১৪
‘হোয়াটসঅ্যাপে এইসব কী পাঠিয়েছ!’ আঁতকে উঠল সিগফ্রেড ফোনটা করেই।
‘এ কী! চিনতে পারছ না! কিন্তু যাকে ছবি তোলার দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে তো এ ব্যাপারে যথেষ্ট এক্সপার্ট! ভালো করে আগুনে পুড়িয়ে তারপর বেশ ফটোজেনিক অ্যাঙ্গল থেকেই তো ছবিগুলো তুলেছে যতদূর জানি।’ ওপাশের গলাটা কথাটা বলল বেশ তির্যক সুরে, রসিয়ে রসিয়ে।
‘তুমি ক্যানাবিসের পুরো স্টকটা আগুন ধরিয়ে দিলে?’ ককিয়ে উঠল সিগফ্রেড।
‘না না, পুরোটা নয়। মাত্র তিনটে প্যাকেট। পুরোটাও পুড়বে, তবে আর কয়েকদিন পরে। কী করব, একে ব্যানড জিনিস, তার ওপর কথার দাম তো রাখতেই হবে সিগফ্রেড। যেমন তোমার মাকে কোন যুগে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম বলে তোমার মতো অপোগণ্ডকে আজও পুষতে হচ্ছে আমায়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ করছি তোমার পেছনে।’
সিগফ্রেডের মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল, মনে হল, যা মনে আছে সব উগরে ফেলে ও, সহ্যের একটা সীমা আছে। ওর নিজের প্রাপ্য টাকা বিকৃতমনস্ক নরকের কীটটা দখলে রেখে দিয়ে ওকেই ব্ল্যাকমেল করে চলেছে দিনের পর দিন!
কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না। বদলে চোখে জল এসে গেল হঠাৎ। ওর এই নরম মনের সুযোগ নিয়েই তো লোকটা দিনের পর দিন নিংড়ে চলেছে ওকে। অথচ আজ দাদা যে উচ্চতায় গেছে, ততটা না হলেও কিছু তো ভালো করতে পারত ও জীবনে! ইতিহাস নিয়ে পড়ে অন্তত নিজের মনে ঘুরে বেড়াত দেশবিদেশ। বদলে কী পেল? ছোট্ট থেকে একটা বদ্ধ ঘরে পাহারার মধ্যে মানুষ হল, আর বড়ো হয়ে সেই বন্দিদশা আরও বেড়ে গেল।
সেই ছোটোবেলা থেকে শারীরিক মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হতে নিজেকে অসংখ্যবার শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছে, শেষ মুহূর্তে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে মনের জোর। অবশেষে ড্রাগের দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে ভুলতে চেয়েছে দুঃখ। তাতেও নিস্তার পায়নি, উলটে সেটাকেই ওর দুর্বলতা ধরে নিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে একের পর এক অবৈধ কাজ।
পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা ভাবলে তো কেঁপে ওঠে, কীভাবে উলটো ক্রাইমে ফাঁসিয়ে ওকেই একবার লোকটা জেল খাটানোর উপক্রম করেছিল।
মায়ের মুখ আজ আর মনে পড়ে না, তবু একটা যে অস্পষ্ট ফটোগ্রাফ আছে ওর কাছে, সেটা দেখে মা—কে মাঝে মাঝেই বলে সে, কেন এমন করলে মা আমার সঙ্গে! কেন একটা পশুর কাছে টাকা পয়সা সব দিক দিয়ে বেঁধে রেখে গেলে আমায়!
সিগফ্রেড স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘আমি চেষ্টা করছি। ওই ব্যাপারটায় একজন অনেকটা এগিয়েছে, হোপফুলি বের করতে পারবে।’
ওপাশের গলাটা গর্জে উঠল, ‘আগের দিনও তুমি এই কথাই বলেছিলে। আর তুমি কি সবাইকে প্রচার করে বেড়াচ্ছ নাকি হাতে মাইক নিয়ে?’
‘না না!’ ও তড়িঘড়ি বলল, ‘আমি অন্য গল্প বলেছি। প্লিজ আর দু—দিন দেখো।
ওপাশের গলাটা এবার অধৈর্য শোনাল, ‘আর কতদিন দেখব? আমার কাছে তো অরিজিন্যাল নেগেটিভগুলো রয়েছে, কোনো উপায়ে কেউ সেগুলোর খোঁজ পেলে তো আমি ফেঁসে যাব। তার ওপর সামনের মাসে দেশে ইলেকশন। গদি উলটে গেলে ড্যানিয়েল আর হেলথ মিনিস্টার থাকবে না, গদি না উলটোলেও থাকার চান্স কম, ওর পার্টি ইতিমধ্যেই ওর ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে। ড্যানিয়েল ওই পোস্ট থেকে সরে গেলে আমার ছেলেগুলোও কিছু করতে পারবে না। তাই সামনের মাসের আগেই আমাদের যে করে হোক মেডিসিনটা অ্যাপ্লাই করতেই হবে সিগফ্রেড, নাহলে এতগুলো ছেলেকে ট্রেনিং দেওয়া, এত টাকার আর্মস, এতগুলো প্ল্যানমাফিক কাজ, এত ইনভেস্টমেন্ট, পুরো মিশনটাই জলে যাবে আমার।’
সিগফ্রেড বলতে গেল, ‘আমি আমার বেস্ট চেষ্টাটাই করছি।’ কিন্তু তার আগেই ওপাশের গলা আবার ধমকে উঠল, ‘নাহ, তোমাকে না ইনভলভ করলেই ভালো হত দেখছি ব্যাপারটায়। এত ভালো স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলাম, ভেবেছিলাম শুধু ওদের সরাব, কিন্তু টেলিপ্যাথিকালি ঠিক এইসময়েই নেগেটিভগুলোরও খোঁজ মিলল, ভাবলাম এটা নির্ঘাত দাদুর আশীর্বাদ! ছোট থেকে দাদুর ডায়েরিতে যা পড়ে এসেছি, সেটা যে এইভাবে পাওয়া যাবে, ভাবতেই পারিনি। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে এসে মনে হয় তোমার জন্য সব বানচাল হবে!’
সিগফ্রেড হতাশ হয়ে ফোনটা রাখল। লোকটাকে ঘৃণার থেকেও বেশি এখন ভয় করতে শুরু করেছে ওর। লোকটা তার দাদুর উপর দিয়ে যাচ্ছে। জার্মানির খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যার কবজায়, সারা ইউরোপ জুড়ে যার এতই স্ট্রং নেটওয়ার্ক যে কোনো দেশেরই পুলিশ এতদিনে এতগুলো অ্যাটাকের কোনো হদিশ করতে পারছে না, সে না জানি আরও কত কী ভয়ংকর কাজ করতে পারে, বিশেষত সে যদি একটা সাংঘাতিক সাইকোপ্যাথ হয়।
তাও তো সিগফ্রেড এটা বলেনি যে ছবিগুলোই ওর কাছে নেই, বললে যে কি হত!
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলোকে ফেরত পেতে হবে। একটা নিশ্বাস ফেলে কেমিস্ট্রির বইতে মনোনিবেশ করল ও। দু—দিন ধরে এইসব পড়ে কেঁচে গণ্ডূষ করতে হচ্ছে ওকে। মেয়েটা এত ধুরন্ধর আগে বোঝা যায়নি, একটু ক্যাজুয়ালি নিয়ে ফেলেছিল সিগফ্রেড, গল্প ফেঁদেছিল হালকাভাবে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মাত্র একটু তাল কাটলেই বিপদ!
তখন আরেক উটকো ঝামেলা হাজির হবে।
ও জানতেও পারল না ওর কলটা কেটে দিয়েই ওপাশের অধৈর্য লোকটা আরেকজনকে ফোন লাগিয়েছে, ‘সিগফ্রেডের দিকে নজর রাখো, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে। জলদি রিপোর্ট চাই আমার। ছবিগুলো ওর কাছে আছে কি না কনফার্ম করো।’