নরকের শহর – ২০

বিশ

অভিজাত এলাকা এভানস্টনে কোন হৈ-চৈ বা আওয়াজ নেই। রাতে থমথম করছে চারপাশ। ম্যানিকিউর করা বিশাল বাগানের ওদিকে আধুনিক সব অপূর্ব সুন্দর ম্যানশন। গাছে ছাওয়া বুলেভার্ডের সামনের পথ ধরে আসছে-যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি।

সিনেটর পিটারের বাড়ি থেকে এক ব্লক দূরে বাতিহীন এক অন্ধকার বাড়ির কাছে লিউনার গাড়ি রেখেছে রানা। আগেই আতাউলের কাছে ফোন করে জেনে নিয়েছে, সিনেটরের বাড়িতে থাকে মাত্র তিনজন মানুষ। রাজনীতিক নিজে, তার স্ত্রী আর তাদের তরুণী মেয়েটা।

গাড়ি থেকে দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে রাস্তার ওদিকের ঘন ঝোপগুলোর ভেতরে ঢুকল রানা। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝে নিল আশপাশে কেউ নেই।

ইজরায়েলি জ্যামার চালু করে পরের তিন মিনিটে দেয়াল টপকে নেমে এল সামনের বাড়িটার উঠনে। বাড়ির পেছনের কাঠের বেড়া বেশ উঁচু। ওটা পার হলেই সিনেটরের বাড়ির বাগানে নামতে পারবে রানা।

পরের দু’মিনিটে বাড়ির পেছনদিকে চলে এল রানা। দড়ি বেয়ে উঠে পড়ল বেড়ার ওপরে। চুপ করে অপেক্ষা করল মিনিটখানেক। আশপাশে কোথাও কোন আওয়াজ বা নড়াচড়া নেই। তারপর দূরে জোরে আটকে দেয়া হলো একটা দরজা। ঘেউ-ঘেউ করে উঠল কোন বাড়ির কুকুর। পেরিয়ে গেল আরও কিছুক্ষণ। জাস্টিন পিটারের বাড়ি থেকে বেরোল না কেউ।

দড়ি ওদিকে ফেলে তরতর করে সিনেটরের বাগানে নেমে এল রানা। চারপাশে চিরহরিৎ গাছের ফলের বাগান। চোখে নাইট-ভিশন গগল্‌স্ পরে বাড়িটার দিকে চলল রানা। শীতের কনকনে হাওয়ার স্ আওয়াজে আরেকটু হলে চাপা পড়ত ওর পেছনে চলে আসা লোকটার বুটের শব্দ।

একেবারে শেষ সময়ে সতর্ক হয়ে গেছে রানা। ঝট করে একদিকে সরে বসে পড়ল মাটিতে। ভাল করেই বুঝে গেছে, পেছনের লোকটা খুব দক্ষ। যেখানে থাকার কথা ওর বুক, সেখান দিয়ে সাঁই করে ঘুরে গেছে আততায়ীর ছোরা। চরকির মত ঘুরেই লোকটার পেট লক্ষ্য করে ডানহাতি ঘুষি মারল রানা। তলপেটে মুঠো গেঁথে যেতেই ঘোঁৎ করে উঠেছে খুনি। পরক্ষণে আবারও সামনে বেড়ে একপাশ থেকে চালাল ছোরা।

ধারালো ফলা হাত বাড়িয়ে ব্লক করতেই ডানবাহুতে যেন আগুন ধরে গেল রানার। একই সময়ে বামহাতে হ্যাঁচকা টানে বের করল খাপ থেকে গার্বার এমকে টু। উঠে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। প্রায় নাচের ভঙ্গিতে ছোরা হাতে ওর দিকে এল আততায়ী। সুযোগ বুঝে সামনে বেড়ে তার হাঁটুর বাটির ওপরে জোরাল একটা লাথি ঝাড়ল রানা।

ব্যথায় ‘উফ্’ বলে থমকে গেছে আততায়ী। ঝড়ের বেগে সামনে বেড়ে তার ঘাড় ডানহাতে পেঁচিয়ে ধরল রানা। পরক্ষণে ওর ছোরা ঢুকে গেল আততায়ীর পিঠ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে। মাত্র দু’বার রানার হাতের ভেতরে ঝাঁকি খেল লোকটা, তারপর শিথিল হয়ে গেল।

শীতল মাটিতে মৃতদেহ নামিয়ে রাখল রানা। লাশের পোশাকে রক্ত মুছে খাপে রেখে দিল ছোরা। সার্চ করে দেখল লোকটার শোল্ডার হোলস্টারে আছে কোল্ট .৪৫ পিস্তল। পকেটে আইডি কার্ড। ওটা অনুযায়ী তার নাম লু এফ. লে। এ-ছাড়া আছে গান লাইসেন্স। সেখানে লেখা: লু এফ. লে ফাইভ স্টার করপোরেশনের সিকিউরিটি, কোয়ার্ডিনেটর। সরকার থেকে তাকে গোপনে পিস্তল বহন করার অনুমতি দেয়া হলো।

রানার বুঝতে দেরি হলো না, এই লোক মাফিয়া দলের সদস্য। সিনেটর আর তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে একে রেখেছিল অ্যালডো রসি।

বাগানে লাশ ফেলে রেখে সিনেটরের বাড়ির পেছনে চলে এল রানা। ওর দশ সেকেণ্ড লাগল পেছনের দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে। ঘরে আগুনে পোড়া কাঠের বুনো এক প্রাচীন সুবাস। কেমন উদাস করে দেয় মন।

নাইট-ভিশন গগলসের কল্যাণে একটু দূরে কারুকাজ করা স্টেয়ারকেস দেখতে পেল রানা। কোথাও ঠোকর না খেয়ে চলে গেল ওটার কাছে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই চোখের কোণে দেখল বেসমেন্টের দরজার তলা দিয়ে আসছে হলদে আলো। সিঁড়ির ধাপ থেকে নেমে নিঃশব্দে বেসমেন্টের দরজার সামনে চলে এল রানা। হ্যাণ্ডেল ধরে ধীরে ধীরে মোচড় দিল নিচের দিকে। দরজা খুলে যেতেই সামনে দেখতে পেল খাড়া ধাপের কাঠের সরু এক সিঁড়ি।

একবার বড় করে শ্বাস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা। বিলাসবহুল আসবাবপত্র দিয়ে গুছিয়ে নেয়া হয়েছে বেসমেন্ট। একটু দূরে মাঝারি একটা বার। ওখানে যত মদ আছে, তাতে অন্তত পাঁচ শ’জনের তৃষ্ণা মেটানো যাবে।

বারের ওদিকে আধখোলা এক দরজা দিয়ে আসছে মৃদু আওয়াজ। সাবধানে ওদিকে চলল রানা। একটা পুল টেবিল পাশ কাটিয়ে চোখ থেকে খুলল নাইট-ভিশন গগল্স। এরই ভেতরে বুঝে গেছে, এটা বাড়ির স্টাডিরুম। আর এখানেই আছে সিনেটর পিটার। দোতলায় বোধহয় ঘুমিয়ে আছে তার স্ত্রী আর মেয়ে। নিঃশব্দে অর্ধেক খোলা দরজায় গিয়ে ভেতরে উঁকি দিল রানা। ওর দিকে পিঠ দিয়ে পুরু গদির দামি আর্মচেয়ারে বসে আছে সিনেটর পিটার। ডানহাতে সোনালি তরলে ভরা ক্রিস্টালের গ্লাস। বিশাল এক এলইডি টিভির দিকে মনোযোগ দিয়েছে লোকটা।

টিভিতে কী ধরনের সিনেমা চলছে, সেটা মোটা গলায় পুরুষের শীৎকারের আওয়াজে বুঝে গেল রানা। টিভির দিকে চেয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে সিনেটর। বামহাতে এদিক-ওদিক নাড়ছে উত্থিত গোপনাঙ্গ।

টিভির পর্দার দিকে চোখ গেল রানার।

সিনেমার নায়িকার বয়স বড়জোর আট। ক্যামেরার পেছন থেকে কারা যেন ভয় দেখাচ্ছে ওকে। বেচারির চোখে- মুখে ভীষণ আতঙ্ক। ওর ওপরে চড়াও হয়েছে হিংস্র চেহারার বয়স্ক এক লালচে দাড়িওয়ালা লোক। টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাল রানা। মন চাইছে, সিনেটরের মাথায় অটোম্যাগের ম্যাগাজিন খালি করতে। তবে প্রচণ্ড রাগ চেপে রাখল ও।

পিচ্চি মেয়েটার ওপরে এতই মনোযোগ সিনেটরের, এখনও টের পায়নি বেসমেন্টে এসে ঢুকেছে অন্য কেউ। তার কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলের স্টপ বাটন রানা টিপে দিতেই বন্ধ হলো ব্লু ফিল্ম। টিভির স্ক্রিন কালো হয়ে যেতেই চমকে গিয়ে ঘাড় কাত করে পেছনে তাকাল জাস্টিন পিটার। রানাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়ল সে। পাশের টেবিলে রাখতে গিয়ে পুরু কার্পেটে ফেলে দিল মদের গ্লাস। চারপাশে ছড়িয়ে গেল অ্যালকোহলের কড়া গন্ধ। চেয়ারটা ঘুরে সরাসরি সিনেটরের মুখোমুখি হলো রানা। বামহাতে খপ করে ধরল লোকটার চোয়াল। ডানহাতে গলা ধরে ঠেলে তাকে গেঁথে দিল চেয়ারে।

ভীষণ ভয়ে বিস্ফারিত হলো সিনেটরের দু’চোখ। তার মুখ থেকে হাত সরাল রানা। হিমশীতল কণ্ঠে বলল, ‘একবার চিৎকার দিলেই খুন হবে!

রানা যে মিথ্যা বলছে না, সেটা বুঝতে দেরি হলো না সিনেটরের। বিস্ফারিত চোখে চাইল ওর দিকে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। থরথর করে কাঁপছে গোটা শরীর। দু’হাতে চেপে ধরেছে চেয়ারের হাতল। ‘ক্ব-কী চাও তুমি?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল সে।

‘তুমি তো দেখি দারুণ সব সিনেমা দেখো, সিনেটর! কোথায় পেলে এই ডিভিডি?’

বড় দ্রুত বলল লোকটা, ‘ভাড়া করেছি।’

‘তা-ই? সিনেমার ডিভিডি যেসব দোকানে বিক্রি হয়, তেমন কোথাও থেকে কিনেছ?’

‘আমার এক বন্ধু দিয়েছে।’

‘কী নাম তার?’

‘নাম মনে নেই।’

রাগের আগুনে পুড়ছে রানার বুক। ডানহাতে এত জোরে কষে চড় দিল যে জাস্টিন পিটারের ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্ত। মুখ থেকে খসে পড়ল ক্যাপ করা মুক্তোর মত সুন্দর দুটো দাঁত। মারের তোড়ে পিছিয়ে গেছে ভারী আর্মচেয়ার। সিনেটরের সামনে বিশাল পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। রাজনীতিকের উপায় নেই যে চেয়ার ছাড়বে।

‘জানতাম যে তুমি মিথ্যা বলবে,’ রাগ চেপে বলল রানা, ‘তে। আবারও প্রথম থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। এখন প্রথম প্রশ্ন: কোথায় রাখা হয়েছে শিশুদেরকে!’

‘কীসের শিশু? এসব কী বলছ!’ হাত তুলে ফাটা ঠোঁট থেকে রক্ত মুছল জাস্টিন পিটার। ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! শিশু নিয়ে আবার কীসের কথা?’

‘অ্যালডো আর তার বোনের ব্যাপারে সবই আমি জানি, ‘ বলল রানা, ‘এ-ও অজানা নয়, ওয়েস্টন এতকাল তাদেরকে বাচ্চা সাপ্লাই দিয়েছে। আর আজ রাতে ওদের শিপমেন্ট পাঠিয়ে দেয়া হবে দূরে কোথাও। এটাও জানি, বহুকাল আগেই নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছ তুমি। নরকের এক দানবের মত রয়ে গেছ পৃথিবীর বুকে। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলার মত সময় এখন আমার হাতে নেই। জানতে চাইছি: ঠিক কখন কোথা থেকে রওনা হবে শিপমেন্ট। এবার আমার কথা বুঝতে পেরেছ? বাচ্চাদের ব্যাপারে তোমাকে মুখ খুলতে হবে।’

বারকয়েক মাথা নাড়ল জাস্টিন পিটার। ফাটা ঠোঁট থেকে টপটপ করে শার্টের বুকে পড়ছে রক্ত। ‘আমার… আমার তো কিছুই জানা নেই… সত্যি কথা বলছি!’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘ভুল লোকের পা চাটতে গেছ, সিনেটর। জন ওয়েস্টন জানত কোথা থেকে রওনা হবে শিশুদের শিপমেন্ট। তাই মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলেছে। প্রাণে বাঁচতে পারেনি পিট ব্ল্যাকও।’

‘ওয়েস্টন… মারা গেছে?’

‘জানি, তোমার কাছে কাদের পাঠায় অ্যালডো বা এলিসা। শিশুদের সাপ্লাই দিয়ে তোমাকে পকেটে রেখেছে তারা।’

সরাসরি ওর চোখ দেখল লোকটা। এক পলকে বুঝে গেল সবই জানে কঠোর চেহারার যুবক। চেয়ারের গদিতে গেঁথে গেল নরপশুটা। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যিই আমি একটা দানব! তবে তুমি হয়তো বুঝবে না, শিশু পর্নোগ্রাফি দেখতে আমার কত ভাল লাগে!’ দু’চোখে অশ্রু এল তার। ‘বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের সিনেমা। বয়স্ক অভিনেতারা যখন ওদেরকে চেপে ধরে ভীষণ কষ্ট দেয়… আমার মনে হয় আমিও যেন…’ একবার ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢাকল সে। ফিসফিস করল, ‘আসলে, রানা… আমার ভেতরে বাস করে একই সঙ্গে দু’জন মানুষ। আমার স্ত্রী আর মেয়েকে ভালবাসি। জান দিতে পারি ওদের জন্যে। কিন্তু এই ধরনের সিনেমা না দেখলে অস্থির হয়ে যাই। আমি আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। আর তাই ফাঁদে ফেলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে রসিরা। ওরা আসলে কোনকালেই মানুষ ছিল না। ওদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন ঈশ্বর, যাতে আবারও সুস্থ হয়ে উঠতে পারি আমি!’

‘ওরা কোথা থেকে শিশুদের রওনা করিয়ে দেবে আজ?’ নরম সুরে জানতে চাইল রানা।

চোখে অশ্রু নিয়ে ওকে দেখল জাস্টিন পিটার। ‘স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার থেকে।’ নিচু গলায় রাস্তার নাম ও অফিসের ঠিকানা জানাল সে। ‘ওই কোম্পানির মালিক অ্যালডো রসি।

‘কখন রওনা হবে শিপমেন্ট?’

‘মাঝরাতে।’

চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা।

ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন বাজে এগারোটা বিশ।

চল্লিশ মিনিট পর বারোটা বাজবে, অর্থাৎ মাঝরাত।

‘রানা… তুমি এখন আমার ব্যাপারে কী করবে?’ থমকে থমকে ফিসফিস করে জানতে চাইল সিনেটর পিটার।

‘নিয়ে যাব তোমার মোবাইল ফোন আর ট্যাব।’ গলা টিপে খুন করতে হলে গায়ে হাত দিতে হবে এই নোংরা কীটের, ভাবল রানা। তখনই দেখতে পেল, পাশের ছোট্ট টেবিলের ড্রয়ারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে কেঁচোটা।

ভালই তো, সমানে সমান সুযোগ পাবে!

ড্রয়ার থেকে হাত বের করছে জাস্টিন পিটার। মুঠোয় ছোট্ট একটা পিস্তল।

যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে নর্দমার কীট। রানার হাত ঝড়ের বেগে নড়ে উঠতেই হোলস্টার থেকে ঝটকা দিয়ে বেরোল বেরেটা পিস্তল। বেসমেন্টের ভেতরে মৃদু খুক আওয়াজ তুলল ওটা। নাইন এমএম স্টিংগার বুলেট চেয়ারে গেঁথে দিল সিনেটরকে। একবার ঝাঁকি দিয়ে ডানদিকের কাঁধে হেলে গেল তার মাথা।

ঘুরে ডিভিডি আর টিভি সেট দেখল রানা। প্লেয়ার থেকে শিশু পর্নোগ্রাফির ডিভিডি নিয়ে রেখে দিল মৃত সিনেটরের বুকে। ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে এল বাড়ির পেছনের দরজার কাছে। কবাট খুলে দেখে নিল এদিক-ওদিক। কেউ নেই আশপাশে। বাগান পার হয়ে বেড়ার দিকে যাওয়ার সময় সিনেটরের স্ত্রী আর মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগল ওর।

সকালে লাশ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে যোগাযোগ করবে তারা। কিছুক্ষণ পর এ-বাড়িতে এসে মৃতের বুকের ওপরে শিশু পর্নোগ্রাফির ডিভিডি পাবে কর্তৃপক্ষ। তাদের করা রিপোর্ট অনুযায়ী আরও নোংরা সব বিষয় মাটি খুঁড়ে বের করবে সাংবাদিকেরা। সমাজে আর কখনও মুখ দেখাতে পারবে না জাস্টিন পিটারের স্ত্রী আর মেয়ে।

জন ওয়েস্টন, পিট ব্ল্যাক আর জাস্টিন পিটার আর বেঁচে নেই। দুনিয়ায় রয়ে গিয়ে আরও পাপ করবে না তারা। অবশ্য এখনও ফূর্তিতে আছে অ্যালডো রসি আর এলিসা রসি। তারা অন্যদের চেয়ে বড় পাপী। অসহায় নিষ্পাপ শিশুদেরকে চিরকালের জন্যে পাঠাচ্ছে স্রেফ নরকে। কিন্তু আজ রাতে রানা বেঁচেবর্তে থাকলে এ-পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে তাদেরকে।

বাড়তি সময় নেই রানার হাতে। ট্রাকে করে শিশুদেরকে রওনা করিয়ে দেয়ার আগেই যেতে হবে ট্রাকিং কোম্পানিতে।

কিছু বিষয় এখনও অপরিষ্কার ওর কাছে।

মি এসবে কীভাবে জড়াল সার্জেন্ট এবার্টন?

সে কি ঘুষের টাকার জন্যে বিক্রি হয়ে গেছে?

ওদিকে মাফিয়ার গুণ্ডারা কোথায় নিল লিউনাকে?

মস্ত বিপদে আছে মেয়েটা।

ওকে উদ্ধার করতে পারবে তো রানা?

সিনেটরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লিউনার গাড়িতে ফিরল রানা। জ্যামার, দড়ি আর অন্যান্য জিনিস রেখে দিল পেছনের সিটে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ইউ টার্ন নিয়ে ঝড়ের বেগে চলল শহরতলী লক্ষ্য করে। ওর পরের গন্তব্য সিনেটরের বলে যাওয়া সেই স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার।

একুশ

‘আপনার বিসিআই এজেন্ট, যাকে সন্তানের মত ভালবাসেন, সে কিন্তু গরম করে ফেলেছে শিকাগো শহর,’ এনক্রিপটেড ফোনে বললেন এফবিআই চিফ।

‘তুমি কি নিশ্চিত যে এসব করছে রানা?’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান।

‘তা হলে আর কার সাধ্যি যে গোটা শহরের আণ্ডার- ওঅর্ল্ড এভাবে কাঁপিয়ে দেবে?’

বিশ্বযুদ্ধে মেজর রাহাত খানের অধীনে কাজ করেছেন এফবিআই চিফ হ্যারি হ্যারল্ড। ফ্রান্স ও জার্মানিতে ঢুকে নাৎসি বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করেছেন তাঁরা। তখন হ্যারল্ড ছিলেন আমেরিকান মেরিনের একজন ক্যাপ্টেন।

‘তোমার কথা অনুযায়ী এসব করছে রানা,’ বললেন রাহাত খান। ‘কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আছে তোমাদের হাতে?’

মৃদু হাসলেন এফবিআই চিফ হ্যারল্ড। ‘তা নেই। তবে কাজের ধরন দেখে সবই বুঝেছি। বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ের কথা মনে পড়ে গেছে আমার। আর যাই হোক, আপনি বোধহয় নিজের হাতে রানাকে ট্রেনিং দিয়েছেন।’

‘তোমার বক্তব্য আসলে কী, হ্যারল্ড?’ আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন রাহাত খান। ‘আমাকে ফোন করেছ কী উদ্দেশ্যে?’

‘কিছু কারণে। আমিও চাই সাফ হোক শিকাগোর শত বছরের নোংরামি। আর সেজন্যে আমার ছেলেদেরকে বলেছি, আপাতত ওরা যেন ওদিকে পা না রাখে।’

‘শুধু এটা বলতে ফোন করেছ?’

‘না। আরও কিছু কথা আছে।’

‘বলো, কী বলবে।’

‘শিকাগোর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। তাই বলে পচে যায়নি সবাই। আর তাদেরই একজন সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন তলে তলে আণ্ডার-ওঅর্ল্ড আর দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসারদেরকে ধরতে তার সঙ্গে চুক্তি করেছি আমরা। আর আজ রাতে তার সঙ্গে দেখা করেছে রানা। ন্যায়পরায়ণ এক বা একাধিক পুলিশ অফিসারের হাতে সে ধরা পড়লে কোনভাবেই রেহাই পাবে না। কাজেই ওকে সতর্ক করা উচিত।’

‘অথচ তুমি চাও নিজের কাজ শেষ করুক রানা। তারপর যেন ত্যাগ করে শিকাগো?’

‘ঠিকই ধরেছেন। ওর কাজ শেষ হলে মাঠে নামবে আমার ছেলেরা।’

‘অর্থাৎ প্রাণের ঝুঁকি নেবে রানা, আর পরে হাসতে হাসতে গিয়ে সব কৃতিত্ব নেবে তোমার ছেলেরা।’

‘এ-ছাড়া কোন উপায়ও তো নেই, স্যর,’ নরম সুরে বললেন এফবিআই চিফ। ‘আমি ফোন করেছি, যাতে আপনি রানাকে বলেন, আগামীকাল ভোরের আগেই যেন শিকাগো ত্যাগ করে ও।’

‘তোমার মনে ‘হচ্ছে যে রানা আমার কথা শুনবে, হ্যারল্ড?’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাহাত খান।

সেক্ষেত্রে মস্ত বিপদে পড়বে ও। একবার গ্রেফতার হলে আগামী বিশ বছরেও আর জেল থেকে বেরোতে পারবে না।’

‘তোমার কথা তো শুনলাম। বেশ, চেষ্টা করব ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তবে আমার ভুল না হয়ে থাকলে ফোন বন্ধ করে কাজে নেমে পড়েছে ও।

‘আপনি ওকে সতর্ক করবেন মনে সে আশা নিয়েই ফোন দিয়েছি, স্যর,’ বললেন এফবিআই চিফ। ‘এটা দায়িত্ব বলেই মনে হয়েছে আমার। আমেরিকার তো কম উপকার করেনি রানা। তাই চাই না আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে হঠাৎ খুন হোক ও।’

‘এভাবে ভেবেছ সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, হ্যারল্ড।’

‘আপনি ভাল থাকবেন, স্যর। গুরুতর আহত আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে শত্রুদের ফাঁকি দিয়ে চার মাইল হেঁটে পৌঁছে দিয়েছিলেন ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ব্রা হসপিটালে। সেটা কখনও ভুলব না।’

ফোন রেখে ভুরু কুঁচকে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলেন বিসিআই চিফ। ভাল করেই জানেন, একবার কাজে নেমে গেলে কখনও পিছিয়ে যাবে না রানা।

.

শহরতলীতে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার আর একাধিক ওয়্যারহাউস। গা কাঁপানো হিমশীতল রাতে ট্রাকের একটা ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া কোথাও কোন আওয়াজ নেই। সাদা বরফে চাঁদের রুপালি আলো পড়ে তৈরি করেছে ফ্যাকাসে অদ্ভুত আভা। কাঁটাভরা বড় এক বেরি বুশের নিচে পাথরের মত পড়ে আছে রানা। নাইট- ভিশন গগল্‌স্ পরা চোখদুটো চেয়ে আছে সামনের কাঁটাতারের ওদিকে।

চরম শীতেও ওভারকোট খুলে কমব্যাট স্যুট পরে নিয়েছে রানা। মুখে ক্যামোফ্লেজ কসমেটিক। ইনফ্রারেড নাইট-ভিশন গগলসের জন্যে ওকে দেখলে যে-কেউ ভাববে, আকাশ থেকে নেমে এসেছে বিদঘুটে এক এলিয়েন! ওর ডান ঊরুর হোলস্টারে অটোম্যাগ, বামকাঁধের হোলস্টারে বেরেটা। বুকের মিলিটারি ওয়েবিঙে অ্যামিউনিশন, গ্রেনেড আর ডানহাতের স্ট্র্যাপের লুপে ম্যাক-১০ এসএমজি।

আশপাশে বিশাল খোলা জমি নিয়ে যেসব ওয়্যারহাউস আর কারখানা, সেসব থেকে অনেক আলাদা অ্যালডো রসির ট্রাকিং অ্যাণ্ড শিপিং কোম্পানি-কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে ওটার তিরিশ ফুট দূরে পৌঁছে গেছে রানা।

কম্পাউণ্ডের দূরে দূরে বৈদ্যুতিক থামে জ্বলছে শক্তিশালী বাতি। অবশ্য ওসবের মাঝে রয়ে গেছে ঘন কালো ছায়া। আর তেমনই এক অন্ধকার অংশের দিকে এগিয়ে চলল রানা। মিনিট দুয়েক পর পৌঁছে গেল কাঁটাতারের বেড়ার পাশে। ছোট কিন্তু দামি এক ওয়াওয়ায়ার কাটার দিয়ে কুটকুট শব্দে কেটে একমিনিটে তৈরি করল কাঁটাতারের বুকে বড় একটা ফুটো। পরের দশ সেকেণ্ডে ঢুকে পড়ল কম্পাউণ্ডে। উঠে একছুটে গিয়ে থামল একটা ওয়্যারহাউসের পাশের ছায়ায়।

একটু দূরে ট্রাকিং কোম্পানির একতলা অফিস দালান। চেইন লিঙ্ক দিয়ে ঘেরা উঠনের মত জায়গায় ডযনেরও বেশি ট্রেইলার ট্রাক। একেকটা যেন লোহার তৈরি ভয়ঙ্কর সব বিশাল দানব। নিশুতি রাতে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে এক ওয়্যারহাউসের ভেতরে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলছে ভারী কোন ট্রাকের ইঞ্জিন।

চামড়ার জুতো পরনে মচমচ শব্দ করে রানার দিকেই এল কে যেন!

লোকটা অ্যালডো রসির দলের গুণ্ডা।

ওয়্যারহাউসের কোনা ঘুরেই বিপদে পড়ল সে। মাটিতে শরীর গড়িয়ে সরাসরি চলে গেছে রানা তার সামনে। লোকটার দু’হাঁটু ধরে বামহাতে হ্যাঁচকা টান দিল ও।

রানার পাশে ধুপ করে পড়ল গার্ড। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই তার মাথার পেছনে লাগল রানার ডানহাতি প্রচণ্ড এক ঘুষি। জ্ঞান হারাতেই শিথিল হয়েছে লোকটা দেহ। পাশেই পড়ে আছে রাইফেল। লোকটার সঙ্গে আরও কেউ আছে কি না, সেটা বুঝতে আরও কয়েক সেকেণ্ড নিল রানা।

না, আর কেউ নেই।

উঠে চারপাশে দেখে নিল ও। বুঝতে দেরি হয়নি, পৌঁছে গেছে ঠিক জায়গায়। গার্ডদের মোকাবিলা করতে তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু তারা বোধহয় অপ্রস্তুত।

অ্যালডো আর এলিসা জানে না, ওয়েস্টনের মৃত্যু-খবর শুনে ভয় পেয়ে শিশু অপহরণের ব্যাপারে সবই ফাঁস করে দিয়েছে সিনেটর। তারপর খুন হয়ে গেছে ওর হাতে।

ওয়্যারহাউসের কোনায় থেমে পরের দালানের দিকে তাকাল রানা। দূরে চেইন লিঙ্কের ওদিকে একের পর এক ট্রাক। বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে ওখানে দু’সারি তারকাঁটার বেড়া। উঁচু দরজাওয়ালা এক দালানের সামনে এক ডযনেরও বেশি ট্রাক্টর ট্রেইলার। দালানের দরজাটা এখন বন্ধ। রানা আন্দাজ করল, ওটার ভেতরে আছে ট্রাকের পার্টস আর যন্ত্রপাতি। এক ওয়্যারহাউসের ওপরে গিয়ে থামল ওর চোখ। দালানের ভেতর থেকে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের আওয়াজ। এইমাত্র লোডিং ডকের দিকে পিছিয়ে গেছে যন্ত্রদানবটা।

চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। মাত্র দশ মিনিট পর ঘড়ির মিনিটের দীর্ঘ কাঁটা স্পর্শ করবে রাত বারোটা।

ওয়্যারহাউসের খোলা দরজা দিয়ে মানুষের নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। কালো কমব্যাট স্যুটের পকেট থেকে ছোট্ট বিনকিউলার নিয়ে ওটার ভাঁজ খুলে চোখে লাগাল। একলাফে নাকের কাছে চলে এল দৃশ্যটা।

ওয়্যারহাউসের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা কয়েকটা ছেলেমেয়ে। যারা বাবা-মার কাছ থেকে ওদেরকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণায় বুকে আগুন ধরল রানার।

দরজা আধখোলা। ওয়্যারহাউসের পুরো দৃশ্য দেখতে . পাচ্ছে না রানা। যদিও যা দেখেছে, তাতে বুঝতে দেরি হয়নি, নানান জাতের শিশু ধরে এনেছে এরা। বাচ্চাদের সবার চোখে ভীষণ ভয়। কাঁদছে কেউ কেউ। শটগান হাতে দুই লোক একে একে ওদেরকে তুলে দিচ্ছে মস্ত এক ট্রাকের ট্রেইলারের ভেতরে।

বছর পাঁচেকের এক ছেলে হাঁটতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে। ওর ঘাড় চেপে ধরে জোরে সামনে ঠেলল এক গার্ড। ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল ছেলেটা। ঝুঁকে দু’হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে তুলল গার্ড। রাগে বিকৃত হয়েছে তার মুখ। এত দূর থেকে বক্তব্য না শুনলেও বুঝে গেল রানা, জঘন্য সব গালি বাচ্চাটাকে দিচ্ছে লোকটা।

এক সেকেণ্ডের জন্যে রানার মনে হলো অটোম্যাগ বের করে গুলি করতে করতে ঢুকবে ওয়্যারহাউসের ভেতরে। পরক্ষণে সামলে নিল নিজেকে। যুদ্ধের কৌশলে ভুল করার কোন উপায় আসলে নেই ওর।

এখন ঝড়ের বেগে ওয়্যারহাউসে ঢুকলে শুরু হবে ক্রস ফায়ার। ফলে গোলাগুলিতে মরবে শিশুদের অনেকে। সুতরাং এখন চাই সবার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার মত ভাল কোন পথ। ওয়্যারহাউস থেকে সরে পরের দু’মিনিটে ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে ট্রাক রাখার উঠনের পেছনে চলে এল রানা। কম্পাউণ্ডের সামনে শক্তিশালী বাতি থাকলেও এদিকে আছে স্রেফ ঘন ছায়া। ট্রাকের উঠনের পেছনে তারকাঁটার বেড়ার মাঝে ছোট একটা দরজা দেখতে পেল রানা। অবশ্য ওদিক দিয়ে ঢোকার কথা ভাবছে না ও। থামের নিচে জোরাল আলোয় দাঁড়িয়ে আছে দু’জন গার্ড। নিরস্ত্র করতে হবে তাদেরকে। বেরেটা দিয়ে গুলি করলে কেউ না কেউ দেখবে যে খুন হয়ে গেছে তারা।

বেড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে প্রায়ান্ধকার এক জায়গায় গিয়ে থামল রানা। চেইন লিঙ্কে টান দিয়ে তৈরি করল মৃদু ঠুং-ঠাং আওয়াজ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে দু’গার্ডের একজন। ঘাড় ঘুরিয়ে রানার দিকে তাকাল সে। পাশের জনকে বলল, ‘শুনলে?’

মাথা নাড়ল দ্বিতীয় গার্ড। ‘কিছুই শুনিনি।’-

‘আমি শুনেছি। ওদিকটা দেখে আসি।’ সাবমেশিন গান শক্ত হাতে ধরে ধীরপায়ে বেড়ার ছায়াময় জায়গার দিকে এল সে। পেছন থেকে বিড়বিড় করে কী যেন বলল তার সঙ্গী।

ছায়ার ভেতরে মূর্তি হয়ে গেছে রানা। লোকটা পাঁচ ফুটের ভেতরে আসতেই তার গলায় বেরেটা দিয়ে গুলি করল ও।

উযি সাবমেশিন গান ফেলে দু’হাতে ঘাড় ও গলা চেপে ধরেছে গার্ড। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে টকটকে লাল রক্ত। দেহের ওজন ধরে রাখতে না পেরে ধুপ করে মাটিতে পড়ল সে। বারকয়েক ছটফট করে থেমে গেল।

সাইলেন্সার্ড বেরেটার ‘খক’ শব্দ না পেলেও সাবমেশিন গান পেভমেন্টে পড়ার ঠং-ঠনাৎ আওয়াজ শুনতে পেয়েছে দ্বিতীয় গার্ড। ফলে হয়ে গেছে সতর্ক। যেদিকের ছায়ায় গেছে সঙ্গী, সাবমেশিন গানের মাল ওদিকে তাক করল সে।

‘এরিক?’ নিচু গলায় ডাকল। ‘ওদিকে কী? এরিক!’

জবাব দিচ্ছে না এরিক। আরও কয়েক সেকেণ্ড পর রানার দিকে এল লোকটা, খুব নার্ভাস।

চুপচাপ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রানা।

ছায়ায় ঢুকে হঠাৎ করে সঙ্গীর দেহ দেখতে পেয়ে থমকে গেল দ্বিতীয় গার্ড। উযি হাতে শত্রুকে গুলি করতে এদিকে- ওদিকে ঘোরাল মাযল। ঘন ছায়ায় নড়ছে না কিছু। এরিকের লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল লোকটা। আর তখনই বিন্দুমাত্র ব্যথা ছাড়াই খতম হয়ে গেল সে। রানার বেরেটার নাইন এমএম গুলির আঘাতে উড়ে গেছে তার মাথার তালু। উধাও হয়েছে মগজের বড় অংশ। চেইন লিঙ্কের বেড়ার পাশে পড়ল তার লাশ।

ছায়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল রানা। ওর মনে হলো না যে কারও কানে গেছে কোন শব্দ। চিৎকার করেনি কেউ। কেউ ছুটে আসেনি এদিকটা দেখার জন্যে।

মাঝের ওয়্যারহাউসের লোডিং ডকে ব্যস্ত অ্যালডো রসির গুণ্ডারা। এরিক নামের গার্ডের লাশ চিত করল রানা। লোকটার পরনে ওভারকোট। মাথায় ফারের ফ্ল্যাপ দেয়া ক্যাপ। আধমিনিটে ওভারকোট ও ক্যাপ খুলে নিয়ে নিজে পরল রানা। ছায়া থেকে বেরিয়ে হেঁটে চলল ট্রাক রাখার উঠনের দিকে। যে-কেউ দেখলে বুঝবে, কাউকে তোয়াক্কা করে না এ-লোক।

ট্রাক রাখার উঠনের কাছে যেতেই অফিস দালান থেকে রানার দিকে এল এক গার্ড। খুশি-খুশি স্বরে বলল, ‘কী, এরিক? কোন সমস্যা? লিয়ো কোথায়?’

না থেমে পেছনের বেড়ার দিকে বুড়ো আঙুল তাক করল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘ওদিকে। অসুস্থ।’

ওর পাশে এসে হাঁটতে লাগল তৃতীয় গার্ড। ‘কী হয়েছে ওর?’

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আর মাত্র ক’ফুট দূরে ছায়ার ভেতরে বিশাল সব ট্রাক। খপ্ করে রানার বাহু ধরল লোকটা। ‘আমাদের দেখা উচিত না যে কী হয়েছে ওর?

‘তুমি গিয়ে দেখো।’ আলোকিত জায়গা থেকে ছায়ায় ঢুকল রানা। এখনও পাশে হাঁটছে গার্ড। তাকে ছায়ার ভেতরে পাওয়ার জন্যেই অপেক্ষা করেছে রানা। কণ্ঠার ওপরে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেল গার্ড। চুরমার হয়ে গেছে অ্যাডাম্‌স্‌ অ্যাপল। শ্বাস আটকে গেলেও সাবমেশিন গান ওপরে তুলতে চাইল লোকটা। পরক্ষণে তার নাকে-মুখে ম্যাক-১০ এসএমজির নল দিয়ে জোর খোঁচা দিল রানা। বিশ্রী রক্তাক্ত ক্ষত তৈরি হয়েছে গার্ডের মুখে। পরের সেকেণ্ডে অস্ত্রের বাঁট দিয়ে তার চোয়ালে গায়ের জোরে মারল রানা। খুব দ্রুত পেছনে গেল গার্ডের মাথা। কড়াৎ আওয়াজে ভেঙে গেছে ঘাড়। ঝুপ করে মাটিতে পড়ল লোকটার লাশ।

ম্যাক-১০ হাতে চারপাশে দেখে নিল রানা।

কেউ নেই এদিকে।

ওভারকোট আর ক্যাপ খুলে মাটিতে ফেলল ও। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল এসএমজি। কুঁজো হয়ে ঢুকে পড়ল আঠারো চাকার বিশাল এক ট্রাকের নিচে। বেল্টে ঝুলন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে নিল সাদা কেকের মত কী যেন। যে-কোন দেশের মিলিটারির দক্ষ যোদ্ধা বলবে ওটা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। ট্রাকের পেট্রল ট্যাঙ্কের নিচে একটুকরো বোমা সেট করে ওটার গায়ে ছোট্ট টাইমার গেঁথে দিল রানা। সময় স্থির করেছে মাত্র চার মিনিটের জন্যে।

এরই ভেতরে বোধহয় ওয়্যারহাউসে ট্রাকের ট্রেইলারে তোলা হয়েছে শিশুদেরকে। আর ওদের কথা ভেবে বোমার টাইমারে বাড়তি সময় সেট করতে পারেনি রানা। একের পর এক ট্রাকের তলায় ঢুকছে ও। চতুর্থ ট্রাকের ট্যাঙ্কের নিচে বসিয়ে দিল শেষ বোমা। টাইমারের সময় আগের মতই। সব মিলিয়ে চারটে ট্রাকের নিচে বোমা বসাতে গিয়ে রানার লেগেছে মাত্র আড়াই মিনিট।

এবার উদ্ধার করতে হবে শিশুদেরকে।

এই কম্পাউণ্ডে ঢুকে মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি আর তার বোন এলিসা রসিকে দেখতে পায়নি রানা। এ-ও জানে না, এখানে আছে কি না লিউনা। অবশ্য ওর মন বারবার বলছে, কাছেই আছে মেয়েটা।

— দূরের এক ট্রাকের পাশে গিয়ে বসল রানা। বোমা ফাটলে তীরবেগে ছুটবে ওয়্যারহাউস্ লক্ষ্য করে। যদিও কয়েক সেকেণ্ড পর যা দেখল, তাতে বাধ্য হয়ে পাল্টে নিল প্ল্যান।

বিশাল লোডিং ডকের পাশে খুলে গেছে সরু এক দরজা। বেরিয়ে এল একে একে চারজন। কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিচু একতলা অফিসের দিকে চলল তারা। আগে আগে হাঁটছে অ্যালডো রসি। মাফিয়া ডনের পেছনেই এলিসা রসি তাকে আগেরবার ডনের বাড়িতে উলঙ্গ দেখেছে রানা। এখন তার পরনে শীতের অভিজাত পোশাক। মহিলার পেছনে হাঁটছে লিউনা, পাশেই রাস্তার এক মস্তান। লিউনার কবজি শক্ত করে ধরে প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সে।

রানার মনে পড়ল, একটু আগে ওয়্যারহাউসের ভেতরে বাচ্চা এক ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এক গুণ্ডা।

মগজের ঘড়ির প্রতিটি সেকেণ্ড এখন গুনছে রানা। অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল অ্যালডো, এলিসা, লিউনা আর মাফিয়ার মস্তান। আটকে গেল দরজা। ঝড়ের বেগে অফিসের দিকে ছুটল রানা। এখন কেউ দেখে ফেলবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবছে না।

অফিসের ভেতরে শেড নামানো জানালার ওদিকে জ্বলে উঠেছে বৈদ্যুতিক বাতি। যত্নের সঙ্গে শেড টেনে নেয়া হয়নি বলে নিচে রয়েছে সামান্য ফাঁক। অফিসের জানালার সামনে থেমে ভেতরে উঁকি দিল রানা।

স্টিলের ডেস্কের ওপরে বসেছে এলিসা। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অ্যালডো রসি। দু’জনই চেয়ে আছে মস্তানের দিকে। ডেস্কের একটু দূরে জোর করে পিঠসোজা এক চেয়ারে লিউনাকে বসিয়ে দিয়েছে লোকটা।

জানালা থেকে সরে দরজার সামনে পৌঁছে গেল রানা। কবাটে কয়েকবার টোকা দিয়ে কাঁধের স্লিং খুলে হাতে নিল ইনগ্রাম ম্যাক-১০। ক্রস ড্র করেছে বলে ওর বামহাতে উঠে এসেছে অটোম্যাগ। পরক্ষণে কাঁধ দিয়ে জোর এক গুঁতো মেরে দরজার কবজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকল রানা।

হুড়মুড় করে দরজা খসে পড়তেই চমকে গিয়ে ওর দিকে তাকাল রসিদের দলের গুণ্ডা। ভুলে গেছে লিউনার কথা। দু’হাতে শটগান ওপরে তুলতে চাইল সে। কিন্তু বন্দুকের বাঁট কাঁধে তোলার আগেই এসএমজির ট্রিগার স্পর্শ করল রানা। ‘একরাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হলো লোকটার বুক। পিঠের ফুটো দিয়ে কয়েক ধারায় ছিটকে বেরোল রক্ত। পিছিয়ে অফিসের আরেকদিকের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল সে। অবশ হাত থেকে খসে গেছে শটগান। মৃত্যুর দু’সেকেণ্ড আগে থরথর করে কাঁপল লোকটার দেহ।

চমকে গিয়ে ডেস্ক থেকে নেমে পড়েছে এলিসা রসি। এতই বিস্মিত যে বিকৃত দেখাল তার সুন্দর মুখ।

রানাকে দেখে হতবাক হয়ে গেছে লিউনা। ওর মুখ ঢেকে দিয়েছে একরাশ কালো চুল। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে রানাকে দেখল লিউনা, সাগর-নীল চোখে স্বস্তির ছাপ।

এদিকে আগের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে অ্যালডো রসি। অস্ত্র বের করার জন্যে কোটে ভরেছে ডানহাত। রানার হাতে .দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দেখে বিস্ফারিত হয়েছে তার দু’চোখ।

‘একদম নড়বে না!’ ধমকের সুরে বলল রানা। অটোম্যা তাক করেছে অ্যালডো রসির মাথায়। এদিকে এলিসা রসির বুকের দিকে চেয়ে আছে ইনগ্রামের মাযল।

‘রানা!’ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল লিউনা। ‘বোঝাতে পারব না তোমাকে দেখে কতটা ভাল লাগছে!’

দু’ভাই-বোনের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল রানা, ‘তুমি ঠিক আছ তো, লিউনা?’

‘ভাল আছি।’ চেয়ার ছেড়ে ওর পাশে চলে এল মেয়েটা। কণ্ঠে প্রকাশ পেল জরুরি ভাব: ‘বাচ্চারা এখানেই আছে, রানা! ওদেরকে বাঁচাতে হবে! একটু পর কোথায় যেন নেবে একটা ট্রাকে করে!’ রসি পরিবারের দুই দুশ্চরিত্র ভাই-বোনের দিকে তাকাল লিউনা। ‘এরা মানুষের বাচ্চা না! কুত্তার বাচ্চারাও এদের চেয়ে অনেক পবিত্র!’

লিউনাকে উপেক্ষা করে রানার দিকে তাকাল এলিসা রসি। সহজ সুরে বলল, ‘এত নাটকের কিছু নেই। মিস্টার রানা, এখানে এসে তোমার কোন লাভ হলো না। আমাদের সঙ্গে আছে কমপক্ষে ত্রিশজন সৈনিক। ‘

বড়বোনের কথায় শান্ত হয়ে গেছে অ্যালডো রসি। ঘর্মাক্ত চেহারায় টিটকারির হাসি ফুটল তার। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি খুন হয়ে গেছ, রানা! যদিও সেটা জানো না!’

মাফিয়া ডন অ্যাড্রিয়ানোর ছেলেমেয়েদের সাহস সত্যিই দেখার মত, ভাবল রানা। বিশেষ করে এলিসা রসির। ‘আমার নিজের আসলে তেমনটা বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা।

‘মানে?’ কিছুটা সংশয়ের সুরে বলল এলিসা।

জবাব না দিলেও চলে সেটা বুঝেও বলল রানা, ‘আমি এসেছি স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর বদলা নিতে। সুতরাং খুন যদি হয়েই যাই, তার আগে খতম করে দেব তোমাদেরকে।’

অ্যালডো ও এলিসার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে রানা, এমনসময় হঠাৎ করেই একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারপাশ। বাইরে ছিটকে উঠেছে আগুনের বিশাল সব হলকা। রক্তিম হয়ে গেছে রাতের আকাশ।

বাইশ

রানা বাদে অন্যদের ধারণা: বিস্ফোরিত হয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী কোন নাপাম বোমা। অফিসের ভেতরে চমকে গেছে অ্যালডো, এলিসা আর লিউনা। অবশ্য চট করে নিজেকে সামলে নিল অ্যালডো রসি। রানাকে গুলি করবে বলে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করতে চাইল পিস্তল। আর তখনই আর্তনাদ করে উঠল এলিসা রসি, ‘অ্যালডি! খবরদার! নাহ!’

মাফিয়া ডনের হাতে পিস্তল উঠে আসতেই তার মুখ লক্ষ্য করে অটোম্যাগের গুলি পাঠাল রানা। হাত-কামানের বুলেটের আঘাতে মেঝে ছাড়ল অ্যালডোর দু’পা। ঘরের কোণে গিয়ে ছিটকে পড়ল মুণ্ডহীন দেহটা।

বাইরে আরও বিস্ফোরণের আওয়াজ। একে একে ফাটছে অক্ষত ট্রাকের পেট্রল ট্যাঙ্ক। লাফ দিয়ে আকাশ চেটে দিচ্ছে নীল আগুনের হলকা। ছোটভাইয়ের মুণ্ডহীন দেহের দিকে চেয়ে আছে এলিসা রসি। কয়েক সেকেণ্ড পর ঘুরে তাকাল রানার দিকে।

চোখ বুজে রানার কাঁধে মুখ গুঁজল লিউনা। ডানহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছে রানা। অন্যহাতে ইনগ্রাম এসএমজি। অস্ত্রটা তাক করা আছে মাফিয়া দলের সত্যিকারের বস এলিসার দিকে। সে-ই আসলে সব অপরাধের মূল হোতা।

‘তুমি… তুমি খুন করেছ আমার ভাইকে!’ ফিসফিস করল এলিসা। ‘আমার ছোট্ট ভাইটাকে খুন করলে!’

‘আজ পর্যন্ত কত শিশুকে ধরে এনে পাচার করেছ, মিস রসি?’ বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল রানা।

ওর কথায় মনে মনে হোঁচট খেল মহিলা। বিড়বিড় করে বলল, ‘অ্যালডি একসময়ে খুব নিষ্পাপ ছিল। হাসিখুশি একটা ছেলে। আমার কথার এদিক-ওদিক কখনও করত না।’

‘সেটাই ছিল তার মস্তবড় ভুল,’ কঠোর সুরে বলল রানা।

কথাটা শুনে বিকৃত হলো এলিসার চোখ-মুখ। ভাল করে দেহে জড়িয়ে নিল ফারের কোট। রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বাড়ি ফিরছি। জানি, বাধা দেবে না। তোমাকে চিনি, মাসুদ রানা, নিরস্ত্র কোন মহিলাকে গুলি করবে না তুমি।’

মুখ তুলে রানার চোখ দেখল লিউনা। বুঝে গেল দ্বিধায় পড়েছে সিংহ হৃদয়ের মানুষটা।

এদিকে রানার মনে এল ওয়্যারহাউসে বাচ্চা ছেলেটাকে হ্যাঁচকা টানে তোলার দৃশ্য। একবার পিচ্চিটাকে পাচার করে দিলে প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যে পড়বে বেচারা। ওর মত নিষ্পাপ শিশুদেরকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করত অ্যালডো আর এলিসা। ভিডিয়োগুলো পাঠাত সিনেটর পিটারের মত একদল পশুর কাছে। না, এরা আসলে সত্যিই মানুষের পর্যায়ে পড়ে না! শত শত বাবা-মার বুক খালি করে দিয়েছে স্রেফ টাকার জন্যে। কখনও ভাবেনি কী হবে বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ। আর এসবের পেছনে যে পিশাচী, সে এখন বলছে তাকে গুলি করতে পারবে না রানা!

‘শিশু কিডন্যাপ করে মহিলাদের সম্পর্কে আমার ভাবনা পাল্টে দিয়েছ তুমি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রানা। ও ইনগ্রামের ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই অস্ত্রটা কেড়ে নিল লিউনা।

এসএমজির নল ঘুরিয়েই পুরো ম্যাগাজিন খরচ করল এলিসা রসির বুক-পেটে। কয়েক হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে কাঁচের জানালার ওপরে পড়ল মহিলা ডন। কাঁচ ভেঙে জানালার এদিকে রইল তার কোমর, বাকি অংশ বাইরে। বুক-পেট ও পিঠ থেকে ঝরঝর করে ঝরছে রক্ত।

রানার কাঁধে মুখ না লুকিয়ে মহিলার লাশের দিকে চেয়ে রইল লিউনা। ওর কাছ থেকে অস্ত্রটা নিল রানা। বাটন টিপে ম্যাগাযিন মেঝেতে ফেলে ভরে নিল নতুন ক্লিপ

‘আমি কোন অন্যায় করিনি, তা-ই না?’ কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল লিউনা।

মাথা দোলাল রানা। ‘ঠিকই বলেছ। এসো, এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে।’ হোলস্টার থেকে নিয়ে লিউনার হাতে দিল বেরেটা। তুমি লড়তে চাও, তা-ই না? এবার সে- সুযোগ পাবে।

‘তুমি দেখো, মাফিয়ার গুণ্ডাদের মাথা উড়িয়ে দেব!’

কীভাবে পিস্তল চালাতে হবে সেটা লিউনাকে শিখিয়ে দিল রানা। ওরা অফিস থেকে বেরোবে, তার আগেই ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল এক যুবক। ‘ডন রসি…’ ঘরের ভেতরে লাশ দেখে কড়া ব্রেক কষে থামল সে। পিস্তল বের করবে, কিন্তু তার আগেই ইনগ্রামের তিনটে নাইন এমএম বুলেট দু’টুকরো করে দিল ইতালিয়ান যুবকের মাথা।

লিউনার হাত ধরে লাশ টপকে অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। ট্রাকগুলোর ট্যাঙ্ক ফেটে গ্যালনের পর গ্যালন পেট্রল গড়িয়ে গেছে চারদিকে। দাউ-দাউ করে জ্বলছে উঠনে রাখা ট্রাক ও ট্রেইলার। রাতের কালো আকাশে উঠছে আগুনের লাল-নীল-বেগুনি স্তম্ভ। চারপাশে প্রচণ্ড তাপ।

তরল আগুন ঢুকে গেছে মেইনটেন্যান্স গ্যারাজে। এরই ভেতরে পুড়ছে সামনের দেয়াল। পাশের ওয়্যারহাউস অবশ্য এখনও অক্ষত। ওখানে আছে অপহৃত শিশুরা। লোডিং ডকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাক্টর ট্রেইলার।

কে বা কারা হামলা করেছে সেটা না জানলেও, উঠনে ছোটাছুটি করছে এলিসার মাফিয়াসোরা। ট্রাকের ট্যাঙ্কের পেট্রল ছিটকে পড়ে আগুন ধরে গেছে কয়েকজনের শরীরে। তাদেরকে জীবন্ত মশাল বলে মনে হলো রানার। দ্বিতীয়বার ওদিকে না চেয়ে ওয়্যারহাউসের দিকে ছুটল লিউনা আর ও।

মস্তবড় দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, এমনসময় ওদেরকে দেখে চিৎকার করে উঠল এক গার্ড। ‘ওই যে! এরাই আগুন দিয়েছে!’

রানার দিকে সাবমেশিন গানের নল ঘোরাল সে, কিন্তু গুলি করার আগেই তার বুকে বিঁধল ইনগ্রামের তিনটে গুলি। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। মৃত্যু-যন্ত্রণায় ট্রিগারে চেপে বসেছে তর্জনী। অস্ত্র থেকে আকাশে গেল কিছু গুলি।

ওয়্যারহাউসের ভেতরে লোডিং ডকে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। হঠাৎ করে রানা আর লিউনাকে দেখে ওদেরকে লক্ষা করে বন্দুকের দুই নল খালি করল সে। তাড়াহুড়ো করে বলে ওদের কয়েক ফুট দূর দিয়ে গেল এলজি বুলেট।

থমকে থেমে বেরেটা থেকে গুলি করল লিউনা। ওর অস্ত্রটা আছে থ্রি-শট মোড-এ। আগুনের শোঁ-শোঁ গর্জন আর মাফিয়ার গুণ্ডাদের চেঁচামেচিতে হারিয়ে গেছে পিস্তলের হুঙ্কার। ট্রাকের দরজার কাছে পেটে তিনটে গুলি নিয়ে দু’ভাঁজ হয়ে লোডিং ডক থেকে নিচে পড়ল বন্দুকওয়ালা। একতিল নড়ছে না আর। উঠনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজেদের ভেতরে চিৎকার করে কথা বলছে গুণ্ডারা।

একদৌড়ে লোডিং ডকের কাছে পৌঁছে গেল রানা আর লিউনা। সিঁড়ি বেয়ে না উঠে লাফিয়ে লোডিং ডকে উঠল রানা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মেঝেতে পিছলে গেল ও। আর সেজন্যেই বেঁচে গেল প্রাণে। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, সেখান দিয়ে গেল অটোমেটিক পিস্তলের কয়েকটা গুলি।

উঠে বসেই ঘুরে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। ইনগ্রামের নল দিয়ে বেরোল একনাগাড়ে কমলা আগুন। অস্ত্রের চেম্বার থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে খরচ হয়ে যাওয়া গুলির তামার শেল। পর পর কয়েকটা গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হলো ওয়্যারহাউসের মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকা গুণ্ডার বুক।

ঝট করে ডানে সরে গেল রানা। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, ওখানে লাগল বেশ কয়েকটা বুলেট।

লোডিং ডকের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে লিউনা। একপাশে সরে গিয়ে পর পর কয়েকটা গুলি পাঠাল দুই গুণ্ডার দিকে। রানাকে লক্ষ্য করে গুলি করছে তারা। লিউনার দিকে সাবমেশিন গান ঘোরাবার আগেই নাইন এমএম বুলেটের আঘাতে মেঝেতে ছিটকে পড়ল তারা দু’জন। একজন এখনও জীবিত। ফুটো হওয়া পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ ছাড়ছে।

ইনগ্রাম থেকে একপশলা গুলি করে যন্ত্রণা থেকে তাকে রেহাই দিল রানা। ওর অস্ত্রের নলের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। বাটন টিপে খালি ক্লিপ ফেলে নতুন ম্যাগাযিন ভরে নিল। রানার কাছে এসে দাঁড়াল লিউনা। পরস্পরের দিকে পিঠ রেখে শত্রুদেরকে খুঁজছে ওরা।

জ্বলন্ত ট্রাকগুলোর কাছ থেকে লোডিং ডক লক্ষ্য করে ছুটে এল দুই গুণ্ডা। রানার ইনগ্রামের দু’দফা গুলি বুকে বিধতেই মাটিতে পড়ে গেল তারা।

শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল রানা আর লিউনা। ট্রাকের দিকে চোখ যেতেই দেখল, এরই ভেতরে ট্রেইলারে তুলে দেয়া হয়েছে শিশুদেরকে। বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে দরজার কাছ থেকে সরে আরও ভেতরে গেছে ওরা। চুপ করে আছে কেউ কেউ। আবার কারও চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু। ক’জন গলা ছেড়ে কাঁদছে। আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে ওরা সবাই।

ছুটে গিয়ে ট্রাকের ট্রেইলারে ঢুকল লিউনা। স্টিলের বদ্ধ বাক্সের মত জায়গায় ফাঁপা শোনাল ওর পায়ের আওয়াজ। ওকে দেখে ভয় পেয়ে সরে যেতে চাইল কয়েকটা শিশু। কিন্তু ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিতেই লিউনার বুকে এসে মাথা গুঁজল ওরা। চিনে গেছে ওদের প্রিয় আণ্টিকে।

‘কিচ্ছু হয়নি, সোনামণিরা,’ বুজে আসা কণ্ঠে বলল লিউনা। চোখ বেয়ে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। ‘তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। এই যে আমি চলে এসেছি!’

ট্রাকের পেছনে ইনগ্রাম এসএমজি হাতে তৈরি হয়ে আছে রানা। শত্রুপক্ষের কেউ এদিকে এলে গুলি করবে। দেখতে পেল, ড্যাব-ড্যাব করে ওকে দেখছে পিচ্চিরা। ওদের একজনের বয়স বড়জোর পাঁচ। ছেলেটা অবাক চোখে দেখছে কালিঝুলি মাখা লোকটাকে। পিচ্চির দিকে চেয়ে ডানচোখ টিপল রানা। তাতে মস্ত এক ফোকলা হাসি দিল উপমহাদেশীয় ছেলেটা। ‘আমি কিন্তু তোমাকে ভয় পাই না, আঙ্কেল!’

মাথার পাশ দিয়ে বুলেট যেতেই চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। পরক্ষণে গর্জে উঠল ওর ইনগ্রাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল দুই গুণ্ডা, বুকে গুলি খেয়ে মাঝ সিঁড়ি থেকে নিচের মেঝেতে গিয়ে পড়ল তাদের লাশ।

অস্ত্র হাতে রানার পাশে এসে দাঁড়াল লিউনা। তবে মাথা নেড়ে ট্রেইলারের দিকে ইশারা করল রানা। ‘ওখানে থাকো! ওদের কাছে! ওরা সবাই ঠিক আছে তো?’

ঘুরে ট্রেইলার দেখল লিউনা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন মাথা দোলাল কয়েকটা পিচ্চি।

‘ওরা ঠিক আছে,’ বলল লিউনা।

ডানকাঁধে ইনগ্রাম ঝুলিয়ে হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিল রানা। গলা চড়িয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই সামনের দিকে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ো!’

দু’চোখ বিস্ফারিত হলো লিউনার। বুঝে গেছে, এবার কী করতে চাইছে রানা। ওয়্যারহাউসে আগুন ধরলে বিস্ফোরিত হবে পেট্রল ট্যাঙ্ক। সেক্ষেত্রে বাঁচবে না কেউ। তার চেয়ে ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে গেলে ট্রেইলারের লোহার দেয়াল গোলাগুলি আর আগুন থেকে আড়াল দেবে শিশুদেরকে।

লোডিং ডক থেকে লাফিয়ে নিচের মেঝেতে নামল রানা। ছুটে চলে গেল ট্রাকের সামনে। ট্রাক রাখার উঠনে দাউ-দাউ করে জ্বলছে লেলিহান আগুন। মাফিয়ার গুণ্ডাদের কয়েকজন পুড়ে মারা গেছে ওখানে। অন্যরা জেনে গেছে এখন আর বেঁচে নেই তাদের ডন। কম্পাউণ্ড ছেড়ে পালিয়ে যাবার জন্যে চেইন লিঙ্কের বেড়ার দিকে সরে গেছে তারা। অবশ্য ট্রাক নিয়ে রানা বেরিয়ে যেতে চাইলে ভুল করবে না গুলি করতে।

ট্রাকের ক্যাবে উঠে দরজা বন্ধ না করে স্টিয়ারিং হুইলের সামনের মেঝেতে বসল রানা। ক্যাব আর ট্রেইলারের স্টিলের বডিতে খটাখট শব্দে লেগে পিছলে গেল কিছু গুলি। কয়েকটা বুলেট ঝনঝন করে ভাঙল ক্যাবের উইণ্ডশিল্ড। ছিটকে ভেতরে এসে রানার মুখ-গায়ে-হাতে লাগল কাঁচের অজস্র টুকরো। ড্রাইভারের দরজা এখনও খোলা। ওটার জানালা ধরে নিজেকে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে টেনে তুলল রানা। একটা বুলেট লাগতেই ওর হাতসহ থরথর করে কাঁপল ধাতব দরজা।

অলসভাবে চলছে ট্রাকের ইঞ্জিন। বামপায়ে ক্লাচ চেপে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিল রানা। লোডিং ডক পেছনে ফেলে ওয়্যারহাউসের দরজার দিকে ছুটল দানবীয় ট্রাক। দ্রুত গিয়ার ফেলে গতি তুলছে রানা। ক্যাবের ভেতরটা ভরে গেছে শক্তিশালী ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজে।

ওয়্যারহাউস থেকে বেরিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকিং কোম্পানির মেইন গেটের দিকে চলল রানা।

গেটের কাছে জড় হয়েছে ক’জন গুণ্ডা। এমনিতেই বেরিয়ে যেত এই কম্পাউণ্ড থেকে, তার ওপরে তাদের দিকে বিশাল ট্রাক তেড়ে আসছে দেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল তারা। অবশ্য দুই বোকা গুণ্ডা ভেবেছে, গুলি করে থামিয়ে দেবে ট্রাক।

ক্যাব ও ট্রেইলারের স্টিলের দেয়াল ভেদ করতে না পেরে পিছলে যাচ্ছে গুলি। একহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিল রানা। পর পর কয়েকটা গুলি করল দুই গুণ্ডাকে লক্ষ্য করে। ট্রাক গায়ের কাছে চলে এসেছে দেখে একেবারে শেষ সময়ে গেটের বাঁদিকে ঝাঁপ দিল তারা। কিন্তু ভুল করে বসেছে হিসাবে। সরাসরি দুই গুণ্ডাকে নাকের ডগায় তুলে দড়াম করে গেটের ওপরে চড়াও হলো ট্রাক। ভারী ইঞ্জিনের আওয়াজের ওপর দিয়ে দুটো করুণ আর্তনাদ শুনতে পেল রানা। পিঁপড়ের মত পিষে গেছে দুই নির্বোধ।

কম্পাউণ্ডের মেইন গেটের সাধ্য নেই যে ঠেকিয়ে দেবে ছুটন্ত ভারী ট্রাক। প্রচণ্ড এক গুঁতো খেয়ে ছিঁড়ে গিয়ে দু’দিকে গিয়ে পড়েছে দুই কবাট। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে আগুনে ভরা কম্পাউণ্ড পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে ট্রাক। দূরের রাস্তায় একসারিতে অনেকগুলো নীল-লাল আলো দেখতে পেল রানা। ওর বুঝতে দেরি হলো না, এসব বাতি পুলিশের ক্রুবারের। প্রতিটি গাড়িতে কমপক্ষে দু’জন অফিসার থাকলেও রসির গুণ্ডাদের চেয়ে সংখ্যায় তারা অনেক বেশি। পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই মাফিয়ার গুণ্ডাদের।

নিজেও আর বেশিদূর যেতে পারবে না রানা। গতিহ্রাস করে রাস্তার পাশে ট্রাক রাখল ও। ওকে পাশ কাটিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আগুনে ভরা ট্রাকিং কোম্পানির দিকে গেল অন্তত পনেরোটা পুলিশের জুয়ার। দূর থেকে এল আরও ভারী সাইরেনের শব্দ। ওগুলো ফায়ার ব্রিগেড আর অ্যাম্বুলেন্সের।

ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যাব থেকে নেমে পড়ল রানা। ট্রেইলারের পেছনে গিয়ে দরজা খুলে দেখল ভেতরে। ভয়- ভরা চেহারায় ধুলোময় মেঝেতে বসে আছে অন্তত ত্ৰিশটা শিশু। আর তাদের মাঝে রাজকুমারীর মত বসে আছে লিউনা। রানাকে দেখে ওর মুখে যে হাসি ফুটল, ওটা বোধহয় বিশ লাখ ওয়াটের বালবের আলোর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। শিশুদের দিকে চেয়ে বলল, ‘বলেছি না, তোমাদের রানা আঙ্কেল আমাদেরকে বিপদ থেকে সরিয়ে নেবে?’

রানার চোখে তাকাল লিউনা, চোখে খুশির অশ্রু।

দূরে একটা-দুটো পিস্তলের গুলির আওয়াজ শুনল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ট্রেইলারের দরজার কাছে হাজির হয়েছে সিভিলিয়ান পোশাকে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন। মস্ত এক রিভলভার সরাসরি ওর বুকে তাক করেছে সে!

‘জানতাম যে এসবের পেছনে আপনি আছেন,’ কড়া গলায় বলল সার্জেন্ট, ‘ধরে নিন আপনার জেল হবে বিশ বছরের। ঠিক আছে, প্রাণে বাঁচতে চাইলে হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিন!’

তেইশ

মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর শুকনো গলায় বলল, ‘তো বাচ্চাদের দায়িত্ব নেবে এমন কাউকে ডাকুন, সার্জেন্ট।

ওকে অস্ত্রের মুখে রেখেছে এবার্টন। অ্যালডো রসির ট্রাকিং কোম্পানির ধসে পড়া গেটের দিকে রাইফেল হাতে ছুটছে ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসার। তাকে নাম ধরে ডাকল সার্জেন্ট। তাতে ঘুরে তার দিকে এল যুবক।

‘মাইকেল, কয়েকজনকে নিয়ে এসে বাচ্চাদেরকে পাহারা দাও, যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে।’

ট্রাকিং কোম্পানির দিকে চলল পুলিশ অফিসার।

ওদিকে ট্রাক রাখার উঠনে এরই ভেতরে গ্রেফতার হয়ে গেছে মাফিয়ার কয়েকজন গুণ্ডা।

ওর জীবনের শেষ লড়াইটা এভাবে সমাপ্ত হবে, ভাবতে পারেনি রানা। টেইলার থেকে নেমে এল লিউনা। সার্জেন্ট এবার্টনের পাশে এসে থেমেছে আরেক ডিটেকটিভ সার্জেন্ট।

‘অ্যাই, মেয়ে, তুমিও হাত থেকে অস্ত্র ফ্যালো,’ লিউনার হাতে বেরেটা ৯৩-আর পিস্তলটা দেখে নির্দেশ দিল এবার্টন।

‘আপনি কিন্তু জানেন না আমরা কারা,’ বোঝানোর সুরে বলল লিউনা। ‘একটু আগে আমরা দু’জন উদ্ধার করে এনেছি বাচ্চাদেরকে।’

‘আমরা কোন ঝামেলা চাই না,’ দ্বিতীয় সার্জেন্টের হাতে অটোম্যাগ আর এসএমজি দেয়ার পর বুক থেকে অ্যামিউনিশন বেল্ট খুলে তার কাছে দিল রানা।

ছোঁ দিয়ে লিউনার বেরেটা কেড়ে নিল সার্জেন্ট এবার্টন। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলাল। রিভলভারের নল দিয়ে দেখাল একটু দূরের এক সাধারণ গাড়ি। ওদিকে চলুন।

ট্রেইলার থেকে সরে গাড়িটার দিকে চলল রানা ও লিউনা, পেছনে দুই ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। ওদের একটু দূর দিয়ে গেল রাইফেল হাতে ইউনিফর্মড ক’জন পুলিশ অফিসার। ট্রেইলারে উঠে নরম সুরে বাচ্চাদেরকে শান্ত করতে চাইল তারা। ট্রেইলারের কাছে এসে থামল একটা অ্যাম্বুলেন্স। ওটা থেকে স্ট্রেচার নিয়ে নামল দু’জন মেডিক।

এরই ভেতরে ট্রাকিং কোম্পানির কম্পাউণ্ডে ঢুকে আগুন নেভাতে শুরু করেছে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসারেরা। দূর থেকে এল গুলির আওয়াজ। ওখানে পুলিশের ঘেরাওয়ের ভেতরে আছে রসিদের দলের কয়েকটা গুণ্ডা। অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ না করলে গুলি খেয়ে মরবে।

‘ঠিক আছে, এবার যা বলার বলুন, মিস্টার রানা,’ নিজের গাড়ির কাছে থেমে বলল সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন।

রানার চোখ চলে গেল ট্রাকিং কোম্পানির উঠনে। ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে বেশকিছু পোড়া মৃতদেহ। একটু পর এসে লাশ সংগ্রহ করবে করোনারের অফিসের লোক।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করল সার্জেন্ট এবার্টন। কড়া গলায় জানতে চাইল, ‘ওরা পঁচিশ না ত্রিশজন ছিল?’

‘আমার জানা নেই,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। সন্ধ্যা থেকে যত ধরনের ঝামেলার ভেতর দিয়ে গেছে, তাতে শ্রান্তিতে ওর এখন মনে হচ্ছে শুয়ে পড়তে। ‘আপনি আমাকে গ্রেফতার করতে চাইলে করতে পারেন, আমার কিছু বলার নেই।’

অন্তত একমিনিট কঠোর চোখে ওকে দেখল এবার্টন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সত্যিই জানি না কী করা উচিত। একসপ্তাহ ধরে জানতাম অপহৃত শিশুদেরকে এ-শহর থেকে সরিয়ে নেবে রসিরা। তাই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। তারপর আজ এসে সব গুবলেট করে দিলেন আপনি। যাই হোক, এবার খুলে বলুন আরও কত ধরনের আইন আপনি ভেঙেছেন।’

রসিরা অপহরণ করে বাচ্চাদেরকে পাচার করবে, সেটা যদি জানতেনই, তো ওদেরকে উদ্ধার করলেন না কেন?’ রেগে গিয়ে জানতে চাইল লিউনা।

‘আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, যাতে ঠিক সময়ে অপরাধীদেরকে প্রমাণসহ গ্রেফতার করতে পারি,’ বলল এবার্টন। ‘সংগ্রহ করেছি নানান ধরনের তথ্য। আর তারপর মাফিয়া ডনের আস্তানা কোথায় সেটা জেনে নিয়ে আজ হানা দেব, এমনসময় পড়ে গেলাম মস্ত বিপদে।’ ঘাড় কাত করে সঙ্গী ডিটেকটিভ সার্জেন্টকে দেখাল সে। এমনকী আমার পার্টনারও ভেবেছে যে আমি ঘুষখোর এক কুত্তার বাচ্চা!’

‘শিকাগো পুলিশের অনেকেই ঘুষ খায়, এটা নতুন নয়, বলল সার্জেন্ট সিমন্স, ‘সন্দেহ করেছি বলে আমাকে দোষ দেয়া যায় না।’

‘আমার যোগাযোগ ছিল এফবিআই অফিসারদের সঙ্গে,’ বলল এবার্টন, ‘তারা বেশকিছু তথ্যও দিয়েছে। তাদের কথায় চোখ রাখতে শুরু করি অ্যালডো রসির প্রতিষ্ঠান আর তার বাড়িতে। সেজন্যেই আজ গিয়েছিলাম তার বাড়িটার সামনে।’

চুপ করে আছে রানা।

‘জানতাম শিশুদের কেসটা খুব সিরিয়াস,’ বলল এবার্টন। ‘তাই অফিসের কারও সঙ্গেই আলাপ করিনি। এদিকে জানি না শিশুদেরকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে অ্যালডো আর এলিসা রসি।’ চোখ সরু করে রানাকে দেখল সে। ‘আমাকে সব যার খুলে বলার কথা, আজ সন্ধ্যায় হেলথ ক্লাবের হামলায় খুন হয়ে গেছে সে। আর সেজন্যেই জরুরি কোন তথ্য আর পেলাম না। তারপর কিছুক্ষণ আগে এদিকের এক কোম্পানির গার্ড ফোন করে বলল, বিশাল এক আগুন জ্বলছে এখানে। এরপর আমার আর বুঝতে দেরি হলো না, এসবের পেছনে আছেন আপনি, মিস্টার রানা। ফলে ক্যাপ্টেনকে বলে অফিসের সবাইকে নিয়ে ছুটে এসেছি রেইড দিতে।’

বিধ্বস্ত ট্রাকিং কোম্পানির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ট্রেইলার দেখল রানা। একে একে নামানো হচ্ছে শিশুদেরকে। মৃদু হেসে সার্জেন্ট এবার্টনকে বলল ও, ‘আপনি যা করতেন, সেই একই কাজ আমিও করেছি। আপনি সফল হলে রসির দলের সবাই আদালত থেকে জামিন পেত। তাতে মোটা অঙ্কের টাকা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে দামি ক’জন উকিলের।

‘আপনি কোন আইন মানেননি,’ বলল এবার্টন, ‘আমরা পুলিশের লোক সেটা করি না। গণতান্ত্রিক দেশ এভাবেই চলে। আর আপনার মত মানুষ সবসময় বুড়ো আঙুল দেখান আইনের শাসনকে।’

‘চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেয়ার বিষয়ে কী যেন লেখা আছে আপনাদের বাইবেলে?’ জানতে চাইল রানা।

‘বাইবেল নয়, শিকাগো পুলিশ মেনে চলে আইনের বই,’ জোর দিয়ে বলল সার্জেন্ট এবার্টন।

তার দিকে তাকাল সার্জেন্ট সিমন্স। ‘অবশ্য আমার মনে হচ্ছে, কখনও কখনও পুলিশেরও উচিত চোখ বুজে থাকা।’

স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে দুর্বল শিশুদের। একজন মেডিকের হাত ছুটিয়ে হঠাৎ ছুটে এল উপমহাদেশীয় ছোট্ট এক ছেলে। মুখে ফোকলা হাসি নিয়ে কড়া ব্রেক কষে থামল রানার সামনে। ‘আঙ্কেল? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ! তুমি কিন্তু সবসময় ভাল থাকবে!’

‘তোমার নাম কী, বাবু?’ ক্লান্ত হাসল রানা।

‘রাগিব চৌধুরী, বুক ফুলিয়ে বলল পিচ্চি। কিন্তু দাদু বলেন আমি কক্ষণও রাগিবো না!’

‘বাড়ি ফিরে দাদুকে বোলো, রানা আঙ্কেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, কেমন?’ নরম সুরে বলল রানা। হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেছে ওর হৃদয়। এখানে এসেছিল স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। বসের নীরব অনুরোধে লড়াই করেছে শিশু অপহরণকারী একদল পিশাচের বিরুদ্ধে। এখন আর কিছুই করার নেই ওর। বার্কলে এবার্টন বা তার সঙ্গীকে আহত করে পালাতে গেলে গুলি করে ওকে খুন করবে পুলিশ অফিসারেরা।

‘নিশ্চয়ই বলব, আঙ্কেল! তুমি কিন্তু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে! আমরা একসঙ্গে লুকোচুরি খেলব! আর সেই সঙ্গে খেলব ক্রিকেট!’

‘নিশ্চয়ই খেলব, আঙ্কেল!’

যার হাত ছুটিয়ে রানার কাছে এসেছে পিচ্চি, সেই মেডিক এসে ওকে নিয়ে গিয়ে সাবধানে তুলে দিল একটা অ্যাম্বুলেন্সে।

বিড়বিড় করে কী যেন নিজেকে বলল সার্জেন্ট এবার্টন। ঘুরে তাকাল সার্জেন্ট সিমন্সের চোখে। নিজেও এক পা এগিয়ে এসেছে সিমন্স। হাতে অটোম্যাগ, ইনগ্রাম আর অ্যামিউনিশন বেল্ট। অন্তর থেকে চাইছে আবারও রানার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে।

‘চোখে বালি পড়েছে বলে কিছুই তো দেখছি না,’ বহু দূরে চেয়ে হোলস্টারে রিভলভার পুরল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘মিস্টার রানা, আপনি বরং চলে যান শিকাগো থেকে। আমরা চুপ করে থাকলেও এফবিআই আপনাকে রেহাই দেবে না।’

‘আমরা আজ মিস্টার রানাকে দেখিইনি!’ অস্ত্রগুলো রানার হাতে গছিয়ে দিল সার্জেন্ট সিমন্স। ঘুরে তাকাল পার্টনারের দিকে। এখন দু’জনের মুখেই আন্তরিক, সহৃদয় হাসি।

‘আজ এখানে যা ঘটল, তাতে দুর্দান্ত এক কাহিনী শুনবেন ক্যাপ্টেন,’ হাসিটা আরও চওড়া হলো এবার্টনের। বেরেটা ধরিয়ে দিল লিউনার হাতে। ‘ঠিক আছে, আমাদের গাড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে অ্যালডো রসির দলের এক ক্রিমিনাল। এবার রওনা হয়ে যান, মিস্টার রানা। সঙ্গে করে নেবেন সুন্দরী এই মেয়েটাকে। নইলে কোথা থেকে এল সেটা নিয়ে নানান কথা উঠবে। … আরেকটা কথা, স্যর, আমরা একই বইয়ের পাঠক না হলেও, আপনি কিন্তু পাঠক হিসেবে বইয়ের কাহিনী দারুণভাবে পড়ে শেষ করেছেন!’

মাসুদ রানা পেশায় পুলিশ না হলেও এই দুনিয়ায় তার মত মানুষের বড্ড দরকার, ভাবছে সার্জেন্ট শ্যন সিমন্স।

গাড়িতে উঠবে রানা, এমনসময় পেছন থেকে ওকে ডাকল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘একমিনিট, স্যর! আমার বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার সময় হ্যাণ্ডশেক করতে চেয়েছিলেন। তখন সেটা করিনি, কারণ চিনতে পারিনি আপনাকে। এখন নিজেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি কি দয়া করে একবার হ্যাণ্ডশেক করবেন আমার সঙ্গে? খুব সম্মানিত বোধ করব, স্যর।’

গাড়ির পেছনের সিটে অস্ত্রগুলো রেখে ঘুরে দাঁড়াল রানা। ওর দিকে এক পা এগিয়ে এসেছে দুই সার্জেন্ট। এক এক করে রানার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল তারা।

‘এবার চলো, সিমন্স, মেলা কাজ পড়ে আছে,’ তাড়া দিল বার্কলে। ‘দুই জায়গায় তো আর একই সঙ্গে থাকতে পারব না!’

‘কথা ঠিক,’ মাথা দোলাল সিমন্স। ‘আমরা তো আর কম চেষ্টা করিনি, মাসুদ রানার টিকির হদিসও খুঁজে পেলাম না!’

আগুনে ভরা ট্রাকিং কোম্পানির উঠনের দিকে চলল দুই ডিটেকটিভ পুলিশ অফিসার। এরই মধ্যে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে বেশিরভাগ শিশুকে। রসিদের দলের ক’জন গুণ্ডাকে গ্রেফতার করে উঠনে জড় করেছে পুলিশের লোক। দালান ও ওয়্যারহাউসের আগুন নেভানোর জন্যে হোস পাইপ হাতে ছুটোছুটি করছে ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা।

গাড়িতে ওঠার আগে একবার ওদিকে তাকাল রানা। অ্যালডো আর এলিসার লাশ যে অফিসে ছিল, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ওটা।

লিউনাকে ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলে ড্রাইভিং সিটে বসল রানা। ওর পাশের সিটে উঠে দরজা আটকে নিল লিউনা। একবার চেয়ে দেখল শিশুদেরকে। নিচু গলায় বলল, ‘দুনিয়ার সব বাচ্চাকে যদি এভাবে নিরাপদে রাখতে পারতাম! আজ ইবলিশগুলোর হাত থেকে যারা বেঁচে গেল, ওদের কপাল খুবই ভাল। চিকিৎসা পেয়ে ফিরে যেতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু সবার ভাগ্য তো এত ভাল হয় না।’

‘প্রতিটি দেশের মানুষ সতর্ক হলে আর কখনও ফণা তুলে ছোবল দিতে পারবে না অ্যালডো বা এলিসার মত কাল- সাপেরা,’ বলল রানা। ‘প্রার্থনা করো, আমরা যেন তেমনই এক পৃথিবী দেখে যেতে পারি।

ঘুরে ওর দিকে তাকাল লিউনা। ‘বলো তো, আমরা এবার কোথায় যাব?’

মেয়েটার চোখে কেমন এক ঘোর দেখতে পেল রানা। মৃদু বাতাসে ওর নাকে ভেসে এল লিউনার চুলের মিষ্টি সুবাস। তাতে আছে অদ্ভুত এক মাদকতা। ‘আমরা হয়তো শহরের বাইরে ছোট কোন হোটেলে গিয়ে উঠব,’ বলল রানা।

‘আমরা কি একই রুমে থাকব?’ বলল লিউনা, ‘যেখানে থাকবে ডাবলবেড?’

‘হয়তো।’

‘কিন্তু আমরা তো পরস্পরকে ভাল করে চিনিই না। অবশ্য আজকের বিশেষ এই রাত হতে পারে চিনে নেয়ার।

সার্জেন্ট এবার্টনের গাড়ির ড্রাইভিং দরজা বন্ধ করল রানা। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল। এখনও এদিকে আসছে একের পর এক পুলিশের ক্রুযার। তবে ওদেরকে থামাবার জন্যে ইশারা দিল না কেউ।

ঝোড়ো বেগে শহরের দিকে চলেছে রানা। তবে কিছুক্ষণ পর ছোট এক জঙ্গলের ধারে থেমে এই গাড়ি ফেলে রেখে উঠে পড়বে লিউনার করোলা গাড়িটাতে। যত দ্রুত সম্ভব ত্যাগ করবে শিকাগো শহর। হঠাৎ করেই রানা টের পেল, ওর উরুর ওপরে হাত রেখেছে লিউনা।

মুখে কিছু না বললেও বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত কী যেন বয়ে গেল ওদের শরীরে। পরস্পরকে দেখল ওরা। দু’জনই অনুভব করল, আজ নয়, সহস্র বছর ধরেই একে অপরকে চেনে।

রানার কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল লিউনা, ‘পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব আমার গ্রামের বাড়িতে। খুব খুশি হব ওখানে তুমি কয়েকটা দিন রয়ে গেলে।

গাড়ির গতি কমিয়ে লিউনার কপালে চুমু এঁকে দিল রানা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *