নরকের শহর – ৫

পাঁচ

নীরবে আদেশ পালন করল পিট। নিউ টাউন হেলথ সেন্টারের লোকগুলোর মতই পেশিবহুল সে। তবে প্রতিনিয়ত অনিয়ম করেছে বলে মুখে অকাল বার্ধক্যের বলিরেখা। দৃষ্টিতে নেই ন্যায়-নীতির বালাই। তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত চেয়ে আছে রানার চোখে।

বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ইতালিয়ান সুন্দরী উলঙ্গ মহিলা। বয়স হবে অন্তত পঁয়ত্রিশ। অতৃপ্ত যৌন তৃষ্ণায় চিকচিক করছে দু’চোখের নীল মণি।

পিটের নাক বরাবর পিস্তল তাক করে ঘরে ঢুকল রানা। চোখ সরছে না এলিসা রসির ওপর থেকে।

প্রেমিকার পাশে গিয়ে থামল পর্নোগ্রাফার।

করিডর থেকে হামলা এলে সেটা ঠেকাতে তৈরি রানা। কোমরে হাত রেখে লোভী চোখে ওকে আপাদমস্তক চাটছে মিস রসি। ‘এখন কিন্তু অন্য কথা ভাবছি, পিট,’ খসখসে গলায় বলল সে। ‘এই যুবক যদি তোমাকে বাঁচতে দেয়, তো বরং চলেই যাও। এ হয়তো চাইবে আমার সঙ্গে…’

তাকে পাত্তা না দিয়ে পিটের দিকে তাকাল রানা। ‘তোমার পুরো নাম কী?’

ঢোক গিলল পর্নোগ্রাফার। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তোতলাতে শুরু করে বলল, ‘পি… পি…পিট! পিট ব্ল্যাক! আপনি আমার দিকে পিস্তল তাক করেছেন কেন?’

অস্ত্রের নল তার দিকে থাকলেও মহিলার দিকে তাকাল রানা। ‘আর আপনি বোধহয় মিস রসি

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলাল মহিলা। চোখ সরছে না রানার সুঠাম দেহের ওপর থেকে। ‘আর তুমি? তুমি কে!’

এলিসা রসি দৃঢ় মনের মানুষ, গলা শুনে বুঝে গেল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা।’

‘সেরেছে!’ মুখ শুকিয়ে গেল পিট ব্ল্যাকের।

‘তুমি আমাদেরকে খুন করবে না,’ বলল এলিসা রসি, ‘সেটা চাইলে আগেই করতে। তুমি এসেছ আসলে আমার ভাইয়ের খোঁজে।’

‘সে এখন কোথায়?’

‘তুমি ভেবেছ তোমার মত খুনিকে বলব নিজের ভাইয়ের খোঁজ?’ বলল মহিলা। ‘তুমি কি পাগল নাকি?’

মারা যাওয়ার ভয়ে মাথা বিগড়ে গেছে পিট ব্ল্যাকের। সরাসরি তার নাকের দিকে চেয়ে আছে রানার পিস্তলের মাযল। কাঁপা স্বরে বলল সে, ‘লিসা! সত্যি কথা বলো! আমরা তো জানি না অ্যালডো আসলে কোথায় গেছে! রানার চোখে চোখ রেখেও দৃষ্টি নামাল সে। ‘কিছুক্ষণ আগে সে ফোন করেছিল।’

প্রশংসার চোখে রানাকে দেখছিল মিস রসি। প্রেমিকের কথা শুনে রাগে লাল হয়ে গেল তার মুখ। ‘একদম চুপ, পিট!’

হড়বড় করে বলতে লাগল পর্নোগ্রাফার, ‘আপনিই আজ হেলথ সেন্টারে হামলা করেছেন, তা-ই না? লিসাকে অ্যালডো বলেছে, কিছু দিনের জন্যে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যাচ্ছে সে। কোথায় গেছে সেটা জানি না।’

সামান্য সরল মিস রসি, পরক্ষণে হাঁটু তুলে জোর এক গুঁতো লাগাল পিট ব্ল্যাকের গোপনাঙ্গে। হঠাৎ আক্রমণে লোকটার নাক-মুখ দিয়ে ভুস করে বেরোল শ্বাস। দু’হাঁটু এক করে কুঁজো হলো সে। দু’হাতে চেপে ধরেছে অণ্ডকোষ আর পেনিস। স্লো মোশনে কাত হয়ে পড়ল মেঝের কার্পেটে। বারবার কেঁপে উঠছে ব্যথায়।

পিট ব্ল্যাকের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রানাকে দে মিস রসি। ‘অ্যালডো কোথায় গেছে তা জানি না। আর যদি জানতামও, তো যত নির্যাতনই করা হোক, বলতাম না।’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে রানাকে দেখছে মহিলা। ‘তো এবার কী করবে তুমি? খুন করবে আমাকে?’

ধীরে ধীরে বেরেটার নল নামাল রানা। রাগে জ্বলছে ওর অন্তর। ভুলতে পারছে না অ্যালডো রসির সেই ডিভিডির দৃশ্য। বুঝে গেল ঝগড়াটে মহিলার কাছ থেকে কোন তথ্য পাবে না। এদিকে সে এমন কোন অপরাধ করেনি, যেজন্যে তাকে খুন করা যায়। বেডরুমে চোখ বোলাল রানা। বিছানার উল্টোদিকে ওয়াক-ইন ক্লসিট। বেরেটার নল দিয়ে সেদিকে এলিসা রসিকে যেতে ইশারা করল ও।

মেঝেতে শুয়ে আছে প্রায়-অচেতন পিট, তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল এলিসা রসি। ‘আর এর কী হবে?’

বেরেটার বাঁট যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে রানার হাতের তালু। ‘শুনেছি পিট ব্ল্যাক তৈরি করে ব্লু ফিল্ম। সেক্ষেত্রে সে কি বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে অভিনয় করায়?’

চোখ পিটপিট করল মিস রসি। ‘তুমি কি পাগল? আমি পিটের সঙ্গে ফূর্তি করলেও অমানুষ তো আর নই! শিশুদের ক্ষতি করবে এমন কারও সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’

বেরেটার ট্রিগার থেকে তর্জনী সরিয়ে বলল রানা, ‘আজ এই নোংরা লোকটাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলে। যাও, এবার দেরি না করে দু’জনেই গিয়ে ঢোকো ক্লসিটে।’

‘আমি ঢুকব না,’ রেগে গিয়ে বলল মহিলা। ‘বিশেষ করে এই ছ্যাঁচড়া ছুঁচোর সঙ্গে নয়!’

‘অবশ্যই ঢুকবে,’ বলল রানা। পরক্ষণে সামনে বেড়ে পিস্তলের বাঁট ঠকাস্ করে নামাল মহিলার কপালের ওপরে। জ্ঞান হারিয়ে যেতেই উল্টে গেল এলিসা রসির চোখ। হুড়মুড় করে পড়ত মেঝেতে, কিন্তু বিদ্যুদ্বেগে সামনে বেড়ে বামহাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল রানা। ডালা খুলে মহিলাকে নামিয়ে দিল কুসিটের মেঝেতে। ফিরল পিট ব্ল্যাকের কাছে। এখনও গোঙাচ্ছে সে। জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে ক্লসিটের ভেতরে তাকে গুঁজল রানা। ঝুঁকে পর্নোগ্রাফারের মাথায় জোরে নামাল বেরেটার বাঁট। তাতে থেমে গেল গোঙানি। জ্ঞান হারাতেই ঘড়ঘড় শব্দে নাক ডাকছে লোকটা।

কুসিটের দরজায় তালা মেরে বিছানার ওপরে চাবিটা ফেলল রানা। ঘর ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল একতলায়। কিচেন পার করে বেরোল রাতের আঁধারে। ঝোপঝাড় ও ফার গাছের আড়াল নিয়ে পৌঁছে গেল দেয়ালের কাছে। নেমেছিল বাগানের এখানেই। পকেট থেকে জ্যামার নিয়ে অফ করল যন্ত্রটা। দূরে গেটের কাছে পায়চারি করছে দুই গার্ড। দড়ি বেয়ে দেয়ালে উঠতে দশ সেকেণ্ড সময় নিল রানা। নেমে এল রাস্তার এদিকের জঙ্গুলে জায়গায়। গেটের দিকে চেয়ে দেখল, কখন যেন চলে গেছে পুলিশের গাড়িটা।

পোর্শের দিকে পা বাড়িয়ে পকেট থেকে স্মার্টফোন নিল রানা। কল দিল বিসিআই-এর রায়হান রশিদকে। একবার রিং হতেই ধরল ওর ভক্ত। ‘জী, মাসুদ ভাই! কিছু বলবেন?’

‘শিকাগোয় মাফিয়া ডন রসির বেডরুমে পেয়েছি অসংখ্য ডিভিডি। শিশুদেরকে ধরে এনে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে সে। প্রথমে ভেবেছি স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের প্রতিশোধ নিলেই হবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, শিশুদের দিয়ে যারা এসব ব্লু ফিল্ম তৈরি করছে, সেই গোটা সিণ্ডিকেটের কারও প্রাণে বাঁচার কোন অধিকার নেই।’

‘আপনার ‘কথায় ঢুকেছি আমেরিকান সরকারের কিছু অফিসের কমপিউটারে,’ বলল রায়হান রশিদ, ‘বাদ পড়েনি এফবিআই হেডকোয়ার্টার। তারা কিন্তু মাফিয়ার পয়সা নিয়ে চুপ করে আছে, তা নয়। আসলে তাদের হাত-পা বোধহয় বাঁধা। ওয়াশিংটনে ক্ষমতাশালী কয়েকজন রাজনৈতিক লবিস্ট রেখেছে মাফিয়া দলগুলো।

‘সেটা জানি,’ বলল রানা। ‘আমার চাই এমন একজনকে, যে অ্যালডো রসি আর শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত।’ পিট ব্ল্যাকের কথা মনে পড়তেই জানাল, ‘এরই ভেতরে কিছু সূত্র পেয়েছি। হয়তো তাতে পৌঁছুতে পারব অ্যালডোর কাছে।’

‘আমি আরও খোঁজ নিচ্ছি, মাসুদ ভাই,’ বলল রায়হান। ‘আপনার বোধহয় একটা কথা জানা নেই। শিকাগোতে হার্বার ইয়ট ক্লাবে ডনের আছে বিলাসবহুল ইয়ট। ওটার নাম প্ল্যাটিনাম। লোকটা ওখানেও গিয়ে থাকতে পারে।’

ইয়ট ক্লাবের ফোন নাম্বার মনে আছে রানার। ‘এখন ইয়টিং মৌসুম নয়। হয়তো সেজন্যেই ওখানে তাকে পাব। এদিকে তোমার কাজ হবে দুটো গাড়ির লাইসেন্স প্লেট থেকে জেনে নেয়া, ওগুলোর মালিক আসলে কারা।

সিনেটরের ফেরারি ও একটু আগের গাড়িটার লাইসেন্স প্লেটের তথ্য রায়হান রশিদকে দিল রানা।

‘মাসুদ ভাই, আশা করি একঘণ্টার ভেতরে যোগাযোগ করতে পারব।’

‘তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হবে, তবে লিউনা গার্ডনার নামের এক মেয়ের ব্যাপারেও জানতে চাই,’ বলল রানা।

‘আমি আমার সাধ্যমত করব,’ বলল রায়হান রশিদ।

বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল রানা। পৌঁছে গেছে আতাউলের ভাড়া করা পোর্শের কাছে। গাড়ি নিয়ে লেক মিশিগানের তীর লক্ষ্য করে রওনা হলো রানা। রাগের আগুনে পুড়ছে ওর অন্তর। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে মাফিয়া ডন রসি। ফলে সহজেই পারছে গুরুতর সব অপরাধ করতে। কিন্তু কিছু কিছু অন্যায়ের কখনও ক্ষমা হয় না, যেমন ফুলের মত শিশুদের জীবন ধ্বংস করে দেয়া। অ্যালডো রসি ভয়ঙ্কর এক শিশু নির্যাতনকারী পিশাচ। আর সেজন্যেই সে এবং তার দলের নরপশুদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়বে, প্রতিজ্ঞা করল রানা।

‘এক এক করে খুঁজে নেব,’ ভাবল ও, ‘তোরা রেহাই পাবি না আমার হাত থেকে!’

মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের বক্তব্য অনুযায়ী: শিশু অপহরণের মত গুরুতর অপরাধ মহামারীর মত ছড়িয়ে গেছে গোটা শিকাগোতে। নিরীহ সব পরিবারে নেমে এসেছে চিরকালীন নারকীয় দণ্ড। আর তাদের শাস্তিদাতা হচ্ছে মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি এবং তার দলের লোকেরা।

অসহায় শিশুদের ওপরে কী ভয়াবহ নির্যাতন চলছে, সেটা ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেছে রানার। হঠাৎ করেই টের পেল, খুব জোরে ধরে রেখেছে স্টিয়ারিং হুইল। হালকা করে ওটা ধরল ও। নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইল অদম্য ক্রোধ। তিক্ত মনে ভাবল: অ্যালডো রসির মুঠোর ভেতরে আছে বড় কিছু রাজনৈতিক নেতা। হয়তো তার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে পুলিশের অফিসারেরা। তবুও মাফিয়া ডনের একটা কথা মনে রাখা উচিত-একবার কেউ খুন হয়ে গেলে তার কোন দাপট থাকে না এই দুনিয়ায়!

আর সেই মেয়ে… লিউনা গার্ডনার? -ভাবল রানা। এসবের ভেতরে কী ভূমিকা তার? এখন কোথায় আছে সে?

গতিসীমার ভেতরে পোর্শের স্পিড নামাল রানা। চট্‌ করে দেখে নিল হাতঘড়ি। এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা।

লেকশোর ড্রাইভে বোধহয় আছে শত শত পুলিশ অফিসার। সুতরাং ওদিকে না যাওয়াই ওর জন্যে ভাল।

গাড়ির পেছনের সিটে নানান পোশাক আর আইডি রেখে গেছে আতাউল। একবার পথের ধারে গাড়ি রাখল রানা। শোল্ডার হোলস্টারে অস্ত্র গুঁজে পরে নিল বিশেষ একটা ইউনিফর্ম। ওটার ওপরে চাপাল ওভারকোট। মিনিট সাতেক পর পৌঁছে গেল হার্বার ইয়ট ক্লাবের পার্কিংলটে। পোর্শে থেকে নেমে ডকে গিয়ে খুঁজতে লাগল ডন অ্যালডো রসির ইয়ট।

ছয়

শিকাগো নদীর উত্তরে হার্বার ইয়ট ক্লাব। এখন ইয়টিং সিযন নয়, তাই ভিড় নেই ওখানে। শ্রমিকের কভারল পরনে জেটির দিকে হেঁটে চলেছে দীর্ঘদেহী এক সুঠাম যুবক, দু’হাতের তালুতে কালো গ্রিস। ঢিলা কভারলে চেইন নেই—পটাপট খুলে নিতে পারবে বোতাম। যুবকের কাঁধের হোলস্টারে আছে বেরেটা ৯৩-আর পিস্তল। এ ছাড়া তার কাছে আরও আছে মানুষকে চমকে দেয়ার মত বেশকিছু অস্ত্র।

গোল্ড কোস্ট মেরিনার মত বিলাসবহুল না হলেও এই হার্বার ইয়ট ক্লাবে আছে দামি কিছু ওঅটার ক্রাফ্ট। তারই একটা হচ্ছে অ্যালডো রসির ঝকঝকে সাদা ইয়ট- প্ল্যাটিনাম।

জেটিতে ইয়টগুলোর নাম দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে রানা। কোন জলযানের ডেকে দেখছে না কাউকে। বহুকাল ধরে অপরাধীদের কাছে প্রিয় এলাকা শিকাগো। সুতরাং রাত নামার পরেও নিজের ইয়টে এক বা একাধিক ক্রুকে পাহারায় রাখবে না অ্যালডো রসি, তা হওয়ার নয়।

রেলিং দেয়া গ্যাংপ্লাঙ্ক ধরে হাঁটছে রানা। মিনিটখানেক পর থামল সাদা এক ইয়টের পাশে। গলা চড়িয়ে ডাকল ও, ‘হ্যালো, প্ল্যাটিনাম! ভেতরে কেউ আছ?’

কম্প্যানিয়নওয়েতে, কেবিনের কাছে নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর কাঁধ। বিপদ হবে বুঝলে ঝড়ের বেগে বের করবে অটোম্যাগ।

কেবিন থেকে বেরিয়ে কড়া চোখে ওর দিকে তাকাল দশাসই এক লোক। ‘এখানে কী চাই?’

নাম বা চেহারা থেকে নয়, তার আচরণে এক পলকে তাকে চিনে গেল রানা। এই লোক স্বভাবে জাতদস্যু। মেকানিক যুবককে দেখে মনে মনে অবহেলা করছে। হুডওয়ালা আকারে ছোট জ্যাকেটে বেমানান লাগছে লোকটাকে। কোমরের কাছে ফুলে আছে পিস্তল। অবশ্য ওটার দিকে হাত বাড়াল না সে।

তার দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসল রানা। ‘এই নৌকায় কি এখন ক্যাপ্টেন আছেন?’

‘এটা কোন নৌকা নয়, আস্ত একটা ইয়ট।’ ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল দস্যু। ‘আমাকে কি ক্যাপ্টেন বলে মনে হচ্ছে? তুমি আসলে এখানে কী চাও?’

‘আমার কোম্পানি আপনাদের হিটিং ইউনিট দেখতে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘হিটিংয়ের তো কোন সমস্যা দেখি না।’

‘আমার বস্ বলেছে ওখানে সমস্যা আছে’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। পকেট থেকে কোঁচকানো কাগজ নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ল। ‘ডেকেছেন মিস্টার রসি। বলেছেন হিটিং ইউনিট যেন চেক করা হয়। উনি কি এখানেই আছেন? তাঁকে একটু ডেকে দেবেন?’ বিক্ষুব্ধ জলের লেক মিশিগানের দিকে তাকাল ও। ‘যদিও মনে হয় না আজ রাতে এই বাজে আবহাওয়ায় কারও ইয়টিং করা উচিত।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভাবতে হচ্ছে বলে আরও কুঁচকে গেল ডাকাতের ভুরু। দ্বিধা নিয়ে কেবিনের দিকে ঘুরে তাকাল। ‘গ্রেগরি? একবার এসো তো!’

পায়ের ধুপধাপ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল মুষ্কো এক লোক। সঙ্গীর চেয়ে গ্রেগরিকে বুদ্ধিমান মনে হলো রানার। চোখে সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখল সে। আবার তাকাল সঙ্গীর দিকে। ‘কে এই লোক?’

‘বলছে চেক করতে এসেছে হিটিং ইউনিট।’

‘বস্ তো আমাকে এ-ব্যাপারে কিছু বলেননি! তা ছাড়া, এত রাতেই বা মেকানিক কেন আসবে?’

গ্যাংপ্লাঙ্কের ধারে থেমে দু’কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তোমরা ইয়টে উঠতে না দিলে আমার কোন সমস্যা নেই। অফিসে গিয়ে ফোনে মিস্টার রসিকে জানিয়ে দেব, আপনার লোক আমাকে কাজ করতে দেয়নি।’

‘একমিনিট, একটু অপেক্ষা করো!’ তড়িঘড়ি করে বলল গ্রেগরি। ‘আমি তো বলিনি হিটিং ইউনিট চেক করতে দেব না! উঠে এসো ইয়টে।’

গ্রেগরিরা চিরকাল ধরেই বসের ধমক এড়াতে ব্যস্ত থাকে। মৃদু হেসে গ্ল্যাংপ্লাঙ্ক থেকে ইয়টে উঠল রানা। যদিও এক পা এগোবার আগেই হাতের তালু ওপরে তুলল গ্রেগরি। ‘একমিনিট! তুমি মেকানিক হলে তোমার টুলবক্স কোথায়?’

‘আমি সাধারণ মেকানিক নই, বস্। একজন টেকনিকাল ডায়াগনস্টিকশিয়ান। পার্টস দেখে মেকানিককে বলে দিই কী মেরামত করতে হবে। আমার যন্ত্রপাতি সব এখানে।’ ডানহাতের তর্জনী তুলে মাথার তালুতে টোকা দিল রানা।

‘ও, তাই?’ কী করা উচিত ভাবছে গ্রেগরি। চাইছে বসের কাছে ওর নামে যেন নালিশ করা না হয়।

আত্মবিশ্বাস নিয়ে কম্প্যানিয়নওয়ের দিকে চলল রানা। ওর পিছু নিল দুই গুণ্ডা।

‘আমরা তোমার ওপরে চোখ রাখব,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে সতর্ক করল গ্রেগরি।

‘তাতে আমার কোন সমস্যা নেই,’ বলল রানা। ‘যদিও এটা বুঝলাম না যে এত ভয় কীসের। তোমরা কি ভাবছ যে এই ইয়টে আমি বোমা পেতে রেখে যাব?’

জবাব দিল না লোকদু’জন। একবার চারপাশ দেখে নিয়ে কেবিনের দিকে চলল রানা। সন্ধ্যার পর বছরের এ-সময়ে কেউ থাকে না ইয়ট ক্লাবে। প্ল্যাটিনামের পাশে নোঙর করে রাখা হয়েছে নতুন একটা স্পিডবোট। অন্যদিকে কুচকুচে কালো জলের ছল-ছলাৎ আওয়াজ।

এই দুই গুণ্ডা ছাড়া আশপাশে কেউ নেই। একবার চট্ করে কাঁধের ওপর দিয়ে লোকদু’জনকে দেখল রানা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়ার সময় ওর ঘাড়ের কাছেই থাকল তারা

‘তোমাদের একজন থার্মোস্ট্যাট চালু করো,’ বলল রানা।

‘কাজটা বরং তুমি করো, ববি,’ বলল গ্রেগরি। ‘আমি এর ওপরে চোখ রাখছি।’

‘ঠিক আছে,’ সায় দিল ববি।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে ইঞ্জিনরুমের কাছে যাওয়ার পর এদের ওপরে হামলা করবে ভেবেছে রানা। লোকদু’জনকে অচেতন করে ঘুরে দেখবে ইয়ট। হয়তো তাতে এখানে পাবে জরুরি কোন সূত্র। ইয়টে ওঠা সহজ ছিল। যদিও এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানে নেই অ্যালডো রসি। লোকটা এরই মধ্যে জেনে গেছে, মেরে ফেলার জন্যে তাকে খুঁজছে মাসুদ রানা নামের এক লোক।

আলাপের সুরে বলল ববি, ‘এই যে ইয়টে উঠলে, এক সেকেণ্ডের জন্যে আমার মনে হয়েছিল যে তুমি হয়তো সেই মাসুদ রানা। সন্ধ্যার পর থেকে যার নাম বারবার শুনেছি।’

সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে সঙ্গীর ওপরে হোঁচট খেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল গ্রেগরি, ‘ফালতু কথা বন্ধ করো তো, ববি!

সিঁড়ির ধাপে থেমে গেল রানা। ধীরে ধীরে ঘুরে কৌতূহলী চোখে দেখল দুই গুণ্ডাকে। ‘মাসুদ রানা? যে-লোক আসলে মাফিয়া দলের পাকা খুনি?’

‘না, সে লড়ছে মাফিয়ার বিরুদ্ধে,’ জানাল ববি।

‘চুপ করো তো, ববি,’ ধমক দিল গ্রেগরি। ‘এই লোক কিন্তু গল্প করতে এখানে আসেনি, নিজের কাজ করুক।’

‘তা ঠিক, আমি শুধু বলছিলাম যে…’ থেমে গেল ববি। লেক মিশিগান চিরে ছুটে আসছে একটা স্পিডবোট। ক্রমেই বাড়ছে ওটার ইঞ্জিনের আওয়াজ।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল গ্রেগরি আর ববি। ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরদিকে রওনা হলো তারা। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে রানাকে দেখল গ্রেগরি। ‘তুমি ইঞ্জিন রুমে যাও। আমরা দেখে আসছি এদিকে কে এল।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা।

ওপরের ডেকে উঠল দুই গুণ্ডা। একটু অপেক্ষা করে তাদের পিছু নিল রানা। শুনতে পেল গ্রেগরির কথা: ‘ওই শালারা আসলে কী করছে!’

কম্প্যানিয়নওয়েতে থেমে একটু দূরে গ্রেগরি আর ববিকে দেখতে পেল রানা। রেলিঙের কাছে গিয়ে থেমেছে তারা। ধূসর শীতল জল কেটে আসছে স্পিডবোট, পেছনে দীর্ঘ ঢেউ। স্পিডবোটে আছে তিনজন লোক। যদিও তারা এত দূরে যে চেহারা দেখতে পেল না রানা। খুব দ্রুত এদিকে ছুটে আসছে স্পিডবোট। দেরি না করে ডেকে উঠে এল রানা। কাঁধের ওপর দিয়ে ওকে দেখল গ্রেগরি। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি না বলেছি নিচে ইঞ্জিন রুমে যেতে?’ সে আরও কিছু বলত, কিন্তু চোখের সামনে দেখল কভারলের বোতাম খুলল যুবক। কভারলের নিচে পরনে আঁটোসাঁটো কালো কমব্যাট স্যুট। ডানহাতে শোল্ডার হোলস্টার থেকে ঝড়ের বেগে নিল পিস্তল!

‘ববি!’ চেঁচিয়ে উঠল গ্রেগরি। একই সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াল তারা।

গ্রেগরি আর ববির কথা ভেবে পিস্তল বের করেনি রানা। ওর নজর স্পিডবোটের ওপরে। ওটার সিটে বসে ইয়টের দিকে অটোমেটিক ওয়েপন তাক করেছে দুই যাত্রী। গতি আরও বেড়ে গেছে স্পিডবোটের। ওটার চালক সরাসরি আসছে ইয়টের দিকে।

হঠাৎ করে স্পিডবোটে ঝলসে উঠল কমলা আগুনের ঝিলিক। কর্কশ গর্জন ছাড়ল সাবমেশিন গান। এদিকে স্পিডবোটের দিকে পিঠ দিয়ে রানার ওপরে মনোযোগ দিয়েছে গ্রেগরি ও ববি। কিন্তু পেছনে গুলির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাতে গেল তারা। যদিও দেরি হয়ে গেছে তাদের।

ইয়টের কাঠের গানওয়েলে লাগল একপশলা গুলি। পরের সেকেণ্ডে টার্গেট খুঁজে নিল পরের বুলেট। অন্তত দশটা গুলি ফুটো করল ববির পিঠ। বুক ঝাঁঝরা হওয়ায় রক্তাক্ত ছেঁড়া জ্যাকেটসহ ছিটকে বেরোল ক্ষত-বিক্ষত হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের টুকরো। ভীষণ হোঁচট খেয়ে সামনে বেড়ে ধুপ করে ডেকে পড়ল ববি। এক সেকেণ্ডে ডেক ভিজে গেল চটচটে রক্তে।

আর তখনই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল গ্রেগরি। যদিও এখন আর কিছু করার নেই। একপাশ থেকে তার কোমর ফুটো করল স্পিডবোটের গানার। হঠাৎ গুলি খেয়ে রেলিঙের ওপরে আছড়ে পড়ল গ্রেগরি। গুরুতরভাবে আহত নয়। কাত হয়ে রানার দিকে তাক করছে পিস্তল। একটা গুলিও পাঠাল, কিন্তু পরক্ষণে তাকে ঝাঁঝরা করল সাবমেশিন গানের অন্তত দশটা বুলেট। রেলিঙের পাশে পড়ল গ্রেগরির লাশ।

ডেকে ঝট করে শুয়ে পড়েছে রানা। মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য গুলি। শরীর মুচড়ে কভারঅল খুলে হার্নেসে বেরেটা রাখল রানা। বদলে নিল অটোম্যাগ।

এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। ইয়টের রেলিঙের কাছে ছিল গ্রেগরি ও ববি, ফলে স্পিডবোটের গানার আর রানার মাঝে পড়ে খুন হতে হয়েছে তাদেরকে।

ফাঁদ পেতেছে অ্যালডো রসি। ভাল করেই জানত তার বাড়িতে হানা দেবে রানা। বেডরুমে রেখেছে টেলিফোনের নাম্বারের ছাপওয়ালা প্যাড। এটাও জানা ছিল, আজ রাতেই হাজির হবে রানা ইয়টিং ক্লাবে। আর সেজন্যে ক্লাবের বিপরীত তীরের কাছে স্পিডবোটে রেখেছে দলের একাধিক গানার।

ইয়টের কাঠ ঝাঁঝরা করছে শত শত বুলেট। হাত বাড়িয়ে কভারলের গভীর পকেট থেকে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড নিল রানা। বামহাতে ওটার পিন খুলে গানওয়েলের ওপর দিয়ে উঁকি দিল। সরাসরি ইয়টে গুঁতো লাগবে বুঝে কাত হয়ে অন্যদিকে সরে যাচ্ছে স্পিডবোটের পাইলট। গুলি বন্ধ করছে না দুই গানার। রাতের আঁধারে লেকের জলের ওপরে হলদে জোনাকির মত দপদপ করছে অস্ত্রের মালের আগুন।

ডেকের যেখানে শুয়ে পড়েছে রানা, সে-জায়গা লক্ষ্য করে অজস্র গুলি পাঠাচ্ছে গানাররা। ক্রল করে অন্যদিকে সরে গেল রানা। উঠে বসে পর পর দু’বার অটোম্যাগ থেকে গুলি পাঠাল স্পিডবোট লক্ষ্য করে। দ্রুতগতি বোটে গুলি না লাগলেও রানা যা চেয়েছে, পূরণ হলো সে-উদ্দেশ্য। কাভার নিল গানাররা। আর এ-সুযোগে স্পিডবোটের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ল রানা।

জলযানটার কয়েক ফুট দূরে পড়ল লোহার সবুজ কামরাঙ্গা। ফেনা ভরা পানিতে টুপ করে ডুবে গেল ওটা। পরের সেকেণ্ডে ফেটে যেতেই লেকের তলা থেকে উঠল আগুন ও মস্ত এক পানির তৈরি ফোয়ারা। বোটের ইঞ্জিনের কর্কশ গর্জনের ওপর দিয়ে এল কার যেন আর্তনাদের আওয়াজ। আকাশ থেকে বৃষ্টির মত ঝরঝর করে নামল লেকের জল। কাত হয়ে ইয়টের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে স্পিডবোট। থেমে গেছে গানারদের গুলিবর্ষণ। সিটে ছটফট করতে করতে রক্তাক্ত ছেঁড়া মুখোশ খুলতে চাইল এক গানার। বোমা ফাটার সময়ে অন্যজন হারিয়ে ফেলেছে হাতের অস্ত্র।

স্পিডবোটের চালককে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। লেকের বিক্ষুব্ধ জলে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। ওটাকে পাশ কাটাল অটোম্যাগের বুলেট। পয়েন্ট ফোরটি ফোর অস্ত্রটা তাক করে আবারও গুলি পাঠাল রানা। এবারও বুলেট গেল স্পিডবোটের চালকের মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে। তিক্ত মনে ভাবল রানা, ইয়ট সার্চ করা খুব জরুরি ছিল। তবে তার চেয়ে বেশি জরুরি এখন এদের কাউকে বন্দি করা। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে জানা যাবে কোথায় আছে অ্যালডো রসি। তখন আর অন্ধের মত এগোতে হবে না ওকে।

ডেক থেকে কভারঅল তুলে দুটো গ্রেনেড আর কমব্যাট নাইফ হাতে নিয়ে একছুটে ইয়টের অন্যদিকে চলে এল রানা। গানওয়েল টপকে নেমে এল ডকে। তারই ফাঁকে দেখল কাছে নোঙর করা কিছু বোটের ডেকে বেরিয়ে এসেছে ক’জন লোক। অবাক চোখে দেখছে ওকে।

ইয়টের পাশের স্পিডবোট আধুনিক এবং দ্রুতগামী। লাফিয়ে ওটার পাইলটের সিটে নেমে এল রানা। ইগনিশনে পেল না কোন চাবি। থাকার কথাও নয়। ড্যাশবোর্ডের নিচে হাত ভরে কয়েকটা তার খুঁজে নিল ও। ওগুলো মুচড়ে দিতেই কর্কশ শব্দে চালু হলো শক্তিশালী মোটর।

‘অ্যাই! আমার বোটে কী! নামো বলছি!’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা।

রেগে গিয়ে দু’হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে ছুটে আসছে এক লোক।

নোঙরের দড়ি কেটে খাপে ছোরা রাখল রানা। পরক্ষণে লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে সিটে বসে ব্যস্ত হয়ে উঠল থ্রটল নিয়ে। ওটা ঠেলে দিতেই রওনা হলো স্পিডবোট। আজ বেশ হাওয়া ছেড়েছে। নাচছে লেকের জল। রানা হুইল ঘুরিয়ে নেয়ায় কাত হয়ে বাঁক নিল স্পিডবোট, ক্রমেই বাড়ছে গতি ।

দূরে ঝড়ের বেগে চলেছে খুনিদের বোট। প্রাণভয়ে নিজেদের হত্যা-মিশনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে গানাররা। চাইছে যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে। বামে শিকাগো নদীর এক অন্তরীপের ওদিকে চলে গেল তাদের স্পিডবোট।

নিজেও থ্রটল খুলে দিল রানা। কয়েক সেকেণ্ডে বাঁক নিয়ে অন্তরীপ পেরিয়ে আবার দেখতে পেল খুনিদের বোট। মসৃণভাবে চলেছে ওর স্পিডবোটের ইঞ্জিন। রাতের হিমঠাণ্ডা হাওয়া যেন ছুরির মত চিরে দিচ্ছে ওর মুখের ত্বক। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, সামনের বোটের চেয়ে ওর বোটের গতি বেশি। ধীরে ধীরে কমে আসছে মাঝের ব্যবধান। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই করে পিছিয়ে গেল লেকশোর ড্রাইভ ব্রিজ।

লেকের চেয়ে নদীর পানি অনেক শান্ত। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে দুই বোট। একটু পর সামনে পড়বে মিশিগান অ্যাভিন্যু ব্রিজ। মনের আয়নায় এলাকাটা দেখল রানা। ডাউন টাউনে দুটো শাখা তৈরি করেছে নদীটা। একটা গেছে উত্তরদিকে, অন্যটা দক্ষিণে। ওখানে পৌঁছুলে হয়তো ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে পালিয়ে যাবে সামনের বোট। এটা বুঝে থ্রটল আরও খুলল রানা। বেড়ে গেল ইঞ্জিনের গর্জন। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। ক্রমেই কাছে চলে আসছে সামনের বোট। এখন ওটা আছে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে। বোটে আহত গানারকে দেখতে পেল না রানা। বোধহয় মেঝেতে শুয়ে আছে সে। হাতে ভারী কী যেন নিয়ে সিটে ঘুরে বসল তার সঙ্গী। ওটার ব্যারেল তাক করেছে রানার বোট লক্ষ্য করে। জিনিসটা কী সেটা বুঝতে পেরে চমকে গেল রানা। এক সেকেণ্ডে শুকিয়ে গেল গলা। হুইল ঘুরিয়ে দ্রুত সরে যেতে লাগল নদীর অন্যদিকে। আর তখনই হুইশ শব্দে লঞ্চার ছেড়ে বেরোল রকেট গ্রেনেড। ওটা সোজা এল ওর বোটের দিকে। রাতের আকাশে ধূসর ধোঁয়ার লেজ নিয়ে ওটা যেন অচেনা কোন ধূমকেতু!

এঁকেবেঁকে সরে যাচ্ছে রানা। তিন সেকেণ্ড পর ওর স্পিডবোটের ওপর দিয়ে গিয়ে পেছনের নদীতে ডুব দিল গ্রেনেড। বিকট আওয়াজে বোমাটা ফেটে যেতেই আকাশে ছিটকে উঠল প্রচুর পানি। দূর থেকেও শকওয়েভের ধাক্কা টের পেল রানা। কাত হয়ে আবার সোজা হলো ওর বোট।

এখনও চল্লিশ গজ দূরে রয়ে গেছে শত্রু-বোট। হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিয়ে গানারকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। এদিকে গ্রেনেড লঞ্চার রেখে হাতে রাইফেল নিয়েছে লোকটা। এ-ব্যাটা বোধহয় অস্ত্রের দোকান লুঠ করে এনে বোটে এসে উঠেছে! -তিক্ত মনে ভাবল রানা। গানারের গায়ে ওর গুলি না লাগলেও ওটা বিধেছে বোটের পেছনে। রানা চাইছে যেন বিকল হয় সামনের বোট। সেক্ষেত্রে হয়তো কাউকে বন্দি করতে পারবে। দেখতে পেল গানারের রাইফেলের মাযল থেকে বেরোল কমলা আগুন। পরক্ষণে ওর বোটের কাউলিং-এ তৈরি হলো বিশ্রী এক ফাটল। দ্রুতগতি বোট থেকে গুলি করছে লোকটা। সে-তুলনায় রীতিমত চমকে দেয়ার মত নিশানা তার।

শত্রু-বোটের গানারকে আহত করতে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। মনে মনে চাইছে ভয় পেয়ে যেন কাভার নেয় লোকটা।

সামনের বোট এখন আছে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। আরেকটু কাছে পেলে পাইলটকে গুলি করবে রানা। সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গতি হারাবে শত্রু-বোট। অনায়াসে তখন ওটার পাশে গিয়ে বন্দি করতে পারবে তাদেরকে।

এখন মাত্র বিশ গজ দূরে শত্রু-বোট। নদীর এদিকে অন্য কোন জলযান নেই। ঝোড়ো বেগে ওদের দিকে এল মিশিগান অ্যাভিন্যু ব্রিজ। সাঁই করে ওটা পেছনে ফেলল দুই বোট। নদীর দক্ষিণ তীরের দিকে চোখ গেল রানার। ওদিকে ঝলমল করছে কিছু বাতি। ওয়্যাকার ড্রাইভে জড় হচ্ছে একের পর এক পুলিশ যার। হার্বার ইয়ট ক্লাবের সদস্যরা ফোন করে ডেকে এনেছে পুলিশদেরকে। নদীতীরের রাস্তা ধরে বোটের পেছনে ছুটে আসছে তাদের গাড়ি।

রানার কাছ থেকে মাত্র দশ গজ দূরে আছে শত্রু-বোট। রাইফেল হাতে ওর দিকে তাকাল গানার। চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা। আবারও গুলি করার জন্যে কাঁধে অস্ত্র তুলল সে।

দেরি না করে তাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা।

কাঁধের হাড়ে বুলেট বিঁধে যেতেই কাত হয়ে সিট থেকে পিছলে পাইলটের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গানার। ভয়ে মুখ বিকৃত করে তাকে গা থেকে সরিয়ে দিল হেলসম্যান।

আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে শত্রু-বোটের পাশে পৌঁছে যাবে রানা। তবে গোলাগুলিতে ব্যস্ত ছিল বলে অন্যদিকে খেয়াল ছিল না ওর। কখন যেন নদীর এদিকে হাজির হয়েছে ধীরগতি পেটমোটা মস্ত এক কমার্শিয়াল ট্যুর বোট!

ওটার ডেকে আতঙ্কিত ট্যুরিস্টদেরকে দেখতে পেয়ে বাঁক নিয়ে সরে যেতে লাগল রানা। পিছিয়ে পড়ছে মাফিয়া- বোটের কাছ থেকে। এদিকে ট্যুরিস্ট বোট এড়াতে গিয়ে গতি কমায়নি অ্যালডো রসির বোটের পাইলট। সোজা গিয়ে চেপে বসল ছোট্ট এক ডিঙি নৌকার ওপরে। ফলে উল্টে গেল ডিঙি।

রানা ভেবে পেল না রাতের নদীতে কী করছে দুই যুবক। গতি আরও কমিয়ে দিল ও। উল্টে যাওয়া ডিঙি ধরে ভাসছে তারা। ভিজে গেছে কালো মাথা দুটো।

‘কোন ক্ষতি হয়নি তো?’ ইঞ্জিনের ওপর দিয়ে জানতে চাইল রানা।

ভেজা চুল মুখ থেকে সরিয়ে মাথা নাড়ল একজন। পরক্ষণে চমকে গেল। রাতের আঁধারে কালো পোশাকে হাত- কামানের মত মস্ত এক পিস্তল হাতে তার দিকেই চেয়ে আছে কঠোর চেহারার এক লোক!

‘আ… আ… আমরা খুবই সুখে আছি, স্যর, বেসুরো কণ্ঠে বলল যুবক।

‘নৌকায় আরও কেউ ছিল?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল দুই যুবক।

শত্রু-স্পিডবোটের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। বহু দূরে চলে গেছে ওটার পাইলট। দুই সাঁতারুকে দেখল ও, পরক্ষণে থ্রটল খুলে বলল, ‘সরি, আপাতত সাহায্য করতে পারছি না!’

তিন সেকেণ্ডে পেছনে পড়ল উল্টে যাওয়া ডিঙি। পেছন থেকে রানার দিকে চেয়ে রইল দুই যুবক। পিস্তল হাতে লোকটা যে চলে যাচ্ছে, তাতেই তারা খুশি। তা ছাড়া, দু’চার মিনিটের ভেতরে কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করবে ওদেরকে।

নতুন উদ্যমে শুরু হলো দুই স্পিডবোটের রেস। যদিও গতি এখন আগের মত নয়। রাতের নদীতে এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছে নানান ধরনের আলোকিত জলযান।

গানারকে আহত করতে পেরে খুশি হয়েছে রানা। নিরীহ মানুষজনের ভেতরে ওদের গোলাগুলি চলুক, সেটা চাইছে না।

দুই স্পিডবোটকে রকেট বেগে রেস করতে দেখে নানান জলযান থেকে আসছে আপত্তির চিৎকার। কেউ কেউ জানতে চাইছে: কী হচ্ছে আসলে। মানুষগুলো অতি কৌতূহলী বলে তাদেরকে দোষ দিতে পারছে না রানা।

সামনে পয়ঃবর্জ্যে ভরা বিশাল এক বার্জ দেখে কপালে উঠল ওর দু’চোখ। ভক করে নাকে এসে লাগল ভয়াবহ বাজে দুর্গন্ধ। বাঁক নিয়ে নৌযানটা থেকে সরে গেল ও। আপাতত উধাও হয়ে গেছে সামনের স্পিডবোট। অবশ্য বার্জ পেরোবার আগেই আবারও ওটাকে দেখতে পেল রানা। মাফিয়ার স্পিডবোট তুমুল বেগে আসছে সরাসরি ওর দিকেই!

হুইল ঘুরিয়ে স্টারবোর্ডে সরে গেল রানা। ওর একফুট দূর দিয়ে পার হচ্ছে পায়খানায় ভরা প্রকাণ্ড বার্জ। সামনের বোটের পাইলটের রাগে বিকৃত চেহারা দেখতে পেল রানা। বারবার পালাতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে লোকটা।

বার্জ থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাবধান!’

বার্জের কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে পেরোল রানার স্পিডবোট। ওদিকে ওর মাত্র কয়েক ফুট পাশ দিয়ে গেল মাফিয়ার বোট। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রানা।

মিশিগান লেকের দিকে ফিরে চলেছে শত্রু-বোট। হুইল ঘুরিয়ে তীরবেগে ওটার পিছু নিল রানা। নতুন করে পেরিয়ে এল বার্জ। বর্জ্যে ভরা জলযানের ডেক থেকে কী ঘটেছে সেটা জানতে চাইছে কর্মীরা। খোলা জলের দিকে ফেরার সময় আগের চেয়ে বেশি শীত লাগছে রানার। কানের কাছে কর্কশ শব্দ করছে স্পিডবোটের মোটর। হু-হু করে মাথার চুলের ভেতর দিয়ে বইছে হিমঠাণ্ডা হাওয়া।

একটু পর আবার সামনে পড়ল নদীর দুই শাখা। ওর বোটের গতি বেশি বলে স্পিডবোটের ঘাড়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে রানা। মেরিনা এরিয়া থেকে সরে গেছে ওরা। তীব্র বেগে চলেছে দুই স্পিডবোট। একবার তীরের দিকে তাকাল রানা। নদীতীরে আর রাস্তায় জ্বলছে পুলিশের গাড়ির অসংখ্য হেডলাইট ও লাল-নীল বাতি।

এইমাত্র সান-টাইম্স বিল্ডিং পাশ কাটাল সামনের বোট ওটা এখন আছে রানার বোট থেকে কমপক্ষে সত্তর গজ দূরে। আরও সামনে নদীতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইনসিগনিয়াসহ শক্তিশালী এক ক্রুযার। ওটার বো থেকে কড়া আলো এসে পড়েছে মাফিয়া বোটের ওপরে। দিনের মত ফর্সা হয়ে গেছে রাত। নদীর চারপাশে ছড়িয়ে গেল বুলহর্নের বিকট আওয়াজ। ভারী গলায় কথা বলছে এক পুলিশ অফিসার: ‘এই যে, দুই স্পিডবোট! থামো! তীরে এসে ভেড়ো! আমরা পুলিশ! আবারও বলছি, গতি কমিয়ে থেমে যাও!’

অফিসারের কথা শুনছে না দুই স্পিডবোটের চালক। গতি কমল না কারও। থ্রটল পুরো ঠেলে দিয়ে হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দিল রানা। দু’হাতে ধরেছে বোটের হুইল- দরকার হলে চট করে সরে যাবে যে-কোন দিকে। দেখতে পেল, আবারও সিটে উঠে বসেছে আহত সেই গানার। লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেহের বামদিক। অবশ্য তার অক্ষত ডানহাতের মুঠোয় এখন একটা পিস্তল।

‘কমপ্লিট গাধা!’ বিড়বিড় করল রানা।

পুলিশ ব্রুয়ারের দিকে বারকয়েক গুলি পাঠাল লোকটা। ফাঁকা জায়গায় আওয়াজটা ছোট পটকার মত শোনাল রানার কানে। পুলিশ ক্র্যারের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল ফ্লেক জ্যাকেট পরনে কয়েকজন অফিসার। মাফিয়ার আততায়ী গুলি করছে বুঝতে পেরে এদিকে-ওদিকে ঝাঁপ দিয়েছে তারা। তাদের মাথার ওপর দিয়ে গেছে কয়েকটা বুলেট। এর ফলে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ফায়ারিং পযিশনে উঠে বসে পাল্টা গুলি পাঠাল পুলিশ অফিসারেরা। মাফিয়া বোট লক্ষ্য করে গেছে শত শত বুলেট। রানা দেখল, অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে চুরচুর হয়ে ভাঙল সামনের স্পিডবোটের উইণ্ডশিল্ড।

নিজের বোটের গতি কমিয়ে সামনের স্পিডবোটের পাইলটকে সিটে পিঠ দিয়ে পড়তে দেখল রানা। পরক্ষণে হুইলের ওপরে হুমড়ি খেল লাশটা। শত বুলেটের আঘাতে গানওয়েল টপকে ঘোলাটে নদীতে পড়ল গানারের মৃতদেহ।

পাইলটের লাশের চাপে হুইল ঘুরে যেতেই প্রচণ্ড বেগে উত্তরদিকের একটি পিয়ারে গিয়ে উঠল সামনের স্পিডবোট। সংঘর্ষে চুরমার হয়ে যেতেই ওখান থেকে এল বোমা ফাটার মত আওয়াজ। আগুন ধরে যাওয়ায় বিস্ফোরিত হলো স্পিডবোটের পেট্রল ট্যাঙ্ক। কালো আকাশে ভুস করে ভেসে উঠল লাল-কমলা আগুনের ফুটবল। পরক্ষণে ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরল ভাঙা ধাতব টুকরো। সেগুলোর ভেতরে আছে মানুষের বিচ্ছিন্ন দেহাবশিষ্ট।

এক শ’ গজ দূর থেকে সব দেখছে রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, এখন আর কারও কাছ থেকে কোন তথ্য পাবে না। বিধ্বস্ত স্পিডবোট লক্ষ্য করে ছুটে গেল কিছু ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। পুলিশ জুয়ার থেকে রানার দিকে তাক করা হলো আগ্নেয়াস্ত্র। বুলহর্নের মাধ্যমে বলা হলো: ‘দ্বিতীয় বোট! যেখানে আছ, ওখানেই থাকো! হাতদুটো মাথার ওপরে তোলো! কথা না শুনলে আমরা বাধ্য হব গুলি করতে!’

পুলিশের অসংখ্য গাড়ি থেমেছে নদীর দু’তীরে। এখন চাইলেও নদী পার করে লেক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না রানা। হঠাৎ খুব জোরে শুরু হলো একটা সাইরেন। আওয়াজটার দিকে ঘুরে তাকাল ও। নদীর শাখা থেকে বেরিয়ে দ্রুত ওর দিকে এল বড় একটা জলযান। ওর বুঝতে দেরি হলো না যে পুলিশের দুই ক্রাফটের মাঝে আটকা পড়ে গেছে ও!

হুইল ঘুরিয়ে থ্রটল ঠেলে দিয়ে নদীতীর লক্ষ্য করে এগোল রানা। দু’তীরে ঝলমল করছে বাতি। তারই ফাঁকে রাতের আঁধারে আছে কিছু স্কাইস্ক্র্যাপার। নদীর ধারে পুলিশের যেসব গাড়ি এসে থেমেছে, তার মাঝে আঁধার কোন জায়গা আছে কি না, সেটা বুঝতে চাইছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর মনে হলো, আশপাশে এমন কোন জায়গা নেই, যেদিক দিয়ে নিরাপদে তীরে উঠতে পারবে ও। অবশ্য ট্রেনিং ওকে বলে দিচ্ছে, কোথাও না কোথাও ত্রুটি আছে পুলিশের লাইনে। আর সেটা পেলেই বেরোতে পারবে এই গাড্ডা থেকে।

পাঁচ সেকেণ্ড পর নদীর তীরে আঁধার এক ডক দেখতে পেয়ে ওদিকে চলল রানা। তীরে ওয়্যাকার ড্রাইভে বিশাল এক বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে গেছে সরু একটা পথ। ডকের পাশে পৌঁছে লাফ দিয়ে বোট থেকে নেমে পড়ল রানা। ঝেড়ে দৌড় দিল অফিস বিল্ডিঙের দিকে। ওকে দেখতে পেয়ে হৈ- হৈ করে পিছু নিল একদল পুলিশ অফিসার। ধমক দিয়ে থামতে বলা হচ্ছে ওকে।

কালো স্যুটের কমব্যাট ওয়েবিং থেকে স্মোক গ্রেনেড নিয়ে পিন খুলে তাদের মাঝে ছুঁড়ল রানা। ওটা উড়ে আসতে দেখে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসারেরা। মাটিতে পড়ে ঘন ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে গড়ান দিচ্ছে স্মোক গ্রেনেড। প্রাণরক্ষায় ব্যস্ত ওদিকের পুলিশ। এ-সুযোগে অন্যদিকের অফিসারদের দিকে ছুট দিল রানা। পুলিশের লোকেরা বুঝে গেছে, আরও গ্রেনেড আছে ওর কাছে। কাভার নিয়ে কয়েকজন অফিসার দেখতে পেল, সরাসরি তাদের দিকেই আসছে কালো পোশাক পরা লোকটা। সামনের দিকের এক অফিসার পিস্তল বের করে ধমকে উঠল, ‘থামো! খবরদার!’

ছুটতে ছুটতে টের পেল রানা, ধুপধাপ শব্দে পাঁজরে এসে লাগছে ওর হৃৎপিণ্ড। পেছনে ধোঁয়ার ভেতরে খক খক করে কেশে চলেছে দু’জন অফিসার। দৌড় না থামিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে ওদিকে তাকাল রানা। ঘন ধোঁয়া থেকে বেরোল কয়েকজন অফিসার। দু’হাতে কচলে নিচ্ছে চোখ। তারই ফাঁকে রানাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল তাদের একজন।

রানার কানের পাশ দিয়ে গেল বুলেট। পরেরটা হয়তো বিধবে ওর পিঠে!

কানের কাছে বুলেটের গুঞ্জন শুনে ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়েছে দ্বিতীয় দলের এক অফিসার। ঘাড় কাত করে দেখল, তাদের দলের কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছে কি না। একটু আগে রানাকে ধমকে উঠেছে যে অফিসার, সে এবার চিৎকার করে বলল: ‘থাম্, শালারা! তোরা তো আমাদেরকেই খুন করছিস!’

এমনটিই হবে সেটা আশা করেছে রানা। উড়ে চলল কাছের দালান লক্ষ্য করে।

অন্ধকার বাড়িটার নিচতলায় অসংখ্য জানালা। নদীর দিকে লবি ও পেছনের উঠান। জানালাগুলোর কাঁচ ধূসর ধোঁয়াটে রঙের। তারই মাঝে প্রথমতলায় ঢোকার বড় এক ডাবল-ডোর। ওটা পাশ কাটিয়ে বাঁক নিয়ে বাড়ির সামনের পার্কিংলটের দিকে উড়ে চলল রানা। মনে মনে আশা করছে, ওদিকে পাবে কোন গাড়ি। পেছনে শুনতে পেল নানাদিকে চিৎকার আর ছোটাছুটির ধুপধাপ আওয়াজ। বাড়ির দিকে আসছে একাধিক সাইরেন। রানা বুঝে গেল, সন্ধ্যায় যে ঝামেলায় পড়েছিল লেকশোর ড্রাইভে, এখন তার চেয়ে ঢের বড় বিপদে আছে। যেসব অফিসার আগেরবার ওকে ধরতে না পেরে বোকা বনে গেছে, এবার সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় তারা দরকার হলে দ্বিধা করবে না রক্ত ঝরাতে।

ছুটতে ছুটতে বাড়ির সামনের পার্কিংলটে চলে এল রানা। মাত্র আশি গজ দূরে উসেন বোল্টের মত তুমুল বেগে ছুটে আসছে এক পুলিশ অফিসার।

ব্যস্ত হয়ে চারদিকে চেয়ে বুঝে গেল রানা, এমন কোন গাড়ির দরজা নেই যেটা লক করা নয়। দু’সারি গাড়ির মাঝে কুঁজো হয়ে পার্কিংলটের শেষমাথা লক্ষ্য করে চলল ও। তবে ওদিকের গাড়িগুলোর কাছে গেলেও চারদিক থেকে ওকে ঘিরে নেবে অফিসারেরা। গাড়ির সারির মাঝে এক লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখলে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবে তারা।

আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তখন হয়তো বাধ্য হয়ে গোলাগুলি করতে হবে রানাকে। তবে সেক্ষেত্রে শিকাগো শহরে এমন কোন পুলিশ থাকবে না যে কি না ওকে খুন করতে চাইবে না।

থেমে একটা গাড়ির পাশে শুয়ে পড়ে শরীর ছেঁচড়ে ওটার তলায় ঢুকল রানা। পিঠ আর মাথায় লোহার যন্ত্রপাতির ঠোক্কর খেয়ে বিরক্ত। মাত্র তিন সেকেণ্ড হলো গাড়ির নিচে ঢুকেছে, এমনসময় শুনতে পেল কাছেই গর্জে উঠেছে একটা গাড়ির ইঞ্জিন। ঘাড় কাত করে ডানে তাকাল রানা। পার্কিংলট থেকে বেরোবার জন্যে ধীরে ধীরে ব্যাক করে এদিকে আসছে গাড়ির মালিক। যে-গাড়ির নিচে আছে রানা, হাঁচড়েপাঁচড়ে ওটার তলা থেকে বেরিয়ে এল ও। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল একটু দূরে মিটসুবিশি মিরাজ জি ফোরের স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে আছে কমবয়সী এক মেয়ে।

পাঁচ কদমে তার পাশে পৌঁছে গেল রানা। দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে হ্যাঁচকা টানে খুলল ড্রাইভিং দরজা। গায়ের কাছে কালো পোশাক পরা কঠোর চেহারার লোকটাকে দেখে ভয়ে ফ্যাকাসে হলো মেয়েটার মুখ। ভাবছে: এবার খুন হব ভয়ঙ্কর খুনিটার হাতে!

আমেরিকার পচে যাওয়া নষ্ট সমাজের নোংরা চিত্র আগেও বহুবার দেখেছে রানা। বেচারি মেয়েটা ধরে নিয়েছে গাড়ি ডাকাতি করার জন্যে ওকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না হাইজ্যাকার। জরুরি সুরে তাকে বলল রানা, ‘সরি, জরুরি কাজে তোমার গাড়িটা দরকার। পরে ফেরত পাবে। আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি।

খুন হবে না শুনে স্বস্তির ছাপ পড়ল মেয়েটার মুখে। বড় একটা ঢোক গিলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। একলাফে ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল রানা। ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছিয়ে নিল জাপানি গাড়িটা। রিয়ারভিউ মিররে দেখল, তীরবেগে আসছে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা নকল উসেন বোল্ট। গাড়িটা তার দিকেই আসছে দেখে ছুটতে ছুটতে থেমে যেতে চাইল সে। ফলে হারিয়ে ফেলল ভারসাম্য। দু’হাতে খামচে ধরতে গেল গাড়ির ব্যাকডালা। আর তখনই ফার্স্ট গিয়ার ফেলে অ্যাক্সেলারেটর মেঝেতে দাবিয়ে দিল রানা। লাফিয়ে এগোল মিটসুবিশি মিরাজ জি ফোর। রিয়ারভিউ মিররে দেখল রানা, পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ঝাড়তে লাগল ইউনিফর্মের ধুলোবালি।

পার্কিংলটের যে গেট দিয়ে বেরোতে চায় রানা, ‘ওখানে এসে থামল একটা স্কোয়াড কার। ওটার আলো এসে পড়েছে সামনের গাড়িগুলোর ওপরে। দেরি না করে একসারি গাড়ি পাশ কাটিয়ে পার্কিংলটের অন্যদিকে চলল রানা। জোরাল সাইরেন বাজিয়ে ওর পেছনে ধেয়ে এল স্কোয়াড কার।

দ্রুতবেগে পার্ক করা গাড়ির সারির শেষমাথায় পৌঁছে বাঁক নিল রানা। কর্কশ আওয়াজে হড়কে গেল গাড়ির চার চাকা। এক শ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে পরের সেকশনে ঢুকতে গিয়ে আরেকটু হলে উল্টে যেত মিরাজ জি ফোর। পেছনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাঁক নিয়েছে স্কোয়াড কার, একদিকের দেয়ালে ধুম্ শব্দে লেগে থেমে গেল ওটা।

পার্কিংলটের এদিকে কংক্রিটের দেয়াল, অন্যদিকে উঁচু সবুজ হেজ ঝোপ। ওদিকেই ওয়্যাকার ড্রাইভের রাস্তা। পার্কিংলটের একটি দিয়ে বেরোবে সে-উপায় আর নেই। গেট জুড়ে এসে থেমেছে দ্বিতীয় স্কোয়াড কার। গাড়ি নিয়ে হেজ ঝোপ লক্ষ্য করে ছুটল রানা। মনে শঙ্কা: হয়তো ঝোপের ওপাশে আছে পাকা দেয়াল। মিরাজ জি ফোরের নাকের গুঁতো খেয়ে ঝরঝর শব্দে দু’দিকে সরে গেল ঝোপ। সামনে কোন কলাম, দেয়াল বা বেড়া নেই। ঝড়ের বেগে পার্কিংলট থেকে ফুটপাথে নেমে এল রানা। একটু দূরের বাঁকে পার্ক করা কিছু গাড়ি। মিরাজ জি ফোরের গতিহ্রাস করে হর্ন টিপে ধরল রানা। সামনে ফুটপাথে হেঁটে চলেছে কয়েকজন পথযাত্রী। পেছনে হর্ন শুনে ঘুরে তাকাল তারা। পরক্ষণে প্রাণের ভয়ে লাফ দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে নিজেও ফুটপাথ থেকে নেমে এল রানা। পরের ব্লকে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়্যাকার ড্রাইভে।

সামনে ধীরগতি গাড়ির জ্যাম। চালকেরা এদিকে-ওদিকে চেয়ে বুঝতে চাইছে এত আওয়াজ কীসের। পরক্ষণে দেখতে পেল তাদেরকে পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে নতুন এক গাড়ি! চালকদের ব্রেক করার আওয়াজ শুনছে রানা। তাদের আবিষ্কৃত দু’চারটা মারাত্মক গালি শুনে লাল হয়ে গেল ওর কান। কোন গাড়িতে আঁচড় না কেটে এগিয়ে চলল মিরাজ। বামে স্টেট স্ট্রিট দেখে ওদিকে ঢুকে পড়ল রানা। এ-পথে হালকা জ্যাম থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না এগোতে। একবার রিয়ারভিউ মিররে দেখল রানা। পেছনের দিকে আরও বেশি জ্যাম বেধে যাওয়ায় ওর পিছু নিতে পারবে না পুলিশের স্কোয়াড কার।

একটু পর শহরতলীর দিকে চলল ওর মিরাজ। পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ম্যাপ দেখে নিল রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, ওকে মৃত্যু-ফাঁদে ফেলেছিল অ্যালডো রসি। ওর মনে পড়ল শিশুদের সেই ব্লু ফিল্ম। তাতে আরও তেতো হয়ে গেল ওর মন। ফোন করল রায়হান রশিদের নাম্বারে। ওদিক থেকে কল ধরতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু জানলে লিউনা গার্ডনারের ব্যাপারে?’

‘না, মাসুদ ভাই। বাংলাদেশের ইন্টারনেট কচ্ছপের মত স্লো, আমার তো মনে হচ্ছে আমি আছি হাজার হাজার কোটি আলোকবর্ষের ওদিকে অ্যান্ড্রোনামিয়ায়। অবশ্য অন্যদুটো ব্যাপারে খোঁজ নিতে পেরেছি।

‘ফেরারি গাড়ির কথা বলছ?’

‘জেনেছি ওয়াশিংটনে কে আসলে অ্যালডো রসির কানেকশন।’ কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রায়হান রশিদ। ‘ফেরারিটা শিকাগোর সিনেটর জাস্টিন পিটারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।’

‘আর অ্যালডোর বাড়ির সামনে যে স্টিকারওয়ালা গাড়ি, ওটার লাইসেন্স প্লেট থেকে কিছু জানলে?’

‘ওটার মালিক সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন। কাজ করে কুক কাউন্টি অর্গানাইড্ ক্রাইম টাস্ক ফোর্সে।

‘তার ব্যাপারে আরও কিছু জেনেছ?

‘বাড়ির ঠিকানা আর কোথায় চাকরি করে সেটা ছাড়া নতুন কিছু পাইনি। এদিকে মনে হচ্ছে শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে অ্যালডো রসির সম্পর্ক থাকতে পারে। সে পতিতালয় চালু রাখা, পর্নো সিনেমা তৈরি করা, পর্নো সিনেমা হল চালানো, জুয়ার আড্ডা বসানো, বেআইনি অস্ত্র ব্যবসা করা আর মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

‘তুমি আরও খোঁজ নাও লিউনা গার্ডনারের ব্যাপারে। ওটা তার সত্যিকারের নাম না-ও হতে পারে। এদিকে আমি দেখা করব সার্জেন্টের সঙ্গে। টেক্সট্ করো তার বাড়ির ঠিকানা।’

‘আপনি হয়তো চাইবেন সিনেটরের সঙ্গেও কথা বলতে। আজ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফাগু রেইয়িং ডিনার থ্রো করেছে। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, মাসুদ ভাই-শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টার আর অ্যামিউযমেন্ট পার্ক তৈরি করার জন্যে টাকা তুলছে ওই লোক।’

‘সিনেটরের ডিনারে গিয়ে তার ব্যাপারে খোঁজ নেব,’ বলল রানা, ‘এদিকে সার্জেন্ট এবার্টনের সঙ্গে মাফিয়া ডন রসির খাতির আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।’

‘মাসুদ ভাই,’ বলল রায়হান রশিদ, ‘তেমন কিছু হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন তার বাড়ির ঠিকানা পাঠাচ্ছি। নতুন কোন তথ্য পেলে আপনাকে ফোন দেব।’

বিদায় নিয়ে স্মার্টফোন পাশের সিটে রাখল রানা। বিড়বিড় করল, ‘আমি জানতে চাই এবার্টন আসলে মানুষ নাকি পশু!’

সাত

তিক্ত হয়ে গেছে বার্কলে এবার্টনের মন। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে দেহ। এমনিতেই কাজের চাপে মরার দশা, তার ওপরে বড়কর্তারা বলে দিয়েছেন, অ্যালডো রসির হেলথ সেন্টারে যে হামলা করেছে, সে লোক সম্ভবত রানা এজেন্সির মালিক মাসুদ রানা। খুনের এলাকায় মিলেছে তার ভিযিটিং কার্ড। কাজেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব যেন গ্রেফতার করা হয় তাকে। তবে সে গোলাগুলি শুরু করলে কোন ঝুঁকি না নিয়ে খুন করতে হবে।

আজকের মত বাড়ি ফিরছে এবার্টন। মন থেকে মুছে দিতে চাইছে মাসুদ রানা নামের ভয়ঙ্কর লোকটাকে। মনস্থির করেছে, আগামীকাল পুরো সময়টা দেবে স্ত্রী জেনিফারকে। লাঞ্চ সেরে নেবে কাছের কোন রেস্তোরাঁয়, তারপর ঘুরে ফিরে দেখবে চিড়িয়াখানা। ওখানে যেতে পছন্দ করে জেনিফার। ক্ষণিকের জন্যে মগজ ফাঁকা হতেই আবারও রানার নাম মনে পড়ল এবার্টনের। আবারও তিক্ত হয়ে গেল অন্তর। গাড়ি রেখে সোজা ঢুকে পড়ল নিজের ছোট্ট একতলা বাড়িটাতে। একই সময়ে কিচেন থেকে বেরোল জেনিফার। স্বামীকে দেখে মিষ্টি করে হাসল সে।

গা থেকে ওভারকোট খুলে হুকে ঝুলিয়ে দিল এবার্টন। ঘুরে কয়েক পা গিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে। আজকাল জেনিফারের কথা ভাবলেই বুকের ভেতরে কেমন যেন হুতাশ আসে এবার্টনের। মনটা ওকে যেন বলে, কেন এমন হলো ওদের জীবন! সে যদি আর দশজন মানুষের মত জীবন পেত! ঠিক সময়ে ফিরত কাজ শেষে বাড়িতে। কাজ শেষে মনের ভেতরে থাকত না কোন দুশ্চিন্তা। আজকাল কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিরকাল ধরে ভালবাসার মেয়েটাকে ঠকিয়ে এসেছে সে।

ছোটবেলা থেকে ওদের প্রতিবেশী ছিল জেনিফারদের পরিবার। ভালবেসে বিয়ে করেছে ওরা। সুন্দরী জেনিফারের বয়স চল্লিশ হয়ে গেলেও এখনও ওকে দেখলে আনচান করে ওঠে এবার্টনের মন। বলতে ইচ্ছে করে: ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি, জেনি!

এক পা পিছিয়ে স্বামীর চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল জেনিফার। নরম সুরে বলল, ‘কোথাও কোন সমস্যা?’

জোর করে হেসে মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘না তো!’ স্ত্রীর কোমরের বাঁকে হাত রাখল সে। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে পড়ে গেছে অস্বস্তির ভেতরে। ভাবছে, মাসুদ রানার ব্যাপারে জেনিফার কিছু জেনে গেলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ‘তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’

যদিও কথাটা হবে আসলে ডাহা মিথ্যা।

মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির বিরুদ্ধে লড়ছে বাংলাদেশি দুর্ধর্ষ যুবক মাসুদ রানা। এরই ভেতরে খুন করেছে মাফিয়া দলের কয়েকজন গুণ্ডাকে। এবার হয়তো তার হাতে খুন হবে অ্যালডো রসি। আর সেটা ঠেকাতে গিয়ে নিজেও হয়তো মারা পড়বে এবার্টন! সেক্ষেত্রে খুব অসহায় হয়ে যাবে জেনিফার।

শিকাগোর তৃতীয় প্রজন্মের আইরিশ পুলিশ এবার্টন। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। এ-শহরের এশিয়া থেকে আসা মানুষগুলোকে আইনগত সহায়তা দেয়ার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছে ওকে। কয়েক বছর আগেও সবই ভালভাবে চলছিল। কিন্তু তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর বাজে সমস্যা। তাতে নাক না গলিয়ে উপায় থাকল না এবার্টনের। আর সেজন্যে হয়তো যে-কোন সময়ে খুন হবে ও।

গত ক’মাস ধরেই নীরবে যেন বলছে জেনিফার: যা-ই ঘটুক, তোমার পাশে আছি। কী হচ্ছে সেটা দয়া করে আমাকে খুলে বলো।

বড় হয়ে গেছে জেনিফার আর এবার্টনের দুই সন্তান। ওরা পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে। নিজের এখন আর বাড়তি কোন কাজ নেই জেনিফারের। তাই স্বামীর দিকে চলে এসেছে ওর সমস্ত মনোযোগ। এবার্টনের ভেতরে সামান্য পরিবর্তন হলেও চট করে সেটা বুঝে যায়।

এবার্টন বুঝেছে, ওকে নিয়ে খুব বেশি ভাবছে জেনিফার। অথচ ওর উচিত নিজের দিকে খেয়াল দেয়া। সেণ্ট মিচেলসের চিরকালের সেরা সুন্দরী হলেও ছোটবেলা থেকেই জেনিফারের রিউমেটিক ফিভার। তার ওপরে আবার অপারেশন করাতে হবে ফুসফুসে। সেজন্যে আগামী সপ্তাহে ভর্তি হবে, হাসপাতালে। অপারেশনটা খুব বিপজ্জনক। এদিকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হুড়মুড় করে ফুরিয়ে যাচ্ছে ওদের জমা করা সব টাকা।

এবার্টনের চাকরিতে বড় কোন সমস্যা হচ্ছে, সেটা ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়েছে জেনিফার। অবশ্য কী ঘটেছে সেটা জানার জন্যে স্বামীর ওপরে কোন চাপ তৈরি করছে না। আর সেজন্যে মনে মনে ওর প্রতি কৃতজ্ঞ এবার্টন।

স্বামীর গালে চুমু দিয়ে আবার কিচেনে গিয়ে ঢুকল জেনিফার। গলা উঁচিয়ে বলল, ‘একটু পর ডিনার।’

দরজার মাঝের কাঁচের ভেতর দিয়ে সামনের উঠান দেখল এবার্টন। ল্যাম্প-পোস্টের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাস্তা। ফুটপাথে হেঁটে চলেছে এক বা দু’জন পথচারী। ধীরগতি তুলে আসছে-যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি।

এই এলাকা বিলাসবহুল না হলেও ভাল লাগে এবার্টনের। ঝামেলা বা হৈ-চৈ নেই। যে-যার মত আছে প্রতিবেশীরা। তাদের মাথা-ব্যথা নেই যে পাশে থাকে এক পুলিশ অফিসার। বরং কোন বিপদ হলে এসে আলাপ করে, যাতে সহজে মিটিয়ে নেয়া যায় সমস্যা।

এবার্টন পরিবারের মাথার ওপরে আছে নিরাপদ ছাত। পেটে আছে খাবার। ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিতে পারছে চিকিৎসা। মধ্যবিত্তের যে কাপড়চোপড় লাগে, তা কিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে না। আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েও হাতে যা থাকছে, প্রতিমাসে সেটা সঞ্চয় করা যাচ্ছিল।

সেক্ষেত্রে একজন পুরুষের এক জীবনে আর কী লাগে? তারপর শুরু হলো জেনিফারের অসুস্থতা। সেটাও হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু অন্য এক কারণে আজকাল এবার্টনের মনে হচ্ছে, যে-কোন সময়ে হয়তো চিরকালের জন্যে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে তাকে। আর সেটা হবে সময়ের আগেই। ঠাঁই হবে অন্ধকার কোন শীতল কবরে।

জানালা দিয়ে উঠনের দিকে চেয়ে আছে সে। আবারও মনে পড়ল মাসুদ রানার কথা। নিজের কর্মচারীদের খুনের বদলা নিতে মাঠে নেমেছে বেপরোয়া যুবক। আর সেটা করতে গিয়ে হয়তো যে-কোন সময়ে নিজেই খুন হবে।

প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে ঝোলাল এবার্টন। লাইটারের আগুনে জ্বেলে নিল শলা। তার মনে পড়ল, আজ রেডিয়োতে বলেছে শিকাগোতে ভারী তুষারপাত হবে। অবশ্য তুষারপাত ঠেকাতে পারবে না দুর্ধর্ষ মাসুদ রানাকে। আগেও এমন মানুষ দেখেছে এবার্টন। প্রাণের ভয় থাকে না এদের।

সামনের রাস্তায় এসে থামল একটা সেডান গাড়ি। ওটা কোন প্রতিবেশীর নয়। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে ওদিকে চেয়ে রইল এবার্টন। গাড়ি থেকে নেমে ওর বাড়ির গেটে থামল অপরিচিত যুবক। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট সে। পরনে ওভারকোট। ট্রেনিং পাওয়া চোখে এবার্টন খেয়াল করল, যুবকের পায়ে কমব্যাট বুট। গেট খুলে বাগানের মাঝের পথ ধরে এসে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়াল সে। শিরশির করে শীতল অনুভূতি মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল এবার্টনের। বুঝে গেছে, ওর বাড়িতে হাজির হয়েছে মাসুদ রানা!

হয়তো সে জেনে গেছে মাফিয়া ডন রসির বাড়ির সামনে নিয়মিত গিয়ে বসে থাকে সে। তাই ধরে নিয়েছে দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট।

এখন সে নিজে খুন হয়ে গেলে জেনিফারের কী হবে, সেটা ভাবতে দিয়ে একবার শিউরে উঠল বার্কলে এবার্টন। মনে মনে মাফ চেয়ে নিল স্ত্রীর কাছ থেকে। ‘তোমায় সুখী করতে পারিনি। যদি সময়ের আগেই চলে যাই, তো মাফ করে দিয়ো, জেনিফার।’

দরজার পাশের কলিংবেল বাজাল যুবক।

পানি থেকে তোলা মাছের মত একবার খাবি খেল বার্কলে এবার্টন। মনে পড়েছে হেলথ সেন্টারের লাশগুলোর রক্তাক্ত ছবি। দরজা না খুললে ওটা ভেঙে ঢুকবে যুবক। কাজেই ছিটকিনি খুলে কবাট সরাল এবার্টন। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন যে আমি এই বাড়িতে থাকি?’

ওভারকোটের পকেটে বেরেটার বাঁট ধরে রেখেছে রানা। কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না। ‘কাজটা কঠিন নয়। একজনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।

ঢোক গিলল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘আমার বোধহয় আপনাকে গ্রেফতার করা উচিত?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ মৃদু মাথা নাড়ল রানা।

ওভারকোটের পকেটে যেখানে আছে রানার হাত, সেখানে গিয়ে চোখ থামল এবার্টনের। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে পিস্তলের অবয়ব। চাপা শ্বাস ফেলে বলল সে, ‘দয়া করে আমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি করবেন না।’

‘ভাববেন না, আমি তেমন কিছু করব না। আমরা বরং বাড়ির ভেতরে গিয়ে কথা শেষ করি।’

দরজা থেকে নড়ল না এবার্টন। ‘আমি চাই না বাড়ির ভেতরে আমাকে খুন করা হোক।

‘তা হলে উঠানে বেরিয়ে আসুন।’

‘আপনি আসলে কী চান আমার কাছে?’

‘কিছু প্রশ্নের জবাব,’ বলল রানা, ‘যেগুলো জানতে হবে আমার।’

‘অবাক লাগছে,’ বিড়বিড় করল এবার্টন। ‘একটু আগেই আপনার কথা ভাবছিলাম।’

সার্জেন্ট আর কিছু বলার আগেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এল জেনিফার। ধীরপায়ে এসে থামল স্বামীর পেছনে। ‘হঠাৎ করেই বুঝলাম দরজা খোলা হয়েছে। বাতাস আসছে বাড়ির ভেতরে। তাই দেখতে এলাম।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এবার্টনের মুখ।

কেউ এসেছে বুঝতে পেরে স্বামীর পাশ থেকে দরজার দিকে তাকাল জেনিফার।

‘আমি একটু ব্যস্ত, জেনি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল এবার্টন। ‘আসুন, ভেতরে আসুন, মেজর রানা। ‘

সার্জেন্ট দরজা থেকে সরে যেতেই বাড়িতে পা রাখল রানা। মৃদু হাসল মহিলার দিকে চেয়ে। নিচু গলায় বলল, *আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিসেস এবার্টন।’

‘অফিসের কাজ, জেনি,’ নরম সুরে বলল এবার্টন। ‘আমরা ডেন-এ গিয়ে বসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।

সার্জেন্টের কথায় সামান্য আশার সুর টের পেল রানা।

‘খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, মেজর।’

‘জী, ম্যাম।’

আবার কিচেনে গিয়ে ঢুকল জেনিফার। তার চোখে অনিশ্চয়তা দেখতে পেয়েছে রানা। বুদ্ধিমতী মহিলা বুঝে গেছে, স্বামী আর মেজরের সম্পর্ক ভাল নয়।

মহিলা আলাপে নাক গলাবে না, সেটা বুঝেছে রানা। ওর এবার জানতে হবে অ্যালডো রসির শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে কোনভাবে জড়িত কি না সার্জেন্ট এবার্টন।

‘এদিকে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সার্জেন্ট।

তার পিছু নিয়ে সরু এক দরজা পার হয়ে বুকশেলফে ভরা এক ঘরে ঢুকল রানা। মেঝেতে মাঝারি মানের কার্পেট। এককোণে ছোট্ট টিভি। দেয়ালে কিছু ছবি। ঘরটা আরামদায়ক হলেও বিলাসবহুল নয়। পেছনে দরজা আটকে দিল রানা।

‘আপনি আসলে কী চান?’ নিচু গলায় কর্কশ সুরে জানতে চাইল এবার্টন। রানাকে বসতে বলেনি সে।

‘আমি অ্যালডো রসিকে খুঁজছি।

নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ করল এবার্টন। ‘আমিও তাকে খুঁজছি। তবে পাচ্ছি না।’

‘আজ কোথায় আছে সে?’

‘আমার এখন অফ ডিউটি,’ বলল এবার্টন। ‘আপনি যা-ই ভাবুন, আমি কিন্তু ওই লোককে আমার বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখিনি।’

‘তা হয়তো রাখেননি, তবে দু’জনে মিলে সাঁতার কাটছেন একই পুকুরে,’ শীতল সুরে বলল রানা।

ফ্যাকাসে হলো এবার্টনের মুখ। ‘তা হলে বলতে হবে যে আপনি ভুল ভাবছেন, মেজর। ভবিষ্যতে মুখ সামলে কথা বলবেন।’

‘আমার চোখ কিন্তু খোলা। আজ রাতে অ্যালডো রসির বাড়ির সামনে আপনি ছিলেন।’

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল সার্জেন্ট। ‘আমি দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসার নই। সেটা বিশ্বাস করুন বা না করুন।’

‘আজ কেন অ্যালডো রসির বাড়ির সামনে গিয়েছিলেন?’

‘আপাতত সেটা বলতে পারব না,’ মাথা নাড়ল সার্জেন্ট বরফ-শীতল চোখে তাকে দেখল রানা। ‘বলতে চাইছেন যে আপনি অ্যালডো রসির পকেটে নেই। অথচ বলবেন না কেন গেছেন তার বাড়ির সামনে। এবার বলুন, এমন কোন প্রমাণ আছে, যেটা থেকে আমি বুঝব যে আপনি একজন অপরাধী পুলিশ নন।’

রাগ-ভয় মিশ্রিত চোখে ওকে দেখল এবার্টন। ‘আপনি যা খুশি ধরে নিন। আমি এখন যা-ই বলি, সেটা আপনার মনোভাব পাল্টে দেবে না।’

‘চেষ্টা করে দেখুন।’

‘তার চেয়ে গুলি করে আমাকে মেরে এখান থেকে বিদায় হোন।’

লোকটার ভেতরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর ভয়ের ছাপ দেখছে রানা। আগেও অস্ত্রের মুখে বহু লোককে রেখেছে ও। তাই ভাল করেই জানে, নানান ধরনের হয় মানুষের ভয়। দোষী পুলিশ ভাবে যে ধরা পড়বে তার অপরাধ। যেটা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর। কিন্তু এবার্টনের চোখে লজ্জা বা পাপের ছাপ নেই।

‘আমাকে দেখেও অবাক হননি আপনি,’ বলল রানা, ‘কিন্তু সেটা কেন?’

কাঁধ ঝাঁকাল এবার্টন। ‘অফিসে আপনার প্রতিটি অপরাধ মনিটর করেছি। প্রথমে হেলথ সেন্টারে হামলা করলেন। খুন হলো একদল গুণ্ডা। অ্যালডো রসির টেবিলের ওপরে রেখে এলেন নিজের ভিযিটিং কার্ড। তখনই মনে হলো অ্যালডো রসির বাড়িতেও আপনি যাবেন। তাই ওদিকে গেছি আপনাকে ধরার জন্যে।

‘অথচ প্রথম থেকেই একদল নৃশংস অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়ছি আমি,’ বলল রানা। ‘আপনার কথা অনুযায়ী আপনিও তা-ই করছেন। আপনার পথ একরকমের, আমারটা অন্য রকমের।’

নাক দিয়ে আবারও ঘোঁৎ আওয়াজ করল এবার্টন। ‘আপনিও রসির মতই বেআইনি কাজ করছেন। আইন বা নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। আমার শহরে আপনার মত লোক আমি চাই না। কাজেই প্রথম সুযোগে আপনাকে গ্রেফতার করব।’

‘আইন কখনও কখনও ক্ষমতাধরের পক্ষে কাজ করে। আর সে-সময় সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হয়।’

‘হ্যাঁ, কখনও কখনও,’ বলল এবার্টন। ‘কিন্তু আপনি যে আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছেন, সেটাও চরম অন্যায়। আপনার আর আমার ভেতরে যা-ই ঘটুক, সেসব থেকে আমার স্ত্রীকে দূরে রাখবেন।’

‘কেন মনে হচ্ছে যে আমি আপনার কথা রাখব?’

‘আমি খোঁজ নিয়েছি। কখনও কাউকে কোন কথা দিলে সেটা আপনি রাখেন।’

পকেট থেকে বেরেটা নিয়ে শোল্ডার হোলস্টারে রাখল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘বেশ, মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির বিষয়ে আপাতত আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না।’

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল এবার্টন। ‘তাই বলে ধরে নেবেন না, আপনার প্রতি পাল্টে গেছে আমার মনোভাব। আমি আইনের লোক। আর আপনি ঠিক তার উল্টো পথের মানুষ। এই যে অস্ত্র হাতে আমার বাড়িতে এসে ঢুকলেন, তারপর হয়তো একটু পর বিদায়ও নেবেন, কিন্তু তাতে আমি ধরে নেব না যে আপনি আসলে অপরাধী নন।’

এ-লোক বোধহয় আসলেই অপরাধে জড়িত নয়, মনে মনে বলল রানা। ‘আমি আপনাকে মনোভাব বদলে নিতে বলছি না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও। ‘আর আপনার বাড়িতে না এসে আমার কোন উপায়ও ছিল না। সেজন্যে আমি দুঃখিত।’

‘আরও কিছু বলবেন?’ চাপা স্বরে বলল এবার্টন।

‘আপনি কি পিট ব্ল্যাক নামের কাউকে চেনেন?’

সার্জেন্টের চোখে কীসের যেন ছাপ। ‘হ্যাঁ, বলা যায় যে তার ব্যাপারে আমি কিছুটা জানি।’

‘দয়া করে তার সম্পর্কে আমাকে একটু ব্রিফ করুন।’

‘ওই লোক চিরকালের হারামি। সে তৈরি করে ছায়াছবি।’

‘টিভি কমার্শিয়াল?’

‘না, নোংরা ফিল্ম। কোন ভদ্রলোক ওসব দেখবে না।’

‘ঠিক জানেন তো?’

‘জেনেবুঝেই বলছি।’

‘কখনও গ্রেফতার করেছেন তাকে?’

মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘আপনার জানা থাকার কথা, নোংরা এসব ফিল্ম যারা তৈরি করে, তারা রয়ে যায় আওতার বাইরে। সবসময় ধরা পড়ে নিচের পর্যায়ের কর্মীরা। হয়তো সে কলেজ ছাত্র, সেমিস্টারের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বিক্রি করছে বেআইনি টিকেট।’

মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ, ওরা যাবে জেলে। চিরকালের জন্যে তাদের নাম উঠবে পুলিশের খাতায়।

‘ঠিকই ধরেছেন। আর তাদের বদলে একই কাজ করবে কলেজের অন্য কোন ছাত্র।’

এবার্টন এখনও অপরাধ না করলেও যে-কোন সময়ে অন্যায়ে জড়াতে পারে, ভাবল রানা। অনেক সময় চোখ বুজে থাকার বিনিময়ে কেকের কত বড় টুকরো পাচ্ছে, সেটাই বড় কথা হয়ে ওঠে পুলিশের অফিসারদের কাছে।

‘অ্যালডো রসির সঙ্গে কীভাবে ভিড়ল পিট ব্ল্যাক?’

‘যারা পর্নোগ্রাফি তৈরি করে, তারা সুসম্পর্ক রাখে ডন অ্যালডো রসির সঙ্গে।’ কাঁধ ঝাঁকাল এবার্টন। ‘রসির পরিবার সিনেমা তৈরি করা আর সেটা বিতরণের সঙ্গে জড়িত। যদিও আগেই এসব আপনি জেনে নিয়েছেন, মেজর।’

‘মিস রসির ব্যাপারে কিছু জানেন?’

ভুরু কুঁচকে ফেলল এবার্টন। ‘কী জানব?’

‘শুনেছি পিট ব্ল্যাকের সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্ক আছে।’

কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভেবে বলল এবার্টন, ‘হতে পারে। কানাঘুষায় এ-কথা আগেও শুনেছি। মহিলা নাকি পর্নোগ্রাফির নতুন পুরুষ অভিনেতা এলেই তাকে চেখে দেখে। যদিও এ- বিষয়ে আমাদের হাতে কোন ধরনের প্রমাণ নেই।’

‘বলুন তো, এখন কোথায় পাব পিট ব্ল্যাককে?’

‘লুপের কাছে শহরতলীতে তার অফিস,’ বলল এবার্টন। ‘যদিও বেশিরভাগ সময় ওখানে থাকে না। এ-ছাড়া তাকে পাওয়া যায় তার স্টুডিয়োতে। না বলে পারছি না, প্রচুর কাজ করে সে। গত কয়েকমাসে তৈরি করেছে একের পর এক ব্লু ফিল্ম।’

‘ঠিকানা দুটো দেবেন?’

টেবিল থেকে প্যাড আর কলম নিয়ে খস খস করে শিকাগোর দক্ষিণ এলাকায় স্টুডিয়ো আর অফিসের ঠিকানা লিখল সার্জেন্ট এবার্টন। তবে কাগজটা না নিয়ে তথ্যগুলো মুখস্থ করে নিল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘আপনি কি ভাবছেন রসির হেলথ ক্লাবে যা ঘটল, পিট ব্ল্যাকের স্টুডিয়োতেও তেমন কিছু ঘটবে?’

‘আপনি আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর আমি হয়তো যোগাযোগ করব পুলিশ স্টেশনে,’ বলল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘সেক্ষেত্রে স্টুডিয়োতে গেলে ধরা পড়বেন আপনি।’

‘অথবা, হয়তো ভাববেন ব্ল্যাকের মত পর্নোগ্রাফারকে শায়েস্তার একটা পথ আপনি খুঁজে পেয়ে গেছেন।’

রানা দেখতে পেল চকচক করছে পুলিশ অফিসারের দুই চোখ। নরম স্বরে বলল এবার্টন, ‘তেমনটা তো হতেই পারে!’

‘পিট ব্ল্যাক কি শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করে?’

ভাবতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল সার্জেন্ট। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘সে তেমন কিছু করলে সবার আগে আইন ভাঙব আমি।’

‘তো আপনি বলবেন না রসির বাড়ির কাছে কেন গেছেন। মনে করি না আমাকে গ্রেফতার করতে সেখানে যান।’

দৃঢ়বদ্ধ হলো সার্জেন্টের চোয়াল। ‘কোন দিনই বলব না। মরে গেলেও না। ওটা অন্য একটা কেস। তবে মনে রাখবেন, মেজর রানা, ফুরিয়ে আসছে আপনার সময়। কাজেই যা করার দ্রুত করতে হবে আপনাকে।’

রানার পেছনে খুলে গেল ডেনের দরজা। ঘুরে বেরেটার জন্যে কোটের ভেতরে হাত ভরল রানা। ধারণা করেছে ঘরে পা রেখেছেন মিসেস এবার্টন।

ওর ধারণাই সঠিক।

স্বামী আর রানার উদ্দেশে মৃদু হাসল মহিলা। ‘সরি, মেজর রানা। ড্রিঙ্ক দিতে ভুলে গিয়েছি। এখন কি দেব?’

‘আমি ডিউটিতে আছি, ম্যাম,’ হালকা সুরে বলল রানা। ‘আমাদের সঙ্গে ডিনার করবেন না? একটু পর সব রেডি হয়ে যাবে।’

‘আজ নয়,’ মাথা নাড়ল রানা, ‘এবার দেরি না করে কাজে যেতে হবে।’ ঘুরে এবার্টনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ও। ‘সময় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, সার্জেন্ট। পরে আপনার সঙ্গে আবারও আলাপ সেরে নেব।

হ্যাণ্ডশেক করবে না স্থির করেছে এবার্টন।

‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে,’ হাত কোটের পকেটে ভরল রানা।

‘সত্যিই হয়তো আবার দেখা হবে,’ বলল এবার্টন।

মিসেস এবার্টনের দিকে মাথা দুলিয়ে ডেন ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। বাড়ি ত্যাগ করার সময় কোন তাড়াহুড়ো করল না। চাইছে না প্রতিবেশীদের কারও মনে কৌতূহল তৈরি হোক। একই সঙ্গে চাইছে এই এলাকা থেকে দ্রুত সরে যেতে।

যখন তখন নিজের মনোভাব পাল্টে স্টেশনে ফোন দেবে সার্জেন্ট এবার্টন। এরই ভেতরে বোধহয় ওর গাড়ির লাইসেন্স প্লেট মুখস্থ করে নিয়েছে। এ-গাড়ি আর ব্যবহার করতে পারবে না রানা। অবশ্য তাতে কোন ক্ষতিও নেই। কয়েক ব্লক দূরে গিয়ে উঠে পড়বে এলিভেটেড স্টেশনে। তখন চট্‌ করে ওকে খুঁজে নিতে পারবে না কেউ।

ডিটেকটিভ সার্জেন্টের কথা মন থেকে দূর হচ্ছে না ওর। এটা স্পষ্ট: ডন অ্যালডো রসির সঙ্গে কোন না কোন যোগাযোগ আছে তার। নইলে সেই বাড়ির কাছে গাড়ি রেখে বসে থাকত না। তাকে দেখেও কিছু বলেনি বাড়ির গার্ডেরা। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আগে বা পরে এরার্টনের সঙ্গে আবারও মোকাবিলা হবে ওর।

এদিকে খোঁজ নিতে হবে সিনেটর পিটারের ব্যাপারে। তাতে হয়তো জানা যাবে অনেক কিছু। তবে আপাতত ওর প্রথম কাজ হবে পিট ব্ল্যাকের স্টুডিয়োতে যাওয়া। যেহেতু মাফিয়া ডনের বোনের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আছে লোকটার, তাই তাকে চাপ দিলে হয়তো জানবে জরুরি সব তথ্য।

আট

শিকাগোর দক্ষিণে বস্তির মত এক জায়গায় কাঠের ছোট কিছু বাড়িতে চলছে ড্রাগস, মদ, জুয়া আর পতিতাদের দেহদানের রমরমা ব্যবসা। এদিকে তেমন চলাচল নেই গাড়িঘোড়ার। যে ঠিকানা দিয়েছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট এবার্টন, সে অনুযায়ী বস্তি থেকে সিকিমাইল দূরে জনবিরল এলাকায় পরিত্যক্ত সব অফিস ও গুদামের পাশে পিট ব্ল্যাকের স্টিলের ওয়্যারহাউস। ফেটে যাওয়া কাঠের ফুটপাথ ধরে সেদিকে হেঁটে চলেছে রানা।

এবার্টনের কথা সত্যি হলে আবর্জনার এই ভাগাড়ের ভেতরে গোপনে নোংরা সিনেমা তৈরি করছে পর্নোগ্রাফার। অথবা ওকে মিথ্যা বলেছে সার্জেন্ট। সেক্ষেত্রে এটা মাফিয়ার পেতে রাখা কোন মৃত্যু-ফাঁদ।

ফাঁকা রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত এক অফিসের পাশে থেমে ব্ল্যাকের ওয়্যারহাউসের ওপরে চোখ রাখল রানা।

থমথমে রাতে কেউ নেই আশপাশে।

এটা কি সত্যিই ফাঁদ? -নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। মন থেকে পেল না কোন জবাব। একটু পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবল, এত দূরে এসে এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। মাফিয়া ডন রসিকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্যে যে- কোন ঝুঁকি নিতে রাজি আছে ও।

আধ ইঞ্চি পুরু বোর্ড দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে ব্ল্যাকের ওয়্যারহাউসের সব জানালা। এক ইঞ্চি বোর্ড মেরে বন্ধ করেছে লোডিং ডকের দরজা। ছায়া থেকে বেরিয়ে ওয়্যারহাউসের দেয়ালের দিকে চলল রানা, হাতে অটোম্যাগ।

এই ব্লকের শেষমাথায় টিমটিম করে জ্বলছে রোড ল্যাম্পের হলদেটে বাতি। সেই আবছা আলোয় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লোহার দেয়ালের পাশে থেমে কোথাও কোন বিপদ আছে কি না তা জানতে চারপাশে তাকাল ও, সতর্ক। বহু দূর থেকে এল শিকাগোর আবছা গুঞ্জন। ঝিকঝিক করছে এলিভেটেড মেট্রোরেলের ট্রেন। বাজল পুলিশের সাইরেন। যদিও এদিকে আসছে না। এ-এলাকা যেন পরিত্যক্ত কোন বন্দর।

ওয়্যারহাউসের দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে রানা, পরনে ওভারকোটের নিচে কালো স্যুট। ভেতরে কীভাবে ঢুকবে সেটা বোঝার জন্যে আশপাশে তাকাল। বিশাল লোডিং ডোরের পাশেই সরু এক দরজা। কিন্তু ওদিক দিয়ে ঢুকতে চাইছে না ও। বাঁক নিয়ে ওয়্যারহাউসের পেছনে সরু গলিতে চলে এল রানা। পেছনের উঠনে পুরনো দুটো কমদামি গাড়ি আর একটা প্রায় নতুন সুজুকি জিপ। শেষেরটা বোধহয় পিট ব্ল্যাকের, ভাবল রানা।

ওয়্যারহাউসের ওপরদিকে একসারিতে বেশকিছু জানালা। যদিও ওগুলো নাগালের বাইরে। আরেকটু এগোবার পর মাটি থেকে আট ফুট ওপরে ছোট্ট এক জানালা দেখতে পেল রানা।

একটু দূরে পেছনের উঠানের ওদিকে বিশাল আকারের কয়েকটা ওয়্যারহাউস। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই।

ওভারকোট খুলে মাটিতে ফেলে লাফ দিয়ে ছোট্ট জানালার নিচের অংশ দু’হাতে ধরল রানা। টেনে তুলল নিজেকে। জানালার নোংরা কাঁচে একরাশ ধুলো। ওদিকের ঘরে উঁকি দিয়ে রানা দেখল, ওটা খুব ছোট একটা বাথরুম। ভেতরে কেউ নেই। অথবা বসে আছে দেয়াল-ঘেঁষা কমোডে। বামহাতে জানালার কাঁচ সরাতে চাইল রানা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। জানালার কাঠের ফ্রেম ফুলে গেছে বলে ফেঁসে গেছে কাঁচের দুই পাল্লা।

জানালার বাইরের দিকের সরু অংশে হাতের তালু রেখে বেকায়দাভাবে ঝুলছে রানা। ভারসাম্য ধরে রাখার জন্যে দেয়ালে ঠেকাল বুটের দুই ডগা। বামহাতে হোলস্টার থেকে নিল অটোম্যাগ। ওটার বাঁট দিয়ে ঠুকঠুক করে বাড়ি দিল জানালার কাঠের ফ্রেমের মাঝে। তাতে একটু পর ভাঙা কাঠ থেকে খসে এল কাঁচের একটা প্যানেল। এতে শব্দ হলেও সেটা খুব জোরাল নয়। ধারেকাছে কেউ থেকে থাকলে আওয়াজটা শুনেছে। তবে এই ঝুঁকি না নিয়ে উপায় ছিল না। হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দ্বিতীয় প্যানেলের পাশে ঠেস দিয়ে কাঁচের প্যানেল রাখল রানা। জানালার সরু জায়গাটা দিয়ে ঢুকতে চাইল। আরেকটু হলে ফ্রেমের ভেতরে আটকা পড়ত চওড়া কাঁধ। বাথরুমের দু’দিকের দেয়াল ধরে ঊরু পর্যন্ত ঢুকল ও। এরপর দু’পা ভেতরে টেনে নিয়ে লাফিয়ে নামল মেঝেতে। বাসি প্রস্রাবের ভয়াবহ বাজে গন্ধে বমি এল ওর। তিক্ত মনে ভাবল: এই কমোড কোনকালেই ফ্লাশ করে না ব্লু ফিল্মের শালা-শালীরা!

হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিয়ে কান পাতল দরজায়। বাইরে যখন ছিল, কোন আওয়াজ পায়নি। ওয়্যারহাউসের ভেতরে এখন চলছে মৃদু বাজনা। ব্লু ফিল্ম তৈরি করার জন্যে বোধহয় ওয়্যারহাউস সাউণ্ডপ্রুফ করে নিয়েছে পিট ব্ল্যাক।

বামহাতে দরজার নব ঘুরিয়ে কবাট খুলল রানা। দরজার ওদিকে আবছা আলো। ভাপসা পরিবেশে কিছু পচে যাওয়ার দুর্গন্ধ। যদিও সেটা বাথরুমের প্রস্রাবের মারাত্মক শুয়োরী কুবাসের চেয়ে ঢের ভাল।

ধারেকাছে কেউ নেই সেটা বুঝে বাথরুম থেকে বেরোল রানা। পেছনে আটকে দিল দরজা। বাইরে থেকে ওয়্যারহাউস পরিত্যক্ত আর ফাঁকা মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। চারপাশে ইকুইপমেন্ট আর প্লাস্টারবোর্ড। শেষেরগুলো দিয়ে তৈরি করা হয় সিনেমার দৃশ্য। দরকার ফুরিয়ে গেলে স্টেজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। রানা বুঝল, পাশের প্লাস্টারবোর্ড কোন না কোন বেডরুমের অংশ। এ-ছাড়া আছে লিভিংরুম আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সব ডিযাইন।

এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ায় ঢুকছে রানা। ওয়্যারহাউসের নিচতলার সেট-এ বাজনা ও আলো দেখে সেদিকেই চলেছে। কিছুটা যেতেই দেখতে পেল, সামনে নানান আসবাবপত্র। তার মাঝে বিশাল এক ওঅটার বেড। দু’দিক থেকে ওটার ওপরে জোরাল আলো ফেলেছে অসংখ্য বাতি।

ওঅটার বেডে দুই মেয়েকে দু’দিকে রেখে রাজার মত বসে আছে উলঙ্গ এক মোটকু ভাঁড়। মেয়েদুটোও পুরো উদোম। তারা যে দারুণ ফূর্তিতে আছে, সেটা বোঝাতে চাইছে ক্যামেরার সামনে। যদিও রানা দেখল, ঘেমেনেয়ে প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে তিন পারফর্মার। চোখে-মুখে চরম ক্লান্তি। বড় এক ক্যামেরার পেছনে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে আছে এক ক্যামেরাম্যান। পাশে সতর্ক শয়তান পিট ব্ল্যাক। অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে মাঝে মাঝে নির্দেশ দিচ্ছে সে। ‘কোমর একটু ওপরে তোলো! চুমু দাও কানের লতিতে! খবরদার! ভুলেও ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ব্লক করবে না!’

এই ব্যাটাই আসলে ডিরেক্টর, ভাবল রানা। মেয়েদের ঘামের বুনো গন্ধ আর পুরুষের বীর্যপাতের বাজে গন্ধে নাক কুঁচকে গেল ওর।

ডাবিং পরে হলেও এসব নোংরা মুভিতে বড় কোন ভূমিকা থাকে না সাউণ্ড-ট্র্যাকের। তবুও ক্যামেরার পেছনে বাজছে স্টেরিয়ো সেটে মিউযিক। এটা করা হচ্ছে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের চাঙ্গা করে তুলতে। যদিও তাতে কোন ফায়দা হচ্ছে না।

ঘণ্টাখানেক আগে বিচিতে এলিসা রসির হাঁটুর জোর গুঁতো আর মাথার ওপরে রানার পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেলেও এখন ভাল মুডে আছে পিট ব্ল্যাক। পুরো মন তার দৃশ্য গ্রহণে। তার নির্দেশনায় ওঅটার বেডে বসে খুশি-খুশি ভাব করছে পারফর্মারেরা।

অন্যদিকে গেল রানার চোখ। ব্ল্যাকের পেছনে চারজন লোক। তাদের তিনজনকে মাফিয়ার গুণ্ডা বলে মনে হলো, ওর। ষাঁড়ের মত দেহ। চোখে-মুখে বুদ্ধির ছাপ নেই। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে অনৈতিক যৌনক্রিয়া। অবশ্য চতুর্থজন একেবারেই আলাদা। তার পরনে দামি পোশাক। চোখ হিসাব-রক্ষকের।

সার্জেন্ট এবার্টন ঠিকই বলেছে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। পিট ব্ল্যাকের নীল ছবি তৈরির ব্যবসায় নাক গুঁজে দিয়ে লাখ লাখ ডলার লুটে নিচ্ছে মাফিয়ারা। খরচ আরও কমাতে এখানে এসেছে হিসাব-রক্ষক, যাতে আরও বেশি মুনাফা করতে পারে অ্যালডো রসি।

পিট ব্ল্যাকের কাছ থেকে অ্যালডো রসির ব্যাপারে খোঁজ নেবে বলে এখানে এসেছে রানা। তবে বাজে সিনেমার এই পরিচালককে যে চট্ করে হাতের মুঠোয় পাবে, সে-সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ।

‘ঠিক আছে, এ-দৃশ্য শেষ,’ বলল ব্ল্যাক, ‘আরেকটু ভাল করলে তোমরা পেয়ে যাবে অ্যাকাডেমি পুরস্কার!’

দেয়াল টপকে ওঅটার বেড থেকে উঠল ভোঁতা চেহারার গণ্ডারের মত মোটা অভিনেতা। পুরো উলঙ্গ বলে বিব্রত বোধ করছে সে। তিক্ত সুরে বলল, ‘তোমার কি মনে হয় আস্ত দুটো ডাইনীর সঙ্গে এসব করতে আমার ভাল লাগে, পিট? পারলে তোমরা নিজেরা আমার মত উদয়-অস্ত খেটে দেখো!’

রাগী চেহারায় ওঅটার বেড ছাড়ল দুই মেয়ে। তাদের একজন খেপে গিয়ে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চাটা বলে কী! আমরা বলে ডাইনী? নিজের নেই মুরোদ!’

ডানহাত তুলে এক পা এগোল গণ্ডার। মেয়েটার গালে চড় দেবে। অবশ্য ব্ল্যাকের পেছনে তিন গুণ্ডাকে নড়ে উঠতে দেখে থেমে গেল সে। মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো, কড়ি। অভিনয়ে তোমাকে না নিলেও, র‍্যাচেল আর ট্রেসিয়াকে ছাড়া আমার কোনভাবেই চলবে না।’

‘আসলে সৃষ্টিশীল কাজ তুমি মোটেই বোঝো না,’ বিড়বিড় করল কড়ি। একটা চেয়ার থেকে তোয়ালে তুলে ঢেকে নিল শরীর।

পিট ব্ল্যাকের সামনে গিয়ে থামল মেয়েদুটো। আগের মেয়েটা হাত রাখল ব্ল্যাকের বাহুতে। ‘তুমি কি আমাদের কথা কখনও ভাববে না, পিট? এই শুয়োরটার সঙ্গে অভিনয় করছি, সেটাই তো মস্তবড় শাস্তি। তার ওপরে তুমি আমাদের কাজ দেখাতে ডেকে এনেছ হাঁদা চেহারার তিন ডাকাতকে! মাফিয়ার তিন পাণ্ডাকে আঙুল তুলে দেখাল সে।

ওর দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে গুণ্ডারা।

ব্ল্যাক ঘুরে তাকাল দামি পোশাক পরা লোকটার দিকে। উলঙ্গ দুই মেয়েকে দেখেও অস্বস্তি নেই তার। কাঁধ ঝাঁকাল ব্ল্যাক। ‘ইয়ে… ট্রেসিয়া, আমরা না হয় পরে এসব নিয়ে আলাপ করব। দুশ্চিন্তা কোরো না, ঠিক সময়ে বেতন পেয়ে যাবে।’

বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে তোয়ালে নিয়ে আরেকদিকে চলে গেল ট্রেসিয়া। বুকের ওপরে তোয়ালে রেখে তার পিছু নিল দ্বিতীয় মেয়েটা। পেছন থেকে তাদেরকে টিটকারির সুরে কী যেন বলল তিন গুণ্ডার একজন।

‘যথেষ্ট, আর একটা কথাও নয়!’ কঠোর চোখে তার দিকে তাকাল হিসাব-রক্ষক। পরক্ষণে ব্ল্যাকের উদ্দেশে বলল, ‘ব্ল্যাক, অফিসে চলো। জরুরি কথা আছে।’

‘জী, মিস্টার লেস্টার,’ লোকটাকে ভয় পায় বলে একটু দ্রুত কথাটা বলেছে পিট ব্ল্যাক।

দূরে কাঠের নড়বড়ে এক ড্রেসিংরুমে ঢুকল ট্রেসিয়া আর র‍্যাচেল। আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল তিন গুণ্ডা। বোধহয় ভাবছে, একটু পর আবার দেখতে পাবে উলঙ্গ মেয়েদেরকে। স্টেজ ছেড়ে ওয়্যারহাউসের কোণে কাঁচে ঘেরা ছোট এক অফিসের দিকে চলেছে পিট ব্ল্যাক আর মিস্টার লেস্টার। তারা জানে না, অন্ধকারে নানান সেট এড়িয়ে নিঃশব্দে ছায়ার মত তাদের পিছু নিয়েছে এক যুবক।

মিনিট খানেক পর অফিসে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ব্ল্যাক আর লেস্টার। ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসল হিসাব-রক্ষক। নিজের চেয়ার ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে কোন আপত্তি নেই ব্ল্যাকের।

অন্ধকার থেকে কাঁচ-ঘেরা অফিসে উঁকি দিল রানা। ওয়্যারহাউসের যেখানে আছে তিন গুণ্ডা, ওখান থেকে অফিসে চোখ রাখতে পারবে না তারা। রানার বড় সমস্যা হচ্ছে, অফিসের মোটা কাঁচ। ওটার জন্যে প্রায় কিছুই শুনছে না ও।

বেশিরভাগ কথা বলছে লেস্টার। রাগে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ডেস্কের সামনে অস্বস্তি নিয়ে বারবার পা বদল করছে পিট ব্ল্যাক। মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছে। মুখে অসহায় ভাব।

অফিসের অন্যদিকে সরে এল রানা। পেছনে সেট ভাঙা বেডরুমের দেয়াল। মেঝেতে কয়েক সারি ইলেকট্রিকের কেই। স্টুডিয়োর তুলনায় অফিস ছোট হলেও সেটা বেশ আধুনিক। মেঝেতে পুরু কার্পেট। দেয়ালে দামি চিত্রকর্ম। চেয়ার-টেবিল বিলাসবহুল। একদিকের দেয়ালের র‍্যাকে সারি সারি উইস্কির বোতল। সিনেমা তৈরি করতে কেপ্পনের মত কম খরচ করলেও ব্ল্যাক যে মদের ব্যাপারে উদারহস্ত, তা বুঝে গেল রানা।

আপাতত খুব মানসিক কষ্টে আছে লোকটা।

‘আর এক পয়সাও নয়,’ কড়া গলায় বলল হিসাব-রক্ষক লেস্টার। ‘বারবার বাধা পড়ছে কাজে। তাতে বেড়ে গেছে খরচ। এদিকে ডিলারেরা বারবার তাড়া দিচ্ছে, যাতে নতুন সিনেমা দেয়া হয়।’

‘তবে আপনি তো জানেন শিল্পীরা আসলে কেমন হয়, ‘ থেমে থেমে বলল ব্ল্যাক। মোটা কাঁচের জন্যে ভোঁতা শোনাচ্ছে কণ্ঠস্বর। ‘আগে ওদেরকে তেল দিয়ে তবে আদায় করতে হয় অভিনয়।

‘তুমি কীভাবে কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার, ব্ল্যাক। আমাদের চাই নিয়মিত ভাল সিনেমা।’ চেয়ারে হেলান দিল লেস্টার। কোটের পকেট থেকে নিল প্লাস্টিকের স্বচ্ছ, ছোট এক প্যাকেট। ওটার ভেতরে সাদা গুঁড়ো। আস্তে করে টেবিলে প্যাকেট রাখল সে। ‘এবারের চালান। এতেই ওদের কয়েক দিন খুশি থাকার কথা।

প্যাকেট হাতে নিয়ে হাসল ব্ল্যাক। ‘হ্যাঁ, এবার কাজ হবে। আমার হয়ে মিস্টার রসিকে ধন্যবাদ দেবেন, স্যর।’

‘তোমার ধন্যবাদ শুনতে বসে নেই ডন রসি। তিনি চান সুন্দর অভিনয়। আর সেটা তাঁকে দিতে হবে।

যথেষ্ট শুনেছে রানা। অফিসে ঢুকবে বলে দরজার দিকে এক পা বাড়াল। আর তখনই ওর পেছন থেকে কাঁচভাঙা গলায় চিৎকার জুড়ল এক মেয়ে: ‘আরে! এখানে কী করো! … কে তুমি?’

চরকির মত ঘুরল রানা। কোত্থেকে যেন হাজির হয়েছে নীল ছবির অভিনেত্রী র‍্যাচেল, বুকের ওপরে তোয়ালে। রানাকে চিনতে না পেরে চমকে গেছে। যুবকের হাতে আবার বিশাল সাইযের এক পিস্তল! ঘুরেই চিলের মত বিশ্রী চিৎকার ছেড়ে অন্ধকারে পালিয়ে গেল মেয়েটা।

ভাগ্যকে মনে মনে অভিশাপ দিল রানা। লেস্টার আর ব্ল্যাকের কথা শুনতে এত ব্যস্ত ছিল ও, টের পায়নি এত কাছে হাজির হয়ে গেছে মেয়েটা। এখন আর কিছু করার নেই। অফিসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্টেজ লক্ষ্য করে অটোম্যাগ তাক করল রানা। নারীকন্ঠের চিৎকার আর ধুপধাপ দৌড়ের আওয়াজে অফিসের দিকে ছুটে আসছে তিন মস্তান। এরই ভেতরে হোলস্টার থেকে বের করেছে পিস্তল।

অন্ধকার থেকে ভূতের মত বেরিয়ে সামনে অটোম্যাগ পিস্তল বাড়িয়ে ধরেছে রানা। অস্ত্রের নল থেকে ছিটকে বেরোল লাল স্ফুলিঙ্গ। ওয়্যারহাউসের বদ্ধ পরিবেশে ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলল অটোম্যাগ। পাশাপাশি অফিসের দিকে ছুটে এসেছে তিন গুণ্ডা। রানার প্রথম গুলিতে বামদিকের মস্তানের গলা থেকে উড়ে গেল আস্ত মাথা। কয়েক ফুট ছুটে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল তার লাশ। ঠনঠনাৎ শব্দে মেঝেতে পিছলে অন্যদিকে গেল হাতের পিস্তল।

নল ডানে ঘুরিয়ে পর পর দুবার বুলেট পাঠাল রানা। ভারী ক্যালিবারের গুলি বিধল অন্যদুই মস্তানের বুকে। দেরি না করে চরকির মত অফিসের দরজার দিকে ঘুরল রানা। এদিকে বাইরে গুলির শব্দ শুনেও লেস্টার আর ব্ল্যাক ভেবেছে সব সামলে নেবে মাফিয়ার মস্তানেরা। কিন্তু তিন-তিনটে গুলির শব্দে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তারা। দরজা খুলে আগে বেরোল লেস্টার, হাতে খাটো নলের ছোট্ট কোল্ট রিভলভার। এদিকে প্রাণের ভয়ে আঁধারে ঝেড়ে দৌড় দিল পিট ব্ল্যাক।

সামনে কালো পোশাক পরা অচেনা এক লোককে দেখে পা হড়কে থেমে গেছে হিসাব-রক্ষক। চালু মাল সে। রানার বুকের দিকে রিভলভার তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার। কানের পাশ দিয়ে বুলেট যাওয়ার শোঁ আওয়াজ শুনল রানা। নিজেও দেরি করেনি, কষ্ট করে অটোম্যাগ ঘুরিয়ে টিপে দিয়েছে ট্রিগার।

লেস্টারের ছোট্ট রিভলভারের গুলির শব্দ চাপা পড়েছে অটোম্যাগের প্রচণ্ড আওয়াজে। কুড়াল দিয়ে মানুষের মাথা দু’ফাঁক করলে যা হবে, সেটাই করেছে .৪৪ বুলেট-স্রেফ দু’ভাগ হয়েছে হিসাব-রক্ষকের মাথা। পেছনে অফিসের কাঁচের দেয়ালে ছলাৎ করে লাগল হলদেটে মগজ। পিছিয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ল লোকটার মৃতদেহ।

ব্ল্যাককে খুঁজতে ছায়ার ভেতরে চোখ বোলাল রানা। ওয়্যারহাউসের পেছনে কার যেন ছুটন্ত পদশব্দ। ওদিক থেকে চিৎকার করল এক মেয়ে: ‘একমিনিট! আমাদেরকে ফেলে যেয়ো না! একটু থামো! প্লিয! ব্ল্যাক!’

স্টুডিয়োর পেছনে খুলে গেল একটা দরজা। আওয়াজটা পেয়ে ওদিকে ছুটল রানা। শুনতে পেল খটাং শব্দে আটকে গেল কোন গাড়ির দরজা। গর্জে উঠেছে জিপের ইঞ্জিন। ব্ল্যাককে যেভাবে হোক ধরতে হবে, ভাবল রানা।

‘একমিনিট!’ চেঁচিয়ে উঠল একটা মেয়ে।

অটোম্যাগ হাতে ঘুরে তাকাল রানা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে সিনেমার ক্যামেরাম্যান। প্রথম গুণ্ডার হাত থেকে পড়ে যাওয়া পিস্তল এখন তার হাতে। অস্ত্র হাতে থরথর করে কাঁপছে তরুণ। রানার বুকে তাক করেছে মাযল।

‘পিস্তল মেঝেতে রাখো,’ কড়া গলায় বলল রানা। ‘আমার লড়াই কিন্তু তোমার সঙ্গে নয়। খুন হয়ো না।’

‘আপনি বলছেন আমার সঙ্গে আপনার কিছু হয়নি?’ ঢোক গিলল ক্যামেরাম্যান। ‘আপনি তচনচ করে দিয়েছেন স্টুডিয়ো। তাতে আমার সত্যিই কিছু না। আমি শুধু এখান থেকে পালিয়ে যেতে চাই।’

‘তো পিস্তল ফেলে বিদায় হয়ে যাও,’ বলল রানা।

‘কিন্তু আপনি আমার পিঠে গুলি করলে, তখন?’

কয়েক সেকেণ্ড তরুণ ক্যামেরাম্যানের দিকে চেয়ে রইল রানা, তারপর হোলস্টারে রেখে দিল অটোম্যাগ। ‘এবার খুশি? তুমি তো ক্যামেরা চালাও। সেজন্যে তোমাকে খুন করবে না কেউ।

‘পরে আবার সত্যি সত্যি গুলি করে দেবেন না তো?’

‘বাঁচতে চাইলে ভাগো! এসবে আর থেকো না।’

রানার কঠোর মুখ দেখে বারকয়েক ঢোক গিলল ক্যামেরাম্যান। মেঝেতে পিস্তল রেখে তীরবেগে ছুটল কাছের দরজার দিকে। তার পিছু নিল রানা। সামনে ফাঁদ আছে ভেবে সতর্ক। প্রায় পৌঁছে গেছে পেছনের সরু দরজার কাছে, এমনসময় ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক অভিনেত্রী।

এই মেয়ের নাম ট্রেসিয়া। রানাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। দু’হাত মুঠো করে কিল দিল ওর বুকে। কিল দিচ্ছে আর নিজেই বলছে, ‘ছেড়ে দে, শয়তান! আমাকে ছেড়ে দে!’

‘তুমিই বরং আমাকে রেহাই দাও, বাপু!’ বলল মহাবিরক্ত রানা। ভাবছে: বাঙালি সিনেমার বস্তাপচা এই ডায়ালগ আমেরিকায় এল কীভাবে! শক্ত হাতে মেয়েটার কবজি ধরল ও। ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। বলতে পারো কোথায় গেছে পিট ব্ল্যাক?’

খুন হবে না শুনে শরীরে তোয়ালে জড়াল মেয়েটা। রাগী গলায় বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা আমাদেরকে ফেলে পালিয়ে গেছে! অথচ বলেছিল: স্টুডিয়োতে রেইড হলে, সব সামলে নেব! শুয়োরটা কত্ত বড় মিথ্যুক!’

‘সে কি চলে গেছে, নাকি এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে?’

‘নিজের চোখে দেখেছি, জিপগাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেল! কয়েকটা গার্বেজ ক্যানের ওদিকে গাড়ি রাখে। হারামজাদা যেমন নোংরা কেঁচো, আবর্জনাতেই ওর থাকা উচিত!’

‘তুমি আর র‍্যাচেল বোধহয় বান্ধবী?’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল ট্রেসিয়া। ‘এত ভয় পেয়েছে যে ড্রেসিংরুম থেকে বেরোচ্ছে না। ওদিকে গুলির আওয়াজে খাটের নিচে গিয়ে ঢুকেছে শুয়োর কড়ি! …বলো তো, তুমি আবার সত্যিই পুলিশ নও তো?’ এক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা।

‘আমি এসেছি ব্ল্যাকের সঙ্গে কথা বলতে, আশ্বস্ত করল রানা।

তাতে গায়ের কাঁপুনি থামল ট্রেসিয়ার। নিচু গলায় বলল, ‘আমরা গুলির আওয়াজ শুনেছি। কিছুই দেখিনি। তাই তোমার ব্যাপারে পুলিশকে কিছুই জানাতে পারব না। আর আমি তো তোমাকে কোনকালে দেখিইনি!’

‘আমিও তোমাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি,’ বলল রানা। ‘এবার বলো তো, এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে ব্ল্যাক?’

‘ভয় পেলে যেখানে গিয়ে ওঠে। রুবা আর সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড ফিটনেস জিমে। একটু আগে যেভাবে পালিয়ে গেল, এখন সোজা গিয়ে লুকাবে রুবার পেছনে।’

‘সিম্পসন আর রুবা কি বেআইনি কোন জয়েন্ট চালায়?’ মাথা দোলাল ট্রেসিয়া। ‘হ্যাঁ। আমার মনে হয় ব্ল্যাকের এসব সিনেমা তৈরি করার পেছনে আছে মিস্টার রসি, সিম্পসন আর রুবা।’

এক পা সামনে বাড়ল রানা।

তোয়ালে বুকের ওপরে টেনে নিল মেয়েটা।

‘রসি সম্পর্কে কিছু জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘মাঝে মাঝে এখানে আসে,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল ট্রেসিয়া। ‘তবে এসব নিয়ে বোধহয় আমার কিছু না বলাই ভাল।’

‘ট্রেসিয়া, এখানে কি ব্ল্যাক বা অন্য কেউ শিশুদের দিয়ে ব্লু ফিল্ম তৈরি করে?’

ভয় ভুলে রেগে গেল মেয়েটা। জ্বলজ্বল করছে দু’চোখ। ‘দেখো, আমরা ভাল মেয়ে নই। খাবার আর বাড়ির খরচ অনেক। তাই বাধ্য হয়ে পয়সার জন্যে এত নিচে নেমে যেতে হয়েছে। তবে আমরা তো আর নরপশু নই!’

‘এদিকে কখনও শিশুদের দিয়ে ব্লু ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, এমন কিছু শুনেছ?’

মাথা নাড়ল ট্রেসিয়া। ‘তেমন কিছু কখনও শুনিনি। আর তেমন কিছু জানলে জীবনেও এসব কুকুরের বাচ্চাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতাম না!’

মেয়েটার কথাগুলো নিয়ে দ্রুত ভাবল রানা। ওয়্যারহাউস এলাকা ছেড়ে হয়তো যায়নি পিট ব্ল্যাক। দোতলা বা এদিকের কোথাও লুকিয়ে আছে। বাইরে ফাঁদ পেতেছে তার দলের লোক। যদিও মনে হচ্ছে না যে মিথ্যা বলছে মেয়েটা। পিট ব্ল্যাক ওয়্যারহাউস ত্যাগ করতেই গর্জে উঠেছে গাড়ির ইঞ্জিন। দ্রুত চলে গেছে জিপ।

‘বান্ধবীকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও,’ বলল রানা ‘একটু পর হাজির হবে পুলিশের লোক।’

ড্রেসিংরুমের দিকে ছুটল ট্রেসিয়া।

নীল ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে ইনসেনডিয়ারি গ্রেনেড ফাটিয়ে রসির ওয়্যারহাউস মাটিতে মিশিয়ে দেবে, ভাবল রানা। পুলিশ আসার আগেই চলে যাবে বহু দূরে। সামনে পড়ে আছে ওর প্রচুর কাজ। রুবা আর সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড ফিটনেস সেন্টারে গিয়ে ধরতে হবে পিট ব্ল্যাককে। তার কাছ থেকে বের করতে হবে হাঁড়ির খবর। এরপর ডন অ্যালডো রসির আস্তানায় পৌঁছে যাবে রানা।

নয়

বহুকাল পর এত ভয় পেয়েছে পিট ব্ল্যাক। ব্লু ফিল্মের স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে সোজা এসেছে সিম্পসনের বারের কাছে। এক ব্লক দূরে গাড়ি রেখে নামতেই টের পেল, ঠক- ঠক করে কাঁপছে তার দু’পা। তবুও দৌড়ে চলল সিম্পসনের বারের দিকে। চোখের সামনে এখনও দেখছে মাসুদ রানার কঠোর মুখ। লেস্টার আর ও অফিস থেকে বেরোতেই যে দৃষ্টিতে ওদেরকে দেখেছে লোকটা, তাতে আরেকটু হলে ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করে দিত ব্ল্যাক। বারবার ওর মনে হচ্ছে, এবার সবকিছু ফেলে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে।

কী করবে সেটা পরে ভাববে, আগে চাই ঢক ঢক করে একগ্লাস উইস্কি গিলে নেয়া। এরপর লুকিয়ে পড়বে কোথাও। একবার এলিসা রসির কথা ভাবল ব্ল্যাক। ব্যথায় টনটন করছে অণ্ডকোষ। বহুৎ কষ্ট করে ক্লসিট থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। তারপর একটা কথাও বলেনি এলিসা রসি।

না, তার কাছে সাহায্য চেয়ে কোন লাভ হবে না। চড়ই পাখির লেজের মত তিরতির করে কাঁপছে দু’হাঁটু। ব্ল্যাক বুঝতে পারছে, শুধু যে মাসুদ রানার হিট লিস্টে আছে, তা নয়, নিজের হিট লিস্টেও ওর নাম তুলেছে ডন রসি। এটা ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরছে তার। হতাশ হয়ে ভাবল, মাত্র একটা দিনের ভেতরে কীভাবে সব বদলে গেল?

মুখে লাগছে কনকনে হাওয়া, ওটা পাত্তা না দিয়ে নিয়ন বাতি দিয়ে সাজানো ভারী দরজা পেরিয়ে তড়িঘড়ি করে সিম্পসনের বারে ঢুকে পড়ল ব্ল্যাক।

কাঠের চারতলা বাড়ি সাদা চুনকাম করা। একদিকে বার, অন্যদিকে রুবার জিমনেশিয়াম।

পেছনে দরজা বুজে যেতেই ভাবল ব্ল্যাক: এবার এখানে এসে ওকে বোধহয় ধরতে পারবে না মাসুদ রানা।

কর্মচারীদের বন্দুক দিয়েছে সিম্পসন। বার কাউন্টারের নিচে ওগুলো লুকিয়ে রাখে তারা। কেউ মাতাল হয়ে ঝামেলা করলে বের করে। রুবার কর্মচারীরাও ঝামেলা হলে যে- কাউকে রুখে দেয়। এই দুই দলের সবার অ্যাপ্রনের নিচে থাকে পিস্তল বা রিভলভার। বিশেষ করে সিম্পসনের বার- এ। নামকরা সব মাফিয়া নেতারা আসে। তাই তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার কাজও সিম্পসনের কর্মচারীদের হাতে।

বারের ছাত বেশ নিচু। দেয়ালে কালো কাঠের প্যানেল। এসব করা হয়েছে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করার জন্যে। এখানে এলে কেমন এক নিরাপত্তার অনুভূতি টের পায় সাধারণ মানুষ। আর এখন পিট ব্ল্যাক নিজেও চাইছে নিরাপদ এক জায়গা, যেখানে হাজির হবে না মাসুদ রানা।

একটা বুথে বসে তর্জনী তুলে বারটেণ্ডারের দিকে ইশারা করল ব্ল্যাক। এই বার-এর কর্মচারীরা ভাল করেই চেনে ওকে। মিনিট তিনেকের ভেতরে ওর সামনের টেবিলে নির্জলা উইস্কি দিয়ে গেল এক ওয়েইট্রেস।

সন্ধ্যার পর বরাবরের মতই বার-এ আছে একদল মাতাল। এত মানুষের ভেতরে মনে মনে স্বস্তি পেল ব্ল্যাক। ইচ্ছা হলেই এখানে এসে সবার চোখের সামনে পিস্তল বের করে যা খুশি করতে পারবে না মাসুদ রানা। এই বার শুধু মাফিয়ার জন্যে নয়, নিরপরাধ মানুষও ড্রিঙ্ক করতে আসে, তাই গোলাগুলি হলে অনেকে আহত হবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে কঠোর চেহারার লোকটার।

গ্লাস খালি করে আঙুল তুলে এক ওয়েইট্রেসকে ডাকল ব্ল্যাক। খাটো স্কার্ট আর নিচু ব্লাউস পরনে মেয়েটা এসে টেবিলে রাখল পুরো এক বোতল পাসপোর্ট উইস্কি। তাতে খুশি হয়ে আদর-আদর এক ভঙ্গি করে ওয়েইট্রেসের নিতম্বে চিমটি কাটল ব্ল্যাক। তাতে রেগে গিয়ে মনে মনে ওর চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে বারের অন্যদিকে গেল মেয়েটা।

বোতল থেকে গ্লাসে উইস্কি ঢেলে সরাসরি তরল-গরল পেটে চালান দিল ব্ল্যাক। গরম হয়ে উঠেছে তার শরীর। একবার ভাবল সে, স্মার্টফোন দিয়ে কাছের কোন বন্ধুকে কল দেবে। ওর চাই এমন কাউকে, যে কি না কিছু দিনের জন্যে ওকে লুকিয়ে রাখবে। মাসুদ রানার কথা ভাবলেই এখনও গা শিরশির করছে ওর।

কোটের পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ওটার সুইচ অফ করে আবারও রেখে দিল পকেটে। বোতল থেকে আরও দুই আউন্স সোনালি তরল গ্লাসে ঢেলে ঢক ঢক করে চালান দিল পেটে। মনের ভেতরে বাড়ছে অ্যালকোহলের তৈরি করে দেয়া নকল সাহস। এত আওয়াজের ভেতরে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারবে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ব্ল্যাক। বুথ থেকে বেরিয়ে বার-এর একদিকের দরজা খুলে চলে এল পাশের করিডরে। ডানে ছোট কয়েকটা টয়লেট। দরজাগুলো এখন খোলা। কফি আর মদ মিশ্রিত প্রস্রাবের গন্ধে নাক কুঁচকে গেল ওর। করিডরের মাঝে বামদিকে আছে চওড়া এক দরজা। ওদিক দিয়ে ঢুকতে হয় রুবার জিমনেশিয়ামে। দরজার আগে দেয়ালে তিনটে পে-ফোন। স্মার্টফোনের যুগে আজকাল কেউ ওগুলো পারতপক্ষে ব্যবহার করে না। আজ অবশ্য সাধারণ কোন দিন নয়। কে জানে, পর্নো স্টুডিয়োয় মানুষ খুন হওয়ায় ওকে হয়তো খুঁজছে মাফিয়া বা পুলিশের লোক। তার চেয়েও খারাপ কথা, একবার ধরতে পারলে হয়তো এক গুলিতে ওকে খতম করে দেবে মাসুদ রানা। লোকটা আসলে আস্ত এক যমদূত!

কাছের পে-ফোনের সামনে থেমে কোটের পকেট থেকে কয়েন নিল ব্ল্যাক। স্লটে কয়েন ফেলে রিসিভার কানে ঠেকাতেই শুনতে পেল ডায়াল টোনের গুঞ্জন। লাল ফোনের ডিজিট টিপতে শুরু করবে, তখনই ওর ডানকাঁধে এসে পড়ল শক্ত একটা বড় থাবা!

.

মিশিগান অ্যাভিন্যু ও স্টেট স্ট্রিটের লুপের মাঝে চওড়া রাস্তা রাশ স্ট্রিট। গরিব ও ধনীর জন্যে এদিকে-ওদিকে পছন্দমত সব বার ও ক্লাব। এ-ছাড়া আছে নানান দেশের খাবারের একের পর এক রেস্টুরেন্ট। চারপাশে গাড়ির জ্যাম। চোরাই এক পুরনো নীল ফোক্সভাগেন বিটল-এ চেপে রাশ স্ট্রিট ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে রানা। ওর চোখ খুঁজছে সিম্পসনের বার আর রুবার জিমনেশিয়াম।

আগেও শিকাগোতে বহুবার এসেছে রানা। কখনোই জায়গাটা ভাল লাগেনি ওর। আমেরিকা মহাদেশের এই এলাকার মানচিত্র আঁকা হয়েছে ষোলো শ’ তেয়াত্তর সালে। এরপর আঠারো শ’ তিন সালে গড়ে তোলা হলো ফোর্ট ডেয়ারবর্ন। দ্রুত বড় হচ্ছিল শিকাগো শহর। তবে আঠারো শ’ একাত্তর সালে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কাঠের বাড়িগুলো। বলতে গেলে কিছুই রক্ষা পেল না। তাতে দমে গেল না ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গরা। নতুন করে গড়ে নিল ইঁট-পাথরের বিশাল এক অরণ্য। এরপর উনিশ শ’ ঊনষাট সালে সামুদ্রিক বন্দরের জন্যে শিকাগো হয়ে উঠল পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা। চারপাশ ছেয়ে গেল থিয়েটার, সিনেমা হল, সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা, শিল্প অ্যাকাডেমি, নানান ইউনিভার্সিটি ও জাদুঘরে। একই সঙ্গে এ-শহরের আণ্ডার-ওঅর্ল্ডে ঘাঁটি গাড়ল শক্তিশালী সব মাফিয়া দল। এই এলাকা হয়ে গেল তাদের নিরাপদ স্বর্গের মত।

জ্যাম ঠেলে এগোচ্ছে ফোক্সভাগেন বিটল। পথের দু’দিকে চোখ রেখেছে রানা। বারবার মনে পড়ছে স্নিগ্ধা আর তুষারের হাস্যরত মুখ, অ্যালডো রসির বেডরুমে ডিভিডির বিকৃত সিনেমার কথা। আরও তিক্ত হচ্ছে ওর মন। ভাবছে, যেভাবে হোক খতম করে দেবে মাফিয়া ডনকে। অবশ্য লোকটাকে হাতের মুঠোয় পেতে হলে আগে খুঁজে নিতে হবে নীল ছবির পরিচালক পিট ব্ল্যাককে। তার কাছ থেকে হয়তো সিনেটর পিটারের ব্যাপারেও কোন তথ্য পাওয়া যাবে। ডন রসির সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত সেই লোক।

রাশ স্ট্রিট ধরে আরও বিশ গজ যেতেই ফুটপাথের ওদিকে সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড রুবা’স জিমনেশিয়াম অ্যাও ম্যাসেজ পার্লারের নিয়ন বাতির সাইনবোর্ড দেখতে পেল রানা। ব্যস্ত রাস্তার পাশে কোন পার্কিংলট নেই। আরও এক ব্লক এগিয়ে তারপর গাড়ি রাখার জায়গা পেল রানা। টার্গেট এরিয়া থেকে গাড়ি এত দূরে রাখতে হচ্ছে বলে খচখচ করছে ওর মন।

গাড়ি থেকে নেমে দরজা লক করে উঠে এল ফুটপাথে। শত মানুষের ভিড়ে মিশে এগিয়ে চলল সিম্পসন আর রুবার আস্তানার দিকে।

.

কাঁধে চাপড় খেয়ে আরেকটু হলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলত পিট ব্ল্যাক। ঢকাস্ করে গলার কাছে উঠে এসেছে অস্থির হৃৎপিণ্ড। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে। ধরেই নিয়েছে চোখের সামনে দেখবে মস্ত এক পিস্তল হাতে নিষ্ঠুর চেহারার মাসুদ রানাকে। কিন্তু তার বদলে লাল চুলের সুন্দরী যুবতী রুবাকে দেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ব্ল্যাক। ‘ওহ্, রুবা! আমি খুব ভয় পেয়েছি!

‘এত ভয় পেলে কেন?’ জানতে চাইল রুবা। ব্ল্যাকের চেয়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু সে। পেটা দেহ ভারোত্তোলকের। খদ্দেরদের কেউ ঝামেলা করলে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তাকে। স্ট্যামিনার অভাব নেই রুবার। ওর সঙ্গে একে একে বিছানায় গিয়ে চাহিদা মেটাতে না পেরে হতক্লান্ত হয়ে ওঠে আট-দশজন পুরুষ। নিজের তিনটে ব্লু ফিল্মে রুবাকে নিয়েছে ব্ল্যাক। তবে সমস্যা হচ্ছে অভিনয় জানে না মেয়েটা, নইলে অনেক নাম করত পর্নো ইণ্ডাস্ট্রিতে।

‘আসলে হয়েছেটা কী?’ তীক্ষ্ণ চোখে ব্ল্যাককে দেখল রুবা। ‘আগে কখনও তো তোমাকে এত ভয় পেতে দেখিনি।’

‘আগে তো কখনও মাসুদ রানা নামের ভয়ঙ্কর এক পিশাচ আমার পেছনে লাগেনি!’ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ব্ল্যাক।

‘ওই লোকের নাম কখনও শুনিনি! আর সে যে-ই হোক, তুমি হলে গিয়ে আদার ব্যাপারী, সে পিশাচ হলেও তার সঙ্গে আবার তোমার কীসের সম্পর্ক?’

‘সম্পর্ক না থাকলেই তো ভাল ছিল,’ তিক্ত চেহারা করল ব্ল্যাক। ‘ইয়ে… রুবা, তুমি আর সিম্পসন কি আমাকে কয়েক দিনের জন্যে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে? ব্যাপারটা খুব জরুরি। আমি হঠাৎ করে মরে যেতে চাই না।’ আরও কিছু বলবে কি না ভাবতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল ব্ল্যাক। ভাবতে শুরু করেছে, ওর উচিত হচ্ছে রুবাকে বিশ্বাস করা? সে যদি খবর দিয়ে দেয় ডন রসিকে?

‘আমার ঘরেই থেকো, লাভার বয়,’ হাসল রুবা। ‘তবে তা হলে রাতে আর ঘুমাতে পারবে না।’

চুপ করে আছে ব্ল্যাক। একবার ভাবল, বলবে কি না যে আরেকটু হলে অণ্ডকোষ ছেঁচে দিয়েছিল এক হারামি মহিলা, তাই আগামী দু’চার দিন বিশ্রাম নিতে হবে ওকে

‘ঠিক আছে, শেলিকে বলে চলে যেয়ো আমার অফিসে। এদিকে আমি কথা বলব সিম্পসনের সঙ্গে। ওর জানা থাকা দরকার, তুমি আমার ওখানে থাকছ।’ পিট ব্ল্যাকের পিঠে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা চাপড় মেরে তাকে প্রায় টলিয়ে দিয়ে বার- এর দিকে চলল রুবা।

‘অনেক ধন্যবাদ, রুবা,’ পেছন থেকে বলল ব্ল্যাক।

‘বন্ধু তা হলে কীসের জন্যে? একটু পর ফিরে এসে তোমার কথা শুনব।’ দুনিয়ার কাউকে তোয়াক্কা করে না রুবা। লয়েটার্ড পরনে করিডর পার করে ঢুকে পড়ল বার-এ।

এদিকে একটু দূরের দরজায় ঝুলছে পুঁতির মালা। ওগুলো সরিয়ে রুবার এলাকায় পা রাখল ব্ল্যাক। এ-বাড়ির একতলা আর দোতলায় আছে ম্যাসেজ পার্লার। প্রতি তলায় কয়েকটা ছোট ঘরে খদ্দেরদের কাছে দেহ ভাড়া দেয় পতিতারা। দোতলায় মিটমিট করে জ্বলছে স্বল্প ওয়াটের বাতি। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া। ধুপ-ধুপ করে দেয়ালে কম্পন তৈরি করছে সিম্পসনের বার-এর জুকবক্সের বাজনা। নিচতলায় একদল মাতালের হৈ-চৈ থাকলেও দোতলায় উঠে জায়গাটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হলো ব্ল্যাকের।

তৃতীয়তলার আসবাবপত্র ও পর্দায় বিলাসিতার ছাপ। ব্ল্যাকের জানা আছে, এখানে নানান বেআইনি কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয় বড়লোকদের ছেলেমেয়েদেরকে। আর চতুর্থতলায় আছে রুবার অফিস ও বেডরুম। নিজে সে নীল ছবির পরিচালক, সেই সুবাদে আগামী কয়েক দিন রুবার ঘরে আরামসে থাকতে পারবে।

তৃতীয়তলার লবিতে ডেস্কের পেছনে বসে আছে শেলি। খোলা টোগার জন্যে দেখা যাচ্ছে ওর শরীরের প্রায় সবই। মেয়েটার সামনে গিয়ে থামল ব্ল্যাক।

‘রুবা আমাকে বলেছে অফিসে গিয়ে বসতে।’

মাথা দুলিয়ে ব্ল্যাককে নিয়ে এলিভেটরে উঠল পতিতা মেয়েটা। কয়েক সেকেণ্ড পর এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই চতুর্থতলার করিডরে বেরিয়ে এল ওরা।

‘আমি কি আরও কিছু করে দেব, মিস্টার ব্ল্যাক?’ জানতে চাইল শেলি। তার মেয়েলি ঘামের গন্ধ পেয়ে শিরশির করছে ব্ল্যাকের তলপেট। যদিও বুঝে গেল, বিচির ব্যথা নিয়ে ফূর্তি করার উপায় নেই ওর। তার ওপরে মাথা থেকে কোনভাবেই দূর করতে পারছে না অবিবেচক মাসুদ রানার প্রতি ভয়।

‘না, আপাতত কিছু লাগবে না।’

‘ঠিক আছে।’ ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল শেলি।

করিডরের মাঝে রুবার অফিসের চওড়া দরজা। ওটা পেরিয়ে চারদিকে তাকাল ব্ল্যাক। রাস্তার আলো যেন এদিকে না আসে, সেজন্যে কালি লেপে কালো করা হয়েছে জানালার কাঁচ। রুবার ঘরটা শুধু অফিস নয়, ব্যক্তিগত জিমনেশিয়াম। একদিকে ডেস্ক ও চামড়ামোড়া চেয়ার। যৌন মিলন ছাড়া অন্য কোন অ্যাওরোবিক্স পছন্দ নয় রুবার, তাই ঘরে রেখেছে বড় কেবিনেটে সারি সারি ওজন তোলার যন্ত্রপাতি। দেয়ালে ঝুলছে তার সুইমিং স্যুট পরা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে গোপন অঙ্গের দিকে আঙুল তাক করেছে সে।

পুরু কার্পেট মাড়িয়ে ডেস্কের পাশে থামল ব্ল্যাক। চট্ করে বুঝে গেল, গত কিছু দিনের ভেতরে সাউণ্ডপ্রুফ করা হয়েছে এ-ঘর। ডেস্কে টেলিফোন দেখে ওটার রিসিভার তুলে নিতে গিয়েও হাত পিছিয়ে নিল ব্ল্যাক। শিকাগো পুলিশ, মাফিয়া ডন রসি, বা রুবা হয়তো ট্যাপ করবে এই ফোন। স্মার্টফোনের চেয়ে ল্যাণ্ড ফোনে কথা বলা কম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অস্বস্তি লাগছে ব্ল্যাকের। বারবার করে মন বলছে: এমন কোথাও লুকাও, যেখানে তোমাকে পাবে না মাফিয়া ডন রসি আর মাসুদ রানা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *