নরক সংকেত – ৮

লন্ডনের আকাশ ভারি খামখেয়ালি।

এই রোদ ঝলমলে আকাশ: পরক্ষণেই ইলশেগুঁড়ির মতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু। সবচেয়ে আশ্চর্যের এই রাত আটটাতেও সূর্যের ক্ষীণ আলো। মাদাম তুসোর উলটোদিকের সেই কফিশপ থেকে বেরোনোর সময়েও দিব্যি ঝকঝকে ছিল আকাশ, আর এখন বেশ ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

তবে এখানকার লোকজন মনে হয় এই অদ্ভুতুড়ে আবহাওয়ায় বেশ অভ্যস্ত, পথ চলতে চলতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হতেই একটুও চলার গতি না কমিয়ে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে ফেলছে তারা, এই এগারো তলা থেকেও মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাইরেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল রুদ্র।

প্রিয়ম রান্নাঘরে খাবার গরম করছিল। এমনিতে একা থাকলে রাতে ও পাঁউরুটি, নুডলস বা বার্গার খেয়ে নেয় প্রায়ই। কোনো কোনোদিন রুটিও বানিয়ে নেয়।

কিন্তু, এখন কয়েকদিন একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া হবে। বেশ জুত করে ধনেপাতা দিয়ে চিকেনের একটা প্রিপারেশন বানিয়েছে আজ, শেষ মুহূর্তের টেস্ট করে দেখা পর্ব চলছে এখন। মাঝে মাঝেই নিজের শখের কোনো একটা রান্না করা ওর প্যাশন, বেশ স্ট্রেসবাস্টার হিসেবেও কাজ করে সেটা।

প্রিয়ম একটু জোরে হাঁক পাড়ল, ‘একটু শুনে যাও রুদ্র, প্লেটগুলো ধুয়ে একটু টেবিলে রাখবে?’

বার দুয়েক ডেকেও যখন কোনো সাড়া পেল না, প্রিয়ম বুঝল, প্রায় এক বছর একা থেকেও রুদ্রর বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি, দিব্যি একরকম আছে।

আসলে করতেই হবে বলে সত্যিই বোধহয় কিছু হয় না। যে মনে করে যে আমি ঘরের কোনো কাজ করব না, সে বিন্দাস কিছু না করে হেলেদুলে কাটিয়ে দিতে পারে সারাটা জীবন, না হলে কাল থেকে এসে সেই যে লাগেজগুলো রুদ্র লবিতে রেখেছে, সেগুলো গুছিয়ে আনপ্যাক করার কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছে না প্রিয়ম। শুধু জামা পরার সময় কোনোমতে চেনটা খুলে পরে নিচ্ছে, তারপর ঘুরে এসেই দলা পাকিয়ে ফেলে রাখছে কাবার্ডের মাথায়।

প্রিয়ম আসার সময় পইপই করে বলে দিয়েছিল ওর ঘরে পরার জন্য কয়েকটা টিশার্ট নিয়ে আসতে, এখানে বড্ড দাম। সেগুলো ব্যাগ থেকে খুলে যে প্রিয়মকে দেওয়া, ওসবের বালাই নেই।

বেমালুম বসে আছে।

আরে এখানে তো আর ইন্ডিয়ার মতো কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই, সব তো প্রিয়মকেই করতে হয়, সেটা আর কে বোঝাবে!

আর কিছু না বলে প্লেট আর ডিশগুলো নিয়ে বাইরে আসতেই প্রিয়ম দেখল বাইরের বারান্দায় যাওয়ার দরজার ওপরের কাচটা খোলা, তা দিয়ে হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট, দুটোই ঢুকছে হু হু করে, আর জানলায় একটা হাত আলতো রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র, সামনে ফোনের স্ক্রিন খোলা। বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগছে ফোনে, ওর গালে, গলা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে জল, ওর কোনো হুঁশ নেই।

পাশেই উঁচু তাকটার উপরে রাখা আজকের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ কাগজটাও ভিজছে বৃষ্টির জলে। ঘুরেটুরে এসে প্রিয়ম কিছুক্ষণ পড়েছিল কাগজটা, তারপর বোধ হয় রুদ্র নিয়েছিল, নিয়ে ওইখানে রেখে দিয়েছে।

কোনো একটা জিনিস যদি কখনো জায়গায় রাখে!

প্রিয়ম টেবিলে প্লেটগুলো রেখে কাগজটা নিয়ে জানলার দিকে এল, কিন্তু রুদ্র এমন নিষ্পাপ ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, যে ও আর রাগ করতে পারল না। বললো, ‘শোনো, কাল তুমি যদি বেরোও, একটু চোখ কান খোলা রেখে রাস্তাঘাটে চলাফেরা কোরো। আজকের কাগজেও সেই মার্ডার দুটোর তদন্তের কোনো প্রোগ্রেস নেই। পুলিশ কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছে না।’

রুদ্র বলল, ‘কোন মার্ডার?’

প্রিয়ম কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আগের মাসে ইসলিংটনের একটা কমপ্লেক্সে একটা ছোটো ব্লাস্ট হয়েছিল, তাতে পাঁচজন রিফিউজি মারা গেছিল। আবার কয়েকদিন আগে কিংস্টনে দু—জন। তাদেরকে তো একদম ডাইরেক্ট গুলি করেছিল। কাউকে ধরতেই পারছে না। কী যে কি হচ্ছে কে জানে! এখানকার পুলিশও দেখছি দিন দিন আমাদের ওখানকার মতো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, আসল কালপ্রিটদের ধরতে পারছে না, এদিকে আমাদের মতো বাইরের লোকদের কিছু হলেই ”পাসপোর্ট পাসপোর্ট” করে পাগল করে মারে।’

রুদ্র বলল, ‘রিফিউজি মানে? কোথাকার রিফিউজি?’

প্রিয়ম বলল, ‘আরে মিডল ইস্টের অনেকগুলো দেশের। ওদিককার সব যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের ইউরোপের অনেক দেশের সরকারই তো আশ্রয় দিয়েছে, তারাই সব রিফিউজি আর কি! ওই ড শ্যুমাখার বলছিলেন না?’

রুদ্র বলল, ‘হুঁ। কিংস্টনেও রিফিউজিই খুন হয়েছিল?’

প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ। বাচ্চা দুটো ছেলে। ইসলিংটন, কিংস্টন, বারনেট এরকম ক—টা শহরতলিতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, আর সেইসব জায়গাগুলোকেই দেখছি টার্গেট করা হচ্ছে। ওদেরই কোনো সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দলের কাজ মনে হয়।’

রুদ্র কোনো উত্তর দিল না, চুপচাপ কী যেন ভাবছিল বাইরে তাকিয়ে।

কোনো জবাব না পেয়ে প্রিয়ম পেছন থেকে আলতো জড়িয়ে ধরল বউকে, ‘এভাবে ভিজছ, ঠান্ডা লেগে যাবে তো? হাওয়াটাও তো খুব ঠান্ডা।’

রুদ্র যেন চমকে উঠল, ‘উঁ?’

প্রিয়ম পাশে সরে এল, ‘কী ভাবছ বলো তো?’

রুদ্র ওর হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে খবরটা পড়তে পড়তে বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টটায় কি শুধু তোমাদের অফিসের লোকরাই থাকে?’

প্রিয়ম একটু অবাক হল, ‘হঠাৎ এরকম প্রশ্ন? আমাদের কোম্পানি আর আরেকটা কোম্পনির জয়েন্ট অ্যাকোমোডেশন এটা। অর্ধেক ফ্লোরে ওরা থাকে, অর্ধেকে আমরা। কেন বলো তো?’

রুদ্র বলল, ‘সেই কোম্পানিটা কি চাইনিজ বা জাপানিজ বা ওই দিকের কোনো দেশের?’

প্রিয়ম বলল, ‘না তো! ইন্ডিয়ারই কোম্পানি, ব্যাঙ্গালোর বেসড।’

রুদ্র চুপ করে গিয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিল, পড়তে পড়তে কিছুক্ষণ বাদে বলল, ‘ওহ। যাই হোক, ভাবছি ড শ্যুমাখারের দাদুর দাবি অনুযায়ী সত্যিই যদি ওরকম কোনো কেমিক্যাল এলিমেন্ট তৈরি করা যায়, আর সেটা যদি হিউম্যান বডিতে অ্যাপ্লাই করে জিন মডিফাইও করা সম্ভব হয়, কিন্তু জিন তো যতদূর জানি একটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ইউনিট যেটা দিয়ে ডি এন এ তৈরি হয়, সেটাকে কীভাবে অ্যাফেক্ট করবে?’

প্রিয়ম বলল, ‘দ্যাখো, আমরা তো আর ওই লাইনের লোক নই, তাই কোনো আইডিয়া নেই আমার। তবে জিন থেরাপি বলে তো একধরনের ট্রিটমেন্ট হয় আজকাল, সেটাও তো বোধ হয় এইরকমই।’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘সেটাই আমি এতক্ষণ পড়ছিলাম ইন্টারনেট থেকে। জেনেটিক ডিসঅর্ডার ঠিক করার জন্য খারাপ বা ড্যামেজড জিনগুলোর জায়গায় কোষে নতুন ভালো জিন ঢোকানোই হল জিন থেরাপির মেইন ফান্ডা। ওই যে শ্যুমাখার বললেন না, বিশেষ একধরনের কোশে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করলে সেটা নেক্সট জেনারেশন ইনহেরিট করে; সেটাই দেখলাম। দ্যাখো আমাদের শরীরে দু—ধরনের কোষ হয়, সোমাটিক আর জার্মলাইন। সোমাটিক কোশে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা হলে সেটা শুধু ওই পেশেন্টের ক্ষেত্রেûই প্রয়োজ্য হয়, মানে ধরো যে রোগটা হয়েছিল সেটা সেরে গেল, কিন্তু তার পরের জেনারেশনে কারুর যে রোগটা আর হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কিন্তু জার্মলাইন কোশগুলোতে যদি জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা যায়, তবে সেটা পুরো পার্মানেন্ট এফেক্ট হয়, আর পরবর্তী জেনারেশনেও এটা ইনহেরিটেড হয়ে যায়। মানে একটা কোনো রোগ সারানোর জন্য কোনো পেশেন্টের শরীরের জার্মলাইন কোষে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করা হলে তার তো রোগটা সারবেই, তার পরবর্তী সব প্রজন্ম থেকেই রোগটা ভ্যানিশ হয়ে যাবে।’

প্রিয়ম শুনছিল, এবার বলে উঠল, ‘তার মানে তো বোঝাই যাচ্ছে, ড শ্যুমাখারের দাদু ওই জার্মলাইন কোশেই যাতে নাইট্রোজেনের সঙ্গে রিয়্যাকশনের মাধ্যমে জিনের রদবদল ঘটানো যায় এমন কোনো কেমিক্যাল এলিমেন্ট আবিস্কার করেছিলেন যার কোনো অস্তিত্ব এখনও অবধি আমাদের পিরিয়ডিক টেবিলে নেই। মার্ভেলাস ইনভেনশন কিন্তু, যাই বল তুমি।’

রুদ্র অন্যমনস্কভাবে খেতে বসল, ‘হুঁ। কিন্তু যতটুকু পড়লাম, পিরিয়ডিক টেবিলে নতুন এলিমেন্ট এখন যেগুলো অ্যাড হচ্ছে, সেগুলো কোনোটাই….’ তারপরেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘এমা, ধনেপাতা দিয়ে মাংস রান্না করলে? ইস, আমি ধনেপাতা খাই না, ভুলে গেলে? কেমন গন্ধ লাগে।’

প্রিয়ম রুদ্রকে খুব ভালোমতোই চেনে। শান্তভাবে বলল, ‘আগে থেকে কমেন্ট করার অভ্যেসটা তোমার আর গেল না দেখছি। কলকাতাতেও এমন করতে। একবছর বাদে বউ কাছে এল, ভাবলাম কোথায় একটু ভালোমন্দ রেঁধে আমাকে খাওয়াবে, তা না, সেই নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করলাম, আর এখন টেস্ট না করেই বকে চলেছ। আগের মাসে অনিন্দ্য আর ওর বউকে ডিনারে ইনভাইট করেছিলাম, এটা খেয়ে তো পুরো ফিদা হয়ে গেছিল।’

রুদ্র বিকৃত একটা মুখ করে প্লেটটা ঠেলে দিল এদিকে।

‘আগে খেয়ে দ্যাখো না!’ প্রিয়ম এবার রেগে গেল।

রুদ্র অত্যন্ত সিটকোনো বিচ্ছিরি একটা মুখ করে চামচে করে একটুকরো মাংস তুলল, ‘শোনো, ধনেপাতা ধনেপাতাই, তা দিয়ে আর কত ভালো রান্না হবে? ওই সেই ডিম ছাড়া কেকের মতো।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে দিয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চিবিয়ে স্বাদ বোঝার চেষ্টা করল ও, তারপর আরও এক চামচ মুখে দিল। সেটাও কিছুক্ষণ চিবিয়ে তারপর চামচটা পাশে নামিয়ে রেখে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একটুখানি জুস তুলে নিয়ে জিভে দিল।

তারপর আরেকবার। বেশ অনেকটা।

এবার ওর মুখচোখ পালটে গেছে, ‘এই, তুমি এটা দারুণ বানিয়েছ কিন্তু। পুরো হোটেলের মতো। সত্যিই ধনেপাতা দিয়ে বানানো এটা?’

প্রিয়মের প্রচণ্ড ইচ্ছে হল রুদ্রর মাথায় জোরে দুটো গাঁট্টা বসিয়ে দেয়। কিন্তু তবুও আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘ক্যাসারোলে রুটি আছে, নিয়ে শুরু করো। আমাকে দুটো দাও। কাল তো আমাকে অফিস যেতে হবে, ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। পরশু দিন তাহলে কোথায় যাবে, মাদাম তুসো না ডার্ডল ডোর?’

রুদ্র বলল, ‘মাদাম তুসোই যাব। ডার্ডল ডোর পরে হবে না হয়। আচ্ছা, এই ড শ্যুমাখারের কি খুব নাম লন্ডনে?’

প্রিয়ম বলল, ‘তা তো জানি না। কেন?’

রুদ্র বলল, ‘না বলছি।’ খেতে খেতে ফোন ঘেঁটে যাচ্ছিল ও একনাগাড়ে, ‘হ্যাঁ, ড শ্যুমাখারের ভালোই নাম আছে। ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করছেন অনেকদিন ধরে। অনেক সায়েন্টিস্ট অ্যাসিস্ট করেন ওঁকে। প্রচুর রিসার্চ পেপারও রয়েছে দেখছি। লন্ডন ছাড়াও ওয়েলসে একটা অঙ্কোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর। অথচ বেশ ডাউন টু আর্থ, না?’

ফোনটা প্রিয়মের দিকে ঘুরিয়ে একটা ছবি দেখাল রুদ্র, ইংল্যান্ডের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে কোনো একটা অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে প্রাইজ নিচ্ছেন ড শ্যুমাখার। কালো সুটে বেশ অভিজাত দেখাচ্ছে ওঁকে।

প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় এটা?’

রুদ্র ফোনটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ছবির ক্যাপশনটা ভালো করে দেখতে দেখতে বলল, ‘দু—বছর আগে এখানকার গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে বোন ম্যারো ক্যান্সারে উল্লেখযোগ্য কন্ট্রিবিউশনের জন্য লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে ওঁকে।’

প্রিয়ম খেতে খেতে বলল, আচ্ছা। ভালো তো। এত বড়ো একজন রিসার্চার তাঁর গবেষণার বিষয়ে তোমার কাছ থেকে হেল্প চেয়েছেন, এর থেকে ভালো ব্যাপার আর কী হতে পারে? ফটোগুলো দেখলে?’

রুদ্র খাওয়া থামিয়ে খুঁটিয়ে কী দেখছিল, বলল, ‘উঁ? হুঁ, দেখলাম।’

প্রিয়ম এবার তাড়া লাগাল, ‘খেয়ে নিয়ে উঠে দ্যাখো না, খাবারটা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কী ভাবছ বলো তো?’

রুদ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে দু—পাশে মাথা নাড়ল, ‘কিছু না। আচ্ছা, কাল আমি একা একা কী করব বলো তো?’

প্রিয়ম একটু চিন্তা করল, ‘সেটা আমিও ভাবছিলাম। এক কাজ করতে পারো, আমার সঙ্গেই বরং ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ো, সিটি টুর করানোর জন্য বাস আছে, তাতে টিকিট কেটে উঠে পড়ো, সব জায়গা ঘুরিয়ে দেবে।’

রুদ্র বলল, ‘সেগুলো তো বেশিরভাগ আজই সব ঘুরে নিলাম। সেই তো এক জায়গাগুলোই ঘোরাবে। তার চেয়ে বাড়িতেই থাকব, কয়েকটা বিষয়ে একটু পড়াশুনো করতে হবে। আচ্ছা, এখান থেকে ড শ্যুমাখারের ল্যাবে যদি যেতে চাই, কী করে যাব?’

প্রিয়ম এবার একটু অবাক হল, ‘সে কী! উনি তো কাল বার বার বলে দিলেন কোনোভাবেই আমরা যেন ওঁর ওয়ার্কপ্লেসে গিয়ে দেখা না করি, ওঁর অফিসেই অনেক স্টাফ আছে যারা এই কাজটার বিরুদ্ধে, কোনোভাবে তারা বুঝতে পারলে সব বানচাল হয়ে যাবে। তোমার কিছু জানার থাকলে তো উনি বলেই দিলেন, ফোন করে কোথাও দেখা করে নিতে।’

রুদ্র বলল, ‘জানি। ওসব নিয়ে চাপ নিয়ো না। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কী করে যাব বলো তুমি।’

প্রিয়ম তবু একটু কিন্তু কিন্তু করতে লাগল।

হাজার হোক, ওরই রেফারেন্সে রুদ্রর সঙ্গে আলাপ করেছেন ভদ্রলোক, রুদ্র দুম করে ভুলভাল কিছু করে বসলে পরে ওকেই অপ্রস্তুত হতে হবে, ও বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না। ভদ্রলোক তো আমার অ্যাপার্টমেন্টটাও চেনেন। তুমি তো কয়েকদিন বাদেই ফিরে যাবে। আমাকে তো এখানে থাকতে হবে।’

রুদ্র এবার রেগে গেল, ‘উফ! এত ভাবো কেন বল তো তুমি? বলছি তো কোনো প্রবলেম হবে না। এটুকু ভরসা যদি আমার উপর না রাখতে পার, তবে ওঁর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেওয়াই আমার উচিত হয়নি।’

প্রিয়ম এবার আর বেশি গাঁইগুঁই করতে পারল না, ঠিকানাটা শুনে বলে দিল কীভাবে যেতে হবে।

রুদ্র খেয়ে উঠে ফটোগুলো নিয়ে বসল।

ড শ্যুমাখার এগুলো ওকে দিতে চাইছিলেন না প্রথমে, বলছিলেন স্ক্যানড কপি দেবেন, কিন্তু অরিজিন্যাল না হলে অনেক কিছুই না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যদিও রুদ্র নিজেই জানে না কতদূর কী করতে পারবে, তবু চেষ্টা তো করাই যায়!

আলটিমেটলি এটা একটা ভালো কাজ।

তা ছাড়া এখন প্যারিসের ওই ওয়ার্কশপে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তো ও মোটামুটি ফ্রি—ই রয়েছে।

রুদ্র প্রোফেশনাল পাজলব্রেকার বা ক্রিপটোলজিস্ট নয়, নয় কোনো গোয়েন্দাও, তবু ভুটানের ঘটনাটা একটু হলেও ওকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। অন্তত যুক্তিবাদী মন, খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার চোখ আর নিরপেক্ষভাবে একটা ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শেখা, এই তিনটে ক্ষমতা হয়ত কিছুটা হলেও ওর আছে। প্রিয়ম যেমন চট করে কোনো ঘটনা একতরফা দেখে বা কারুর কথা একতরফা শুনেই কনভিন্সড হয়ে যায়, ও তেমন হয় না মোটেই। নিজেকে মাঝামাঝি জায়গায় রেখে একজন এক্সটারনাল এন্টিটি হিসেবে পুরো জিনিসটাকে দেখে চেষ্টা করে।

যেমন এই মুহূর্তে ফটোগুলো ও দেখছিল ঠিকই, কিন্তু মাথা থেকে সেই ছোটো বাদামি চোখের আর গাঢ় খয়েরি হাইলাইট করা চুলের লোকটাকে ও তাড়াতে পারছিল না।

কফিশপের ভেতরে বসে প্রথম ও লোকটাকে দেখেছিল বাইরের টেবিলের একটায় বসে কফিতে চুমুক দিতে। ও নিশ্চিত ড শ্যুমাখার লোকটিকে দেখতে পাননি।

তারপর দেখেছিল বেরোনোর সময়। বিশাল বাইকটা নিয়ে কফিশপের বাইরের ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে ছিল।

কফিশপ থেকে প্রথমে ড শ্যুমাখার বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তারও প্রায় মিনিট দশেক বাদে ওরা বেরিয়েছিল ডাক্তারের কথামতো। প্রিয়ম একটা ক্যাব বুক করেছিল, তাতে করে এসে এই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামার সময়েও ও রিয়ার গ্লাসে একঝলকের জন্য দেখেছে লোকটার সেই বিশাল কালো লাল বাইকটা। ওরকম বাইক তো ইন্ডিয়াতে দেখাই যায় না, এখানে অবশ্য চোখে পড়ছে ভালোই। তার মানে ওরা যতক্ষণ কফিশপে ছিল, লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর ওদের ক্যাবের পেছন পেছন এসেছে এই অ্যাপার্টমেন্ট অবধি।

কিন্তু কেন? ড শ্যুমাখারের কথা অনুযায়ী তথাকথিত সেই সমস্ত ফার্মা কোম্পানি বা ক্যান্সার রিসার্চ ল্যাব, যারা ভীষণভাবে চেষ্টা করছে ওঁর এই রিসার্চটা বানচাল করতে, তাদেরই কোনো লোক কি? তাই যদি হবে, তারা এত এফিশিয়েন্ট যে শ্যুমাখার প্রথমবার ওর সঙ্গে দেখা করতে আসামাত্রই ওরা ট্র্যাক করে ফেলল?

নাকি তারা যেকোনো উপায়ে এই ফটোগুলো হাতানোর চেষ্টা করছে?

অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুদ্র এবার উঠে রান্নাঘরে গেল। দেখল প্রিয়ম একমনে বেসিনে প্লেটগুলো ধুচ্ছে। ওর এবার একটু খারাপ লাগল। ইস, প্রিয়মটা কীরকম দ্যাখো, একা একাই সব কাজ করছে, ওকে একবার ডাকবে তো!

একটু অপরাধীর গলায় গিয়ে ও বলল, ‘দাও আমাকে কিছু, মেজে দিই আমি।’

প্রিয়ম গম্ভীর গলায় বলল, ‘থাক। হয়েছে। আর তোমাকে মাজতে হবে না। কাচের বাসন, তোমার অভ্যেস নেই, এখুনি হয়তো মাজতে গিয়ে ভেঙে ফেলবে, তখন আর একটা কাজ বাড়বে। কলকাতায় থাকো, সামনে পেছনে কাজের লোক নিয়ে ঘোরো, এখানে দিনের পর দিন থাকতে হলে বুঝতে পারতে। তার চেয়ে পারলে ঘরে গিয়ে বিছানাটা একটু পরিষ্কার করো।’

রুদ্র মিষ্টি হেসে প্রিয়মের গালে একটা আলতো চুমু খেয়ে একটু রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘সত্যি! তুমি এত ভালো প্রিয়ম, তবু তোমার একটুও অহংকার নেই।’

প্রিয়ম এবার রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল, ‘দেখে শেখো। কোনোদিনও শিবরাত্রিতে একঘণ্টাও উপোস করে রইলে না, অথচ এইরকম একটা কমপ্লিট ধামাকা প্যাকেজ পেয়ে গেলে। এবার যাও, গিয়ে যেটা বললাম দয়া করে করো, ল্যাপটপ চার্জার সব ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। সারাদিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি হয়েছে।’

রুদ্র পাখির মতো উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছিল ঘরে, যাওয়ার আগে বন্ধ জানলার কাচ থেকে আলতো একবার উঁকি দিল বাইরের অন্ধকারে। এত ওপর থেকে কিছুই যদিও বোঝা যাচ্ছে না, ওই খয়েরি চুলের লোকটা কি এখনও দাঁড়িয়ে আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *