৩৩
সারাটা রাস্তা টেনশনে রুদ্র সুস্থির হয়ে বসতে পারছিল না, টেনশনে ছটফট করছিল। ফেডেরাল পুলিশের তরফ থেকে পটসড্যাম শহর থেকে ওদের বার্লিনে একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে জিমি আর আরেকজন ইনস্পেকটর, যার নাম ফেলিক্স। কাল ভোর হতেই ওদেরকে গাড়ি করে টেম্পলহফ নিয়ে চলে যাওয়া হবে, এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন অ্যান্টন স্নেইডার।
গাড়িতে উঠে প্রথমে রুদ্র কিছু না বললেও জিমি কথা শুরু করল, ‘আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না! ঈশ্বর করুন, কাল যেন ওদের পরিকল্পনা বানচাল করতে পারি।’
রুদ্র চুপ করে ছিল। জিমি কথা বলতে বলতেও মাঝে মাঝেই রুমাল দিয়ে চোখ দুটো মুছছিল।
রুদ্রর অনেক প্রশ্ন থাকলেও সেগুলো করতে পারছিল না। জিমির সঙ্গে কথা বলার অস্বস্তিটা রুদ্রর এখনও যায়নি। ওর চোখের দিকে তাকালেই নিজেকে খুব দোষী দোষী মনে হচ্ছে।
প্রিয়মই ওই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে রুদ্রকে বাঁচাল, ‘আপনি ডাক্তার দেখাননি?’
জিমি মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, দেখিয়েছিলাম। ড্রপ দিচ্ছি, কয়েকদিন সময় লাগবে সারতে। ও ঠিক আছে। আমাদের এসব লেগেই থাকে।’ পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল রুদ্রকে, ‘আচ্ছা, ওই সিগফ্রেড বলে লোকটা আপনাকে কিছু বলেছিল ওর সাঙ্গোপাঙ্গর ব্যাপারে?’
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ‘সিগফ্রেড কে?’
জিমি বলল, ‘ওহ! আপনাকে তো বলা হয়নি। ওই যে লন্ডনের ওই ডাক্তার সিগমুন্ড শ্যুমাখারের যমজ ভাই, সিগফ্রেড! যে আপনাকে প্রথম এসব বলেছিল। ওর কথা বলছি।’
রুদ্র আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ওই লোকটা অরিজিন্যাল ড শ্যুমাখারের যমজ ভাই! সেইজন্যই হুবহু এক দেখতে! শুধু চোখের মণির রং আলাদা। এইরকম হয় নাকি?’
জিমি মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। খুব রেয়ার, কিন্তু হয়। আমিও জানতাম না। এয়ারপোর্ট ডিটেইলসে অন্য নাম ছিল, ভুয়ো পাসপোর্ট। সব বাজেয়াপ্ত করেছি, ওই পাসপোর্ট নিয়ে কোনো এয়ারপোর্টে ঢুকলেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যারেস্ট করা হবে। আর আসল পরিচয়টা আজ সকালেই জেনেছি। ইন ফ্যাক্ট এই রিপোর্টটা দিতেই এসেছিলাম আজ স্যারকে, কিন্তু আপনারা এসে যাওয়ায় আর বলা হল না। ড শ্যুমাখার খাঁটি ভদ্রলোক, ওঁকে গিয়ে পরিচয় দিতেই সব বলে দিলেন। ওঁর বাবা মায়ের ছোটোবেলায় ডিভোর্স হয়ে যায়। ড শ্যুমাখার মানুষ হন বাবার কাছে, আর ওঁদের মা এই সিগফ্রেডকে নিয়ে আবার বিয়ে করেন। বার্লিন শহরেই ওঁর মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর বাড়ি ছিল, কিন্তু সেই স্বামীর ডিটেইলস উনি ঠিক বলতে পারলেন না। বললেন যমজ ভাইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই ওঁর। আমি খোঁজ চালাচ্ছি পুরো বার্লিনে। লন্ডন পুলিশকেও জানানো আছে।’
রুদ্র বলল, ‘লোকটা এখন কোথায়?’
জিমি কাঁধ ঝাঁকাল, ‘সেটাই তো আসল প্রশ্ন। লোকটা যেন হঠাৎ উবে গেছে কর্পূরের মতো। আপনার কথা অনুযায়ী আজ সকালে বার্লিন আসার ট্রেনে আপনার কাছ থেকে ওই ছবি চুরি ওর পক্ষে করা সম্ভব নয়, কারণ ওর পরিচয় জানার পর বার্লিন শুধু নয়, গোটা জার্মানির সমস্ত স্টেশনে, এয়ারপোর্টে আমি মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, কোথাও গেলেই ও সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়বে। তার মানে ওর দলের কেউ চুরিটা করেছে।’
রুদ্র বিড়বিড় করল, ‘আপনি বলছেন ওর কাছে ভুয়ো পাসপোর্ট আছে। এসব এখানে এত সহজে পাওয়া যায়?’
জিমি হাসল, ‘নিয়ম অনুযায়ী তো যায় না, কিন্তু নিয়মের বাইরে তো সব দেশেই সব কিছু হয়। নাহলে এত লোক জার্মানিতে লুকিয়ে ঢুকছে কী করে।’
রুদ্র বলল, ‘তাহলে ওর কাছে আরও কোনো জাল পাসপোর্ট থাকলে ছদ্মবেশেও তো এখানে চলে আসতে পারে!’
জিমি এবার একটু থেমে গেল, ‘তা পারে। খুব নিখুঁত ছদ্মবেশ থাকলে এয়ারপোর্টে পার পেলেও পেয়ে যেতে পারে।’
রুদ্র চিন্তা করছিল, ‘কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, একটা লোকের পক্ষে এতগুলো জায়গায় ব্লাস্ট করা সম্ভব নয়। ওর পেছনে কোনো দল আছে শুধু তাই নয়, ওর পেছনে অনেক বড়ো কোনো মাথা আছে।’
জিমি শুনতে পেয়ে বলল, ‘এগজ্যাক্টলি, আমারও তাই মত। এতদিন ফলো করলাম লোকটাকে লন্ডনে, কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ করতে দেখলাম না আপনাকে ছাড়া। এদিকে একের পর এক ব্লাস্ট হয়ে চলেছে সারা মহাদেশ জুড়ে। খুব স্ট্রং নেটওয়ার্ক মেইনটেইন করছে যেটা আমরা ধরতে পারছি না।’
রুদ্র বলল, ‘টেম্পলহফে কী ব্যবস্থা নিলেন?’
জিমি বলল, ‘আমি তো আজকেই ফোর্স পাঠাতে চাইছিলাম, কিন্তু স্যার বললেন কাল সকালেই একেবারে পাঠাতে। কাল ভোর ভোরই ওখানে ফেডেরাল পুলিশের বিশাল ফোর্স চলে যাবে।’
ফেলিক্স এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এইবার বলল, ‘আপনারা তো লন্ডন থেকে আসছেন। কিংস্টনের নিউজটা নিশ্চয়ই আরও ডিটেইলে পড়েছেন। কোলনের ব্লাস্টটার সময় যে কথাটা আততায়ীরা বলেছিল, সেরকম কিছু কি ওখানেও বলেছিল, জানেন কি?’
‘কী বলেছিল?’ রুদ্র প্রশ্ন করলো।
ফেলিক্স বলল, ‘ওই যে, কেইন স্লেচটেস ব্লাট ইন ইউরোপা!’
রুদ্র বলল, ‘মানে? এটা কি জার্মান ভাষা?’
ফেলিক্স মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। ইংরেজি করলে মানে দাঁড়ায় নো ব্যাড ব্লাড ইন ইউরোপ!’
রুদ্র বিস্মিত চোখে বলল, ‘ইউরোপে কোনো খারাপ রক্ত থাকবে না? এটার মানে কী?’
ফেলিক্স বলল, ‘এই কথাটা চিৎকার করে বলেই তো বোমাটা ছুড়েছিল কোলনে।’ বলতে বলতেই হঠাৎ ফোন ঢুকল ফেলিক্সের ফোনে, জার্মান ভাষায় কাউকে কিছু নির্দেশ দিয়ে ও ফোন রাখল, ‘টেম্পলহফের সিকিউরিটি অফিসার ফোন করেছিল। আশ্বস্ত করল কোনো চিন্তা নেই। স্নেইডার স্যার একটু আগেই একটা হাইলি এফিশিয়েন্ট সিকিউরিটি গার্ডের টিম পাঠিয়েছেন, যারা আজ ওভারনাইট গার্ড দেবে।’ কথাটা বলে ও জিমির দিকে তাকাল, ‘ওইজন্যই বোধ হয় স্যার তোমাকে কাল সকালে ফোর্স পাঠাতে বলেছেন। চিন্তার কিছু নেই।’
জিমি মাথা নাড়ল।
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ওই স্নেইডার স্যারই কি গোটা ফেডেরাল পুলিশের হেড?’
ফেলিক্স মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। অ্যান্টন স্নেইডার ফেডেরাল পুলিশের চিফ কমিশনার। মানে আমাদের সর্বময় কর্তা বলতে পারেন। ভীষণ এফিশিয়েন্ট, সঙ্গে আবার শখের কবি। মাঝে মাঝেই উনি কাজের ফাঁকে কবিতা লেখেন, সেগুলো আবার আমাদের পড়ে শোনানও।’ ফেলিক্স হাসল।
রুদ্র চুপ করে ছিল। ওর মাথায় হঠাৎ বিশাল যন্ত্রণা হচ্ছিল, দু—পাশের রগ দুটো এতটাই দপদপ করছিল, ও টিপে ধরল সেই জায়গা দুটো।
একটা ভুল হচ্ছে কোথাও। বিশাল কোনো ভুল।
ওকে চুপ করে যেতে দেখে প্রিয়ম গল্প জুড়ে দিল জিমি আর ফেলিক্সের সঙ্গে। দুজনেই তরুণ পুলিশ অফিসার। কালকের সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে দুজনেই এক্সাইটেড। জিমি জাপানের ছেলে নয়, তাইওয়ানের। কিন্তু এখানে তার বেড়ে ওঠা। ফেডেরাল পুলিশের ইনভেস্টিগেশন স্কোয়াডের সে একজন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট।
সিংহভাগ রাস্তা পেরিয়ে এসে ওদের গাড়ি যখন বার্লিন ঢুকে গেছে, রুদ্র হঠাৎ মুখ তুলল, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, কেমন একটা অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকিয়ে ও বলল, ‘টেম্পলহফের দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলুন, এক্ষুনি!’
জিমি কী—একটা কথায় হাসছিল, হঠাৎ এই কথায় অবাক হয়ে গিয়ে বলল, ‘টেম্পলহফ? এখন? কাল তো যাওয়ার কথা!’
রুদ্র চেচিয়ে উঠল, ‘না, এখুনি চলুন! শিগগিরই গাড়ি ঘোরাতে বলুন ওদিকে।’
ফেলিক্স আর জিম হকচকিয়ে গেলেও সামনে ঝুঁকে গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু একটা নির্দেশ দিল।
রুদ্র অস্থিরভাবে বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে?’
ফেলিক্স বলল, ‘বড়োজোর পাঁচ মিনিট। এই রাস্তাতেই পড়ে। আপনি ভালো সময়ে বলেছেন। কিন্তু, কী ব্যাপার বলুন তো? কাল সকালে গেলে হত না?’
রুদ্র বলল, ‘না! আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না।’