২০
অগাস্ট ১৯৩৩
ফ্রিৎজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন, কিছুটা এসেই আবার পেছনে ফিরতে হল টুপিটা নিতে ভুলে গেছেন বলে। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখেন স্ত্রী সোফি বাড়ির পোশাকেই হন্তদন্ত হয়ে টুপিটা হাতে নিয়ে আসছেন।
ফ্রিৎজ হেসে ফেললেন, ‘আমি তো যাচ্ছিলামই। তুমি আবার বেরিয়ে এলে কেন?’
সোফি বললেন, ‘টুপিটা দেখেই এমিলিয়া এমন কান্নাকাটি শুরু করল। ভেবেছে বুঝি বাবা এখনও বাড়িতেই আছে।’
ফ্রিৎজ আর সোফির মেয়ে এমিলিয়া এখন দেড় বছরের। ওইটুকু একটা তুলোর মতো শরীর, পুতুলের মতো নীল চোখে সে ফ্রিৎজের দিকে যখন তাকায়, এত ডামাডোলের মধ্যেও ফ্রিৎজের মনে হয় জীবনে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই পাওয়ার নেই। কোলে নিলে ওইটুকু নরম মাটির মতো শরীরটা যখন আঁকুপাঁকু করে তাঁর বুকে মাথা ঘষে, পা দুটো দিয়ে বেয়ে উঠতে চায়, মুখ দিয়ে বিজাতীয় সব শব্দ করে তার বাবাকে আদর করে, ফ্রিৎজের মনে হয় তিনি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বস্তুত মেয়ে হওয়ার পর থেকে ফ্রিৎজ যেন বেশ ভীতু হয়ে পড়ছেন, আগের মতো একরোখা, জেদি, অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটু ইতস্তত করছেন।
সারাক্ষণ তাঁর মনে একটাই চিন্তা, এমিলিয়া কোনো কষ্ট পাবে না তো জীবনে?
সন্তানের আনন্দে যেমন বাবা মা আত্মহারা হয়ে যান, সন্তানের দুঃখেও তাঁরা অস্থির হয়ে ছটফট করেন, মরেও যেন শান্তি পান না। এমিলিয়ার জন্যই জার্মানিকে বাঁচাবার এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে তাঁকে, ফ্রিৎজ মনে মনে ভাবলেন।
ফ্রিৎজকে চুপ করে কী ভাবতে দেখে সোফি বললেন, ‘কী ভাবছ?’ তারপর একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, ‘তুমি বেরোনোর পরই একটা লোক এসেছিল, তোমার অফিসের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিল।’
ফ্রিৎজ একটু অবাক হয়ে গেলেন। নাতসি পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ওঁর ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজ উঠে গেছে, প্রায় প্রতিদিনই পার্টির লোকেরা এসে ইটপাথর ছুড়ত, শেষের দিকে তো একটু বেশিই সাহস বেড়ে গিয়েছিল, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে পড়ত। পুলিশে জানাতে গেছিলেন ফ্রিৎজ, তখন সেই পুলিশ অফিসার একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘চ্যান্সেলর যে এখনও আপনার কাগজটাকে নিষিদ্ধ করে দেননি, বা আপনাকে অ্যারেস্ট করেননি, এটাই কি যথেষ্ট নয় মি ফ্রিৎজ?’
কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই ‘স্ট্রেট পাথ’কে ব্যান করে দেওয়া হয়। ফ্রিৎজকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল, কিন্তু তারপর মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, এটা আশ্চর্যের বিষয় বই কী! হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ফ্রিৎজের বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের।
তবে জেল থেকে মুক্তি পেলেও সব ব্যাপারে সরকারি তরফে হ্যারাসমেন্ট কমেনি একবিন্দুও। নিত্যদিনের ওই অত্যাচারে বাধ্য হয়েই বড়োরাস্তার উপরের ওই অফিস ছেড়ে মাসখানেক হল বাড়ির কাছেই একটা ছোটো ঘর ভাড়া করে অফিস শিফট করেছেন ফ্রিৎজ। নিজের কাগজ বেরোয় না ঠিকই, তবু অন্য কাগজে বেনামে লেখা পাঠান ফ্রিৎজ। তার কিছু ছাপা হয়, বেশিরভাগই সরকারবিরোধী বলে বাতিলের ঝুড়িতে চলে যায়। ভাগ্যক্রমে পৈতৃক সম্পত্তির সুবাদে মাথার উপর ছাদটা আছে ফ্রিৎজের তবু নিজের সন্তানের মতো আস্তে আস্তে বড়ো করে তোলা কাগজটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখ কুরে কুরে খায় তাঁকে।
একটা ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ, জার্মানি এখন ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে, যেকোনো মুহূর্তে সেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করবে সবাইকে। ভার্সাইয়ের সন্ধির শর্তগুলোকে এক কথায় বলতে গেলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হিটলার সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে চলেছে, যে পার্টি ভিন্নমত পোষণ করছে, রাতারাতি সেই পার্টির বৈধতাই বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। হিটলারের ক্রমাগত উসকানিমূলক বক্তৃতায় স্পষ্টই ইহুদিরা একঘরে হয়ে পড়ছে গোটা দেশে, সর্বক্ষণ তারা একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এভাবে আর কতদিন?
মন সারাক্ষণ বিষণ্ণতায় মোড়া থাকে ফ্রিৎজের, তবু কলমের ধার কমাননি তিনি এক ফোঁটাও। যতদিন দেহে একবিন্দু অবধি রক্ত আছে ততদিন লিখে যাবেন নিরপেক্ষভাবে।
ফ্রিৎজ সোফির হাত থেকে টুপিটা নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও। আর ঠিকানাটা বলেছ কি?’
সোফি একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘বলল আগে কাজ করত তোমার অফিসে, তাই বলে দিলাম। নাম বলল ফ্রেডরিক। দ্যাখো এতক্ষণে হয়তো পৌঁছেও গেছে তোমার ওই অফিসে। বড়োরাস্তা ধরে গেল তো, তাই বোধ হয় তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।’
ফ্রিৎজের মনে পড়ে গেল ফ্রেডরিক ছেলেটাকে। বেশিদিনের কথা তো নয়। চার পাঁচ মাস আগে কাগজ সরকারি আদেশে বন্ধ হওয়ার আগে আগেই ওকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছিলেন ফ্রিৎজ। কর্মীসংখ্যা কমাতে হচ্ছিল তখন, কোনো উপায় ছিল না।
কিন্তু ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান ছিল। আর পাঁচটা শ্রমিকের মতো কলের পুতুল না হয়ে নিজস্ব যুক্তিবোধও ছিল একটা। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই ফ্রিৎজের কাছে এসে বসত, জানতে চাইত দেশের অবস্থা, এটা কেন, ওটা কী, প্রশ্ন করত।
ওর তিন মাসের মাইনে বাকি ছিল, সেটার জন্য এসেছে কি? তাহলে বেশ বিপদেই পড়ে যাবেন ফ্রিৎজ। এখন বলতে গেলে জমানো টাকা তুলে তুলেই সংসার চালাতে হচ্ছে ফ্রিৎজকে। তাঁর যা সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বলে বলে দেশের প্রথম সারির কাগজের অফিসে ঢুকতে পারতেন, কিন্তু খোদ চ্যান্সেলরের রোষানল যার দিকে পড়েছে, তাকে কোন কাগজ চাকরি দেবে? টুকটাক ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যা লেখেন তাতে রোজগার খুবই সামান্য। তাছাড়া জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে, মানুষের রোজগার সেই অনুপাতে তো আর বাড়ছে না। কাগজ কিনে পড়াটা এখন সাধারণ মানুষের কাছে বিলাসিতা।
গলিপথ দিয়ে নিজের অফিসে এসে ঢুকতেই ফ্রিৎজ ফ্রেডরিককে দেখতে পেয়ে গেলেন, বসার ঘরের একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে। চেহারাটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে ছেলেটার, যদিও চোখের দৃষ্টি একইরকম বুদ্ধিদীপ্ত।
ফ্রিৎজ এগিয়ে গিয়ে ফ্রেডরিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে করমর্দন করলেন, ‘আরে ইয়ং বয়, কী খবর? কেমন আছ তুমি?’
ফ্রেডরিক অল্প হাসল, ‘ভালো স্যার। আপনার লেখা রেগুলার পড়ি, খুব ভালো লাগে। আমারও মনে কতরকম চিন্তা আসে, কিন্তু আপনার মতো তো লেখার ক্ষমতা নেই। তাই লিখতে পারি না, মনেই রেখে দিই।’
ফ্রিৎজ হাসলেন, কাগজ যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হল, সেদিন ফ্রেডরিক এসেছিল। ছদ্মনামে লিখতে শুরু করার আইডিয়াটা ওর সঙ্গেই প্রথম শেয়ার করেছিলেন ফ্রিৎজ।
তিনি বললেন, ‘বোসো। কী করছ এখন?’
ফ্রেডরিক বলল, ‘একটা প্রেসে কাজ করছি এখন, স্যার। বিজ্ঞাপনের লিফলেট, হ্যান্ডবিল এইসব ছাপায়। চলে যাচ্ছে মোটামুটি।’
ফ্রিৎজ বললেন, ‘বাহ! খুব ভালো।’ তারপর একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘তোমার মাইনেটা বাকি আছে ফ্রেডরিক, আমার মনে আছে। তুমি যদি আর তিন—চার মাস বাদে একবার আসতে পারো’
ফ্রেডরিক এবার তাড়াতাড়ি বলল, ‘স্যার, আমি ওইজন্য আসিনি। আমি একটা অন্য কারণে এসেছি আপনার কাছে। খুব গোপন একটা ব্যাপারে।’
ফ্রিৎজ এবার বললেন, ‘কী বলো তো?’
ফ্রেডরিক এবার একটু এদিক—ওদিক দেখে নিল। অবশ্য দেখবার তেমন কিছু নেই, ছোট্ট একফালি ঘর। ঘরের মাঝখানে ফ্রিৎজ স্যারের লেখার টেবিল, চেয়ার, একপাশে দুটো বইয়ের আলমারি। দরজার মুখে বসে রয়েছে একটা বুড়ো মতো লোক, সম্ভবত এই পুরো বিল্ডিংটার পাহারাদার।
ফ্রিৎজ বুঝতে পেরে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। এই ঘরটা ছোটো হলেও এর ছাদটা ভারি সুন্দর। শীতের সময় পুরোটাই বরফে ঢেকে যায়, শুধু চিমনিগুলো মুখ বার করে চেয়ে থাকে ল্যাম্পপোস্টের মতো। সোফি বলেছিলেন, কাগজ যখন বন্ধই হয়ে গেল, তখন আর অন্য ঘর নেওয়া কেন, বাড়িতে বসেই লেখো, ফ্রিৎজ রাজি হননি। সাংসারিক আবহে, দৈনন্দিন জীবনযাপনের মাঝে তাঁর লেখা আসে না, সমাজের দগদগে ঘা হতে যাওয়া ছোটো ফোঁড়াগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পারেন না তিনি।
তাঁর লেখার জন্য যত ছোটোই হোক, একটা আলাদা ঘর চাই।
ছাদে এসে ফ্রিৎজ একটা চুরুট ধরালেন, ফ্রেডরিকের দিকে একটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, ফ্রেডরিক?’
ফ্রেডরিক মাথা নাড়ল। ও তামাক খায় না, গন্ধ লাগে। ও বলল, ‘স্যার, খুব সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে জার্মানিতে। আমার এক বন্ধু আছে নাতসি পার্টির উঁচু পোস্টে, তার কাছ থেকে জানতে পেরেছি।’
ফ্রিৎজ এবার ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘কী? হিটলার যুদ্ধ ঘোষণা করতে চলেছে শিগগিরই?’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিৎজ ভাবলেন, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে, তবু সেই অভিশাপ থেকে এখনও মুক্তি পায়নি জার্মানি, যুদ্ধপরবর্তী সমস্ত রোগে এখন ধুঁকছে গোটা দেশ। এর মধ্যেই ওই বিকৃত শয়তানটা আবার যুদ্ধ চাইছে?
এবার যুদ্ধ শুরু হলে সারা পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে আর?
ফ্রেডরিক ওঁর চিন্তায় বাধা দিল, ‘না স্যার। যুদ্ধ নয়। তার চেয়েও ভয়ংকর। অনেক, অনেক ভয়ংকর।’
ফ্রিৎজ এবার আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কী?’
ফ্রেডরিক এবার ঢোঁক গিলল। গত তিনদিন ধরে মনের মধ্যে নিজের সঙ্গেই নিজের দ্বন্দ্ব চালিয়ে যাচ্ছে সে। কী করা উচিত, কী না করা উচিত। অনেক ভেবেচিন্তে সে ফ্রিৎজ স্যারের কাছে আসাই ঠিক মনে করেছে।
ওর জন্মদিনের দিন ভিক্টর এসেছিল কেক নিয়ে। ভিক্টর শুধু যে ওর নিজের পাড়ার একদম ছোটোবেলার বন্ধু তা—ই নয়, একইসঙ্গে ওরা দুজনে হাইস্কুল শেষ করে চলে এসেছিল বার্লিনে। একটা ছোট্ট একফালি ঘর, তাতে দুটো উপরনীচে বার্থ, এভাবেই থাকত দুজন। ওদের গলায় গলায় বন্ধুত্ব দেখে অনেকেই তখন ভুল করত ওদের ভাই ভেবে।
অথচ এত বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও দুজনের মানসিকতা বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই বিপরীত মেরুতে হাঁটতে শুরু করেছিল। ভিক্টর প্রথম থেকেই দুটো ব্যাপারে খুব স্পষ্ট ছিল, ও বার্লিনে টাকা কামাতে এসেছে, আর এইজন্য যা করতে হতে পারে তাই করতে ও রাজি আছে। কিন্তু ফ্রেডরিক সেরকম পারত না। ও বইপত্র নিয়ে থাকতে ভালোবাসত। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা টাকা দিয়ে ও একটা প্রেসের অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করতে ঢুকেছিল। আর ভিক্টর প্রথমে কিছুদিন এদিক—ওদিক চেষ্টাচরিত্র করে একসময় ঢুকে পড়ল নাতসি পার্টিতে।
তখন অবশ্য কেউ ভাবতেই পারেনি নাতসি পার্টি দেশ শাসন করবে একদিন। ভিক্টর বরাবরই চালাক, উনিশশো তিরিশের ভোটে নাতসি পার্টি বেশ বড়োসড়ো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেই ভিক্টরও প্রায় উল্কার গতিতে দলে উঠতে শুরু করল পার্টির মই বেয়ে। ওর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দুজনের বন্ধুত্বটাও ফিকে হতে শুরু করেছিল।
তবে মতের অমিল থাকলেও তাতে একেবারে ভাঁটা পড়ে যায়নি। ফ্রেডরিক বিয়ার, পুরোনো রাস্পবেরির জুস আর লেবুর রস নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে একটা ককটেল বানাতে পারে যেটা ভিক্টরের খুব প্রিয়। একটু তিতকুটে আর ঝাল, কিন্তু নেশা হয় মারাত্মক, তার রেশও থাকে বেশ কিছুক্ষণ। যত কাজ, যত ব্যস্ততাই থাক, বার্লিনে এলে ওই ককটেল খাওয়ার জন্য পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ভিক্টর ভোলে না।
সেদিন রাতে প্রায় চার বোতলেরও বেশি খেয়ে ফেলেছিল ভিক্টর। এতটাই নেশা হয়ে গিয়েছিল, ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছিল না, কিন্তু ঘুমোতেও যাচ্ছিল না। ফ্রেডরিকের ওই ছোটো খাটে একটানা বসে থেকে বিড়বিড় করে চলেছিল ও।
প্রথমে ফ্রেডরিক বিশেষ পাত্তা দেয়নি, জোর করে বন্ধুকে শোয়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তারপর ভিক্টরের মুখ থেকে কয়েকটা ছাড়া ছাড়া শব্দ, বিশেষ করে হিটলার, সুপার জিন, ইউজেনিক্স এই কয়েকটা শব্দ শুনে ওর কৌতূহল হয়। আর একবার জিজ্ঞাসা করতেই নেশার ঘোরে সব কথা হড়হড় করে উগরে ফেলেছিল ভিক্টর।
ফ্রেডরিক একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, হিটলার চাইছেন পুরো জার্মান জাতিকে এমন একটা ওষুধ খাওয়াতে, যেটা তাদের পুরো জিনটাকেই পালটে একটা অতিমানবে পরিণত করবে। কোনোরকম ডিফেক্ট থাকবে না বা এমন কিছু বিষয় যাতে তারা দুর্বল হবে। শুধু তারা নয়, তাদের উত্তরসূরিরাও তেমনই হবে। সুপারম্যান টাইপ।’
ফ্রিৎজ এতক্ষণের উদবেগের পর এইবার হেসে ফেললেন। ফ্রেডরিক ছেলেটা একেবারে ছেলেমানুষ!
নিজের পেশার জন্য দেশবিদেশের নানা পত্রপত্রিকা সংগ্রহে রাখতে হয় ফ্রিৎজকে। বেশ কিছুদিন আগে তেমনই একটা সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনে জেরি সিয়েগেল নামের এক আমেরিকান ভদ্রলোকের লেখা গল্প পড়েছিলেন সুপারম্যান নামে এক অতিমানবের কাণ্ড নিয়ে প্লটের অভিনবত্বে খুব শোরগোল ফেলেছিল গল্পটা। নাম ছিল ‘সুপারম্যানের রাজত্ব।’
ফ্রেডরিক নির্ঘাত ওই ম্যাগাজিনটা কোনোভাবে হাতে পেয়েছে। আর নয়তো, আমাদের খ্যাপা চ্যান্সেলরেরই ওই কমিকস সিরিজটা পড়ে মাথায় এই নতুন ভূত চেপেছে, মনে মনে ভাবলেন ফ্রিৎজ। বললেন, ‘কোথা থেকে পেলে ম্যাগাজিনটা? লাইব্রেরি?’
ফ্রেডরিক এবার অবাক হল, ‘ম্যাগাজিন! কী ম্যাগাজিন?’
ফ্রিৎজ বললেন, ‘ওই যেখানে সুপারম্যান নিয়ে লেখা গল্পটা পড়েছ! সব দিক থেকে শক্তিশালী একজন সুপারহিরো, নাম সুপারম্যান!’
ফ্রেডরিক এবার বিস্মিতভাবে মাথা নাড়ল, ‘স্যার, আপনি বুঝতেই পারছেন না আমি কী বলছি! সুপারম্যান কোনো গল্প নয়, সুপারম্যান মানে অতিমানব। আমাদের সবাইকে হিটলার কিছু একটা ওষুধ খাওয়াবে, যাতে আমরা সব দিক থেকে শ্রেষ্ঠ হই, আর তারপর ইহুদিদের সব্বাইকে মেরে ফেলা হবে। শুধু ইহুদিরাই নয়, জার্মানি ছাড়া কোনো দেশকেই বাঁচিয়ে রাখবে না হিটলার!’
ফ্রিৎজ এইবার আর হাসি চাপতে পারলেন না, হিটলারের পাগলামি এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে? আজগুবি কল্পনার একটা সীমা আছে।
ফ্রেডরিক হাল ছাড়ল না। এমনিতে নানা কারণে ও খুব বিভ্রান্ত। ও হঠাৎ বলল, ‘স্যার, আপনি হাসছেন? ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের নাম শুনেছেন? ইউজেনিক্সের জনক বলা হয় ওঁকে।’