১৯
সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনে ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেকিং মিটে গেল কিছুক্ষণ বাদেই। রুদ্রর আগে থেকেই ফ্রান্সের ভিসা করানো ছিল বলে জার্মানি যেতে কোনো বাধা নেই। এখানকার নিয়ম হল একটা দেশের ভিসা করানো থাকলেই ইউরোপের অনেকগুলো দেশে যাওয়া যায়। এটাকে বলে শেনজেন ভিসা, সমস্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য। শুধু ইংল্যান্ডের জন্য আলাদা ভিসা লাগে।
ওরা দুজনে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছিল ওদের ট্রেনের। এতক্ষণ পরপর এত কিছু ঘটে গেল, কেউই আর কোনো কথা বলছিল না।
রুদ্রই প্রথম নীরবতা ভাঙল, ‘আজ সকালে তুমি অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর একটা লোক আমার কাছে ছবিগুলো হাতাতে এসেছিল।’
প্রিয়ম উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল দূরে। আনমনে বলল, ‘কোন লোক?’
রুদ্র বলল, ‘একটা জাপানি লোক। সঙ্গে একটা বিশাল বাইক। লোকটাকে আমি কাল মাদাম তুসোর উলটোদিকের ওই কফিশপটায় বসে থাকতে দেখেছিলাম, তারপর আমরা বেরোনোর পর দেখেছিলাম, আর আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময়ে বাইক নিয়ে দেখেছিলাম। আজ সকালে এসে ও ওই সিকিউরিটি জনের সঙ্গে কথা বলছিল। লিফটে করে ওপরে এসে পৌঁছোনোর আগেই আমি নেমে যাই, কিন্তু মাঝপথে আমায় ধরে ফেলে ঠিক।’
প্রিয়ম এবার ভ্রূ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘তারপর?’
রুদ্র ফোনটা বের করল, ‘বলছি। আগে এই ছবিটা দ্যাখো তো।’
প্রিয়ম একঝলক দেখেই বলল, ‘এটা তো কাল রাতেই দ্যাখালে। ড শ্যুমাখার রানি এলিজাবেথের থেকে প্রাইজ নিচ্ছেন। এসব ছাড়ো, ওই লোকটা কে সেটা বলো।’
রুদ্র ফটোটাকে জুম করল, ‘ভালো করে ড শ্যুমাখারকে লক্ষ করো তো!’
প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘দেখলাম তো! কালো রঙের সুট, হাতে একটা বেশ দামি ঘড়ি, পায়ে কালো শু, চোখে রিমলেস…।’
রুদ্র একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, ধীরে ধীরে বলল, ‘চোখ দুটো লক্ষ করেছ?’
প্রিয়ম ছবিটাকে আরও জুম করতে গেল, কিন্তু আর হল না, ‘চোখ? হ্যাঁ, দেখছি তো। চোখে আবার কী পেলে তুমি?’
রুদ্র এবার বলল, ‘মণির রংটা দেখেছ?’
প্রিয়ম আরও একবার ছবিটা নিয়ে দেখে ওর দিকে তাকাল, ‘মণির রং যা হয় তাই, কালো।’ পরক্ষণেই ও অবাক হয়ে বলল, ‘ওয়েট ওয়েট! ড শ্যুমাখারের চোখের মণিটা নীলচে না?’
রুদ্র বলল, ‘কারেক্ট! নীলচে নয়, পুরোপুরি নীল রঙের মণি ভদ্রলোকের। আর সেইজন্য কাল থেকে এই ছবিটা দেখলেই আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে সেটা আমার ইনটিউইশন বলছিল।’
প্রিয়ম ততক্ষণে যে ওয়েবপেজে ওই ছবিটা ছিল, তাতে ঢুকে ওই অনুষ্ঠানের বাকি ছবিগুলো দেখতে শুরু করেছে। একটা ছবিতে ড শ্যুমাখারের ক্লোজ আপ ছবি নেওয়া হয়েছে, কৃতিত্বের হাসি হাসছেন উনি। সেখানেও তাঁর মিশমিশে কালো মণিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ও একটু কনফিউজড হয়ে গিয়ে বলল, ‘কেসটা কী বলো তো? লেন্স ইউজ করেছে?’
রুদ্র কাধ ঝাঁকাল, ‘যদি লেন্স ইউজ করে থাকে, তবে কোনটা ওর চোখের আসল রং, নীল না কালো?’
প্রিয়ম এবার আর কোনো উত্তর দিতে পারল না।
রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা, এবার আরেকটা কথা বলো, কাগজের ফোটোগ্রাফ যদি কেউ কোনো কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভ ছাড়া সাধারণ ডায়েরির মধ্যে রেখে দেয়, সেটা কতদিন থাকতে পারে?’
প্রিয়ম বলল, ‘সেটা কী করে বলব?’
রুদ্র খাবারের প্যাকেটটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা স্যান্ডউইচ বের করে আনল, সেটায় এক কামড় বসিয়ে বলল, ‘বলতে পারবে না, না? আচ্ছা, বিয়ের পর যখন প্রথম তোমাদের কল্যাণীর বাড়িতে গিয়ে ছিলাম কিছুদিন, তোমার বাবা—মায়ের বিয়ের ফটোগুলো দেখেছিলাম মনে আছে? তোমার মা—ই বের করে দেখিয়েছিলেন।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অর্ধেকই নষ্ট হয়ে গেছে, ওরা ঠিকমতো অ্যালবামেও রাখেনি প্রথম থেকে, কেমন সাদা সাদা স্পট ছেয়ে গেছে বেশিরভাগ ফটোতেই, অনেকদিন হল তো!’
রুদ্র বলল, ‘হুঁ। কতদিন হল তোমার বাবা মা—র বিয়ে হয়েছে যেন?’
প্রিয়ম বলল, ‘প্রায় ত্রিশ বছর। কেন?’
রুদ্র বলল, ‘ত্রিশ বছরে যদি ফটোর ওই দশা হয়, তাও একভাবে আলমারির মধ্যে থেকে, তবে প্রায় একশো বছর আগের ছবি, তার ওপর ইন্ডিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এত দেশ ঘুরেছে, সেগুলোর তো ওই সাদা স্পটে পুরো ফটোটাই ঢেকে যাওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, ফটোর পেপারটাও ড্যামেজড হয়ে ছিঁড়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ড শ্যুমাখারের দাদুর ডায়েরির ভাঁজে রেখে যাওয়া ওই দশটা ফটো কিছুই হয়নি, একদম অবিকৃত রয়েছে। ফটোপেপারটাও সাদা হয়নি, নেতিয়ে যায়নি একটুও, শুধু কোনাগুলো হালকা মোড়ানো, সেই ভাঁজটাও দেখে মনে হচ্ছে টাটকা। যেন আমি সন্দেহ করতে পারি বলে দেওয়ার আগে ইচ্ছে করে কোণগুলো মোচড়ানো হয়েছে।’
‘আমাকে একটা দাও তো, খাই। বড্ড খিদে পেয়েছে।’ প্রিয়ম এবার রুদ্রর হাত থেকে স্যান্ডউইচটা নিয়ে একটা কামড় দিল, ‘এটা কিন্তু একটা ভালো পয়েন্ট ধরেছ তুমি, আমার মাথাতেও আসেনি। সত্যিই তো, অত বছরের পুরোনো ছবি এখনও এমন ইনট্যাক্ট থাকে কী করে?’
রুদ্র বলল, ‘হুঁ। সকালে যে লোকটা এসেছিল, তাকে আমি আগের দিন দেখেছিলাম আমাদের ফলো করতে, তাই কাল সকালেও যখন দেখলাম জনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, তারপর আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছে, আমি ভেবেছিলাম এ সেই দলের লোক, যারা ডেসপারেটলি ড শ্যুমাখারের ওই রিসার্চটা পণ্ড করতে চায়, যেকোনোভাবে ওই ফটোগুলো হাতানোই ওর উদ্দেশ্য। তাই আমি আর রিস্ক নিইনি। ওকে আসতে দেখেই আমিও ফটোগুলো নিয়ে লিফট দিয়ে নীচে নেমে যাই। তখন এতটাই পাজলড হয়ে গেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কাছ থেকে যদি ফটোগুলো ছিনিয়ে নেয়, আমি মুখ দেখাব কী করে, সেই সময়েই হঠাৎ ড শ্যুমাখারকে ফোন করে ফেলি। ঠিক করেছিলাম ওঁর সঙ্গে দেখা করে ফটোগুলো হ্যান্ডওভার করে দেব, কী দরকার শুধু শুধু রিস্ক নিয়ে! কিন্তু মাঝপথেই লোকটা ঢুকে এল লিফটের মধ্যে।’
প্রিয়ম চুপচাপ শুনছিল, রুদ্র থামার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তারপর?’
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হুড়মুড়িয়ে কিছু একটা ওর ওপরে পড়ল, ও ছিটকে উঠে এল চেয়ার থেকে। ওর সারা গা ভিজে গেছে, ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠেছে প্রিয়মও।
ওরা দুজনে কথা বলছিল প্ল্যাটফর্মের ওপর এয়ারপোর্টের কায়দায় সাজানো সার সার চেয়ারে বসে। লোকজন এমনিতেই কম, তার ওপরে এই প্ল্যাটফর্মটায় কোনো ট্রেন নেই, তাই এত রাতে একদমই ফাঁকা চারদিক। ওদের নিজেদের ট্রেন এখনও দেয়নি ডিসপ্লে বোর্ডে। তারই মধ্যে ওদের ঠিক পেছনের চেয়ারটায় কেউ একটা বিশাল বড়ো লাগেজ রেখে চলে গেছে, ওরা খেয়াল করেনি। সেই লাগেজের একদম ওপরের পকেটে থাকা একটা জলের বোতলের ছিপি খুলে গেছে হঠাৎ, মুহূর্তে ছিপি খুলে বোতলের সবটুকু জল পড়েছে রুদ্রর কাঁধে। এই ঠান্ডায় এত কনকনে জল গায়ে পড়ার থেকেও এতটাই আচমকা ঘটল ঘটনাটা, ওরা কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গেল।
প্রিয়মই প্রথম কথা বলল, ‘ওয়াশরুমে চলো শিগগিরই! কে রেখে গেছে এরকম কেয়ারলেসভাবে? পাসপোর্টটার কিছু হয়নি তো?’
তাই তো রুদ্র খেয়ালই করেনি, পাসপোর্টটা তো হাতেই ধরে বসে ছিল ও, তাকিয়ে দেখল কোনাগুলো ভিজে গেছে অল্প, ঠিক সময়ে ও সরে গেছে বলে বেশিরভাগ জলটাই ওর ঘাড়ে পড়েছে, ঘাড় বেয়ে পিঠের দিকে গিয়ে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে, সপসপ করছে ওর পুলওভারের ভেতরের থার্মালটা।
ও বলল, ‘কার বলো তো লাগেজটা?’
প্রিয়ম বলল, ‘কী জানি! কাউকে তো এদিকে আসতে দেখিনি! তুমি আগে চলো ওয়াশরুমে। এই ঠান্ডায় ভিজে গায়ে থাকলে এক্ষুনি সর্দি হবে তোমার। ভাগ্যিস বোতলটা খুলে গেছিল, অত ভারী স্টিলের জলভরতি বোতল মাথায় পড়লে তো আরেক কেলেঙ্কারি হত। চলো চলো।’
কিন্তু ওয়াশরুম অবধি আর যাওয়া হল না। তার আগেই ওদের ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর দিয়ে দিল ডিসপ্লে বোর্ডে। প্রিয়ম তবু বলল, ‘চলো, ওয়াশরুম ঘুরে তারপর যাব। তুমি রুকস্যাক থেকে একটা এক্সট্রা জামা বের করো।’
কিন্তু রুদ্র রাজি হল না, ‘দরকার নেই। লন্ডন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে চাই। তেমন হলে ট্রেনে উঠে চেঞ্জ করব না হয়।’
ওরা ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্তও ওই বিশাল লাগেজের মালিকের দেখা পাওয়া গেল না। সেন্ট প্যানক্রাস খুব বড়ো স্টেশন। এ—মাথা থেকে ও—মাথা হাঁটতে হল যতক্ষণ ধরে, ততক্ষণে ঠান্ডা জল ভেতরে ঢুকে রুদ্রর কাঁপুনি লাগতে শুরু করেছে।
গলার কাছটাও ব্যথা করতে শুরু করেছে কেমন।
ট্রেনে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে অস্ফুটে একটাই কথা ও বিড়বিড় করল, ‘জলের বোতল খুলে পড়তেই পারে, কিন্তু এই ঠান্ডায় এত কনকনে জল কে নিয়ে বেরোয়!’
শেষমুহূর্তে টিকিট কাটার জন্য বেশ চড়া দাম দিয়ে টিকিট কাটতে হয়েছে ওদের, এখানে ট্রেনের টিকিটের দামও প্লেনের মতো বাড়ে কমে। তবে, বার্থ ভালোই পেয়েছে ওরা, একটাই ক্যুপের মধ্যে দুজন। জার্মানি এখান থেকে লাগবে প্রায় দশ ঘণ্টা। মাঝে ব্রাসেলসে পালটাতে হবে ট্রেন। তার মানে, রুদ্র মনে মনে হিসাব করল কাল সকাল দশটার আগে ট্রেন বার্লিন ঢুকবে না।
ওয়াশরুম থেকে জামা পালটে এসে ও দেখল, প্রিয়ম খাবারগুলো সামনের ছোট্ট টেবিলের ওপর সাজিয়ে ফেলেছে।
রুদ্র দরজাটা ভাল করে লক করে এসে ওর হাতব্যাগটা খুলল, একটা লুকোনো চেন খুলে বের করে আনল ফটোর খামটা।
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা, তুমি যে দুমদাম করে আমায় বের করে দিয়ে এলে, আমার যদি শেনজেন ভিসা করানো না থাকত? তবে তুমি একাই চলে যেতে?’
রুদ্র মুচকি হাসল, ‘তুমি তো আগের মাসেই বলেছিলে ফ্রান্সের ভিসা করিয়ে রেখেছ, আমার সঙ্গে প্যারিস যাবে বলে। পরে তো তোমার এই অফিসের কাজটা পড়ে গেল।’
প্রিয়ম কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল, ‘মনেও রাখতে পারো তুমি! যাই হোক, লোকটা কে, সেটা বলো এবার।’
রুদ্র সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা বলল।
প্রিয়ম শুনে হতবাক হয়ে গেল, ‘তুমি লোকটার চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়ে পালিয়ে এলে? যদি চিৎকার করত? পুলিশ ডাকত? তোমাকে তো ইমিডিয়েট বেসিসে অ্যারেস্ট করত! আমারও ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে টানাটানি হত।’
রুদ্র বলল, ‘রিস্ক নিতেই হয়েছিল। কিছু করার নেই। ফটোগুলো আমি দেব না বলেই ঠিক করেছিলাম। আর দেব না বললে যদি জোর করে কেড়ে নিত, তাই ইন্ডিয়ান থেরাপি দিলাম একটু।’
প্রিয়ম তবু তোতলাচ্ছিল, ‘তবু লঙ্কাগুঁড়ো! কী ডেঞ্জারাস! লোকটা মরে যায়নি তো?’
রুদ্র উড়িয়ে দিল একফুঁয়ে প্রিয়মের কথা, ‘চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ছেটালে কেউ মরে? কী যে বল তুমি! শুধু চোখটা জ্বলে খাক হয়ে যাবে, এই যা। আর লোকটা নিজে দু—নম্বরি বলে চেঁচিয়ে জানাজানি করবে না সেই কনফিডেন্সটা আমার ছিল। তাই, ওটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এর জন্য অবশ্য তোমার একটা থ্যাঙ্কস প্রাপ্য, কত সুন্দর করে মশলাগুলো কিচেনে গুছিয়ে রাখো তুমি।’
প্রিয়ম কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর নরম গলায় বলল, ‘এবার বলবে কী, তোমার মাথায় আরও কী কী মতলব ঘুরছে? তুমি কখন যে কী করে ফেলছ, ইনফ্যাক্ট দুমদাম আরও কী কী করে ফেলতে পারো সেটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
রুদ্র মুখ টিপে বলল, ‘আপাতত কিছুই করছি না, বার্লিন যাচ্ছি।’
‘আমরা কেন বার্লিন যাচ্ছি? তুমি ফটোগুলো এই মুহূর্তে হাতছাড়া করতে চাইছ না খুব ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে এত দূর কেন, প্যারিস গেলেই তো হত। কিংবা ইংল্যান্ডেরই অন্য কোনো শহরে, ওয়েলস বা স্কটল্যান্ডের দিকটাও চলে যাওয়া যেত। এর জন্য আমার অফিসে কতদিন ছুটি লাগবে আমি নিজেই জানি না। একে এখন এত প্রেশারে আছি। আর তা ছাড়া।’ প্রিয়ম বোতল থেকে জল খেল অনেকটা, ‘ড শ্যুমাখারকে ব্যাপারটা বললে উনিও হেল্প করতে পারতেন! আল্টিমেটলি জিনিসটা হাতছাড়া না হওয়ার পেছনে তো ওঁর গরজটাই বেশি।’
রুদ্র এবার মাথা নাড়ল, ‘আমার নিজের মনে কিছু কনফিউশন তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর উত্তর না পেলে আমি কাউকেই ভরসা করতে পারছিলাম না। ড শ্যুমাখারের ছবিতে একরকম চোখ, সামনাসামনি আরেকরকম কেন? একশো বছরের পুরোনো ফটোগ্রাফ এত নতুনের মতো ঝকঝকে হয় কী করে? যে মুহূর্তে আমি ফোনে ড শ্যুমাখারকে বলে দিয়েছি যে আমি ফটোগুলো নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছি না, সেই মুহূর্ত থেকে ড শ্যুমাখার যেকোনো উপায়ে ফটোগুলো ফেরত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, এদিকে এই লোকটাও যে কার হয়ে এই ফটোগুলোকে দখল করার জন্য ফলো করছিল সেটাও মাথায় ঢুকছে না। কে যে সত্যি, আর কে যে মিথ্যে, আমি পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি।’
প্রিয়ম মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করে বলল, ‘আমরা এক্সটারনাল হিসেবে এত ঝামেলা না নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বলে জিনিসটা জমা দিয়ে দিলেই হত। সব ঘোরা বাতিল, সব প্ল্যান বানচাল।’
রুদ্র এবার সোজা চোখে তাকাল প্রিয়মের দিকে, ‘আর যদি ড শ্যুমাখারের দাবি সত্যি হয়? ওর মতলব ভালো না মন্দ জানি না, কিন্তু ওই মৌলর ব্যাপারটা তো ঠিক হতেও পারে। ক্যান্সারের মতো অভিশাপের হাত থেকে পুরো পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারি জেনেও সেটাকে ব্যুরোক্র্যাটিক ঝামেলার মধ্যে ফেলে দেব? পুলিশের কাছে জমা দেওয়া মানেই এই নিয়ে সরকারি তরফে ইনভেস্টিগেশন শুরু হবে। ওই এলিমেন্ট প্রয়োগ করা উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে মত দিতে হবে আন্তর্জাতিক মহলে। কাজ কিছু হবে কি না তার নেই ঠিক, সারা পৃথিবী জুড়ে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে। কোনো রেভলিউশনারি ভালো কাজ করতে গেলে চুপচাপই করতে হয়, অত হইহই করে আর সেটা করা যায় না। লাদেনকে মারার সময় ওবামা কি সারা দুনিয়াকে জানিয়ে অপারেশনটা চালিয়েছিল? সাকসেসফুল হওয়ার পর বলেছিল সবাইকে। আর সেটাই উচিত।’
প্রিয়মের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, ও বলল, ‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ ড শ্যুমাখার কোনো অসাধু কাজের জন্যও তোমার মদত চাইতে পারেন?’
রুদ্র বলল, ‘চাইতেই পারেন। সেটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।’
‘কিন্তু এইটা আমার মাথায় এখনও ঢুকল না যে হোয়াই বার্লিন?’ প্রিয়ম বলল।
রুদ্র এবার খামটা খুলল। ফটোগুলোকে সাবধানে বের করে সাজিয়ে রাখল সামনে। একটা ফটো তুলে পেছন দিকটা ঘুরিয়ে ওপরের দিকে তুলল, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
প্রিয়ম হাত থেকে ফটোটা নিতে যেতেই রুদ্র বলল, ‘উঁহু। ওভাবে দেখলে দেখতে পাবে না। ওপরের দিকে নিয়ে দ্যাখো, হলোগ্রাম তো।’
প্রিয়ম ফটোটা নিয়ে ওপরের দিকে তুলে কিছুক্ষণ দেখল, ‘কয়েকটা অস্পষ্ট ইংরেজি হরফ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ওয়ার্ডটার কোনো মানে নেই। কী বলো তো?’
রুদ্র বলল, ‘আগে যখন ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না, আমরা ফটো তুলে তারপর ফিলমটা স্টুডিয়োতে দিতাম, মনে আছে? সেখান থেকে প্রিন্ট করার সময় ফটোর পেছনে স্টুডিয়োগুলো এইরকম করে নিজেদের হলোগ্রামটা খোদাই করে দিত।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, শুধু ফটো কেন, ভালো কোয়ালিটির পেপারেও তো কোম্পানির হলোগ্রাম করা থাকে, কাগজটা ওপরের দিকে তুলে আলোয় দেখলে বোঝা যায়।’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘এই ফটোগুলোর পেছনে যে দুটো শব্দ লেখা আছে, সে—দুটো জার্মান শব্দ। ক্যাসপার ফোতোগ্রাফি।’
প্রিয়ম খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘কিন্তু ফটোগ্রাফি বানানটা তো অন্যরকম।’
রুদ্র বলল, ‘জার্মান ভাষায় ওটাই বানান। আমি নেটে সার্চ করেছি, ক্যাসপার শব্দের অর্থ জার্মান ভাষায় হল রয়্যাল।’
প্রিয়ম বলল, ‘মানে, রয়্যাল ফটোগ্রাফি?’
রুদ্র এবার ফটোটা প্রিয়মের হাত থেকে নিয়ে টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, ‘ক্যাসপার ফটোগ্রাফি বার্লিনের একটা বড়ো স্টুডিয়ো। বছর চল্লিশের পুরোনো। বেশ নামকরা। ফটোগুলো ওখান থেকেই প্রিন্ট করা হয়েছে।’
প্রিয়ম এইবার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘বছর চল্লিশের পুরোনো? কিন্তু ড শ্যুমাখারের দাদু তো প্রায় একশো বছর আগে এই ফটোগুলো রেখে গেছেন।’
রুদ্র হাতের কাজ থামিয়ে এবার প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘এবার বুঝতে পারছ কেন আমি এতটা ধন্দে রয়েছি? ড শ্যুমাখারের দাদু একশো বছর আগে ভারতের পন্ডিচেরিতে বসে ফটোগুলো তুলে প্রিন্ট করিয়ে ডায়েরিতে রেখে দিলেন, এদিকে জার্মানির একটা চল্লিশ বছরের স্টুডিয়োর হলোগ্রাম সেই ফটোগুলোর পেছনে ছাপা হয়ে গেল, এটা কী করে সম্ভব? আমি ওই স্টুডিয়োর ওয়েবসাইটটাও ভালো করে দেখেছি, এরকম নয় যে আগে ওদের কোনো পেরেন্ট অফিস ছিল কোথাও। পরিস্কার লেখা আছে উনিশশো আশি সালে তৈরি হয়েছে।’
প্রিয়ম চিন্তা করে করতে বলল, ‘তুমি কি বার্লিনে যাচ্ছ ওই স্টুডিয়োটায় যাবে বলে?’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করব যে কীভাবে এই হলোগ্রামটা এই ফটোগুলোয় এল। আর শুধু সেজন্যই যাচ্ছি তা নয়, বার্লিনে ড শ্যুমাখারের সম্বন্ধেও কিছু খোঁজখবর নেওয়ার আছে আমার।’
প্রিয়ম বলল, ‘কিন্তু তোমাকে ওরা উত্তর দেবেই—বা কেন। তুমি তো কোনো পুলিশ বা সরকারি তরফে যাচ্ছ না, তার ওপর বিদেশি। আর তা ছাড়া, যে এই কাজের সঙ্গে তোমাকে ইনভলভ করেছে, সে নিজেই যদি তোমার মনে কনফিউশন তৈরি করে থাকে, তবে তো ব্যাপারটা থেকে সরে আসাই ভালো ছিল, এটা তো আর নিজেদের কোনো সমস্যা নয়, এ যেন আগ বাড়িয়ে বিপদের মধ্যে জড়ানো, তাই নয় কি?’
রুদ্র স্থির চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়মের দিকে।
প্রিয়ম আবার বলল, ‘এই উটকো ঝামেলার জন্য মাঝখান থেকে আমার অফিস কামাই, তোমার ঘোরা ক্যানসেল, সামনের সপ্তাহে সেমিনার, কী করবে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
রুদ্র এবার হাসল, ম্লান মুখে বলল, ‘তোমার এই কথাটা শুনে মার্টিন নিয়েমোলারের সেই বিখ্যাত কবিতাটা মনে পড়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে তিনিও জার্মানিরই লোক ছিলেন। আজ দুপুরে জার্মানি নিয়ে যখন ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, তখন এটা আরও একবার চোখে পড়েছিল একটা ব্লগে। কবিতাটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা। হিটলারের নাতসি বাহিনী যখন চরম অত্যাচার চালাচ্ছে সারা দেশে, আনছে একের পর এক অদ্ভুত আইন, সাধারণ মানুষের সমস্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তখনও জার্মানির ওপরমহলের লোকেরা চুপ করেই ছিলেন, ঠিক তোমারই মতো, সারা দেশে যতই অত্যাচার হোক, তাঁদের নিজেদের গায়ে যতক্ষণ না আঁচ লাগছে, তাঁরা কেন কিছু বলবেন? তাই তাঁরা নির্লিপ্ত ছিলেন। পড়েছ কবিতাটা?’
প্রিয়ম দু—দিকে মাথা নাড়ল।
রুদ্র ফোনে গুগল খুলে কবিতাটা বের করল, তারপর এগিয়ে দিল প্রিয়মের দিকে।
‘প্রথমে ওরা সোশ্যালিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কিছু বলিনি
কারণ আমি তো সোশ্যালিস্ট নই!
তারপর ওরা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য এল, আমি কিচ্ছু বলিনি
কারণ আমি তো ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই!
তারপর ওরা এল ইহুদিদের জন্য, আমি তখনও কিচ্ছু বলিনি
কারণ আমি ইহুদি নই!
সবশেষে ওরা এল আমার জন্য
কিন্তু তখন আমার হয়ে বলার জন্য আর
কেউই বেঁচে ছিল না!’
প্রিয়ম বলল, ‘ইহুদি তো ইজরায়েলের লোকেদের বলে, তাই না?’
রুদ্র বলল, ‘ইহুদি একটা বহু পুরোনো জাতি, জার্মানিতেও তারা প্রচুর আছে। তবে ইজরায়েলেই বেশি। কবিতাটার আসল মানেটা কী বুঝলে? যেমন ধরো, ওদের দেশে হিটলার ক্ষমতায় এসে অন্য সমস্ত পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন ব্যান করে দিয়েছিল, উচ্চবিত্তরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। যদিও এই কবিতাটা তার আগেই লেখা, তবু ওই কনটেক্সটে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। হিটলার তো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প করে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলেছিল। তাতেও খুব একটা প্রোটেস্ট করেনি কেউ।’
প্রিয়ম বলল, ‘অ্যাঁ! লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছিল? সে কী?’
রুদ্র এবার অবাক হল, ‘হিটলারের কাজকর্ম পড়োনি নাকি হিস্ট্রিতে?’
প্রিয়ম এবার বলল, ‘পড়েছিলাম, সে তো কোন যুগে, আর আমার আগের বছরেই পরীক্ষায় হিটলার এসেছিল, তাই ওটা বাদই দিয়েছিলাম একরকম।’
রুদ্র ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বলল, ‘তোমার কথাবার্তা শুনে না মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি ডাক্তার হলে কী করতে! পেশেন্টের যদি দেখতে এমন একটা রোগ হয়েছে, যেটা তোমার আগের ইয়ারে এসেছিল বলে তুমি সাজেশনে পড়নি, তখন কি পেশেন্টকে না দেখেই ছেড়ে দিতে?’
প্রিয়ম এবার বলল, ‘সেটা অন্য ব্যাপার, বস! সব কিছুই নিজের ইন্টারেস্টের ওপর ডিপেন্ট করে। ইতিহাস আমার জঘন্য লাগত, পড়তে বসলেই ঘুম পেত। তোমার বাড়িতে ঐতিহাসিক অ্যাম্বিয়েন্স ছিল, তাই। আমার বাড়িতে কস্মিনকালেও কোনো ইতিহাসের লোক ছিল না, ফলে আমি পাতিহাঁসও হইনি। আমার ফেভারিট ছিল অঙ্ক, সেটাতে আমি সবসময় এক ক্লাস করে এগিয়ে থাকতাম।’
রুদ্র এবার চোখ পাকাল, ‘আমার বাবা যেমন আর্কিয়োলজিস্ট ছিলেন, মা—ও তেমনই কলেজে অঙ্ক পড়ান, তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। অঙ্কে ভালো মানেই সে ইতিহাস জানবে না এটা কোনো কথা হল? বেসিকটা জানা উচিত সবারই। আর অঙ্কে আমিও যথেষ্ট ভালো ছিলাম স্যার।’
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা বাবা, দেশে ফিরেই আবার নাইন টেনের হিস্ট্রি বই কিনে পড়া শুরু করব, শান্তি? এখন বলবে কী? হিটলার ইহুদিদের মেরেছিল কেন? কেউ কিছু বলেনিই—বা কেন?’
রুদ্র বলল, ‘কে আবার কী বলবে? কোনো অপোনেন্ট পার্টির অস্তিত্বই রাখেনি হিটলার। সব পার্টি ব্যান করে দিয়েছিল। আর হিটলার ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে করত।’
প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলো, হিটলার তো জার্মানির প্রধানমন্ত্রী ছিল?’
রুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ। ওদের দেশে ওই পোস্টটাকে বলে চ্যান্সেলর।’
প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা জানি। তা, চ্যান্সেলর হয়েছিল মানে তো লোকেরাই ওকে জিতিয়েছিল, রাইট? তারপরেও ওকে কুখ্যাত নেতা বলে কেন? শুধু স্বৈরাচারী ছিল বলে?’
রুদ্র এবার বাবু হয়ে বসল বার্থের মধ্যেই, ‘আমি আজ সারা দুপুর নেট থেকে হিটলারের সম্পর্কে প্রচুর পিডিএফ নামিয়ে পড়াশুনো করেছি। কারণ ড শ্যুমাখারের সঙ্গে হিটলারের কোনো একটা যোগাযোগ আছে।’
প্রিয়ম চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘অ্যাঁ? শ্যুমাখারের সঙ্গে হিটলারের? সে আবার কী?’
রুদ্র বলল, ‘ইয়েস! সেকথায় পরে আসছি। আগে তোমাকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে দিই, না হলে তুমি বুঝতে পারবে না। আমি নিজেও এত ডিটেইলে জানতাম না, বাবা ফোনে বলল, তারপর নিজেও পড়লাম। শোনো, হিটলার একটা খুব রেয়ার ক্যাটেগরির সাইকো ছিল, ওর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র জার্মানরাই পৃথিবী শাসন করবে, তারাই একমাত্র সব ব্যাপারে এগিয়ে থাকবে। হিটলারের রাজত্বের ঠিক আগে আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মিত্রশক্তি, মানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকার জোট জিতেছিল। আর অন্যদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, এইসব দেশ খুব বাজেভাবে হেরেছিল। যুদ্ধ শেষ হয় ভার্সাইয়ের সন্ধি দিয়ে, তাতে যুদ্ধের সব দোষ সব দায় মিত্রশক্তির জয়ী দেশগুলো চাপায় জার্মানির ওপর। এমনকী জার্মানির আর্মড ফোর্সও বন্ধ করে দেয়।’
প্রিয়ম মন দিয়ে শুনছিল, ‘তারপর?’
রুদ্র বলল, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি একেই ধুঁকছিল, তার ওপর ওই দেশগুলোর মোটা ক্ষতিপূরণের বোঝা মেটাতে গিয়ে জার্মানিতে মারাত্মক ইনফ্লেশন দেখা দেয়। টাকার কোনো দামই ছিল না, একেকটা জিনিসের দাম রাতারাতি হাজার হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এইসব কিছুর জন্য হিটলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ছোটো থেকে ওর একটা ধারণা হয়েছিল—জার্মানির হার, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সব কিছুর জন্য দায়ী মাইগ্রেশন। ইহুদিরা অন্য দেশ থেকে জার্মানিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সেই আক্রোশ থেকেই ও মাস কিলিং শুরু করে।’
প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘মানে, ইহুদিদেরকে ধরে ধরে খুন করত?’
রুদ্র বলল, ‘তার চেয়েও ভয়ংকর। হলোকাস্ট—এর নাম শোননি? পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কালো অধ্যায় বলতে পারো। ষাট লক্ষেরও বেশি ইহুদিকে হিটলারের নাতসি পার্টি মেরে ফেলেছিল। হাজার হাজার কিলিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল।’
প্রিয়ম বলল, ‘কিলিং ক্যাম্প! মানে সেই ক্যাম্পে খুন করা হত লোকজনকে?’
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘একদম। বিষাক্ত গ্যাস ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হত তাদের। পনেরো লক্ষের বেশি ইহুদি শিশুকেও মারা হয়েছিল তাতে।’
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হুঁ, এই নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। আচ্ছা ওগুলোই কি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প?’
রুদ্র বলল, ‘না। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা দেশের শত্রু তাদের সবাইকে রাখা হত। তাদের মধ্যে ইহুদি, রোমানরা ছিল। আবার দাগি ক্রিমিনাল বা গুরুতর অসুস্থদেরও রাখা হত। তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক খাটানো হত। মুরগির খামারের মতো গাদাগাদি করে থাকতে হত ওদের, যখন—তখন কারণে অকারণে মেরে ফেলত। মেয়েদের ওপর অকল্পনীয় অত্যাচার চলত। মানে, সব নাগরিক অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের। আর কিলিং ক্যাম্পে শুধুই বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে, কিংবা একদম অনাহারে রেখে খাটিয়ে খাটিয়ে মারা হত। অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি পড়নি?’
প্রিয়ম চোখ সরু করে শুনছিল। ও একটু আবেগপ্রবণ, দুঃখের সিনেমা বা বই পড়লেও ওর চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, সেখানে এ তো সত্যি ঘটনা। তুলনায় রুদ্র অনেক শক্ত।
রুদ্র থামতেই প্রিয়ম বলে উঠল, ‘এই বিষাক্ত গ্যাসটা কী?’
রুদ্র বলল, ‘হিটলারের সময়ে কেমিস্ট্রিতে অনেকরকম ইনভেনশন শুরু হয়েছিল। শুধু পয়জনাস গ্যাসই নয়, শক্তি বাড়ানোর ক্যাপসুলও বের করা হয়েছিল, ক্ষতিকারক ড্রাগ ছিল তাতে। ওইজন্যই একটা মিথ আছে শোননি? জার্মান সৈন্যরা কখনো ক্লান্ত হত না? ওদের শরীরে ওই ড্রাগগুলো ইনজেক্ট করা হত।’
প্রিয়ম চুপ করে মাথা নাড়ল।
রুদ্র এবার বলল, ‘যাই হোক যেটা বলছিলাম, হিটলারের এত কাণ্ডেও জার্মানির উচ্চবিত্তেরা কোনো প্রতিবাদই করেনি তারা নিজেরা নিরাপদ আছে ভেবে। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো জার্মানিই শেষ হয়ে গেল।’ এক মুহূর্ত থেমে ও একটা লম্বা শ্বাস নিল, ‘আসলে আমরা সবাই স্বার্থপর, যতক্ষণ না নিজের গায়ে আঁচ লাগছে, ততক্ষণ পাশের লোকেরা পুড়ে মরছে দেখলেও আমরা কেয়ার করি না, ভাবি আমি তো ঠিক আছি, আমার কী দরকার আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে! ঠিক তুমি যেমনটা বললে। আর এইরকমভাবেই একদিন নিজের গায়েও এসে সেই আগুনটা লাগে। আজকে যদি ড শ্যুমাখারের কথা ঠিক হয়, ওর মতলব বদ বুঝতে পারছি, কিন্তু সত্যিই যদি ওইরকম কোনো কেমিক্যাল বানানো যায়, সারা পৃথিবী চিরকালের মতো ক্যান্সারকে জয় করতে পারবে, কিন্তু তবুও তা নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথাই নেই, কেন? না, তোমার কোনো প্রিয় মানুষের ক্যান্সার হয়নি এখনও। এই যদি দুম করে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে…।’
প্রিয়মের এবার চোখমুখ কুঁচকে গেল, একটু জোরেই বলল, ‘আজেবাজে বকছ কেন বলো তো?’
রুদ্র চোখ দুটো সরু করে বলল, ‘আজেবাজে কিছুই বকছি না, শুনলে তো সেদিন, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন অলরেডি ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে ক্যান্সার মহামারির আকার নেবে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দেখা দেবে। আর সত্যিই তো তাই হচ্ছে! তুমি দ্যাখো না, ইদানীং অফিসে, পাড়ায়, বন্ধুমহলে সব জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাও না? অমুকের ক্যান্সার, তমুক হঠাৎ মারা গেল ক্যান্সারে?’
প্রিয়ম ঘাড় নাড়ল, ‘হুঁ। খুব বেড়ে গেছে আজকাল। মানুষের লাইফস্টাইল, খাবারদাবারে পেস্টিসাইডস, কেমিক্যালস, তারপর পলিউশনও এইজন্য দায়ী।’
রুদ্র বলল, ‘তবে?’
প্রিয়ম বলল, ‘তাহলে এত এদিক—ওদিক না ভেবে, ওই শ্যুমাখারের মণির রং কী, এই ফটোগুলো কোথা থেকে ডেভেলপড এইসব নিয়ে মাথাখারাপ না করে ফটোগুলো থেকে কিছু বের করতে পারো কি না দেখলেই হয়। সত্যি যদি কোনো নতুন এলিমেন্ট তৈরির প্রসিডিয়র লেখাও থাকে, তুমিই তো প্রথম বুঝতে পারবে সেটা।’
রুদ্র একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তোমাকে যদি কেউ কোনো জিনিস চুরি করে নিয়ে এসে গিফট করে, আর সেটা তুমি জানতে পারো, তারপরেও তুমি নিয়ে নেবে? কী বলছ বলো তো! আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!’
প্রিয়ম বলল, ‘যাব্বাবা, চুরিডাকাতি আবার এর মধ্যে কোত্থেকে এল! ড শ্যুমাখারের দাদুই তো এটা…!’
রুদ্র বলল, ‘আরে, সেটা তো ওর নিজের কথা। সত্যি মিথ্যে জানি আমরা? ডায়েরিটা দেখিয়েছেন উনি আমাদের? ওঁর কথামতো ডায়েরিতে তো পুরো জিনিসটা নাকি ওই দাদু ন্যারেট করে গেছেন যে এই ফটোগুলোর মধ্যেই ওই এলিমেন্ট তৈরির প্রসেস রয়েছে, ওঁর রিসার্চ প্রোগ্রেস সব কিছু নিজের ভাষায় লিখে গেছেন, সেটা তো শ্যুমাখার আমাদের দেখাননি!’ একটু থেমে ও বলল, ‘আর আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিয়োর যে বললেও উনি দেখাতে পারবেন না।’