২১
সিগফ্রেড মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক, ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। একে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে খুব সতর্কতার সঙ্গে, তারপর এত বড়ো বিপদ! এবার তো যত গালাগালিই খাক, ওদিকে জানাতেই হবে ব্যাপারটা, হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে।
একবার ও ভাবল, ও—ও কি প্যারিস চলে যাবে? কিন্তু যদি সেখানে গিয়েও কোনো হদিশ না পায়? আর আগুপিছু না ভেবে ও ফোন করে ফেলল, ‘বলছি, একটা মুশকিল হয়েছে।’
‘কী মুশকিল? আবার কী পাকালে তুমি?’ হিসহিস করে উঠল ওপাশের গলা।
সিগফ্রেড একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ‘যাকে দিয়েছিলাম ছবিগুলো, সে সেগুলো নিয়ে প্যারিস চলে গেছে হঠাৎ, কেন বুঝতে পারছি না।’
ওপাশে কিছুক্ষণ কোনো আওয়াজ নেই।
সিগফ্রেড তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, মানে যাকে দিয়েছিলাম সে এমনি হার্মফুল নয়, মানে এই ব্যাপারটাই সে জানে না, আমি অন্য একটা গল্প ফেঁদে…।’
ওদিক থেকে কিছুক্ষণ দুরন্ত স্রোতের মতো চোখাচোখা বাক্যবর্ষণ চলল, ‘তুমি কি ইয়ার্কি মারছ ওখানে বসে? নাকি সবাইকে নিজের মতো পাঁঠা ভাবো? তোমাকে কবে শেষ করে দিতাম, শুধু তোমার মায়ের কথা ভেবে কন্ট্রোল করি নিজেকে!’
সিগফ্রেড বলল, ‘না, অনেকটা সলভ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ এসে দেখি…!’
‘তোমায় কে বলল প্যারিস গেছে? লোকেশন ট্র্যাক করিয়েছে?’
‘না, মানে ওদের সিকিউরিটি…!’
‘ক্যালাস একটা! ফোন নম্বর দাও কুইক! লোকেশন ট্র্যাক করিয়ে যে করে হোক ওদের খোঁজ পেতে হবে!’
‘না, আমি ফোন করেছিলাম। ওদের দুজনের ফোনই সুইচড অফ।’
‘তুমি দাও অত কথা না বলে!’ গর্জে উঠল ওপাশের গলা।
মিনিট দশের বাদে ফোনটা দেখে সিগফ্রেড কী করবে প্রথমে বুঝতে পারল না, এইরকমভাবে যে ছবিগুলো হাতছাড়া হতে পারে, সেটা ওর মাথাতেই আসেনি। উফ! বিশ্বাসযোগ্যতা দেখানোর জন্য কত পড়াশুনো করল ও, তবু ধরা পড়ে গেল?
হঠাৎ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা অন্য কথা মনে পড়ে গেল ওর। ছোটো থেকেই ইতিহাস, বিশেষ করে ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষের পুরাণের প্রতি ওর ভীষণ আকর্ষণ ছিল। কেমিষ্ট্রি নিয়ে পড়ার সময়েও অনলাইনে ও হিন্দু মাইথোলজি নিয়ে পড়াশুনো করত। তখনই পড়েছিল, মনু স্মৃতি, ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এইরকম বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রচুর ধরনের নরকের উল্লেখ রয়েছে। কী অপরাধ করলে কোন নরকে যাবে, সেখানে কী ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হবে, সেইভাবে একেকটা স্তর আলাদা করা ছিল। তার মধ্যে একটা স্তরে কাকোলা বলে একটা বিষের কথা উল্লেখ ছিল, যেটা অপরাধীদের খাওয়ানো হত, সেই বিষ খেলে জন্ম জন্ম ধরে নরকেই থাকতে হত তাদের, কোনোভাবেই কোনো জন্মেই আর মুক্তি মিলত না।
ওর হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীর যে মানুষগুলোকে তাদের নিজেদের অজান্তেই অতিমানবে পরিণত করে ফেলা হবে, তারাও কি এই কাকোলার মতোই কোনো বিষ পান করবে না? ঈশ্বরপ্রদত্ত দোষ গুণ, স্বাভাবিকত্ব লুপ্ত হয়ে যে যান্ত্রিক সুপিরিয়রিটি জাগ্রত হবে তাদের মধ্যে এবং চলতে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, সেটাও কি নরকবাসের থেকে কম কিছু?
এক লহমার জন্য ওর মনে হল, ছবিগুলো বোধ হয় হারিয়ে যাওয়াই ভালো।
যেমন হারিয়ে ছিল এত যুগ ধরে!
কিন্তু, যার এত স্ট্রং ইনফ্লুয়েন্স, সে কি হাল ছেড়ে দেবে? নাকি, সারা পৃথিবীটাকেই কিছুদিনের মধ্যে নরকের দুটো স্তরে পরিণত করবে! একটা স্তরে অতিমানব, অন্যটায় অবমানব।
আচ্ছা, হিন্দু মাইথোলজি অনুযায়ী যদি সত্যিই নরক বলে কিছু থেকে থাকে, তবে ওই শয়তানটা নরকের কোন স্তরে যাবে?
শয়তানটার দাদুটাই—বা এখন কোন নরকে রয়েছে?