নরক সংকেত – ২৯

২৯

বার্লিন স্টেশনের বাইরে থেকে পুলিশের গাড়িতে রুদ্র আর প্রিয়ম উঠেছে তাও প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল। রুপোলি রঙের উপর নীল শেডের বি এম ডব্লিউ গাড়িটা শহর পেরিয়ে একটা নদীর পাশ দিয়ে চলেছে ঝড়ের গতিতে। গাড়ির ওপরের উজ্জ্বল নীলচে আলো দুটো এই দিনের বেলাতেও জ্বলছে নিভছে। একটু আগে জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘ওয়েলকাম টু পটসড্যাম’ বোর্ডটা চোখে পড়েছে ওদের দুজনেরই। সামনে বসা পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এসে গেছি প্রায়। ফেডেরাল পুলিশের হেড কোয়ার্টার এখানেই।’

গাড়িতে উঠেই রুদ্র উত্তেজিতভাবে বলেছিল, ‘আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’

অফিসারটা গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, ‘আপনি চলুন, ম্যাডাম। কমিশনার স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

তারপর থেকে রুদ্র শান্তভাবে বসে থাকলেও প্রিয়ম ছটফট করছিল, ‘তোমার নাম এরা আগে থেকে কী করে জানল, রুদ্র? ওই শ্যুমাখারের ছদ্মনামে থাকা লোকটা উড়ো ফোন করে তোমার ওপর ছবি চুরির দায় চাপিয়ে দেয়নি তো? সেরকম কিছু হলে, তুমি কল্পনা করতে পারছ কী হবে? জেলে তো ঢুকবেই, আমার চাকরিটাও যাবে। এইসব দেশের আইনকানুন যে কতটা কড়া তুমি জানো! আমার ওয়ার্ক ভিসাও সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড করা হবে। একে আইটির এই রিসেশনের মার্কেট, তার উপর…উফ! আমি আর ভাবতে পারছি না।’

রুদ্র স্থিতধী মুনির মতো শান্তস্বরে বলেছিল, ‘ভাবার চেষ্টাও কোরো না। ওইরকম কিছু হলে আমাকে ওখানেই আরেস্ট করত। সেরকম কিছু করেনি যখন, বেকার এত চাপ নিয়ো না। দেখ গিয়ে হয়তো আমাদের জন্য গ্র্যান্ড রিসেপশন অপেক্ষা করছে।’

প্রিয়ম তবু শান্ত হতে পারেনি। সারাটা রাস্তা আর কোনো কথাও বলেনি রুদ্র, শুধু ফোনে ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজের মনেই বিড়বিড় করে গেছে অনবরত। মাঝে তো ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে কী লেখারও চেষ্টা করছিল, তারপর গাড়ির ঝাঁকুনিতে সেই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিল।

প্রিয়ম দু—একবার জিজ্ঞেস করতে শুধু বলেছে, ‘ইউজেনিক্স প্রিয়ম! সব শেষ হয়ে যাবে আরেকটু দেরি করলেই। ইস! আমি এত বোকা, এত দেরি করলাম বুঝতে?’

পটসড্যাম শহরের মধ্যে ঢুকে ওদের গাড়ি যখন ফেডেরাল পুলিশের হেডকোয়ার্টারে ঢুকল, তখন প্রায় বেলা এগারোটা।

ক্যাম্পাসে ঢুকে গাড়ির দরজা খুলতেই রুদ্রর মনে হল এক হাজারটা ঠান্ডা ছুঁচ এসে কেউ বিঁধিয়ে দিল ওর শরীরে। তবু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে যতটা সম্ভব নিজেকে ঢেকেঢুকে ও বেরোল। সামনের দিকে এগোতে যেতেই গাড়ির অফিসারটি বললেন, ‘ওদিকে না। আমার সঙ্গে আসুন।’

মিনিট পাঁচেক ধরে ওদের সর্বস্ব চেকিং হওয়ার পর যখন দোতলায় নিয়ে গিয়ে জার্মান ভাষায় ‘পুলিশ কমিশনার’ লেখা দরজা ঠেলে বিশাল ঘরটায় ওদের ঢোকানো হল, কমিশনারের দিকে তাকানোর আগেই তাঁর উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকা লোকটাকে দেখে রুদ্র হতভম্ব হয়ে গেল, বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল যেন।

উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকা ফেডেরাল পুলিশের ইউনিফর্ম পরা লোকটার দিকে তাকালেই সবচেয়ে আগে যেটা নজরে পড়ে সেটা হল ওর চোখ দুটো। চোখ দুটোর দিকে তাকালেই শিউরে উঠতে হয়, কোনো বিষাক্ত পোকা যেন কামড়ে দিয়েছে তাতে। টকটকে লাল হয়ে রয়েছে সে—দুটো, জল পড়ছে অনবরত। আর পুরো অংশটাই ফুলে ঠেলে উঠেছে অনেকটা।

লোকটা একটা রুমাল ধরে রয়েছে ডান হাতে, মাঝে মাঝেই সেটা দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছে তাকে।

রুদ্র লোকটার ইউনিফর্মটার দিকে একবার তাকাল, তারপর ফ্যাকাশে মুখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল একটা।

কমিশনার মি স্লেইডার ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন, ‘ভারতীয় মহিলারা সাহসী হয় জানা ছিল, কিন্তু এইরকম লঙ্কাগুঁড়ো পকেটে নিয়ে ঘোরে সত্যিই আমাদের ধারণারও বাইরে ছিল।’

রুদ্র কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। লন্ডনের ওই ফলো—করা জাপানি লোকটা, যার চোখে ও লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছিল, সে জার্মানির পুলিশ!

যে সে পুলিশও নয়, খোদ ফেডেরাল পুলিশের লোক।

রুদ্রর শাস্তি কী? জার্মানির জেলে সারাজীবন কারাদণ্ড? একঝলকের জন্য বাবা মায়ের মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

রুদ্র মিনমিন করে বলল, ‘আমি বুঝতেই পারিনি যে উনি..!

মি স্নেইডার ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন করমর্দনের জন্য, ‘আমরাও বুঝে উঠতে পারিনি যে আপনি কোন দলে, আমাদের বন্ধু না শত্রু! একদিকে ফটোগুলো নিয়ে পালিয়ে আসছেন, অন্যদিকে ছুটছেন ড শ্যুমাখারের ল্যাবে ভেরিফাই করতে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না আপনি কে, কার হয়ে কাজ করছেন, আর কেনই—বা করছেন! আমরা এতটাই কনফিউজড ছিলাম যে জিমিকে পাঠানো হল জানবার জন্য। তাতে ওর যা অবস্থা করলেন আপনি, সেটা তো আর না বলাই ভালো, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন!’

জিমি বলে পুলিশ অফিসারটা তার টকটকে লাল চোখ দিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই আগের মতোই পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ।

প্রিয়মের দিকে একঝলক তাকিয়ে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে।

রুদ্র সিঁটিয়ে গেল।

মারবে—টারবে না তো?

রুদ্রর একদম মুখোমুখি এসে লোকটা দাঁড়াল, এক মুহূর্ত থেমে পকেট থেকে হাতটা বের করল।

ওই হাত রুদ্রর মাথায় পড়লে ও ঠিক টু ডাইমেনশনাল ফিগার হয়ে যাবে।

লোকটা হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ওর সঙ্গে, জড়ানো ইংলিশে বলল, ‘ওয়েলকাম টু জার্মানি!’

কিছুক্ষণ বাদে একটু ধাতস্থ হয়ে বসে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে রুদ্র পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার করার চেষ্টা করছিল, ‘আমি লন্ডনে আমার হাজব্যান্ডের কাছে এসেছিলাম ঘুরতে। ড শ্যুমাখার আমার হাজব্যান্ডের মাধ্যমে আমার সঙ্গে আলাপ করেন, আমি ভূটানে একটা ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে একটু ইনভলভড ছিলাম, সেই সূত্র ধরে উনি আমাকে কয়েকটা ফটো দিয়ে বলেছিলেন এগুলো ওঁর দাদুর ডায়েরিতে পাওয়া গেছে, যাতে এমন একটা কেমিক্যাল এলিমেন্টের কথা বলা আছে, যেটা মানুষের দেহে প্রয়োগ করলে জিনটাকে এমনভাবে মডিফাই করবে যাতে ক্যান্সার চিরকালের মতো পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ছবিগুলোতে লেখাগুলো দেখে উনি কিছুই উদ্ধার করতে পারছেন না, তাই আমি যদি একটু সাহায্য করি! প্রথমে এইরকম একটা ভালো কাজ শুনে আগ্রহ দেখালেও আস্তে আস্তে আমি ওঁর কথার মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্য পেতে থাকি।’

মি স্নেইডার মন দিয়ে শুনছিলেন। ভেতরে ভেতরে তাঁর বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কীরকম অসামঞ্জস্য?’

রুদ্র বলল, ‘ওর চোখের মণিটা নীল অথচ আমি গুগলে কিছু ছবি দেখতে পাই, যেখানে ওর কালো রঙের মণিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওঁর ফেসবুক প্রোফাইলটাও ফেক, সেখানেও কোনো তথ্য নেই। উনি বলেছিলেন একশো বছর আগে ওঁর দাদু ভারতে বসে এই ছবিগুলো তুলেছিলেন, কিন্তু একশো বছরের পুরোনো ছবির মতো কন্ডিশন ওগুলোর ছিল না। অন্যদিকে বার্লিনের ক্যাসপার ফটোগ্রাফি থেকে ফটোচুরির খবরটা আমার চোখে পড়ে। আমি এটুকু বুঝতে পারি ড শ্যুমাখার সত্যি কথা বলছেন না।

মি স্নেইডার বললেন, ‘কারেক্ট! লোকটা গল্প ভালোই বানিয়েছিল। তারপর?’

রুদ্র একটু আড়ষ্টভাবে জিমি বলে জাপানি লোকটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘এরই মধ্যে উনি আমাকে ফলো করতে শুরু করলে আমি পাজলড হয়ে যাই, তারপর যখন দেখি ফটোর জন্য উনি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসেছেন, আমি একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম।’

মি স্নেইডার ভ্রূ দুটো বেশ খানিকটা ওপরে তুলে বললেন, ‘আপনি নার্ভাস হয়ে গিয়েই জিমিকে লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে ভাগিয়ে দিলেন? রেগে গেলে কী করেন?’

রুদ্র লজ্জায় অধোবদন হয়ে মাটির দিকে তাকাল।

মি স্নেইডার হেসে বললেন, ‘জাস্ট কিডিং! তবে আপনি তো একবার ওর বক্তব্যটা শুনতে পারতেন!’

রুদ্র মাথা নাড়ল।তিনি ঠিকই বলেছেন। সেদিন লোকটার বক্তব্যটা শোনা উচিত ছিল ওর।

‘যাই হোক, তারপর বলুন।’ মি স্নেইডার বললেন।

রুদ্র মিনমিন করে বলতে লাগল, ‘তার পরের দিন আমি ওঁর ক্লিনিকে গিয়ে বুঝতে পারি উনি আসলে ড শ্যুমাখারই নন, অন্য কেউ!’

মি স্নেইডার বললেন, ‘কী করে বুঝলেন?’

রুদ্র বলল, ‘ক্লিনিকের ড শ্যুমাখারের চোখের মণি দুটো কালো আর সবচেয়ে বড়ো কথা মুখের আশ্চর্য মিল থাকলেও উনি অনেক মোটা, বেশ ভুঁড়িও আছে। তার মধ্যেই আমি কাগজে পড়ি যে বার্লিনের একটা স্টুডিয়ো থেকে একটা পুরোনো নেগেটিভের বাক্স চুরি গেছে। ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি যে আমার কাছে থাকা ছবিগুলোর পেছনেও ওই একই স্টুডিয়োর হলোগ্রাম! আমি ঠিক করে ফেলি আমাকে বার্লিন যেতেই হবে। কারণ একদিকে ছবি নেওয়ার জন্য হামলা, অন্যদিকে ওই ড শ্যুমাখার পরিচয় দেওয়া লোকটা কে, এগুলো না জানা অবধি আমার শান্তি হচ্ছিল না। তাই আমি আর বেশি কিছু না ভেবে বার্লিনের জন্য বেরিয়ে পড়ি কাল রাতেই।’

মি স্নেইডার এবার তাঁর চেয়ারে হেলান দিলেন, ‘ম্যাডাম, আপনি তো আবার আমাকে কনফিউজ করে দিচ্ছেন। আপনিও যে এই চুরিতে জড়িত নেই সেটা আমরা বুঝব কী করে? ক্ল্যারিফাই করার জন্য জিমিকে পাঠানো হল, সেও ফেরত চলে এল ওই অবস্থায়। তার মধ্যেই খবর পেলাম আপনি বার্লিন আসছেন। এসে আবার পুলিশের সঙ্গেও দেখা করলেন।’

রুদ্র বলল, ‘আসলে এর মধ্যেই একদিন আমি ড শ্যুমাখারের সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে এটুকু বুঝতে পেরেছি ওই ছবিগুলোতে লেখা হরফগুলো আসলে একেকটা ইংরেজির অক্ষরকে সিগনিফাই করছে, যদিও সেই শব্দগুলোর কোনো মানে হয় না। আসলে তখন তো আমি ওঁর ফ্রেঞ্চ দাদুর ডায়েরি থেকে পাওয়া, সেটা ভেবেই এগোচ্ছিলাম, তাই ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজির সঙ্গে মিল না পাওয়ায় একটু কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। ওই খবরটা পড়ে বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলে জার্মান ভাষায় লেখা। এদিকে উনি এমনভাবে চাইছিলেন…!’

মি স্নেইডার হঠাৎ সোজা হয়ে বসেছেন, রুদ্রর দিকে চেয়ে অবিশ্বাস্য চোখে বললেন, ‘আপনি ওই ছবিগুলোর মানে বুঝতে পেরেছেন?’

রুদ্র এবার অধৈর্য হয়ে উঠল, ‘শুধু মানে বুঝতে পেরেছি তাই নয়, এর পেছনে যে কত বড়ো চক্রান্ত চলছে সেটা বুঝতে পেরেই আমি বার্লিন স্টেশনে পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। আপনারা জানেন কি না জানি না সময় কিন্তু বেশি নেই! আর একটুও দেরি করলে এমন একটা সন্ত্রাস হতে চলেছে যার মতো ভয়াবহ বিস্ফোরণ পৃথিবী খুব বেশি দেখেনি।’

মি স্নেইডার চমকে উঠে বললেন, ‘কীসের ব্লাস্ট?’

রুদ্র এইবার রেগে উঠল, আপনাদের তো তা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। তখন থেকে আমি কেন চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়েছি তা নিয়ে বকে চলেছেন।’

মি স্নেইডার এইবার একটু থমকে গেলেন, ত্বরিতে পাশের লোকটাকে কিছু একটা বললেন জার্মান ভাষায়, সঙ্গেসঙ্গে সে বেরিয়ে গেল বাইরে। আর ওই লাল চোখের জিমি নামের জাপানিটাও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

প্রিয়ম ফিসফিস করল রুদ্রর কানের কাছে এসে, ‘তুমি পুলিশ কমিশনারকে এরকমভাবে ধমকাচ্ছ, আমাদের অ্যারেস্ট করবে না তো? আমার চাকরিটা কিন্তু শিয়োর শট যাবেই তাহলে!’

রুদ্র চোখ কুঁচকে এক ঝলক প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে নিয়েই মি স্নেইডারের চোখে চোখ রাখল, ‘আপনি কি মনে করছেন এটা সামান্য একটা অ্যান্টিক চুরি? মোটেই না! সারা পৃথিবী পালটে যেতে পারে এই কয়েকটা ছবি দিয়ে, ইনফ্যাক্ট সেই চেষ্টাই করে চলেছে কিছু মানুষ!’

মি স্নেইডার বললেন, ‘আপনি একটু খুলে বলবেন, প্লিজ?’

রুদ্র এবার বলল, ‘শুনুন, এই ব্যাপারটা শুধু আজকের নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতীতের জার্মানির এক কলঙ্কময় অধ্যায়। হিটলারের নাতসি পার্টির অধীনে থাকা জার্মানি।’

মি স্নেইডার তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে একবার জিমির দিকে তাকালেন, তারপর রুদ্রর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললেন, ‘হিটলার! সেটা কি প্রথম ছবি যেটার ব্যাপারে কাগজে বেরিয়েছিল, সেটা দেখে ইনফার করছেন?’

রুদ্র বলল, ‘একদম নয়।’ চকিতে ফোনটা বের করে একটা ছবি খুলল সে, ‘আমি নোটিশ করেছি, ওই লোকটা আমাকে যে দশটা ছবি দিয়েছিল, প্রত্যেকটাই তোলা হয়েছে হিটলারের সময়ের সরকারি রাইটিং প্যাড থেকে, এই দেখুন, নীচের এই চিহ্ন দুটো দেখতে পাচ্ছেন?’ ওই জায়গাটা জুম করে সবাইকে দেখাল ও।

এটা কী চিহ্ন

স্নেইডার বললেন, ‘এটা কী চিহ্ন?’

রুদ্র বলল, ‘বলছি। আগে আমাকে একটা কাগজ দিন।’

স্নেইডার তড়িঘড়ি একটা কাগজ দিতেই রুদ্র বিশাল আঁকিবুকি কাটাতে শুরু করল তাতে।

দুটো ডায়াগ্রাম

‘ভালো করে বুঝুন। এই দুটো ডায়াগ্রামের প্রতিটা ঘরে দুটো করে অক্ষর রয়েছে। এই খোপগুলো দিয়ে অক্ষরগুলোকে বোঝানো হচ্ছে, বুঝতে পারছেন? মানে, A মানে হল A টা যে খোপে রয়েছে সেই খোপের আকারটা, অর্থাৎ’ রুদ্র আবার আঁকল।

রুদ্র আবার আঁকল

‘এই একই নিয়মে,’ ও পরপর লিখে চলল।

কটা হরফ

স্নেইডার সরু চোখে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। মিনিট দুয়েক বাদে বললেন, ‘আপনি যে—কটা হরফ লিখলেন, প্রত্যেকটাই নিজের খোপের এক নম্বর হরফ। দ্বিতীয় হরফগুলোর জন্য কীরকম সংকেত হবে?’

রুদ্র হাসল, ‘আমার বলা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। প্রতিটা খোপের দ্বিতীয় হরফের জন্য ওই খোপটাই হবে, শুধু ভেতরে একটা ফুটকি।’

ও আবার আঁকতে লাগল।

এই হল হিটলারের সেই ক্রিপটোগ্রাফির মানে

রুদ্র লেখা শেষ করে হাসল, ‘এই হল হিটলারের সেই ক্রিপটোগ্রাফির মানে।’

ততক্ষণে স্নেইডার শুধু নয় প্রিয়ম, জিমি আর ফেলিক্সও হুমড়ি খেয়ে দেখছে ওর ডিসাইফার করা।

প্রিয়ম এতক্ষণ বাদে ফিসফিস করল, ‘পিগপেন সাইফার! ইস, আমার মাথার আগেই আসা উচিত ছিল। এটা আমি অনেকদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম।’

রুদ্র হাসল, ‘একদম ঠিক! সত্যি তোমার এটা বের করা উচিত ছিল প্রিয়ম, তাহলে আমাকে এত পিডিএফ পড়ে পড়ে মাথা খারাপ করতে হত না। এই ক্রিপটোগ্রাফিটার নাম পিগপেন সাইফার। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সময় এটা ভীষণভাবে ব্যবহার করা হত বলে অনেকে এটাকে নেপোলিয়ন সাইফারও বলে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে এই কোড।’ ও স্নেইডারের দিকে তাকাল, ‘হিটলারের ওই নাতসি পিরিয়ডে কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খুব ক্রিপটোগ্রাফি ব্যবহার করা হত, জানেন নিশ্চয়ই? তো, এটা যে পিগপেন সাইফার কোডে লেখা, এটা বোঝার পরেই আমি নীচের লোগোটাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করি। ওখানে দেখি লেখা রয়েছে, ‘রুদ্র আবার আঁকল,

ডাবল এইচ

‘আর এই ডাবল এইচটা বলতে যে সেই সময় হেইল হিটলার কথাটা বোঝানো হত, প্রতিটা সরকারি নথিপথে এই উক্তিটা থাকত, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই আমার চেয়েও ভালো জানেন।’

কমিশনারের বিরাট ঘরটা একদম চুপ।

প্রিয়ম বলল, ‘হেল হিটলার? মানে?

রুদ্র বলল, ‘হেল নয়, হেইল। জার্মান ভাষায় হিটলারের জয়! নাতসি সময়ে এটাই ছিল স্যালুটের ধরন। অনেকটা আমাদের জয় বাবা লোকনাথ টাইপ আর কি! তবে, ‘সত্যিই হেল হিটলার! গোটা পৃথিবীটাকেই নরক করে তোলার ষড়যন্ত্র করে ফেলেছিল!’ ও নিশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *