নরকের শহর – ১

এক

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে পুরো এক বছরের জন্যে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে মাসুদ রানাকে। হাতে জরুরি কোন কাজ নেই বলে গত কয়েক মাস ধরে ভবঘুরের মত নানান দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও। তবে আগের মত আর পা দিচ্ছে না অনিয়মের ফাঁদে। খুব ভাল করেই জানে, প্রাণপ্রিয় দেশটির বড় কোন বিপদ এলে সেটা রুখে দিতে হলে আবারও গড়েপিটে নিতে হবে নিজেকে। তাই যেখানেই থাকুক, প্রতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে পার্ক বা জঙ্গলে গিয়ে বিরতি ছাড়াই দৌড়োচ্ছে টানা দশ মাইল। এরপর শুরু হচ্ছে কঠিন সব ব্যায়াম। প্রশিক্ষণে কোথাও কোন ফাঁকি দিচ্ছে না ও।

গতকাল কলেজের পুরনো বন্ধু গ্রেগরি কার্লটনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ছোট্ট বসতি বারবারা জোন্স-এ পা রেখেছে রানা। সঠিক সময়ে হাজির হয়ে গেছে চার্চে। এরপর বন্ধু আর তার প্রেমিকা র‍্যাচেলের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতেই উপহার হিসেবে হানিমুনের জন্যে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে বাহামায় যাওয়ার বিমানের টিকেট। পঞ্চাশ পদের লোভনীয় বুফে লাঞ্চ সেরে নববিবাহিত দম্পতিকে নিজে পৌঁছে দিয়েছে ছোট্ট এয়ারপোর্টে। তারপর শহরে ফিরে উঠেছে সেরা আবাসিক হোটেল থ্রি-স্টার ওল্ড টাইম্‌স্-এ।

আর আজ ছোট শহর বারবারা জোন্স-এ ওর দ্বিতীয় দিন।

এখন বাজে সকাল নয়টা।

হাতে কোন কাজ নেই বলে ঘরের ডাবল সোফায় বসে

এলইডি স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে রানা। যদিও আসলে দেখছে না কিছুই। মনে পড়েছে মাস কয়েক আগের বেশ কিছু ঘটনা। তখন আমেরিকার প্রতাপশালী মিলিটারির অত্যাধুনিক সব অস্ত্র লোপাট করে কুখ্যাত এক মেক্সিকান ড্রাগ-লর্ডের কাছে ওগুলো পাচার করত ওকলাহোমার টুসান শহরের মেয়র অ্যারন স্টার্লিংফোর্ড এবং তার ভাড়া করা খুনে ডাকাতেরা। তবে হামলা করে তাদের হাজার হাজার চোরাই অস্ত্রের বড় একটা চালান ধ্বংস করে দিয়েছিল রানা একা। এরপর বিশাল এক র‍্যাঞ্চে নিজের বাবার হাতে খুন হয়ে গিয়েছিল মেয়র।

সে-সময়ে প্রচণ্ড এক ক্রোধের অনলে পুড়ে দুর্নীতিপরায়ণ ক’জন পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রাক্তন দুই মিলিটারি অফিসারকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছিল রানা।

আকস্মিক এসব হামলার নেপথ্যে কে বা কারা আছে, সেটা জানতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে টুসানের পুলিশবাহিনী ও এফবিআই। ভালভাবে তদন্ত করার সুযোগ পেলে তারা জেনে যেত, এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের বেপরোয়া, দুঃসাহসী এক দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা। কিন্তু তারা আরও খোঁজ-খবর নেয়ার আগেই তাদের বাড়া ভাতে মুঠো ভরা ছাই ঢেলে দেন নুমা বা ন্যাশনাল আণ্ডারওঅটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সির চিফ (অব.) অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন।

যেদিন একের পর এক হামলা চালাল রানা, তার পরদিন ওর কুশল জানতে ফোন করেন তিনি। সে-সময়ে রানার কাছ থেকে টুসান শহরের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে সবই জেনে যান। এরপর তাঁর দেরি হয়নি হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁর বক্তব্যে টুসান শহরের অপরাধ-প্রবণ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছিল, তাতে সেদিনই এফবিআই চিফ ও ওকলাহোমার পুলিশ চিফকে তলব করেন প্রেসিডেন্ট। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক শেষে তাঁদেরকে জানিয়ে দেন: এরই ভেতরে যা ঘটে গেছে টুসানে, এরপর যেন আরও ঘোলা না করা হয় কর্দমাক্ত জল। এদিকে নুমার চিফ জর্জ হ্যামিলটন ফোন করে রানাকে বলেন, ‘মনে করি না তোমার আর কোন বিপদ হবে।’

আনমনে এসব ভাবছে রানা, এমনসময় হঠাৎ করে ছোট্ট টি-পয়ের ওপরে ক্রিং-ক্রিং শব্দে বেজে উঠল ল্যাণ্ডফোন। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল ও। ‘হ্যালো’ বলার আগেই শুনতে পেল ওর প্রাণপ্রিয় বন্ধু বিসিআই-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদের কণ্ঠস্বর: ‘তুই বোধহয় এরই ভেতরে সব জেনে গেছিস?’ ওর গলা ভারী।

‘বিষয়টা কী, সেটা তো বলবি?’ সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। মনের ভেতরে কু ডাকছে ওর।

খুক খুক করে কেশে নিয়ে ইতস্তত করল সোহেল, তারপর বলল, ‘শিকাগো শহরে রানা এজেন্সির শাখার চিফ স্নিগ্ধা হাসান আর অপারেটর তুষার মল্লিক আর নেই, রানা।’

বন্ধুর কথায় ভীষণ হোঁচট খেয়েছে রানা। মাত্র ক’দিন আগেও হাসিখুশি স্নিগ্ধা আর কৌতুকপ্রিয় তুষারের সঙ্গে কথা হয়েছে ওর।

‘ওটা কি কোন রোড অ্যাক্সিডেন্ট?’ জানতে চাইল রানা।

‘না, তা নয়। ওদেরকে খুন করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়।’

‘কখন আর কোথায়, সোহেল?’ শুকনো গলায় বলল রানা। ‘কে বা কারা ওদেরকে খুন করেছে?’

‘স্থানীয় সময় আজ সকাল আটটায় অফিসের কাছে ওরা যেতেই ব্রাশ-ফায়ার করেছে মুখোশধারী চার গুণ্ডা,’ জানাল সোহেল। ‘আমাদের ধারণা: এসবের পেছনে আছে শক্তিশালী এক ইতালিয়ান মাফিয়া দল।’

‘সেই মাফিয়া দলের নেতৃত্বে এখন কে আছে?’

‘ডন অ্যালডো রসি।’

‘খবরটা কার কাছ থেকে জানলি তোরা?’

‘কয়েক মাস আগে কমপিউটার সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বিসিআইয়ের জুনিয়র এজেন্ট আতাউল কবীর। স্নিগ্ধা আর তুষারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওর। ও ফোন করেছিল আমাদের অফিসে।

চুপ করে আছে রানা।

‘শিকাগো শহরে গত দু’বছর ধরে একের পর এক এশিয়ান আর আফ্রিকান-আমেরিকান শিশুরা উধাও হচ্ছে। তুই বোধহয় জানিস, সেজন্যে বসের নির্দেশ পেয়ে এ-বিষয়ে তদন্ত করছিল স্নিগ্ধা ও তুষার। মেধা আর যোগ্যতা প্রমাণের আদর্শ ক্ষেত্র পেয়ে খুশি হয়েছিল। আর তারপর আজ…’ চুপ হয়ে গেল সোহেল। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমরা ওদের মৃত্যু-খবর পেয়েছি মাত্র বিশ মিনিট আগে। তখনই বাড়িতে ফোন করেছি বসের কাছে। তিনি সব শোনার পর বললেন, তোকে যেন খবরটা পৌঁছে দিই।’

একদম থম মেরে গেছে রানা। বুকে জ্বলতে শুরু করেছে প্রতিশোধের ধিকিধিকি আগুন।

‘রানা, তুই যেখানে আছিস, সেখান থেকে শিকাগো শহর খুব বেশি দূরে নয়,’ বলল সোহেল। ‘আর ডাক্তারের মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তুই এখন প্রায় ফিট।’

‘আজই শিকাগোয় পৌঁছে যাব,’ দৃঢ়স্বরে বলল রানা।

‘শোন, তুই তো ভাল করে চিনিস আমাদের বুড়োটাকে। তুই টোটালি ফিট না, তাই তোকে অফিশিয়াল কোন নির্দেশ তিনি দেবেন না। শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বলেছেন, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু রাজীব চৌধুরীর একমাত্র নাতিটাকেও তুলে নিয়ে গেছে মাফিয়ার গুণ্ডারা। শিশু অপহরণের ব্যাপারে গা করছে না শিকাগো পুলিশ। মাফিয়ার গুণ্ডারা বাদামি, হলদে বা কালো রঙের শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে গেলেই বা তাদের কী! ওরা তো আর শ্বেতাঙ্গ নয়!’

‘শিকাগোতে আমার কিছু যন্ত্রপাতি লাগবে, সোহেল,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

‘তুই ওখানে গেলে সবই পেয়ে যাবি। তোর শুধু যোগাযোগ করতে হবে আতাউলের সঙ্গে।’

‘কোথায় ওর সঙ্গে দেখা হবে?’ জানতে চাইল রানা।

‘বিকেলে রানা এজেন্সির অফিসের বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করবে। তোকে তুলে নিয়ে চলে যাবে আমাদের নতুন সেফহাউসে।’

‘এ-ছাড়া জরুরি বেশ কিছু ইনফরমেশন লাগবে।’

‘আতাউল যা জানে সেটা জানাবে। এদিকে তুই শিকাগো পৌঁছে যাওয়ার আগেই রায়হান রশিদ হয়তো ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করতে পারবে বেশ কিছু তথ্য।’

‘বেশ, তা হলে তোর সঙ্গে পরে কথা হবে।’ বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল রানা। ওর মনে পড়েছে রানা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালু করতেই প্রথম থেকে বিরোধিতা করেছে শিকাগো পুলিশ। ওদের এজেন্সিতে বেশি কাজ ছিল না। তাই দায়িত্বে ছিল মাত্র দু’জন অপারেটর। এই তো ক’দিন আগে তুষার ফোন করে বলল, এক মাফিয়া ডনের বিরুদ্ধে বেশকিছু সূত্র পেয়েছে ওরা। এখন খুঁজছে আরও জোরাল প্রমাণ। তেমন কিছু পেলে পুলিশের সাহায্যে গুটিয়ে আনবে জাল।

আর আজ একটু আগে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ওরা। এই দুই হত্যাকাণ্ডের মামলা চাপা দেয়ার জন্যে হয়তো এরই ভেতরে লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে গেছে পুলিশের ক’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে রানা এজেন্সির দুঃসাহসী দুই অপারেটরের খুনের তদন্তের ফাইল চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে নতুন সব ফাইলের নিচে।

অবশ্য স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের মোটিভ খুঁজবে পুলিশ, সে-আশায় চুপ করে বসে থাকবে না রানা। ওর মনের আয়নায় ফুটে উঠল স্নিগ্ধা আর তুষারের তারুণ্যে ভরা মুখের ছবি। ওরা যেন হেসে হেসে বলছে ওকে: ‘জানেন, মাসুদ ভাই, কী অবাক কাণ্ড—আপনার সঙ্গে আর কখনও আমাদের দেখা হবে না!’

মুখের ভেতরটা নিমফলের মত তিতকুটে লাগল রানার। মনে পড়ল রাহাত খানের কঠোর দুটো চোখ। বিসিআই চিফ চান স্নিগ্ধা ও তুষারের মৃত্যুর বদলা নেয়া হোক। এবং… সম্ভব হলে রানা যেন উদ্ধার করে অপহৃত শিশুদেরকে।

মনে মনে শপথ নিল রানা: ‘যারা স্নিগ্ধা আর তুষারকে খুন করেছে, প্রাণে বাঁচতে দেব না তাদেরকে। আর যারা নিষ্পাপ শিশুদেরকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে, তারাও কোন ক্ষমা পাবে না আমার কাছ থেকে।’

মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি বা তার দলের দুষ্কৃতিকারীরা এখনও জানে না, আজ রাতেই শুরু হবে শিকাগো শহরে ভয়ঙ্কর প্রবল এক বহ্নিঝড়।

দুই

গা হিম করে দেয়া কনকনে শীতল ডিসেম্বর মাস।

আঠারো তারিখ।

শিকাগোর উত্তরদিকে সেকেণ্ডারি এক নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে তেইশ সালের নীল রঙের এক পোর্শে নাইন ইলেভেন স্পোর্টস্কার। প্রতিবার বাঁক নেয়ার সময় কুয়াশা কেটে ওটার হ্যালোজেন সাদা হেডলাইট গিয়ে পড়ছে আবাসিক সব বাড়ির কারুকাজ করা গেট, দেয়াল বা তুষারে ভরা বাগানের ওপরে।

গাড়িটা ড্রাইভ করছে কঠোর চেহারার এক যুবক নাম তার মাসুদ রানা। ড্যাশবোর্ডের মৃদু আলোয় দেখলে যে-কেউ ভাববে, স্রেফ নিরেট গ্র্যানিট পাথর দিয়ে খোদাই করা হয়েছে ওকে। রানার কুচকুচে কালো মণিদুটোয় কীসের যেন কঠিন এক প্রতিজ্ঞা।

মিনিটখানেক পর ওর স্পোর্টসস্কারের মতই অতি দামি সব গাড়িতে ভরা এক পার্কিংলটে ঢুকল রানা। একদিকে ছাউনি দেয়া একতলা লম্বাটে দালানের কাছে খুঁজে নিল পার্কিং প্লেস। হেডলাইট নিভিয়ে বন্ধ করল গাড়ির ইঞ্জিন। দরজা খুলে না নেমে ফিটনেস সেন্টারের সদর দরজার দিকে চেয়ে রইল রানা। এ-শহরে বিসিআই-এর নতুন সেফহাউসে পৌঁছুবার পর অস্ত্র বেছে নিতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছে ও। অস্ত্রগুলো আতাউল কবীরের গাড়িতে তুলে সরাসরি হাজির হয়েছে দামি এক রেন্টাল গাড়ির অফিসে। নকল কাগজপত্র দেখিয়ে দশ হাজার ডলার জমা দিয়ে সংগ্রহ করেছে এই পোর্শে গাড়িটা।

বি এইমাত্র নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের কাঁচের ডাবল- ডোর খুলে দিল ভালুকের মত প্রকাণ্ড এক গার্ড। তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল বছর বিশেক বয়সের দুই তরুণ-তরুণী। তারা খেয়াল করল না, পোর্শের ড্রাইভিং সিট থেকে তাদের দিকেই চেয়ে আছে সুঠাম দেহের শ্যামলা বর্ণের এক যুবক।

পোর্শে পাশ কাটিয়ে নিজেদের গাড়ির উদ্দেশে চলেছে তরুণ-তরুণী। নিজেদের ভেতরে জুড়েছে গল্প। প্রচণ্ড শীতে কথা বলার সময় নাক-মুখ দিয়ে ভুসভুস করে বেরে কুয়াশার মত ধূসর বাষ্প। যে-কেউ ভাববে, কষে টান মেরে গাঁজার ধোঁয়া উগলে দিচ্ছে ওরা। পার্কিংলটের দূরপ্রান্তে গিয়ে উঠে পড়ল কালো এক ফেরারি গাড়িতে। হয়তো একমিনিট পেরোবার আগেই হুশ শব্দে পার্কিংলট ছেড়ে বেরিয়ে যাবে তাদের গাড়ি।

পোর্শের ভেতরে বসে ক্লাবের কাঁচের ডাবল-ডোরের ওদিকে চেয়ে আছে রানা। গার্ড লোকটাকে কমিক্সের চরিত্র বাঁটুল দ্য গ্রেট বলে মনে হচ্ছে ওর। অবশ্য এর কানে ছোট্ট দুটো সোনার দুল। লোকটার বুক বেঢপ ফোলা। মাথা ন্যাড়া। পা-দুটো চড়ই পাখির ঠ্যাঙের মত লিকলিকে সরু। লেভি জিন্স প্যান্টের পায়াদুটো যেন বারো বোর বন্দুকের নল। উচ্চতার তুলনায় আমেরিকান বাঁটুলের ওজন অন্তত তিরিশ পাউণ্ড বেশি। একটু পর পর দরজা খুলতে হচ্ছে বলে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে তার গায়ে। তাতে কোন বিরক্তি নেই চেহারায়। সরাসরি চেয়ে আছে কম্পাউণ্ডের প্রধান ফটকের দিকে।

পার্কিংলটে ফেরারির ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই রানা বুঝল, ফিটনেস সেন্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই দুই তরুণ-তরুণী। পলকের জন্যে ফেরারির হেডলাইট এসে পড়ল পোর্শের ভেতরে, তারপর আলো সরে গেল অন্যদিকে।

কাজে নামার আগে অস্ত্রগুলো চেক করতে লাগল রানা। সেফহাউসে ওয়ালথার পিপিকে ছিল না। সেটার বদলে রানা নিয়েছে নাইন এমএম বেরেটা ৯৩-আর। জ্যাকেটের তলা থেকে নিয়ে পিস্তলের অ্যাকশন পরীক্ষা করে নিল। বার কয়েক ঝড়ের বেগে স্পিড রিগ থেকে নিয়ে আবার রেখে দিল জায়গামত। সেল্‌ফ্ লোডিং পিস্তলটার ফায়ার বাটন সরিয়ে ঠিক জায়গায় রাখলে একবার ট্রিগার টিপলে গুলি বেরোয় তিনটে করে। ফলে প্রতি মিনিটে বুলেট ছুঁড়তে পারে এক শত দশটা। বক্স ম্যাগাজিনে এখন আছে বিশটা গুলি। মাযলে জুড়ে নেয়া যাবে সাপ্রেসর।

অবশ্য আজকের এই রেইডে ডিটাচেবল ম্যাগাজিন বা সাইলেন্সার লাগবে বলে ভাবছে না রানা। বেরেটার মতই লোড করেছে অটোম্যাগ। ওর বামবগলের কাছে বিশেষভাবে তৈরি ফাস্ট-ড্র হোলস্টার থেকে ঝট করে অস্ত্রটা নিল রানা। খেয়াল করল গাড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে আসা পার্কিংলটের আলোয় চকচক করছে স্টেইনলেস স্টিলের ৪৪ অটোমেটিক পিস্তল। ওটার ওজন পৌনে চার পাউণ্ড। বুলেটের শক্তি ভারী কোন রাইফেলের গুলির প্রায় সমান। নির্মাতারা অটোম্যাগের রিকয়েল সামলে নেয়ার জন্যে রেখেছে রোটেটিং বোল্ট হেড, নইলে বুলেট পেছনে যে ধাক্কা দিত, তাতে চুরচুর হয়ে ভাঙত শুটারের কবজি। ন্যাটো ৭.৬২ এমএম গুলির প্রায় সমান গতি অটোম্যাগের বুলেটের। নিরেট ইঞ্জিন ব্লক ফুটো করে খতম করতে পারে গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীকে। এখন ম্যাগাজিনে আছে ইন্টারনাল গ্যাস প্রেশারাইড্ এক্সপ্লোসিভ বুলেট। প্রচণ্ড ঝাঁকি দেবে বলে শক্তহাতে ধরতে হবে অস্ত্রের বাঁট। পিস্তল বিশেষজ্ঞরা হেসে বলেন, অটোম্যাগ আসলে হাওয়াইয়ার রকেট লঞ্চারের মত।

আরও একবার ড্র করার পর হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দিল রানা। পোর্শের ড্রাইভিং ডোর খুলে নেমে পড়ল। দরজা লক না করে হেঁটে চলল নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের ডাবল-ডোর লক্ষ্য করে। পায়ের নিচে কুড়মুড় করে ভাঙছে বরফ হয়ে যাওয়া পিছলা তুষার।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফিটনেস সেন্টারের দিকে কঠোর চেহারার এক যুবককে হেঁটে আসতে দেখছে টাকমাথা গার্ড। যুবকের পরনে কালো প্যান্ট ও জ্যাকেট। নিয়ম মেনে তার জন্যে ডাবল-ডোর খুলে দিল বাঁটুল দ্য গ্রেট। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে হেলথ ক্লাব সদস্যদের হাসির আওয়াজ ও কথা শুনছে রানা। মস্ত কামরায় পা রেখে গার্ডকে কোন কিছু না বলে পা বাড়াল লবির দিকে।

টাকমাথা ডোরম্যান অভিজ্ঞ একজন বাউন্সার। নতুন এ- যুবককে আগে কখনও এখানে দেখেনি। নিচু গলায় গালি দিয়ে দু’মুঠো পাকিয়ে ফেলল সে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘আপনি তো এই ক্লাবের মেম্বার নন!’

‘তো?’ বলেই ঘুরে খপ করে ডোরম্যানের টি-শার্টের কলার চেপে ধরল রানা। একই সময়ে আরেক হাতে ধরেছে বাঁটুলের কোমরের বেল্ট। ভালুকটার অগ্রগতি কাজে লাগিয়ে তাকে চরকির মত ঘুরিয়ে নিল রানা। পরক্ষণে পিঠে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে দরজার কাঁচের ওপরে ফেলল গার্ডকে। ঝনঝন শব্দে ভাঙল পুরু কাঁচ। তাল সামলাতে না পেরে পিছলে গেল বাঁটুল দ্য গ্রেটের দু’পা। হড়কে গিয়ে পাথুরে সিঁড়ির নিচের ধাপে গিয়ে পড়ল সে। ঠাস্ করে ফেটে গেছে নাকের নরম হাড়। তীব্র ব্যথা পেয়ে কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল সে। সরসর করে নেমে গেল বরফ-ঢাকা সামনের উঠনে। ভাঙা নাকের তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ ও টাক। একবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল, তার শরীরে আর কোন নেই!

মৃদু আলোকিত হেলথ স্পা-র লবির দিকে তাকাল রানা। এখানে-ওখানে দামি অ্যাডিডাস জিম ব্যাগ। ওকে কৌতূহলী চোখে দেখছে সুন্দরী ক’জন তরুণী। দৃষ্টিতে মিশ্র অনুভূতি- রাগ, ভয়, বিস্ময় আর প্রশংসা।

নিউ টাউন হেলথ সেন্টারটাকে সিঙ্গলস্ বার বা নামকরা কোন কাউন্টি ক্লাবের মিশেল বলে মনে হলো রানার। গোপন বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি দামি আসবাবপত্র। বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখছে অন্তত দশজন পুরুষ। যদিও তাদেরকে পাত্তা দিল না রানা। ভাল করেই জানে; মূল্যবান ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারে পেশিবহুল হয়ে উঠলেও প্রচণ্ড পরিশ্রম করে না এরা। তাই শরীরে নেই পর্যাপ্ত শক্তি। বাজি ধরে বলতে পারবে রানা, কমাণ্ডো সার্ভাইভাল ট্রেনিং-এ নিলে দু’ঘণ্টার ভেতরে এরা হয়ে উঠবে চরম অসুস্থ। নিয়মিত স্কচ উইস্কি আর সোডা গেলার পরেও প্রতিদিন মাত্র একঘণ্টা মেশিনে ব্যায়াম করেই ধরে নিয়েছে, তারা আসলে হয়ে গেছে সত্যিকারের কঠিন পুরুষ।

মাফিয়ার যেসব হেলথ ক্লাব আছে, সেখানে ব্যায়াম করতে আসা প্রখ্যাত ডাক্তার, নামকরা উকিল আর টাকাওয়ালা বিজ্ঞাপন-নির্মাতাদেরকে একদম পছন্দ করে না রানা। লবিতে থেমে পকেট থেকে আপেলের মত কী যেন বের করল ও। সবার চোখ গিয়ে পড়েছে টেনিস বলের মত জিনিসটার ওপরে। পরক্ষণে সবাই বুঝে গেল, ওটা একটা তাজা গ্রেনেড!

হঠাৎ করেই নতুন এই যুবকের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারাল লবির সবাই। সুদর্শন পুরুষ ও সুন্দরী যুবতীদের ভেতরে শুরু হলো তীব্র প্রতিযোগিতা-কে আগে বেরোবে কাছের দরজা দিয়ে!

পিন খুলে সবুজ আপেলটা লবির এককোণে ছুঁড়ে দিল রানা। ওটা মেঝেতে পড়ার আগেই ঘুরে তাকাল অন্যদিকে। ক্লাব ঘরের একদিকে ডেস্কের পেছনে বসে আছে এক তরুণী রিসেপশনিস্ট। ভয়ে জমাট বেঁধে গেছে। ডেস্কের কাছে রানা যাওয়ার আগেই বিকট শব্দে ফাটল গ্রেনেড। কালো ধোঁয়া ছিটকে বেরিয়ে ছেয়ে দিল গোটা ঘর। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে রানার দিকে চেয়ে রইল রিসেপশনিস্ট, মুখে রা নেই।

আতঙ্ক কমাতে আলতো হাতে তার বাহু স্পর্শ করল রানা। গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই যেন পালিয়ে যেতে পারে ক্লাবের সাধারণ সদস্যরা, তাই ফাটিয়ে দিয়েছে গ্রেনেড। ‘অ্যালডো রসি,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘তার অফিসটা যেন কোথায়?’

এরই ভেতরে ফাঁকা হয়ে গেছে লবি। কঠোর চেহারার যুবকের প্রশ্ন শুনে আরও ফ্যাকাসে হলো রিসেপশনিস্টের মুখ। করিডরের দূরের এক দরজার দিকে চোখ গেল তার। বিড়বিড় করে বলল, ‘তিনি একটু আগে চলে গেছেন। আপনি আসলে এখানে কী চান? –

জবাব না দিয়ে ওকে কাঁচ ভাঙা দরজা দেখাল রানা। ‘এখানে গোলাগুলি হবে। তুমি নিজেও বরং চলে যাও।’

‘সতর্ক করলেন বলে ধন্যবাদ, স্যর।’ কাউন্টারের কাছ থেকে নড়ল না মেয়েটা। চেয়ে আছে দুর্দান্ত সুদর্শন শ্যামলা যুবকের দিকে। চোখে একরাশ কৌতূহল।

হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ পিস্তল বের করল রানা। দ্রুত চলে গেল রিসেপশন ডেস্কের পেছন-দেয়ালের কাছে। কাঁচের বক্সে ফায়ার অ্যালার্মের সুইচ। রানার ৪৪ ক্যালিবারের পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে ভাঙল গ্লাসের বক্স। সুইচ অন করে দিতেই বিকট শব্দে বেজে উঠল ফায়ার অ্যালার্ম।

চারপাশে স্মোক গ্রেনেডের ঘন কালো ধোঁয়া। রিসেপশন ডেস্কের উল্টোদিকে ঝট করে খুলে গেল একটা দরজা। ঘর থেকে ছুটে লবিতে বেরোল দু’জন লোক। তাদের চেহারা দেখলে যে-কেউ বুঝবে, মায়ের পেট থেকে নেমেই চুরি- ডাকাতি শুরু করে দিয়েছে এরা। লম্বা নলওয়ালা অস্ত্র হাতে কঠোর চেহারার রানাকে দেখে হোলস্টার থেকে পিস্তল নিতে গেল তারা। কিন্তু অস্ত্রের বাঁট ধরার আগেই ফায়ার অ্যালার্ম ছাপিয়ে পর পর দু’বার গর্জে উঠল অটোম্যাগ। বজ্রপাতের বিকট আওয়াজে কানে ঝিঁঝি ধরে গেল রিসেপশনিস্টের। অবাক হয়ে দেখল, হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠে করিডরের দূরের মেঝেতে গিয়ে পড়েছে দুই গুণ্ডা। তাদের বুকে মুঠো ভরে দেয়া যাবে এমন বড় দুই ফুটো। সেখান থেকে ঝরঝর করে ঝরছে তাজা রক্ত।

রিসেপশনিস্টের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। হতবাক হয়ে গেছে মেয়েটা। মানতে পারছে না যে চোখের সামনে খতম হয়ে গেছে দু’জন লোক!

‘তুমি বরং বাড়ি ফেরো!’ ফায়ার অ্যালার্মের আওয়াজের ওপর দিয়ে জানাল রানা।

এবার মাথা কাজ করল মেয়েটার। কাউন্টার ঘুরে ঝড়ের বেগে ছুটল কাছের দরজার দিকে। পাঁচ সেকেণ্ডে হারিয়ে গেল ঘন ধোঁয়ার ভেতরে। করিডর ধরে এগিয়ে চলল রানা। সামনে একে একে তিনটে ঘর। কাঁচের এক দেয়ালের ওপাশে সুইমিংপুল। অন্যদিকে র‍্যাকেটবল কোর্ট আর জগিং এরিয়া। সুইমিংপুলে ঢোকার দরজার ওপরে লেখা: অ্যাওরোবিক এক্সারসাইয, সৌনা, হুইর্লপুল, স্টিম অ্যাণ্ড তাই কোয়ান ডো রুম।

করিডর ধরে হেঁটে চলেছে রানা। সামনেই খোলা এক বড় দরজা। ওপাশে আবছা আলোয় ভরা বাররুম। দরজা দিয়ে ঢুকে ঝট করে বামদিকে সরে গেল রানা। কোন গুলি এল না ওর দিকে। দেয়ালে বাতির বৈদ্যুতিক বোর্ড পেয়ে সুইচ টিপে দিল ও। মাথার ওপরে দপ করে জ্বলে উঠেছে কিছু এলইডি বাল্ব। ঘরটার একদিকে বারকাউন্টার, উল্টোদিকে ড্যান্স ফ্লোর। টেবিল আর বারকাউন্টারের ওপরে গোটা পাঁচেক আধখালি গ্লাস।

রানা ছাড়া ঘরের ভেতরে আর কেউ নেই। অটোম্যাগের বাঁট দিয়ে বাতির সুইচ বন্ধ করে করিডরে বেরিয়ে এল ও।

লবির কাছের করিডরে হাজির হয়েছে সশস্ত্র তিন গুণ্ডা।

দু’জনের হাতে পাম্প শটগান, অন্যজনের কাছে নাইন এমএম উযি সাবমেশিন গান। ঘন ধোঁয়ায় খক খক করে কাশছে তারা। এইমাত্র দেখেছে লবির আর্চওয়ের কাছে লাশ হয়ে গেছে দলের দু’জন। মুখ তুলেই সরাসরি রানাকে দেখতে পেল তারা। চট্ করে সরে যেতে চাইল পরস্পরের কাছ থেকে। ওপরে তুলছে অস্ত্রের নল। যদিও দেরি করে ফেলেছে। ‘করিডরের মাঝে থেমে অটোম্যাগের ট্রিগার পর পর তিনবার স্পর্শ করল রানা। ভয়ঙ্কর অস্ত্রটার নলের মুখ চিরে ছিটকে বেরোল কমলা আগুনের দীর্ঘ হলকা। প্রথম গুলি উড়িয়ে দিয়েছে উযির সাবমেশিন গানের মালিকের মাথা। পিছিয়ে গিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে লাশ। বুকে মস্ত গর্ত নিয়ে পাশের দেয়ালে পড়ল দ্বিতীয়জন। পিছলে মেঝেতে নেমে আসার আগেই বেরিয়ে গেছে প্রাণবায়ু। ঘুরে পালিয়ে যেতে চেয়েছে তৃতীয় গুণ্ডা। কিন্তু পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙে তার হৃৎপিণ্ডে ঢুকেছে রানার তৃতীয় বুলেট। বেকায়দা এক হোঁচট খেয়ে লবির কাছে ভূমিশয্যা নিল সে।

লাশ তিনটে একবার দেখে নিয়ে করিডরের শেষমাথা লক্ষ্য করে এগোল রানা। ওদিকের একটা দরজার ওপরে ছিল রিসেপশনিস্টের চোখ। দুটো দরজা পার করে তৃতীয় দরজার ওপরের নেমপ্লেট পড়ল ও অ্যালডো রসি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

এই লোকটাকেই হাতের মুঠোয় চায় রানা। ভাল করেই জানে, প্রমাণসহ ধরিয়ে দিলেও ক’দিনের ভেতরে আমেরিকার ফস্কা আইনের ফাঁক গলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবে সে। তখন নতুন করে চালু করবে ড্রাগ জয়েন্ট, পতিতালয়, পর্নোগ্রাফিক সিনেমা ‘হল; চলবে চুরি-ডাকাতি, খুন আর চাঁদাবাজির মচ্ছব। কিশোর গ্যাংগুলোর হাতে যাবে চোরাই অস্ত্র। রসির নির্দেশে বিনা বিচারে খুন হবে স্নিগ্ধা বা তুষারের মত নিরীহ মানুষ।

সুতরাং মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির মত ঠাণ্ডা মাথার খুনির বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!

ফিটনেট সেন্টারে তার কতজন স্যাঙাত আছে, জানা নেই রানার। বিশাল দালানে চলছে হৈ-চৈ। বোধহয় পরের দু’মিনিটে তারা খুঁজে নেবে ওকে। অবশ্য তাতে কিছুই আসবে যাবে না ওর। এখানে এসেছে রসিকে দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে। সেটা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতেও আপত্তি নেই ওর। রিসেপশনিস্ট আগেই বলেছে, ক্লাব থেকে চলে গেছে মাফিয়া ডন। সেক্ষেত্রে তার দলের গুণ্ডারা খতম হলে পরিষ্কার একটা বার্তা পাবে সে। বুঝে যাবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে শিকাগো শহরে এসেছে বাঙালি এক যুবক। মানুষটা এমনই একজন, যাকে কোনভাবে ভয় দেখাতে পারবে না মাফিয়া ডন।

প্রচণ্ড এক লাথি মেরে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরের দরজা খুলল রানা। একদিকের দেয়ালে ঠাস করে লেগে ভেঙে গেল কবাটের লোহার দুটো কবজা। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল রানা, পরক্ষণে সরে গেল একদিকের দেয়ালের কাছে।

দামি আসবাবপত্রে সাজানো ঘরে কেউ নেই এখন। একদিকে প্রকাণ্ড ডেস্ক। আরেকটু বড় হলে রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করতে পারত ৭৭৭ বোয়িং বিমানের পাইলট। বুক পকেট থেকে একটা ভিযিটিং কার্ড নিয়ে ডেস্কের ওপরে রাখল রানা। বেরিয়ে এল করিডোরে।

হঠাৎ করে বিশাল দালানে থেমে গেল ফায়ার অ্যালার্মের আওয়াজ। র‍্যাকেটবল কোর্টে উত্তেজিত ক’জনের কণ্ঠস্বর।

তারা হাজির হবে বলে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে রানা।

একমিনিট পর র‍্যাকেটবল কোর্টের দরজায় উঁকি দিল মাফিয়ার দুই গুণ্ডা, হাতে নলকাটা দুটো শটগান। লবিতে রক্তাক্ত পাঁচটা লাশ দেখে নার্ভাস হয়ে গেছে তারা।

ধূসর ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে তাদেরকে দেখছে রানা। ট্রিগার স্পর্শ করতেই বুম করে উঠল হাতের অটোম্যাগ। র‍্যাকেটবল কোর্টের দরজার কাছে গাছ থেকে পড়া বেলের মত দু’ভাগ হলো একজনের মাথা। অন্যজন ঘরের ভেতরে কাছিমের মত টেনে নিল গলা। সামনে বেড়ে কাছের ফায়ার একযিটের স্টিলের বার-এ লাথি বসাল রানা। কিন্তু একতিল নড়ল না ওটা। লক করে রাখা হয়েছে দরজা।

বদ্ধ জায়গায় অটোম্যাগের গুলির আওয়াজে থরথর করে কাঁপল করিডর। প্রচণ্ড শক্তিধর বুলেট চুরমার করে দিয়েছে ফায়ার একযিটের তালার মেকানিযম। নতুন ম্যাগাযিন অস্ত্রে ভরে দরজা খুলে দালানের বাইরে চলে এল রানা।

আবছা আঁধারে পার্কিংলটের দিকে এগিয়ে পাশ কাটাল দুর্গন্ধময় এক ডাম্পস্টার। তপ্ত অটোম্যাগের নলের মুখ দিয়ে চুইয়ে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। আশপাশে শত্রুপক্ষের কাউকে দেখলে গুলি করতে দেরি করবে না রানা। দালানের কোনা ঘুরে পৌঁছে গেল পার্কিংলটের কোণে। আর তখনই দেখতে পেল বিপদগ্রস্ত মেয়েটাকে।

তিন

যুবতীকে টেনে-হিঁচড়ে কালো লিংকন গাড়িটার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে তিন গুণ্ডা। এরা যে অ্যালডো রসির লোক, তাতে মনে কোন সন্দেহ থাকল না রানার। দুই গুণ্ডার গায়ে ফারের দামি টপকোট। দু’হাতে যুবতীর দু’বাহু চেপে ধরেছে তারা। মেয়েটার বয়স বড়জোর পঁচিশ। মাথায় কালো দীর্ঘ চুল, পরনে জ্যাকেট ও লেভি প্যান্ট। লিংকন আর একটা ফেরারি গাড়ির মাঝে ওকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে তিন মস্তান। রানার মনে আছে, একটু আগেও পার্কিংলটে ছিল না লিংকন। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই ওটাতে করে এসেছে গুণ্ডাদের দু’জন।

লিংকন আর ফেরারি ছাড়া পার্কিংলটে এখন আছে শুধু রানার পোর্শে নাইন ইলেভেন। মেয়েটার কাছ থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে ওটা। এবার কী করবে সেটা ভাবতে শুরু করেছে রানা, তখনই শুনতে পেল দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন। ক্রমেই এগিয়ে আসছে বিশ্রী আওয়াজটা।

মেয়েটার বাহু শক্ত হাতে ধরেছে যে দুই গুণ্ডা, তাদেরকে সাহায্য করছে নাকফাটা সেই ডোরম্যান। প্রাণপণে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে মেয়েটা। হেলথ সেন্টারের দিকে ঘাড় কাত করে ষাঁড়ের মত চেঁচাল ডোরম্যান: ‘আমরা ওকে ধরেছি! জলদি! চলে এসো!’

তবে দালান থেকে সাড়া দিল না কেউ।

রানার ধারণা: আগেই ওর হাতে খুন হয়েছে বেশিরভাগ গুণ্ডা। লুকিয়ে পড়েছে অন্যরা।

এলইডি বালবের আলোয় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ডোরম্যানকে। নাকে-মুখে তাজা রক্ত। ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে চেয়ে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে কী যেন ফেরত চাইল।

দালানের ধারে আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে রানা। দু’হাতে শক্ত করে ধরেছে অটোম্যাগের বাঁট। মেয়েটার বিপদ হবে না সেটা বুঝতে পারলেই খতম করে দেবে তিন গুণ্ডাকে। লড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে গেছে মেয়েটা, তবে তখনই একথোকা থুতু ছুঁড়ল ডোরম্যানের মুখে।

মেয়েটার সাহস দেখে মৃদু হেসে ফেলল রানা। কাঁধের সমস্ত জোর দিয়ে যুবতীর গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিল টাকমাথা বাউন্সার। জোরাল ঠাস শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পেল রানা। হারামজাদা এতই জোরে মেরেছে, মাথা ঘুরে পার্কিংলটের তুষারে ভরা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেয়েটা। দু’দিক থেকে ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরেছে অন্য দুই গুণ্ডা। মেঘের মত কালো চুল ঢেকে দিয়েছে মেয়েটার মুখ। বুকের কাছে ঝুলে গেছে চিবুক।

এক সেকেণ্ডের জন্যে রানার মনে হলো, দেরি করে ফেলেছে ও। প্রচণ্ড চড়টা বোধহয় ভেঙে দিয়েছে বেচারির ঘাড়। পরক্ষণে রানা শুনতে পেল প্রাণপণ মেয়েলি চিৎকার।

মেয়েটার আর্তনাদ থামানোর জন্যে চুল খামচে ধরে ওপরের দিকে টান দিল ডোরম্যান। অন্যহাতে পকেট থেকে নিয়েছে সুইচব্লেড ছোরা। সুইচ টিপে দিতেই সড়াৎ করে বেরোল ছ’ইঞ্চি ইস্পাতের ফলা। আলোয় চকচক করছে ওটা। মেয়েটার কণ্ঠনালীতে ছোরার ডগা ঠেকাল বাউন্সার। কী যেন জানতে চাইল ঘড়ঘড়ে গলায়। বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। বারকয়েক মাথা নাড়ল। হয় প্রশ্নের জবাব জানে না, অথবা বলবে না।

যুবতী এখন বসে আছে তুষারে ঢাকা মেঝেতে, আর এ- সুযোগে গুলি করবে ভাবল রানা। মেয়েটার চুল আরও জোরে ওপরে টানল ডোরম্যান। পরক্ষণে ছোরা দিয়ে পটাপট খুলে দিল বেচারির জ্যাকেট আর ব্লাউসের বোতাম। ফর্সা বুকে ছোরা ঠেকিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করল। আর তখনই গুলি করল রানা। দু’ শ’ চল্লিশ গ্রেইন বোটটেইল বুলেটের আঘাতে ঠাস শব্দে কয়েক টুকরো হলো ডোরম্যানের মাথার খুলি। ধপ করে পার্কিংলটের মেঝেতে পড়ল লাশ।

অটোমেটিক পিস্তলের বিকট গর্জনে চমকে গিয়ে যুবতীর হাত ছেড়ে দিয়েছে বামদিকের গুণ্ডা। অস্ত্র বের করতে চাইল সে। এদিকে লিংকন গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে উঠেছে এক লোক। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির পেছনের সিটে যুবতীকে তুলতে চাইল ডানদিকের গুণ্ডা। বামদিকের গুণ্ডা পিস্তল বের করার আগেই ‘বুম!’ শব্দে আবারও গর্জে উঠল রানার অটোম্যাগ। ওটার বুলেটের প্রচণ্ড আঘাতে পাশের ফেরারি গাড়ির বনেটের ওপরে গিয়ে পড়ল বামদিকের গুণ্ডা, বুকে মস্ত এক গর্ত। বনেট থেকে পিছলে পার্কিংলটের মেঝেতে নেমে এল তার মৃতদেহ।

রানা তৃতীয়বার গুলি করার আগেই মেয়েটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছে ডানদিকের গুণ্ডা। ধুপ করে আটকে নিল দরজা। চাকা পিছলে রওনা হলো লিংকন, ক্রমেই বাড়ছে ওটার গতি। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিয়ে এক শ’ আশি ডিগ্রি ঘোরানো হলো ক্রু-ওয়্যাগান। পার্কিংলটের গেট লক্ষ্য করে রকেটের বেগে ছুটল গাড়িটা।

এদিকে অটোম্যাগের প্রচণ্ড রিকয়েলের কথা মাথায় রেখেছে রানা। দালানের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পর পর তিনবার গুলি পাঠাল বুলেটপ্রুফ গাড়িটার দিকে।

লিংকনের বড়িতে পিছলে গিয়ে কমলা আগুন ছিটিয়ে কোথায় যেন চলে গেল তিন প্রজেকটাইল। যুদ্ধের ভারী ট্যাঙ্কের মত পেছনদিক হড়কে রাস্তায় নেমে গেল গাড়িটা। পরের দু’সেকেণ্ডে উধাও হলো রানার চোখের সামনে থেকে।

সরাসরি উত্তরদিকে চলেছে ওটা। একদৌড়ে পার্কিংলটে চলে এল রানা। পোর্শের কাছে পৌছুতে ওর লাগল মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড। চট্ করে দেখল বনেট বা বডিতে সন্দেহজনক তার, ডেটোনেটর বা কোন প্যাকেজ আছে কি না।

না, তেমন কিছু নেই।

দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। পরক্ষণে চাবিতে মোচড় দিতেই গর্জন ছাড়ল পোর্শে নাইন ইলেভেন। গাড়ির দরজা আটকে নিয়ে পার্কিংলট থেকে বেরোবার জন্যে মিসাইলের গতি তুলল রানা। ভাবছে: মাফিয়াদের ক্লাবে কে বা কারা হামলা করেছে, সেটা এখনও জানে না গুণ্ডারা। অবশ্য বসের টেবিলে ওর ভিযিটিং কার্ড পেলে সবই জানবে তারা।

ডোরম্যান আর এক গুণ্ডার লাশ মাড়িয়ে যাওয়ার সময় দুলে উঠল পোর্শে। পরের তিন সেকেণ্ডে নেমে এল রাস্তায়। কয়েক ব্লক দূরে রানা দেখতে পেল লিংকনের লাল টেইল- লাইট। সাঁৎ করে পিছিয়ে গেল ফিটনেস সেন্টার। ওটার পার্কিংলট, ধোঁয়াভরা লবি আর করিডরে বেশ ক’টা লাশ পাবে পুলিশের লোক। আজকের এই রাত ফুরোবার আগেই হয়তো ওর হাতে মরবে আরও অনেকে। অথবা, রানা নিজেই হয়তো বিদায় নেবে দুনিয়া থেকে।

সামনের মোড়ে গতিহ্রাস না করেই রাবার পুড়িয়ে কর্কশ আওয়াজ তুলে বাঁক নিল রানা। নতুন করে দাবিয়ে দিল অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল। হোলস্টারে রাখল অটোম্যাগ। পরক্ষণে রিগ থেকে নিল বেরেটা। অস্ত্রটা রেখে দিল পাশের সিটে। রাস্তার দু’পাশে সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে পড়ছে বিশাল সব বাড়ি। লিংকনের পেছনে প্রায় উড়ে চলেছে রানার পোর্শে।

একটু আগে দেখা ফেরারির কথা মনে পড়ল ওর। পোর্শের হেডলাইটের আলোয় দেখেছে ওটার লাইসেন্স প্লেট। গাড়িটার মালিক আসলে কে, সেটা অনায়াসে জানতে পারবে পুলিশের লোক। অথচ ওর উপায় নেই সেটা জানার। অবশ্য শিকাগো পুলিশের ডেটাবেজ হ্যাক করে তথ্যটা হয়তো জানাতে পারবে বিসিআই-এর কমপিউটার জাদুকর রায়হান রশিদ।

নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের লড়াকু সেই মেয়েটার কথা মনে এল রানার। খুন না হয়ে গিয়ে থাকলে সে আছে লিংকন গাড়ির পেছনের সিটে। বেচারিকে উদ্ধার করা এখন নিজের দায়িত্ব বলেই মনে হচ্ছে ওর।

সামনের পথ সোজা চলে গেছে বহু দূরে। অনেক এগিয়ে আছে লিংকন। ওটার ড্রাইভার ব্রেক করতেই জ্বলে উঠল পেছনের লাল বাতি। পরক্ষণে একটা চৌরাস্তা পেরিয়ে উধাও হলো গাড়িটা।

নিজেও তুমুল বেগে চলেছে রানা। চাপা গর্জন ছাড়ছে পোর্শে নাইন ইলেভেনের ইঞ্জিন। কনকনে শীতের ভেতরেও ঘেমে গেছে রানার কপাল। পেছনে শুনতে পেল পুলিশের সাইরেন। কাছে চলে এসেছে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ। চট্‌ করে রিয়ারভিউ মিরর দেখে নিল রানা। ওর দু’ব্লক পেছনে ছুটে আসছে পুলিশের দুই সুপার চার্জড় ক্রুযার।

লিংকন যেদিকে গেছে, চাকার তীব্র আওয়াজ তুলে সে- পথে বাঁক নিল রানার পোর্শে। অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে গাড়ির গতি আরও বাড়াল ও। মনে আশঙ্কা সামনের কোন এক বাঁকে হারিয়ে যাবে লিংকন। এদিকে ওর পেছনে তীব্র বেগে আসছে পুলিশের দুই গাড়ি।

পরের বাঁক নেয়ার আগে ফুটপাথে উঠে পড়ল পোর্শের সামনের চাকা। রাবার পুড়িয়ে আবার রাস্তায় নামল রানা।’ পোর্শের নিচ থেকে এল চাকা ঘষটে যাওয়ার কর্কশ আওয়াজ। একবিন্দু গতি না কমিয়ে ঝড়ের বেগে সামনের মোড়ে বাঁক নিল ও। দূরে দেখতে পেল কমার্শিয়াল রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে চলেছে লিংকন।

এদিকটা বাণিজ্যিক এলাকা, তার ওপরে রাত নেমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তার দু’পাশের বেশিরভাগ দোকান ও পেট্রল স্টেশন। মাঝে মাঝে পেছনে পড়ছে একটা-দুটো খোলা জেনারেল স্টোর। ইঞ্জিন থেকে সব শক্তি নিংড়ে নিচ্ছে লিংকনের ড্রাইভার। একই কাজ করছে রানা। ওর পেছনে আসছে পুলিশের দুই সুপার চার্জড় গাড়ি। রাতের আঁধারে চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাইরেনের আওয়াজ আর লাল-নীল আলো।

পেছনে চাকার কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেল রানা। একটা ক্রুয়ারের পেছনে আসছে অন্যটা। এইমাত্র চৌরাস্তায় বাঁক নিয়ে বাণিজ্যিক রাস্তায় এসে পড়েছে ও-দুটো। লিংকন আর রানার পোর্শে যেন পলাতক দুই খরগোশ, আর পেছনের দুই পুলিশ যার ক্ষ্যাপা দুটো হাউণ্ড।

রানার ধারণা: এরই ভেতরে রেডিয়োতে ব্যাকআপ চেয়েছে পুলিশ অফিসারেরা। ফলে চারদিকের এলাকা থেকে যে-কোন সময়ে আসবে একের পর এক পুলিশ যার, আটকে দেবে সামনের সব পথ। সেক্ষেত্রে আর কিছুই করার থাকবে না ওর। পোর্শের চালককে হাতের মুঠোয় পেলেই খুশি হয়ে উঠবে তারা। জানতেও চাইবে না, লিংকনে করে ধরে নিয়ে গেছে কিডন্যাপড্ এক অসহায় মেয়েকে। এদিকে বেআইনি অস্ত্রসহ ধরা পড়লে গ্রেফতার হবে রানা। আর এ- সুযোগে হাসতে হাসতে উধাও হবে কিডন্যাপারেরা।

আইনরক্ষকদের সঙ্গে গোলাগুলিতে জড়াতে চায় না ও। অথচ প্রতি ব্লকে ওর পোর্শের দিকে এগিয়ে আসছে পুলিশের ক্রুযার। অফিসারেরা শুধু পালন করছে নিজ নিজ দায়িত্ব। সুতরাং নৈতিকভাবে তাদেরকে গুলি করতে পারবে না রানা। বিপদের মাত্রা বুঝে শুকিয়ে গেল ওর গলা।

মাটিতে বিছিয়ে দেয়া ফিতার মত সোজা চলে গেছে রাস্তা। রানার সামনে তুফান বেগে উড়ে চলেছে লিংকন গাড়িটা। এদিকে পেছনে আসছে তীব্র বেগে পুলিশ ব্রুযার।

চট্ করে একবার রিয়ারভিউ মিরর দেখল রানা। আবার সামনে চোখ যেতেই ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এবার বোধহয় খুলবে ওর কপাল। পথের ধারের এক পার্কিংলট থেকে বেরোচ্ছে পুরনো লম্বাটে এক পিকআপ। ঝোড়ো বেগে ওটাকে পাশ কাটাল লিংকন। পথে উঠে আসার আগেই গাড়িটাকে পেরোতে পারল রানা। ওটার ড্রাইভার মাথামোটা ধরনের মানুষ। ধরেই নিয়েছে, পুলিশের ক্রুযারদুটো আসার আগেই ঘোরাতে পারবে নিজের গাড়ি। জানা নেই কতটা বেগে আসছে পুলিশের ক্রুযার।

পিকআপটা পথে ওঠার আগেই ওটাকে পেরোল পুলিশের সামনের ক্রুযার। কিন্তু পেছনের গাড়ির বাম্পারে বেধে গেল পিকআপের নাক। রানা রিয়ারভিউ মিররে দেখল, পথের মাঝে চরকির মত ঘুরছে পেছনের ক্রুযার। একটা লাইট পোস্টে গুঁতো মেরে থামল ওটা। দু’ভাঁজ হয়ে গাড়ির বনেটে ধুপ করে পড়ল সরু থাম। শীতের রাতে ক্রুয়ারের ভাঙা রেডিয়েটর ভুসভুস করে ছাড়ছে সাদা বাষ্প।

কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও রিয়ারভিউ মিরর দেখল রানা। নেমে যার যার গাড়ির ক্ষতি বুঝে নিতে চাইছে পিকআপের ড্রাইভার আর দুই পুলিশ অফিসার। কেউ আহত নয় তারা। এদিকে সঙ্গীরা সুস্থ আছে কি না তা বুঝতে গিয়ে গতি কমিয়ে দিয়েছে রানার পিছু নেয়া ব্রুয়ারের ড্রাইভার।

বাড়তি এ-সময়টা হাতে পেয়ে পেছনের ক্রুযার থেকে বহু দূরে সরে এল রানা। বাঁক নিয়ে লেকশোর ড্রাইভে পড়ল লিংকন ও পোর্শে। সামনে শিকাগোর ডাউনটাউন বিযনেস লুপ। শহরের মাঝারি সব রাস্তার চেয়ে চওড়া। বেশিরভাগ সময় এ-পথে চলে প্রচুর গাড়িঘোড়া। তবে আজ কোন ভিড় নেই। রানার কান কালা করে দিয়ে জোরালো গর্জন ছাড়ছে পোর্শে। একপাশে লেক মিশিগানের বালিভরা সৈকত। এক শ’ ত্রিশ মাইল বেগে গাড়িটাকে পথে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রানা। এখন মাত্র পনেরো গজ সামনে লিংকন। বামহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখে ডানহাতে পাশের সিট থেকে রেরেটা ৯৩-আর নিল ও। দেরি না করে অফ করল ওটার সেফটি ক্যাচ। এখন ট্রিগার টিপে দিলেই প্রতিবারে বেরোবে তিনটে করে গুলি।

লিংকন বুলেটপ্রুফ, ওটার ভেতরে গুলি ঢুকবে না। তবে চাকা কখনও গুলি নিরোধক হয় না। যে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে, তাতে চাকা ফেটে গেলে যে-কোন সময়ে উল্টে পড়বে গাড়িটা। সেক্ষেত্রে আহত বা নিহত হবে মেয়েটা। অবশ্য এরই ভেতরে হয়তো ওকে খতম করেছে খুনিরা।

লিংকনের ড্রাইভার নিশ্চয়ই চাইবে না ঘটে যাক মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা। সুতরাং গুলি করে চাকা ফুটো করা হলে যত দ্রুত সম্ভব গতি কমাবে সে। আর সে সুযোগে খুনিদের হাত থেকে মেয়েটাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারবে রানা।

আমেরিকার অন্যান্য শহরের চেয়ে দক্ষ শিকাগোর ট্রাফিক পুলিশ। চারপাশ থেকে জাল গুটিয়ে এনে দু’চার মিনিটের ভেতরে লেকশোর ড্রাইভ বন্ধ করে দেবে তারা। তখন কোনদিকেই যেতে পারবে না রানা। পোর্শের সাইড উইণ্ডো দিয়ে বের করে লিংকনের পেছনের চাকা লক্ষ্য করে বেরেটা তাক করল ও। তারই ফাঁকে দেখল, সামনের গাড়ির পেছনের সিটে ঘুরে জানালা দিয়ে অর্ধেক শরীর বের করেছে মাফিয়ার এক তস্কর। তুমুল বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে তার সোনালি চুল ও কালো কোট। লোকটার হাতে নলকাটা পাম্প শটগান। সরাসরি পোর্শের উইণ্ডশিল্ডের দিকে অস্ত্র তাক করল সে।

এবার কী ঘটবে সেটা বুঝে গেছে রানা। দেরি না করে পিছলে নেমে যেতে চাইল ড্রাইভিং সিটের সামনে। একহাতে একটু ঘুরিয়ে নিয়েছে স্টিয়ারিং হুইল। তবে তাতে কোন লাভ হলো না, পোর্শের ইঞ্জিনের ওপর দিয়ে এল বন্দুকের ভোঁতা ‘বুম্!’ গর্জন। হাজার টুকরো হয়ে ঝরঝর করে ওর ওপরে ঝরল সেফটি উইণ্ডশিল্ড। একেক টুকরো যেন ঝলমলে হীরার খণ্ড। উইণ্ডশিল্ড নেই বলে চৌকো ফাঁক দিয়ে হু-হু করে এল শীতল হাওয়া। রানা ঝট করে উঠে বসে টের পেল, কপাল বেয়ে নামছে সরু এক উষ্ণ স্রোত। মুখ না মুছে মাথা একদিকে কাত করল ও। এবার চোখে এসে পড়বে না রক্ত। বামহাত ওপরে তুলে টিপে দিল বেরেটার ট্রিগার।

লিংকনের পেছনের জানালা দিয়ে অর্ধেক দেহ বের করে ওকে দেখছে মাফিয়ার গুণ্ডা। অন্ধকারে তার হাতে সোনালি আগুনের ঝিলিক দেখল রানা। আবারও গুলি করেছে লোকটা। একই সময়ে বেরেটার নাইন এমএম প্যারাবেলাম বুলেট গেঁথে গেল, তার বুকে। হাত থেকে রাস্তায় পড়ে ছিটকে আরেকদিকে গেল শটগান। পরক্ষণে কাত হয়ে গাড়ি থেকে খসে পড়ল মাফিয়ার গুণ্ডার লাশ।

গতি না কমিয়ে শটগান আর ওটার মালিকের ওপর দিয়ে পেরোল পোর্শে। রিয়ারভিউ মিররে রানা দেখল, গোলাগুলি হচ্ছে জেনেও গতিহ্রাস করেনি পুলিশের ক্রুয়ারের ড্রাইভার। এখন আছে মাত্র সিকি মাইল দূরে। পুলিশের অফিসারদেরকে রক্তের গন্ধ পাওয়া ক্ষ্যাপা হাঙরের মত বলে মনে হলো ওর।

ক্রুয়ারের পেছনে আরও ক’টা পুলিশের গাড়ি। ওদিকে লেকশোর ড্রাইভের উত্তরদিক থেকে আসছে বেশকিছু জুয়ার। মিনিট চারেকের ভেতরে ধরা পড়তে চলেছে, বুঝে গেল রানা। লিংকনে এখন আছে শুধু ড্রাইভার আর সেই যুবতী। একদল শয়তানের বিরুদ্ধে বাঘিনীর মত লড়াই করেছে মেয়েটা। এখনও সে বেঁচে থাকলে রানার উচিত তাকে উদ্ধার করা। যদিও সেটা করতে গিয়ে নিজেই হয়তো গ্রেফতার হবে পুলিশের হাতে।

সামনের গাড়ির দিকে এক পশলা বুলেট পাঠাল রানা। লিংকনের পেছনের ডান চাকার রিমে লেগেছে একটা গুলি। রিমে পিছলে কমলা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি করে চাকার ভেতরে গিয়ে ঢুকল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে দুলতে লাগল লিংকন। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আবারও গাড়িটা সামলে নিল ড্রাইভার। দ্রুত কমছে লিংকনের গতি। পথ থেকে নেমে চলে গেল ঘাসে ভরা এবড়োখেবড়ো জমিতে

একটু দূরে সৈকতের ধারে বরফের মত শীতল মিশিগান লেক। লেকশোর ড্রাইভের ল্যাম্প-পোস্ট আর কোটি নক্ষত্রের মৃদু আলো থাকলেও আজ রাতে আকাশে নেই চাঁদ। লেকের ওদিকের তীরে বহুতল ভবনগুলোর জানালায় ঝলমল করছে বৈদ্যুতিক বাতি।

হোলস্টারে বেরেটা রেখে গাড়ির গতি কমিয়ে নিচু জমিতে নেমে এল রানা। এখন ওর কাছ থেকে মাত্র দশফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লিংকন। পোর্শে থেকে নেমে ওটার পাশে চলে গেল ও। কালচে সৈকতে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল একাধিক সাইরেনের কর্কশ আওয়াজ।

কোটের ভেতর থেকে অটোম্যাগ নিয়ে চাপা স্বরে নির্দেশ দিল রানা, ‘কোন চালাকি নয়! হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে এসো!’ কেউ না কেউ গাড়ি থেকে নামবে, ভাবছে ও।

লিংকনের ভেতরে জ্বলল হলদেটে বাতি। পরের সেকেণ্ডে যা বুঝবার সব বুঝে গেল রানা। ধীরে ধীরে খুলে গেছে লিংকনের সামনের দরজা। সামান্য ইতস্তত করে নেমে এল মেয়েটা। অটোম্যাগের ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে নিল রানা। মনে সন্দেহ রইল না, এই যুবতী নায়িকা সোফিয়া লরেনের চেয়েও সুন্দরী। যদিও এখন থমথম করছে মুখ। অচেনা এক লোকের হাতে ভয়ঙ্কর-দর্শন পিস্তল দেখে চোখে ভর করেছে আতঙ্ক। ধীরে ধীরে মাথার ওপরে তুলল দু’হাত।

লিংকনের ভেতরে চোখ বোলাল রানা। হলদেটে আলোয় স্টিয়ারিং হুইলের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ড্রাইভার। ঘাড় আর মাথার সংযোগে গেঁথে গেছে ছোট্ট এক পকেট নাইফ। বাঁচার উপায় ছিল না তার।

রানা যখন শটগানসহ মাফিয়ার গুণ্ডাকে গুলি করে গাড়ি থেকে ফেলল, একই সময়ে পেছনের সিটে একা হয়েছে মেয়েটা। আর তখনই নিয়েছে সুযোগ। ড্রাইভার খুন হতেই সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে চলে এসেছে সে। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে নেমে গেছে সৈকতে।

সত্যিকারের সাহসী মেয়ে, ভাবল রানা। গাড়ির ভেতরের বাতি নিভিয়ে লাথি মেরে বন্ধ করল লিংকনের দরজা। কয়েক পা সরে মুখোমুখি হলো মেয়েটার।

ভয় পেয়ে সরে গেল না যুবতী। নিচু গলায় শুধু জানতে চাইল, ‘কে আপনি? আপনি তো মাফিয়া অথবা পুলিশের কেউ নন!’

‘আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নরম সুরে বলল রানা, ‘নাম কী তোমার?’

‘লিউনা, লিউনা গার্ডনার,’ চাপা শ্বাস ফেলল মেয়েটা। লিউনা শকের ভেতরে আছে ভেবে চট করে ওর হাত ধরল রানা। আপত্তি করল না লিউনা।

‘আমাকে তুমি করে বলতে পারো,’ বলল রানা। ‘এসো, পুলিশ আসার আগেই সরে যেতে হবে। নাকি তুমি চাও তাদের সঙ্গে কথা বলতে?’

‘পুলিশের সঙ্গে? নাহ্!’ চমকে গেল মেয়েটা।

লিউনাকে নিয়ে লিংকন থেকে সরে এল রানা। দ্রুত হেঁটে চলেছে লেকশোর ড্রাইভের সবচেয়ে জনবহুল আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে। পুলিশের লোক এদিকের এলাকা ঘিরে ফেলার আগেই তাদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

রানার পাশে নরম বালি মাড়িয়ে ছুটে চলেছে মেয়েটা। মৃদু খস খস আওয়াজ তুলছে জুতো।

‘লোকগুলো তোমার কাছে কী চেয়েছিল?’ জগিঙের বেগে এগিয়ে চলেছে রানা। ডানহাতে ঝুলছে অটোম্যাগ।

‘ধরে ফেলেছিল,’ ছোটার ফাঁকে জানাল লিউনা। ‘আমি আসলে… একটা হোমিং ডিভাইস রেখেছিলাম।’

‘ফেরারি গাড়িটাতে?’

মৃদু মাথা দোলাল লিউনা। ‘হ্যাঁ, ওটা সিনেটরের গাড়ি।’ রানার পেছনে এসেছে যে ব্রুযার, এইমাত্র লিংকন আর পোর্শের কাছে এসে থামল ওটা। গাড়িটার জোরালো আলো এসে পড়েছে লেকতীরের সৈকতে। দূর থেকে দেখে রানার মনে হলো, অন্ধকারে ওর দিকে চেয়ে আছে কোন দানবের জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। দু’সেকেণ্ড পর দুই হেডলাইটের সঙ্গে যোগ দিল শক্তিশালী এক স্পটলাইট। মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল রানা, ‘বালিতে শুয়ে পড়ো!’

ওর পেছনে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লিউনা। নিচু গলায় বলল, ‘ভুলেও পুলিশদেরকে খুন কোরো না!’

‘ভেবো না,’ বলল রানা। পরক্ষণে ওর হাতে বজ্রপাতের আওয়াজ তুলল অটোম্যাগ। সঙ্গে সঙ্গে চুরচুর হয়ে ভেঙে গেল স্পটলাইট। দপ করে নিভে গেছে শক্তিশালী আলোটা।

এবার পালিয়ে যেতে হবে সেটা জানাবার জন্যে লিউনার দিকে ফিরল রানা। কিন্তু আশপাশে কোথাও নেই মেয়েটা!

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল রানা।

সাইরেন বাজিয়ে পথের ধারে থামল একের পর এক পুলিশের জুয়ার। ধুপধাপ আওয়াজে খুলে যাচ্ছে দরজা। পেভমেন্টে নেমে সৈকত লক্ষ্য করে ছুটে এল অফিসারেরা।

আবছা আলোয় তাদের রাগান্বিত চেহারা দেখতে পেল রানা। সবার হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল।

লেকটাকে পাশে রেখে ক্ষিপ্র চিতার বেগে ছুটে চলল রানা। তারই ফাঁকে ভাবল: সাধ্যমত করেছি মেয়েটার জন্যে। সঙ্গে আসবে না সে। সুতরাং আর কিছু করার নেই।

রাত মোটেই গভীর নয়। যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে নিতে হবে মাফিয়া ডন রসিকে। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে ইউএস সিনেটরের কীসের সম্পর্ক, সেটাও জানতে হবে। লিউনা বোধহয় বহু কিছু জানত। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনকিছুই জানা গেল না।

এখন ওর প্রথম কাজ হবে পুলিশ কর্ডন এড়িয়ে নিরাপদ কোথাও পৌঁছে যাওয়া। পোর্শে সার্চ করে দেখবে পুলিশের লোক। পরে তল্লাসী করবে লিংকন গাড়িটা। তখন ওটার ভেতরে পাবে লাশ। অফিসারেরা ছড়িয়ে পড়বে সৈকতে। সন্দেহজনক কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলে আগে গুলি করে পরে কথা বলবে। সুতরাং, তাদের জাল ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া এখন খুব জরুরি। আর সেজন্যে চাই সামরিক দক্ষতা ও অঢেল সৌভাগ্য। সৈকত মাড়িয়ে আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে প্রাণপণে ছুটে চলল রানা।

চার

স্রেফ কপাল গুণে লেকের তীর থেকে পালিয়ে এসেছে রানা, বিষয়টা তেমন নয়। শত্রু-এলাকায় হামলা করে অক্ষত শরীরে ফেরার জন্যে মাসের পর মাস কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে ওকে। তবুও পুলিশের কর্ডন ভেদ করতে গিয়ে ওর লেগেছে পনেরো মিনিট। দু’বার ক’জন পুলিশ অফিসারের তিনফুট দূর দিয়ে যেতে গিয়ে ছুটে গেছে কালঘাম। এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ায় সরে গেছে প্রেতাত্মার মত। তারপর রাস্তায় উঠে সহায়তা পেল এক ক্যাব ড্রাইভারের কাছ থেকে। হাত নাড়তেই থামল সে। শহরের মাঝে পৌঁছে গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে ক্যাব থেকে নেমে পড়েছে রানা। স্মার্টফোনে আগেই কথা বলেছে আতাউল কবীরের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর সতেরো সালের পোর্শে নাইন ইলেভেন নিয়ে হাজির হলো সে। এটাও ভাড়া করা। গাড়িটা রানাকে বুঝিয়ে দিয়ে বাসে চেপে চলে গেল শহরের অন্যপ্রান্তে। পেছনে ফেউ নেই বোঝার পর ফিরে গেছে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। এদিকে দরকারি জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে সেফহাউসে ফিরে এসেছে রানা।

তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে একটু আগে হাজির হয়েছে ধনী-এলাকা লেক ফরেস্টে। ওর পরনে কালো স্কিন-স্যুট। ডান ঊরুতে অটোম্যাগসহ হোলস্টার। বুকের পাশে খাপে ভরা কমব্যাট নাইফ। বামবাহুর পাশে স্পিড-রিগে বেরেটা। কোমরে বাড়তি গুলির ক্যানভাস পাউচ। বুকের ওয়েবিঙে কয়েক ধরনের গ্রেনেড। এ-ছাড়া ওর সঙ্গে আছে ইনফ্রারেড নাইট-ভিশন গগল্‌স্‌, তারের মৃত্যু-ফাঁস, দেয়াল বেয়ে ওঠার দড়ি ইত্যাদি।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চোখে নাইট-ভিশন গগল্স্ পরে ষাট গজ দূরে অ্যালডো রসির এস্টেটের মেইন গেট দেখছে রানা। ওর মনে হচ্ছে, মাফিয়া ডনের ম্যানশন যেন মধ্যযুগীয় কোন জমিদারের দুর্গের মত।

এবারের এই রেইডে বিসিআই সেফহাউস থেকে আরও নিয়েছে রানা ম্যাক সাউণ্ড সাপ্রেসরসহ ইনগ্রাম মডেল-১০ এসএমজি। ওর বামকাঁধে ফিতা থেকে ঝুলছে অস্ত্রটা। মাত্র দুই সেকেণ্ডে উঠে আসবে হাতের মুঠোয়। এ-ছাড়া ওর সঙ্গে আছে বিশেষ একটি জ্যামার। ইসরায়েলি আর্মির জন্যে ম্যাচ- বক্সের মত ছোট্ট অত্যাধুনিক যন্ত্রটা তৈরি করেছে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা। ওটা চালু করা হলে সত্তর গজের ভেতরে রেডিয়ো, মোবাইল ফোন, সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি বিকল হয়ে যায়। কয়েক মাস আগে সিরিয়ায় কঠিন এক অ্যাসাইনমেণ্টে গিয়ে জ্যামারটা হাতে পায় বিসিআই এজেন্ট তুফান আরেফিন। পরের মাসে বিসিআই-এর টেকনিশিয়ানেরা জেনে গেল ওটার ভেতরের গুমর। এরপর একই জিনিস তৈরি করে বিসিআই-এর প্রতিটি সেফহাউসে রাখা হয়েছে একটা করে জ্যামার। দরকার হলে যেন ব্যবহার করতে পারে বাঙালি এজেন্টরা।

গাড়িটা সিকিমাইল দূরে রেখে পায়ে হেঁটে রসির এস্টেটের দক্ষিণে চলে এসেছে রানা। ওর বুঝতে দেরি হয়নি, কোথা দিয়ে ঢুকতে হবে ওকে। স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারে গিয়েছিল। তবে ওখানে ছিল না অ্যালডো রসি। এখন হয়তো বাড়িতেই আছে। সেক্ষেত্রে তাকে খুন করতে দেরি করবে না রানা।

জঙ্গলের ধারে ধনীদের দুর্গের মত সব ম্যানশন। চট্ করে বোঝা যায় না যে কোনদিক থেকে ওগুলো ডনের বাড়ি থেকে আলাদা। নিখুঁত, রুচিশীল ম্যানশনগুলোতে গার্ডবক্স নেই। অথচ রসির বাড়ির ভেতরে আছে শক্তপোক্ত গার্ডবক্স। ওটা দেখলে মনে হবে দুর্গম কোন কারাগার পাহারা দেয়ার জন্যে তৈরি। গেটের ওদিকে অস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে পায়চারি করছে দু’জন গার্ড। একঘণ্টা আগে নিউ টাউন হেলথ সেন্টারে হামলা হলেও মনে হচ্ছে না মানসিক কোন চাপে আছে তারা। গাড়ি নিয়ে গেট ভেঙে ঢুকলেও বাড়ির দিকে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথে গতি তুলতে পারবে না কেউ। দশফুট যাওয়ার আগেই ঝাঁঝরা হবে গার্ডদের রাইফেলের গুলিতে।

বাড়িতে বোধহয় এখন নেই অ্যালডো রসি, ধারণা করছে রানা। নইলে কম্পাউণ্ডে থাকত অন্তত দশজন গানম্যান। মাফিয়া ডন না থাকলেও বাড়িটা সার্চ করবে ও।

পাতাহীন ওক গাছের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগোল। একটু পর দেখতে পেল রসির বাড়ির গেটের কাছে থেমেছে একটা গাড়ি। চট্ করে নাইট-ভিশন গগল্স্ দিয়ে ওটার লাইসেন্স প্লেট পড়ল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ করে হেডলাইট অফ করেছে ড্রাইভার। বোধহয় এবার গাড়ি থেকে নামবে, ভাবল রানা।

দু’মিনিট পেরিয়ে গেলেও সিটেই বসে থাকল লোকটা।

বাড়ির দেয়ালের কাছে কালো প্লাস্টিকের কয়েকটা গার্বেজ ব্যাগ। আগামী ভোরে ওগুলো সরিয়ে নেবে মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক। নাইট-ভিশন গগল্স্ দিয়ে গাড়ির ভেতরে চোখ বোলাল রানা। আর কেউ নেই। সিটে বসে সিগারেট ফুঁকছে লোকটা। গাড়ির পেছন বাম্পারে স্টিকারে লেখা: আমি একজন পুলিশ। আর সেজন্যে আমি গর্বিত।

হঠাৎ এদিকে কেন এই লোক? – ভাবল রানা। আসলে হয়তো চরম দুর্নীতিপরায়ণ। টাকা খেয়ে বিক্রি হয়ে গেছে এমন পুলিশ অফিসারের অভাব নেই শিকাগোতে। ডিউটির পর এসেছে ডনের বাড়ি পাহারা দিতে। আবার হয়তো এই লোক সৎ এক পুলিশ অফিসার। জরুরি তদন্তের জন্যে চোখ রেখেছে রসিদের এস্টেটের ওপরে।

আপাতত জানার উপায় নেই কী তার উদ্দেশ্য।

গাড়ি ও গেটের কাছ থেকে সরে এস্টেটের দক্ষিণ-পশ্চিম দেয়ালের সামনে হাজির হলো রানা। পকেট থেকে নিয়ে চালু করল জ্যামার। মিলিটারি ওয়েবিং থেকে নিল রাবার দিয়ে মোড়া স্টিলের আঁকশিওয়ালা ক্লাইমিং রোপ। মাথার ওপর দু’বার ঘুরিয়ে দেয়ালের ওদিকে ফেলল দড়ি। টান দিতেই দেয়ালের ওদিকে আটকে গেল দুই আঁকশি।

দড়িতে বারদুয়েক টান দিয়ে রানা নিশ্চিত হলো, খুলে আসবে না ওটা। দেয়ালে উঠতে ওর লাগল মাত্র দশ সেকেণ্ড। বাগানের ভেতরে ফেলল দড়ি। তারপর সরসর করে নেমে এল এদিকে। বাগানের ভেতরে অন্ধকারে বসে থাকল ভূতের মত। হাতে ম্যাক-১০। উত্তরদিকে অন্তত এক শ’ গজ দূরে গেট। ওখানে পায়চারি করছে দুই গার্ড। আশপাশে আর কেউ নেই।

বাগানে ফার গাছের মাঝ দিয়ে বাড়ির দিকে গেছে সরু পিচ-ঢালা পথ। একটা বাতি জ্বলছে ম্যানশনের দোতলায়। দেয়ালের কাছ থেকে সরে ঝোপঝাড় ও ফার গাছের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বাড়ির দিকে চলল রানা। মাঝে মাঝে সতর্ক চোখে দেখছে দুই গার্ডকে। ভাবছে: বোধহয় তার স্যাঙাতদের ওপরে হামলা হওয়ায় গোপন কোন আস্তানায় চলে গেছে অ্যালডো রসি। তার পরিবার সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য দিয়েছে আতাউল।

একসময় নামকরা একটা বার অ্যাণ্ড রেস্তোরাঁর দারোয়ান ছিল অ্যালডোর বাবা অ্যাড্রিয়ানো রসি। শিকাগোর দুই মাফিয়া ডনের মধ্যে লড়াই শুরু হলে ফুটসোলজার হিসেবে যোগ দেয় জ্যাকো পেরেলের দলে। দুই ডনের মরণপণ যুদ্ধে বিজয়ী হয় পেরেলের মাফিয়া দল। এরপর পেরেলের মৃত্যু হলে পরের দশ বছরে মগজ খাটিয়ে দলের প্রধান হয়ে ওঠে অ্যাড্রিয়ানো রসি। জন্ম তার ষাট সালে। পঁচিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে ইতালিয়ান এক সুন্দরী তরুণীকে। সাতাশি সালে তাদের পরিবারে এল একমাত্র মেয়ে এলিসা রসি। এরপর তিরানব্বুই সালে জন্মাল ছেলে অ্যালডো রসি।

বাবা-মা-র কথা না শুনলেও বড়বোনের কথা মেনে চলত অ্যালডো। এখনও বিয়ে করেনি তার প্রিয় বড়বোন। মহিলার বয়স এখন সাঁইত্রিশ বছর। অনেকে বলে একত্রিশ বছর বয়সী ভাইটাকে মায়ের মত করে আগলে রেখেছে সে। দু’হাজার দশ সালে তাদের মা হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলে নিজেকে গুটিয়ে নেয় অ্যাড্রিয়ানো রসি। এরপর পাঁচবছর পর মারা যায় ক্যান্সারে। তাদের মাফিয়া দলের ডন হয় অ্যালডো রসি। শোনা যায় বাবার মত নয় সে। যত না ইতালিয়ান পুরুষ, তার চেয়ে বেশি আমেরিকান। ইউনিভার্সিটি থেকে নিয়েছে উচ্চতর ডিগ্রি। নানানদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের ব্যবসা। শিকাগোর রাজনীতিতে আছে তার জোরালো হাত। কেউ কেউ বলে অ্যালডো রসির মতামত না নিয়ে এক পা ফেলেন না একাধিক সিনেটর।

বাড়ির পেছনে এসে নিচতলায় কোন বাতি দেখতে পেল না রানা। এমনকী সামনের বারান্দাতেও আলো জ্বলছে না। অবশ্য অনেক সময়ে নিভিয়ে রাখা হয় মাফিয়া ডনের বাড়ির বেশিরভাগ বাতি, যাতে শত্রুরা মনে করে যে ওটা অরক্ষিত। যদিও ভুল এ-ধারণা করলে চরম মূল্য দিতে হয় যে-কাউকে।

লড়াইয়ের জন্যে পুরো তৈরি রানা। বাড়ির পেছনে সরু এক দরজা দেখে ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে ওখানে পৌঁছে গেল ও। নবে মোচড় দিয়ে দেখল দরজার তালা লক করা। ছোরা বের করে ওটার ডগা দিয়ে তালা খুলতে ওর লাগল বড়জোর দশ সেকেণ্ড। কবাট সরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পেল ওর দিকেই এগিয়ে আসছে কে যেন!

কবাট সামান্য ফাঁক করে রেখে বাইরে উঁকি দিল রানা। বাড়ির অন্য দুই গার্ডের মতই তৃতীয়জনের কাঁধে রাইফেল। বাড়ির পেছনের কোনা ঘুরে হাজির হয়েছে সে। শীতে বারবার মুঠো করছে হাত। নাইট-ভিশন গগল্‌স্‌ দিয়ে পরিষ্কার তাকে দেখছে রানা। সরু দরজার কাছে সে আসতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রানা। প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল লোকটার কানের নিচে। অচেতন দেহটা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই দু’হাতে ধরে ফেলল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে রানা, হুঁশ ফিরতে অন্তত দেড়ঘণ্টা লাগবে এ-লোকের। দেহটা টেনে নিয়ে ঘন এক ঝোপের ভেতরে গুঁজে রাখল ও। আবার ঢুকল গিয়ে বাড়ির ভেতরে। ডান বাহুর স্ট্র্যাপে রেখেছে ম্যাক-১০। সামান্য ঝাঁকি দিলেই হাতে উঠে আসবে অস্ত্রটা। হোলস্টার থেকে বেরেটা নিয়ে চারপাশ দেখল রানা। এটা বাড়ির কিচেন। আশপাশে কথাবার্তা বা নড়াচড়ার কোন শব্দ নেই। আঁধার কবরের মত থমথম করছে নিচতলা।

বৈদ্যুতিক বাতি না জ্বেলে নাইট-ভিশন গগল্স্ পরে পুরো নিচতলা ঘুরে দেখল রানা। কিচেন, ডাইনিংরুম, লিভিংরুম, ডেন, চারটে বেডরুম আর বড় এক স্টাডিরুম। শেষ ঘর ব্যবহার করে রসি। একদিকে বড় ডেস্ক। ওটার ওপরে প্রাচীন আমলের টেলিফোন। পাশেই ডিরেক্টরি আর প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া নোটবুক।

ডিরেক্টরি নিয়ে কালো স্যুটের ভেতরে গুঁজল রানা। স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠল দোতলায়। থামল ওপরের করিডরে। দু’পাশে ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। ওর ডানে অন্ধকার হলওয়ে গেছে বাড়ির শেষমাথা পর্যন্ত। মাত্র একটা দরজার তলা দিয়ে আসছে হলদে আলো। সেখান থেকে ভেসে এল কথা বলার আওয়াজ।

ওখানে আছে অন্তত দু’জন। পুরো দোতলা ঘুরে দেখার পর আলোকিত ঘরে ঢুকবে বলে মনস্থির করল রানা।

প্রথমতলার চেয়ে বেশি তথ্য দিল দোতলা। মেইন বেড রুমে পুরুষের দামি সব স্যুট দেখতে পেল রানা। খাটের পাশে নাইটস্ট্যাণ্ডে ছোট্ট নোটেশন প্যাড। কী যেন লিখে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে ওটার প্রথম পাতা। পরের পৃষ্ঠায় চেপে বসেছে কলমের নিব। টেবিল থেকে একটা পেন্সিল নিয়ে তেড়চাভাবে দাগের ওপরে শিষ বোলাল রানা। পরিষ্কার দেখতে পেল ভেসে উঠেছে একটা ফোন নাম্বার। বেডের পাশে বসে ফোনের রিসিভার নিল ও। নাম্বারগুলো ডায়াল করতেই কয়েকবার বেজে ওঠার পর ওদিক থেকে বলল এক নারীকণ্ঠ: ‘হার্বার ইয়ট ক্লাব।’

ক্রেডলে রিসিভার রেখে ঘর সার্চ করল রানা। এককোণের অ্যালকোভে বিশাল এক এলইডি স্ক্রিন। পাশের তাকে ডিভিডি প্লেয়ার আর পাহাড়ের মত উঁচু করে রাখা অসংখ্য ডিভিডি ডিস্ক। কয়েকটা খাপের লেখা পড়ে দেখল রানা।

জেনি।

জিমি।

জিনা।

কেন যেন ওর মন বলল, ডিভিডি প্লেয়ারে একটা ডিস্ক ভরে দেখে নেয়া উচিত ওটার কনটেন্ট।

সেটাই করল রানা। মাত্র পনেরো সেকেণ্ডে তেতো হয়ে গেল ওর মন। বাটন টিপে বন্ধ করল ডিভিডি প্লেয়ার। ভাবল, এখনই উচিত গুলি করে যন্ত্রটা চুরমার করে দেয়া।

শীতল রাগে ওর মগজে ধরে গেছে আগুন। ডিস্কে ছিল অসহায় নিষ্পাপ দুটো বাচ্চা মেয়ে। একদম উলঙ্গ। ওদের একজনের ওপরে চড়াও হয়ে রেপ করছে বছর তিরিশেকের এক পাষণ্ড। আর শুয়োরটা স্বয়ং ডন অ্যালডো রসি!

চোয়ালে চোয়াল চেপে নিজেকে শান্ত করতে চাইল রানা। মনে মনে বলল, যে-কাজে এসেছ, ঠাণ্ডা মাথায় সেটা শেষ করো। রসির বেডরুম থেকে করিডরে এসে আলোকিত ঘরের দিকে চলল রানা, হাতের মুঠোয় বেরেটা। সামনের ঘরটা সার্চ করা শেষ হলেই বিদায় নেবে এ-বাড়ি ছেড়ে।

কার্পেট বিছানো করিডরের দু’দিকের দেয়ালে আধুনিক সব দামি তৈলচিত্র। সামনের ঘর থেকে এল চাপা উত্তপ্ত বিতণ্ডা। খেপে গিয়ে বলল নারীকণ্ঠ: ‘সবই বুঝতে পেরেছি! তুমি মিথ্যা বলছ! তোমার ব্লু ফিল্মের নোংরা কোন মাগীর সঙ্গে শুয়েছ! আর সেজন্যেই আজ আমাকে আর শান্তি দিতে পারবে না! কবেই বা দুটো মেয়েকে একই রাতে স্বস্তি দিতে পেরেছ? তুমি আসলে চিরকালই নোংরা নর্দমার কেঁচো!’

‘এমনটা হতে পারে না, আমি হয়তো তোমার অতিরিক্ত খায়েস মেটাতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি?’ পাল্টা বলল পুরুষকণ্ঠ: ‘প্রতিদিন চার-পাঁচবার এসব কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অবশ্য তুমি আমাকে ভুল ভাবছ, লিসা। শপথ করে বলতে পারি, অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছি না।’

‘সেটা হলেই তোমার মঙ্গল, পিট! নইলে বাঁচবে না! আর এখন তো মনে হচ্ছে, তোমার আর কিছু দেয়ারও নেই! তার ওপরে এমনিতেই তোমার যন্ত্রটা চড়ুই পাখির ওটার সমান!’

দরজার সামনে থেমেছে রানা। ভাবছে এখনই ঢুকবে না ঘরে। আগে শোনা যাক এরা জরুরি কিছু বলে কি না।

‘তোমার মস্তানদেরকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না,’ বলল পিট। ‘মস্ত ভুল করেছি তোমার মত ডাইনীর সঙ্গে বিছানায় গিয়ে! আগে যদি জানতাম প্রতিদিন এতবার করে…’

‘বাজে কথা বাদ দাও, শুয়োর কোথাকার!’ গলা উঁচিয়ে ধমক দিল এলিসা রসি। ‘বরং এটা বলো, আগামী কিছু দিন কেন দেখা করবে না। ভাল কোন ব্যাখ্যা না দিলে খুন হবে আমার হাতে।’

অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে বলল পিট, ‘তুমি তো জানো আজ কী ঘটেছে হেলথ সেন্টারে। যে পেশায় আছি, যে-কোন সময়ে অচেনা সেই লোকটা হামলা করবে আমার ওপরে।’

‘মাসুদ রানা? সে আবার কী করবে? তুমি পর্নো মুভি তৈরি করলে তাতে তার কী?’ বিরক্ত সুরে বলল এলিসা রসি।

‘কাজটা তো আর ভাল নয়।’

‘তাতে কী?’

‘মাসুদ রানাকে ধরতে গিয়ে নানাদিকে ছান দেবে পুলিশ। আমিও যখন-তখন ধরা পড়তে পারি। সেক্ষেত্রে আমার পেট থেকে তোমার ব্যাপারে বহু কিছুই জেনে নেবে তারা।’

‘যদিও আমার মনে হচ্ছে এসব কথার পেছনে তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে,’ বলল এলিসা রসি। ‘তুমি আসলে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ।’

‘কী যে বলো, লিসা!’

‘তো যা করতে বলছি, কাপড় ছেড়ে সেটা করো। নইলে কচ করে কেটে নেব তোমার নুণ্টি।’

এবার রানা বুঝল, ঘরে লোকটার পরনে পোশাক আছে। কী করবে ভাবতে শুরু করেছে ও, এমনসময় দরজার কাছ থেকে বলল লোকটা, ‘তুমি বরং নিজের জন্যে জোগাড় করো গোটা চারেক মর্দা বাঁদর! আজ কিছুতেই অত পরিশ্রম করতে পারব না।’

খুলতে শুরু করেছে দরজা।

‘খবরদার, পিট!’ গর্জে উঠল এলিসা রসি। ‘আমাকে শান্তি না দিয়ে…’

হঠাৎ নিজে থেকে দরজা খুলে যেতেই লা-জওয়াব হয়ে গেল মহিলা। তার সঙ্গী বিস্মিত চোখে দেখল করিডরে কঠোর চেহারার এক যুবক, হাতে উদ্যত বেরেটা পিস্তল!

‘ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াও,’ হিমশীতল স্বরে বলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *