নরক এক্সপ্রেস – সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
জলটা চেপে এল৷ ঝড়ের ধাক্কায় দোর-জানলা কেঁপে কেঁপে উঠছে৷
রাত দশটা বেজে গেছে তখনো আমরা বসবার ঘরে আড্ডা দিচ্ছি৷ জয়ন্ত আমি আর সুরমা৷
‘আজ আর তোমার যাওয়া হয় না ভাই জয়ন্ত’—এই নিয়ে বার সাতেক অনুনয় করা হল জয়ন্তকে৷
সুরমা কথায় ঝাঁজ মিশিয়ে কৈফিয়ৎ চাইলো—‘আজ এই রাক্ষুসে রাতে রওনা না হলে কী আপনার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, বলুন তো জয়ন্তবাবু?’
‘দুই দিনের কড়ারে এসে আটদিন রয়েছি বউদি! এর পরে শেষকালে প্রহারেণ ধনঞ্জয় করবেন, সেটা না আপনাদের দিক থেকে শোভন, না আমার দিক থেকে বাঞ্ছনীয় হবে৷’
গম্ভীরভাবে এই কথা বলে একটা পান মুখে পুরলো জয়ন্ত৷
তার কথা বলার ধরন দেখে আমি হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলাম৷ সুরমারও ঠোঁটের কোণে দেখা গেলো হাসির ঝিলিক৷
কড় কড় করে বাজ পড়লো নিকটেই কোথাও৷
‘কিন্তু সত্যি বলো তো, এই দুর্যোগে দেরাদুন এক্সপ্রেসে চাপতে তোমার ভয় হবে না? ঈশ্বর না করুন, অ্যাকসিডেন্ট তো হামেশাই হচ্ছে!’
আমার তূণের শেষ বাণ এইটি৷ ট্রেন-দুর্ঘটনার ভয়েও যদি ও নিরস্ত না হয়, তবে আর উপায় কী? বন্ধু বই আর কিছু নয় যে জোর করে বলব—‘হবে না যাওয়া!’ বন্ধু মাত্র৷ তাও মাঝে কয়েক বৎসর কোনো খোঁজই রাখিনি ওর৷ হঠাৎ সেদিন একটা চিঠি এসে হাজির কে জানে কোথা থেকে আমার ঠিকানা জোগাড় করে নিয়ে জানিয়েছে—‘তোমার জঙ্গলে দুটো দিন কাটিয়ে আসতে চাই৷ পরশু রওনা হব৷’
আমার এটা জঙ্গলই বটে৷ ফরেস্ট অফিসার আমি, যে বাংলোতে থাকি, তা থেকে স্টেশন অন্তত আধ মাইল৷ রাস্তা পাকা বটে, কিন্তু নিরাপদ নয়৷ রাত্রে বুনো হাতি চলাচল করে, আর সাপ অগুনতি৷
জয়ন্ত এসেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল৷ বাস করতে হয় তো, এইরকম জায়গাতেই৷ একেবারে আইডিয়াল নিভৃত-নিবাস৷ বেশ আছ তোমরা—‘কপোতকপোতী যথা বাঁধি নীড় সুখে…৷’
‘থাকো না দিনকতক, তুমিও বেশ থাকবে’—এই বলে সুরমাকে ফিরিস্তি দিতে বসে গেলাম—ছাত্রজীবনে ও চা-য়ে কয় চামচ চিনি খেত, ডিমের পোচ পছন্দ করত, না মামলেট, আর ফুলের ভেতর বেলফুলের বেশি পক্ষপাতী ছিলো, না রজনীগন্ধার৷
‘দেরাদুন এক্সপ্রেসে ভয়?’—আমার কথা শুনে ঠোঁট বেঁকিয়ে উত্তর দিলো জয়ন্ত— ‘নরক এক্সপ্রেসে চড়েও বেঁচে ফিরে এসেছি যখন, পৃথিবীর কোনো ট্রেনের কোনো অ্যাকসিডেন্টই আমার কিছু করতে পারবে না ভাই!’
‘নরক এক্সপ্রেস?—সে আবার কী?’—দু’জনেই একসঙ্গে প্রশ্ন করলাম—সুরমা আর আমি৷
হাই তুলে দু’হাতে একসঙ্গে তুড়ি দিলো জয়ন্ত৷ ‘কথাটা বলে ফেলেছি তাহলে! এটা আমার একটা ব্যারামে দাঁড়ালো দেখছি৷ যেখানেই যাই—ঐ ছাই নরক এক্সপ্রেসের কথা না বলে পারিনে! এটা অবচেতন অহমিকা৷ একে দমন করতে হবে৷’
‘তা দমন করতে হয়, করো এর পর৷’—আমি পেয়ে বসলাম৷ ‘এখন তো গল্পটা আমাদের বলো৷’—আশা হল এই গল্পের নেশায় মেতে উঠলে ট্রেন-ধরার নেশা ছুটে যাবে হয়তো৷
হাত-ঘড়িতে সময় দেখলো জয়ন্ত৷ দশটা বাইশ৷ দেরাদুন এক্সপ্রেস এগারোটা পঞ্চাশে৷ দেড় ঘণ্টা৷ আধ মাইল যেতে—এই ঝড়-বৃষ্টির দরুন সময় বেশি লাগবে—তবু আধ ঘণ্টার বেশি কিছুতেই লাগতে পারে না৷ ‘এক ঘণ্টা হাতে আছে যখন, নরক এক্সপ্রেসের গল্পটাই শুনিয়ে যাই তোমাকে—’
‘বছর তিনেক হল লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম—যেমন চিরদিন বেড়াই৷ মধ্যভারতের ঐ দিকটায়৷
হঠাৎ একদিন বিকেল বেলা একটা ছোট্ট স্টেশন প্রথম নজরেই বড় ভালো লেগে গেলো৷ দূরে দূরে নীল পাহাড়, স্টেশনের লাল ঘরগুলি অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিলো তাদের ছায়ায়৷ আমগাছে কোকিল ডাকছে, হরিণ ছুটছে মাঠের ভিতর৷
ভালো যখন লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে৷ স্টেশনের নামটাও তখনো দেখিনি৷
আমি নামার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিলো৷ আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম ওয়েটিং-রুমের দিকে ব্যাগটা বিছানাটা কারো জিম্মা করে দিয়ে বেড়াতে বেরুব৷
স্টেশনের নাম দেখতে পেলাম—বুলন্দশহর৷
বুলন্দশহর! কী যেন মনে পড়ে-পড়ে, পড়ে না৷ ঐ নামের সঙ্গে জড়ানো কী যেন কবেকার একটা কাহিনী৷ রবিবাবুর গল্পে এক বুলন্দশহরের কথা পড়েছি না? যেখানকার নবাবপুত্রী—কিন্তু না যে-গল্পটা আমার মনের আনাচে-কানাচে উঁকি দিচ্ছে, অথচ ধরা দিচ্ছে না, সেটা কোনো নবাবপুত্রীর গল্প নয়৷
তবে, কী সেটা?
প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে মাঠে পড়েছি, মাঠ পেরিয়ে ঢুকে পড়েছি বনে৷ রেললাইন আমার পাশে পাশেই চলেছে৷
বন তখনো আদ্ধেক পেরুতে পারিনি, একটা নদীর ধারে এসে পড়লাম৷ সরু নদী, কিন্তু গভীর খুব৷ এখন গরমের দিনে জল বেশি নেই, মাঝে মাঝে চড়াও বেরিয়েছে৷ কিন্তু বর্ষার দিনে এ নদীতে যে অনেক জল থাকে আর স্রোতও হয় প্রবল, তা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম৷
এই নদীর উপর মজবুত কংক্রিটের পুল, তারই উপর দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন৷
কিন্তু বাঁয়ে ওটা কী? আর একটা পুল না?
একটা কাঠের পুল, মাঝখানে ভাঙা৷ অর্থাৎ হাতদশ-বারো জায়গায় না আছে কাঠ, না আছে লোহা না আছে থাম, না আছে লাইন৷
বেশ বোঝা যায়, ঐটিই এ-নদীর আদি পুল, এককালে ঐ পুল দিয়েই রেললাইন নদী পার হত৷
যা এতোক্ষণ কিছুতেই মনে পড়ছিলো না, তা চট করে মনে পড়ে গেলো এইবার৷ বুলন্দশহর! এই সেই বুলন্দশহর! তিন বৎসর আগে এই স্টেশনে, এই নদীর উপরেই একটা ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো৷ এক দুর্যোগের রাত্রে ঐ কাঠের পুলটা ভেঙে গোটা একখানা ট্রেন পড়ে গিয়েছিলো নদীর জলে৷ একটি প্রাণীও বাঁচেনি সে ট্রেনের৷
বটে! এই সেই বুলন্দশহর! ঐ সেই পুল!
একটা গোটা ট্রেনের সমস্ত যাত্রী সমুখের ঐ জায়গাটাতে জলে ডুবে মরেছিলো, জলে-ডোবা রেলগাড়ির কামরায় বন্ধ হয়ে, বা তার নিচে চাপা পড়ে৷ ঠিক খাঁচায়-বন্ধ ইঁদুর যে ভাবে জলে ডুবে মরে, সেই ভাবে৷
মনে পড়ে৷ আর কল্পনাতে শিউরে শিউরে উঠি৷
হঠাৎ খেয়াল হল—সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ পূব আকাশে ঐ জ্যোছনা চিকচিক করছে— মস্ত-বড় চাঁদ, দ্বাদশী বা ত্রয়োদশী তিথি হবে৷
রাতে বেড়ানো অভ্যাস আছে৷ বাঘ-ভাল্লুককে বড়-একটা কেয়ার করি না৷ তবু আজ এই পহাড়ে নদীর ভাঙা পুলের কাছে ভর-সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে গা ছমছম করে উঠল৷ জানা জিনিসের চাইতে অজানার ভয় আমাদের হাড়ে মজ্জায় অনেক বেশি নিবিড় করে মেশানো আছে৷ আমি তাড়াতাড়ি স্টেশনের দিকে পা চালিয়ে দিলাম৷
ছোট্ট জায়গা, বাজার দোকান নেই বললেই হয়৷ এক ভুজাওয়ালার দোকানে ডাল- রোটির ব্যবস্থা করতেই দু’ঘণ্টা কেটে গেলো৷ তারপর ফিরে এলাম প্ল্যাটফর্মে৷
স্টেশনমাস্টারকে টিকিটখানা দেখানো দরকার ছিলো৷ মাঝপথে নেমে পড়েছি এই টিকিটেই বাকি দূরত্বটুকু পাড়ি দেওয়া চলবে তো?
‘চলবে’—একগাল হেসে উত্তর দিলেন তিনি৷
লোকটিকে মিশুক অমায়িক বলেই ধারণা হল৷ আমার হাতে কাজ নেই তো বটেই তাঁরও কিছু আছে বলে মনে হয় না৷ অনাহূত একটা টুল অধিকার করে গল্প শুরু করা গেলো৷
‘বেশ জায়গাটি আপনাদের৷’
‘তা যা বলেছেন৷’ মাস্টারমশাই উত্তর করলেন—‘জায়গাটি এমনিতে বেশ তবে বাঘ-ভাল্লুক আছে আর—’
‘আর’ বলে থেমে পড়লেন ভদ্রলোক৷
‘আর কী?’—আমি জিগ্যেস করলাম—‘কী যেন বলতে বলতে থেমে গেলেন বোধ হচ্ছে?’
‘না, ও কিছু নয়৷ বছর তিনেক আগে এইখানটাতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, শুনে থাকবেন৷ বেশ বড়-রকমের অ্যাকসিডেন্ট৷
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’—আমি আগ্রহের সঙ্গে সায় দিলাম—‘খুব শুনেছি৷ পুল ভেঙে—’
‘লোকের মাথায় পোকা আছে, জানেন তো?’—স্টেশনমাস্টার বললেন—‘ভূত থাক না থাক, লোকে ভূতের গল্প করতে ভালোবাসে৷’
একটা মালগাড়ি এসে পড়লো৷ স্টেশনমাস্টার তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে৷
ভূতও আছে তাহলে এই ছোট্ট জায়গাটিতে থাকবে বই কি! শত শত লোকে পাইকারি হারে একসাথে যেখানে মারা যায়—
বেরিয়ে ভুজাওয়ালার দোকানে হাজিরা দিলাম৷ ডাল-রোটি সে পাকিয়ে ফেলেছে৷ আমিও চোখ কান বুজে খেয়ে ফেললাম৷
ওয়েটিংরুমে ফিরে এসে একটা বেঞ্চি অধিকার করলাম৷ সতরঞ্চিটা পেতে, কম্বল মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম আরাম করেই৷ রাত একটায় আমার ট্রেন৷ ঘুম যদি ঠিক সময়ে ভাঙে, ধরব সেটা৷ যদি না ভাঙে, কুছ পরোয়া নেই, কাল সকালে যে ট্রেন পাব, সেটাইতে উঠে পড়ব৷ রাত একটার গাড়ি আমায় ধরতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ আমায় দেয়নি৷
দেহ ক্লান্ত, কিন্তু ঘুম সহজে আসে না৷ এটা, ওটা, নানা চিন্তা৷ কলকাতার মেসে এক বামুন ঠাকুর ছিলো, সে অড়হর-কা দাইল রাঁধত—চমৎকার৷ আজকের এই ভুজাওয়ালার ডাইল তার কাছে কিছু না৷ মেসের সেই বামুন ঠাকুর দাঙ্গার সময় খুন হয়, ভূত হয়ে সে সারা রাত রান্নাঘরে হাঁড়ি-কড়া ঘটঘট করত৷ ট্রেনভর্তি যে লোকগুলো তিন বছর আগে এখানে নদীর জলে ডুবে মরেছে, তাদের মধ্যে মেসের ঠাকুর কেউ ছিলো কিনা, কে বলবে?
কিন্তু, এত লোক ওয়েটিংরুমে ঢুকলো কেন? কখনই বা ঢুকলো? একটু বোধহয় তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো এর ভেতরে৷ এরই মধ্যে ঘর যেন গিস গিস করছে লোকে৷ চুপি চুপি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, ফিসফাস কথা কইছে পরস্পরে৷ এরা কোন ট্রেনে যাবে? রাত একটার সেই ট্রেনে? ভীষণ ভিড় হবে দেখছি!
চোখ মেলে লোকগুলোর দিকে চেয়ে দেখবার উৎসাহ আর হল না৷ চৈতন্য হারিয়ে ফেললাম ঘুমের কোলে৷
কে জানত—এ ঘুম কাল ঘুম?
কতক্ষণ এই কাল ঘুমে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ ঘুম ভাঙলো একটা অস্পষ্ট কোলাহলে৷ ঘর-ভরা লোক দুদ্দাড় ছুটে চলেছে৷ ট্রেনে উঠবার জন্যে নাকি? উঠে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি—তাই বটে, গাড়ি এসে গিয়েছে, দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মের পাশে৷ উঃ, খুব সময়মতো ঘুমটা ভেঙেছে৷
তাড়াতাড়ি বিছানাটা গুটিয়ে বগলে তুললাম ব্যাগটা হাতে নিয়ে সুমুখেই যে কামরাটা চোখে পড়লো, উঠে পড়লাম তাতেই৷ আলোয়-আলো সারা গাড়ি, জানলায় জানলায় অগুনতি মানুষের মাথা, হাঁক-ডাঁক—কেউ চা-ওলাকে ডাকছে, কেউ চাইছে গরম দুধ, কেউ-বা দেশলাই বিড়ি!
গাড়িতে উঠে বসে পড়লাম একটা খোলা জানলার পাশে৷ হঠাৎ বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ কেন, কে জানে?
হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই তাই!
প্ল্যাটফর্মটা, স্টেশনঘরটা জনপ্রাণী-শূন্য৷
একটা আলো পর্যন্ত কোথাও নেই!
গাড়িতে কামরায় আলো ঝলক দিচ্ছিলো, তাই আগে লক্ষ্য করি নি স্টেশনের আলোর অভাব৷ এ কি রকম? দূরপাল্লার একটা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়িয়েছে৷ স্টেশনে আলো নেই, মানুষ নেই! ট্রেন স্টেশনে এসে ঢুকলো কি করে? সিগন্যাল না পেলে এখন ট্রেন ছাড়বেই বা কী করে? স্টেশনমাস্টারকে তো কোথাও দেখছি না! স্টেশনের ঘরটাই বন্ধ!
কিন্তু গাড়ি ছাড়লো ঠিকই৷ কেউ ঘণ্টা বাজালো না, কেউ নিশান দেখালো না, তবু ছাড়লো গাড়ি৷ ঘটাং-ঘট-ঘট-ঘটাং শব্দে দুলতে দুলতে স্টেশনের এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো৷
হাতঘড়ির দিকে দৈবাৎই চোখটা পড়েছিলো চমকে উঠলাম—রাত মোটে বারোটা!
আমার এক্সপ্রেস গাড়ি তো রাত একটায় আসবার কথা!
এ তবে কোন ট্রেন?
যাঃ, কোথায় গিয়ে পড়ব এবার, কে জানে! এমন রাগ হল স্টেশনমাস্টারটার ওপরে! লোকটা কিনা আমায় অম্লান বদনে বললো যে রাত একটার আগে কোনো গাড়ি নেই?
গাড়ি নেই যদি, এটা তবে কী?
পাশের এক ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলাম—‘ও মশাই, বিদেশী লোক, না-জেনে উঠে পড়েছি, গাড়িটা যাবে কোথায়?’
লোকটা একবার তাকিয়ে দেখলো আমার পানে, কিন্তু জবাব কিছু দিলো না৷ লোকটা কালা নাকি?
অন্য পাশে ছিলো এক পাৎলুন-পরা পার্শি৷ তাকেও জিগ্যেস করলাম ঐ একই প্রশ্ন৷ নাঃ, জবাব এও দিলো না৷
রেগে গেলাম রীতিমতো৷ স্টেশনমাস্টারের ওপর, এই সহযাত্রীদের ওপর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর৷ এরা আমায় উজবুক বানিয়ে ছেড়েছে! গোল্লায় যাও সব৷
রেগে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷
হঠাৎ খেয়াল হল—রাতটা বড় অন্ধকার ঠেকছে৷ চাঁদটা গেলো কোথায়? সেই সন্ধেবেলা দেখেছিলাম—এত বড় সোনার থালার মতো ত্রয়োদশীর চাঁদ সারা পৃথিবী আলোয় উজ্জ্বল করে তুলেছে—সে-চাঁদ আমার গেলো কোথায়? রাত মোটে বারোটা, ত্রয়োদশীর চাঁদ তো এক্ষুনি অস্ত যেতে পারে না!
তবে মেঘে ঢেকে ফেলেছে?
ওঃ, তাই বলো! জমাট মেঘ সারা আকাশে৷ কালো৷ নিকষ কালো৷ ঐ যাঃ, বিদ্যুৎ চমকালো যে!
শুধু বিদ্যুৎ? কড় কড় করে বাজ ডেকে উঠল৷ আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত গড়িয়ে ডাকতে ডাকতে ছুটলো৷ কড়-কড় কড়াৎ!
কোথায় ছিলো ঝড়, আর কোথায় ছিলো বৃষ্টি! দুই মিনিটের ভেতর প্রলয়-দুর্যোগ শুরু হয়ে গেলো৷ জানলা বন্ধ করে বসলাম সাবধানে৷ সহযাত্রীরা যেন ক্ষেপে উঠেছে ততোক্ষণে৷ ডাক ছেড়ে কাঁদছে, এ-ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে, কপাল চাপড়াচ্ছে, যেন ভয়ে আর নৈরাশ্যে৷
দুই একজনকে জিগ্যেস করলাম—‘ক্যা হুয়া, রোতা কাহে? তুফান বরখা কভি দেখা নেহি?’
কে কার কথা শোনে৷ আমার দিকে কানই দিলো না কেউ৷ সমানে কাঁদতে থাকলো বাপ-দাদার নাম করে৷
বিরক্ত হয়ে জানলা খুললাম৷ ঝড়-বাদলের ঝাপ্টা বরং সহ্য হবে, এদের এ পাগলামি অসহ্য৷
জানলা খুলে ফেললাম৷ সেই মুহূর্তে এল একটা বিদ্যুতের চমক৷ চোখের পলকে যা দেখলাম, তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো আমার৷
নদীর ধারে এসে পড়েছি আমরা৷ আর—
ডাইনে ঐ কংক্রিটের পুল৷
বাঁয়ে সেই ভাঙা কাঠের পুল৷
আমাদের ট্রেন কংক্রিটের পুলের দিকে গেলো না, বাঁয়ে মোড় খেয়ে তীরবেগে ছুটলো কাঠের পুলের পানে৷
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম৷ গাড়ি-ভর্তি পঞ্চাশটা লোকের ভয়ার্ত রোদনের ওপরেও আমি শুনতে পেলাম আমার নিজের সেই চিৎকার৷
ঘড়াস! ঘস! ঝপাস! ঝপ!
আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে খোলা জানলা দিয়ে লাফ দিলাম৷ গায়ের সমস্ত শক্তি একত্র করে লাফ দিলাম—কিসের ভিতরে লাফ দিচ্ছি, না দেখেই দিলাম লাফ৷
তারপর কী হল, জানি নে৷
জ্ঞান হল যখন, তখন আমি নবীনগরের হাসপাতালে৷ আষ্টেপৃষ্ঠে ব্যান্ডেজ বাঁধা৷ শুনলাম, সকালবেলায় কারা নাকি আমায় নদীর চড়ায় অজ্ঞান আর আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্টেশনে নিয়ে যায়৷ স্টেশনমাস্টার আমায় পাঠান হাসপাতালে৷
লোকটি ভালো৷ একদিন আমায় দেখতে এলেন হাসপাতালে৷ কথায় কথায় তাঁর মুখেই শুনলাম সব৷ ও ট্রেনটা আসলে ট্রেনই নয়, ট্রেনের ভূত৷ ওখানকার লোকে ওর নাম দিয়েছে—নরক এক্সপ্রেস৷ তিনবছর আগের সেই মারাত্মক দুর্ঘটনায় যে ট্রেনটা নদীতে উল্টে পড়ে গিয়েছিলো, সে এখনো রোজ রাতে একবার বুলন্দশহরের পাশ দিয়ে পুলের পানে ছোটে আর রোজ রাতে একবার ঝাঁপ খায় নদীর জলে৷
আমার বরাত মন্দ যে সেই ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম৷ আবার বরাত ভালো যে নরক এক্সপ্রেসও আমাকে নরকে নিয়ে যেতে পারে নি৷’
গল্প শেষ হল৷ সুরমা চুপ, আমিও চুপ৷ হঠাৎ জয়ন্ত গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো৷
‘এবার বেরুতে হয়৷ নইলে গাড়ি পাব না৷’
‘সত্যিই এই জল-ঝড়ে?’—আর কথা ফুটলো না আমার৷
‘সেরাত্রের জল-ঝড় এর চেয়ে বেশিই ছিলো ভাই৷ শুধু কি জল-ঝড়? চারিধারে ঘিরে ছিলো নরকের অধিবাসীরা৷ সামনে ছিলো মৃত্যুর হাতছানি৷ সেখান থেকে যখন ফিরতে পেরেছি, তখন কিছু ভয় করো না—আমি ঠিক পৌঁছে যাব৷’
বেরিয়ে পড়লো জয়ন্ত৷
তার বর্ষাতি-মোড়া সুদীর্ঘ দেহটা অচিরেই হারিয়ে গেলো বর্ষার ঘন-চিকের আড়ালে৷