১৬
জুলাই, ১৯৩৩,
অ্যাডলফ অস্থিরভাবে তাঁর রাজকীয় প্রাসাদের দোতলার ব্যালকনিতে পায়চারি করছিলেন। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে প্রায়, তবু তার হালকা লাল আভা ছড়িয়ে আছে সারা আকাশে। পাখিরা সারাদিনের কাজের শেষে একে একে ফিরছে তাদের বাসায়।
জুলাই মাসের শেষাশেষি। জার্মানিতে এখন সুন্দর আবহাওয়া। ঠান্ডা থাকলেও তা আরামদায়ক।
তাঁর গায়ে এখন পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক। মাথায় খাকি মেরুন টুপি, বর্ডারটা অবশ্য সোনালি রঙে বোনা, গায়ে খাকি ওভারকোট, কোমরে বেল্ট, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুট। এমনিতে চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর পোশাক যথেষ্ট অনাড়ম্বর, তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান সৈন্য হিসেবে লড়াই করে পুরস্কার স্বরূপ যে আয়রন ক্রসটা পেয়েছিলেন সেটা তিনি কখনো পরতে ভোলেন না। ওটা তাঁকে শুধু গর্বিতই করে না, মনে শক্তিও জোগায়।
আনমনে তিনি তাঁর মোটা অথচ চৌকো গোঁফটায় তা দিলেন।
পার্টির মুখ হিসেবে যখন সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছিলেন তখন একজনের পরামর্শে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি করার জন্য এই গোঁফটা রাখতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। সারা পৃথিবীর চোখ এখন এই চৌকো গোঁফের দিকে। কেউ তাঁকে ভয় পায়, কেউ করে ঘৃণা।
কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারুর নেই।
রেলিং—এ ভর দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আডলফ ভাবলেন চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর বেশ কয়েক মাস পূর্ণ হতে চলেছে। নিন্দুকেরা যে যাই বলুক, এখনও অবধি বিশ্বযুদ্ধের পরের সেই লাঞ্ছিত পরাজিত জার্মানিকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভালো হয়েছে, বেকারত্বও কমেছে এক লাফে অনেকটা। বিশ্বযুদ্ধের সেই অপমানজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তাঁর জার্মানি এখন অনেকটাই সক্ষম।
শুধু তার আগে ছাঁকনিতে ছেঁকে নিতে হবে গোটা দেশটাকে। জার্মানরা হল বিশুদ্ধ আর্য জাতির বংশধর, তাদের মধ্যে হাবিজাবি রক্ত এসে মেশাটা বন্ধ করতে হবে চিরতরে।
ক্ষমতায় আসার আগে যখন তিনি জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির মামুলি একজন বক্তা ছিলেন, তখন ইহুদিদের তাড়ানো নিয়ে অনেক রক্তগরম করা বক্তৃতা দিতেন। বলতে গেলে ওই বলার গুণেই রাতারাতি পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। তখন তাঁর বক্তৃতা শুনে কেউ বাহবা দিত, কেউ আবার তিরস্কার করত। সেই পার্টিকে নাম পালটে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি, বা সংক্ষেপে নাতসি পার্টি করেছিলেন তিনিই।
কিন্তু তারপরের ওই ন—টা মাস রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ল্যান্ডসবার্গের জেলে কাটানো সময়টুকুতে যখন এসব ছেড়ে আত্মজীবনী লেখা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন, তখন অন্তত তিনি এইটুকু বুঝেছিলেন যে আর যাই হোক, কোনো দেশের শাসক দল হিসেবে ক্ষমতায় আসতে গেলে এই সমস্ত কথা বলে অপ্রিয়ভাজন হওয়ার চেয়ে আগে আমজনতা যা শুনতে চায় তাই বলো, পরে ক্ষমতায় এসে যা করবার করো।
আর সেটাই করতে চলেছেন তিনি এখন। জার্মানির দেশপ্রধান পদটার নাম চ্যান্সেলর। এ ছাড়াও প্রেসিডেন্ট থাকেন একজন। চ্যান্সেলর তো অ্যাডলফ হয়ে গেছেন, এখন শুধু অপেক্ষা বুড়ো প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের মরার, ইতিমধ্যেই মৃত্যুশয্যায় সে, মরলেই ওই পদটারও অবসান ঘটাবেন অ্যাডলফ, নিজেই দুটো দায়িত্ব মাথায় নিয়ে একচ্ছত্র অধিপতি ‘ফুয়েরার’ হবেন জার্মানির।
অ্যাডলফ হিটলারের বিরুদ্ধে কোনো দল থাকবে না, অ্যাডলফ হিটলারের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনো মানুষকে জার্মানির নিশ্বাস নিতে দেবেন না তিনি।
ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে বড়ো ছোটো সমস্ত পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন অ্যাডলফ। কম্যুনিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, এমনকী ট্রেড ইউনিয়নও ব্যানড। কথায় কথায় ধর্মঘট করা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল ওই সব দলগুলোর। প্রোডাকশনের ক্ষতি ছাড়া ধর্মঘটে কিছুই হয় না, অতএব ধর্মঘট করাও এখন বেআইনি। দেশের ভেতরের রাজ্যগুলোর যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল, সেই অটোনমি দেওয়ারও আর প্রয়োজন মনে করেননি অ্যাডলফ, অটোনমি দেওয়া মানেই আজ যে প্রজা কাল সে রাজা হয়ে উঠবে, কী দরকার! প্রতিটা রাজ্যে নাতসি নেতাদের গভর্নর করে দেওয়া হয়েছে।
জার্মানির মাটিতে দাঁড়িয়ে যে অ্যাডলফ হিটলারকে সমালোচনা করবে, তার আয়ু আর বড়োজোর চব্বিশ ঘণ্টা স্থায়ী হবে। আর জার্মানির বাইরে? তাদের জন্য তো মাস্টার প্ল্যান আসছেই শিগগিরই। জার্মানির সেনাবাহিনীকে এমনভাবে তৈরি করছেন তিনি, যুদ্ধ শুরু হলে অন্য দেশগুলো যেন লড়া তো দূর, সামনে দাঁড়াতে না পারে। মেথামফেটামাইন ড্রাগটা গোটা আর্মিকে খাইয়ে তাদের থেকে অতিমানবীয় পারফর্ম্যান্স আদায় করবেন তিনি। এই ব্যাপারে ড মরেলের সঙ্গে আলোচনাও সেরে রেখেছেন। যুদ্ধ শুরু করার আগে সব দিক নিপুণভাবে রেডি রাখতে চান অ্যাডলফ, যাতে যুদ্ধের মাঝে দিশেহারা না হয়ে পড়তে হয়। ওই পারভিটিন স্টিম্যুল্যান্টটাও লক্ষ লক্ষ পরিমাণে সাপ্লাই করতে হবে আর্মি শিবিরগুলোয়।
হোক সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক, দেশকে সবার উপরে নিয়ে যাবে তারা, প্রতিশোধ নেবে দেশের অপমানের, তবেই না তারা দেশপ্রেমিক?
দেশের জন্য এইটুকু করতে পারবে না?
মোটামুটি পরিকল্পনা সেরে নিয়েছেন অ্যাডলফ। পোল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া সব একে একে শেষ করবেন তিনি। ওদিকে চেক, হাঙ্গেরিগুলো তো সোজা টার্গেট, রাশিয়ার মস্কো শহরটাকে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে একটা সুন্দর লেকে পরিণত করার ইচ্ছে বহুদিন ধরে মনে মনে পোষণ করছেন তিনি।
তবে কিনা পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষেরও কখনো কখনো মনে রোম্যান্স জেগে ওঠে। তেমনি গোধূলি আলোর এই পড়ন্ত বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে অ্যাডলফের বহুদিন বাদে গেলির কথা মনে পড়ে গেল। সেই ফুলের মতো নিষ্পাপ, শিশুর মতো উচ্ছল গেলি, যে মাত্র তেইশ বছরে শেষ করে দিয়েছিলো জীবনটা!
তখন অ্যাডলফ বোঝেননি, নিষ্ফল আক্রোশে নিজের মুঠোর মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন সবসময় গেলিকে, রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও গেলিকে নিজের কাছে রেখে অদ্ভুত এক শান্তি পেতেন। মনে করেছিলেন গেলি সম্পূর্ণ তাঁর, একমাত্র তাঁর। মামা হয়ে তাঁর এমন আচরণ দেখে লোকে কত কথা বলেছে, দিদি অ্যাঞ্জেলা পর্যন্ত গেলি চলে যাওয়ার পর ওঁকে ক্ষমা করতে পারেনি অ্যাডলফ জানেন।
তবু আজ এতদিন বাদে এসে তিনি বোঝেন, গেলিকে তিনি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন।
হয়তো একমাত্র গেলিকেই তিনি ভালোবাসতেন!
তবে সবার তো ভালোবাসার ভাষা সমান হয় না।
ইভার ডাকে হঠাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল ওঁর, ‘অ্যাডি, ভিক্টর ব্র্যাক এসেছে। বসতে বলেছি।’
মুহূর্তে বর্তমানে ফিরে এলেন অ্যাডলফ। আজ একটা অত্যন্ত বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন তিনি, যার জন্য হয়তো প্রচুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ওঁকে। বিশেষত ওই ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজের এডিটরটার। সম্মুখীন হতে হবে হাজারো ভ্রূকুটির।
ওই ফ্রিৎজ গার্লিককে চরম শাস্তি না দিয়ে শান্তি নেই, একদম গোড়া থেকে উঠে—পড়ে লেগেছে ওঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে। শয়তানটার কথা ভাবলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় অ্যাডলফের। কাগজটা নিষিদ্ধ হয়েও থামেনি, বেনামে একের পর এক কাগজে অ্যাডলফের নামে কুৎসা লিখে যাচ্ছে সে, অ্যাডলফ কি কিছুই খবর রাখেন না নাকি!
ক্ষমতায় আসার মাসখানেকের মধ্যেই গ্রেপ্তার করেও ফেলেছিলেন ওই নরকের পোকাটাকে, কিন্তু জোরদার প্রমাণাভাবে গয়েবেল বলল আপাতত ছেড়ে দিতে।
জোসেফ গয়েবেল পাবলিক এনলাইটমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রী। পদমর্যাদায় ওর ওপরে আরো দু—তিনজন মন্ত্রী থাকলেও দূরদর্শিতার জন্য অ্যাডলফ ওর কথায় বেশ গুরুত্ব দেন। গয়েবেল যখন বলছে এভাবে ফ্রিৎজকে ধরে রাখলে জনতা খেপে যেতে পারে, তখন সেটা না করাই ভালো, ভেবেছিলেন অ্যাডলফ।
তবে তিনি নিজে বিশ্বাস করেন শত্রুর শেষ রাখতে নেই।
বেশিদিন ফেলে রাখলেই আবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে প্ল্যানটা পুরো গুছিয়ে নিলেন অ্যাডলফ। আজকের সিদ্ধান্তটার সমালোচনা হয় হোক, কিন্তু দেশপ্রধান হিসেবে তিনি যা করতে চলেছেন, ইতিহাস ওঁকে মনে রাখবে চিরকাল। সারা পৃথিবীর মধ্যে জার্মান জাতিকে বুদ্ধিতে, বীরত্বে, মননে শ্রেষ্ঠ করে তুলবেন তিনি, জার্মান জাতিকে পৃথিবীর সর্বোত্তম জাতিতে পরিণত করবেন। প্রতিটা জার্মান হবে সুপারম্যান।
আর সেটা অনন্তকালের জন্য!
শান্ত লয়ে তিনি কনফারেন্স রুমে এসে ঢুকলেন। জার্মানির দেশনায়ক হিসেবে যথেষ্ট অনাড়ম্বর তাঁর জীবন, উচ্ছৃঙ্খলতা তাঁর পছন্দ নয় কোনোকালেই। এমনিতেই তাঁর পেটের অবস্থা ভালো নয়, সারাদিন অসংখ্য ওষুধের ওপর থাকতে হয় তাঁকে, তার ওপর অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়ছে দিন দিন।
তবু বিশ্রাম নিতে তিনি নারাজ।
ভিক্টর বসে ছিল, অ্যাডলফকে ঢুকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত সামনে উঁচু করে তুলে ধরে মস্ত একটা অভিবাদন ঠুকল, ‘হেইল হিটলার!’
সে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার চ্যান্সেলরের বাসভবনে এল। প্রথমবার তো খুব উত্তেজিত ছিল, তার মতো একজন সাধারণ পার্টি ওয়ার্কারকে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান ডেকে পাঠানোয়। ভয়ও পেয়েছিল।
কিন্তু পরে বুঝেছিল সে অ্যাডলফের বেশ নেকনজরে পড়ে গিয়েছে।
অ্যাডলফ কিছু না বলে ইঙ্গিতে বসতে বললেন, ‘ভিক্টর, কিছু এগোল?’
ভিক্টর বিনীতভাবে বলল, ‘আজ্ঞে গ্যালটন মারা গেছেন তাও বাইশ বছর হয়ে গেল। ওঁর অনেক দিকে গবেষণা ছিল, ওঁর বিভিন্ন ছাত্র বিভিন্ন ফিল্ডে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বেশ বিখ্যাত। তাই কী ব্যাপারে না বললে…!’
অ্যাডলফ চুপ করে গেলেন। এই ভিক্টর ব্র্যাক বিশ্বস্ত বলেই মনে হয়, অনেক ভেবেচিন্তেই এই কাজের জন্য ওকে বেছেছেন তিনি তবে কথায় বলে দেওয়ালেরও কান আছে। আর এইসব ব্যাপারে তো কাউকে বিন্দুমাত্র টের পাওয়ানো চলবে না। এইজন্যই তিনি মন্ত্রীসভার পোড় খাওয়া হোমরাচোমরাদের কাউকে ডাকেননি। এমনকী হিমলার, গয়েবেল, গোরিং, পার্টির বড়ো বড়ো নেতাদেরও ইনভলভ করেননি।
অ্যাডলফ কাজে বিশ্বাসী। কাজটা মিটে যাক, একদম আইন পাশ হবে, ইমপ্লিমেন্টেশন শুরু হবে, তারপর মানুষ জানবে।
ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে, শুধু এমনটাই প্রাথমিক আলাপে ছেলেটাকে বলেছিলেন অ্যাডলফ।
এই ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের সম্পর্কে অ্যাডলফ প্রথম জানতে পারেন ল্যান্ডসবার্গের জেলে বসে। ভদ্রলোকের লেখা একটা বই পড়ে এতটাই চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন যে সাময়িক পার্টির প্রতি বিরাগটা কাটিয়ে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্মকাণ্ডে। অসম্ভব ট্যালেন্টেড ছিলেন ওই বৈজ্ঞানিক, কিন্তু এতটাই অস্থিরমতি যে কোনো গবেষণাই তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
ওঁর লেখা বই পড়েই অ্যাডলফ প্রথম জানতে পারেন কেন একটা জাতিকে শুদ্ধ করা ভীষণভাবে প্রয়োজন। ওর ওই বই পড়েই বর্তমান জার্মানির দুরবস্থার কারণ প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি।
তিনি নিজেই আস্তে আস্তে উপলব্ধি করেছেন, বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় হার, তারপরের এই অরাজকতা এগুলোর সব কিছুর পেছনে আসল এবং অন্যতম কারণ হল প্রচুর আজেবাজে জাতির বাজে রক্ত এসে জার্মান জাতিতে মিশে যাওয়া। জার্মান মানুষেরা হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আর্য জাতির বংশধর। আদিম যুগে আর্যজাতি সেন্ট্রাল ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উত্তরপুরুষ হল সুইডেন আর নরওয়ে অঞ্চলের নর্ডিক জাতির মানুষেরা। প্রকৃত জার্মানরা হল এই আর্য—নর্ডিক সংমিশ্রণের সার্থক রূপ। এই যে জার্মানদের সোনালি চুল, সুঠাম চেহারা, শক্ত, ঋজু গড়ন, অসীম দৈহিক শক্তি এইগুলো কি তারই ইঙ্গিত দেয় না?
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাডলফের নিজস্ব সিকিউরিটি গার্ড পাথরের দৃষ্টিতে উলটোদিকের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ঠিক যেন একটা যন্ত্র। অ্যাডলফের মৃদু অঙ্গুলিহেলনে সে মুহূর্তে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
গার্ডটি চলে যেতেই অ্যাডলফ উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। যদিও ইতিমধ্যে বারপাঁচেক তাঁর উপর হত্যার চেষ্টা হয়ে গেছে, তবু সবসময় পাহারা দেওয়াটা একেবারেই না পসন্দ তাঁর।
‘শোনো ভিক্টর, তুমি খুব ভালো করে বুঝে নাও আমি কী চাইছি। আগের দিন তো তোমায় কিছুটা বলেছি, একটা দেশ। একটা জাতি তখনই দুর্বল, ভঙ্গুর হয়ে পড়ে যখন তার ভেতরে প্রচুর অন্য রক্ত এসে মেশে, আর সেই জাতিটাকে বাঁচাতে গেলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন শুদ্ধিকরণ। সেইজন্যই ফ্র্যান্সিস গ্যালটনকে আমাদের প্রয়োজন, কারণ তিনি ইউজেনিক্সের কথা বলে গেছেন।’
ভিক্টর চুপ করে শুনছিল। সে কাজপাগল মানুষ, চ্যান্সেলর যা বলবেন সেটা তার কাছে শিরোধার্য। বিশেষত এই মিশনটার জন্য যখন তাকেই পছন্দ করেছেন অ্যাডলফ, এই একটা সাফল্যই ওর কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
চ্যান্সেলর বলতে লাগলেন, ‘পৃথিবীর জনসংখ্যা সাংঘাতিক হারে বাড়ছে। সেখানে জার্মান জাতিকে সবার উপরে নিয়ে যেতে গেলে প্রয়োজন আমাদের জিনটাকে উন্নত করা। আর খারাপ জিনগুলোকে ছুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া। আর তার জন্য দরকার সিলেক্টিভ ব্রিডিং। যে কেউ নিজে রোগের ডিপো হয়ে যাকে তাকে বিয়ে করল, ছেলেমেয়ে হয়ে গেল, এরকম আর চলবে না। এরকম ভালোখারাপ জিনমেশানো মানুষদের জন্য আমার সরকার আর পয়সা খরচ করবে না।’ নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একমুহূর্ত থামলেন অ্যাডলফ, ‘আর এটা কিন্তু নতুন নয়। তুমি কি জানো প্রাচীন যুগে গ্রিসের স্পার্টাতে কোনো বিকলাঙ্গ শিশু জন্মালেই তাকে ওখানকার টেগেটাস পাহাড়ের উপর থেকে আছড়ে ফেলে মেরে ফেলা হত?’
ভিক্টর এবার চমকে উঠল, ‘অ্যাঁ! জ্যান্ত বাচ্চাকে?’
অ্যাডলফ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস! স্পার্টাতে কোনো বাচ্চা জন্মালেই তাকে মদে চুবিয়ে কিংবা খোলা হাওয়ার মধ্যে রেখে দিয়ে পরীক্ষা করা হত সে কতটা শক্তিশালী, ভবিষ্যতে বিভিন্ন স্ট্রাগলের সঙ্গে লড়াই করে সে যুঝতে পারবে কি না। না পারলে মরো, পারলে থাকো। আর এইজন্যই সে সময় বীরত্বে, শ্রেষ্ঠত্বে কেউ স্পার্টার সমকক্ষ হতে পারেনি। কারণ ওদের রাজ্যে দুর্বল অসুস্থ মানুষের কোনো স্থানই ছিল না। যাদের দেশকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের বাঁচিয়েই রাখা হত না। এইজন্য তারা ইউজেনিয়া বলে এক দেবীর আরাধনাও করত, শুধু শক্তিশালী সুস্থ শিশুই বেঁচে থাকতে পারতো ওই দেশে।’
ভিক্টর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আর বাচ্চাগুলোর বাবা মা? তারা কিছু বলত না?’
অ্যাডলফ এবার একটু বিরক্ত হলেন, ‘একটা রাষ্ট্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ করতে গেলে বাবা মা, স্বামী—স্ত্রী, এইসব ইমোশনের দাম দিলে হয় না ভিক্টর! স্বয়ং প্লেটো বলে গেছেন কোনো দেশকে উন্নত করতে হলে ইউজেনিক্স প্রয়োগ করতেই হবে। অর্থাৎ ভালো জিনগুলোকে প্রোমোট করো, আর খারাপ জিনগুলোকে জাস্ট হাপিশ করে দাও।’ তারপর দুটো হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন, ‘আমিও সেটাই চাই। আমি চাই জার্মানিতে প্রতিটা মানুষ সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ হোক, কোনো দুর্বলের স্থান নেই এখানে। আর এই ব্যাপারে আমি তিনটে অ্যাজেন্ডা ঠিক করেছি।’
ভিক্টর এবার উৎসুক চোখে চাইল।
অ্যাডলফ থুতনিকে দুটো আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘ইউথেনাশিয়া, ম্যারেজ মনিটরিং আর সবশেষে ইউজেনিক্স!’
ভিক্টর বলল, ‘মানে?’
হিটলার বলে চললেন, ‘এক, সারা জার্মানিতে হাজার হাজার হসপিটল বা মেন্টাল অ্যাসাইলামে লক্ষ লক্ষ মানুষ পড়ে আছে, যারা কোনোদিনও সুস্থ হবে না। যারা শেষদিন অবধি একইরকমভাবে বোবা কালা, পাগল বা যেকোনোরকম প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে থাকবে। কেউ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে রয়েছে, কেউ সমকামের মতো বিকৃতিতে আসক্ত। আবার কয়েকশো আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে জেলে রয়েছে। এরা দেশকে কিছু দিতে পারবে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাডলফ, ‘কিচ্ছু না! তাই তাদের পেছনে আমার সরকার অর্থ বা সময় কিছুই আর নষ্ট করবে না। তাদের প্রত্যেককে মেরে ফেলা হবে। একেকটা লিস্ট তৈরি করে, একসঙ্গে অনেকজনকে নিয়ে সুন্দরভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে তাদের। এটাকেই বলে ইউথেনাশিয়া বা মার্সি কিলিং।’
ভিক্টর আবার চমকে উঠল। অ্যাডলফ ভোটে জেতার পর এমন একটা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর আর কিছু না হতে ভেবেছিল গুজব।
অ্যাডলফ বলতে লাগলেন, ‘দুই জার্মানির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে যাতে কোনো শারীরিক বা মানসিক বিকৃতি না আসে, সেইজন্য মানুষকে তার বংশগত কী কী রোগ আছে তা রেজিস্টার করে রাখতে হবে। আর এইজন্য আমি নতুন আইন আনব। স্বাস্থ্য আদালত তৈরি হবে, কেউ বিয়ে করতে চাইলে স্বাস্থ্য আদালতে অ্যাপ্লাই করতে হবে, তাদের দুজনের স্বাস্থ্য, বংশ সব খতিয়ে দেখে তবেই বিয়ের জন্য অনুমতি দেওয়া হবে।’
ভিক্টর এবার মুখ খুলল, ‘বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা! মানবে মানুষ?’
অ্যাডলফ তাঁর চৌকো গোঁফটা তা দিতে দিতে একটু অবাক হওয়ার ভান করে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, ‘আমার দেশে মানুষ আইন মানে না ভিক্টর, আমি মানতে বাধ্য করি। এটা তুমি জানো বোধ হয়! আর এটা তো ভবিষ্যতের কথা ভাবলে তাদের ভালোর জন্যই! অসুস্থ বিকৃত প্রতিবন্ধী জীবনের কোনো মানে আছে?’
ভিক্টর আবার চুপ করে গেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘কোনো রোগের রেকর্ড না থাকা দুজন সুস্থ মানুষ বিয়ে করলেই যে তাদের সন্তানও সুস্থ হবে এরকম কোনো গ্যারান্টি তো…!
অ্যাডলফ মাথা নাড়লেন, ‘গ্যারান্টি নেই ঠিকই, কিন্তু বিকলাঙ্গ হবার সম্ভাবনা তো অনেকটাই কমে যাবে, না? এমনকী এই নিয়ে প্লেটো একটা উপায়ও বলে গিয়েছিলেন, প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হবে, যাদের জিন খারাপ, রোগগ্রস্ত, তাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। শুধু গুড জিনের কাপলদেরই বিয়ের পারমিট দেওয়া হবে।’
ভিক্টর বলল, ‘তিন নম্বর?’
অ্যাডলফ বললেন, ‘তিন নম্বর হল, আমি পুরো জার্মান জাতির ওপর ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের ইউজেনিক্স অ্যাপ্লাই করব। জার্মান সেনারা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ক্লান্ত হবে না, জার্মান শিশুরা সব দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে, পায়ের তলায় রাখবে সারা বিশ্বকে। প্রতিটা জার্মান হবে গ্রিক দেবতাদের মতো সুন্দর, লিওনার্দোর মতো সৃজনশীল, আলেকজান্ডারের মতো সাহসী বীর আর,’ একটু থামলেন তিনি, ‘আমার মতো বুদ্ধিমান। কোনো খারাপ জিন তাদের শরীরে থাকবে না, এমনভাবেই তাদের তৈরি করা হবে।’
ভিক্টর এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘কী বলছেন স্যার! এসব তো রূপকথাতে হয় জানি। এরকমভাবে তৈরিটা করবেন কী করে! এ যে খোদার ওপর খোদকারি!’
অ্যাডলফ স্থির চোখে তাকালেন, ‘আমার কথা এখনও শেষ হয়নি ভিক্টর। গ্যালটন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু এতটাই চঞ্চলমতি ছিলেন যে কোনো কাজেই বেশিদিন লেগে থাকেননি। উনি এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন যা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে এটা করা সম্ভব আর পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রেও সেটা অ্যাপ্লিকেবল হবে। ওঁর ডায়েরিতে এমনই লিখে গেছেন উনি, আমি নিজে পড়েছি। সেটা আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে ভিক্টর। ভেবে দ্যাখো, এভাবে আমরা জার্মান জাতিকে কোথায় নিয়ে চলে যাব। আর তারপর ভার্সাইয়ের অপমানের বদলা, বিশ্বযুদ্ধের প্রতিশোধ সব একে একে নেব আমি।’ উত্তেজনায় চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে অ্যাডলফের, ‘আর হ্যাঁ। তার সঙ্গে সঙ্গেই চলবে জেনোসাইড, ইহুদিদের পুরো লুপ্ত করে দেওয়ার প্রসেস। ব্যাটারা বহু বছর ধরে আমাদের জায়গায় এসে আমাদেরকেই সব জায়গা থেকে বঞ্চিত করেছে। শালা রিফিউজির দল! বড়ো বড়ো গ্যাস চেম্বার তৈরি কর, তাতে যতগুলোকে পারো, একসঙ্গে ঢুকিয়ে লেথাল গ্যাস ছেড়ে দাও। ব্যস! খরচও কম হবে, ঝামেলাও নেই।’
ভিক্টরের মুখে বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। ও অপলক তাকিয়ে রইল চ্যান্সেলরের দিকে। ধবধবে সাদা হাতির দাঁতের কাজ করা সিংহাসনের মতো রাজকীয় চেয়ারে বসে তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছেন অ্যাডলফ হিটলার, জার্মানির বিখ্যাত দেশপ্রধান।
অ্যাডলফ বললেন, ‘আর হ্যাঁ, আগেই বলেছি, গ্যালটন ইংল্যান্ডের লোক ছিল। বার্মিংহামে বাড়ি। শত্রু দেশ, কাজেই সতর্ক হয়ে এগোতে হবে তোমায়। টাকার চিন্তা কোরো না, যত টাকা ইনভেস্ট করতে হয়, করব আমি। কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা করবে।’
ভিক্টর এবার হাতে ধরে রাখা টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাননীয় চ্যান্সেলরকে একটা স্যালুট ঠুকল, বলল, ‘বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দিন স্যার। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই জানাচ্ছি আপনাকে।’
অ্যাডলফও উঠে দাঁড়ালেন। ভিক্টর ছেলেটার সম্পর্কে পুরো ডেটা আছে ওঁর কাছে। অর্থনীতি নিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার পরে সব ছেড়েছুড়ে পার্টিতে যোগ দিয়েছে। বেশ উদ্যমী ছেলে, মিউনিখে নাতসি পার্টির যে হেডকোয়ার্টার আছে, সেই ব্রাউন হাউসে ইতিমধ্যেই একে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এমন ছেলেই তো তাঁর চাই!
পারলে এ—ই পারবে।
অ্যাডলফ স্যালুট গ্রহণ করলেন না, পরিবর্তে করমর্দন করলেন ভিক্টরের সঙ্গে, ‘এই তিনটে অ্যাজেন্ডার যে অপারেশন চলবে, তোমাকে তার প্রধান নিযুক্ত করতে চাই আমি। হেলথ ডিপার্টমেন্টের যে কোর্ট তৈরির কথা বললাম, তারও প্যানেলে আমি তোমাকেই রাখব। এই বয়সে এই সব পোস্ট পেলে ভবিষ্যতে কতদূর উঠতে পারবে তুমি কল্পনা করতে পারছ?
ভিক্টর বিমূঢ়ভাবে মাথা নাড়ল। এই ক—দিন আগেও সে ছিল পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। আর এখন সে একটা এত বড়ো মিশনের হেড?
চ্যান্সেলর নিজে তাকে এই দায়িত্ব দিচ্ছেন?
ও এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল, কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল।
চ্যান্সেলরের কথা শেষ হয়ে গেছে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হয়েও একবার পেছনে ফিরলেন জার্মানির দেশপ্রধান। কেটে কেটে বললেন, ‘ভিক্টর, খুব শিগগির পোল্যান্ড অ্যাটাক করে যুদ্ধ ঘোষণা করব আমি। জার্মানিকে আগের যুদ্ধে যাদের কাছে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হয়েছিল, যাদের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে আমরা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম, সেইসব দেশকে তছনছ করে দেব। আর হ্যাঁ!’ অ্যাডলফ কী—একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইহুদিগুলো সব শেষ হলে ওদের শরীরের নানা অর্গ্যান প্রিজার্ভ করে রাখতে হবে একটা মিউজিয়ামে।’
ভিক্টর বলল, ‘মিউজিয়াম!’
‘ইয়েস!’ বললেন, অ্যাডলফ, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তো জানা উচিত যে কেন আমি একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করেছি? ওদের জিন কত ইনফিরিয়র, কত নিকৃষ্ট, সেটা তো রেকর্ড করে রাখতে হবে, না!’