৩
সিগফ্রেড ঘরে এসে ভালো করে মুখচোখ ধুয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিল। গত কয়েকদিন সে টেনশনে ঘুমোতেই পারেনি, কিন্তু আজ একটু হলেও স্বস্তির বিশ্রাম নেবে।
অন্যবার লন্ডনে এলে ওর মনটা বেশ খুশি খুশি থাকে, অন্তত সাময়িক হলেও সারাক্ষণ নজরদারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু, এবারে সেটা আর হচ্ছে না। সারাক্ষণ একটা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
শুয়ে শুয়ে বিছানার একপাশে—পড়ে—থাকা রুকস্যাকটার একটা চেন খুলে হাতড়ে হাতড়ে সে একটা মানিব্যাগ বের করল, তারপর সেখান থেকে সিমটা বের করে ফোনে ঢুকিয়ে কানে দিল, ‘তুমি আমাকে প্লিজ আর দু—দিন টাইম দাও প্লিজ!’
ওপাশ থেকে একটা হিসহিসে গলা শোনা গেল, ‘ওয়ার্থলেস একটা! আর কত টাইম লাগাবে তুমি? তোমাকে কি আমি বলেছিলাম আগ বাড়িয়ে এইসব করতে? এমন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় একটা করে দিন যাওয়া মানে রিস্ক আরও বাড়ানো।’
সিগফ্রেড একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বুঝতে পারছি। আমি চেষ্টা তো করছি হার্ট অ্যান্ড সোল!’
ওপাশের গলাটা খিঁচিয়ে উঠল, ‘কীসের চেষ্টা? চেষ্টা করার জন্যও একটা মিনিমাম যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে। পইপই করে বলেছিলাম কেউ যেন তোমায় ট্রেস করতে না পারে, সেখানে এত তাড়াতাড়ি জিমি তোমায় খুঁজে পেয়ে গেল কী করে? তুমি কি ওখানে গিয়ে সারা শহর টো টো করে বেড়াচ্ছ নাকি? নাকি নিজের অরিজিন্যাল পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেছ বহাল তবিয়তে! এটা কেন বুঝতে পারছ না যে কান টানলে মাথা আসার মতো তোমাকে একটু কালটিভেট করলেই আমাকেও লিঙ্ক করে ফেলতে পারে জিমি!’
সিগফ্রেড বলল, ‘আমি সাবধানেই ছিলাম। জিমির সঙ্গে আমার হঠাৎ একদিন মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকেই পেছনে লেগেছে। এয়ারপোর্টের সিসিটিভি থেকে মুখ চিনেছে হয়তো। স্টুডিয়োয় কিন্তু পিটার ক্যামেরাটা আগেই ঢেকে দিয়েছিল।’
দাঁতে দাঁত চিপল ওপাশের গলা, ‘বাহ! কী সুন্দর এক্সকিউজ! এয়ারপোর্টে ঢোকার সময় কি মুখটা ভালো করে দেখিয়ে গিয়েছিলে যে একবার দেখেই চিনতে পেরে গেল?’
সিগফ্রেড আবার মিনমিন করল, ‘চিনতে যে পেরে গেছে আমি এখনও শিয়োর নই, তবে নজরে রাখছে এটা ঠিক।’ বলেই ও বলল, ‘আর তা ছাড়া তুমি কী করে শিয়োর হচ্ছ যে এটাই সেই ছবিগুলো? এটা তো অন্য কিছুও হতে পারে।’
‘তুমি দয়া করে তোমার ভোঁতা মগজটা এই ব্যাপারে লাগানো বন্ধ করো! ফ্রান্সিস গ্যালটনের সেই ফর্মূলাটাও এনকোড করা হয়েছিল প্রথমে, আমি নিজে পড়েছি দাদুর ডায়েরিতে। আর যে সেটা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল সেও আইসল্যান্ডেই গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে গিয়ে সে টিম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ গলাটা এবার আরও জোরে ধমক দিল, ‘তুমি কি আমাকে তোমার নিজের মতো ভাবো?’
সিগফ্রেড তড়িঘড়ি বলল, ‘আচ্ছা, বুঝলাম। আমাকে আর দু—দিন টাইম দাও, প্লিজ! আমি কেপেবল একজনকে পেয়েছি, সে একটু চেষ্টা করে দেখুক।’
‘কাকে? রিলায়েবল কি না দেখেছ?’ তিতিবিরক্ত ওপাশের গলা পরক্ষণেই সাবধানী।
সিগফ্রেড বলল, ‘হ্যাঁ। পুরোপুরি রিলায়েবল। আমি ক্রেডেবিলিটির জন্য ফেসবুকেও অ্যাড করেছি। তোমার ওই জিমিও সন্দেহ করতে পারবে না।’
‘ফেসবুক! এর মধ্যে আবার ফেসবুক এল কোথা থেকে! জিনিসটা তোমার কাছে আছে তো?’
সিগফ্রেড ঢোঁক গিলল। তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, আছে।’
‘মনে রেখো, এবারেও যদি কিছু গণ্ডগোল হয়, তোমার সব কিছু কিন্তু চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে!’ ওপাশ থেকে আবার গলা চড়ল।
সিগফ্রেড আঁতকে উঠল, ‘না না! দু—দিন সময় দাও, আমি প্রোগ্রেস দেখাতে পারব।’
ফোনটা ততক্ষণে পিঁ পিঁ শব্দ করে কেটে গেছে।
সিগফ্রেড ত্বরিত গতিতে সিমটা ফোন থেকে খুলল, তারপর প্রবল আক্রোশে পাশেই রাখা মানিব্যাগটা ছুড়ে মারল সামনের দেওয়ালে।
সব কিছুর একটা লিমিট আছে!
দিনের পর দিন ওরই প্রাপ্য সম্পত্তি দখল করে লোকটা ব্ল্যাকমেল করে চলেছে ওকে। সিগফ্রেড অতটা কড়া মনের নয়, মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে আপ্রাণ, কিন্তু ওর এই ভদ্রতাটাকে শয়তানটা দুর্বলতা ভেবে ফেলেছে এখন।
মাঝে মাঝে সিগফ্রেড ভাবে, একইসঙ্গে, একই মাতৃজঠরে জন্মেও কী করে দুটো মানুষের ভাগ্য সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটে!
এর পেছনে কি ওর বাবা মায়ের কোনো হাতই নেই, যারা ছোট্টবেলাতেই ওদের শৈশবটা একটা অনিশ্চিত আবর্তে ফেলে দিয়েছিল? দাদার ভাগ্য ভালো ছিল, সে মানুষ হয়েছে ভালো পরিবেশে, ভালো আবহে। আর সিগফ্রেড নিজে খারাপ কপাল নিয়ে জন্মেছিল, প্রতিভা থাকতেও সে কিছুই করতে পারল না, তার উপর এমন একজনের অভিভাবকত্বে তাকে ফেলে দেওয়া হল, যাতে তার সবটাই শেষ হয়ে গেল।
আর এখন তো সে একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া অধ্যায়, যাকে শুধুমাত্র দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে ক্রমাগত।
ভাবলেও ওর গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ওঠে যে ও একদিন ইতিহাস নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে পড়তে দেওয়া হয়নি। বদলে তাকে পড়তে হল কেমিস্ট্রি, সেটাও অবশ্য ওর মন্দ লাগত না।
কিন্তু শেষ করার আগেই ওর জীবনটা চিরকালের মতো অন্ধকারে তলিয়ে গেল।