নরকের ভাঙা দরজা
ঔষধের তীব্র গন্ধ অন্ধকার বদ্ধ হলঘরটার ভেতরে পাক খাচ্ছে। কারও ঘ্রাণশক্তি খুব উচ্চপর্যায়ের হলে সে আরও দুটো গন্ধ পাবে। কাগজ পোড়ার গন্ধ আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের স্যাঁতস্যাঁতে আঁশটে গন্ধ। এখানে-ওখানে ভাঙা চেয়ার টেবিল পড়ে আছে। সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুধু কাঁচের টুকরো আর জুতা। টুকরো টুকরো ছাই উড়ছে বাতাসে।
কিছুক্ষণ পরে আকাশে চাঁদ উঠল। হলঘরের অনেক ওপরে থাকা ঘোলা হয়ে যাওয়া কাঁচের শার্শিগুলো দিয়ে চাঁদের আলো হল ঘরে ঢুকল। যেন কেউ আকাশ থেকে টর্চের আলো ফেলে হলঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে।
লম্বা হয়ে ঝুলতে থাকা সিলিং ফ্যানগুলোর ছায়া পড়ল হলঘরের দেওয়ালে। হল ঘরের মাঝখানে দুটো ছায়ামুর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। প্রথম ছায়ামূর্তিটার হাতে টর্চের আলো জ্বলছে।
“ওদিকটা দেখেছ?”- দ্বিতীয় ছায়ামুর্তিটা প্রথম ছায়ামুর্তিটাকে বলল। ভারি কণ্ঠস্বরটা হলঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসার আগেই প্রথম ছায়ামুর্তিটা বলল, “জী। একই অবস্থা।” কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বলল, যতদুর জানি বেশিরভাগ ফাইল-টাইল এই লাইব্রেরীতেই রাখা ছিল।”
“আর সাবজেক্ট ফাইলগুলো? পাওয়া গিয়েছে?”
“এই লাইব্রেরীতেই ছিল। তবে এক্সপেরিমেন্টাল আউটকাম লিস্টের ফাইলগুলো স্যারের স্টাডিতেই থাকত। কিন্তু বেশিরভাগ ফাইলই আগুনে পুড়ে গিয়েছে। অল্প কিছু ফাইল উদ্ধার করা গিয়েছে। তাও বেশিরভাগই আধপোড়া।”
“উনার স্টাডিটা সার্চ করা হয়েছে? ওখানকার কি অবস্থা?”
“সার্চ চলছে। স্টাডিটার তেমন ক্ষতি হয়নি। ওটাই একমাত্র জায়গা যেটাতে লেভেল ফাইভের সিকিউরিটি দেয়া ছিল।”
“ডঃ বশিরের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে?”
“না স্যার। এখন পর্যন্ত না।”
“উনাকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা কর। যেভাবে পার। প্রজেক্টটা উনার হাতে ছিল। আর এখানে ফরেনসিকের কয়েকজনকে পাঠিয়ে দাও। সাবজেক্ট ফাইলগুলো উদ্ধার করা যায় কিনা দেখো। সাবজেক্ট ফাইলগুলোই সব থেকে ইম্পর্টেন্ট। ডঃ বশির এইখানে কোন আক্কেলে ফাইলগুলো রাখলেন? দে ওয়্যার দ্য মোস্ট কনফিডেনশিয়াল ডকুমেন্টস অফ আওয়ার ইন্টেলিজেন্স, গড ড্যাম ইট। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো আর কেউ কোন গুরুত্বই দেন নাই।”
প্রথম ছায়ামূর্তি কোন উত্তর দিল না। হঠাৎ দ্বিতীয় ছায়ামুর্তি আবার প্রথম ছায়ামুর্তিটাকে ডাকল, “মেজর রঞ্জন।”
“জী স্যার?”
“একটু তাড়াতাড়ি। ভোর হওয়ার আগে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। ও হ্যাঁ ভালো কথা, গার্ডদের আর্মসগুলো পাওয়া গিয়েছে?”
“না স্যার। একটা রাইফেলও পাওয়া যায়নি।”
“হুম। আচ্ছা যাও।”
প্রথম ছায়ামুর্তিটা কি একটা বলার জন্য কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এলো।
“স্যার।”
“হুম বল।”
“স্যার, কংসচক্রের সেই ডায়েরিটা নাকি এখানেই ছিল। অনেককে বলতে শুনেছি যে কায়জুদ্দিনের হাতে সেই ডায়েরিটা দেখেছে।”
“আমরা এখানে ফালতু ডায়েরি খুঁজতে আসিনি, রঞ্জন। কায়জুদ্দিনের সেল অনেকবার সার্চ করেও কোন ডায়েরি পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ডায়েরিটার থেকেও ভয়াবহ কিছু ঘটনা ঘটেছে এখানে। মিডিয়ার তৈরি গল্পের পেছনে সময় নষ্ট না করে কাজের কাজগুলো তাড়াতাড়ি সারো।”
প্রথম ছায়ামুর্তিটা মাথা নেড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
হলঘরটা ঝুপ করে অন্ধকারে ডুবে গেল আবার। দ্বিতীয় ছায়ামুর্তি পা দিয়ে সামনের একটা চেয়ার সরিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করল। এই নিকষ কালো আঁধারেও ছায়ামুর্তিটা যেন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
ভাঙা চেয়ার টেবিলের স্তূপের নিচে বেশ কয়েকটা লাশ পড়ে আছে। প্রত্যেকের পরনে সবুজ গেঞ্জি আর সবুজ ট্রাউজার। বেশিরভাগ লাশই থেঁতলানো। কয়েকটা লাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আছে। লাশগুলো দেখলেই বোঝা যায়, এখানে এদেরকে মারা হয়নি। অন্য কোথাও মেরে এখানে এনে ফেলে রাখা হয়েছে। লাশ টেনে নেওয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া এই রুমটায় আগুনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অথচ এই লাশগুলোর কিছুই হয়নি। এ থেকেও বোঝা যায় যে এই মানুষগুলোকে এখানে মারা হয়নি।
দ্বিতীয় ছায়ামুর্তিটা একটা টেবিলের ভগ্নাংশ সরাল। একটা লাশ পড়ে আছে কাত হয়ে। লাশের মুখমন্ডল খুব জঘন্যভাবে থেঁতলানো। খুলির সামনের অংশ ফেটে খানিকটা মগজ বের হয়ে আছে। মাছি বসছে। হত্যাকারী হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি। মানুষটার খুলি ফাটানো হয়েছে মারা যাওয়ার পরে। তারমানে, খুনির ভেতর তীব্র চাপা ক্ষোভ ছিল। ছিল তীব্র ঘৃণা।
শুকনো রক্তের ওপরে ছায়ামূর্তির বুটের ছাপ পড়ল।
বেশিরভাগ বুকশেলফ আগুনে ঝলসে গিয়েছে। স্টিলের তৈরি বুকশেলফ। বেশ কয়েকটা বুকশেলফ আগুন লেগে বাঁকা হয়ে গিয়েছে। শেলফে শেলফে বইয়ের বদলে কালো ছাই। কিছু শেলফে আধপোড়া বই ঝুলছে। হলঘরের দক্ষিণ দিকে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। তারমানে আগুন দক্ষিণ দিকে থেকেই ছড়িয়েছে। কিন্তু হঠাৎ মাঝখানে এসে আগুন দুর্বল কেন হয়ে গেল? মাথার ভেতরে একটা হিসাব মিলাতে যেয়েও মিলছে না।
চারজন সাদা ক্লিনিকাল স্যুট পরা লোক হল ঘরে ঢুকল। তাদের ভেতরে একজন ছায়ামূর্তিটার সাথে কর্মদন করল। মুখ থেকে ক্লিনিকাল মাস্ক নামিয়ে বলল, গুড ইভনিং মেজর জেনারেল।
ছায়ামূর্তিটাও সৌজন্যহীন কণ্ঠে বলল, “গুড ইভনিং, ডাঃ ফারুক।” বাকি তিনজন পোর্টেবল ফ্লাডলাইট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ক্লিনিকাল স্যুট পরিহিত ফারুক নামের ভদ্রলোকটি বলল, “আপনি সশরীরে আসবেন ভাবিনি। রঞ্জন বলছিল তখনও বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম মেজর ইকবাল আসবেন। এই প্রজেক্টটার বেশির ভাগ দায়িত্ব ওর হাতেই ছিল কিনা।”
ছায়ামূর্তি ডঃ ফারুকের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে বললেন, “ মেজর ইকবাল ইজ মিসিং। তাই আমাকেই আসতে হল বাধ্য হয়ে। হলোকাস্টটা হওয়ার পর থেকে ওর নম্বরটা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেলফোনের জিপিএস সেন্সর ট্র্যাকিং চলছে। যাই হোক, ফাইলগুলোর কিছু করতে পারলেন?”
“পাওয়া না পাওয়া সমান বলতে পারেন। স্যারের চেম্বারে বেশ কিছু ফাইল আর কিছু টেকনিক্যাল ডকুমেন্ট পেয়েছি। বেশির ভাগই আধপোড়া।” ডঃ ফারুক বললেন।
“যেমন?”
“কিছু ভিডিও আর অডিও ক্লিপ। আর রিসার্চ আউটপুটের কিছু সফট কপি। এভিডেন্স বক্সে সব আছে। কিন্তু সবগুলো ফাইলের হার্ডকপি অক্ষত পাওয়া যায়নি। আপনি চাইলে দেখতে পারেন। তবে ডঃ বশির জামান ভালো বলতে পারতেন আসলে কি ঘটেছিল।”
“আপনার কী মনে হয়? বশির জামান বেঁচে আছেন?”
“সত্যি বলতে, এত কিছুর পরে আমার মনে হয় না উনি বেঁচে আছেন। তারপরেও উনার লাশটা না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না।”
ডঃ বশির জামান খুব বিশ্বস্ত একজন লোক ছিলেন। এতগুলো বছর একসাথে কাজ করেছেন, একবারও কথার এদিক ওদিক করেননি। তার ওপরে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যেত। নিজের অজান্তেই দ্বিতীয় ছায়ামূর্তির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
খ্যাট খ্যাট করে শব্দ হল। পোর্টেবল ফ্লাডলাইটের আলোতে পুরো হল ঘর ভেসে গেল। অন্ধকারে যে বীভৎসতাগুলো লুকিয়ে ছিল, ফ্লাডলাইটের আলোয় সেগুলো বেরিয়ে পড়ল। দেয়ালে দেয়ালে আগুনের রেখে যাওয়া কালির দাগ। ছাইয়ের স্তূপ। আর শুকিয়ে যাওয়া পুডিং-এর মতো ঘন রক্তের ভেতরে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন লাশ। আর তার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা সেই দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি, মেজর জেনারেল মহিউদ্দিন হক ফিরোজ। সংক্ষেপে ফিরোজ হক। তামাটে বর্ণের লম্বা মুখমন্ডল। ক্লিনশেভড, আর্মি ছাঁট চুল। উচ্চতা সাধারণ বাঙালীদের চেয়ে খানিকটা বেশি। পরনে অফহোয়াইট রঙের ফুলস্লিভ শার্ট আর কালো প্যান্ট। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। দুই হাতে নীল রঙের ক্লিনিক্যাল গ্লাভস। পলিশ করা চকচকে কালো জুতা।
রাশিয়ার জেনারেল স্টাফ একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট আর ফ্রান্স থেকে ইন্টার কোর্স স্টাফ ডিগ্রীধারী এই মানুষটা ন্যাটোর মেরিন উইং-এ কাজ করেছিলেন সাত বছর। সেখানে সবাই তাকে হক (Hawk) নামেই বেশি চিনত। কারণ অন্যান্য মিলিটারি দক্ষতার পাশাপাশি স্নাইপিং-এ তরুন ফিরোজের দক্ষতা ছিল দেখার মত। অন্ধকারেও মানুষটা যেন সব কিছু দেখতে পেত! সবাই মনে করত সে প্যাসিফিক অঞ্চলের কেউ। কারণ এশিয়ার কাউকে এর আগে ন্যাটোতে দেখা যায়নি। ফ্রান্সের অ্যাডমিরালই ন্যাটোর কাছে ফিরোজের জন্য সুপারিশ করেন। সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ সার্বিয়াতে ন্যাটোর একটা অপারেশন শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এবং নিজের দেশের নৌবাহিনীর অপারেশন উইং-এর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। অভ্যন্তরীণ যেকোন গুরুত্বপূর্ণ মিশনে পুলিশ এবং এলিট ফোর্সে প্রায়ই তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত। তবে বেশিরভাগই ছদ্মনাম নিয়ে। কেন তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন কেউ জানে না। সংবাদ সম্মেলনেও মেজর জেনারেল ফিরোজের ছিল যথেষ্ট অনীহা। অনেকবার আন্তর্জাতিক অপারেশনে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও কেন জানি উনি আর দেশের বাইরে যাননি। পঞ্চাশোর্ধ অকৃতদার এই মানুষটা একটা সময় স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহন করতে চাইলে কমান্ডার ইন চিফের পক্ষ থেকে তাকে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার এক্সিকিউটিভ হিসাবে যোগদান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। উনি সে প্রস্তাব সম্মানের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটা মোটেই বন্ধুবৎসল নন। তার কোন বন্ধু নেই- অন্তত তার আশেপাশের মানুষগুলো তাই বলে। কিন্তু সিনিয়র অফিসার্স লাউঞ্জে তার মত আড্ডাবাজ আর কেউ নেই। ব্যক্তিগত জীবনে তার মত নিঃসঙ্গ অফিসার আর দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না।
মিলিটারি রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ইউনিট (MRAU) এ যোগ দেওয়ার দুই মাসের মাথায় একটা প্রজেক্ট নেওয়া হয়। শুরুতে প্রজেক্টের কোডনেম ছিল A 22. পরে প্রজেক্টের নামকরণ করা হয়, প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প। ফিরোজ তখন পর্যন্ত জানতেন না যে এই প্রজেক্ট তার এবং তার নিজ হাতে গড়ে তোলা MRAU এর জন্য কি বয়ে আনতে যাচ্ছে।
ফিরোজ ওয়াকিটকিতে মেজর রঞ্জনকে একবার আসতে বললেন। গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা দেখা হয়নি। হাতঘড়িতে তখন বাজে রাত দুইটা ঊনচল্লিশ। সূর্য ওঠার আগেই কাজ শেষ করে এই বাড়িটা সিল করে দিতে হবে। তারপর সন্ধ্যার মিটিংয়ে এই বাড়িটার এবং এই অসমাপ্ত অভিশপ্ত প্রজেক্টের ভবিষ্যত নির্ধারণ হবে।
মেজর রঞ্জন ফিরোজকে একটা ছোট রুমে নিয়ে গেলেন। এই কক্ষটাতে কোন জানালা নেই। স্টোররুম হিসাবে রুমটা ব্যবহার হত। মেজর রঞ্জন একটা দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ব্যারেল সরালেন। মেঝেতে একটা দরজা দেখা গেল।
“এখান দিয়েই পালিয়েছে ওরা স্যার।” মেজর রঞ্জন বললেন, “এটা ইমার্জেন্সি এক্সিট রুট ছিল। তাছাড়া সামনের ডেইরি ফার্মটাতে যাওয়ার জন্যও মাঝে মাঝে এই রাস্তা ব্যবহার করা হত।”
মেজর জেনারেল ফিরোজ দরজার কিনারাটা পরীক্ষা করলেন। কিছু একটার সাহায্যে চাড় দেয়া হয়েছে। যার ফলে ছিলকে উঠে গিয়েছে অনেক জায়গায়। দরজাটা একবার খুললেন উনি। ভেতরে কাঠের তৈরি অনেকগুলো ধাপ নেমে গিয়েছে। এই বিল্ডিংটার স্ট্রাকচারটার খুঁটিনাটি জানে মেজর ইকবাল। ওকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে যাচ্ছে।
ফিরোজ দরজাটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “ডেইরি ফার্মটা দেখা হয়েছে?”
“জী। আর ফার্মের সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে স্যার।”
“এই বিল্ডিংটার ডিটেইলস লাগবে রঞ্জন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি ডিটেইলস ম্যানেজ করে দাও। আর ডেইরি ফার্মটা আমি একবার দেখতে চাই।”
ফিরোজ মেজর রঞ্জনকে নিয়ে কন্ট্রোলরুমের দিকে রওনা হলেন। সিসিটিভি ফুটেজগুলো দেখতে হবে। হঠাৎ খড়খড় করে জেনারেল ফিরোজের ওয়াকিটকি বেজে উঠল। বাইরে পাহারারত পেট্রোল টিমের একজন জানালো, “বাইরে ঝামেলা হয়েছে।”
ফিরোজ আর রঞ্জন তাড়াতাড়ি বাইরে আসলেন। কম্পাউন্ডের এক কোণায় পেট্রোল টিম একজন লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। লোকটা মাথা নিচু করে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পুরো কম্পাউন্ড অন্ধকার। ইচ্ছা করেই অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। লোকটাকে ঘিরে কালো ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে পেট্রোল টিমের কয়েকজন সদস্য।
পেট্রোল টিমের ইনচার্জ মেজর হাসান এগিয়ে এসে মেজর জেনারেল ফিরোজকে বললেন, “স্যার, লোকটা কম্পাউন্ডের ভেতর ঘোরাঘুরি করছিল। শরীরের কয়েকটা জায়গায় আঘাতের দাগ আছে। সম্ভবত প্রাচীর টপকে ঢুকেছে। প্রাচীর টপকাতে গিয়েই আঘাত পেয়েছে। কেন ঢুকেছে বলছে না। শার্টের পকেটে একটা চাবি পাওয়া গিয়েছে।”
ফিরোজ হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিলেন। বললেন, “অস্ত্রটস্ত্র কিছু পেয়েছেন?”
“নো স্যার।”
“এনি অথোরাইজেশনাল সিগনিফিকেন্সি?”
“নো স্যার।”
মেজর জেনারেল ফিরোজ লোকটার কাছে গেলে পেট্রোল টিমের কেউ একজন লোকটার মুখের ওপরে টর্চের আলো ফেলল।
“নাম কি?” ফিরোজ জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটা নীরব। মাথা নিচু করে আছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “নাম কি?”
লোকটা ক্ষীণস্বরে বলল, “তৈয়ব। আমি সামনের ফার্মে কাজ করি। আমাদের ফার্মের একটা গরু হারাইছে। এদিকে খুঁজতে এসেছিলাম।”
ফিরোজ বললেন, “মিথ্যা বলবে না। আসল নাম কি?”
লোকটা গোঁয়ারের মত বলল, “বললামই তো।”
ফিরোজ অন্ধকারে পেট্রোল গার্ডদেরকে ইশারা করলেন। সাথে সাথে একটা বন্দুকের বাঁট এসে পড়ল লোকটার কাঁধে। লোকটা ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠল। ফিরোজ বললেন, “সামনের ডেইরি ফার্মটা আমাদের। ওখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে সব আমাদের জানা। যত সত্যি বলবে, তত কম ঝামেলায় জড়াবে।”
অস্ফুট স্বরে লোকটা বলল, “জামিল।”
“কী কর?”
“অটো চালাই। আমার কোন বদ উদ্দেশ্য ছিল না স্যার। সত্যি স্যার, এই প্রথম জামিলের কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ল। এতক্ষণে যেন সে বুঝেছে এই মানুষটার কাছে ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে।”
“এই চাবি তুমি কোথায় পেলে?” ভাবলেশহীন কণ্ঠে ফিরোজ জিজ্ঞাসা করলেন।
“একজনের ব্যাগ থেকে, স্যার। স্যার আমাকে ছেড়ে দেন স্যার।” জামিলের কণ্ঠে অস্থিরতা।
ফিরোজ খানিকটা অবাক হলেন। কিন্তু অন্ধকারে সেটা বোঝা গেল না।
“চাবিটা কিসের তুমি জানো? কার কাছ থেকে পেয়েছ?”
“স্যার, একটা লোক, না মানে একটা মেয়ে আমার অটোতে ব্যাগ ফেলে গিয়েছিল। আমি ব্যাগ ঘাঁটতে গিয়ে এই চাবিটা পেয়েছি স্যার।”
জামিল এইটুকু বলেই থেমে গেল। সে আস্তে আস্তে নিজের জালেই জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন যদি তাকে প্রশ্ন করা হয় ব্যাগটা কোথায়, সে কি জবাব দেবে?
জামিলের মনের প্রশ্নটাই ফিরোজ করলেন, “ব্যাগটা কোথায়?”
জামিল বমি করার মত করে হড়হড় করে সব কথা বলে ফেলল। অচেনা মেয়েটার ব্যাগ ফেলে যাওয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত বলে দিল।
ফিরোজ চাবিটা মুঠো করে ধরলেন। মেজর রঞ্জনকে ডাকলেন। বললেন, “এই লোকটাকে নিয়ে ব্যাগের মালিককে খুঁজে বের কর। মেয়েটার পরিচয় কি সেটাও জানার চেষ্টা করবো। গাড়িতে না গিয়ে একটা ভ্যান নিয়ে যাও। তোমার প্রেজেন্সটা যতটা গোপন রাখা যায় তত ভালো। কেউ যেন আমাদের কিংবা এই প্রজেক্টের ব্যাপারে না জানতে পারে। প্রজেক্টের ব্যাপারে আমরা কোন রিস্ক নিতে পারি না। যদি কাজ শেষ হয়ে যায়, তো বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই। বুঝেছ?”
মেজর রঞ্জন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। মেজর রঞ্জনের সাথে আরও তিনজন পেট্রোল টিমের সদস্য ভ্যানে উঠল।
কিছুক্ষণের ভেতরেই জামিলকে নিয়ে একটা পুলিশ ভ্যান বের হয়ে গেল।
***
হোটেল সুকর্ণের কলাপসিবল গেটের সামনে একটা কুকুর শুয়েছিল। নীল ফ্লুরোসেন্টের আলোতে কুকুরটাকেও নীল মনে হচ্ছে। শহরের ক্লান্ত বাতাসে একটা পলিথিন গড়াতে গড়াতে রাস্তা পার হল। কুকুরটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সেদিকে তাকাল।
রাস্তার ওপারে একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ ভ্যানে কুকুরটার আগ্রহ নেই। সে আবার শুয়ে পড়ল।
পুলিশ ভ্যানটার সামনের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে মেজর রঞ্জন হোটেল সুকর্ণের সদর গেটটার দিকে একবার দেখলেন। নীল রঙের একটা সাইনবোর্ড। হোটেল সুকর্ণ। কিছু পোকা সাইনবোর্ডটাকে ঘিরে উড়ছে। মেজর রঞ্জন ঘাড় ঘুরিয়ে জামিলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এইখানে?”
জামিল অন্ধকারে ঘাড় নেড়ে জানালো যে সে চাবির মালিককে এইখানেই নামিয়ে দিয়েছে।”একটা মেয়ে, স্যার।” জামিলের কাছে কিছুই শুনতে চাওয়া হয়নি, তারপরেও সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
সামনের সিট থেকে মেজর রঞ্জন কিছুই বললেন না। এখনই গিয়ে একবার দেখে আসবে নাকি চাবির মালিককে? সকালে যদি না থাকে?
এত রাতে পুলিশ হোটেলে ঢুকতেই পারে। গরীব দেশে পুলিশের অন্য কাজ না থাকলেও রাত বিরাতে হোটেলে হানা দিয়ে দু’পয়সা কামানো তাদের পবিত্র দায়িত্বের ভেতরে পড়ে। কিন্তু শুধুমাত্র একজনের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য এটা ভালো সময় না। গভীর রাতে একজনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে ব্যপারটা চাপা থাকবে না। দিনের বেলা আসতে হবে। সিভিল ড্রেসে।
জামিল অস্ফুট স্বরে বলল, “আমাকে ছেড়ে দেন স্যার। আমার বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে আছে স্যার।”
মেজর রঞ্জন জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ি কোথায় তোর?”
জামিল বাড়ির ঠিকানা বলল। মেজর রঞ্জন মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বললেন, “চল তোমারে বাড়িতেই নামায়ে দিয়ে আসি।”
পুলিশ ভ্যানটা যেমন নিঃশব্দে এসেছিল। ঠিক তেমন নিঃশব্দে চলে গেল।