নরক সংকেত – ৩৫

৩৫

জিমি সোজা বন্দুক তুলে এগিয়ে গেল পেছন ঘুরে বসে থাকা লোকটার দিকে, ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে জোরে একটা লাথি কষিয়ে লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়েই অবাক গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘সিগফ্রেড!’

রুদ্র, প্রিয়ম আর ফেলিক্স এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল লোকটার দিকে।

ড সিগমুন্ড শ্যুমাখারের যমজ ভাই ওরফে সিগফ্রেড?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সিগফ্রেড কোনো নড়াচড়া করল না, আওয়াজও না। জিমির আঘাতে পড়ে গিয়েও মনে হচ্ছিল ও যেন ঘুমোচ্ছে।

না, ঠিক ঘুমোচ্ছে না, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন। নীল রঙের চোখ দুটো অর্ধ—উন্মীলিত, ঠোঁট দুটো খোলা, সে—দুটো খুব মৃদু লয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল। চোখের দু—পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।

রুদ্রর মনটা হঠাৎই একটু ভিজে গেল। হাজার হোক, কথাবার্তায় নানা অসংগতি পেলেও যে দু—দিন দেখা করেছিল তাতে বুঝেছিল, লোকটা কিন্তু বেশ হাসিখুশি আর আলাপি ছিল। খেতেও ভালোবাসত।

এত বড়ো চক্রান্তের পান্ডা এত দিলখোলা হয় কি?

নাকি এই লোকটাকেও ব্যবহার করা হচ্ছিল!

ফেলিক্সের হাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছিল, রুমাল দিয়ে জায়গাটা টেনে বেঁধে রেখেছিল, তবু তারই মধ্যে কয়েক সেকেন্ড আর অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে সিগফ্রেডকে পুরোটা পরখ করে ওর হাতে ধরে থাকা লম্বা পাইপটা টেনে নিয়ে তার একদিকের খোলা সরু মুখটা সে নাকের কাছে নিয়ে এসে শুঁকল, ‘ক্যানবিস! কয়েক ঘণ্টা এরকম থাকবে এখন।’ কথা বলতে বলতে যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করল ফেলিক্স।

অন্য কেউ এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেত, পুলিশ বলেই এখনও সে এতটা সক্রিয় থাকতে পারছে।

রুদ্র বুঝতে পারল না, ‘মানে? ক্যানাবিস কী? কোনো রোগ? সিগফ্রেড বেঁচে আছে?’

পাশ থেকে প্রিয়ম ফিসফিস করল, ‘ক্যানাবিস একধরনের ড্রাগ, ইউরোপে চলে, যদিও সম্পূর্ণ ব্যানড। মারিজুয়ানার নাম শুনেছ তো, ওটাকেই এখানে ক্যানাবিস বলে। হেরোইন, কোকেন এসবের থেকেও মারাত্মক। কয়েক দিন আগেই কয়েকটা ছেলেমেয়ে মারা গেছে নিতে গিয়ে, কাগজে পড়েছিলাম।’

রুদ্র পাশে—পড়ে—থাকা বিশাল বিশাল পাইপগুলো দেখছিল, ওগুলো কি আদৌ পাইপ? না অন্য কিছু?

ও আর দেরি করতে চাইছিল না, যেকোনো মুহূর্তে কেউ এসে পড়তে পারে, তার আগে নিজেরাই ঢোকা ভালো। ও বলল, ‘ভেতরে চলুন।’ তারপর ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতের এই অবস্থা নিয়ে আর ভেতরে যেতে হবে না আপনাকে, আপনি বরং এই ঘরটায় বসে একটু রেস্ট নিন, কেউ এলে বুঝতে পারবেন। আর হ্যাঁ, ওই সিকিউরিটি অফিসার ম্যাক্সকে ফোন করে বলুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওঁর গার্ডদের ক্যাম্পের পেছনের দিকে পাঠাতে। আর আমরা যেভাবে এসেছি সেভাবেই আসতে বলবেন। ক্যাম্পের ভেতর দিক দিয়ে যেন না আসে।’

ফেলিক্স কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ল সিগফ্রেডের অচৈতন্য শরীরের পাশেই। ক্লান্ত গলায় ফোন করে ম্যাক্সকে ফোন করে কথা বলল কিছুক্ষণ।

রুদ্র ফিসফিস করল, ‘ওদের আসতে কতক্ষণ লাগতে পারে?’

ফেলিক্সের চোখ দুটো রক্তপাতের শ্রান্তিতে বুজে আসছিল, বলল, ‘বড়োজোর পাঁচ থেকে সাত মিনিট।’

রুদ্র জিমির দিকে তাকাল, ‘আমরা ঠিক তিন মিনিট বাদে ভেতরে ঢুকব। যাতে ঢোকার পর কোনো বাজে পরিস্থিতিতে পড়লে একটুবাদেই ওরা এসে পড়তে পারে।’

জিমি সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় চোখের নিমেষে, আবার কখনো এক একটা মিনিটকে মনে হয় এক এক ঘণ্টা, কাটতেই চায় না। অপেক্ষা করতে করতে রুদ্রর ভেতরটা ধুকপুক করছিল, মনে হচ্ছিল ঢুকেই যায় ভেতরে, কিন্তু তিনজন মিলে এইভাবে ঢোকা নেহাত নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ফেলিক্স হঠাৎ ওর প্যান্টের একটা পকেট থেকে ছুরি বের করল, একঝলক ওদের দিকে তাকিয়েই বাঁ—হাত দিয়ে ছুরির ধারালো দিকটা লম্বালম্বি ঢুকিয়ে দিল গলগল করে রক্ত বেরোনো ক্ষতস্থানটার মধ্যে।

রুদ্র আঁতকে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল, জিমি ইশারায় ওকে চুপ করিয়ে দিল, ‘ও গুলিটা বের করে ফেলছে নিজেই। ভালোই হবে, এতে যন্ত্রণাটাও কমবে, রক্ত পড়াটাও।’

তবু ফেলিক্সের কার্যকলাপ দেখে অজান্তেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। যেন মনে হচ্ছে কোনো মুরগি কাটছে, ঠিক এইভাবে ছুরি চালিয়ে গুলিটাকে ভেতর থেকে বিকৃত মুখে বের করল ফেলিক্স, তারপর রুমালটা দিয়ে টানটান করে চেপে বেঁধে ফেলল জায়গাটা।

রুদ্র আর প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে ও ঈষৎ হাসল, ‘এতে আর ব্লিডিং হবে না।’

ভেতরে ঢুকে উজ্জ্বল আলোয় যা দেখল, তাতে ওদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল।

বাইরের ঘরে পড়ে থাকা পাইপগুলোর মতো অন্তত দশটা পাইপ লম্বালম্বি বসানো হয়েছে পুরো জায়গাটায়। পাঁচ থেকে সাতজন গার্ডের ইউনিফর্ম পরা লোক মুখে মাস্ক পরে সেই পাইপগুলো থেকে লম্বা নল টেনে নিয়ে একে একে লাগাচ্ছে ওপারে থাকা রিফিউজিদের হল ঘরটার ভেন্টিলেটরগুলোতে।

বিশাল পাইপগুলো আদতে একেকটা গ্যাস সিলিন্ডার। নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন রোবটের মতো নলগুলো লাগিয়ে চলেছে আরও কয়েকটা লোক, সময় বেশি নেই। নল লাগানো হয়ে গেলেই সিলিন্ডারগুলোর নবগুলো খুলে দেবে তারা।

এমনই ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে।

পুরো জিনিসটা হৃদয়ঙ্গম করতে ওদের ঠিক কুড়ি সেকেন্ড সময় লাগল, তারপর রুদ্র চিৎকার করে উঠল, ‘গ্যাস! পয়জনাস গ্যাস! জিমি!’

ওর মুখের কথা শেষ হবার আগেই একটা হলুস্থুল পড়ে গেল আর জিমি প্রায় উল্কার গতিতে ছুটে গেল ওদিকে।

ছুটে ওদিকে যাওয়ার আগেই রুদ্রর চোখ দুটো এক আকস্মিক চাপে ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ও অনুভব করল, পেছন থেকে একটা বজ্রকঠিন হাত এসে ওর গলায় চেপে বসছে। এত জোরে গলা টিপে ধরায় নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল ওর।

সারা মুখ লাল হয়ে আসছিল, সারা শরীরের রক্ত যেন আস্তে আস্তে গিয়ে জমা হচ্ছিল হাত আর পায়ের ডগায়, নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়েও ও হাত দুটোকে আলগা করতে পারছিল না। সামনে চলা গোলাগুলির আওয়াজও কেমন ফিকে হয়ে আসছিল।

আরও কয়েক সেকেন্ড পর যখন ওর শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিল, চোখের সামনে সব কেমন অস্পষ্ট হয়ে আসছে দ্রুত তখনই খুব সামনে একটা গুলির আওয়াজ হল, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর গলার সেই হাত দুটো আলগা হয়ে গেল।

কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে পেছনে ফিরেই রুদ্র দেখল, ওর গলা টিপে ধরা লোকটা মাটিতে পড়ে গেছে, আর তার পাশেই কোনোমতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেলিক্স। তার হাতের সেই রুমালটা রক্তে ভিজে সপসপ করছে। এতটা রক্তপাতে সে নিজেও টলছে অল্পস্বল্প, তবু আজ ফেলিক্সের জন্যই ও প্রাণে বাঁচল!

রুদ্র তীব্রবেগে কাশতে কাশতে থেবড়ে বসে পড়ল মাটিতে। প্রিয়ম টেনে তুলল ওকে, ‘ফেলিক্স, একটু জলের জোগাড় করতে পারো? ওকে একটু জল খাওয়াতে হবে।’

ফেলিক্স ততক্ষণে উপুড় হয়ে পড়া লোকটার দিকে চলে গেছে, ফেলিক্সের অব্যর্থ নিশানা তার পিঠের বাঁ—দিক দিয়ে ঢুকে গেছে।

ফেলিক্স তার কোমরের টর্চটা প্রিয়মকে দিল, প্রিয়ম টর্চটা জ্বেলে লোকটাকে উপুড় করতেই ঘটনার আকস্মিকতায় টর্চটা প্রায় খসে পড়ল প্রিয়মের হাত থেকে।

আর ফেলিক্স চমকে আর্তনাদ করে উঠল, ‘এ কি স্যার! আ—আপনি!’

রুদ্র ততক্ষণে উঠে এসেছে।

বিশাল বপুর লোকটার যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকানোর আগে ওর চোখে পড়ল লোকটার আঙুলগুলোর দিকে, যেগুলো একটু আগেই প্রবল আক্রোশে চেপে বসেছিল ওর গলায়। দুটো হাতেরই মধ্যমায় একই ধরনের আংটি, আর তার উপরের পাথরে যে সংখ্যাটা খোদাই করা, সেটা যে দুই, সেটা এই আলো আঁধারিতেও স্পষ্ট বুঝতে পারল রুদ্র।

কমিশনার মি অ্যান্টন স্নেইডার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।

রুদ্রর মুখে একটা বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল, ‘আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম।’

ফেলিক্স হতবুদ্ধি হয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘এটা কী করে হল?’

রুদ্র স্নেইডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দিব্যি খেলাটা জমিয়েছিলেন। সৎ ছেলেকে দিয়ে নেগেটিভগুলো চুরি করালেন, সেগুলো সলভ করার দায়িত্ব দিয়ে বেচারাকে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে লন্ডন পালাতে সাহায্য করলেন। এদিকে আপনার ইনফ্লুয়েন্স কাজে লাগিয়ে লাকি নম্বর বেছে বেছে একটার পর একটা ব্লাস্ট করে চলল আপনার দল, আর আপনি সরষের মধ্যেই ভূত হয়ে থেকে, সেগুলোকে সামাল দিয়ে চললেন। আগামীকাল সবচেয়ে বড়ো ব্লাস্টটা করবেন বলে ঠিক করে রেখেও আমি সেটা ধরে ফেলায় মত পালটে ঠিক করলেন আজই রাতের অন্ধকারে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু ভুলটা করলেন হাতে নিউমেরোলজি অনুযায়ী লাকি নম্বরের আংটিটা রেখে। আপনার গুরুদেবের মতো আপনারও যে লাকি নম্বর দুই, সেটাকে মিলিয়েই যে আপনি একের পর এক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, সারা পৃথিবীটাকে নরকে পরিণত করার আয়োজন করছেন আপনিই, সেটা আপনার ওই আংটি দুটো দেখার পর বুঝতে আমার খুব বেশিক্ষণ লাগেনি মি স্নেইডার!’

ফেলিক্স হতবুদ্ধির মতো ওর দিকে তাকাল, ‘গুরুদেব মানে?’

রুদ্র শ্লেষমেশানো গলায় বলল, ‘অ্যাডলফ হিটলার, আবার কে! ইনি নিজেকে দ্বিতীয় হিটলার হিসেবে তৈরি করছিলেন আস্তে আস্তে! সাইফার কোডটা বোঝানোর সময় যখন টেবিলে ওঁর রাইটিং প্যাডটা নিয়ে লিখছিলাম, তখনই চোখে পড়েছিল কবিতাটা। প্রথম লাইনটাই ছিল কেইন স্লেচটেস ব্লাট ইন ইউরোপা। তখন বুঝতে পারিনি মানেটা। পরে গাড়িতে শুনে বুঝতে পারলাম।’

ততক্ষণে সামনের গেট থেকে মাক্সের পাঠানো প্রায় পঞ্চাশের ওপর গার্ড চলে এসেছে। ফেলিক্স আর জিমির নেতৃত্বে নিমেষের মধ্যে যেন রণক্ষেত্র হয়ে উঠল জায়গাটা। কুড়ি পঁচিশটা অল্পবয়েসি নকল ইউনিফর্ম পরা ছেলেদের ধরাশায়ী করতে খুব বেশি গুলি খরচ করতে হল না ওদের।

গোলাগুলির মধ্যেই জিমি ছুটে এসেছে এদিকে। স্নেইডারকে দেখে সেও হতবাক হয়ে গেল, ‘স্নেইডার স্যার! এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’

কথায় আছে, আহত জন্তু মৃত্যুর আগে মরণকামড় দিতে ভোলে না। এক্ষেত্রেও শেষবারের মতো বিকৃত গলায় গর্জে উঠলেন স্নেইডার, ‘ইউরোপ শুধু ইউরোপিয়ানদের জন্য! কেইন স্লেচটেস ব্লাট ইন ইউরোপা! নো ব্যাড ব্লাড ইন ইউরোপ! ইউরোপ উইল বি অন দ্য টপ অলওয়েজ!’

রুদ্রর মুখ দিয়ে তীব্র ঘৃণা ঝরে পড়ল, নেহাত মৃত্যুপথযাত্রী বলে সংযত করছিল নিজেকে, ‘সেইজন্য ইউরোপে যারা একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছে, সেই অসহায় মানুষগুলোকে একে একে মারছিলেন আপনি? দেশের রক্ষাকর্তাদের একজন হয়ে আপনার এটা করতে লজ্জা করল না? ঠিক যেমনটা করেছিলেন হিটলার? যিনি শুধু জার্মানির নয়, সারা পৃথিবীর লজ্জা! আর নিজেদের সুপারম্যান বানিয়ে বাকি বিশ্বটাকেই ক্রীতদাসে পরিণত করবার তালে ছিলেন? আর রক্ত খারাপ কি শুধু জাত দিয়ে বোঝা যায়?’ রাগের চোটে ও টেনে হিঁচড়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে এল জিমিকে, ‘এ—ও ইউরোপিয়ান নয়, কিন্তু আপনার দেশের স্বার্থে নিজের জীবনও বিপন্ন করেছে জিমি। আর আপনি? দেশপ্রেম শুধু রক্ত দিয়েই হয় না বুঝলেন, মানবিকতা দিয়ে হয়।’

একটা জান্তব আর্তনাদ বেরোল স্নেইডারের মুখ দিয়ে, ‘হেইল হিটলার!’ তারপর গোটা দেহটা একবার কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল।

ততক্ষণে গার্ডরা সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়ায় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল পুরো এন্ট্রান্সটা।

প্রিয়ম অস্ফুট বিস্ময়ে বলল, ‘স্নেইডার হিটলারের এত ভক্ত ছিল কেন?’

রুদ্র একদৃষ্টে স্নেইডারের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিল, ‘হিটলার মারা যাওয়ার আগের দিন বিয়ে করেছিল ওর মিসট্রেস ইভা ব্রাউনকে। পরের দিনই দুজনে একসঙ্গে সুইসাইড করে। ওদের দুজনের বহুদিনের সম্পর্ক ছিল। সারা পৃথিবী জানে না, কিন্তু ইভা নিজে ওঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন ওঁদের একটা ছেলে হয়েছিল এবং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে রাজনৈতিক টালমাটাল থেকে দূরে রাখতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইভার এক মাসির কাছে। ইভার একজন দাসী ছিল, হিস্ট্রি চ্যানেলকে দেওয়া তাঁর এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউটা ইউটিউবে দেখে জানলাম। হিটলার নিজেও তার সন্তানের অস্তিত্ব গোপন রাখতে চেয়েছিল হয়তো!’

জিমি বলল, ‘কী নাম ছিল তার?’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘অনেক বই ঘেঁটেও তার নাম জানতে পারিনি, তবে ইভার সেই মাসির নাম ছিল এমিলি স্নেইডার। আমি গেস করছি হিটলারের সেই ছেলের ছেলে এই স্নেইডার। কেননা হিটলারের অন্য যারা বংশধর ছিল, ওর ভাগনে বা অন্যান্য সব আত্মীয়রা ওর পরিচয়ে এতটাই লজ্জিত ছিল যে তাদের কেউ না হওয়াটাই স্বাভাবিক!’

প্রিয়ম বলল, ‘কিন্তু, তুমি কী করে বুঝলে যে স্নেইডারই কালপ্রিট? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।’

রুদ্র বলল, ‘ব্লাস্টের সঙ্গে ওই নেগেটিভগুলোর সম্পর্ক আছে এটা বুঝতে পারার পরেই যেটা আমার মাথায় প্রথম এসেছিল সেটা হল, এইরকম সারা ইউরোপ জুড়ে ব্লাস্ট করানোর মতো নেটওয়ার্ক থাকা সিগফ্রেড বলে ওই একা নকল শ্যুমাখারের পক্ষে সম্ভব নয়, আর থাকলেও ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এক্ষেত্রে পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ইনফ্লুয়েনশিয়াল মাথা আছে, যে সামলাচ্ছে সব কিছু। আর হিটলারের লাকি নম্বর দুই সেটা অনুযায়ী ব্লাস্টগুলো ঘটছে এটা বের করার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম এমন কেউ আছে পেছনে যে নিউমেরোলজিতে খুব বিশ্বাস করে। সিগফ্রেডের সঙ্গে আমি বারদুয়েক দেখা করেছি, তাতে লোকটার ওইরকম কোনো বাতিক আমার চোখে পড়েনি। আজ স্নেইডারের টেবিলে বসে যখন কথা বলছিলাম তখন দেখছিলাম ওর দু—হাতে দুটো বিশাল আংটি, দুটোতেই দুই লেখা। ওর সামনে থাকা লেখার প্যাডটা একবার নিয়ে লিখছিলাম মনে আছে? সেখানেই দেখলাম হাজার আঁকিবুকির মাঝে একটা কবিতা লেখা, প্রথম লাইনটাই হল, কেইন স্লেচটেস ব্লাট ইন ইউরোপা। তখন মানে বুঝিনি, গাড়িতে ফেলিক্সের কথা থেকে মানেটা বুঝতে পারলাম। তারপরেও ঠিক ধরতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, সে তো উনি নিজেও ইনভেস্টিগেট করতে করতে অচেতনে লিখে ফেলতে পারেন। তারপর যখন শুনলাম কোলনের ব্লাস্টে মারা যাওয়া লোকটাও ওই একই কথা বলে গেছে, আর যেখানে সঙ্গে সঙ্গে টেম্পলহফে ফোর্স পাঠানো উচিত ছিল, সেখানে জিমি আর ফেলিক্স, দুজনকেই স্নেইডার ফোর্স পাঠাতে বারণ করে একদল নতুন গার্ড পাঠিয়েছেন, তখন হঠাৎ মনে হল, স্নেইডারই তো সবচেয়ে সুবিধার পজিশনে আছেন এইসব কাণ্ডগুলো ঘটানোর জন্য। আর সঙ্গে সঙ্গে ইভা ব্রাউনের সেই মাসির সারনেমটাও মনে পড়ে গিয়েছিল।’

প্রিয়ম চূপ করে ভাবছিল।

রুদ্র বলে চলছিল ‘তারপর অঙ্ক না পারলে যেমন ব্যাক ক্যালকুলেশন করতাম, সেইরকমই স্নেইডারকে দোষী ধরে নিয়েই পুরো জিনিসটা সাজাতে লাগলাম। দেখলাম উত্তরটা মিলে যাচ্ছে একদম। স্নেইডার কী পরিবেশে মানুষ হয়েছে সেটা তো জানি না, তবে সম্ভবত ছোটো থেকেই তার মাথায় এইসব ঢুকিয়েছিল কেউ। হিটলারের কোনো সিক্রেট ডায়েরিও থাকতে পারে, সেখান থেকে এইসব জেনে থাকতে পারে। হিটলার যে ওই মৌলর খোঁজ পেয়েছিল, সেটাও।’

প্রিয়ম বলল, ‘মানে এমনিতে ওই ব্যাকগ্রাউন্ডটা স্নেইডারের জানা ছিল। আর কাগজে ভাটনাজুকল থেকে পাওয়া নেগেটিভে হিটলারের ছবি পাওয়া যেতে বুঝে ফেলে যে ওটাই সেই মৌল!’

রুদ্র মাথা নাড়ল, নিজের মনেই বলল, ‘এত বড়ো পোস্টে চাকরি করে কী করে জানি না এই লোকটা দ্বিতীয় হিটলার হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। হিটলার যেমন যেকোনো উপায়ে ইহুদিদের শেষ করতে চেয়েছিল, এও তেমনই মিডল ইস্ট থেকে আসা সব রিফিউজিদের শেষ করে ইউরোপকে সুপারপাওয়ার করতে চেয়েছিল। কারুর থেকে হয়তো শুনেছিল হিটলার গ্যালটনের মৌলটা তৈরি করতে গিয়েও শেষমেষ পারেনি, মাসখানেক আগে ভাটনাজুকল থেকে উদ্ধার হওয়া ওই নেগেটিভগুলোর প্রথম ছবিতে হিটলার আর ভিক্টর ব্র্যাকের বর্ণনা শুনে ও আন্দাজ করেছিল ওটাই সেই খোয়া যাওয়া রিসার্চের প্রসেস। সত্যিই! জিন কী অদ্ভুত দ্যাখো! হিটলারের সেই শয়তান জিন কেমন তার পরবর্তী প্রজন্মে ফিরে এসেছে!’

প্রিয়ম স্বগতোক্তি করল, ‘ইউজেনিক্স!’

পাঁচটা বিশাল মাপের সিলিডার পড়ে আছে মাটিতে, তার পাশে শুয়ে কাতরাচ্ছে কয়েকটা লোক। রুদ্র ক্লান্ত শরীরে এগিয়ে গিয়ে ফেলিক্সকে বলল, ‘আগে সিলিন্ডারগুলোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। সাংঘাতিক পয়জনাস গ্যাস আছে কিন্তু ওর মধ্যে।’

ফেলিক্স মাথা নাড়ল।

রুদ্র বলল, ‘মোস্ট প্রোব্যাবলি সারিন গ্যাস। কোনো রং নেই, কোনো গন্ধ নেই, অথচ এতটাই বিষাক্ত যে নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢোকার দু মিনিটের মধ্যে মৃত্যু অবধারিত।’

জিমি বললেন, ‘কী করে বুঝলেন এটা সারিন গ্যাস?’

রুদ্র কাঁধ ঝাঁকাল, ‘এটাও আন্দাজ করছি। গন্ধ, রং কিছুই নেই, এটা বাতাসে ছড়িয়ে দিলে সামনের গেটে থাকা গার্ডটা কিছুই টের পেত না, অথচ দেখা যেত কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো ক্যাম্পটাই শ্মশান হয়ে গেছে। হিটলার নিজে সারিন গ্যাস বানিয়েও মানুষের ওপর প্রয়োগ করার সাহস ক্যাম্পগুলো ছাড়া কোথাও খুব একটা দেখায়নি, কিন্তু এই যুগের হিটলার সেটা করতে যাচ্ছিল আর একটু হলে।’

সবচেয়ে কাছে থাকা পুলিশ স্টেশন থেকে ফোর্স পাঠানোর জন্য জিমি উত্তেজিতভাবে ফোন করছিল। রুদ্র বলল, ‘ওই সিগফ্রেড লোকটাকেও দেখুন। সে নিজে হয়তো এতটা খারাপ নয়, ওকে ওর সৎ বাবা এই ড্রাগ নিয়ে ব্ল্যাকমেল করে এইসব করতে বাধ্য করত। ওকে নিয়ে যান।’ তারপর অস্ফুটে বলল, ‘দুই যমজ ভাই! একজন হল নামকরা ডাক্তার, আরেকজন কেমিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশুনো করলেও মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর সৎ বাবার সাহচর্যে হয়ে উঠল ড্রাগঅ্যাডিক্টেড ক্রিমিনাল! সত্যি! এক্ষেত্রেও সেই জিনই ভিলেন!’

প্রিয়ম হঠাৎ ছুটে গেল স্নেইডারের মৃতদেহের দিকে। খুঁজতে লাগল কিছু।

রুদ্র এগিয়ে গেল, এইসময় বডিতে হাত দেওয়া একদমই উচিত নয়, ‘কী খুঁজছ?’

প্রিয়ম উত্তর দিল না। মিনিটখানেক বাদে স্নেইডারের হাঁটু পর্যন্ত পামবুটের ভেতরের চেন থেকে বের করে আনল দুটো ছোটো এনভেলপ।

সে—দুটোর মধ্যে একটা এনভেলপ রুদ্রর সঙ্গে কয়েক রাত কাটিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সেই ছবিগুলো।

আরেকটায় রয়েছে সেই অরিজিন্যাল নেগেটিভগুলো।

রুদ্র চোখ কপালে তুলল, ‘আমার মনেই ছিল না প্রিয়ম। তালেগোলে এক্কেবারে ভুলে গিয়েছিলাম এগুলোর কথা!’ প্রিয়মের থেকে যত্ন করে ও সেই খাম দুটো হাতে নিল, ‘এখন থেকে মিউজিয়ামে থাকবে এ দুটো। সবাই দেখবে, আজ থেকে অতবছর আগে কী আশ্চর্য আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালটন সাহেব!’

এখানকার পুলিশ অবিশ্বাস্য লেভেলের প্রম্পট। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল পুলিশবাহিনী এসে ঘিরে ফেলল জায়গাটা, দুটো হেলিকপ্টার এসে টহল দিতে লাগল ওপরের আকাশটায়। আহত লোকগুলোকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল, মি স্নেইডারের বডিটা স্ট্রেচারে করে নিয়ে গিয়ে একটা পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নেওয়া হল।

স্নেইডারের দলের মোট সাত—আটজন গার্ডের ছদ্মবেশে ছিল, প্রত্যেকেই জিমি এমন ঘায়েল করেছে, যে তাদের ওঠার ক্ষমতাও নেই। তবু সেভাবেই তাদের টেনে—হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হল পুলিশ ভ্যানে।

চমকের তখনও একটু বাকি ছিল।

ম্যাক্স নামে সিকিউরিটি অফিসারটি একটু বাদেই একজন মহিলাকে নিয়ে এসে হাজির করলেন ওঁদের সামনে, ‘কাঁটাতারের পাঁচিল টপকে পালাচ্ছিল। আমার লোক ধরেছে। বলছে নাকি স্নেইডারের গার্লফ্রেন্ড।

রুদ্র আর প্রিয়ম দুজনেই চমকে উঠল বার্লিন আসার ট্রেনের সেই সোশিয়োলজির প্রোফেসর ইভাকে দেখে!

যদিও তাঁকে দেখে এখন চেনা দায়। সকালের সেই সুন্দর মেক—আপ—করা মুখ এখন ভ্যানিশ।

ছোট্ট ছোট্ট করে কাটা ঝাঁকড়া সোনালি চুল ছড়িয়ে আছে সারা মাথায়, চোখ টকটকে লাল, পরনে কালো জ্যাকেট আর নীল জিনস। রুদ্রকে দেখেই সে ঘৃণায় একদলা থুতু ছুড়ল, সঙ্গে অশ্রাব্য কিছু গালাগাল।

রুদ্র অস্ফুটে বলল, ‘এবার বুঝতে পারছ সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনে আমার পাসপোর্টটায় জল ফেলার চেষ্টা, ট্রেনের কামরা থেকে ছবিগুলো চুরি করা? স্নেইডারই সিগফ্রেডের কাছ থেকে আমার ছবিগুলো নিয়ে পালানোর কথা শুনে ইভাকে পাঠিয়েছিল।’ পরক্ষণেই ও চমকে উঠল, ‘কী সাংঘাতিক! এটাও মিলে গেল! হিটলারের মতো স্নেইডারেরও সঙ্গিনীর নাম ইভা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *