নয়া বীরপুরুষ – প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র
মা
বাবলু
যুবক
দুজন প্রতিবেশী
প্রথম দৃশ্য
[একটি একতলার ফ্ল্যাটের ঘর। মধ্যবিত্ত মালিকের পরিবার। চেয়ার টেবিল সাধারণ। একপাশে একটা সিন্দুক দেওয়ালে গাঁথা। দুপুরবেলা বাবলু চেয়ারে বসে কবিতা মুখস্থ করছিল। পাশের ঘর থেকে মা ঢুকল। মার্কেটিং-এ বার হবে, তাই কাঁধে কাজকরা চটের থলি। সময় দুপুর]
বাবলু। একী, মা, তুমি এই দুপুরে বেরোচ্ছ?
মা। বাজারে যাব। কিছু কাজের জিনিস কিনতে হবে।
বাবলু। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ মুখস্থ করেছি। শুনে যাও।
মা। তাড়াতাড়ি বলো, আমার দেরি হয়ে যাবে।
বাবলু। তবে শোনো-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’-
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
মা। বাঃ! বেশ হচ্ছে। মস্ত কবিতা, পরে সবটা শুনব। আমার তাড়া আছে।
বাবলু। আচ্ছা মা, বলো তো, আমি বীরপুরুষ হতে পারি না?
মা। কেন পারবে না?
বাবলু। আমার তো রাঙা ঘোড়া নেই। আর তুমিও পালকি চড়ো না।
মা। ওসব তো একালে চলে না।
বাবলু। যাঃ! একালে বীরপুরুষ হয় না?
মা। (হেসে) বীরপুরুষ সবকালে হয় বাবা।
বাবলু। বলো না, কী করে হব?
মা। মনে সাহস আনতে হবে, ভয় পেলে চলবে না। বুদ্ধি করে বিপদ কাটাতে হবে। (মা গাইল) ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না। দু-বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’
বাবলু। আমি পারব তো? বীরপুরুষ হতে পারব তো মা?
মা। আমার বাবলু সোনা নিশ্চয় পারবে। (বাবলুকে আদর করে) আর কথা নয়। আমি মার্কেটে যাচ্ছি। তুমি দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। আমি না ফিরলে কিছুতেই খুলবে না। আজকাল পাড়ায় খুব চুরি-ডাকাতি হচ্ছে। তুমি একা থাকবে। বাইরের বদলোক যদি ঢুকে পড়ে!
বাবলু। না মা, আমি কষে দরজা বন্ধ করে রাখব। যতই কলিংবেল বাজুক কিছুতেই খুলব না। চোর-ডাকাতের সাধ্য কী, আমি থাকতে এই ঘরে ঢোকে। ‘এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার, টুকরো করে দেব তোদের মেরে।’ মা আমার তো তলোয়ার নেই। একটা তলোয়ার কিনে আনবে?
মা। ছোটো ছেলেদের তলোয়ার নিতে নেই। কখন হাত কেটে যাবে।
বাবলু। তবে যে রবিঠাকুর লিখেছেন, ‘এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার…’
মা। নাঃ, তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। আমি আসছি।
বাবলু। যাবে আর আসবে। বেশি দেরি কোরো না। আমার জন্যে চকলেট আনবে। ভুলো না।
মা। না ভুলব না। দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করে রেখো। যেই আসুক, কিছুতেই খুলো না। খিদে পেলে, ও ঘরে ফল আছে, খেয়ে নিয়ো।
[মা বাইরে বেরিয়ে গেল]
বাবলু। (কবিতার ছত্র বলল) ভয় কোরো না মাগো। (সে দরজা বন্ধ করে দিল, সাবধানে লক করল)
চোর কাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।
তারপর, তারপর, ঠিক মনে পড়ছে না। বইটা একবার দেখে নিই। (বই খুলল। দরজায় ঘণ্টা বাজল) আঃ, বীরপুরুষ মুখস্থ ঝালিয়ে নিচ্ছি। কে আবার ডাকে? (ঘণ্টা আবার বাজল) কে, কে, দরজায় ঘণ্টা বাজাচ্ছে?
যুবক। (নেপথ্যে) দরজা খোলো। আমি টেলিফোনের মেকানিক। তোমাদের বাড়ি টেলিফোন সারাতে এসেছি। দরজা খোলো।
বাবলু। না খুলব না, তুমি পরে এসো। মা দরজা খুলতে বারণ করেছে। (কবিতায় মন দেয়)’এমন সময়… হারে-রে-রে, রে-রে-রে… ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে’- (আবার ঘণ্টা বাজল) আঃ জ্বালিয়ে মারলে। এত ভালো কবিতাটা আমাকে মুখস্থ করতে দিচ্ছে না।
যুবক। (নেপথ্যে) খোলো দরজা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে।
বাবলু। না, খুলব না, মা বলেছে, চোর-ডাকাত ঢুকে পড়বে।
যুবক। (নেপথ্যে) আমি চোর-ডাকাত নই, টেলিফোনের মেকানিক। দরজা খোলো।
বাবলু। (জোরে) না খুলব না। মার বারণ। চলে যাও। চলে যাও বলছি।
মা। (নেপথ্যে) বাবলু, দরজা খোলো। আমি ফিরে এসেছি।
বাবলু। (দরজা খুলল। মা ঢুকল) তুমি এর মধ্যে ফিরে এলে যে?
মা। তোমার কবিতা শুনতে শুনতে টাকা নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম। তুমি কাকে ধমক দিচ্ছিলে?
যুবক। (প্রবেশ করে) আমাকে। আমি টেলিফোনের মেকানিক। আপনাদের টেলিফোন সারাতে এসেছি। (সে হাতের ব্যাগটা টেবিলে রাখল)
মা। এই অসময়ে এলেন? আমি আবার এখনই বেরোব। তাড়াতাড়ি মেরামতি সেরে ফেলুন।
যুবক। (অন্য মূর্তি ধরে) আমি মেরামতি করতে আসিনি, মেরামতি দেখাতে এসেছি। (ব্যাগ থেকে একটা রিভলভার বের করে বাবলুর মার দিকে ধরে) এটা কী দেখছ?
বাবলু। রিভলবার! কে তুমি? ডাকাত? (কবিতার ছন্দে) ‘হাতে লাঠি মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।’ তোমার এ এসব কিছু নেই?
যুবক। চোপরও ছোঁড়া, কী আছে এখনই দেখবি।
মা। এরা ভদ্রবেশী ডাকাত, মারুতি গাড়ি চড়ে ডাকাতি করতে আসে।
যুবক। সবই তো জানো। তবে সুড়সুড় করে সিন্দুকের চাবিটা ফেলে দাও। নইলে গুলি চালিয়ে বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেব।
মা। সিন্দুকে কিচ্ছু নেই। খালি সিন্দুক। সব গয়না ব্যাংকের লকারে আছে।
যুবক। মিথ্যে কথা। আমি খবর পেয়েছি কাল লকার থেকে গয়না বার করে পরে বিয়ের নেমন্তন্নে গেছিলে। সব গয়না সিন্দুকে আছে। লকারে তোলার সময় হয়নি। দাও চাবি।
মা। চাবি কোথায় আছে আমি জানি না, চাবি আমার স্বামীর কাছে থাকে।
যুবক। (ঝট করে বাবলুর ঘাড় ধরে) বের কর চাবি। নইলে তোর ছেলের মাথার খুলি রিভলভারের বাঁট দিয়ে চৌচির করে দেব।
মা। না না আমার ছেলেকে মেরো না, ছেড়ে দাও। এই নাও চাবি। (ব্যাগ থেকে চাবি বার করে দিল)
যুবক। (বাবলুকে ছেড়ে বাঁ হাতে রিভলবার ধরে ডান হাতে চাবি তুলে নিয়ে) পথে এসো বাছাধন। এতে অনেক চাবি। কোনটা সিন্দুকের?
মা। বড়ো চাবি।
যুবক। (সিন্দুক খুলল। তখনও বাঁ হাতে রিভলবার উঁচিয়ে) বাঃ বাঃ কত সোনার গয়না, চুড়ি, হার, কানের দুল, আংটি…।
আমি একাই কাজ হাসিল করছি। কাউকে ভাগ দিতে হবে না। (সে ব্যাগটা খুলল গয়না পোরার জন্য)
মা। না, না নিয়ো না, ওগুলিই আমার যথাসর্বস্ব। নিয়ো না। (মা যুবককে বাধা দিতে গেল, যুবক এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিল)
যুবক। খবরদার, হাত তোলো হাত তোলো, নইলে গুলি চালাব।
মা। মার গুলি, তবু তোকে আমার গয়না নিতে দেব না।
[বাবলু এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে সব দেখছিল। মার বিপদে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে যুবকের পায়ে সজোরে ল্যাং মারল, যুবক মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ল। সে কিছু করবার আগেই মা রিভলবার তুলে নিয়ে যুবকের দিকে তাক করল]
মা। হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ। নইলে গুলি চালাব।
যুবক। (যাত্রাদলের মত হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠল) ওতে কিছু হবে না। ওটা খেলার রিভলভার, ওতে শুধু আওয়াজ হয়, মানুষ মরে না।
[মা খটখট করে রিভলভারের ঘোড়া টিপল। শুধু আওয়াজ হল। মা রিভলভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বাবলু সেটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখতে লাগল]
যুবক। কেমন, বিশ্বাস হল তো? এইবার আমি মালগুলো পাচার করি। খবরদার কেউ নড়বি না, নইলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।
মা। আমি এখন চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করব। ডা-কা-
যুবক। (যুবক মায়ের গলা টিপে ধরল) তোকে গলা টিপে খুন করব।
[ধস্তাধস্তিতে মা মাটিতে পড়ে গেল। যুবক তার বুকের ওপর বসে গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছে আর মা প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে]
বাবলু। (যুবকের হাত টেনে) ছেড়ে দাও, আমার মাকে মেরো না, ছেড়ে দাও।
যুবক। চোপরও ছোঁড়া, তোর মাকে মেরে তোকে খতম করব।
বাবলু। তবে রে পাজি ডাকাত? দেখ কী করি। (সে রিভলবারের বাঁট দিয়ে সজোরে যুবকের মাথায় মারল) তোর অস্ত্রেই তোর মাথার খুলি চৌচির করে দিচ্ছি।
যুবক। (মাথায় খটাস করে আওয়াজ হল) বাপরে। (যুবক অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল। মা উঠল)
বাবলু। যা লোকটা মরে গেল নাকি?
মা। (দেখে) তোমার মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। জ্ঞান হলে আর রক্ষে নেই। এসো আমরা পাড়ার লোক জড়ো করি।
[মা আর বাবলু বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো]
উভয়ে। বাঁচাও, বাঁচাও, ডাকাত পড়েছে, ডাকাত। দু-নম্বর ফ্ল্যাটে।
[নেপথ্যে কোলাহল]
প্রতিবেশীরা। (নেপথ্যে) কোথায়, কোথায় ডাকাত?
মা। দু-নম্বর ফ্ল্যাটে। বাঁচাও বাঁচাও।
প্রতিবেশীরা। (নেপথ্যে) যাচ্ছি, যাচ্ছি, ডাকাতের নিকেশ করছি।
[যুবক এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে উঠে বসল, তার মাথা থেকে রক্ত ঝরে পড়েছিল]
যুবক। সর্বনাশ! পাড়ার লোক ছুটে আসছে। আমি পালাব কী করে? ধাপপা দিয়ে পালাই। (চিৎকার করে) ডাকাত, ডাকাত, পাকড়ো, পাকড়ো। (বাবলু আর মাকে দোরগোড়ায় ঠেলে সরিয়ে চিৎকার করতে করতে পালাল)
মা। ওই যে ডাকাত পালায়। ধরো, ধরো ওর মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে । ধরো, ধরো।
[দু-তিনজন প্রতিবেশী ছুটে আসে]
প্রতিবেশীরা। ওই যে মাথায় রক্ত ঝরছে। ধরেছি, ধরেছি। মার, মার, মেরে তক্তা বানিয়ে দে। গণধোলাই দে, ডাকাতির সাধ ঘুচিয়ে দে।
[যুবকের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল]
মা। ওকে অত মেরো না, মরে যাবে। তোমরা বিপদে পড়বে। ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও।
প্রতিবেশী ১। সেই ভালো কথা, চল চল থানায়।
প্রতিবেশী ২। মাসিমা, আপনি মাথায় ঘা না দেখালে ডাকাতটা চম্পট দিত। ওটাকে ঘায়েল করলেন কীকরে?
মা। আমি কিছু করিনি, বাবা। বাবলুই ডাকাতকে ঘায়েল করেছে।
প্রতিবেশী ২। এই ছোট্ট ছেলেটা? বাহাদুর বাবলু।
সকলে। বাহাদুর বাবলু জিন্দাবাদ, বাহাদুর বাবলু জিন্দাবাদ।
মা। নয়া বীরপুরুষ! (বাবলুকে জড়িয়ে ধরে) ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে’।