নরক সংকেত – ৪

পরের দিন সন্ধেবেলা পর্যন্ত রুদ্র আর প্রিয়মকে আর অপেক্ষা করতে হল না। তার আগেই ড শ্যুমাখারের সঙ্গে দেখা করতে হল।

রুদ্ররা ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়েছিল। দোতলা হুডখোলা বাসে করে বাকিংহাম প্যালেস, বিগ বেন, লন্ডন আই, পিকাডেলি সার্কাস সব ঘুরে ওরা যখন ন্যাশনাল গ্যালারিতে ঢুকেছে, তখন প্রিয়মের ফোন এল।

দুশো বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী ন্যাশনাল গ্যালারি, তাতে দু—হাজারের ওপর দুষ্প্রাপ্য সমস্ত ছবি রয়েছে। ট্রাফালগার স্কোয়ার চত্বরটাই দারুণ সুন্দর। ফ্রান্স আর স্পেনের সঙ্গে ঐতিহাসিক ট্রাফালগারের যুদ্ধে জেতার পর ব্রিটিশ নেভির পক্ষ থেকে এই স্কোয়ার বানানো হয়েছিল। একদিকে নিখুঁত ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু, অন্যদিকে ফোয়ারা, তার মাঝে অজস্র পায়রার ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো, সব মিলিয়ে একটা দারুণ পরিবেশ।

প্রতিটা ছবি ওরা তন্ময় হয়ে দেখছিল, ডিটেইলড নোটগুলো পড়ছিল, এমন সময় প্রিয়মের ফোন বাজতে প্রিয়ম কথা বলতে বাইরে চলে গেল।

মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এল, ‘রুদ্র, ড শ্যুমাখার ফোন করেছিলেন।’

রুদ্র তখন বেশ মনোযোগ দিয়ে ভ্যান গঘের আঁকা একটা ছবি দেখছিল, অন্যমনস্কভাবে ছবি থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘একটু দেরি করে আসতে বলেছ তো? এখান থেকে মাদাম তুসো যাব তো, অনেক সময় লাগবে ওটা ঘুরতে।’

প্রিয়ম বলল, ‘ওঁর কী—একটা কাজ পড়ে গেছে সন্ধেবেলা, তাই আসতে পারবেন না।’

রুদ্র বলল, ‘বাঁচা গেছে। তাহলে আর জলদি ফেরার তাড়া নেই। শোনো, আমি কাল গুগল ম্যাপে দেখছিলাম মাদাম তুসো মিউজিয়াম থেকে একদম পায়ে হাঁটা দূরেই বেকার স্ট্রিট। শুনেছি ২২১ বি ঠিকানায় এখন একটা মিউজিয়াম হয়েছে? ওটা দেখে আসব, কেমন? উফ, ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ লাগে, না?’

প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘আরে না। উনি বললেন দরকারটা খুব জরুরি। তাই, এখনই দেখা করতে চান, আধ ঘণ্টা সময় দিলেও চলবে।’

রুদ্র এবার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘এখন? মানে? এখন না ঘুরে—টুরে বাড়ি চলে যাব? আচ্ছা মুশকিল তো!’

প্রিয়ম এবারেও মাথা নেড়ে বলল, ‘না বাড়ি যেতে হবে না। উনি অপেক্ষা করছেন।’

রুদ্র এবার আরও অবাক হয়ে গেল, ‘কোথায়?’

প্রিয়ম আমতা আমতা করে বলল, ‘মাদাম তুসো মিউজিয়ামের সামনের একটা কপিশপে। বললেন, ওখানকার কফি নাকি দারুণ।’

রুদ্র এবার রেগে গেল, ‘মাদাম তুসোর সামনে গিয়ে আমরা ভেতরে না ঢুকে বাইরে বসে কফি খাব? কোথা থেকে তুমি জোটাও বলো তো এইসব লোকেদের? ওঁর সঙ্গে বকতে বকতে যদি মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যায়? কী এত দরকার আমার সঙ্গে? চিনি না, জানি না।’

প্রিয়ম মানানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘উনি আধ ঘণ্টার বেশি সময় নেবেন না বারবার বলছেন। তারপরেই আমরা মাদাম তুসোয় ঢুকে পড়ব।’

রুদ্র বিরক্তির একটা শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, ‘ডিসগাস্টিং!’

প্রিয়ম বলল, ‘কী করব বল, এরকমভাবে বার বার কেউ যদি রিকোয়েস্ট করে! এত চাপ নিয়ো না, আমি তো বলেই দিচ্ছি ওঁর দরকারটা কী।’

রুদ্র কটমট করে তাকাল, ‘কী দরকার শুনি?

প্রিয়ম বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাল, ‘ওই তো, দাদু ইন্ডিয়া গেছিল, কিছু গুপ্তধন—টনের খোঁজ পেয়েছিল নির্ঘাত, উদ্ধার করার আগেই বোধ হয় উপরে চলে গিয়েছিল, সেই কথা ডায়েরিতে লিখে গেছে, এ চায় তোমায় দিয়ে উদ্ধার করাতে। সিম্পল! তুমি বরং চিন্তা করো কত পারসেন্ট কমিশন নেবে সেই গুপ্তধনের। এ তো আর তোমার সমাজসেবা নয়। হে হে।’

রুদ্র নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল, ‘তোমার এই স্বভাবটার জন্য না লাইফে তুমি অনেক পস্তাবে দেখো, প্রয়োজনে ‘না’ বলতে জানো না বলে। দরকারটা যখন তাঁর, তাঁকে তো আমাদের সময় সুযোগ মতো আসতে হবে, তাই না! ঘুরতে বেরিয়েছি একরকম মাইন্ডসেট নিয়ে, তার মধ্যে এরকম ব্রেক পড়লে কী যে বিরক্ত লাগে!’

ঘণ্টাখানেক পর মাদাম তুসো মিউজিয়ামের ঠিক উলটোদিকের খুব সুন্দর ছোট্ট কফিশপটায় বসে যখন রুদ্র কফিতে চুমুক দিচ্ছিল, তখন অবশ্য আার অতটা খারাপ লাগছিল না।

এখানে সামারের সময় সব রেস্টুরেন্টেরই বাইরেটা বসার ব্যবস্থা করা হয়। একটা মিষ্টি বেগুনি ফুলের গাছ দিয়ে পুরো কফিশপটাই মোড়ানো। কী গাছ এটা, রুদ্র মনে মনে চিন্তা করছিল। অনেকটা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার মতো। একদম ছড়িয়ে রয়েছে। আর মাটিতে পড়ে সারা রাস্তাটাকে রাঙিয়ে তুলেছে অজস্র রংবেরঙের ফুল।

ঠিক যেন বসন্তের পলাশ।

ওঁরা পৌঁছোনোর আগেই ড শ্যুমাখার সেখানে এসে বলে ছিলেন। যদিও ওঁর অনুরোধ অনুযায়ী বাইরে না বসে ওদের রেস্টুরেন্টের ভেতরেই বসতে হল, রুদ্র কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেলল যতদিন এখানে থাকবে ততদিন সকাল বিকেল ও এইরকম বাইরে বসে গায়ে রোদ মেখে কফি খাবে।

কিছু কিছু মানুষের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, মানুষটা ভালো। ড শ্যুমাখারও তেমনই। বেশ অমায়িক ভদ্রলোক। একটা ক্যাজুয়াল ছাইরঙা ট্রাউজার আর কনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো কালো শার্টে ওঁকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছিল। টকটকে ফর্সা লালচে গায়ের রং, সোনালি চুল, যদিও সামনেটায় এই অকালেই টাক পড়েছে কিছুটা, মুখেও সামান্য বলিরেখা হানা দিয়েছে, তবে কালো ফ্রেমের চশমার মধ্য দিয়ে চোখের ঝকঝকে নীল রঙের মণি দুটো স্পষ্ট বোঝা যায়। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করার সময় রুদ্র অবশ্য বুঝল ভদ্রলোক ডান পা—টা সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন ড শ্যুমাখার, ‘আপনাদের প্রাইভেট সময়ে ভাগ বসানোর জন্য ভেরি সরি। তবে আমি বেশি সময় নেব না একেবারেই। আসলে আমার প্রয়োজনটা এতটাই আর্জেন্ট, আর আপনার সম্পর্কে ওই আর্টিকলটা পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আপনিই আমাকে হেল্প করতে পারেন। মানে, আপনি ওই ভুটানের মিস্ট্রিটা যেভাবে সলভ করেছিলেন, অন্য কোনো ডিটেকটিভই…!’

রুদ্র বাধা দিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আপনি প্রথমেই একটা জিনিস ভুল করছেন ড শ্যুমাখার। আমি ডিটেকটিভ নই। আমি ছাপোষা একজন চাকুরিজীবী, ব্যাঙ্কে চাকরি করি। ভুটানে আমার বাবা একটা বিপদে পড়েন, সেখান থেকে তাঁকে বের করতে গিয়ে আমি ওই ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়ি। এটা আমার প্রোফেশন নয় মোটেই। আর আমার হাজব্যান্ডও আমায় হেল্প করেছিল।’ প্রিয়মের দিকে আঙুল দেখায় ও।

ড শ্যুমাখার হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘ইয়েস, আমি জানি সেটা। আমি সবটাই পড়েছি ম্যাডাম। আমি এমনিই ইন্ডিয়ানদের খুব অ্যাডমায়ার করি, আর আমার মনে হয়েছে আপনিই এই ব্যাপারটায় পারফেক্ট। আপনি যখন এখানে এসেইছেন একটু যদি আমাকে হেল্প করেন, আই উড বি গ্রেটফুল টু ইউ। আর এটা আমার জন্য না, ফর দ্য সেক অফ হোল ম্যানকাইন্ড!’

রুদ্র লক্ষ করল ভদ্রলোকের ইংরেজি একদমই জড়ানো নয়, বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়। ও বলল, ‘আমি তো এখানে এসেছি ঘুরতে, বেশিদিন তো থাকব না, আমার নিজেরও কাজ আছে অফিশিয়াল….!’

ড শ্যুমাখার এবার ওঁর মাথার সামনের ফাঁকা অংশটা কিছুক্ষণ চুলকে নিলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘আপনি যদি একবার শোনেন ম্যাডাম….!’

রুদ্র এবার একটু অস্বস্তিতে পড়ল।

অন্তত এত সুন্দর কফিশপে বসে কফি খাওয়ানোর পরও ব্যাপারটা না শুনলে অভদ্রতা করা হবে।

ও তাড়াতাড়ি হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই। বলুন। আপনি কি এখানেই থাকেন?’

ড শ্যুমাখার এবার বললেন, ‘হ্যাঁ। বাই প্রোফেশন আমি ডাক্তার। আমার জন্ম জার্মানিতে। আমার বাবা ছিলেন জার্মান, কিন্তু তাঁর মা ছিলেন পর্তুগিজ। আর আমার মা আবার ছিলেন ফ্রেঞ্চ।’

ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গিমাটা বেশ মজাদার লাগল রুদ্রর, ও—ও তাই হালকা রসিকতা করল, ‘বাবা জার্মান, ঠাকুমা পোর্তুগিজ, মা ফ্রেঞ্চ, আপনি তো একদম পুরো ইউরোপকেই রক্তে বয়ে নিয়ে চলছেন দেখছি!’

ড শ্যুমাখারও হাসলেন, ‘এইটা একদম খাঁটি কথা বলেছেন আপনি। অনেক জাতির রক্ত বইছে আমার শরীরে। তবে কী,’ ভদ্রলোক এক মুহূর্ত থামলেন, ‘হাইব্রিড প্রোডাক্ট হয়েও আমি নিজেকে জার্মান বলতেই ভালোবাসি। জীবনের অনেকগুলো বছর ওখানেই কেটেছে তো! জার্মানিই আমার নিজের দেশ।’

রুদ্র স্মিত মুখে মাথা নাড়ল।

ভদ্রলোক বলে চললেন, ‘যেটা বলছিলাম। আমার মায়ের দাদু ফ্রান্স থেকে আপনাদের ইন্ডিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে গিয়েছিলেন আর পন্ডিচেরিতে বেশ কিছুদিন ছিলেনও। পরে উনি দেশে ফিরে গেলেও ওঁর ছেলে মানে আমার মায়ের বাবা ফেরেননি। উনি ওখানেই সেটল করে গিয়েছিলেন। আমার মায়েরও ছোটোবেলা ওখানেই কেটেছে। তবে আমার দাদু খুব অল্পবয়সে মারা যান, তাই তারপর মা—রা সবাই আবার ফ্রান্সে ফিরে যান।’

প্রিয়ম মাঝপথে বাধা দিল, ‘কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো ছিল ইংরেজদের। আপনার মায়ের দাদু ফ্রান্সের লোক বলছেন যে?’

এবার রুদ্র মুখ খুলল, ‘উঁহু, ইংরেজদের যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল, তেমনই ইংরেজদের দেখাদেখি ফ্রেঞ্চরা, পোর্তুগিজরা সবাই ইন্ডিয়াতে বা এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাবসা করার জন্য তাদের নিজস্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুলেছিল। কিন্তু কেউই ইংরেজদের দাপটে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি, বেশিদিন কোম্পানি চালাতওে পারেনি। ড শ্যুমাখার ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথাই বলছেন। ফ্রেঞ্চরা তবু কিছুটা হলেও পেরেছিল পন্ডিচেরি বা চন্দননগরে, পোর্তুগিজরা একেবারেই পারেনি, যদিও ওরাই প্রথম ভারতে এসেছিল। ভাস্কো দা গামা মনে আছে তো?’

প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ। সেই ক্লাস ফোরের ইতিহাস। ১৪৯৮ সাল, কালিকট বন্দর।’ বলেই ড শ্যুমাখারের দিকে তাকাল, ‘আপনি তাহলে ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা বলছেন?’

ড শ্যুমাখার এবার উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ‘ইয়েস! ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেখানকার সব কথা দাদুর ডায়েরিতে আমি পড়েছি। উনি তো ওখানে অনেকদিন ছিলেন। উনিও ডাক্তার ছিলেন। তার সঙ্গে প্রতিদিনের রোজনামচা লিখে রাখা ছিল ওঁর শখ। ওঁর লেখা পড়েই অনেক কিছু জেনেছি। তখনকার ইন্ডিয়া, স্পিরিচুয়ালিটি, মানুষের লাইফস্টাইল সব। ইন ফ্যাক্ট সেসব পড়েই আমার ইন্ডিয়া নিয়ে এত ইন্টারেস্ট। তো যাই হোক, আমি অবশ্য জন্মে থেকেই জার্মানিতে। ওখানেই পড়াশুনো। কেরিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে আমি লন্ডনে শিফট করেছি, আমার কাজের সুবিধার জন্যই। আমি দুটো ক্লিনিকের সঙ্গে অ্যাটাচড, এ ছাড়াও আমার নিজস্ব একটা রিসার্চ ল্যাবও আছে। আমি ক্যান্সারের ওপর কাজ করি আর সেই ব্যাপারেই আপনার হেল্প আমার খুব দরকার।’

এইবার রুদ্র সত্যিই খুব অবাক হয়ে গেল। প্রিয়ম এতক্ষণ বেশ আত্মপ্রসাদের ভঙ্গিতে রুদ্রর দিকে তাকাচ্ছিল ওর আন্দাজ ঠিক ছিল বলে, কিন্তু শেষ কথাটায় ও—ও হকচকিয়ে গেল। থতোমতো মুখে রুদ্রর দিকে তাকাল।

রুদ্র বলল, ‘ক্যান্সার! ক্যান্সারের ওপর রিসার্চে আমি কীভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি?’

মি শ্যুমাখার বললেন, ‘বলছি। তার আগে পুরোটা শুনুন। আমি ক্যান্সারের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি বহুদিন ধরে, তা প্রায় বছর দশেক হল। এখান থেকে বেশি দূরে নয় আমার ল্যাব। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং—এর জন্যই হোক, বা পলিউশন, কিংবা এখনকার মানুষজনের সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ক্যান্সার হু হু করে বেড়ে চলেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনই ক্যান্সারের মেইন কারণ। তো এই নিয়ে সারা পৃথিবীতেই অনেক গবেষণা চলছে এবং অনেকরকম মেডিসিন বা থেরাপিও বেরিয়েছে যার ফলে প্রাথমিক স্টেজে ডায়াগ্নোসিস করা গেলে পেশেন্টকে এখন সারিয়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছে। যেমন কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, সার্জারি বা ইমিউনোথেরাপি। এগুলো জানেন তো?’

প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টে এখন অনেকরকম প্রসিডিয়র বেরিয়েছে। স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেও তো সারানো হচ্ছে এখন।’

ড শ্যুমাখার মাথা দোলালেন, ‘ঠিক। কিন্তু এগুলোর সবকটাই কিন্তু কারেক্টিভ মেজার। কারেক্টিভ রিসার্চে ক্যান্সারের সলিউশন এভাবে বের করা গেলেও এটা দিয়ে একশো পারসেন্ট সাকসেস রেট কিন্তু অ্যাচিভ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এভাবে সারিয়ে তোলার প্রসেসটাও অত্যন্ত পেইনফুল আর ওই পেশেন্টের শরীরে ক্যান্সার আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। তাই, আমি সেদিকে ইন্টারেস্টেডও নই। আমি রিসার্চ করছি ক্যান্সারের প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়ে।’ এক সেকেন্ড নিশ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন ভদ্রলোক, ‘আচ্ছা, আগে বুঝিয়ে বলে দিই প্রিভেন্টিভ আর কারেক্টিভ মেজারটা ঠিক কী।’

রুদ্র এবার মুখ খুলল, ‘জানি। যেকোনো অসুখ দু—রকমভাবে সলভ করা যায়, একটা প্রিভেন্টিভ, অন্যটা কারেক্টিভ। কারেক্টিভ হল, রোগটা হবার পর ওষুধ দিয়ে সরিয়ে তোলা। মানে জ্বর হল, তারপর ওষুধ খেলাম। কিন্তু প্রিভেন্টিভ সলিউশন মানে, রোগটা হবার যে কারণ সেটাকেই এলিমিনেট করে দেওয়া। মানে এমন কিছু একটা ট্রিটমেন্ট যাতে জ্বরটাই হবে না। এভাবে প্রচুর রোগকে অনেক দেশ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া গেছে। যেমন স্মলপক্স বা পোলিয়ো। এই প্রিভেন্টিভ মেজারের জন্যই হওয়ার পরেই বাচ্চাদের বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। তাই তো?’

কথা শেষ করে ও লক্ষ করল ভদ্রলোকের হাতের উপরের দিকে বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো গর্তের দাগ, অনেকটা আগেকার দিনে বাচ্চাদের টিকা দিতে গেলে যেরকম হত।

ড শ্যুমাখারের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল উনি বেশ ইমপ্রেসড হয়ে গেছেন, ‘একদম ঠিক বলেছেন আপনি। আমি এই প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়েই কাজ করছি। পৃথিবী থেকে ক্যান্সার হওয়ার কারণগুলোকেই যদি সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো মানবজাতির একটা বিশাল জয় হবে, তাই না।’

রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল, এবার একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু, ক্যান্সারকে এলিমিনেট করা কি সম্ভব? মানে, এটা তো কোনো ভাইরাসঘটিত রোগ নয়, যে সেই ভাইরাসটার ভ্যাকসিন বের করে, বা সেই ভাইরাসটাকে নিশ্চিহ্ন করে রোগটা সারানো যাবে! দু—তিন হাজার বছর আগেও তো ক্যান্সারের অস্তিত্ব ছিল, সেটা তখন ক্যান্সার বলে আইডেন্টিফাই করা যেত না।’ কথাটা শেষ করে ও দেখল, ড শ্যুমাখার বেশ গভীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।

ও বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘যদিও আমি কোনো মেডিক্যাল লাইনের লোক নই তবু যেটুকু বই পড়ে জানি সেটা হল, ক্যান্সার পার্টিকুলার একটা রোগ নয়, শরীরের কোনো জায়গার কোষ যদি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে আশপাশের টিসুতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই ম্যালিগন্যান্সি বা ক্যান্সার। এমনিতে শরীরের প্রয়োজনমতো নতুন কোষ তৈরি হয়, কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে কোশ তৈরি হতে থাকে। আর ক্যান্সার কেন হয়, তার কোনো ওয়েল—ডিফাইনড লিস্টও তো নেই মনে হয়।’

ড শ্যুমাখার ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ‘হুঁ। আপনি ঠিকই বলেছেন। এমনিতে কোনো কোষ যখন বুড়ো হয় বা ড্যামেজড হয়ে যায়, তখন সেগুলো মরে যায়, তার জায়গায় নতুন কোশ তৈরি হয়। কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পুরোনো ড্যামেজড কোষগুলো মরে না, আর দরকার না থাকতেও নতুন কোশ তৈরি হতে থাকে, আর এই এক্সট্রা কোশগুলোই বাড়তে বাড়তে টিউমর ফর্ম করে।’

প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘টিউমর হওয়া মানেই কি সেটা থেকে ক্যান্সার হয়?’

শ্যুমাখার দু—দিকে মাথা নাড়লেন, ‘না। টিউমর হয় দু—ধরনের, বিনাইন আর ম্যালিগন্যান্ট। বিনাইন টিউমর একমাত্র ব্রেনে না হলে লাইফরিস্ক নেই, এগুলো সাইজে যদিও বড়ো হয়, কিন্তু আশপাশের টিসুগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে না বা সেগুলোকে অ্যাটাক করে না। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট মানে ক্যান্সারের টিউমরের ক্ষেত্রে এরা আশপাশের টিসু শুধু নয়, রক্তের মধ্য দিয়ে আরও অনেক দূর গিয়ে নতুন নতুন জায়গায় টিউমর তৈরি করে, আর এরা ক্ষতিও করে।’ একটানা বলে ড শ্যুমাখার রুদ্রর দিকে ডাকালেন, ‘এবারে আপনার প্রশ্নে আসি। হ্যাঁ, ক্যান্সার কোনো ভাইরাসঘটিত রোগ নয়, তাই স্মলপক্স বা পোলিয়োর মতো প্রসেসে একে দূর করা যাবে না। কিন্তু ক্যান্সার হল একটা জেনেটিক রোগ, জিনের মাধ্যমেই এটা ছড়িয়ে পড়ছে, সেটাকে ফোকাস করে আমরা রুট ধরে এগোলেই কিন্তু ক্যান্সারকে পুরোপুরি এলিমিনেট করা যায়, বুঝতে পারলেন?’

রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, পাশ থেকে প্রিয়ম একটু উশখুশ করে উঠল। এবারে ও প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘কী হয়েছে?’

প্রিয়ম বাংলায় বিড়বিড় করল, ‘আর কিন্তু মাত্র পনেরো মিনিট তোমার মাদাম তুসো খোলা থাকবে!’

বাইরের কারুর সামনে তাঁর অজানা কোনো ভাষায় কথা বলা বেশ অভদ্রতা, রুদ্র মুখে কিছু না বলে চোখ দিয়ে একটা তিরস্কারের ভ্রূকুটি করল। ওর নিজেরও এবার মনে পড়ে গেল আজ ওদের মাদাম তুসো দেখতে যাওয়ার কথা। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছে প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর, ভালোও লাগছে, কিন্তু এখনও দরকারটা কী, ও বুঝে উঠতে পারল না।

মূল পয়েন্টে এসে আলোচনায় ইতি টানার জন্য ও ড শ্যুমাখারের দিকে ফিরল, আপনার রিসার্চের ওয়েটা সত্যিই বেশ অ্যাপ্রিশিয়েটিং। আপনার সাকসেসের জন্য অনেক শুভকামনা রইল।’ বলেই ও একটা এয়ারহোস্টেস—মার্কা হাসি ঝোলাল মুখে, ‘এইবার তো আমাদের উঠতে হবে, তাই দরকারটা যদি একটু তাড়াতাড়ি বলেন!’

ড শ্যুমাখারার উপর নীচে মাথা নাড়লেন, হাত দুটোকে পেছনে আড়মোড়া করে চেয়ারে হেলান দিলেন, ‘হ্যাঁ। আমার ওই পন্ডিচেরির দাদু ডাক্তার হলেও তিনি প্র্যাকটিসের থেকে বেশি কেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণায় মেতে থাকতেন। তাঁর ডায়েরিতে বিভিন্ন অসুখ, সেগুলো থেকে সেরে ওঠার উপায়, বিভিন্ন বায়োকেমিক্যালস, ড্রাগস নিয়ে প্রচুর গবেষণার কথা লেখা আছে। আমার তো মনে হয়, তিনি সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। আমার এই বায়োকেমিক্যাল ড্রাগস নিয়ে রিসার্চের প্রতিভাটা হয়তো আমি ওঁর থেকেই পেয়েছি। আমার বলতে লজ্জা নেই, আমার অনেক ওষুধের পেটেন্টের মূল ভাবনা আমি ওঁর ওই ডায়েরি থেকেই পেয়েছি।’ ভদ্রলোক একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসলেন।

প্রিয়ম এবার আর আড়াল আবডাল করল না খুব একটা, মৃদু একটা খোঁচা মারল রুদ্রর কোমরে।

সেটা লক্ষ করে ড শ্যুমাখার তড়িঘড়ি বললেন, ‘আমার নিজস্ব রিসার্চে অনেকটাই এগিয়েছিলাম, কিন্তু সম্প্রতি আমি ওঁর ডায়েরিতে এমন একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি, যা থেকে আগামী একমাসের মধ্যে এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারপর থেকে নতুন যে শিশুরা পৃথিবীতে জন্মাবে, ক্যান্সার কোনোদিনও তাদের বা তাদের বংশধরদের শরীরে থাবা বসাতে পারবে না। শুধু শিশু নয়, প্রাপ্তবয়স্ক যারা এখনও সুস্থ আছে, তাদেরও কোনোদিন ক্যান্সার হবে না।’

রুদ্র এবার অবাক হয়ে গেল, ‘মানে? সেটা কীভাবে সম্ভব?’

ড শ্যুমাখার একটু চাপা গলায় উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘সম্ভব, কিন্তু একদম অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উনি এমন একটা মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন যেটা অ্যাপ্লাই করে মানুষের জিনগুলোকে এমনভাবে মডিফাই করে দেওয়া যায় যাতে কোনো কোষের অ্যাবনর্মাল গ্রোথ হবে না!’

‘তাদের ক্ষেত্রে হয়তো অ্যাবনর্মাল গ্রোথ হবে না, কিন্তু তাদের নেক্সট জেনারেশনের ক্ষেত্রে তো হতেই পারে।’

ড শ্যুমাখার দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘না, একধরনের কোষ আছে, যাতে জিন থেরাপি অ্যাপ্লাই করলে সেটা পরবর্তী সব প্রজন্মের ক্ষেত্রে অ্যাপ্লিকেবল হয়।’

‘তাই?’

শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ। এবার বুঝতে পারছেন এতে মানবজাতির কত বড়ো ওয়েলফেয়ার হবে? সেই ব্যাপারেই আপনার কাছ থেকে আমার সাহায্য চাই, খুব আর্জেন্ট আর সিক্রেটও বটে।’ প্রিয়মের দিকে তাকালেন তিনি, ‘আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে লাকিলি পরিচয় হয়েছিল আমার, যদিও আপনার সম্পর্কে আগেই পড়েছিলাম আমি। আমার মনে হয়েছে আপনিই আমাকে হেল্প করতে পারেন। আর এতটা দরকার না থাকলে আপনার সঙ্গে দেখা করতামও না আমি।’

রুদ্র এবার আর তাড়াহুড়ো করতে পারল না। এবার একটু একটু আগ্রহ হচ্ছিল ওর বিষয়টার ওপর। কোনো যন্ত্রণাকাতর কেমোথেরাপি নয়, রে দেওয়া নয়, ক্যান্সার রোগটারই আর অস্তিত্ব থাকবে না পরবর্তী প্রজন্মে?

এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে?

হঠাৎ নিজের দাদুর কথা মনে পড়ে গেল রুদ্রর। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। ছোটোবেলায় বাবা মা দুজনেই অফিস বেরিয়ে যেতেন, খুব ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ফিরে ও দাদুর কাছেই থাকত। দাদুর কোলে চেপেই স্কুলে যেত, বিকেলে খেলতে যেত মাঠে। বই পড়ার অভ্যেস দাদুই করিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। দেশ—বিদেশের জানা অজানা কতরকম গল্প শুনত ও দাদুর কোলে বসে। অলিভার ট্যুইস্ট, গালিভার্স ট্রাভেলস, রবিনসন ক্রুসো, হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম!

এমনকী শেক্সপিয়রের কালজয়ী সব ক্লাসিক্সও ওই বয়সের উপযোগী করে ওকে গল্প শোনাতেন দাদু।

সেই দাদু ওর ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হঠাৎ চলে গেলেন। তখন বোঝেনি ও, কতদিন স্কুল থেকে ফিরে কাজের মাসির হাত থেকে খাবার না খেয়ে একা একা গুমরে গুমরে কেঁদেছে, দাদুর কথা জানতে চেয়ে বাবা—মা—কে অতিষ্ঠ করেছে। বেশ কয়েক মাস লেগেছিল ওর স্বাভাবিক হতে। পরে বড়ো হয়ে শুনেছিল দাদুর ক্যান্সার হয়েছিল ফুসফুসে। ফাইনাল স্টেজ। কিচ্ছু করা যায়নি। অথচ সিগারেট তো দূর, দাদু চা কফিও বেশি খেত না।

এত বছর পর সেসব কথা মনে পড়তে চোখে জল এল না ঠিকই, সময় সব ক্ষততেই মলম লাগিয়ে দেয়, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠল ওর। প্রায়ই আজকাল ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দ্যাখে একদম ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদেরও ক্যান্সার ধরা পড়ছে, কেমো চলার সময় তাদের কষ্ট দেখা যায় না।

হঠাৎ হঠাৎ আশপাশের চেনাজানার পরিধি থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে একেকজন, এই মারণরোগে।

ড শ্যুমাখারের দাবি ঠিক হলে এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *