষ নয়? জার্মানিকে তারা নিজের দেশ মনে করে না? সমস্ত ইহুদিদের শেষ করতে চায় ও।’
কার্ল মাথা নাড়ল, ‘না, সেসব তো অনেক আগে বলত। জেল থেকে ফিরে এসে নতুনভাবে দলের দায়িত্ব নেওয়া থেকে, ইলেকশনের সময় অবধি কিন্তু আর এরকম কিছু বলেনি অ্যাডলফ, এটা লক্ষ করেছ কি? হয়তো বুঝতে পেরেছে নিজের ভুল।’
ফ্রিৎজের মুখ থেকে শ্লেষ ঝরে পড়ল, ‘ভুল বুঝতে পেরেছে? তাও আবার অ্যাডলফ? তোমরা সত্যিই সব দিবাস্বপ্ন দেখছ কার্ল! এটা ওর চাল, ও এটা বুঝতে পেরেছিল যে ওইসব বললে ও জিততে পারবে না, তাই ক—দিন চুপ ছিল। ক্ষমতায় এসেছে, এইবার ওর স্বরূপটা দেখতে থাকো তোমরা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এইরকম একটা অসুস্থ বিকৃত লোক কিনা জার্মানির চ্যান্সেলর হল আজ থেকে?’ চিৎকার করে কথাগুলো বলে এই সপ্তাহের ‘স্ট্রেট পাথ’—এ ওঁর নিজের লেখা এডিটোরিয়ালের পেজটা তুলে নিলেন ফ্রিৎজ, ‘আর কী করে জিতল তার ব্যাখ্যা তো আমি বিস্তারিত করেছি এই উইকেই! তুমি কি আজকাল নিজেদের কাগজটুকুও ভালো করে পড় না কার্ল?’
নীচের ছাপাখানার শ্রমিকরা অবাক চোখে দেখছিল। প্রত্যেকের গায়ে পুরোনো একটা করে ছেঁড়াখোঁড়া কোট, অপুষ্টিতে আর অনিশ্চয়তায় শীর্ণ চিন্তিত মুখ। যুগে যুগে যা হয়ে এসেছে, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ নেই, এটাই মনে করে এরা। এদের মনে এখন শুধু একটাই ভয়, নতুন গভর্নমেন্ট যদি এই কাগজটাকেই বন্ধ করে দেয়, পেট চলবে কীভাবে! একেই তো এই ভয়ানক মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম এতটাই বেড়ে গেছে, যে সেই টাকার আর কোনো দামই নেই।
তবু কিছু কিছু ব্যতিক্রমী লোক তো সব জায়গাতেই থাকে যারা একটু অন্যভাবে ভাবতে চেষ্টা করে, তেমনই একজন ফ্রেডরিক। সে অবশ্য মামুলি শ্রমিক নয়, ছাপার ব্লকগুলো রিপেয়ার আর মেইনটেইন করা ওর কাজ, তার সঙ্গে টাইপিংটাও মোটামুটি পারে। বছরখানেক হল এই কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্রিৎজ স্যারের সঙ্গে ওর সরাসরি তেমন কোনো কথাই হয় না, তবু সে দূর থেকে এই অগাধ পাণ্ডিত্যের মানুষটাকে খুব শ্রদ্ধা করে।
ফ্রেডরিক বলল, ‘স—স্যার! আজকের কাগজে একটা বিজ্ঞপ্তি দেখেছেন?’
ফ্রিৎজ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, ‘কীসের বিজ্ঞপ্তি?’
ফ্রেডরিক বলল, ‘যারা জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ, বা মানসিক প্রতিবন্ধী, কিংবা যারা এমন রোগে আক্রান্ত যে কোনোদিনই সুস্থ হতে পারবে না, তাদের পেছনে সরকারের প্রচুর টাকা খরচা হচ্ছে। তাই ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে যে সরকারি উদ্যোগেই এদের মেরে ফেলা হবে। খুব শিগগিরই নাকি বিলও আনবে নতুন সরকার। মানে,’ ফ্রেডরিককে উত্তেজিত দ্যাখাল, ‘আমাদের বাবা মায়েরা যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন, তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার স্বাধীনতাটুকু আমাদের থাকবে না? কিংবা আমাদের সন্তান যদি অসুস্থ হয়? এ কীরকম নিয়ম স্যার?’
বাইরে তখন মানুষের উল্লাসে কান পাতা দায়। অনেকক্ষণ ধরে এই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজের অফিসে ভাঙচুর করে তারা এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, দুর্বলকে বেশিক্ষণ প্রত্যাঘাতবিহীন নিপীড়নেও সুখ নেই।
এবার তারা হইচই করতে করতে চলেছে বার্লিনের অন্য প্রান্তে। সারা জার্মানি যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে, ঘরে বসে নেই কেউ। নাতসি পার্টির লাল কালো স্বস্তিকা চিহ্নের ফ্ল্যাগে, ফেস্টুনে পোস্টারে সারা রাস্তাটা যেন ঢেকে গেছে। ছোটো চৌকো কালো গোঁফের ওই লোকটার বিশাল বিশাল কাট আউট বয়ে নিয়ে চলেছে মানুষ। হাজার হাজার মানুষ তাদের ডান হাত উপরে মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে ধরে সোল্লাসে জয়ধ্বনি করছে, ‘হেইল হিটলার! হেইল হিটলার!’ অর্থাৎ ‘হিটলারের জয়!’
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এইরকম ঘটনাবহুল বছর জার্মানিতে খুব কম এসেছে। এই বছরের একদম গোড়ায় জানুয়ারি মাসে যুক্তফ্রন্টের প্রধান হিসেবে অ্যাডলফ দেশের চ্যান্সেলর অর্থাৎ দেশপ্রধান হয়েছিল। সেই ফ্রন্টে নাতসিরা ছিল তিন নম্বর দল। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই জার্মান মন্ত্রীসভা রেইচস্ট্যাগে হঠাৎ আগুন লাগল। ফ্রিৎজ বা অন্য যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সেসময় বুঝেছিলেন যে এটা নাতসি পার্টিরই কাজ। ওরা তিন নম্বর দল হয়ে থাকলে হিটলার চ্যান্সেলর হলেও তাকে বাকি দুটো বড়ো দলের কথামতোই চলতে হত। তাই আগুন লাগানোটা তাদের পরিকল্পিত।
কিন্তু নাতসিরা রেইচস্ট্যাগের সেই আগুনের জন্য কম্যুনিস্টদের অভিযুক্ত করল এবং আবার জেনারেল ইলেকশনের দাবি তুলল। আর তার পরেই এই ইলেকশন। এতে নাতসি পার্টির বিপুল সাফল্যে হিটলার এখন বলতে গেলে দেশের একনায়ক হয়ে গেল, দ্বিতীয় বলার মতো কোনো বিরোধী দলই রইল না রেইচস্ট্যাগে।
কী ভবিষ্যৎ এই দেশের ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তাঁর।
ফ্রিৎজ ফ্রেডরিকের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালেন। উত্তেজনায় রাগে দুঃখে তাঁর মুখ ঘামে ভিজে উঠেছে, তবু তাঁর ভালো লাগল। একজন অন্তত হিটলারের কার্যকলাপকে সন্দেহ করছে। বাকিরা তো স্রোতে তাল মিলিয়ে পুরো সম্মোহিত হয়ে গেছে হিটলারের জাদুতে।
কার্ল ফ্রেডরিকের কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে দাঁড়াও। বিল আনলেই তো আর সেটা পাশ হয়ে যাবে না রেইচস্ট্যাগে। সব পার্টি রাজি হলেই না সেটা আইন হবে। এখন থেকে এত চাপ নিচ্ছ কেন তোমরা?’
ফ্রিৎজ তেতোমুখে হাসলেন। নাতসি পার্টি যেরকম গরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে, তাতে অন্য পার্টিগুলোকে রেইচস্ট্যাগে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, আর তারা নাকি ভোট দেবে। ওদের ভোটের দামই তো নেই কোনো।
অ্যাডলফ কি হিপনোটাইজ করেছে কার্লের মতো শিক্ষিত লোকগুলোকে যে এরা নিজেদের সাধারণ বোধবুদ্ধিগুলোও হারিয়ে ফেলছে?
ফ্রিৎজ ভালো করে ঘরে উপস্থিত শ্রমিকদের দিকে তাকালেন, বেশিরভাগকেই তিনি চেনেন না, নীচে কাজ করে এরা।
এরাই তো আমজনতা! এরাই আসল জার্মানির মুখ, খেটে খাওয়া সমাজের প্রতিভূ। এরা তাঁর কাগজ পড়ে না ঠিকই, কিন্তু এরা দেশকে ভালোবাসে।
অন্তত যাঁদের জন্য তিনি কলমে তুফান তুলছেন সেই নির্বিকার হয়ে থাকা তথাকথিত জার্মানির উচ্চবিত্তদের থেকে বেশি দেশের ভালো চায় এরা।
আর এদের চাওয়ার মধ্যে কোনো স্বার্থ নেই।
ফ্রিৎজ আধভাঙা স্বরে ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আজ থেকে জার্মানিতে শয়তানের রাজত্ব শুরু হল। তোমরা প্রস্তুত থেকো।’