নরক সংকেত – ২২

২২

মি স্নেইডার আজকেও তাঁর কেবিনে বসে কবিতা লেখার চেষ্টা করছিলেন। যখন মাথায় প্রচুর চিন্তা এসে জড়ো হয়, উপরমহল থেকে ক্রমাগত তাগাদা আসতে থাকে প্রোগ্রেস জানিয়ে রিপোর্ট করার জন্য, তখন তাঁর কবিতা লেখার শখও বেশি বেশি করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, এটা তিনি আগেও লক্ষ করেছেন। তবে, আশ্চর্যজনকভাবে এই কবিতার লাইনগুলো মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তাগুলোর জটও একে একে খুলতে থাকে।

যেমন আজ তাঁর অনেকদিন বাদে খুব মনে পড়েছিল সিমোনের কথা, মনে হচ্ছিল সিমোনকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে। যদিও আজ প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে সিমোন ওঁকে ছেড়ে চলে গেছে, তবু স্নেইডার তাঁকে ভুলতে পারেননি একদিনের জন্যও। সিমোন তার আগের পক্ষের সন্তানকে নিয়ে তাঁর কাছে যেদিন একবস্ত্রে চলে এসেছিল, সেইদিন থেকে ওর চলে যাওয়ার দিন, সবটুকু ওঁর মাথায় একটা সুন্দর সিনেমার মতো ধরা আছে। এতদিন পরেও তা একটুও ফিকে হয়নি।

তারপর থেকে স্নেইডার আর বিয়েও করেননি। যদিও সঙ্গিনী হিসেবে আছে একজন তাঁর জীবনে, তবু সেভাবে বলতে গেলে একা মানুষ তিনি একাই থাকেন, কাজ আর কবিতা নিয়েই আছেন। একেকটা কবিতা তিনি অনেকদিন ধরে লেখেন, প্রচুর পরিশ্রম আর এতটাই উচ্চমার্গের চিন্তাভাবনা মেশানো থাকে তাতে, সাধারণ মানুষ তো দূর, বার্লিনের তাবড় তাবড় পত্রিকার এডিটররাও সেগুলোর গূঢ় অর্থ বুঝতে না পেরে বাতিল করে দেন।

তবে তা নিয়ে স্নেইডারের বিশেষ খেদ নেই। বলতে গেলে ফেডেরাল পুলিশ তাঁর বর্তমান স্ত্রী আর কবিতা তাঁর প্রেমিকা। ফলে স্ত্রীর প্রতি তিনি কর্তব্যে যেমন ত্রুটি রাখেন না, তেমনই প্রেমিকার প্রতি একতরফা প্রেম নিবেদনেও।

আজ না হোক, একদিন মানুষ তাঁর প্রতিভা বুঝতে পারবেই, এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

প্রথম দুটো লাইন লিখে ফেলেই বেশ খুশি হলেন স্নেইডার, আজকের মতো যথেষ্ট সাহিত্যচর্চা হয়ে গেছে। যেকোনো সৃষ্টির শুরুটাই আসল, সেটা যখন হয়ে গেছে, আর চিন্তা নেই। এই কবিতাটা এখন তিনি প্রায় ছয় মাস ধরে লিখে চলবেন।

তৃপ্ত মনে তিনি তাঁর ফাউন্টেন পেনের সোনালি নিবটা বন্ধ করলেন। এই ডিজিটাল যুগেও তিনি কাগজ কলমেই লেখেন, আর এই পেন দিয়ে না লিখলে ঠিক কাব্য আসে না।

কাজে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটা কথা মনে হল। ফেলিক্সের পাঠানো সব ফোল্ডারগুলো একে একে ল্যাপটপে খুললেন তিনি। এগুলো সব তাঁর নিজস্ব বায়োমেট্রিক আইডি দিয়ে প্রোটেকটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে এই ল্যাপটপ ওপেন করা হয়, আর তারপর প্রতিটা ফোল্ডার খোলার জন্য ফেস রেকগনিশন সফটওয়ার গ্রিন সিগনাল দিলে তবেই এই ফোল্ডারগুলো খোলে।

ফেলিক্স ছেলেটা এমনিতে একটু বেশি প্রশ্ন করে বটে, তবে কাজের আছে। প্রতিটা বিস্ফোরণের ডিটেইলড রিপোর্ট পাঠিয়েছে, সঙ্গে ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি। তিনি নিজগুণে ফেডেরাল পুলিশের এত উপরে উঠলেও আজও তিনি টেকনিক্যালি অতটা সড়োগড়ো নন, খাতায়—কলমে কাজ করাই পছন্দ তাঁর। সেইরকমই নির্দেশ দেওয়া আছে তাঁর জুনিয়রদের। আর তাই, এইগুলো ছাড়াও ফেলিক্স একটা বড়ো সিনপসিস পাঠিয়েছে হাতে লিখে।

ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি আগে ওই লেখাটাই পড়তে লাগলেন মন দিয়ে।

১। ইসলিংটন, ইংল্যান্ড—গত মাসের ২ তারিখ সকাল ৯.৩০—এ ব্লুমসবেরি কমপ্লেক্সে একটা বোমা ফেটে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ব্লুমসবেরি কমপ্লেক্সটা ইসলিংটন মিউনিসিপ্যালিটি সিরিয়ান রিফিউজিদের থাকার বাসস্থান হিসেবে অ্যালোকেট করেছিল প্রায় তিন বছর আগে। গোটা বাড়িটায় প্রায় পঞ্চাশজন শরণার্থী থাকে, কিন্তু মৃত পাঁচজনই এরিট্রিয়া বলে একটা আফ্রিকান দেশের নাগরিক, যারা বেআইনিভাবে বসবাস করছিল ওখানে। তাদের ঘরে কোনো বৈধ কাগজপত্র বা পাসপোর্টও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পেরেছে, ওই কমপ্লেক্সেরই একটা সিরিয়ান রিফিউজি গোপনে তার ঘরটা ভাড়া দিয়েছিল এদের।

২। কাভালা, গ্রিস—গত মাসের ১১ তারিখ বিকেল ৫.১৫—তে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সরাসরি গুলি করা হয় দুজন সিরিয়ান শরণার্থীকে। এরা মাত্র পাঁচমাস আগে লিবিয়া থেকে এসেছিল গ্রিসে। বৈধ ইমিগ্রেশন করিয়েই থাকছিল কাভালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়েই ভিড় বাজারের মধ্যে আচমকা গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারা, কিন্তু হত্যাকারীকে এখনও অবধি ধরা যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজনদের স্কেচ আঁকিয়ে তদন্ত চলছে।

৩। প্যারিস, ফ্রান্স—গত মাসের ২০ তারিখ প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের টিকিট কাউন্টারের কিছু দূরে একটা দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেলে বোমা ফেটে মারা যায় তিনজন স্কুলপড়ুয়া, তারা প্রত্যেকেই আফগানিস্তানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। লণ্ডনে পড়াশুনো করত, ছুটিতে প্যারিস বেড়াতে গিয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সাইকেলের মালিককে গ্রেফতার করা হলেও সে নিজে বোমা রাখেনি, সাইকেলটা রেখে সে নিজেই আইফেল টাওয়ারে উঠেছিল। সেইসময়ে যে এসে বোমাটা আটকেছে, সে টুপি পরে থাকায় এখনও ধরা সম্ভব হয়নি।

৪। কিংস্টন, ইংল্যান্ড—এই মাসের ২ তারিখ রাত ১০.৩০ নাগাদ দুজন ভারতীয় ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয় নির্জন রাজপথে। এক্ষেত্রেও আততায়ী অধরা, তদন্ত চলছে।

৫। কোলন, জার্মানি—চারদিন আগে, জার্মানির কোলন শহরে কোলন ক্যাথিড্রালের সামনে একটা চলন্ত বাইকে বোমা ছুড়ে দেয় কেউ, বাইকআরোহী দুজনই সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী, সামনের জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়, আর পিছনের জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেও মারা যায় দু—দিন বাদে।

লেখাটা এই পর্যন্তই। মি স্লেইডার ল্যাপটপে তাকিয়ে দেখলেন, ফেলিক্স কোলনের ওই বাইকের পেছনে বসা ব্যক্তিটির জবানবন্দির ভিডিয়োটাও দিয়ে গেছে।

সেটা খুললেন তিনি। হসপিটালের বেডে শুয়েই বেচারা যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছে। তার পুরো বাঁ—দিকের অংশটাই ব্যান্ডেজ করা, পাঁজরের বাঁ—দিকের অংশে গভীর ক্ষত। স্বভাবকবি স্নেইডারের সেটা দেখতে দেখতে মনটা ভিজে উঠল। তিনি একটু আবেগপ্রবণ। এই লোকটা দিব্যি জ্যান্ত অবস্থায় কথা বলছে পুলিশের সঙ্গে বেচারা সে জানেও না আর দু—দিন বাদেই তার স্থান হবে মর্গে!

কী দরকার ছিল এই বিদেশে এসে বেচারার বেঘোরে প্রাণটা হারানোর? ওদের দেশে থাকলে কি এইরকমই কিছু হত লোকটার?

লোকটা এত অস্ফুট গলায় কথা বলছিল, ভলিউমটা সর্বোচ্চ করে দিয়েও তিনি কিছু শুনতে পেলেন না। বাধ্য হয়ে ভিডিয়োটা বন্ধ করে ফেলিক্সের রিপোর্টটা খুললেন। সেটার মধ্যে পুরোটাই লেখা আছে। লোকটা অনেক কষ্টে যেটুকু বলতে পেরেছে সেটা হল ও বাইকের পেছনে বসে ছিল, সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ওর বাঁদিকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়, ও অতটা লক্ষ করেনি, তবে সেটা সাদা রঙের গাড়ি ছিল, আর গাড়িটার সামনে দু—জন বসে ছিল, সেটা ও খেয়াল করেছিল। সিগনাল গ্রিন হতে বাইকটা চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ওর যে বন্ধু বাইক চালাচ্ছিল, তার পিঠে বাঁ—দিক থেকে কিছু একটা এসে পড়তে দ্যাখে, সঙ্গেসঙ্গেই সেটা ফেটে যায়, বীভৎস আগুনের ঝলকানিতে ও জ্ঞান হারায়। তবে, এক মুহূর্তের জন্য ও বাঁ—দিক থেকে ভেসে আসা একটা চিৎকার শুনেছিল, ‘কেইন স্লেচটেস ব্লাট ইন ইউরোপা!’

স্নেইডারের ভ্রূ কুঁচকে গেল। এটা একটা জার্মান বাক্য।

তিনি একটু ঝুঁকে তাঁর প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন করলেন একটা। কিছুক্ষণ কথা বলে বেল টিপে ফেলিক্সকে ডাকতে যাবেন, তার আগেই ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। অপারেটরের ফোন, জিমি এসেছে, দেখা করতে আসছে স্নেইডারের সঙ্গে।

স্নেইডার সোজা হয়ে বসলেন। জিমি দু—দিন আগে শেষ রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে এটুকু বোঝা গিয়েছিল ও অনেকদূরই এগিয়েছে। এখন আর কী বলে দেখা যাক।

ফেডেরাল পুলিশ যে ক—জন স্পাইকে আউটসোর্স হিসেবে রেখেছে, তাদের মধ্যে জিমি অন্যতম এফিশিয়েন্ট এজেন্ট। তাইওয়ানের ছেলে, তুখোড় রিফ্লেক্স।

স্নেইডার চিবুকে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন, হঠাৎ জিমির দিকে চোখ পড়তেই শিউরে উঠলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *