নয়ে নবগ্রহ

নয়ে নবগ্রহ

‘আপনার বাড়ি কলকাতা থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাটে। পড়াশুনো গ্রামের স্কুলে। উচ্চশিক্ষা কলকাতায় এবং দিল্লিতে। তাই তো?’ প্রশ্ন করলেন এক সদস্যের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির মিস্টার আয়ার।

‘হ্যাঁ,’ উত্তর দিল প্রথমা।

মিস্টার আয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তরের উচ্চপদস্থ অফিসার। উনি জানেন না যে প্রথমা কাইমেরা নামের একটি এলিট ইন্টেলিজেন্স উইং-এর সদস্য। উনি জানেন যে প্রথমা র-এর এজেন্ট, যার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রথমার বস, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ।

রঞ্জিতের নির্দেশে প্রথমা ওয়ারিস্তান গিয়েছিল র-এর এজেন্ট ধ্রুবিকার প্রাণ বাঁচাতে। সে নির্দেশ মানেনি। জেনেশুনে ধ্রুবিকাকে খুন হতে দিয়েছিল। বসের নির্দেশ অমান্য করার জন্যে এক সদস্যের তদন্ত কমিটির মিস্টার আয়ারের চেন্নাইয়ের অফিসে এসেছে প্রথমা। আয়ার তার অতীত মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে খুঁটিয়ে দেখছেন। জেরা শুরু হয়েছে সকাল ন’টায়। এখন বিকেল চারটে বাজে।

‘আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দুটো। দিল্লির ধলাকুঁয়ায় এক কামরার ফ্ল্যাট। নতুন গাড়ির জন্যে ইএমআই গুনতে হচ্ছে বারো হাজার টাকা করে। নতুন কেনা ডাটসুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশান নাম্বার, ডাব্লিউ বি ৩০ এন ১৪৪২। এইটা আমার কাছে একটু অবাক লাগছে।’ বললেন আয়ার।

‘কোনটা?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা। জেরা চুকলে আজকের ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরবে সে।

‘গাড়ির নম্বর প্লেট কীভাবে লেখা হয় এই নিয়ে আপনার কোনও ধারণা আছে?’

‘নাম্বার প্লেটের রং হলুদ হলে সেটা কমার্শিয়াল ভেহিকল বা ট্যাক্সি। সাদা প্লেটের ওপরে কালো দিয়ে লেখা থাকলে সেটা ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়ি। রেজিস্ট্রেশান নম্বরের প্রথম অক্ষর দুটো দিয়ে স্টেট বা রাজ্য বোঝা যায়। এর বেশি কিছু জানি না।’

‘অনেকটাই জানেন দেখছি। বাকিটা আমি বলে দিচ্ছি। আপনার গাড়ির নম্বর ডাব্লিউ বি ৩০ এন ১৪৪২। নম্বর প্লেটের রং সাদা। তার মানে এটা আপনার নিজের গাড়ি। ডাব্লিউ বি মানে ওয়েস্ট বেঙ্গলে রেজিস্ট্রেশান হয়েছে। তারপরে যে দুটি সংখ্যা আছে, সেটা দিয়ে জেলা বোঝায়। কলকাতার ক্ষেত্রে সেটা ০২। আপনার নম্বর প্লেটে ৩০ কেন?’

‘৩০ হল তমলুকের রেজিস্ট্রেশান নম্বর। আমার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। আমি তমলুকের ডাটসুনের শোরুম থেকে গাড়িটা কিনেছি পাঁচ মাস আগে। ইনফ্যাক্ট গাড়িটা ভারতে লঞ্চ হয়েছে মাত্র আটমাস আগে।’

‘ডাব্লিউ বি ৩০ অবধি বোঝা গেল। এবারে ‘এন’। মূল ব্যাপার হল, রেজিস্ট্রেশান শুরু হয় অ্যালফাবেট ‘এ’ থেকে। তারপরে আসে অ্যালফাবেট পিছু চারটে করে সংখ্যা। ‘এ ০০০১’ থেকে ‘এ ৯৯৯৯’। ‘এ’ সিরিজের নম্বর শেষ হয়ে গেলে আসবে ‘বি’। তখন ‘বি ০০০১’ থেকে ‘বি ৯৯৯৯’। একই ভাবে আসবে সি, ডি ইত্যাদি। জেড অবধি কোটা পূর্ণ হয়ে গেলে শুরু হবে এএ, এবি, এসি…ইত্যাদি। আপনার নতুন কেনা গাড়ি। তাই ‘এন’। পুরোনো গাড়ির ক্ষেত্রে এই অ্যালফাবেটটা এ, বি বা সি। বুঝতে পারলেন?’

‘এত ডিটেলে জানতাম না।’ বলল প্রথমা।

‘এখনও শেষ হয়নি,’ হাসলেন মিস্টার আয়ার। ‘সব শেষে আসছে আপনার নিজস্ব নম্বর। যেটা হল ১৪৪২। এখন, আমার প্রশ্ন হল, আপনি দিল্লির বাসিন্দা হয়ে তমলুকের শোরুম থেকে গাড়ি কিনলেন কেন?’

‘আমি প্রতি মাসে একবার বাড়ি যাই বাবা-মাকে দেখতে। ওঁরা কোলাঘাটে থাকেন। গাড়ি কিনে ওঁদের গাড়িতে চড়াব বলেই ওখান থেকে কেনা। পরে সেলফ ড্রাইভ করে দিল্লি এসেছিলাম।’

প্রথমার উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হয়ে আয়ার বললেন, ‘আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। আপনাকে নিয়ে তদন্ত কমিটির তরফে আমি সন্তুষ্ট। এই কথাটা যেখানে জানানোর, জানিয়ে দেব। আপনি এখন আসতে পারেন।’

‘ধন্যবাদ।’ লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রথমা। ধ্রুবিকাকে খুন হতে দিয়ে সে যে-কোনও অন্যায় করেনি, সেই তত্ত্বে সরকারি শিলমোহর পড়ল।

প্রথমার চিন্তার মধ্যে মিস্টার আয়ারের টেবিলের ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। আয়ার অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকালেন। এই নম্বর কারও কাছে থাকার কথা নয়।

তিনি ফোন ধরলেন। ‘হ্যালো’ বলার পরেই চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘ইয়েস স্যার! আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। হ্যাঁ। ওঁর সব ডকুমেন্ট চেক করা হয়ে গেছে। কোনও গন্ডগোল নেই। আমরা জাস্ট গল্প করছি। হ্যাঁ স্যার। এক্ষুনি।’ কথা শেষ করে কাঁপা হাতে রিসিভার ক্রেডলে রেখে বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জির অফিস থেকে ফোন এসেছে। আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে অবিলম্বে ছেড়ে দিতে। অফিসের বাইরে আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে।’

গাড়িতে বসে রয়েছে প্রথমা। কানে মোবাইল। ও প্রান্তে কথা বলছেন অরুণ চ্যাটার্জি। প্রথমার সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক। উনি নিজে ফোন করেছেন মানে পরিস্থিতি গুরুতর।

অরুণ ফোনে বলছেন, ‘শ্রীহরিকোটার নাম শুনেছিস?’

প্রথমা বলল, ‘অন্ধ্রপ্রদেশে, বঙ্গোপসাগরের ধারে। এখানে ‘সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার’ আছে। ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ সেন্টার’ বা ইসরো-র যাবতীয় স্যাটেলাইট এখান থেকে লঞ্চ হয়।’

‘কাজের কথাগুলো জানিস। আমি দুটো পয়েন্ট যোগ করছি। জায়গাটা চেন্নাই থেকে একশো পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এবং তুই এখন আর্মির হেলিকপ্টারে শ্রীহরিকোটায় যাচ্ছিস।’

‘কেন?’ প্রথমা অবাক।

উত্তর না দিয়ে অরুণ বললেন, ‘এই গাড়ি তোকে চেন্নাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে তুই চলে যাবি সতীশ ধাওয়ান স্পেস রিসার্চ সেন্টারে। সময় কম। হেলিকপ্টারে ওঠার আগে মন দিয়ে কাজের কথাগুলো শুনে নে।’

প্রথমা বলল, ‘শুনছি।’

অরুণ বললেন, ‘সবাই জানে শ্রীহরিকোটার সঙ্গে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের কোনও সম্পর্ক নেই। আসল কথাটা হল, এখানে ‘ডিআরডিও’ বা ‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশান’-এর কাজও হয়। ওরা আজ রাত ন’টার সময়ে একটা মিলিটারি স্যাটেলাইট লঞ্চ করছে। যেটার নাম ‘নবগ্রহ’। নামটা আমার দেওয়া। লঞ্চিং-এর কাজটা আমরা গোপনে আজই ঘটাতে চলেছি।’

চেন্নাই এয়ারপোর্ট এসে গেছে। এয়ারপোর্টের স্টাফেদের ব্যক্তিগত গাড়ি ঢোকার রাস্তা দিয়ে ঢুকেছে প্রথমার গাড়ি। দৌড় লাগিয়েছে আর্মির হ্যাঙ্গারের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্মির হেলিকপ্টার। অরুণ বলছেন, ‘প্রজেক্ট নবগ্রহের সঙ্গে যুক্ত আছেন চারজন মানুষ। তিন বিজ্ঞানী আর এক মন্ত্রী। বিজ্ঞানীরা হলেন বাংলার সূর্যনাথ বসু, মহারাষ্ট্রের সোনিকা খাতুন, কেরালার চার্লস ব্রায়েন। পদাধিকার বলে তোর বস, ডিফেন্স মিনিস্টার রঞ্জিত চতুর্থ সদস্য।’

শ্রীহরিকোটায় রঞ্জিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাঁর নাম শুনে প্রথমার ভুরু কুঁচকে গেল। সে এখনও রেগে আছে রঞ্জিতের ওপরে। ওঁর জন্যেই প্রথমাকে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। যে লোকটাকে বাবার মতো ভালোবাসত তাকে এখন এক নম্বর শত্রু বলে মনে করে।

অরুণ বলছেন, ‘সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের স্টাফেরা জানেন যে ইসরোর স্যাটেলাইট লঞ্চ হচ্ছে। নবগ্রহর আসল পরিচয় জানেন এই চারজন। স্পেস সেন্টারের একটি কমপ্লেক্সে গতকাল রাতে চারজন চলে এসেছিলেন। আজ ভোরবেলা কমপ্লেক্সের বেসমেন্টের কার পার্কিং-এ সোনিকা খাতুনের ডেডবডি পাওয়া গেছে। ধারালো ছুরি দিয়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।’

‘বাপরে!’ সিঁড়ি দিয়ে হেলিকপ্টারে উঠছে প্রথমা। হেলিকপ্টারে সে ছাড়া আর কোনও যাত্রী নেই।

অরুণ বললেন, ‘ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ইউ কে নায়ারকে তুই চিনিস। আমি নায়ারকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর নেতৃত্বে মিলিটারি পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমি চাই যে তুই যা।’

‘কেন?’ রোটর ব্লেডের শপশপ আওয়াজের মধ্যে জানতে চাইল প্রথমা।

‘প্রথম কারণ, খোদ রঞ্জিত একজন সাসপেক্ট। দ্বিতীয় কারণ, হাতে খুব কম সময়। তুই ওখানে পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্যাটেলাইট লঞ্চ। তার আগে ইনভেস্টিগেশান গুটিয়ে ফেলতে হবে। এটা হ্যান্ডল করার জন্যে ল্যাটেরাল থিঙ্কিং লাগবে।’

হেলিকপ্টার এখন অনেক ওপরে। টাওয়ার পাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। প্রথমা বলল, ‘ওই কমপ্লেক্সে সিসিটিভি নেই?’

অরুণ বললেন, ‘আমিই বলেছিলাম না রাখতে। তখন ভাবিনি যে এই কেলেঙ্কারি হবে।’

কথা বলতে গিয়ে প্রথমা বুঝতে পারল, মোবাইলের টাওয়ার চলে গেছে। অরুণের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের নিজস্ব এয়ার স্ট্রিপে হেলিকপ্টার টাচ ডাউন করেছে। কপ্টার থেকে নেমে প্রথমা দেখল সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইউ কে নায়ার।

নায়ারের সঙ্গে করমর্দন করছে প্রথমা, এমন সময় আবার মোবাইল বেজে উঠল। ল্যান্ডলাইন নম্বরটা চেনা। মাননীয় রাষ্ট্রপতি একটু আগে এই নম্বর থেকেই ফোন করেছিলেন।

প্রথমার সামনে দ্রুত হাঁটছেন নায়ার। প্রথমা কানে মোবাইল দিয়ে শুনতে পেল অরুণ বলছেন, ‘পৌঁছে গেলি?’

‘হ্যাঁ,’ বলল প্রথমা, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে। ‘মিলিটারি স্যাটেলাইটের নাম নবগ্রহ কেন? নয়ে নবগ্রহ কেন বলা হয়? সূর্যের গ্রহ তো আটটা।’

অরুণ বললেন, ‘সূর্যের গ্রহরা হল—বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটো। কিছুদিন আগে প্লুটো তার গ্রহত্ব হারিয়েছিল। পরে স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। অর্থাৎ গ্রহের সংখ্যা এখনও আট। কিন্তু অন্য একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান।’

‘সেটা কী?’

‘অতীত দিনের ন’টি গ্রহ হল—সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু আর কেতু।’

‘সূর্য তো নক্ষত্র! রাহু আর কেতু তো কল্পনা!’

‘ঠিক। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়ার আগে প্রাকৃতিক নানা ঘটনা মানুষ কল্পনা দিয়ে ভরিয়ে তুলত। খালি চোখে দিনরাত মিলিয়ে আকাশে দেখা যায় সাতটি উজ্জ্বল আকাশদীপ। মানুষ মনে করত এরা সবাই গ্রহ। এমন কি সূর্যও। পাশাপাশি সারা বছরে একাধিকবার সূর্যকে আর চাঁদকে কালো ছায়া এসে গ্রাস করে। কখনও আংশিকভাবে, কখনও পুরোপুরি। মানুষ ভেবে নিল রাহু আর কেতু নামের দুই গ্রহ সূর্য আর চাঁদকে খেয়ে ফেলে।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ বলল প্রথমা। সে এখন কমপ্লেক্সের বেসমেন্টে দাঁড়িয়ে।

‘তা হলে কাজ শুরু করে দে। এখন সন্ধে ছ’টা বাজে। নবগ্রহের লঞ্চিং রাত ন’টায়। তার আগে সমস্যাটার সমধান কর।’ ফোন কেটে দিলেন অরুণ।

পার্কিং-এ পাঁচটা গাড়ি রাখা রয়েছে। তার মধ্যে একটা আর্মির গাড়ি। এটায় করে নায়ার এসেছেন। একটি গাড়ি সাদা অ্যাম্বাস্যাডার। সেটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিতের। বাকি তিনটি গাড়ি হল ডাটসুন, ফক্স ভাগেন আর মারুতি। ডাটসুনের নম্বর প্লেট হল ‘ডাব্লিউ বি ০২ সি ৬৯৬৯’। ফক্স ভাগেনের ‘ডাব্লিউ বি ১২ এন ৮৮৮৮’। মারুতির নম্বর প্লেট ‘এম এইচ’ দিয়ে শুরু। ‘এম এইচ’ মানে মহারাষ্ট্রের গাড়ি। প্রথমা আন্দাজ করল, এটা সোনিকা খাতুনের। সেক্ষেত্রে বাকি দুটি গাড়ি বাংলার সূর্যনাথ বসু এবং কেরালার চার্লস ব্রায়েনের। কিন্তু কেরালার নাগরিকের গাড়িতে কেন বাংলার নম্বর প্লেট থাকবে? এই সব ভাবতে ভাবতে প্রথমা নায়ারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কখন এলেন?’

নায়ার বললেন, ‘আমি, আমার টিমের ড্যান আর আসিফ দিল্লি থেকে আর্মির হেলিকপ্টারে এসেছি। সকাল সাড়ে দশটার সময়ে।

‘এখনও পর্যন্ত কী জানা গেল?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।

নায়ার বললেন, ‘এখানে এসেই আমরা একটা অফিস বানিয়ে ফেলেছি। সেখানে চলো। বলছি।’

‘প্রথমেই যেটা বলার, সেটা হল, সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের বাকি অংশের সঙ্গে এই কমপ্লেক্সের কোনও যোগ নেই। এর এন্ট্রান্স আলাদা।’ অফিসের চেয়ারে বসে বললেন নায়ার।

প্রথমা চেয়ারে বসে দেখল মিলিটারির উর্দি পরা দুজন ছেলে ল্যাপটপে কাজ করছে। প্রথম ছেলেটি হাত নেড়ে বলল, ‘হাই! আমি ড্যান।’ অন্য ছেলেটি বলল, ‘হ্যালো। আমি আসিফ।’

নায়ার বললেন, ‘ওরা দুজনেই ফরেনসিক এক্সপার্ট।’

প্রথমা মৃদু হেসে হাত নাড়ল।

নায়ার বললেন, ‘কম কথায় পুরো সিচুয়েশান বলছি। মন দিয়ে শোনো। গোটা বিল্ডিং-এ সিসিটিভি কভারেজ নেই। গতকাল রাতে তিন বিজ্ঞানী এবং এক মন্ত্রী আলাদা আলাদা সময়ে এখানে ঢুকেছেন। তাঁদের মুখের কথার ওপরে ভরসা করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। আমাদের হাতে রয়েছে ওয়েপন অফ মার্ডার আর একটা ডেডবডি।’

আসিফ বলল, ‘ওয়েপন অফ মার্ডার একটা ছুরি। এটা ক্রাইম সিনেই পড়ে ছিল। কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই। কোনও বডি ফ্লুইড বা ফাইবারও নেই যে ম্যাচ করব।’

প্রথমা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বেসমেন্টের পার্কিং জোনে ছুরি কোথা থেকে এল? কিলার সঙ্গে এনেছিল?’

‘এটা কিচেন নাইফ। এই কমপ্লেক্সে একটা কিচেন আছে। সেখানে আরও ছুরি আছে।’ বলল আসিফ।

‘তা হলে কিলার ছুরিটা ক্রাইম সিনে ফেলে গেল কেন?’ প্রথমার ভুরু এখনও কুঁচকে আছে।

ড্যান বলল, ‘ছুরির চলন সোনিকার গলার ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে। এর মানে হল, খুনি পিছন থেকে ডানহাতে সোনিকার গলায় বেড় দিয়েছে। তারপর বাঁ-হাতে ছুরি চালিয়েছে। মোস্ট প্রোব্যাবলি কিলার বাঁ-হাতি।’

অপ্রিয় প্রশ্নটা করতে বাধ্য হল প্রথমা, ‘বডি কোথায়?’

আসিফ বলল, ‘বডি পোস্ট মর্টেমের জন্যে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পেতে একদিন লাগবে।’

প্রথমা শ্রাগ করে বলল, ‘তা হলে আর দুটো রাস্তাই পড়ে আছে। সাসপেক্টদের জেরা করা আর তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা।’

ড্যান বলল, ‘দুটো কাজই কমপ্লিট। সব ডেটা এক জায়গায় করে আপনার জন্যে প্রিন্টআউট নিয়ে রেখেছি। আপনি জেরাটা আর একবার করুন।’

ড্যানের হাত থেকে পাতলা একটা ফাইল নিয়ে প্রথমা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘প্রথমে চার্লসের সঙ্গে কথা বলব।’

চার্লসের বেডরুমে ঢুকে প্রথমা দেখল, একদিকের দেওয়াল কাচ দিয়ে মোড়া। সেখান থেকে স্যাটেলাইটের লঞ্চিং গ্রাউন্ড দেখা যাচ্ছে। গ্রাউন্ডে জনাকুড়ি স্টাফ কাজ করছে। বাঁ-হাতে ওয়াকি টকি ধরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন বছর পঞ্চাশের চার্লস। টেবিলে রাখা রয়েছে ঢাউস ডেস্কটপ। সেখানে ক্রমাগত নতুন নতুন ডায়াগ্রাম আসছে।

চার্লসের চেহারা লম্বা-চওড়া। নায়ারকে ঢুকতে দেখে বললেন, ‘প্লিজ, এবার আমাকে রুম থেকে বেরোতে দিন। ওরা আমাকে ছাড়া ম্যানেজ করতে পারছে না।’

নায়ার হাত নেড়ে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘তার আগে ইনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

চার্লস প্রথমার পরিচয় জানতে চাইলেন না। ওয়াকি টকি টেবিলে রেখে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি।’

ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে প্রথমা বলল, ‘জন্ম ত্রিচিতে। বাবা-মায়ের এক ছেলে। কেরালাতেই অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনো। প্রথম চাকরি ডিআরডিওতে। সেটাই এখনও করছেন। ব্যাঙ্কে ত্রিশ লাখ টাকার ধার।’

‘ওটা হাউস বিল্ডিং লোন।’ বিরক্ত মুখে বললেন চার্লস।

‘নতুন ফ্ল্যাট কিনতে হয়েছে কারণ দু’বছর আগে আপনার ডিভোর্স হয়েছে। প্রাক্তন স্ত্রীকে আগের ফ্ল্যাট দিতে বাধ্য হয়েছেন। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কলকাতা থেকে গাড়ি কিনেছেন কেন?’

চার্লস বাঁ-হাত দিয়ে ডেস্কটপের কিবোর্ডে ঝড় তুলে কিছু একটা লিখলেন। সেটা সেভ করে বললেন, ‘আমার ছেলে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটে পড়ে। ওকে ছ’মাস আগে ফক্স ভাগেনটা কিনে দিয়েছিলাম। ছেলে ব্যবহার করে না বলে নিয়ে চলে এসেছি। আগের গাড়িটা প্রাক্তন বউ নিয়েছে।’

ফাইল পাশে রেখে প্রথমা বলল, ‘আপনি এখন কোথায় থাকেন?’

‘এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরের হাউজিং কমপ্লেক্সে।’

‘কাল এখানে ক’টার সময়ে ঢুকেছেন?’

‘রাত সওয়া ন’টায় ঢুকে গ্যারাজে গাড়ি রেখে এখানে চলে আসি। ডেস্কটপে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কাজ করে শুতে যাই। ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে ব্যায়াম করা আমার বরাবরের অভ্যেস। আজ ভোরে উঠে মনে পড়ল গাড়ি থেকে বুলওয়ার্কার বার করতে ভুলে গেছি। সেটা আনতে কার পার্কিং-এ গিয়ে সোনিকার ডেডবডি দেখতে পাই। তখন দৌড়ে এসে রঞ্জিত আর সূর্যনাথকে ঘুম থেকে তুলি।’

‘কাল রাতে ওঁদের কারও সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল? বা সোনিকার সঙ্গে?’

‘না,’ কঠিন গলায় উত্তর দিয়ে ওয়াকি টকি বাঁ-হাত দিয়ে তুলে নিলেন চার্লস। প্রথমা নায়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন। এবার সূর্যনাথের কাছে যাই।’

সূর্যনাথের বয়স চল্লিশের আশেপাশে। শ্যামলা রং, পেটানো চেহারা। টিশার্ট আর বারমুডা পরে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর ডান কানে ওয়াকি টকি গুঁজে কথা বলছেন। নায়ার আর প্রথমাকে দেখে ডানহাতের ইশারায় বসতে বলে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। সেই সুযোগে প্রথমা ফাইল খুলে সূর্যনাথের বায়োডেটা পড়ে নিল।

ডোভার লেনে বাড়ি। বাবা-মা দুজনেই কলেজের অধ্যাপক। যমজ ছেলের নাম সূর্যনাথ এবং চন্দ্রনাথ। সূর্যনাথের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার সোনা দিয়ে বাঁধানো। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্সে অনার্স। তারপরে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনো করে ডিআরডিও-তে চাকরি। বিয়ে করেননি। ডোভার লেনের বাড়িতে ত্থাকেন বাবা-মা এবং ভাই চন্দ্রনাথ। সেখানে দু’মাসে একবার ঘুরে আসেন। চেন্নাইতে নিজের বাড়ি আছে।

ড্যানের দেওয়া প্রিন্ট আউটের মধ্যে একাধিক ফোটো আছে। তার মধ্যে সূর্যনাথ আর চন্দ্রনাথের ছোটবেলার ব্যাডমিন্টন খেলার ফোটোও আছে। ফোটোতে সূর্যনাথ ডানহাতি এবং চন্দ্রনাথ বাঁ-হাতি।

ওয়াকি টকি খাটে রেখে, ডানহাত দিয়ে কিবোর্ডে টরেটক্কা বাজাতে বাজাতে সূর্যনাথ বললেন, ‘যা জানতে চান দ্রুত জিজ্ঞাসা করুন।’

প্রথমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল ক’টার সময়ে কমপ্লেক্সে ঢুকেছিলেন?’

‘রাত সাড়ে ন’টা।’

‘তখন কার পার্কিং-এ ক’টা গাড়ি ছিল?’

একটু ভেবে সূর্যনাথ বললেন, ‘খেয়াল করিনি। গাড়ি পার্ক করে ঘরে এসেই শুয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে চার্লস ডাকার পরে ঘুম ভাঙল। আমিই ডিআরডিও-তে ফোন করে মিলিটারি পুলিশ পাঠাতে বলি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছিলেন।’

‘বিরোধিতা কেন করেছিলেন? আপনার কী মনে হয়।’

সূর্যনাথ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমার কিছু বলা সাজে না।’

সূর্যনাথের নীরবতার কারণ প্রথমা বুঝতে পারছে। সূর্যনাথ সরকারি কর্মচারি। রঞ্জিত তাঁর দপ্তরের মাথা। বসের বিরুদ্ধে উনি মুখ খুলবেন না।

প্রথমা জিজ্ঞাসা করল, ‘সোনিকাকে কে খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়?’

সূর্যনাথ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘একটা কথা বলি। এই প্রজেক্টে প্রচুর আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা রোবোট ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যান্ড দে আর ড্যাম স্মার্ট। দে ক্যান কিল আ পারসন। ক’দিন আগেই কোরিয়াতে একটি কিলার রোবোটের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাগজে পড়েছেন নিশ্চয়?’

লোকটা এবার বাজে বকছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল প্রথমা। অন্তিম গন্তব্য, রঞ্জিত গগৈ।

রঞ্জিত মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। প্রথমা আর নায়ারকে ঢুকতে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এক্ষুনি আমার কাছে খবর এল। নবগ্রহ লঞ্চিং-এর ব্যাপারটা ওয়ারিস্তান জেনে গিয়েছিল। ওরা স্পেস সেন্টারের মধ্যে নিজেদের লোক প্লান্ট করেছে। আজ লঞ্চিং-এর আগে বোমা ফাটবে।’

প্রথমা রঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই লোকটা তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি বসিয়েছিলেন। এই লোকটা ভেবেছিলেন সে দেশবিরোধী কাজ করেছে। আজ সেই অভিযোগগুলোতেই লোকটা অভিযুক্ত। রঞ্জিতের পলিটিকাল কেরিয়ার এখন প্রথমার হাতে। মিডিয়ার কাছে এই খবর পৌঁছে গেলে রঞ্জিতের মন্ত্রীত্ব যেতে বাধ্য। একটা মাত্র ফোন কল রঞ্জিতের কেরিয়ার শেষ করে দিতে পারে। প্রথমা কি প্রতিশোধ নেবে?

রঞ্জিত ঢোঁক গিলে বললেন, ‘এখন আটটা বাজে। লঞ্চিং ন’টার সময়ে। প্রথমা, ডু সামথিং!’

প্রথমা ফাইলের পাতা উল্টোচ্ছে। পঞ্চাশ বছরের রঞ্জিতের জন্ম অসমের দিসপুরে। বাবা-মা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী ছিলেন। রঞ্জিতরা পাঁচ ভাইবোন। বাকি ভাইবোনেরা অসমেই থাকেন। দু’জন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন প্রফেসর। রঞ্জিত জুলজিতে স্নাতক। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা আছে। পরবর্তীকালে রাজনীতি করেছেন, দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে মন্ত্রী হয়েছেন। ভোটে দাঁড়িয়েছেন বলে রঞ্জিতের সম্পত্তির হিসেব ইলেকশান কমিশনকে দিতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে তিনি কোটিপতি। আর একটি তথ্য চোখে পড়ল প্রথমার। রঞ্জিতের ডান এবং বাঁ-হাত সমান চলে। বাংলায় এদের সব্যসাচী বলে। ইংরিজিতে, অ্যাম্বিডেক্সট্রাস।

প্রথমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল রাতে আপনি ক’টার সময় এখানে ঢুকেছেন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জিত বললেন, ‘রাত ন’টার সময়। কার পার্কিং-এ গাড়ি রেখে নিজের কামরায় চলে আসি। তারপরে কী হয়েছে জানি না। কাল রাতে সূর্যনাথ, সোনিকা বা চার্লসের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আজ ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়ে চার্লস আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলে যে সোনিকা খুন হয়েছে। বেসমেন্টে ওর ডেডবডি দেখে আমি এতটাই পারপ্লেক্সড হয়ে যাই যে কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’

‘পুলিশে খবর দিতে চাননি কেন?’

‘ব্যাপারটা ওরকম নয়।’ সূর্যনাথ চেঁচামেচি শুরু করলেন, ‘এক্ষুনি খবর দিতে হবে!’ আমি বললাম, ‘একটু ওয়েট করুন। আমাকে ভাবতে দিন। উনি শুনলেন না।’

নায়ার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘সূর্যনাথকে আমার প্রথম থেকে সন্দেহ হচ্ছে। পুলিশ ডাকা নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কেন? তার ওপরে কিলার রোবোট নিয়ে ফালতু কথা বলে ডিসট্র্যাক্ট করার চেষ্টা করছেন।’

প্রথমা এই আলোচনার মধ্যে ঢুকল না। তার মন বলছে, যা জানার, জানা হয়ে গেছে। যা দেখার, দেখা হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে জমেছে ডেটা বেস। তার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো তুলে নিয়ে জুড়ে ফেলতে হবে।

কী সেই তথ্য? আজ এখানে আসার পর থেকে সে কী কী জেনেছে? কী কী দেখেছে? কী কী শুনেছে? কে কে মিসগাইড করার চেষ্টা করছে। কেই বা সত্যি কথা বলছে?

রঞ্জিতের ঘর থেকে বেরোল প্রথমা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল কার পার্কিং-এ। বেসমেন্টের মেঝেয় বসে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজল।

নবগ্রহ লঞ্চের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। সেটা নিয়ে না ভেবে মার্ডার নিয়ে ভাবছে প্রথমা। এবং উল্টোদিক থেকে ভাবছে। নবগ্রহের লঞ্চিং ওয়ারিস্তান কীভাবে বন্ধ করতে পারে? স্যাটেলাইটের মধ্যে সাবোতাজ করে? এই সম্ভাবনা সত্যি হলে, সাবোতাজকারী খুন করতে গেল কেন? সোনিকা কি ওয়ারিস্তানের এজেন্টকে চিনতে পেরেছিল? তাই তাকে প্রাণ দিতে হল?

হঠাৎই প্রথমার মাথায় খেলে গেল আর একটা সম্ভাবনা। সে মোবাইলে চেন্নাই পুলিশের এসপিকে ফোন করল। উনি প্রথমাকে চেনেন।

প্রশ্ন শুনেই উত্তেজিত হয়ে এসপি একগাদা কথা বললেন। অনেক তথ্য মেইল করে দিলেন। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে প্রথমা। দৌড়ে দোতলায় গিয়ে প্রতিটা রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর বলছে, ‘সব্বাই নীচে আসুন। এক্ষুনি!’ তারপরে বেসমেন্টে ফিরে আসছে।

চার্লস এলেন সবার আগে। তারপরে সূর্যনাথ আর নায়ার। প্রথমা বলল, ‘স্যার কোথায়?’

‘এসে গেছি,’ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন রঞ্জিত। প্রথমা দেখল তিনি কোলে করে একটা রোবট নিয়ে এসেছেন। ‘দুর্গা’ নামের রোবোটটি যান্ত্রিক গলায় বলছে, ‘আই উইল স্টার্ট কাউন্টডাউন উইদিন ফাইভ মিনিটস। প্লিজ গেট রেডি।’

দুর্গাকে মেঝেতে নামিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘লঞ্চিং-এর সময় আর পাঁচ মিনিট পরে।’

প্রথমা রঞ্জিতকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার গাড়ির নম্বর কত?’

‘জানি না,’ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন রঞ্জিত। ‘আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরের অ্যাম্বাস্যাডার গাড়িতে চড়ি। নম্বর জানি না।’

চার্লসের দিকে তাকিয়ে প্রথমা বলল, ‘আপনার ফক্স ভাগেনের নম্বর হল ডাব্লিউ বি ১২ এন ৮৮৮৮’। গাড়িটা কবে কেনা?’

‘ছ’মাস আগে।’ জবাব দিলেন চার্লস। তিনি অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন।

সূর্যনাথের দিকে তাকিয়েছে প্রথমা। ‘আপনার ডাটসুন গাড়ির নম্বর হল ডাব্লিউ বি ০২ সি ৬৯৬৯। ‘সি’ সিরিজের গাড়ি অনেক পুরোনো হয়। কিন্তু ডাটসুন ভারতে লঞ্চ হয়েছে মাত্র আটমাস আগে। সেই গাড়িতে ‘সি’ এল কী করে?’

সূর্যনাথ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রথমা বলল, ‘আপনি সূর্যনাথ নন। তাঁর যমজ ভাই চন্দ্রনাথ। ওয়ারিস্তানের এজেন্ট।’ তারপর চন্দ্রনাথের রগে পিস্তল ঠেকিয়ে সেফটি ক্যাচ অন করে বলল, ‘তিন গুনব। তার মধ্যে সত্যি কথা না বললে…এক…দুই…’

হাঁউমাউ করে উঠেছেন চন্দ্রনাথ, ‘প্লিজ আমাকে মারবেন না!’

পিস্তল না সরিয়ে প্রথমা বলল, ‘প্ল্যানটা বলে ফেলুন। কুইক!’

চন্দ্রনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমার গাড়িটায় বোম ফিট করা আছে। কার বোম্ব। টাইমার অন করা আছে। ফাটবে স্যাটেলাইট লঞ্চ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড আগে।’

ঠিক এই সময়ে দুর্গা যান্ত্রিক গলায় বলে উঠল, ‘কাউন্টডাউন হ্যাজ স্টার্টেড। সিক্সটি, ফিফটি নাইন, ফিফটি এইট…’

‘আর এক মিনিটের মাথায় নবগ্রহ লঞ্চ!’ ফিশফিশিয়ে বললেন রঞ্জিত।

প্রথমা চন্দ্রনাথের পকেটে হাত গলিয়ে গাড়ির চাবি বার করে গাড়িতে উঠতে গেল। ওঠার আগেই চোখ চলে গেছে গাড়ির ভিতরে। এসইউভি ভর্তি রয়েছে জেলাটিন স্টিকে। এক্সপ্লোসিভ নিয়ে হাতেকলমে অনেক কাজ করেছে প্রথমা। সে বুঝতে পারল বড় গাড়ি নেওয়া হয়েছে যাতে অনেক বিস্ফোরক পদার্থ ধরে। বিস্ফোরণ হওয়া মাত্র উড়ে যাবে এই বেসমেন্ট, এই কার পার্কিং, এই কমপ্লেক্স। উড়ে যাবে নবগ্রহ। পুরো সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার উড়ে যাবে কি? কে জানে?

এক মিনিটের নোটিশে, অ্যান্টি বোম্বিং গিয়ার ছাড়া এক্সপ্লোসিভ নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে ভাবা এখন বিলাসিতা। প্রথমা চন্দ্রনাথের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে গাড়ির মধ্যে বসাল। বাইরে থেকে দরজায় লক করে বাকিদের বলল, ‘পালান! হাতে দশ সেকেন্ড আছে!’

প্রথমা, চার্লস আর রঞ্জিত দৌড়োচ্ছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে রঞ্জিত বললেন, ‘চন্দ্রনাথ যদি সুইসাইড বম্বার হয়? তাহলে ও গাড়ির মধ্যে চুপটি করে বসে থাকবে।’

দুর্গা বলল, ‘ফিফটি সেভেন, ফিফটি সিক্স, ফিফটি ফাইভ…’

প্রথমা দৌড়তে দৌড়োতে বলল, ‘চন্দ্রনাথের রগে যখন আমি পিস্তলের নল ঠেকালাম, তখন ও ভয় পেয়ে বলল, ‘প্লিজ আমাকে মারবেন না!’ তারপরে সব কথা গলগল করে বলে দিল। সুইসাইড বোম্বারের মানসিকতা এটা নয়।’

দুর্গা যান্ত্রিক গলায় বলল, ‘ফিফটি, ফর্টি নাইন, ফর্টি এইট…’

চার্লস বলল, ‘কিন্তু ও যদি বোম্ব ডিফিউজ করার কায়দা না জানে?

প্রথমা বলল, ‘তা হলে আমরা সবাই মরে যাব।

দুর্গা বলল, ‘ফর্টি সেভেন, ফর্টি সিক্স, ফর্টি ফাইভ…’

প্রথমা, চার্লস, নায়ার আর রঞ্জিত দাঁড়িয়ে পড়লেন। এই টেনশান আর নেওয়া যাচ্ছে না। যা হওয়ার হয়ে যাক।

কোনও বিষ্ফোরণের শব্দ নেই। দুর্গা বলে যাচ্ছে, ‘ফর্টি ফোর, ফর্টি থ্রি, ফর্টি টু…’

প্রথমা উলটো দিকে দৌড় দিয়েছে। চেঁচিয়ে বলছে, ‘মিশন সাকসেসফুল! চলুন, আমরা দোতলা থেকে নবগ্রহের উড়ান দেখি!’

সাউথ ব্লকে রঞ্জিতের অফিসে বসে রয়েছেন রঞ্জিত, নায়ার এবং অরুণ। প্রথমা ঘরে ঢুকে সবাইকে স্যালুট করে বলল, ‘জয় হিন্দ স্যার!’

অরুণ হাত নেড়ে বসতে বললেন। প্রথমা সোফায় বসে বলল, ‘চেন্নাই পুলিশের এসপির সঙ্গে এক্ষুনি আবার আমার কথা হল। গতকাল রাত ন’টার একটু আগে উনি আমাকে সূর্যনাথের মার্ডার সংক্রান্ত ফাইলটা মেইল করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে চন্দ্রনাথকে কাস্টডিতেও নিয়েছেন। চেন্নাই পুলিশ শুধু এইটুকু জানে যে চন্দ্রনাথ তাঁর যমজ ভাই সূর্যনাথকে খুন করেছেন। চন্দ্রনাথ যে ওয়ারিস্তানের এজেন্ট, এটা জানে না। আর একটা কথা। পুলিশ যেহেতু মিডিয়াকে কোনও তথ্য দেয়নি, তাই সূর্যনাথের খুন সম্পর্কে কোনও তথ্য ইন্টারনেটে নেই। ড্যান আর আসিফ সূর্যনাথের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলেও, লোকটা যে খুন হয়ে গিয়েছে এই তথ্য জানতে পারেনি। ওই জন্যেই বলি, যন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের ইনটেলিজেন্সের ওপরেও ভরসা রাখতে হয়।’

রঞ্জিত বললেন, ‘মিডিয়া এইবার খবর পাবে। তিন-চার দিন খুব হইচই হবে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলেই চন্দ্রনাথ ‘র’-এর কাস্টডিতে যাবে। কিন্তু সে সব বাদ দেওয়া যাক। তুই আমাকে বল, সূর্যনাথের খুনটা আন্দাজ করলি কী করে?’

প্রথমা বলল, শৈশবের ফোটোতে এক ভাই ফর্সা আর এক ভাই শ্যামলা। যমজ ভাইয়ের নাম সূর্যনাথ আর চন্দ্রনাথ রাখার পিছনে যুক্তি হল একজন ফর্সা আর অন্যজন শ্যামলা। গতকাল সূর্যনাথ শ্যামলা দেখে প্রথম খটকাটা লাগল। গাড়ির নম্বরের গন্ডগোলটা দ্বিতীয় খটকা। তখন চেন্নাই পুলিশের এসপির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনি বললেন, সূর্যনাথ খুন হয়েছেন। ক্রাইম সিনের যাবতীয় ফোটো আমাকে মেইল করে দিলেন। দেখলাম, যিনি খুন হয়েছেন তিনি ফর্সা। এবং তাঁর গাড়িটি লাল মারুতি। যে মডেল আজকাল আর তৈরি হয় না। তাছাড়া, আমার মনে পড়ে গেল দুই ভাইয়ের ব্যাডমিন্টন খেলার ফোটোর কথা। চন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে ছুরির মুভমেন্ট দেখে পুলিশ বুঝে যাবে, খুনি বাঁ-হাতি। তাই উনি আমাদের সামনে ডানহাত ব্যবহার করছিলেন।’

‘উনি লাল মারুতিকে গাড়িবোমা হিসেবে ব্যবহার করলেন না কেন?’ জিজ্ঞাসা করলেন অরুণ।

‘ছোট গাড়িতে বেশি জেলাটিন স্টিক রাখা যায় না। পুরো স্পেস সেন্টার ওড়ানোর জন্যে অনেক বেশি বিষ্ফোরকের প্রয়োজন ছিল।’

‘নম্বর প্লেট কেন বদলাল? নতুন গাড়ি নিয়ে ঢুকলেই তো হত।’

‘তার কারণ স্পেস সেন্টারের সিকিয়োরিটি সিস্টেম। সেখানকার ডেটাবেসে ওই নম্বরটাই স্টোর করা আছে। নতুন নম্বর প্লেটওয়ালা গাড়ি নিয়ে চন্দ্রনাথ ঢুকতে পারতেন না। সেই জন্যেই নতুন গাড়িতে পুরনো নাম্বার প্লেট লাগাতে হয়েছিল। সূর্যনাথকে খুন করা এবং নাম্বার প্লেট বদলানো—সবই নিখুঁত প্ল্যানিং-এর অঙ্গ। কিন্তু চন্দ্রনাথ মাথায় রাখেননি যে পুরোনো গাড়িতে নতুন নম্বর প্লেট বসালে সেটা ধরা পড়ে যায়। যেটা সোনিকা দেখা মাত্র বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ওঁকে মরতে হল।’

‘চন্দ্রনাথ হঠাৎ ওয়ারিস্তানের এজেন্ট হয়ে গেল কী করে?’

‘প্রজেক্ট নবগ্রহের সঙ্গে সূর্যনাথ যুক্ত। এবং তাঁর যমজ ভাই আছে। এই তথ্য জেনেই ওয়ারিস্তান চন্দ্রনাথকে টোপ দেয়। টাকার লোভে উনি কাজটা করেন। সোনিকা সেই রাতে কার পার্কিং-এ নতুন ডাটসুন দেখে চন্দ্রনাথকে মোবাইলে ফোনে জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যাপার? ধরা পড়ে গেছেন বুঝতে পেরে, হাতে গ্লাভস পরে, রান্নাঘর থেকে কিচেন নাইফ নিয়ে নেমে এসেছিলেন চন্দ্রনাথ। সোনিকাকে খুন করে ওপরে পালিয়েছিলেন। সোনিকা খুন হয়ে ভারতবর্ষকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন। গাড়িবোমা ফাটলে স্পেস স্টেশান উড়ে যেত। স্যাটেলাইট লঞ্চ ব্যর্থ হত। সারা পৃথিবী জেনে যেত যে আমরা গোপনে মিলিটারি স্যাটেলাইট লঞ্চ করছিলাম। আশা করা যায়, পালানোর রাস্তা চন্দ্রনাথ রেডি রেখেছিলেন। কীভাবে, সেটা জেরা করলেই জানা যাবে।’

অরুণ প্রথমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর ল্যাটেরাল থিঙ্কিং কী সুন্দর কাজ করল!’

রঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে প্রথমা বলল, ‘ল্যাটেরাল থিঙ্কিং কি না জানি না। তবে রঞ্জিত স্যার আমাকে তদন্ত কমিটির মুখে না ফেললে এই কেসটার সমাধান করতে পারতাম না। গাড়ির নাম্বার প্লেট কীভাবে ডিকোড করতে হয়, সেটা গতকাল সকালে তদন্ত কমিটির মিস্টার আয়ারের কাছ থেকে শিখলাম।’

রঞ্জিত মাথা নিচু করে বসেছিলেন। মাথা তুলে বললেন, ‘সরি প্রথমা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *