১১
‘কোলনের ব্লাস্টে স্যার একদমই খুশি নন। পেছনের জন স্পটডেড হয়নি কেন? দু—দিন অবধি বেঁচে ছিল!’ সামনে বসা কুড়ি থেকে পঁচিশ জন ছেলের সামনে মাস্টারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে কে ছিল ওটায়?’
দুটো ছেলে আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল। ওই লিডার গোছের মহিলাকে বাদ দিলে এই হল ঘরটায় থাকা সবারই বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে।
এই বয়সটাই সবচেয়ে ভালো। শরীরে রক্ত গরম থাকে, ঠিকভাবে উদবুদ্ধ করতে পারলে এরা মিশন সাকসেসফুল করার জন্য জান লড়িয়ে দেয়।
মহিলাটিকে দেখে এক লহমায় তার বয়স বোঝা মুশকিল, চল্লিশও হতে পারে। আবার ত্রিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। খয়াটে গড়ন, খানিকটা কুঁজোও।
সামনের ছোটো করে ছাঁটা সোনালি চুলে মুখটাকে বেশ নিষ্ঠুর দেখায়।
উঠে দাঁড়ানো ছেলে দুটোর মধ্যে একজন বলল, ‘থ্রোইংটা ঠিক হয়নি একটু সরে গিয়েছিল, বাইকটাও হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে দিয়ে দিল…!’
মহিলা সরু চোখে জরিপ করলে ছেলে দুটোকে কিছুক্ষণ, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমরা কি কোনো শট পাট কম্পিটিশনে গিয়েছিলে?
ছেলেটা এইরকম অদ্ভুত প্রশ্নে প্রথমে হকচকিয়ে গেল, তারপর বিস্মিত মুখে মাথা নাড়ল।
মহিলা চিৎকার করে উঠল, ‘তবে এখনও এইরকম ছেলেমানুষি ভুল হয় কী করে? আগের মিশনগুলোয় যারা গেল, এমনই একটা ভলিয়ুমে স্লোগানটা বলল কেউ শুনতেই পেল না, এটাতে আবার দু—দিন বেঁচে রইল ভিক্টিম। তোমাদের পেছনে কত ইউরো করে খরচ করা হচ্ছে, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? তোমাদের বাড়িতে মাসের প্রথমেই যে মোটা টাকাটা পৌঁছোয়, সেটা কি এইরকম ইয়ার্কি মারবার জন্য?’
ছেলেটা মাথা নীচু করল।
বাইরে একটানা কোথাও একটা পাখি ডেকে চলেছে। টুপটাপ শব্দে জল পড়ছে বাইরের ভাঙাচোরা কার্নিশে।
এইরকম অলস দুপুরে কারুর খুন জখমের কথা শুনতে ভালো লাগে?
জার্মানির দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চল। এর চারপাশে রাইন নদীর ঢালু উপত্যকা ছড়িয়ে থাকলেও গভীরতায়, বৈচিত্র্যে, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে ব্ল্যাক ফরেস্ট ইউরোপের অন্যতম সুবিস্তৃত অরণ্যভূমি। কোথাও এতটাই ঘন যে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢুকতে পরে না, কোথাও বরফে ঢাকা হিমবাহ, কোথাও আবার গড়ে উঠেছে ছোটো গ্রাম, ছোটো জনবসতি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে।
ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের নাম এসেছে এই অঞ্চল থেকেই। কেউ মনে করে এই জঙ্গলের আলো আঁধারি মেশানো কালো অন্ধকার, তার মাঝে শুভ্রশীতল বরফের ছোঁয়া, আর মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি নাম—নাজানা ফুলের গাছ, এই ডিজাইনটাই ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকে আনা হয়েছে, কোকো কেকের উপর সাদা ক্রিম আর লাল চেরির টপিং দিয়ে।
আবার কারুর মতে ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলে বসবাসকারী এক উপজাতির মহিলারা যে বিশেষ পোশাক পরতেন, কালো রঙের ঘাগরা, সাদা রঙের ব্লাউজ, আর লাল উলের টুপি, সেখান থেকেই ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের উৎপত্তি।
প্রাচীন যুগ থেকে এখানে অনেক জাতি উপজাতি বসবাস করলেও গত দু—তিনশো বছর ধরে এই বিশাল জায়গাটা বিভিন্ন যুদ্ধের সময় আদর্শ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। শোনা যায় এই জঙ্গলেরই মধ্যে লুকোনো এক বাঙ্কারে একবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল হিটলারকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে অসংখ্য লুকোনো বাঙ্কার সারা ইউরোপে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে ছিল, এটা তারই একটা। চট করে বাইরে থেকে দেখলে বোঝাই যায় না যে জঙ্গলের আড়ালে এমন একটা পরিত্যক্ত বিশাল টানেল আছে, যার মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে এই ছেলেগুলোর ট্রেনিং চলছে। প্রথম থেকেই টিমের কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, তাই সংখ্যা না বাড়িয়ে এই পঁচিশটা ছেলেকেই ঘষে—মেজে তৈরি করা হচ্ছে। এদের দেখভাল, ট্রেনিং—এর দায়িত্বে রয়েছে মোট চারজন।
নিঝুম হল ঘরে ছোটো সোনালি চুলের মহিলাটি পায়চারি করার ভঙ্গিতে চলতে চলতে প্রতিটা ছেলেকে গভীর চোখে পরখ করছিল। তারপর গলা নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘তোমাদের বয়সি ছেলেরা যে টাকাটা পাচ্ছ, সেটা বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউসও পে করে না এই বয়সে। তোমাদের জামা, জুতো, ঘড়ি এভরিথিং ইজ ব্র্যান্ডেড। ওয়ার্ল্ড ক্লাসের ট্রেনিং প্রোভাইড করা হয় তোমাদের। কেন? বিকজ ইউ পিপল আর দ্য রিয়েল সেভিয়ার অফ ইউরোপ! তোমাদের হাত ধরেই সব কিছু আবার নিট অ্যান্ড ক্লিন হবে। নিজেদের তোমরা দেশপ্রেমিক মনে করতে শেখো, তবেই কাজে মন আসবে। বুঝেছ?’
ছেলেগুলো নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
সোনালি চুল বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘এভাবে চললে তো কোনো দেশই বুঝতে পারবে না আমাদের আসল মোটিভ। অ্যাট লিস্ট আমাদের উদ্দেশ্যটা তো আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে দিতে হবে! আরে আমরা তো কোনো ছিঁচকে টাইপ টেররিস্ট নই! আমরা যা করছি, দেশের জন্য করছি! এই যে আইসিসরা কোনো পরিষ্কার মোটিভ ছাড়াই এইভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, কালও নিউজ চ্যানেলে দেখলাম, একটা ইয়াজিদি মেয়েকে পাঁচদিন না খাইয়ে তারপর তার বাচ্চার মাংস রেঁধে খাইয়েছে, লক্ষ লক্ষ মেয়েকে যৌনদাসী হিসেবে অমানুষিক অত্যাচার করছে ওরা, কেন? কারণ ওরা মুসলিম নয়। আমরা কি এইরকম কোনো বিকৃত কাজ করছি? আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, ইউরোপকে শুদ্ধ করা, ইউরোপকে সুপ্রিমে নিয়ে যাওয়া। বুঝতে পারছ তোমরা?
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার বলল, ‘আর কিন্তু এক সপ্তাহ বাকি আছে ফাইনাল মিশনের। তার আগে ট্রেনিং—এ কারুর কোনো গাফিলতি যেন না চোখে পড়ে আমার! স্যারের কাছে কিন্তু ডিটেইলড রিপোর্ট যাবে প্রত্যেকদিনের।’
একটু আগে ধমক খাওয়া ছেলেটা পাশের জনের কানে ফিসফিস করল, ‘তারপর কি আমাদের কাজ শেষ?’
পাশের জন দলের মধ্যে একটু মুরুব্বি গোছের, সে বলল, ‘এই মিশন শেষ। তারপর অন্য কাজ, যতদূর জানি।’ একটু চোখ ছোটো করে হাসল সে। ‘তোমার চাপ কীসের? আমাদের ডিউটি ইউরোপকে বাঁচানো, বেস্ট পারফরম্যান্স দেওয়া, আমরা দিয়ে যাব, সে যে কাজই হোক!’
ধমক খাওয়া ছেলেটা ঢোঁক গিলল। এরা সবাই নিজেদের একেকটা হিরো ভাবছে, এমন মগজ ধোলাই করা হয়েছে। গোটা ইউরোপকে নাকি বাঁচাবার দায়িত্ব ওদের এই মাত্র ক—জনের কাঁধে। আরে ভাই, সব দেশের বড়ো বড়ো আর্মি ফোর্সগুলোর কাজ কী তাহলে? আর তা ছাড়া মানুষকে মেরে কী করে কোনো দেশকে বাঁচানো যায়, সেটা ওর মাথায় ঢোকে না। ও নিজে এত কিছু বোঝেও না, অন্যদের মতো কোনো দেশপ্রেমও উথলে ওঠে না ওর, শুধু টাকার জন্য জীবন বিপন্ন করে পড়ে রয়েছে এখানে। এসেছিল টাকার লোভে, আর এখন তো বেরোনোর পথ পুরোপুরি বন্ধ। প্রতিটা মিশনে যাওয়ার আগে ওরা না ফিরলে যে কত টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে ফ্যামিলির কাছে, সেই লোভেই বিভোর থাকে ওরা এখন।
সোনালি চুল আবার বলল, ‘ফাইনাল মিশনের দিন স্যার নিজেও থাকবেন। বুঝতেই পারছ কতটা অপটিমাম লেভেলে পারফর্ম করতে হবে তোমাদের? একটুও যেন কোনো কিছু এদিক থেকে ওদিক না হয়।’
ছেলেটা একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলল। এই স্যার বলে লোকটার কথা দিনে অন্তত চারবার করে শুনেত হয় ওদের।
এই ‘স্যার’ লোকটা কে ভাই?
ওরা প্রত্যেকে যেন ঘড়ির কাঁটায় চলা একেকটা রোবটে পরিণত হয়েছে!
আচ্ছা ওরা কি সত্যিই দেশপ্রেমিক?