দশ
নীল ছবির স্টুডিয়োতে জানালা দিয়ে ঢোকার আগে গা থেকে ওভারকোট খুলে মাটিতে ফেলে রেখে গেছে রানা, তাই ওটাতে লেগেছে একগাদা ধুলোবালি। এখন সিম্পসনের বার- এ পা রাখার আগে ওভারকোট চাপড়ে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।
হাড়-কাঁপা শীতে বারের খদ্দেরদের গায়ে ওভারকোট। ওগুলো ওরটার চেয়ে ঢের পরিষ্কার। রানার অবশ্য মনে হলো না যে তারা ধরে নেবে, পাটখেত থেকে উঠে এসেছে ও।
ঘরের ভেতরে দমবদ্ধ পরিবেশ। বাতাসে ভাসমান ধূসর ধোঁয়া ঘোলা করে দিয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি। বিকট আওয়াজে জুকবক্সে বাজছে মিউযিক। ওটা ছাপিয়ে মদ খেতে খেতে নিজেদের ভেতরে হৈ-চৈ করছে একদল মাতাল।
আতাউলের তথ্য অনুযায়ী এই বারের মালিক আসলে মাফিয়া ডন রসি। ম্যানেজার হিসেবে এখানে বহু দিন ধরে চাকরি করছে সিম্পসন। আবার রুবার জিমনেশিয়াম আর ম্যাসেজ পার্লারের মালিকও ডন রসি।
মাতালদের ভিড় ঠেলে বার কাউন্টারের কাছে গেল রানা। চোখাচোখি হতেই ওকে ইস্পাতের মত কঠিন দৃষ্টিতে দেখল বারটেণ্ডার। তাকে বিয়ার দিতে বলল রানা। শিরশির করছে ওর মেরুদণ্ড। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানাতে শুরু করেছে: এই জায়গা তোমার জন্যে একদম নিরাপদ নয়!
একটু দূরে আলাপ করছে এক লোক আর এক যুবতী। সোনালি চুলের বেঁটে মধ্যবয়সী লোকটার চেহারায় বিরক্তি। তার সঙ্গিনীর মাথার চুল আগুনের মত টকটকে লাল। মেয়েটার পরনে সংক্ষিপ্ত পোশাক। হাতে-পায়ে দড়ির মত পেশি। ঝুঁকে সঙ্গীর কানে কানে কী যেন বলছে সে।
রানার সামনে কাঠের কাউন্টারে ঠকাস করে বিয়ারের গ্লাস রাখল বারটেণ্ডার। তার কাছে জানতে চাইল রানা, ‘পিট ব্ল্যাক কি এদিকে আছে?’
এই নামের কাউকে চিনি না,’ অলস সুরে বলল বারটেণ্ডার। সোনালি চুলের বেঁটে লোকটার দিকে ঘাড় কাত করে দেখাল। ‘উনি এই জয়েন্টের বস্। কিছু জানতে চাইলে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করো। ইচ্ছে হলে তিনি জবাব দেবেন।
বিয়ার স্পর্শ না করে ক’জনকে পাশ কাটিয়ে সিম্পসনের সামনে গিয়ে থামল রানা। লোকটার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি পিট ব্ল্যাককে খুঁজছি।’
ওর কথায় বিস্ফারিত হলো সিম্পসনের চোখ। কুঁচকে গেছে নাক-মুখ। একই সময়ে ঘুরে রানার দিকে তাকাল লাল চুলের যুবতী। পরক্ষণে কাঁধের সমস্ত শক্তি দিয়ে রানার থুতনি লক্ষ্য করে ঘুষি মারল সে।
রানা ভাবতেও পারেনি উসকানি ছাড়াই ওর ওপরে হামলা করবে যুবতী। একটু দেরি হলেও ঝট করে একদিকে সরিয়ে নিল মাথা। ওর চোয়াল ঘষে পিছলে গেল ঘুষিটা। ভারসাম্য হারিয়ে দু’পা পেছাল রানা। ওদিকে সামনে বেড়ে বাতাসে ভেসে উঠে কোমর ঘুরিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি ওর বুকে বসাতে চাইল রুবা।
লাথিটা আসতে দেখে দ্রুত আরও দু’পা পেছাল রানা। এদিকে লাথি মারতে না পেরে রেগে গেছে রুবা। মাটিতে তার পা পড়তেই সামনে বেড়ে আবারও আক্রমণে গেল সে। কোমর ঘুরিয়ে লাথি দিল রানার পাঁজর লক্ষ্য করে। তবে এবার তৈরি রানা খপ করে ধরল গোড়ালি। পা-টা মোচড় দিয়ে ওপরে ঠেলে দিতেই ভারসাম্য হারাল রুবা। কাত হয়ে কাঠের শক্ত মেঝেতে হুড়মুড় করে পড়ল সে।
এদিকে বারের ভেতরে মারামারি শুরু হয়েছে দেখে যে- যার গ্লাস হাতে সরে যাচ্ছে খদ্দেরেরা। ঘাড় ফিরিয়ে কাউন্টারের দিকে তাকাল রানা। বারের নিচের এক তাক থেকে নল-কাটা বন্দুক নিয়েছে বেঁটে সিম্পসন। ওর দিকে ব্যারেল ঘুরিয়ে ডানহাতের তর্জনী ভরল ট্রিগার গার্ডে। সত্যি গুলি করা হলে ছররা লাগবে আশপাশের অনেকের গায়ে!
ব্যাটার মাথা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে, ভাবল রানা। শোল্ডার হোলস্টার থেকে ঝড়ের বেগে ওর হাতে উঠে এল বেরেটা ৯৩-আর। সিম্পসনের বন্দুক আগুন ঝরাবার আগেই গর্জে উঠল রানার পিস্তল। সেকেণ্ডের বিশভাগের একভাগ সময়ে সিম্পসনের নাকের গোড়ায় বিধল নাইন এমএম বুলেট। খুলির ভেতরে ঢুকে ছেতরে দিল মগজ। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পেছনের বার কাউন্টারের ওপরে গিয়ে পড়ল লোকটা। ওখান থেকে নামল বন্দুকসহ মেঝেতে। ঝনঝন করে ভেঙে গেছে অসংখ্য মদের বোতল। মৃত ম্যানেজারের তর্জনীর চাপে ‘বুম্!’ শব্দে গর্জন ছেড়েছে নল-কাটা বন্দুক। ছররা লেগে বিচ্ছিন্ন হলো সিম্পসনেরই ডান গোড়ালি।
এদিকে বারের ভেতরে শুরু হয়েছে চরম হুলুস্থুল। আরও গুলি করা হবে ভেবে ঘর থেকে বেরোতে চাইছে খদ্দেরেরা। এদিকে কাউন্টারের তাক থেকে বন্দুক নিতে কুঁজো হয়েছে দুই বারটেণ্ডার। গোলাগুলি এড়াতে গিয়ে খদ্দেরদের মধ্য দিয়ে ছুট দিল রানা। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল পাশের দরজা পার হয়ে করিডরে। চট্ করে বুঝে গেল এই প্যাসেজের বামের দরজার ওদিকে রুবার ম্যাসেজ পার্লার।
দরজার দিকে যাওয়ার আগে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। করিডরে ঢুকে পড়েছে দুই বারটেণ্ডার। ডানের লোকটার হাতে বন্দুক। ট্রিগার টিপে দিতেই বিকট আওয়াজ তুলল তার অস্ত্র। অবশ্য এক সেকেণ্ড আগেই এক লাফে রুবার ম্যাসেজ পার্লারের দরজার ওদিকে চলে গেছে রানা। করিডরের একদিকের দেয়ালে বিঁধেছে বেশকিছু হুররা। কাঠের দেয়ালের এক জায়গায় এখন মুঠোর আকৃতির ফুটো। ঘুরেই দরজার ওপাশে তাকাল রানা। পরক্ষণে ওর হাতে লাফিয়ে উঠল বেরেটা। তিন রাউণ্ড বুলেটের একটা ফস্কে গেলেও অন্যদুটো ছিঁড়ে দিল বন্দুকওয়ালার অর্ধেক ঘাড়। পেছনদিকে ঝর্নার মত ছিটকে গেল লাল রক্তের স্রোত। লাশটা মেঝেতে পড়ার আগেই ঘুরে প্রাণভয়ে দৌড় দিল দ্বিতীয় বারটেণ্ডার। এখন আর লড়াই করার ইচ্ছে নেই তার।
এদিকে খুলে গেছে করিডরের বামের দুটো দরজা। চেহারায় ভয় নিয়ে উঁকি দিচ্ছে উলঙ্গ কয়েকজন লোক। বন্দুক আর পিস্তলের আওয়াজে শুকিয়ে গেছে সবার মুখ।
এটা পুলিশের রেইড ধরে নিয়ে করিডরে বেরোল উদোম তিন মেয়ে, হাতে যার যার পোশাক। প্রাণপণে ছুটল বারের দিকে। গোলাগুলি থেমে গেছে বুঝতে পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েদের পিছু নিল উলঙ্গ খদ্দেরেরা, হাতে যার যার পোশাক। ঘুরে রুবার ম্যাসেজ পার্লারের লবির দিকে তাকাল রানা। রিসেপশন ডেস্কের পেছন থেকে এল বুলডোযারের মত ভারী শরীরের এক তরুণী। লবির পাশে ছোট কয়েকটা কিউবিকল থেকে বেরোল গোটা চারেক লোক। কোন দিকে না চেয়ে রানাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে গেল করিডরের দূরে। তরুণী করিডরে পা রাখার আগেই খপ্ করে তার কবজি ধরল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘পিট ব্ল্যাক এখন কোথায়?’
চোখ তুলে ওকে দেখল তরুণী। পরক্ষণে ঘাড় কাত করে দেখাল ওপরতলা। তার মাথায় এল জরুরি প্রশ্ন। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনি আসলে কে?’
‘আমি এমন একজন, যে ব্ল্যাককে খুঁজছে,’ বলল রানা। ‘ওকে দেরি না করে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
‘আপনি তার বন্ধু, না? উনি আছেন রুবার অফিসে।’
সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলা থেকে নামছে ক’জন লোক আর পতিতারা। রুবার অফিস ওপরতলায়, আগেই আন্দাজ করেছে রানা। লবির কোণে এলিভেটর দেখেও একেকবারে তিনধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ছুটল ও। চওড়া কাঁধের সুঠাম যুবককে দেখে পথ ছেড়ে দিচ্ছে সবাই।
তৃতীয়তলায় উঠে কোন অফিস দেখতে পেল না রানা। আবারও উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। চতুর্থতলার করিডরে ডানে দেখতে পেল বড় এক দরজা। ওটার ওদিকেই বোধহয় রুবার অফিস। বেরেটা হাতে দরজার কাছে পৌঁছে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে দড়াম করে দুই কবাট খুলল ও। ঘরের ভেতরে রুবার ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসে আছে পিট ব্ল্যাক। হাতে ফোনের রিসিভার। হঠাৎ করে রানাকে যমদূতের মত হাজির হতে দেখে বরফের মূর্তি হয়ে গেছে সে।
ব্ল্যাকের বুকে পিস্তল তাক করে ধমকের সুরে বলল রানা, ‘খবরদার, একটুও নড়বে না!’
‘আ… আ… আপনি এখানে এলেন কীভাবে?’ মস্ত ঢোক গিলল ব্ল্যাক। ধরেই নিয়েছে যে এবার আর বাঁচবে না।
হাতে যথেষ্ট সময় পাবে না, বুঝে গেছে রানা। নিচতলায় নিজেদেরকে সামলে নিতে পারলেই ওকে খুঁজতে শুরু করবে মাফিয়ার গুণ্ডারা। তার আগেই এখান থেকে বেরোতে হবে ওর। ‘বাঁচতে চাইলে ফোন রাখো,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।
ক্রেডলে রিসিভার রাখল ব্ল্যাক। কাঁপা গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনি আমার কাছে কী চান?’
‘প্রথমবার দেখা হলে নেংটো মেয়েলোকটার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে ভুলে গেছ, তুমি আসলে ডন রসির ব্লু ফিল্মের ভাড়াটে পরিচালক,’ বলল রানা। ওর বেরেটা সরাসরি চেয়ে আছে ব্ল্যাকের কপাল লক্ষ্য করে।
‘আ… আমি… আপনার কথা বুঝতে পারিনি,’ দুর্বল হাসি দিল ব্ল্যাক। ‘ওই বাড়িতে গেছি রসির বড়বোনের খোঁজ-খবর নিতে। সামাজিক মানুষ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। কারও তো কোন ক্ষতি করিনি। আমি আসলে তাদের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না।’
‘বাজে কথা বাদ দাও, ব্ল্যাক,’ কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। ‘অ্যালডো তোমার বস্। তার টাকায় পর্নোগ্রাফি তৈরি করো তুমি।’
‘ইয়ে… এটা তো সাধারণ ব্যবসা,’ চট্ করে বলল ব্ল্যাক। ভয়ে করমচার মত লাল হয়ে গেছে মুখ। ‘শপথ করে বলতে পারি, ওটা ছাড়া তার আর কোন কিছুতেই আমি নেই।
‘শিশুদেরকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির ব্যাপারে কী বলবে? তুমি এসবে জড়িত নও?’
হাঁ হয়ে গেল পিট ব্ল্যাক। তিরতির করে কাঁপছে ডান গাল। তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে রানার মনে হলো, যে- কোন সময়ে জ্ঞান হারাবে লোকটা। তারপর তুতলে উঠে বলল ব্ল্যাক: ‘বা….. বাচ্চাদের পর্নোগ্রাফি? এসব কী বলছেন আপনি! এত নোংরামিতে আমি কখনও নাক গুঁজে দিইনি। এমনিতেই বয়স্কগুলোকে দিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে পাছার গু মাথায় উঠে যায়!’
মুখের ভেতরে তেতো ভাব টের পেল রানা। পিট ব্ল্যাক এত বেশি ভয় পেয়েছে, মনে হচ্ছে না মিথ্যা বলছে সে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে এর কাছ থেকে শিশু কিডন্যাপিং বা শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে কিছুই জানতে পারবে না।
‘মিথ্যা বলছ, ব্ল্যাক! তুমি কিন্তু আমার হাতে খুন হবে! পাণ্ডুর হয়ে গেল লোকটার মুখ। ঘন ঘন মাথা নাড়ল। ‘খোদার কসম! ইবলিশের কিরা! আমি কখনও কোন বাচ্চার কোন ক্ষতি করিনি! তার চেয়ে মরে যাওয়াও তো ভাল!’
কঠোর দৃষ্টিতে ব্ল্যাককে দেখল রানা। ‘সিনেটর জাস্টিন পিটার সম্পর্কে বলো।’
‘কার কথা বললেন?’
‘জাস্টিন পিটার।’
চোখ পিটপিট করল ব্ল্যাক। ‘সিনেটর?’ কণ্ঠে দ্বিধা। ‘মাঝে মাঝে তাঁকে দেখি টিভিতে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সামনা- সামনি কখনও দেখা হয়নি।’
‘তার আর অ্যালডো রসির ভেতরে কীসের সম্পর্ক?’ বলল রানা। ‘সে ব্যাপারে বলো।’
বেরেটার নলের দিকে চুপ করে চেয়ে আছে পিট ব্ল্যাক। নিচতলা থেকে এল কয়েকজনের হৈ-চৈ।
‘আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না,’ বলল ব্ল্যাক। ‘আজকে বাচ্চাদের জন্যে ফাণ্ড সংগ্রহ করতে এক হোটেলে ডিনারের আয়োজন করেছেন। আপনি বরং নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলুন।’
‘হয়তো তা-ই করব,’ বলল রানা। ‘কিন্তু তার আগে ডন রসিকে চাই। সুতরাং বলো সে এখন কোথায় আছে।’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘আমি যদি জানতাম, তো আপনাকে বলে দিতাম। বিশ্বাস করুন, তার ব্যাপারেও কিছুই জানি না। আমাকে মেরে ফেললেও কিছু জানাতে পারব না।’
তার চোখ দেখে রানার মনে হলো, যা বলেছে লোকটা, তার চেয়ে ঢের বেশি জানে। কিন্তু তাকে জেরা করার মত সময় এখন ওর হাতে নেই।
বেরেটা নামিয়ে নিল রানা। বিরক্ত স্বরে বলল, ‘তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি, ব্ল্যাক। এলিসা রসির কাছ থেকে দূরে থেকো। কারণ আজ রাতে এ-শহরে অনেকের রক্ত ঝরবে। যদি বাঁচতে চাও, ভুল কোথাও পা রেখো না।’
ঢকাস্ করে বড় ঢোক গিলল ব্ল্যাক। করুণ চোখে চেয়ে রইল রানার দিকে।
‘ওয়্যারহাউসে যে ড্রাগস্ পেয়েছিলে, সে-ব্যাপারে কী বলবে? কোত্থেকে এসেছে ওগুলো? রসি পাঠায়নি?’
‘তা ঠিক জানি না। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতই পর্নোগ্রাফির ওরাও ড্রাগস্ ছাড়া কাজ করতে চায় না।’
‘বুঝলাম। বাঁচার একটা সুযোগ দিচ্ছি। মরতে না চাইলে পালিয়ে যাও শিকাগো ছেড়ে। দরজার দিকে পিছিয়ে গেল রানা। আর তখনই ওকে সতর্ক করল ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়- পেছনে চলে এসেছে কেউ না কেউ!
ঝট করে ঘুরেই দরজার দিকে পিস্তল তাক করল রানা। চৌকাঠে এসে থেমেছে লাল চুলের সেই যুবতী। অবশ্য তার হাতে কোন অস্ত্র নেই।
‘সাহস থাকলে খালি হাতে লড়ো,’ বলল রুবা। ‘লড়ব শুধু তুমি আর আমি। বুকে সাহস আছে?’
ভাল বিপদে পড়েছি তো, ভাবল রানা।
‘নামিয়ে রাখো তোমার পিস্তল,’ বাঁকা হাসল রুবা। ‘খালি হাতে লড়বে। নিচতলায় সবাই অপেক্ষা করছে। তুমি আমার হাতে মার খেয়ে খুন হলে এসে লাশ সরিয়ে নেবে।’
ডেস্কের পেছন থেকে বিড়বিড় করল ব্ল্যাক, ‘বোকামি কোরো না, রুবা! এ-লোক ভয়ঙ্কর! বাঁচতে চাইলে নিচতলা থেকে কয়েকজনকে ডেকে আনো!’
‘ভয় পেয়ো না, ব্ল্যাকি বয়,’ নরম সুরে বলল রুবা। ‘কারও সাহায্য লাগবে না। এই লোক যদি নিরস্ত্র এক মেয়েকে গুলি করে, তো সেটা আলাদা কথা। নইলে পিটিয়ে ভাঙব ওর সব হাড়গোড়।’ একবার রানা আর ওর হাতের পিস্তল দেখল যুবতী। ‘কী? সাহস আছে লড়াই করার? নাকি ধরে নেব তুমি দুনিয়ার সেরা কাপুরুষ!’
বেরেটার নল রুবার হৃৎপিণ্ড বরাবর তাক করল রানা। মুখে কোন কথা নেই। যদিও ওর চোখ সব পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছে রুবাকে। প্রাণভয়ে ঘুরেই দৌড় দিয়ে করিডরে বেরোল যুবতী। লাইন অভ ফায়ার থেকে সরে কর্কশ স্বরে চেঁচাল, ‘এবার ওকে শেষ করে দাও!’
রানা আগেই বুঝেছে, পিস্তল নামালে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে নির্দেশ দেবে রুবা, যাতে তারা এসে বন্দুক দিয়ে ঝাঁঝরা করে ওকে। করিডরে শুনতে পেল ছুটন্ত পায়ের শব্দ। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে রুবার ডেস্কের দিকে তাকাল রানা। মুখ বিকৃত করে চেয়ারে গ্যাঁট মেরে বসে আছে ব্ল্যাক। ধরে নিয়েছে এবার খুন হবে সে।
ব্ল্যাকের পেছনে কালো কালিতে লেপা কাঁচের জানালা। ওদিকে ধাতব ফায়ার এস্কেপ। একবার সেদিকে চেয়েই ঘুরে তাকাল রানা। দরজার কাছে চলে এসেছে এক লোক, হাতে পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ ক্যালিবারের রিভলভার। রানার গুলিতে ফুটো হলো তার ডানকাঁধ। আলগোছে হাত থেকে খসে পড়ল তার অস্ত্রটা। ভীষণ ব্যথায় বামহাতে আহত ডানকাঁধ চেপে ধরে উদ্দাম নাচে মেতে উঠল গুণ্ডা টাইপের লোকটা।
ঘুরেই কয়েক পা গিয়ে একলাফে ডেস্কে উঠল রানা। পিছলে যেতে দিল পা। ওর হাতে খুন হবে ভেবে কুঁই-কুঁই শব্দে কাঁদতে শুরু করেছে পিট ব্ল্যাক। ডেস্ক থেকে লাফিয়ে কাঁচ ভেঙে সরাসরি ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির ধাতব পাটাতনে নামল রানা। শুনতে পেল দূর থেকে আসছে একাধিক পুলিশের গাড়ির সাইরেন। এই এলাকায় যে গোলাগুলি হয়েছে, দেরিতে হলেও সে খবর গেছে পুলিশের কাছে। হোলস্টারে বেরেটা রেখে ছুটতে ছুটতে ফায়ার এস্কেপের ধাপ ভেঙে নামতে লাগল রানা। জানালা-পথে বেরিয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল কয়েকটা গুলি। বিষয়টা বিপজ্জনক মনে হওয়ায় ধাপ বেয়ে নামা বাদ দিয়ে রেলিঙে চেপে বসল রানা। নেমে চলেছে সাঁই-সাঁই করে। বুঝে গেছে নিচতলায় নেমে যেতে একমিনিটও লাগবে না ওর।
ভাঙা জানালায় উঁকি দিচ্ছে কয়েকজন গুণ্ডা। রানার দিকে গুলি পাঠাল তারা। ধাতব ধাপে লেগে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে নানান দিকে গেল বুলেট। পরের দুটো ল্যাণ্ডিং পার করে রেইলিং টপকে নিচের গলিতে খসে পড়ল রানা। তীরবেগে চলল রাশ স্ট্রিটের বাতিগুলোর দিকে।
কিন্তু পথরুদ্ধ করে গলির মুখে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে!
সে জিমনেশিয়াম ও ম্যাসেজ পার্লারের রুবা। সামনের রাস্তার আলোয় আগুনের মত দেখাচ্ছে তার মাথার লাল চুল।
‘যাবে কোথায়?’ টিটকারির সুরে বলল যুবতী। ‘পিটিয়ে তোমার হাড়গোড় ভেঙে দেব!’ সামনে বেড়ে মার্শাল আর্টের কঠিন সব কৌশল রানার ওপরে প্রয়োগ করতে চাইল সে।
বাধ্য হয়ে কয়েকবার পেছাল রানা। বেশিরভাগ ওজন উত্তোলনকারী মেয়ের মত ভারী নয় রুবার শরীর। গতি তার বৈশাখী ঝড়ের মত। এদিক-ওদিক সরে ধুপধাপ ঘুষি ও লাথি মারছে। আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ডে বিরক্ত হয়ে গেল রানা। এড়াল পরের ঘুষি। কিন্তু এর পরের ঘুষিটা নিল বামবাহুর ওপরে। একই সঙ্গে সামনে বেড়ে চলে এল রুবার খুব কাছে। যুবতী পরের আক্রমণে যাওয়ার জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই একটু ঝুঁকে গেল রানা, পরক্ষণে প্রায় মাটি থেকে তুলে এনে রুবার থুতনির নিচে ঝেড়ে দিল প্রচণ্ড এক আপারকাট। ওর ঘুষির জোর এতই বেশি, ঝটকা খেয়ে মাটি ছেড়ে তিন ইঞ্চি ভেসে উঠল রুবার দু’পা। উড়ে গিয়ে গলির মুখে ধড়াস করে পড়ল যুবতী। জ্ঞান নেই।
একবার তার নাকের কাছে হাত নিয়ে রানা বুঝল, ভালভাবেই শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। তখনই পেছন থেকে এল একটা গুলি। ওর বামকানের পাশ দিয়ে গেল ওটা। পিস্তল হাতে খড়মড় আওয়াজে ফায়ার এস্কেপ বেয়ে নেমে আসছে রুবার লোকজন। জবাব দেয়ার জন্যে অটোম্যাগ বের করে পর পর তিনবার পাল্টা গুলি পাঠাল রানা।
বদ্ধ গলিতে কামানের শব্দ তুলেছে শক্তিশালী পিস্তল। ফলে মৃত্যুভয় ঢুকে গেল সামনের দুই গুণ্ডার মনে। কড়া ব্ৰেক কষে ঘুরেই দৌড়ে আবার গিয়ে ঢুকল অন্ধকারে। দলের ক’জনের মধ্যে হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ। এদিকে রানার গুলি বুকে নিয়ে ফায়ার এস্কেপের রেইলিং টপকে নিচে পড়েছে একজন। এখন আর একদম নড়ছে না।
গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক ভীষণ পাজি, বুঝে গেছে সিম্পসন ও রুবার দলের গুণ্ডারা। তাই থেমে গেছে তাদের তরফ থেকে গোলাগুলি। ছুটে আসছে না কেউ। গলির ভেতরে কোন হৈ-চৈ নেই।
এ-সুযোগে অচেতন রুবাকে টপকে ফুটপাথে উঠল রানা। গুলির শব্দে এখন সিম্পসনের বারের ধারে-কাছে কেউ নেই। হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে চোরাই গাড়ির দিকে চলল রানা। এক ব্লক পার হওয়ার আগেই বুঝে গেল, সাহস করে পেছনের গলি থেকে বেরোয়নি কেউ।
ফোক্সভাগেন নিয়ে স্বাভাবিক বেগে রওনা হলো রানা। দেখতে পেল ওকে পাশ কাটিয়ে বারের কাছে গিয়ে থামল পুলিশের কয়েকটা ব্রুযার। ঝটপট ওগুলো থেকে নেমে পড়ল অন্তত দশজন অফিসার
এরা মাসুদ রানা নামের এক যুবককে খুঁজছে, যে একের পর এক হামলা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে গোটা শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে। হাতে অস্ত্র বাগিয়ে হুড়মুড় করে সিম্পসনের বার-এ গিয়ে ঢুকল বেশ ক’জন অফিসার।
রাশ স্ট্রিট পেরিয়ে ভাবল রানা, দরকার হলে একটা একটা করে উল্টে দেখবে এ-শহরের প্রতিটা পাথর। আজই দেখা করবে সিনেটর পিটারের সঙ্গে। মাফিয়া ডনের হেলথ সেন্টারে ছিল লোকটার ফেরারি। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, ডন রসির সঙ্গে গভীর কোন সম্পর্ক আছে সিনেটরের। সুতরাং তার কাছ থেকে হয়তো জানা যাবে বহু কিছুই।
এগারো
সিনেটর পিটারের ডিনার পার্টি একটু পর শেষ হবে, এমনসময় ফোর অ্যাণ্ড হাফ স্টার ইন্টারকন্টিনেন্টাল শিকাগো হোটেলের বলরুমে পা রাখল রানা। এদিকে আসার পথে বড় এক মার্কেটে থেমে নামকরা এক পোশাকের দোকান থেকে কিনে নিয়েছে আকাশী রঙের শার্ট, লাল টাই আর দুই পিসের দামি স্যুট। ওভারকোট ও ব্যাটল ড্রেস খুলে গাড়িতে বসে পরে নিয়েছে নতুন পোশাক। এখন বুকের ট্যাগে লেখা: শিকাগো মান্থলি টাইম্স্ ডাইজেস্ট। নিচে ওর নাম: জার্নালিস্ট রুস ওয়ালি। সমাজের উঁচুতলার মানুষের অনুষ্ঠানে পাহারায় থাকবে পুলিশ ও প্রাইভেট সিকিউরিটির লোক, তাই তাদের হাতে যাতে ধরা না পড়ে, সেজন্যে গাড়িতে রেখে এসেছে অটোম্যাগ। অবশ্য বেরেটা আছে কাঁধের হোলস্টারে।
দামি ডেয়ার্ট শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছেন নিমন্ত্রিত অতিথিরা। বিশাল বলরুমের একদিকে উঁচু মঞ্চের কাছে ভিড় করেছে কয়েকটি টিভি কোম্পানি আর দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকেরা। ভিডিয়ো ক্যামেরা আর সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে তোলা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ছবি। এই অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হচ্ছে ইলিনয় রাজ্য জুড়ে।
টেবিলে যারা বসে আছেন, তাঁদের বেশিরভাগের পরনে দামি টুক্সেডো। আজ বিশেষ এ-রাতে মহিলাদের পরনে দুর্মূল্য ইভিনিং গাউন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝিলিকে দশগুণ রশ্মি ছড়াচ্ছে তাদের হীরার অলঙ্কার। ঘরে চোখ বুলিয়ে রানা বুঝে গেল, এখানে এমন কোন অতিথি নেই, যার বার্ষিক আয় বিশ লাখ ডলারের নিচে।
বলরুমের পেছন-সারিতে গিয়ে থামল রানা। এখানে জড় হয়েছে কিছু সাংবাদিক। তাদের গায়ে বড়লোকদের মত দামি পোশাক নেই।
সামনের টেবিলে বসেছে সিনেটর জাস্টিন পিটার। ওটা অন্য টেবিলের চেয়ে সামান্য উঁচু। নানানদিক থেকে তার ছবি তুলছে একদল ক্যামেরাম্যান। সিনেটরের সঙ্গে আছে তার দলের শিকাগো শহর ও ইলিনয় রাজ্যের রাজনৈতিক সব ব্যক্তিত্ব।
মন দিয়ে জাস্টিন পিটারকে দেখছে রানা। সত্যিই দুর্দান্ত সুপুরুষ লোক সিনেটর। একটু চিকন হলেও দীর্ঘদেহী। কপালের ওপরদিক ঢেকে রেখেছে ধূসর চুল দিয়ে। মুখে মৃদু হাসি। তার পাশেই ন্যাড়া মাথার বয়স্ক এক লোক। দুই কানের ওপরে দু’গোছা বালিরঙের চুল। চোখে ভারী কাঁচের দামি চশমা। মণিদুটো হালকা নীল। মুখে প্রশান্তিময় হাসি। যে-কারও মনে হবে, ইনি কারও না কারও প্রিয় একজন চাচা।
সাংবাদিকদের পাশ থেকে রানা দেখল, হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল বয়স্ক এক রাজনীতিবিদ। হাতের গ্লাসে চামচ দিয়ে ঠুং-ঠুং শব্দ তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। ‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আপনাদের জন্যে এবার দু’চার কথা বলবেন আমাদের সিনেটর জাস্টিন পিটার।’
কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখছে কয়েকজন সাংবাদিক। ওকে চিনতে না পেরে পরস্পরের দিকে তাকাল তারা। অবশ্য কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। সিনেটর পিটার উঠে দাঁড়াতেই তার বক্তৃতা নোট করার জন্যে কোট থেকে প্যাড ও কলম নিল রানা।
‘আজ শুধু এটাই বলব, আপনাদের সঙ্গে এখানে দেখা হলো বলে আমি খুব আনন্দিত,’ মসৃণ কণ্ঠে জানাল সিনেটর। ‘আপনারা এসেছেন নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে। আপনারা আপনাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গরিব শিশুদের দিকে। এটা সত্যিই খুব বড় একটি বিষয়। আপনারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফুলের মত কোমল হৃদয়ের শিশুদের জন্যে আপনাদের মনে রয়েছে অশেষ ভালবাসা।’
কিডন্যাপড্ শিশুদের কথা ভেবে দৃঢ়বদ্ধ হলো রানার চোয়াল। এদিকে গড়গড় করে বলে চলেছে সিনেটর পিটার, ‘আপনারা ভাল করেই জানেন, দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ আজ হয়ে গেছে অন্তরহীন বিবেকশূন্য সব যান্ত্রিক রোবট। চারপাশে চলেছে পর্নোগ্রাফি, নানান অপরাধ আর খুনোখুনির ভয়ঙ্কর এক জোয়ার। তবুও আমরা যারা এখনও মানুষের মত করে ভাবতে চাই, অবশ্যই তাদের এক হয়ে গড়তে হবে প্রতিরোধ। আজ আপনারা খুবই ভাল একটি কাজের জন্যে লাখ লাখ ডলার দান করেছেন। আর এই টাকায় শত শত এতিম বাচ্চাকে আমরা মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারব। আর আমরা যদি সেটা না-ও পারি, অন্তত নিজেদের অন্তরের কাছে সবসময় পরিষ্কার থাকতে পারব।’
সিনেটরের কথা শুনে হাততালি দিল অতিথিরা । জাস্টিন পিটারের দিকে চেয়ে আছে রানা।
বলরুমে নীরবতা নেমে আসতেই বলল সিনেটর, ‘আমরা এরই ভেতরে এ-শহরের শিশুদের খেলার জন্যে তৈরি করছি একাধিক বিনোদন পার্ক। আর তাতে ভবিষ্যতে শিশুদের আর কখনও রাস্তায় গাড়ির ভিড়ভাট্টার ভেতরে ঝুঁকি নিয়ে খেলতে হবে না। ওরা থাকবে নিরাপদে। আর দুরূহ এই কাজটি যিনি করে দিচ্ছেন, সেই ভদ্রলোক আজ আমাদের এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন।’
একটু দূরে বসে থাকা টাকমাথা লোকটাকে ঘাড় কাত করে দেখাল জাস্টিন পিটার।
‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আসুন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক জন ওয়েস্টনের জন্যে একবার হলেও আমরা হাততালি দিই। তিনি শিকাগো শহরের শিশুদের জন্যে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। …মিস্টার জন ওয়েস্টন, আপনি কি দয়া করে একবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবেন?’
ধীরে ধীরে চেয়ার ছাড়ল লাজুক মানুষটা। এত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বিব্রত বোধ করছে। তার জন্যে বজ্রপাতের মত আওয়াজে হাততালি দিল শত শত মানুষ।
‘দয়া করে আমার পাশে আসুন, স্যর,’ বলল সিনেটর। ‘প্লিয, আমাদের জন্যে দু’চার কথা বলুন।’
সিনেটরের পাশে থেমে কোটের পকেট থেকে ছোট একটা কাগজ নিল জন ওয়েস্টন। পডিয়ামের একপাশে সরে গেল জাস্টিন পিটার। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলল মিস্টার ওয়েস্টন, ‘আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো বলে আমি খুশি। আমি তো আসলে ভাল করে কথা গুছিয়ে বলতে পারি না, তাই বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু এটা বলব, আমাদের প্রিয় সিনেটরের কাছে আমার তরফ থেকে এই চেকটা দিচ্ছি।’
হাত বাড়িয়ে চেক নিল সিনেটর পিটার। টাকার অঙ্কের পরিমাণ দেখে বিস্ফারিত হলো তার দুই চোখ।
‘আমরা শিশুদের জন্যে যেসব প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, সেজন্যে মিস্টার ওয়েস্টন দিয়েছেন পুরো বিশ লাখ ডলার!’
হাততালির প্রচণ্ড আওয়াজে যেন ভেঙে পড়ল বলরুম। হাত বাড়িয়ে জন ওয়েস্টনের সঙ্গে করমর্দন করল সিনেটর পিটার। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে চারপাশ।
‘আমি কি তবে বেশি কম দিয়ে ফেলেছি?’ লজ্জা পেয়ে বলল জন ওয়েস্টন।
‘দুনিয়ার কেউ এ-কথা বলতে পারবে না, স্যর,’ আন্তরিক হাসল সিনেটর। ‘আমাদের তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার ওয়েস্টন!’
পডিয়াম থেকে নেমে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল মানুষটা।
‘বলুন তো, কে এই জন ওয়েস্টন?’ পাশের সাংবাদিকের কাছে জানতে চাইল রানা।
ওর কথা শুনে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল রিপোর্টার। ‘বলুন তো দেখি আপনি কোথা থেকে উদয় হয়েছেন? উনি জন ওয়েস্টন! মস্তবড় ব্যবসায়ী! এ-রাজ্যের হাজার হাজার গরিব মানুষের জন্যে কী-ই-না করেছেন? অন্তত বিশটা এতিমখানা চালান। নিজে থেকে দিয়ে দেন এতিমদের স্কুল-কলেজের সমস্ত খরচ। অবশ্য তিনি বড় বেশি একাকী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে দেখেননি। তাঁর স্ত্রী হওয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে শিকাগো শহরের দারুণ রূপসী সব মেয়ে।’
রানাকে আরেকবার তাচ্ছিল্য-ভরা চোখে দেখে নিয়ে পডিয়ামের দিকে মনোযোগ দিল সাংবাদিক।
সত্যিই হয়তো সমাজ-কল্যাণে কাজ করে চলেছে জন ওয়েস্টন, ভাবল রানা। সে যে অত্যন্ত বিনয়ী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। লাজুক মুখে চুপচাপ বসে আছে নিজের চেয়ারে।
পরবর্তী পনেরো মিনিট টানা বক্তৃতা দিল সিনেটর পিটার, তারপর প্রবল হাততালির মাধ্যমে শেষ হলো তার কথা।
ভদ্রলোক পডিয়াম থেকে নেমে পড়তেই ভিড়ের ভেতর দিয়ে তার দিকে এগোল রানা।
এটা রাজনৈতিক মিটিং নয়, তাই বলরুমের সিকিউরিটি বেশ শিথিল। বেরোবার দরজাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাড়া করা কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী
জাস্টিন পিটারের কাছে পৌঁছে গেল রানা। দেখা করতে আসা লোকগুলোর সঙ্গে একে একে হাত মেলাচ্ছে সিনেটর। তাদের পেছনেই থাকল রানা। ভিড় কমে গেলে কয়েক পা সামনে বেড়ে বলল, ‘মাফ করবেন, সিনেটর, আমি কি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? বড়জোর পাঁচ মিনিট নেব, স্যর।’
সিনেটর পিটার ধরে নিয়েছে রানা একজন সাংবাদিক। নরম সুরে বলল সে, ‘দুঃখিত, ইন্টারভিউ নিতে হলে আগামীকাল সকালে আমার প্রেস এইডের অফিসে যোগাযোগ করুন।’
‘আমার মনে হয় না অত সময় অপেক্ষা করতে পারব, মিস্টার সিনেটর,’ বলল রানা। ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই অ্যালডো রসির বিষয়ে।
ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকাল জাস্টিন পিটার। ‘বলুন তো, আপনি আসলে কে?’
‘মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নেব আপনার কাছ থেকে, স্যর, ‘ বলল রানা।
এবার . বহুবার প্র্যাকটিস করা হাসি উপহার দিল সিনেটর। ‘অসুবিধে কী? চলুন, আলাপ সেরে নিই।’ আশপাশে যারা আছে, তাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাকে একটু মাফ করবেন। একটু পর ফিরব। প্রেস যখন বিনে পয়সায় প্রচারে সাহায্য করছে, তো মানা করি কী করে!’
জবাবে মুচকি হাসল কয়েকজন ভদ্রলোক।
বলরুমের পেছন-দরজার দিকে রানা পা বাড়াতেই ওর পাশে হাঁটতে লাগল সিনেটর। বরাবরের মতই মুখে ধরে রেখেছে মৃদু হাসি। যদিও রানা দেখল তার কপালে ফুটেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।
‘আশা করি জরুরি কোন কথা বলবেন,’ নিচু গলায় বলল সিনেটর। ‘সময় নষ্ট করতে চাই না। আরেকটা কথা, অ্যালডো রসি সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না।
বলরুমের পেছন-দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন ভদ্রলোক। তাদের কাছে পৌঁছুবার আগেই বলল রানা, ‘ফালতু কথা বাদ দিন। মুখে হাসি ধরে রাখুন। আপনি নিশ্চয়ই চান না লাখ লাখ ভোটার হারাতে, সিনেটর?’
পলকের জন্যে রাগী চোখে ওকে দেখল জাস্টিন পিটার। হাসি-হাসি মুখে ভদ্রলোকদের মাঝ দিয়ে হেঁটে পেরিয়ে গেল পেছনের দরজা। সামনে খাটো করিডর গিয়ে মিলেছে একটা ডাবল সুইং-ডোরে। ওপাশে হোটেলের কিচেন থেকে আসছে প্লেট ও চামচের টুং-টাং শব্দ।
করিডরের মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে রানার দিকে তাকাল সিনেটর। চোখে-মুখে বিরক্তি। ‘এবার বলুন কী বলবেন? আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।’
‘আপনি হয়তো জানেন, অ্যালডো রসির হেলথ সেন্টারে গোলাগুলি হয়েছে। সিনেটর…’
‘হ্যাঁ, এটা জানি যে ওটা একটা হেলথ ক্লাব, রানার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে জাস্টিন পিটারের মুখ।
‘ওটার মালিক কি অ্যালডো রসি?’
‘তা-ই তো জানি।’ মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘কিন্তু গোলাগুলির সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আপনি আসলে কী বলতে চান?’
‘আপনি অনায়াসে হেসে হেসে মিথ্যা বলেন, সিনেটর, তা-ই না? পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনাকে বলা হয়নি যে ওখানে ছিল আপনার ফেরারি গাড়ি? পুলিশ আসার আগে আমি নিজেই তখন ওখানে ছিলাম।’
চোখ সরু করল সিনেটর পিটার। ‘তার মানে আপনি সাংবাদিক নন? তা হলে আপনি আসলে কে?’
‘আপনিই বরং বলুন আমি কে?’ কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। হাতে বেরিয়ে এসেছে বেরেটা।
আগ্নেয়াস্ত্র দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সিনেটরের মুখ। ‘আপনি কে সেটা তো আমার জানার কথা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি সেই হেলথ ক্লাবের সদস্য। মিস্টার রসি ওটা কিনে নেয়ার পর থেকে সেখানে শরীরচর্চা করি। ব্যস, এটুকু সম্পর্ক আছে মিস্টার রসির সঙ্গে আমার। আইন মেনে ক্লাব করেছে সে। তাতে কোন দোষ তো দেখি না। কাজেই ওখানে আমার ফেরারি গাড়ি থাকলেও সেটা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করা উচিত নয় আপনার।’
বামহাতে সিনেটরের ডানকবজি ধরল রানা। মুঠোর ভেতরে গুঁজে দিল কী যেন।
ভিযিটিং কার্ডটা পড়ে নিয়ে একবার ঢোক গিলে রানাকে দেখল সিনেটর। ‘আপনিই তা হলে রানা এজেন্সির চিফ? আগেও অনেকের মুখে আপনার কথা শুনেছি। পুলিশ ধারণা করছে যে আপনিই হামলা করেছেন হেলথ সেন্টারে।’
‘আমি এটা জানি, আপনি আছেন রসির পকেটে,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘এবার বলুন, আমি সন্ধ্যায় ওখানে যাওয়ার আগে আজ অ্যালডোর সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলেন? পরে আপনাকে এই হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে সে।’
‘আমি তার ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানি না, মিস্টার রানা, সামান্য কেঁপে গেল রাজনীতিকের গলা।’
‘তো বলতে চাইছেন আপনি শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত নন?’
মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘ওটা তো ভয়ঙ্কর ঘৃণ্য অপরাধ!’
‘কিন্তু কোন না কোন অপরাধ করে ধরা পড়েছিলেন আপনি। আর সেজন্যে আপনাকে চলে যেতে হয়েছে রসির পকেটে। বলুন, শুনি কী ছিল সেই অপরাধ?’
চুপ করে আছে জাস্টিন পিটার।
‘রসির জন্যে ওয়াশিংটনে লবিং করেন কেন? স্রেফ টাকার জন্যে?’
এবারও জবাব দিল না লোকটা।
‘আপনার মত রাজনৈতিক নেতাদেরকে কিনে নিচ্ছে সে। তার চাই আরও ক্ষমতা। আর সেটা যেন পায়, সেজন্যে তার হয়ে কাজ করছেন আপনারা। কিন্তু সেটা কেন করছেন?’
জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল সিনেটর পিটার। ‘কয়েকবার রসির বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ এলে আমি শুধু অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। আর কিছুই করিনি।’
‘নিজের ভোটারদেরকে ঠকিয়ে দিয়েছেন,’ বলল রানা। ‘আর সেটা বড় ধরনের অপরাধ।’
রানার চোখে ঝড় দেখে আরেকবার ঢোক গিলল জাস্টিন পিটার। তার বুকের দিকে চেয়ে আছে বেরেটার মাযল।
‘আপনি কি আমাকে খুন করবেন? প্লিয! আমি তো কোন দোষ করিনি! রসির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই!’
‘মিথ্যা বলবেন না!’ চাপা স্বরে বলল রানা। ‘রসির বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ না পেলে এখানেই হয়তো আপনাকে খতম করব।’
টুং-টাং শব্দ হোটেলের কিচেনে। বলরুমে মানুষের চাপা গুঞ্জন। বেঁটে করিডরে পা রাখেনি অন্য কেউ। তবে রানা বুঝে গেল, যে-কোন সময়ে সিনেটরকে খুঁজতে এদিকে চলে আসবে কেউ না কেউ। সুতরাং বেশিক্ষণ সময় পাচ্ছে না ও।
‘আমার কানে এসেছে কিছু গুজব,’ থমকে থমকে বলল সিনেটর পিটার। ‘সেসব সত্যি কি না সেটা জানি না।’
‘আপনি যা জানেন সেটা বলুন।’
‘ঠিক আছে, বলছি। ইয়ে… শুনেছি রসির মাফিয়া দলের প্রধান আসলে সে নিজে নয়। দলটা চালায় তার বড়বোন এলিসা রসি। আপনি তো জানেন, গুণ্ডারা কোন মেয়ের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে চায় না। তাই অ্যালডো রসিকে সামনে রেখে দল চালায় সেই মহিলা।’
‘অ্যালডো রসির ব্যাপারে আর কী জানেন?’
‘জীবনে মাত্র দুয়েকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে ফোনে বড়জোর তিনবার।’
লোকটা মিথ্যা বলছে কি না সেটা জানার উপায় নেই, ভাবল রানা। সত্যিই হয়তো রসির মাফিয়া দলের চালিকা- শক্তি এলিসা রসি। তা হতেই পারে। তবে তাতে কিছুই বদলে যাচ্ছে না। জানা সম্ভব হচ্ছে না কোথায় লুকিয়ে পড়েছে অ্যালডো রসি। স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের বদলাও নেয়া যাচ্ছে না। আর শিশুদের কিডন্যাপ করাও ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওর চারপাশে আসলে আছে এখন একরাশ ছেঁড়া সুতো।
বলরুমের দরজা বারবার দেখছে সিনেটর। পিস্তল হাতে ডাকাতের মত লোকটা তাকে খুন করবে কি না, সেটা নিয়ে ভয়ে আছে সে।
‘এবার কি আমি যেতে পারি?’ নরম স্বরে জানতে চাইল সিনেটর, ‘আমার তো আর কিছু জানা নেই।’
খর চোখে তাকে দেখল রানা। ‘যেতে পারেন। তবে আপনার ব্যাপারে আমি পরে খোঁজ নেব।’
বড় করে শ্বাস ফেলল সিনেটর। ‘কী বিষয়ে খোঁজ নেবেন, মিস্টার রানা?’
‘আজ বলরুমে যা বললেন, সেটা সত্যি কি না সেটা জেনে নেব,’ বলল রানা। ‘এটাও জানব যে আপনি শিশুদের জন্যে কাজ করেন, নাকি করেন না। পরে যদি দেখি যে একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছেন, তো আরেকবার দেখা করব আপনার সঙ্গে। আর সে-সময় আপনি প্রাণে বাঁচবেন না।’
‘আমি তো কখনও মিথ্যা কথা বলি না,’ কাঁপল সিনেটরের গলা।
‘আমি হোটেল থেকে বেরোবার আগে কোন ঝামেলা করবেন না। নইলে খুন হবেন আমার হাতে।’
‘কাউকে কিছু জানাব না,’ ফিসফিস করল সিনেটর।
হোলস্টারে বেরেটা রেখে আতঙ্কিত লোকটাকে পেছনে ফেলে দৃঢ়পায়ে বলরুমে গিয়ে ঢুকল রানা।
বারো
সারা জীবনে যত পাপ করেছে, মাসুদ রানার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সবই মনে পড়েছে জাস্টিন পিটারের। গরম হয়ে গেছে কানের লতি। শুকিয়ে গেছে গলা। ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। মাথা নিচু করে মেঝের দিকে চেয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে দেখল করিডরে সে ছাড়া আর কেউ নেই। নীরবে বিদায় নিয়েছে যমদূতের মত লোকটা।
এবার কী করা উচিত, ভাবতে চাইল সিনেটর পিটার। কোট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে মুছে নিল ঘর্মাক্ত মুখ। মনে মনে বলল, আর কখনও মুখোমুখি হতে চাই না তার।
হঠাৎ করে খুলে গেল বলরুমের দরজা। আরেকটু হলে ভয়ে লাফিয়ে উঠল সিনেটর। চট করে ওদিকে তাকাল।
‘এই যে, মিস্টার সিনেটর, আপনি তা হলে এখানে? ভাবছিলাম হঠাৎ কোথায় গেলেন। ধীরপায়ে সিনেটরের দিকে এল জন ওয়েস্টন।
লালচে হয়ে গেছে সিনেটর পিটারের মুখ।
‘হায়, ঈশ্বর! আপনার আসলে কী হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ওয়েস্টন। ‘আমার তো মনে হচ্ছে যে আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। আমি কি ডাক্তার ডেকে আনব?’
হাত বাড়িয়ে মুঠোয় রাখা কার্ড দেখাল সিনেটর। শুকনো গলায় বলল, ‘মাসুদ রানা এসেছিল।
পুরু কাঁচের ওদিকে বিস্ফারিত হলো ওয়েস্টনের চোখ। নিচু গলায় বলল সে, ‘আপনার ব্যাপারে সব জেনে গেছে?’
মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘তবে সন্দেহ করছে।’
‘আর আমার ব্যাপারে?’
‘কিছু বলেনি।’
ঠোঁট মুচড়ে ফেলল জন ওয়েস্টন। ‘কু ডাকছে আমার মন। আপনি আসলে তাকে কী বলেছেন?’
‘তেমন কিছুই না,’ ঢোক গিলল সিনেটর পিটার। ‘তবে লোকটা ভয়ঙ্কর। বারবার মনে হয়েছে সবই জানে সে।’
ওয়েস্টন দ্রুত ভাবছে, সেটার ছাপ পড়েছে তার মুখে। ‘মাসুদ রানা অতি চালাক লোক। আমরা এরই ভেতরে সেটা জেনেছি। তবে আসলে তেমন কিছুই জানে না। এখানে এসে আপনার কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করেছে। তবে তাতে কোন লাভ হবে না। আপনি তো কিছু বলেননি, তা-ই না?’
মাথা নাড়ল সিনেটর পিটার।
‘তবু ঝামেলা আরও করার আগেই তাকে সরিয়ে দেব, ‘ সহজ সুরে বলল ওয়েস্টন।
‘কী করতে চান?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল পিটার। ‘সে কিন্তু খুব বিপজ্জনক।’ ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিতে চাইছে সব দায়িত্ব।
‘কতক্ষণ আগে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে সে?
‘একমিনিট হবে। করিডরে আসার সময় আপনার সঙ্গে হয়তো দেখাও হয়েছে। ভান করছে সে একজন সাংবাদিক।’
কী যেন ভেবে নিয়ে বলল ওয়েস্টন, ‘আমি হোটেলের সিকিউরিটিকে বলছি, অচেনা এক লোক ঢুকেছে বলরুমে। সিনেটরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে টাকা-পয়সা। ওদিকে আমাদের লোকেদের জানাব, এখানে ঘুরঘুর করছে মাসুদ রানা।
‘মাফিয়ার লোক কি এই হোটেলে আছে?’
‘অবশ্যই। ওদের ছাড়া হোটেলে পা রাখতাম? আমার মত বড় ব্যবসায়ী এমন ঝুঁকি নেয় নাকি?’
‘অ্যালডো রসির ব্যাপারে কী করবেন?’
‘সেটা পরে দেখব। অত ভাববেন না। শিকাগো থেকে প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারবে না মাসুদ রানা।’
অস্বস্তি নিয়ে মাথা দোলাল সিনেটর পিটার। এখনও ভয় লাগছে তার, যে-কোন সময়ে হাজির হবে মাসুদ রানা। আর, তখন গুলি করে ঝাঁঝরা করবে ওয়েস্টন আর তাকে।
‘আশা করি যা করার ভেবেচিন্তে করবেন,’ মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল সিনেটর।
মৃদু হাসল ওয়েস্টন। এক পলকে হয়ে গেছে জন মানুষ। ‘ঠিক আছে, সিনেটর, এবার আমাকে নিজের কাজে যেতে হবে। আমারই তৈরি এক এতিমখানায় যাওয়া জরুরি। আগামীকাল ওখানে ভলিবল ফাইনাল। বাচ্চাদের মন তো আর ভেঙে দিতে পারি না।’
সিনেটর কিছু বলার আগেই ঘুরে বলরুমের দিকে চলল ওয়েস্টন। পেছন থেকে তার দিকে চেয়ে রইল জাস্টিন পিটার। ভাবছে: ইঁদুরের মত খুদে এক লোক কী করে এত হারামি হয়? বাচ্চাদের নিয়ে যে কুকীর্তি করে চলেছে, সেটা আসলেই অকল্পনীয়। নিজে এসবে জড়িয়ে গেছে বলে মনে মনে ভাগ্যকে গালি দিল সিনেটর। ভাল করেই বুঝতে পারছে, একবার সব জেনে গেলে তাকে আর প্রাণে বাঁচতে দেবে না মাসুদ রানা।
.
বলরুমের মেইন ডোর পেরিয়ে করিডর ধরে হোটেলের লবির দিকে চলেছে রানা। দু’পাশে ছোট কিছু মিটিং রুম। ওগুলো পেছনে ফেলে কারুকাজ করা বিলাসবহুল বিশাল লবিতে এসে ঢুকল রানা। মস্ত এই ঘরের সিলিং তিনতলা উঁচু। কয়েকতলা বারান্দার একদিকে কাঁচের তৈরি দেয়াল। ওদিক দিয়ে উঠছে- নামছে একাধিক এলিভেটর। লবির মাঝে প্রকাণ্ড ফোয়ারা। এলিভেটরের উল্টোদিকে দীর্ঘ কাউন্টারে অতিথিদের চেক-ইন আর চেক-আউটের জন্যে বসে আছে কয়েকজন ক্লার্ক।
কাউন্টারের শেষমাথায় সিকিউরিটি অফিস।
ফোয়ারের কাছে যেতেই সিকিউরিটি অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সুঠামদেহের তিনজন লোককে বেরোতে দেখল রানা। তাদের একজনের পরনে স্যুট, অন্যদের গায়ে রেন্ট- এ-কপ ইউনিফর্ম। লবির এদিকে-ওদিকে দেখছে তারা।
রানা বুঝে গেল, ওকেই খুঁজছে এরা।
অতিথিদের চেক-ইন আর চেক-আউটের জন্যে বেশ ব্যস্ত লবি। তার ওপরে ফাও রেইয়িং ডিনারের অতিথিরাও অনেকে চলে এসেছে এদিকে। কোথাও না থেমে ফোয়ারা ঘুরে সোজা সিঁড়ির দিকে চলল রানা। আকাশ-ছোঁয়া উঁচু সর হোটেলে সিঁড়িতে কখনও ভিড় থাকে না, তাই নিচের বেসমেন্টের গ্যারাজে নেমে যেতে পারবে বলে ভাবছে রানা। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে সদর রাস্তায় গিয়ে উঠবে। আবার এসে ঢুকবে হোটেলের পার্কিংলটে, গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে যাবে।
সিনেটর পিটারকে সৎ লোক বলে মনে হয়নি ওর। একই কথা খাটে পিট ব্ল্যাকের ব্যাপারে। এদের ব্যাপারে কি আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল, নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। মন থেকে কোন জবাব পেল না।
স্টেয়ারওয়েলের দরজায় পৌঁছে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। বুঝে গেল, ওকে দেখতে পায়নি সিকিউরিটির লোক। সুইং ডোর খুলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল আণ্ডারগ্রাউণ্ড গ্যারাজের দিকে। কিন্তু নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দু’জন লোক, পরনে হোটেল সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক। বোধহয় চলেছে লবিতে। উৎকণ্ঠার ছাপ তাদের চেহারায়। হোলস্টারে রাখা পিস্তলের বাঁটের কাছে ঝুলছে ডানহাত। চারপাশে তাকাচ্ছে সন্দেহ নিয়ে।
‘এদিকে কী হয়েছে?’ নিরীহ সুরে জানতে চাইল রানা। ‘হোটেলে ডাকাত পড়েছে?’
‘আর এক পা-ও নড়বেন না, ওখানেই দাঁড়ান!’ ওকে নেমে আসতে দেখে বলল বামের সিকিউরিটি গার্ড। ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে সিনেটরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনতাই করতে চেয়েছে এক লোক। আর যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সেটা পুরো মিলে যাচ্ছে আপনার সঙ্গে!’
দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়ল রানা। ‘সরি, আপনারা কী বলছেন সেটা বুঝলাম না। মিটিং করব বলে তাড়া আছে। আপনারা অন্য কাউকে খুঁজছেন।’
আবারও সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা।
হাতের ইশারায় ওকে থামতে বলল ডানের সিকিউরিটি গার্ড। ‘আপনি আপাতত কোথাও যাচ্ছেন না। আমাদের আগে জানতে হবে আপনি সেই ছিনতাইকারী কি না। আমাদের সঙ্গে সিকিউরিটি অফিসে আসুন। তারপর দেখব কে আসলে কী।’ কথা শেষ করেই কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে গেল সে।
‘গার্ডস্, আপনাদের বড় কোন ভুল হচ্ছে,’ দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে বলল রানা। পরক্ষণে সাঁই করে কাছের লোকটার ঘাড়ে নামল ওর ডানহাতের তালুর একপাশ।
ব্যথায় কাতরে উঠে হাঁটু গেড়ে সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল লোকটা। অবশ্য হ্যাঁচকা টানে বের করেছে হোলস্টার থেকে পিস্তল। রানার জোর লাথি খেয়ে লোকটার হাত থেকে উড়ে গেল অস্ত্র। ঠং-ঠনাৎ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল বেসমেন্টে ওদিকে ঘুরেই দ্বিতীয় গার্ডের কোমরে কষে একটা লাথি বসিয়ে দিয়েছে রানা। হোঁচট খেয়ে সঙ্গীর ওপরে পড়ল সিকিউরিটি গার্ড। সিঁড়ির ধাপে গড়াতে শুরু করে নিচের গ্যারাজের মেঝেতে গিয়ে থামল ‘দু’জনের দেহ। রানার মনে হলো, এবার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াবে লোকগুলো। সুতরাং ওর আর উপায় নেই যে বেসমেন্ট দিয়ে বেরোবে।
ল্যাণ্ডিঙে থেমে সামনের করিডর ধরে তীরবেগে ছুট দিল রানা। করিডরের শেষমাথায় ধাতব বন্ধ দরজা। হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বুঝতে পারল যে ওটা তালা বদ্ধ নয়। ধীরে ধীরে কবাট সামান্য খুলল রানা। ওদিকের ঘর হোটেলের কিচেনের গুদাম। দেয়ালের পাশের র্যাকে খাবারের ভারী কন্টেইনার। ঘরের অন্যদিকে বিশাল এক দরজা। ওপাশে বোধহয় কিচেন। আপাতত কেউ নেই গুদামঘরে।
দরজা পার হয়ে গুদামের শেষমাথায় চলে এল রানা। নির্বিকার চেহারায় দরজা খুলে ঢুকে পড়ল বিশাল কিচেনের ভেতরে। না থেমে হনহন করে হেঁটে চলল অন্যদিকের দরজা লক্ষ্য করে। কিচেনে ব্যস্ত চারজন বাবুর্চি। অবশ্য কারও মাথায় শেফের টুপি নেই। সবার পরনে সাদা পোশাক। একজনের হাতে ভয়ঙ্কর চেহারার এক কাটারী।
পাশ কাটাবার আগে বাবুর্চিদের দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসি দিল রানা। ‘হেলথ ইন্সপেকশন। তোমরা কাজ করো। ভয়ের কিছু নেই।’
কয়েক পা সরে রানার পথরুদ্ধ করল কাটারী হাতে বাবুর্চি। ‘এসব চাপা মেরে কোন লাভ হবে না। মাঝরাতে আবার কীসের হেলথ ইন্সপেকশন? তেড়িবেড়ি না করে বলে ফেলো কেন কিচেনে এসে ঢুকেছ!’
‘শর্টকাট নেয়ার জন্যে কিচেনটা ব্যবহার করছি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। চেহারায় এখন হাসি-হাসি ভাবটা নেই। ‘নিজের ভাল চাইলে পথ ছেড়ে দাও।’
ওর কথায় রেগে গিয়ে চোখ গরম করল রাঁধুনি। ‘তুমি হচ্ছ সে-লোক, যাকে খুঁজছে সিকিউরিটির সবাই!’ এক সহকর্মীর দিকে তাকাল সে। ‘সিকিউরিটির লোক ডাকো তো, ন্যাব! আমি ততক্ষণ একে আটকে রাখছি!’ কাটারী নাচিয়ে রানার দিকে তাকাল সে। ‘খবরদার! আর এক পা-ও নড়বে না!’
‘ও, তুমি ঝামেলা করতে চাও?’ অর্ধেক ঘুরে কাঁধ ঝাঁকাল রানা, পরক্ষণে বাবুর্চি কিছু বোঝার আগেই তার কাটারীর ওপর দিয়ে গেল ওর ডানহাতের মুঠো।
নাকে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে পিছিয়ে চকচকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল রাঁধুনি। হাত থেকে খসে গেছে কাটারী। ঝনঝন শব্দে দূরে সরে গেল ওটা।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল অন্য বাবুর্চিরা। কারও মনে সন্দেহ নেই, এই খুনি লোকটা এসেছে স্রেফ নরক থেকে!
কিচেন থেকে বেরোবার প্রধান দরজার দিকে চলল রানা, জানে না ওদিকে কী আছে। চওড়া কবাট খুলে সামনে দেখতে পেল আবছা আলোর এক করিডর। একবার পেছনে তাকাল রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, কিচেনের রাঁধুনিরা এখন হন্যে হয়ে ডাকছে সিকিউরিটির লোক। এদিকে নিশ্চয়ই সিঁড়ি থেকে গ্যারাজে পড়া সিকিউরিটির দুই লোক সামলে নিয়েছে নিজেদেরকে। লবিতে বোধহয় ওকে খুঁজছে তাদের দলের অন্যরা। কাজেই ওর হাতে বাড়তি এক সেকেণ্ডও নেই!
করিডর শেষ হলো সরু এক গলিতে। ওটার একদিকের দেয়ালের পাশে বড় দুটো গার্বেজ ক্যান। আপাতত কেউ নেই এদিকে। গলির দু’দিকে সরকারি রাস্তা। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে একের পর এক গাড়ি।
হঠাৎ করেই গলিতে ঢুকে সরাসরি রানার দিকে এল একটা গাড়ি। চালক বোধহয় চাপা দিতে চাইছে ওকে!
হেডলাইটের জোর আলোয় দিন হয়ে গেছে গলির ভেতরে। হোলস্টার থেকে নিয়ে উইণ্ডশিল্ড লক্ষ্য করে বেরেটা তাক করল রানা। অবশ্য গুলি করার আগেই কড়া ব্রেক কষে রাবার পুড়িয়ে ওর পাঁচ ফুট দূরে থামল গাড়িটা। ঝট করে খুলে গেল ড্রাইভিং দরজা। কে যেন বলে উঠল, ‘রানা! জলদি! গাড়িতে ওঠো!’
তেরো
‘রানা, কুইক!’ আবারও গাড়ি থেকে এল নারীকণ্ঠ।
লিউনা গার্ডনার!
কেন যেন রানার মনে হয়েছিল, আবারও মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবে। দ্রুত পায়ে টয়োটা করোলা গাড়ির ড্রাইভিং দরজার পাশে চলে গেল ও। ‘তুমি পাশের সিটে সরে বোসো।’
এক সেকেণ্ডের জন্যে ওর মনে হলো, প্রতিবাদ করবে লিউনা। কিন্তু সেটা না করে গাড়ির কন্ট্রোল কন্সোল পার হয়ে চলে গেল প্যাসেঞ্জার সিটে। চট্ করে ড্রাইভিং সিটে উঠে ধুপ শব্দে দরজা আটকে নিল রানা। গিয়ার ফেলে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরল অ্যাক্সেলারেটর। চাকা পিছলে তীরবেগে ছুটল গাড়িটা। গার্বেজ ক্যান পেছনে ফেলে চলে এল গলির মুখে। চলমান গাড়ির স্রোতে ফাঁকা এক জায়গা দেখে সেখানে ঢুকে পড়ল রানা। ব্রেক করতে হয়েছে বলে হর্ন দিল পেছনের গাড়ির বিরক্ত ড্রাইভার।
ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের আবছা আলোয় লিউনা গার্ডনারের দিকে তাকাল রানা। গম্ভীর মুখে বসে আছে মেয়েটা। ‘তুমি জানলে কী করে যে আমি হোটেলে আছি?’ জানতে চাইল রানা।
‘তোমার জন্যে ওখানে যাইনি। তবে ফোক্সভাগেন গাড়ি নিয়ে তোমাকে হোটেলের পার্কিংলটে ঢুকতে দেখেছি। আগে থেকেই চোখ রেখেছি চ্যারিটি ডিনারের আয়োজক সিনেটর পিটার আর আরেকজনের ওপরে।’
‘আবারও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে, লিউনা,’ মৃদু হাসল রানা।
‘আজই আমার প্রাণরক্ষা করেছ। সে ঋণ শোধ করে দিতে পেরে আমারও ভাল লাগছে।’ রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল মেয়েটা। ‘দেখলাম তুমি গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকলে। পরে বলরুম থেকে বেরিয়ে দেখি তোমার গাড়ির দরজার লক খোলা। আর তখনই প্রথম টের পেলাম, তোমাকে খুঁজতে শুরু করেছে হোটেলের সিকিউরিটির লোকেরা। তাই দেরি না করে ফোক্সভাগেন থেকে তোমার দরকারি জিনিসপত্র, গায়ের কাপড়চোপড় আর বিরাট পিস্তলটা আমার গাড়ির পেছনের সিটে এনে রেখেছি তারপর সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি সরু সেই গলিতে। গাড়ি রেখে তোমাকে খুঁজতে যাব, এমনসময় হাজির হলে তুমি।’
চট করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনের সিটে চোখ বোলাল রানা। ওর দরকারি সবই ওখানে দেখে অবাক হয়েছে।
সামনে হালকা হয়ে গেছে গাড়ির ভিড়। পুবে চলল রানা। একটু পর পড়ল আইযেনহাওয়ার এক্সপ্রেসওয়েতে। এরই ভেতরে স্থির করেছে, আপাতত ড্রাইভ করবে উদ্দেশ্যহীনভাবে। তারই ফাঁকে জেনে নেবে মেয়েটার কাছ থেকে কিছু তথ্য।
‘এবার বলো, লিউনা, কেন সিনেটর পিটারের ওপরে চোখ রেখেছিলে? আগেই বলেছ, তার গাড়িতে হোমিং ডিভাইস প্ল্যান্ট করতে হেলথ সেন্টারে গিয়েছিলে। কিন্তু সেটা করলে কেন? আমার মনে হচ্ছে তোমার লিউনা নামটা হয়তো নকল। আমি কি সঠিক ভেবেছি?’
‘না, এটাই আমার আসল নাম। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যখন নিজের নাম বললে, ওটা মনে রেখেছি। পরে ইণ্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি তোমার ব্যাপারে। তুমি রানা এজেন্সির চিফ। সত্যিকারের এক অ্যাডভেঞ্চারার। পাহাড়ে, মরুভূমিতে, সাগরে হারিয়ে যাওয়া বহু মানুষকে উদ্ধার করে এনেছ। আর তাই তোমাকে নিজের ব্যাপারে বলতে কোন দ্বিধা নেই আমার। …হোটেলে জন ওয়েস্টন নামের এক লোক ছিল। তাকে কি তুমি দেখেছ?’
মাথা দোলাল রানা। মনে পড়েছে বয়স্ক চাচা টাইপের লাজুক চেহারার লোকটাকে। ‘পডিয়ামের কাছের এক টেবিলে ছিল। পরে সিনেটরের অনুরোধে মাইকে কথা বলে। তার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে তুমি?’
‘শিশু কিডন্যাপিঙের সঙ্গে সে জড়িত, উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে দূরের বাতির দিকে তাকাল লিউনা। ‘কীভাবে জড়িত, এখনও জানি না। তবে এতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’
‘একটু খুলে বলবে?’ নরম সুরে বলল রানা।
‘চার মাস আগের কথা। কাজ করতাম ওয়েস্টনের এক ডে-কেয়ার সেন্টার-এ। ম্যানেজার ছিলাম।’
গাড়ির জানালা সামান্য খুলল রানা। হু-হু করে ভেতরে ঢুকল শীতল হাওয়া। তাতে ভাল লাগল ওর।
‘চার মাস আগে কী হয়েছিল?’
জবাব দেয়ার আগে দ্বিধা করল লিউনা, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘একই দিনে সেন্টার থেকে চুরি হলো তিনটে বাচ্চা। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ভেবে পেলাম না যে ওদের অভিভাবকদেরকে কী জবাব দেব।’
‘ঠিক কী হয়েছিল সে-দিন?’ জানতে চাইল রানা।
দূরে চেয়ে রইল লিউনা। কথা বলার আগে গুছিয়ে নিচ্ছে সব। ‘বাচ্চারা সে-দিন দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। ম্যানেজার হলেও লোকবলের অভাবে চোখ রাখছিলাম ওদের ওপরে। জ্বর ছিল বলে আসেনি দু’জন বেবি সিটার। সেন্টারে তখন বড়মানুষ বলতে শুধু আমি। দুপুরের শেষদিকে ফোন এল অফিসে। ক্রিংক্রিং আওয়াজে বাচ্চাদের ঘর ছেড়ে গিয়ে ঢুকলাম ওখানে। ফোন করেছিল জন ওয়েস্টন। তাকে জানালাম সেন্টারে এখন বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কথা শুনে লোকটা বলল, তা হলে যেন দেরি না করে বাচ্চাদের ঘরে ফিরে যাই। পরে ফোন করবে সে। অফিস থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম বাচ্চাদের ঘরে। আর তখনই বুঝতে পারলাম যে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে। ওদের বয়স বড়জোর চার বা পাঁচ।’ শেষদিকে কথা বলতে গিয়ে ভেঙে গেছে লিউনার কণ্ঠস্বর।
‘বাচ্চাদেরকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করলাম অন্যরা কোথায়। তবে ওরা কিছু বলতে পারল না। যে বা যারা এসেছিল, তারা ভাল করেই জানত কখন বাচ্চা তিনটেকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। আরও খারাপ দিক হচ্ছে, জন ওয়েস্টনের অন্যান্য ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আগেও বাচ্চা চুরি হয়েছে। ওই একই দল এসব করেছে।’
লিউনার কথা শুনে শীতল অনুভূতি হচ্ছে রানার বুকের ভেতরে। ‘তারপর কী হলো?’
‘পুলিশে খবর দিলাম। কিন্তু তাদের সব সন্দেহ এসে পড়ল আমার ওপরে। খবর পেয়ে হাজির হলো জন ওয়েস্টন। তারও ধারণা: এসবে হাত আছে আমার। অবশ্য নরম সুরে বলল: সেন্টারে যা ঘটে গেছে, তারপর বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরি থেকে বের না করে দিয়ে তার আর কোন উপায় নেই, নইলে অভিভাবকেরা নিজেদের বাচ্চাদেরকে অন্য কোন ডে-কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করাবে। সত্যি কথাই বলেছে সে। দৈনিক পত্রিকায় কিডন্যাপ হয়ে যাওয়া তিনটে বাচ্চার ছবির সঙ্গে ছাপা হলো আমার হাফ পেজ ছবি। বিশাল আর্টিকেল করল কয়েকটা সংবাদপত্র। লাইভ প্রোগ্রাম হলো টিভি চ্যানেলে। কোথাও মুখ দেখাবার উপায় থাকল না আমার। বুঝে গেলাম এই রাজ্যের কোথাও কোন চাকরি আর পাব না।’
নীরবে কাঁদতে শুরু করেছে মেয়েটা।
ওকে সান্ত্বনা দিল না রানা। বুঝতে পারছে, এখন প্রতিটি সেকেণ্ড খুব জরুরি। ‘তুমি কীভাবে জানলে যে জন ওয়েস্টনের অন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আগেও বাচ্চা চুরি করা হয়েছে?’
হাত তুলে চোখ মুছল লিউনা। ‘কয়েক বছর ধরে ডে- কেয়ার সেন্টারে কাজ করেছি। তাই অনেককে চিনি। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জেনেছি। এদিকে কয়েক দিন আমার ওপরে চোখ রাখার পর হাল ছেড়ে দিল পুলিশের লোক। আর আমিও বুঝলাম, বাচ্চারা কিডন্যাপ হয়ে গেলেও তাদের তদন্ত করার কোন গরজ নেই। আর তখন থেকেই আমি নিজে তদন্ত করতে শুরু করেছি।
চুপ করে আছে রানা। বুঝে গেছে, নিজে থেকেই সব বলবে লিউনা।
‘প্রথমে চোখ রাখলাম জন ওয়েস্টনের ওপরে। জানি না কেন সেটা করলাম। অবশ্য আমার মনে হয়েছিল তার ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু আছে। প্রথমেই লোকটার সম্পত্তির ব্যাপারে খোঁজ নিলাম হল অভ রেকর্ডস-এ। আর তখনই বুঝলাম, এত সম্পত্তির মালিক আসলে সে নয়।
ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল রানা। ‘তা হলে মালিক কে?’
‘একটা করপোরেশন। আগে ওটার নাম শুনিনি। ফাইভ স্টার নামের সেই সংগঠনের চিঠি জমা হয় পোস্ট অফিসের এক মেইল-বক্সে। তদন্ত করতে গিয়ে সেই করপোরেশনের ব্যাপারে পেলাম বেশকিছু তথ্য। ওটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে আণ্ডার-ওঅর্ল্ডের। আমার ধারণা করপোরেশনটা চালায় এক মাফিয়া দল। আর সেটার নেতা অ্যালডো রসি। এমনকী ওয়েস্টন যে বাড়িতে অফিস করে, ওটার মালিকও তারা। ডে-কেয়ার সেন্টার, এতিমখানা থেকে শুরু করে সবকিছুর মালিক আসলে মাফিয়ারা। এসব জেনে এখন তোমার ঠিক কী মনে হচ্ছে, রানা? ‘
‘অপরাধে নাক ডুবিয়ে দিয়েছে ওয়েস্টন,’ বলল রানা।
ঘন ঘন মাথা দোলাল লিউনা। শুধু তা-ই নয়, নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টার আর লাভজনক বেশকিছু ব্যবসায়িক সংস্থার মালিক এই ফাইভ স্টার করপোরেশন। ওটার বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক অ্যালডো রসি। আর করপোরেশনের বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভেতরে একজন হচ্ছে সিনেটর পিটার। আসলে সেজন্যেই তাকে অনুসরণ করে নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারে গিয়ে তার গাড়িতে হোমিং ডিভাইস রেখেছি।’
‘তুমি সঠিক কাজই করেছ,’ বলল রানা। ‘আমারও মনে হয়েছে যে সিনেটর পিটারকে নিজের পকেটে পুরে রেখেছে অ্যালডো রসি। হোটেলে লোকটা মিথ্যা বলেছে, ভাবছে ও। নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের সাধারণ সদস্য নয় সিনেটর। অপরাধের কূপে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে সে। তাকে ভালভাবে জেরা করা উচিত। আজ হোটেলে সেটা করার মত সময় ওর হাতে ছিল না।
‘আরও তদন্ত করব সিনেটরের ব্যাপারে,’ বলল লিউনা, ‘তবে আগে জানতে হবে শিশু অপহরণের ঘটনার সঙ্গে কতটা জড়িত জন ওয়েস্টন। তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে হলে আগে লাগবে শক্ত প্রমাণ।’
‘তুমি নিজে কিন্তু মস্ত বিপদে আছ,’ বলল রানা।
‘জানি। তবে কখনও জেনেবুঝে কোন পাপ করিনি। তাই অপরাধীদের শাস্তি দিতে গিয়ে যদি মরেই যাই, তো আফসোস করব না। এমনিতেই আমার জীবন নরক করে দিয়েছে এরা।
‘জন ওয়েস্টনের ব্যাপারে কী করতে চাও তুমি?’ জানতে চাইল রানা।
‘তার অফিস একটা এতিমখানায়,’ বলল লিউনা, ‘আগে একসময়ে সেখানে কাজ করেছি। বিশেষ করে কোন কর্মচারী অসুস্থ হলে বাড়তি ডিউটি দিতাম। আর পরে যখন ওয়েস্টন আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিল, এতিমখানায় ঢোকার একটা সাইড ডোর আর তার অফিসের দরজার চাবি ফেরত নিতে ভুলে গেছে। তাই ভাবছি আবারও একবার ঢুকব ওখানে।’
‘তুমি কি চাকরি চলে যাওয়ার পরেও লোকটার অফিসে গোপনে ঢুকেছ?’
মাথা দোলাল লিউনা। ‘জানি কাজটা ছিল খুব বিপজ্জনক। আমার দায়িত্বে থাকা শিশুদেরকে তুলে নিয়ে গেছে, সেটা ভাবতে গিয়ে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করিনি। ওয়েস্টনের অফিস থেকে নিয়েছি অন্তত বিশটা ফাইল। আর সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে বুঝেছি, শিকাগো থেকে চুরি করা হয়েছে শত শত শিশু। পরে আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। যদিও এসব ফাইল যে ওয়েস্টনের, সেটা প্রমাণ করতে পারব না।
আড়ষ্ট হয়ে গেছে রানার পেটের পেশি। সেটা ভয়ের জন্যে নয়। শীতল আগুন জ্বলে উঠেছে ওর বুকের ভেতরে। ‘বাচ্চাগুলোকে কোথায় সরিয়ে নেয়?’ জানতে চাইল রানা।
‘আমার জানা নেই। তবে গোটা অপারেশনের সঙ্গে জড়িত জন ওয়েস্টন। সেদিন জানত ডে-কেয়ার সেন্টারে আমি ছাড়া কর্মচারী বলতে অন্য কেউ নেই। অফিসে ফোন করে বাচ্চাদের ঘর থেকে আমাকে সরিয়ে নেয় সে। একই সময়ে তার লোক বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যায়। এতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’
‘সহজেই কাজটা করতে পেরেছে,’ বলল রানা। লিউনার দিকে তাকাল। ‘বড় ধরনের অপারেশনে নেমেছে। তবে তুমি যখন সন্দেহ করলে, তখন পুলিশের কাছে গেলে না কেন?’
মাথা নাড়ল লিউনা। ‘নিজেই তো দেখলে ওয়েস্টনকে। আমি ছিলাম তার একজন কর্মচারী, যাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অভিযোগে চাকরি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়েছে দয়ালু এক চাকরিদাতা। যে-কেউ বলত, চাকরি হারিয়ে তার পেছনে লেগেছি আমি। পুলিশের কাছে গেলে আমার একটা কথাও শুনত না। তা ছাড়া, বিপদ হলে সহজেই দরকারি সব ডকুমেন্ট তৈরি করে নিত ওয়েস্টন। তার কমপিউটারে বা ফিযিকাল ফাইলে কোথাও কোন ত্রুটি থাকত না। মাঝখান থেকে বোকা বনে যেতাম আমি পুলিশের কাছে।’
‘ওয়েস্টনের ফাইল হাতে পাওয়ার পর ভাবলে সিনেটর পিটারের ওপরে চোখ রাখবে,’ বলল রানা। ‘অর্থাৎ বদলে নিলে আক্রমণের অ্যাঙ্গেল।’
‘এ-ছাড়া উপায় ছিল না। ততক্ষণে বুঝেছি, খুঁজে নিতে হবে এই র্যাকেটের সবচেয়ে দুর্বল লোকটাকে। তার ব্যাপারে সংগ্রহ করতে হবে জোরাল প্রমাণ, নইলে আমার একটা কথাও শুনবে না পুলিশের লোক। এটাও আমি ভেবেছি, সিনেটরকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারলে অনেক কিছুই জানা যাবে।’
কথাটা শুনে মাথা নাড়ল রানা। ‘তার ধারে-কাছে যাওয়ার আগেই খুন হবে। তুমি আসলে না বুঝে নেমে পড়েছ খুব বিপজ্জনক এক খেলায়।’
ঘুরে ওকে দেখল লিউনা। ‘কিন্তু এটা তো স্বীকার করবে, এখন পর্যন্ত খারাপ করিনি?’
‘তা ঠিক।’ মৃদু হাসল রানা। ‘তবে এরপর হয়তো ভাগ্যের সহায়তা আর পাবে না।’
‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?’
‘এরপর থেকে যা করার সেটা আমাকে করতে দাও।’
‘কী করবে তুমি?’ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল লিউনা।
‘আমি ছিঁড়ে দেব এদের জাল,’ হিমশীতল শোনাল রানার কণ্ঠ। ‘এরই ভেতরে তুমি অনেক সাহায্য করেছ। অ্যালডো রসিকে খতম করতে গিয়ে তোমার সঙ্গে পরিচয়। আর তাতে চিনলাম ওয়েস্টন আর সিনেটরকে। এসব তথ্য আমার অনেক কাজে আসবে। এদের তিনজনের একজন মাফিয়া ডন, দ্বিতীয়জন নোংরা মনের রাজনীতিক আর তৃতীয়জন হচ্ছে শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত এক পচে যাওয়া ব্যবসায়ী। তবে এখন যেহেতু চিনে গেছি, তাই এবার আমার কাজ হবে এদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া।’
‘আমি হয়তো তোমার পাশে থেকে সাহায্য করতে পারব,’ অনেকটা অনুরোধের সুরেই বলল লিউনা।
‘এরই ভেতরে প্রিয় দু’জন মানুষকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে বসেছি,’ বলল রানা। ‘তাই চাই না তুমিও খুন হও।’
‘এ-লড়াই তো আমারও, রানা!’ রেগে গিয়ে বলল লিউনা। থমথম করছে মুখ। ‘প্রথম থেকেই জানি বিপদটা কত বড়। তবে আমি তো আর এসব শুরু করিনি। যখন দেখলাম কিছুই করবে না পুলিশের লোকেরা, তখনও হাল ছেড়ে দিইনি। আর তুমি এখন চাইছ আমি যেন এ-লড়াই থেকে সরে যাই। কিন্তু আমি কেন সেটা মেনে নেব?’
লিউনার কথার ভেতরে দৃঢ়তা টের পেল রানা। এ-ও বুঝে গেল, অনুরোধ করলেও শুনবে না এই মেয়ে। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ ভাবল রানা। ওর মনের ভেতরে কু ডাকছে: বড় কোন ক্ষতি হবে লিউনার! তবুও একবার বড় করে শ্বাস ফেলে বলল ও, ‘ঠিক আছে, একটা পর্যায় পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। কিন্তু গোলাগুলি শুরু হলে নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে পড়বে। এ-ব্যাপারে যদি কথা দাও, তো তোমাকে সঙ্গে রাখতে পারি।
‘তা-ই নাকি?’ টিটকারির সুরে বলল লিউনা।
‘হ্যাঁ, তা-ই। হয় এতে রাজি হবে, নইলে এখনই তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব।
ওর গম্ভীর চেহারা দেখে লিউনা বুঝল, ওর দ্বিতীয় কোন অনুরোধ রাখবে না এই যুবক।
‘ঠিক আছে, রানা, তোমার কথাই রইল,’ নরম সুরে বলল লিউনা।
নীরবতা নামল গাড়ির ভেতরে।
রানা ভাবছে অপহৃত শিশুদের কথা। ওদের করুণ পরিণতি আর অসহায় বাবা-মার সীমাহীন কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে তিক্ত হয়ে গেছে অন্তর। তীব্র ঘৃণা বোধ করছে মাফিয়া ডন রসি, সিনেটর পিটার আর ব্যবসায়ী ওয়েস্টনের প্রতি। বিড়বিড় করে বলল, ‘নরকের পিশাচ! এই দুনিয়ায় এসে ক্ষতি করছে সমাজের!’
‘কিছু বললে?’ জানতে চাইল লিউনা।
‘আমার মাতৃভাষা, বাংলা,’ বলল রানা।
‘খুব মিষ্টি শোনাল! ইংরেজির মত খটমটে নয়।’
‘বাংলা ভাষার মাধুর্য হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আর পল্লীকবি জসীম উদ্দীন।’
‘সত্যিই যদি কখনও সুযোগ হয়, একবার ঘুরে আসব তোমাদের দেশ থেকে।’
‘তুমি চাইলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব,’ বলল রানা।
চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল লিউনা।
আবারও নীরবতা নামল গাড়িতে।
জরুরি কিছু সূত্র পেয়েছি, ভাবছে রানা। এবার বদলা নেব স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর। খুঁজে বের করব অসহায় অপহৃত শিশুদেরকে। প্রথম সুযোগে চরম শাস্তি দেব অপরাধীদের। আজ রাতেই যাব কয়েক জায়গায়। তাতে হয়তো খুন হবে কিছু নরপশু। অথবা তাদের হাতেই শেষ হব। ঘটনা যা-ই হোক, কখনও নিজের দায়িত্ব থেকে পিছাব না।
মনের আয়নায় বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কঠোর চেহারা দেখতে পেল রানা।
গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বস বললেন, ‘কাজ শেষে দেখা করবে। জরুরি কথা আছে।’
কট্টর বুড়োর কথা ভেবে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রানা। ভাবছে, কতকাল স্যরকে দেখি না! এখনও কি আগের মত আমাকে ভালবাসেন? অন্যদের কাছে সে-ভালবাসা প্রকাশ হয়ে গেলে আগের মতই বিব্রত হন? ও নিজে দেশে না থাকলে উদ্বিগ্ন হয়ে সেই রাগ ঝেড়ে দেন এমনকী সোহানার ওপরেও?
আনমনে হাসল রানা। ওর বুকের কৃতজ্ঞতা দু’ফোঁটা অশ্রু হয়ে ঝরল চোখ থেকে। মনে মনে বলল: ‘এই মিশন থেকে ফিরলে প্রথম সুযোগে দেখা করব আপনার সঙ্গে, তখন যেন আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, স্যর!’
চোদ্দ
চাকরি জীবনের শুরু থেকেই অফিসে বসে ডেস্ক-জব করতে বিরক্তি বোধ করত বার্কলে এবার্টন। বিশাল ঘরে হয়তো বাজছে রেডিয়োর গান, খটাখট আওয়াজে লেখা হচ্ছে কি বোর্ডে রিপোর্ট, অথবা আড্ডা জমিয়ে হৈ-চৈ করছে ক’জন অফিসার মিলে। সন্দেহভাজন কোন লোককে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে অফিসে। আসলেই কেমন যেন বাজে এক পরিবেশ বিরাজ করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। আর আজকের এ-রাত আরও বিশ্রী। ক্যাপ্টেন ডিউটিতে ডেকে না নিলে এখন বাড়িতে স্ত্রীকে সময় দিত এবার্টন। ক’দিন পর জেনিফারের ফুসফুসে জটিল অপারেশন। মেডিকেল বোর্ড থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ওর বাঁচার সম্ভাবনা পঞ্চাশ পার্সেন্ট।
অবশ্য বাড়িতে রয়ে গেলেও অস্বস্তি বোধ করত এবার্টন। আর সেজন্যে সম্পূর্ণভাবে দায়ী রানা এজেন্সির চিফ মাসুদ রানা। তার কারণে নড়েচড়ে গেছে শিকাগোর আণ্ডার-ওঅর্ল্ড ঘুষখোর পুলিশ অফিসারদেরকে চাপ দিচ্ছে বড় বড় সব অপরাধী: ‘জলদি গ্রেফতার করুন উন্মাদ মাসুদ রানাকে!’
অর্গানাইযড ক্রাইম টাস্ক ফোর্সের ক্যাপ্টেন রন হাওয়ার্ডকে খেপা কুকুরের মত কামড়ে দিতে চাইছে মেয়র গ্রেগরি বার্নস্টেবল। ফোন করছে প্রতি আধঘণ্টা পর পর।
মস্তবড় অফিসে চলছে চরম হৈ-চৈ আর হুলুস্থুল। তারই ভেতরে মাথা-ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে চাইছে এবার্টন। বাড়ি থেকে মাসুদ রানা’ বেরিয়ে যেতেই নীতিগতভাবে ওর উচিত ছিল পুলিশে যোগাযোগ করা। সেটা সে করেনি। নিজেকে এসবে জড়াতে না চাইলে অন্য কোন ফোন থেকেও খবর দিতে পারত হেডকোয়ার্টারে। একটা রুমাল দিয়ে রিসিভার চেপে ধরে কথা বললে কেউ বুঝত না কে কল করেছে। চাইলে দিতে পারত রানার পরনের পোশাক আর গাড়ির বর্ণনা। যদিও এতক্ষণে পোশাক বা গাড়ি পাল্টে নিয়েছে লোকটা ঝামেলা এড়াতে গিয়ে দূরের কোন থানাতেও ফোন করতে পারত এবার্টন। কোনভাবেই কেউ রানার বিষয়ে জড়াতে পারত না তাকে।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল এবার্টন। এসব কিছুই করেনি সে। আর তাতে বিপদ হবে তেমন সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। ইন্টারনাল অ্যাফেয়ারের কমিশনার বা এফবিআই এজেন্টরা মাসুদ রানাকে জেরা করলেও অনায়াসে নিজের দায় অস্বীকার করতে পারবে এবার্টন। কারও হাতে প্রমাণ নেই যে আইন ভেঙেছে সে। আসলে এ-ধরনের অনৈতিক কাজ করেছে স্রেফ জেনিফারের কথা ভেবে। প্রাণের চেয়েও বেশি স্ত্রীকে ভালবাসে সে। আমেরিকার আদালতের চরম ব্যর্থতা আর দুর্বলতার ব্যাপারে জেনিফারের মনোভাব জানে বলেই দ্বিধা করেনি আইনকে কাঁচকলা দেখাতে। একবার ডেস্ক থেকে মুখ তুলে স্কোয়াড রুমে চোখ বোলাল এবার্টন। একটু পর পর ফোন এলে ব্যস্ত হয়ে উঠছে অফিসারেরা। নানান রিপোর্ট আসছে মাসুদ রানার বিষয়ে। গোটা শিকাগো শহর যেন হয়ে গেছে যুদ্ধ এলাকা!
অবশ্য অর্গানাইড্ ক্রাইম ইউনিটের কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না, মাসুদ রানার হাতেই খুন হচ্ছে আণ্ডার- ওঅর্ল্ডের অপরাধীরা। অন্তর থেকে এবার্টন মেনে নিয়েছে, যোগ্য এই বাঙালি যুবক আসলেই যেন সত্যিকারের মৃত্যুদূত!
ডেস্কের ওপরের ড্রয়ার খুলে ওটার ভেতর থেকে এককৌটা অ্যান্টাসিড নিল সার্জেন্ট এবার্টন। ক্যাপ খুলে চারটা ট্যাবলেট নিয়ে মুখে ফেলে কুড়মুড় করে চিবিয়ে গিলে নিল। নদীর চরাঞ্চলের মত শুকিয়ে গেছে মুখ। লিনোনিয়াম মেঝের দিকে চেয়ে ভাবতে চাইল; এরপর কী করা উচিত তার? মুখ তুলে দেখতে পেল মুখোমুখি ডেস্কে বসে এদিকেই চেয়ে আছে তার পার্টনার শ্যন সিমন্স, চোখে কৌতূহল।
শ্যন সিমন্স বেঁটে ও মোটা ধরনের মানুষ। মাথার চুলগুলো সোনালি। মাত্র সাত বছর হলো চাকরিতে ঢুকেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একই সঙ্গে কাজ করেছে বলে সে বুঝে গেছে, বড় ধরনের কোন ঝামেলায় আছে সিনিয়র পার্টনার।
হাতের কাগজ ডেস্কে রেখে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল শ্যন সিমন্স। ‘আমি কফি নেব, এবার্টন। আপনার জন্যে কি এক কাপ আনব?’
ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে মুখে আরেকটা অ্যান্টাসিড চালান দিল এবার্টন। ‘না, খালি পেটে কফি খেলে স্টমাক ওয়াল পুড়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে,’ ঘুরে কফি মেশিনের দিকে চলল সিমন্স। ভাবছে, কোন না কোন কারণে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে এবার্টন। বড় এক ফাইল কেবিনেটের ওপরে আছে কফি মেকার। পাশেই স্টাইরোফোমের কাপ। একটা কাপ নিয়ে মেশিনের কলের নিচে ধরল সিমন্স। কলের ওপরে চাপ দিতেই কাপে এসে পড়তে লাগল কড়া কালো কফি। কাপ ভরে নিয়ে কল থেকে হাত সরিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিল সে। চিনি বা কফিমেট নেই বলে ভীষণ তেতো লাগছে কফি। কুঁচকে গেল তার মুখ। পুলিশদের অফিসে সবসময় বাজে কফিই থাকে, বিরক্ত হয়ে ভাবল। পাকা সব অপরাধীকে ধরে এনে তাদের অপরাধের পরিমাণ বুঝতে পেরে এই কফির মতই তিক্ত হয়ে যায় ওদের সবার মন। বিশাল ঘরের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আবারও দেখতে পেল কানে মোবাইল ফোন ঠেকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে এবার্টন। চুপ করে তার দিকে চেয়ে রইল সিমন্স।
খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে সার্জেন্ট এবার্টনকে। নিচু গলায় কী যেন বুঝিয়ে বলছে ওদিকের লোকটাকে। কেউ শুনছে কি না, সেটা দেখার জন্যে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে এদিকে-ওদিকে।
যার সঙ্গে কথা বলছে, তার ফোন নাম্বার পেলে ভাল হতো, ভাবল সিমন্স। শার্টে যাতে ছলকে কফি না পড়ে, সেজন্যে সাবধানে ধরল আগুনের মত গরম কাপ। ব্যস্ত হয়ে ঘরের নানাদিকে ছুটছে অর্গানাইড্ ক্রাইমের অফিসারেরা। তাদেরকে এড়িয়ে সার্জেন্ট এবার্টনের ডেস্ক লক্ষ্য করে চলল সার্জেণ্ট সিমন্স।
তাকে ফিরতে দেখে ফোন কেটে দিল এবার্টন। তাতে মনে মনে রেগে গেল সিমন্স। তারা যেহেতু দু’জন পার্টনার, তাই এবার্টনের উচিত সবকিছু শেয়ার করা। বছরের পর বছর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পরস্পরের প্রাণরক্ষা করেছে তারা। কাজেই পার্টনার সবসময় সততার সঙ্গে চলবে, স্বাভাবিকভাবেই সেটা দাবি করতে পারে অপর পার্টনার।
এবার্টন হয়তো ব্যক্তিগত বা সাংসারিক ঝামেলায় পড়েছে, ভাবল সিমন্স। তার জানা আছে এবার্টনের স্ত্রী অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। আবারও হয়তো শুরু হয়েছে ফুসফুসের ব্যথা। অবশ্য সেটাই যদি হবে, তো হঠাৎ করে আজকে এবার্টনের মুখে অপরাধের ছাপ কেন? আবার গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল সিমন্স। ‘রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই মাসুদ রানা, তা-ই না?’ আলাপ করার ইচ্ছে থেকে বলল সে। ‘তা-ই তো মনে হচ্ছে,’ বিরক্তির সুরে বলল এবার্টন। ‘লোকটা ভয়ঙ্কর একটা তুষার-ঝড়ের মত। আমরা তো তার কোন খোঁজই পাচ্ছি না! মাসুদ রানা যে আসলে খুনি, সেটাও জানি না। সে শিকাগো থেকে বিদায় হলে বাঁচতাম।’
‘এত সহজে যাবে না সে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবার্টন।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখল সিমন্স। পরক্ষণে তাকাল মস্ত ঘরের অন্যদিকে। সেখানে টেলিফোন বেজে উঠতেই কল রিসিভ করেছে এক অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর দেয়ালে ঝুলন্ত শিকাগো শহরের ম্যাপের মাঝে কয়েকটা পিন থেকে খানিক দূরে আরেক এলাকায় নতুন একটা পিন গুঁজল সে।
‘অন্তত এটা বলতে পারি, নিরীহ কারও ওপরে হামলা করছে না,’ বলল সিমন্স। এরা যারা খুন হচ্ছে, প্রত্যেকে সবাই পাকা কালপ্রিট।’
আবারও কৌটা থেকে নিয়ে দুটো অ্যান্টাসিড মুখে পুরল এবার্টন। ‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু তাতে কী? সে তো আর কোন আইন মেনে চলছে না।’
আগে কখনও এবার্টনকে এতটা অসহায় হতে দেখেনি সিমন্স। হঠাৎ করেই সে যেন হয়ে গেছে নিয়তিবাদী এক সাধু!
‘ইয়ে, এবার্টন, বলল সিমন্স, ‘আপনাকে যদি কোনকিছু বিব্রত করে থাকে, বা যদি কোন সমস্যায় পড়ে থাকেন, পার্টনার হিসেবে আমার সঙ্গে সে-বিষয়ে আলাপ করতে পারেন। অন্য কেউ জানবে না।’
বাতাসে হাত নাড়ল এবার্টন। ‘আমাকে নিয়ে ভেবো না, কিড। আসলে আমার খারাপ লাগছে, কোনভাবেই মাসুদ রানাকে হাতের মুঠোয় পাচ্ছি না আমরা। একটু আগে তুমি বললে, সে যেন ভয়ঙ্কর একটা তুষার-ঝড়ের মত। কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। সে আসলে প্রচণ্ড এক টাইফুন। ওটার গতিপথে পড়লে রেহাই নেই কারও। আমরা এ-ও জানি না যে এরপর কোথায় হামলা করবে সে। আর তাতে মানসিকভাবে অস্বস্তিতে পড়ে গেছি আমি।’
‘ঠিকই বলেছেন।’ মাথা দোলাল সার্জেন্ট সিমন্স। সহজ সুরে বলল, ‘একটু আগে যেন কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন?’ সরাসরি জানতে চাওয়াই বোধহয় ভাল, ভাবছে সে।
‘কথা বলেছি জেনিফারের সাথে,’ বলল এবার্টন, ‘বাড়েনি ওর ফুসফুসের ব্যথা। ওকে জানিয়ে দিয়েছি, আজকে হয়তো সারারাত অফিসে ডিউটি দিতে হবে।’
জবাবটা অযৌক্তিক নয়। সিমন্সের অবশ্য মনে হলো ডাহা মিথ্যা বলেছে ওর পার্টনার। স্ত্রীকে ফোন করেনি এবার্টন। আর সত্যি যদি স্ত্রীর কাছে কল দিয়ে থাকে, তা হলে কী বিষয়ে কথা হয়েছে তাদের ভেতরে?
ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্সের অফিসারের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলবে কি না ভাবতে শুরু করেছে সিমন্স। কিন্তু সত্যিই যদি অভিযোগ করে, সেক্ষেত্রে কী নালিশ করবে-আমার পার্টনার উদ্ভট আচরণ করছে?
দিনের পর দিন চাপের মুখে পড়ে বেশিরভাগ পুলিশ কোন না কোন সময়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে, এটা নতুন কিছু নয়। শিকাগোর অপরাধীদেরকে একে একে শেষ করে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর এক খুনি, আর সেটা পুলিশ অফিসার হিসেবে হজম করা খুব কঠিন কাজ। যে-কারণেই হোক অস্বাভাবিক আচরণ করছে এবার্টন। তবে তাতে ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই যে, বেআইনি কোন কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে।
এখন থেকে বিপজ্জনক মিশনে নিজের প্রাণরক্ষার ব্যাপারে এবার্টনের ওপরে আর ভরসা করব না, ভাবল সিমন্স। মানসিক কোন সমস্যা হয়েছে বলেই নিজের মনের ভেতরে ডুব দিয়েছে সে। আর সেটা ধীরে ধীরে হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।
ভয়ঙ্কর এক খুনির আবির্ভাব হওয়ার পর, এখন বিপদে- আপদে হয়তো পার্টনারের সহায়তা পাব না, ভাবল সিমন্স। মনে মনে নিজেকে শোনাল: এখন থেকে আরও সতর্ক হও!