নরকের চলচ্চিত্র – সৈকত মুখোপাধ্যায়

নরকের চলচ্চিত্র – সৈকত মুখোপাধ্যায়

ডিয়ার মিস্টার রাজশেখর, অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরস-এর ডিরেক্টর হিসেবে আপনার সমস্ত অভিযোগ মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। সত্যিই আপনার কাজ শেষ করতে আমাদের অস্বাভাবিক দেরি হয়ে গেল। বুঝতে পারছি, যেহেতু এই কাজটুকু আপনার আগামী সিনেমা ‘অন্তিমযাত্রা’-র অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই আমাদের জন্যে সেই সিনেমাও আপনি শেষ করতে পারছেন না। আমি সত্যিই আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

হয়তো এইটুকু লিখেই এই চিঠি শেষ করে দেওয়া যেত, তাতে ব্যবসায়িক সৌজন্যও রক্ষিত হত। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে এমন কাজ করতে বাধা দিচ্ছে। আমার মন বলছে ‘অন্তিম যাত্রা’-র অ্যানিমেশনের কাজ করতে গিয়ে যে অপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমি গিয়েছি তা আপনাকে খোলাখুলি জানিয়ে রাখাই উচিত। কী জানি কেন, আমার কেবলই মনে হচ্ছে সেই অলৌকিক ঘটনার জের এখনো শেষ হয়নি। হয়তো আমার ঘর ছেড়ে সেই দুর্ভাগ্য, সেই দুঃস্বপ্ন এবার আপনার ঘরে ঢুকবে।

সিনেমা পরিচালক হিসেবে আপনার খ্যাতি আমার অজানা ছিল না, বিশেষত হরর ফিলম বা ভয়ের ছবির পরিচালক হিসেবে। জানতাম, এ ব্যাপারে আপনার প্রথম দুটো সিনেমা হলিউডের সঙ্গে টেক্কা দিয়েছে। সারা দুনিয়া একবাক্যে স্বীকার করেছে—এই কলকাতায় বসে, টালিগঞ্জের স্টুডিয়োগুলোর সামান্য কারিগরী কৌশল ব্যবহার করে আপনি যে বিশ্বমানের ছবি তৈরি করেছেন তা প্রতিভা ছাড়া হয় না। আর সেই জন্যেই, আপনার আগামী ছবির কিছু বিশেষ দৃশ্যের অ্যানিমেশন করে দেওয়ার জন্যে আপনি যখন আমাকে প্রথম অনুরোধ করলেন তখন আমি ভীষণই গর্বিত বোধ করেছিলাম। একজন প্রতিভাবানের কাছ থেকে কাজের স্বীকৃতি পাওয়া তো যে কারুর পক্ষেই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমাদের কী পারিশ্রমিক দিচ্ছেন সেটা আমার কাছে গৌণ ছিল। আসল লক্ষ্য ছিল একটা চ্যালেঞ্জিং কাজকে সফলভাবে রূপায়ণ করার যে আনন্দ, সেই আনন্দটুকু পাওয়া।

হ্যাঁ, আপনি যে কাজটা আমাদের দিয়েছিলেন তা ছিল চ্যালেঞ্জিং, ভীষণই চ্যালেঞ্জিং। আপনি চেয়েছিলেন নরকের একটা বিশ্বাসযোগ্য চলমান ছবি আমরা আপনাকে বানিয়ে দিই। সেই ছবি আপনার মূল কাহিনিতে আপনি ব্যবহার করবেন।

আপনি যে ধরনের দৃশ্য কল্পনা করেছিলেন, আজ থেকে পনেরো বছর আগেও সে দৃশ্যের কথা কোনো পরিচালক কল্পনা করতে সাহস পেতেন না। কারণ স্টুডিয়োতে অমন দৃশ্য বানানো যেত না, তা সে যত আধুনিক স্টুডিয়োই হোক না।

আজ কিন্তু বানানো যায়; স্টুডিয়োয় নয়, কম্পিউটারের স্ক্রিনে। যেসব অসম্ভব দৃশ্য স্টুডিয়োর ফ্লোরে তৈরি করা যায় না, তারা রূপ পায় আমাদের মতন অ্যানিমেটরদের মাউসের ক্লিকে। গর্জমান ডায়নোসর থেকে নিমজ্জমান টাইটানিক—সবই এই অ্যানিমেটরদের কারিকুরি।

সেইজন্যেই পনেরো বছর আগে যে দৃশ্যের স্বপ্ন দেখা যেত না, আজ তা যায়। যেমন আপনি দেখেছিলেন।

আপনি আমাদের বানিয়ে দিতে বলেছিলেন লেলিহান আগুনের চলচ্চিত্র। আপনি চেয়েছিলেন সেই আগুনের মধ্যে অগণিত ছায়ামূর্তি। সেই আগুনের রং যেন পৃথিবীর কোনো আগুনের মতন না-হয়। সেইসব ছায়ামূর্তির মধ্যে যেন যন্ত্রণার ছাপ থাকে। এমন আরো অনেক কিছুই আপনি চেয়েছিলেন আমাদের কাছে। তবে সবশেষে আপনি পুরো ব্যাপারটাই আমাদের ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আপনি বলেছিলেন সব মিলিয়ে যেন নরকের একটা বিশ্বাসযোগ্য ছবি ফুটে ওঠে আপনার সিনেমার মধ্যে।

আর আমি পুরো কাজের দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়েছিলাম অনির্বাণের ওপর। অনির্বাণ মজুমদার, আমার সব থেকে কমবয়েসি সহকর্মী। কিন্তু সব থেকে প্রতিভাবান।

দু-বছর আগে, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সিলিকন ভ্যালির একটা কলেজ থেকে অ্যানিমেশনে ডিগ্রি নিয়ে এসে আমাদের কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিল অনির্বাণ।

আমাদের এই অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরস-এর ছাদের তলাতেই ওর চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ কর্মী আছেন। তারা টেকনিকাল দিক থেকে হয়তো অনির্বাণের চেয়ে বেশি দক্ষ, কিন্তু এই দু-বছরে অনির্বাণ তাদের সকলকে টেক্কা দিয়েছে একটা জায়গাতেই। কল্পনাশক্তিতে।

কোনোকিছু নিখুঁতভাবে কপি করতে বললে ও পারত না। রেগে যেত। কিন্তু নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে বললে ও ভীষণ খুশি হত। তখন ওর মনোযোগ দেখে কে! আর ওর প্রতিটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হওয়ার পরে আমরা সকলে এক বাক্যে স্বীকার করেছি, এমন অরিজিন্যাল কাজ এ দেশে বিরল। ওর এমন কিছু কাজের দৌলতে ‘অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরসকে আই টি দুনিয়ার রথী-মহারথীরাও সম্মান করতে শুরু করেছিল।

তো, সেই অনির্বাণ মজুমদারকেই আমি নরকের চলচ্চিত্র বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? এই কাজটায় তো কল্পনাশক্তিই লাগত। নরক সম্বন্ধে তো আর কারুর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নেই।

অনির্বাণ কিন্তু তা বিশ্বাস করত না।

কাজটা হাতে পাওয়ার পরেই অনির্বাণ বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল। নানা রকমের বই। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা বই, কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে আনা বৃষ্টির ছিটে লাগা হলুদ পাতার বই, ক্ষীণজীবী সাময়িক পত্রপত্রিকা, আর সর্বোপরি ই-বুক তো ছিলই। অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ ও নিজের কিউবিকলে ঘাড় গুঁজে বসে বই পড়ত। তখন শুনশান অফিসে থাকতাম খালি আমরা দুজন—আমি আর অনির্বাণ।

অ্যাসাইনমেন্টটা ওকে দেওয়ার মাস দুয়েক বাদে, এরকমই এক জনশূন্য সন্ধ্যাবেলায় অনির্বাণ তার সমস্ত বইপত্র সরিয়ে রেখে আমার চেম্বারে ঢুকল। ওকে দেখে আমার খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। চোখ দুটো যেন কেমন ঘোর লাগা। আমি বললাম, বসো অনির্বাণ। কিছু বলবে?

হ্যাঁ, একটাই কথা বলব বলে এলাম। আমার বিশ্বাস নরক ব্যাপারটা কাল্পনিক নয়। রূপক তো নয়ই। সত্যিকারেই নরক রয়েছে, যেমন রয়েছে এই কলকাতা।

ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি বেশি পড়াশোনা করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমার ঘোর সন্দেহ হল, অনির্বাণের তাই হয়েছে। তবু বহু বছর ধরে অফিস চালাচ্ছি তো, তাই মনের কথা বেমালুম মনে চেপে রেখে বললাম, কেমন করে বুঝলে?

সে তো এককথায় আপনাকে বোঝাতে পারব না। তবে পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মহাকাব্য, লোককথা, উপকথায় অদ্ভুতভাবে একেবারে একইরকম ছবি আঁকা হয়েছে নরকের। এটা কেমন করে সম্ভব, যদি না একটাই মডেল থাকে আঁকার জন্যে?

আমি তর্ক করতে পারতাম। বলতে পারতাম পৃথিবীর সব মানুষেরই মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে একটা ভয় আছে। সেই ভয়টাই অমন ভয়ংকর ছবি হয়ে দেখা দেয় তাদের লেখায় কিংবা আঁকায়। ভয়টা যেহেতু একরকম, তাই ভয়ের ছবিগুলোও একরকম। কিন্তু তা না-করে আমি অনির্বাণকে বললাম, বাঃ! এতে তো তোমার কাজ সহজ হয়ে গেল। তোমাকে আর কল্পনাশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে না। ওইসব লেখায় যেমন বর্ণনা পাচ্ছ তেমন করেই অ্যানিমেশন ফিলমটা বানিয়ে দাও না মিস্টার রাজশেখরের জন্যে।

উঁহু। বেশ জোরে ঘাড় নাড়ল অনির্বাণ। এত জল মিশেছে না ও সব লেখায়। জল না-বলে রং বলাই ভালো। বহুবছর আগে লেখা মহাকাব্য কিংবা উপকথাগুলোয় পরের যুগের মানুষ যখনই পেরেছে একটু করে রং চড়িয়েছে। নানা যুগের নানা রকম মিথ্যে গল্প ঢুকতে ঢুকতে মূল গল্পটাকেই আর চেনা যাচ্ছে না। আমি যদি এখন ‘অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড, তাহাতে ডুবায় ধরে পাতকীয় মুণ্ড’—এই বর্ণনা অনুযায়ী নরকের ফিলম বানাই, তাহলে সে ফিলম দেখে আপনি ভয় পাবেন না হেসে ফেলবেন? হতাশা আর বিরক্তি একই সঙ্গে ঝরে পড়ছিল ওর গলা থেকে।

তাহলে? এবার আমিও সত্যি করেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি কাজের মানুষ। নরক আছে কী নেই তাতে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমার মাথায় শুধু ঘুরছে আপনার তাগাদার ফোন আর চিঠিগুলো। অনির্বাণ কাজটা এখনো শুরুই করল না, শেষ করবে কবে? তাই আবারও বললাম তাহলে কী করবে ভাবছ বলো তো।

একবার যদি নিজের চোখে দেখতে পারতাম মৃত্যুর পরের সেই দেশটা!—প্রায় স্বগতোক্তির মতন মৃদুস্বরে বলল অনির্বাণ। আমি মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, তোমার নামটা তাহলে অনির্বাণ থেকে পালটে নচিকেতা করে দিতাম। বেশ রাগ হয়ে গিয়েছিল আমরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের এমন বাচ্চাদের মতন আইডিয়া দেখে। তাই এবারে বেশ কড়া সুরেই বললাম, তুমি যাই করো অনির্বাণ, মিস্টার রাজশেখরের কাজটা কিন্তু আমাকে আর একমাসের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। তার বেশি সময় তোমাকে আমি দিতে পারব না।

মাত্র একমাস! স্পষ্টতই হতাশ হল সে।

আমার রাগ হচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে মায়াও হচ্ছিল ওর জন্যে। বেশ বুঝতে পারছিলাম—যে জিনিসকে একবার বাস্তব বলে ভেবে ফেলেছে ও, তাকে আর কল্পনায় ধরতে ওর মন চাইছে না। এই দোটানায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা। কী করবে ও কে জানে! কিন্তু আমাকেও তো কাজটা শেষ করাতে হবে। আর দু-একদিন দেখে অন্য কারুর কাছে ট্রান্সফার করে দেব তাহলে অ্যাসাইনমেন্টটা, এরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু সে-সময় আর পেলাম না।

ঠিক দু-দিন বাদে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনির্বাণের গাড়ি কোনা-এক্সপ্রেসওয়ের ওপর একটা উঁচু ব্রিজের ওপর থেকে নীচে পড়ে গেল।

পড়ে গেল? নাকি অনির্বাণ নিজেই নিজেকে ছুড়ে দিল অতল শূন্যতার বুকে? আজ আমার সন্দেহ হয়, দ্বিতীয়টাই ঠিক। ও মৃত্যুর পরের দেশ দেখতে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, সেই দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় অনির্বাণের।

মিস্টার রাজশেখর, বুঝতে পারছি আপনার ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। তবে আমি আর বেশি সময় নেব না।

অনির্বাণের মৃত্যুর ঠিক দু-দিন পরের ঘটনা। মানে আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন আগে। তারিখটা ছিল আঠারোই জানুয়ারি। সেই রাতে যেমন শীত পড়েছিল, তেমন শীত কলকাতায় অন্তত আমি কখনো পাইনি। তীব্র ঠান্ডায় কুঁকড়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। তারই মধ্যে আমার সেলফোনটা বেজে উঠল। ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম আলোকিত স্ক্রিনের ওপর ফুটে ওঠা ঘড়ি সময় দেখাচ্ছে রাত দুটো। যে নামটা ফুটে উঠেছে সেটাও আমার খুব পরিচিত। মিস্টার আহুজা। নিউ আলিপুরে রাস্তার যে পাশে আমাদের ‘অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরস’-এর অফিস, তার ঠিক উলটোদিকেই মিস্টার আহুজার বাড়ি। কিন্তু এত রাতে তার ফোন কেন!

ভারি অবাক হয়ে বললাম, বলুন মিস্টার আহুজা।

মিস্টার প্রধান, শান্ত ভাবে শুনুন। ডোন্ট গেট প্যানিকড। আপনার অফিসে আগুন লেগেছে। আমি আপনাকে ফোন করার আগে ফায়ার-ব্রিগেডে খবর দিয়ে দিয়েছি। ইনফ্যাক্ট দে হ্যাভ অ্যরাইভড অ্যান্ড ডাউজড দা ফায়ার। আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। তবু আপনার একবার আসা উচিত মনে হয়।

এক্ষুণি আসছি আমি। আর আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব…

ও সব পরে হবে। আপনি চলে তো আসুন আগে।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে আমার সল্টলেকের বাড়ি থেকে নিউ আলিপুরে যতক্ষণে পৌঁছোলাম ততক্ষণে আগুন পুরোটাই নিভে গেছে। অফিসঘর জলে থই থই করছে। কিন্তু তা ছাড়া, দেখে আস্বস্ত হলাম, ক্ষতি প্রায় কিছুই হয়নি। এবং তার জন্যে পুরো কৃতিত্বটাই প্রাপ্য মিস্টার আহুজার। উনি যদি অত তাড়াতাড়ি দমকলে খবর না-দিতেন তাহলে অনেক কিছুই আগুনের গ্রাসে হারিয়ে যেত।

দমকলের লোকেরা যখন বিদায় নিল তখন ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। ক্লান্ত শরীর এবং বিধবস্ত মন নিয়ে মিস্টার আহুজার ফ্ল্যাটেই গিয়ে বসলাম। ওনার কাজের লোক আমাদের দুজনের জন্যেই ধূমায়িত চায়ের কাপ রেখে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিস্টার আহুজা যা বললেন তা শুনে আমি চমকে উঠলাম। উনি বললেন আপনার স্টাফেদের মধ্যে কেউ কি রাতে অফিসে থেকে গিয়েছিল, মিস্টার প্রধান?

না তো, কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছেন?

না, মানে আমি তো অনিদ্রারোগী। রোজকার মতনই জানলার ধারে বসে বই পড়ছিলাম। তার মধ্যেই একবার চোখ তুলে দেখি আপনার অফিসের ভেতর একটা ছায়ামূর্তি চলাফেরা করছে। একটা কিউবিকলে আলো জ্বলছিল। সেই আলোর সামনে ঝুঁকে বসে কিছু করছিল লোকটা। মাঝে মাঝে আবার জানলার ধারে এসে তাকাচ্ছিল আকাশের দিকে। যেন ওই রাতের আকাশে কিছু একটা ফুটে উঠবে এক্ষুণি।

আমি ভেবেছিলাম আপনার কোনো স্টাফ ওভারটাইম কাজ করছে বুঝি। একটু পরে আলোটা নিভে গেল আর তার কিছুক্ষণ পরেই আগুনের প্রথম হলকাটা দেখতে পেলাম। আমি আর দেরি করিনি। কিন্তু…কিন্তু….তাহলে কি কেউ স্যাবোটেজ করল আপনার অফিসে!

আমি বললাম, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মিস্টার আহুজা। আমার এত বড়ো শত্রু কেউ আছে বলে তো জানি না। তা ছাড়া দমকলের লোকেরা তো আমার অফিসে ঢোকার কোলাপসিবল গেট, রোলিং শাটার সব বন্ধই পেয়েছিল। ওরা হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে ঢুকেছে। তাহলে ভেতরে লোক আসবে কোত্থেকে?

না, মানে ধরুন কাল অফিস ছুটির পরে যদি কেউ লুকিয়ে বসে থাকে…

অসম্ভব। আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস সবার শেষে অফিস থেকে বেরোনো, এবং তার আগে পুরো অফিস তন্ন তন্ন করে দেখে যাওয়া। প্রতিটি কম্পিউটার সাট-ডাউন করা আছে কিনা তাও দেখে, নিজের হাতে তালা লাগিয়ে অফিস থেকে বেরোই। কালকেও তাই করেছি।

তবে কি আমিই ভুল দেখলাম? হতে পারে। বয়েস হচ্ছে। বিমর্ষ স্বরে বললেন মিস্টার আহুজা।

না, মিস্টার আহুজা ভুল দেখেননি।

পরের দিন অফিস পরিষ্কার করে নতুনভাবে কাজ শুরু করলাম আমরা। আমার নিজস্ব কম্পিউটারটা একেবারেই আমার নিজস্ব পাস ওয়ার্ড দিয়ে খুললাম, এবং খুলেই দেখলাম একটা নতুন আইকন জ্বলজ্বল করছে আমার ডেস্কটপে। তার নাম…’নরকের চলচ্চিত্র’।

হ্যাঁ, মিস্টার রাজশেখর। প্রায় আধঘন্টার একটা ভিডিয়ো ক্লিপিংকে ওই নামেই আমার কম্পিউটারে ডাউনলোড করে দিয়ে গিয়েছিল কেউ। না, এমন অস্পষ্ট ভাষায় বলার প্রয়োজন নেই। বলছি যখন তখন আমার ধারণাটা খুলেই বলি, তাতে আপনি যদি আমাকে উন্মাদ ভাবেন তাতে আমার কিছু করার নেই। ওই ছবি আমার কম্পিউটারে ডাউনলোড করে দিয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ। মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে এসে।

আমি, কেবল আমিই আমার কম্পিউটারের মনিটরে চালিয়ে দেখেছি সেই চলচ্চিত্র।

ওই চলচ্চিত্র এ জগতের নয়। আগুনের অমন রং আমরা পৃথিবীর মানুষেরা কোনোদিন দেখিনি। সেই আগুনের মধ্যে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে যে জীবগুলো তারাও এই জগতের কেউ নয়। অত যন্ত্রণাবিকৃত মুখ পৃথিবীর মানুষের হতে পারে না।

এই চিঠি যার হাত দিয়ে পাঠাচ্ছি তার হাতেই ওই ভিডিয়ো আমি একটা সিডি বন্দি করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আমার নিজের কাছে ওই ভয়ংকর দৃশ্যের আর কোনো কপি রাখলাম না।

আপনি ভিডিয়োটা নিজে দেখুন। দেখে আপনি স্থির করুন ওই ছবি আপনার সিনেমায় জুড়বেন কিনা। যদি আমার পরামর্শ নেন, তাহলে বলি জুড়বেন না। মৃত্যুর পরের জগতে উঁকি মারার অধিকার বোধহয় আমাদের, জীবিত মানুষদের নেই।

বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই নেই। তার প্রমাণ কি জানেন? আমার অফিসের ওই আগুন।

পরলোক থেকে তার আরব্ধ কাজ শেষ করে যাওয়ার জন্যে এসেছিল অনির্বাণ। করেও ছিল শেষ। জানি না মৃত্যুর পরে কোন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল সে, কিন্তু অমন কোনো অলৌকিক ক্ষমতার জোরেই সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নরকের চলমান ছবি। সে ছবি রেখেও গিয়েছিল আমার কম্পিউটারে। কিন্তু ততক্ষণে টনক নড়েছে নরকের প্রহরীদের। তারা ধাওয়া করেছিল অনির্বাণকে। জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল আমার কম্পিউটারটা। জ্বালিয়ে দিতে পারেনি শুধু দ্রুত দমকলের লোকেরা চলে আসায়।

কিন্তু ওরা কি চেষ্টা ছেড়ে দেবে? মনে হয় না। সেইজন্যেই আবার বলছি, আপনি সাবধানে থাকবেন।

নমস্কারান্তে—

 সুধাময় প্রধান

 ডিরেক্টর, অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরস

 3 ফেব্রুয়ারি 2011

দৈনিক পূর্বদিগন্ত

4 ফেব্রুয়ারি, 2011 নিজস্ব সংবাদদাতা : গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জনপ্রিয় বাংলা ছবির পরিচালক রাজশেখর সিনহা, প্রচারমাধ্যমে যিনি এস রাজশেখর নামেই পরিচিত ছিলেন।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কথায় জানা যাচ্ছে যে, তিনি নিজের ঘরে বসে কম্পিউটারে কিছু কাজ করছিলেন। এইসময়েই সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে তার কম্পিউটারে আগুন লেগে যায়। সেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছুঁয়ে যায় রাজকুমারবাবুর শরীর। সাধারণত এমন আগুনের শিখা বেশিদূর ছড়ায় না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, এই ঘটনায় আগুনের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে রাজকুমারবাবু তার আসন ছেড়ে ওঠবার সময় অবধি পাননি। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তার সমস্ত শরীর। কম্পিউটার এবং রাজকুমারবাবুকে গ্রাস করে সেই আগুন যেমন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল, তেমন হঠাৎই নিভেও যায়।

রাজশেখরবাবুর মৃত্যুতে অসমাপ্ত রয়ে গেল তার নির্মীয়মান ছবি ‘অন্তিম যাত্রা’।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *