নয়াঠগী – সমরেশ বসু

নয়াঠগী – সমরেশ বসু

বিকালের পড়ন্ত বেলা। অশোক এখনো ওর খাটের বিছানা ছাড়েনি। বৈকালিক চায়ের পাট মিটে গিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। পড়ন্ত বেলার হৈমন্তিক স্বর্ণাভায় ছায়া নামতে শুরু করেছে। ঘরের মধ্যে আলোর আভাস অল্প। বাতি জ্বালবার সময় হয়ে এল। কিন্তু অশোক একাগ্রভাবে ক্রিমিনোলজির ওপরে লেখা একটি ইংরেজি বই নিয়ে তন্ময় হয়ে পড়ে যাচ্ছে। প্রধানত অপরাধের মনস্তত্ত্বের ওপরেই, লেখক নানা দিক থেকে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। দিনকয়েক আগে, সংবাদপত্রে একটি অদ্ভুত খুনের ঘটনা ছাপা হয়েছিল, যার কোনো কূলকিনারা পুলিস করতে পারেনি। খুনি কোনো চিহ্নই রেখে যায়নি। অথচ ঘটনাটা যে খুন, তা নিহতের শরীরে স্পষ্ট চিহ্নিত ছিল। একটি লোহার শিক গরম করে, খুনি একজন মহিলার গলায় ঠিক মাঝখানে আমূল বিঁধিয়ে দিয়েছিল। সেই লোহার শিকটি পাওয়া গিয়েছে নিহতের দেহের কাছেই অথচ শিকের গায়ে কোনো হাতের ছাপ ধরা পড়েনি। ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে। শিকটি এতই গরম ছিল, তা অনায়াসেই নিহত মহিলার গলার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, বলতে গেলে রক্তপাত হয়নি।

সংবাদপত্রের সংবাদে, পরিবেশ এবং তথ্য যতটুকু জানা গিয়েছে, তা হল—মহিলাটির সংসারে তাঁর বারো বছরের নাবালক ভ্রাতুষ্পুত্র ছাড়া কেউ নেই। বাড়ির মালিক মহিলা নিজেই। তিনি সধবা ছিলেন, যে কোনো কারণেই হোক, তাঁর স্বামী দীর্ঘকাল নিখোঁজ, এবং মহিলার নিজের কোনো সন্তান ছিল না। বয়স অনুমান পঞ্চাশের কাছাকাছি। ভ্রাতুষ্পুত্রটি পিতৃমাতৃহীন, পিসিমার কাছেই বলতে গেলে মানুষ। খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বেলা এগারোটা নাগাদ। রান্নাঘরে কয়লার উনোন জ্বলছিল। মহিলা রান্নাও শুরু করেছিলেন, দু—একটি ব্যাঞ্জনাদি দেখে তা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তিনি নিহত হয়েছেন তাঁর শোবার ঘরে। দোতলার একটি অংশে তিনি থাকতেন। একতলার পুরোটা এবং দোতলার অংশবিশেষ ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটেরা কেউ কোনো আর্তনাদ বা চিৎকার শুনতে পায়নি। বাইরের থেকে, বাড়ির মধ্যে কারোকে ঢুকতে দেখেনি, কেননা, কারোর কোনো লক্ষ করার কথা মনে হয়নি। ভ্রাতুষ্পুত্রটি যে ইস্কুলে পড়ে, তার দূরত্ব সামান্য। সে দুপুরে, টিফিনের সময়, অন্যান্য দিনের মতো খেতে এসে, পিসীমাকে মৃত দেখতে পেয়ে, চিৎকার করে ওঠে। সেই চিৎকারেই সবাই ছুটে আসে, এবং পুলিশে সংবাদ দেয়।

অশোক ঘটনাটা কাগজে পড়ার পর, বইটা আরো বিশেষ করে পড়ছে। হত্যার ধরনটা খুবই অদ্ভুত, এবং নৃশংস তো বটেই। এই মফসসল শহরের, গঙ্গার ধারে, মিল কোম্পানির ধাঙড়—মেথরদের বস্তিতে অশোক যে ভাবে শূকর নিধন করতে দেখেছে, বেলেঘাটার খুনের ঘটনাটা যেন অবিকল সেই রকম। মাংসের জন্য যখন শূকর হত্যা করা হয়, তখন শূকরের দেহ থেকে একফোঁটাও রক্তপাত হয় না। অশোক নিজের চোখেই দেখেছে, হাত—পা বাঁধা শূকরের শরীরের মধ্যে, আগুনে পোড়ানো লাল টকটকে লোহার শিক গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে শূকরটি মরে ধীরে ধীরে, চিৎকার করে পরিত্রাহি, এবং আস্তে আস্তে চিৎকার থেমে আসে। কিন্তু বেলেঘাটার মহিলার কোনো চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি। কেন? এ রকম মৃত্যু যন্ত্রণাদায়ক। যন্ত্রণায় চিৎকার করা স্বাভাবিক। এবং শূকর হত্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে, এভাবে হত্যায়, মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে ঘটতে পারে না। আবার পারেও, বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে। তপ্ত লোহার শিক যদি শ্বাসনালি ভেদ করে যায়, তাহলে মৃত্যু ঘটতে দেরি হবার কথা না। শূকরকে শ্বাসনালিতে তপ্ত শিক বিদ্ধ করা হয় না, তার গুহ্যদেশে বিদ্ধ করা হয়। অশোক একটি ইংরেজি ছবি দেখেছিল। তাতে শ্বেত শূকরকে হাত—পা বেঁধে, ফুটন্ত জলে ডোবাতে দেখেছিল। তারপরে তুলে, ছুরি দিয়ে লোম চেঁছে নেওয়া হয়েছিল। কোনটা কম নৃশংস, অশোক বুঝতে পারে না। তবে ভারতীয় রীতিটা বেশি নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল কারণ পশুটিকে মৃত্যুযন্ত্রণা অনেকক্ষণ বেশি সহ্য করতে হয়। স্লটার হাউসে কীভাবে শূকর হত্যা করা হয়, অশোকের জানা নেই। বিশেষ করে, রক্তপাত না ঘটিয়ে।

কোনো হত্যার বিষয়েই দূর থেকে, অনুমান এবং কল্পনা করে কিছু বলা যায় না। অথচ হত্যার ধরনটা অশোককে ভাবিয়েছে বলেই, ও ক্রিমিনোলজির বইটা নিয়ে পড়েছে। হত্যার সাইকোলজি থেকে অনেক সময়, একটা অনুমানে আসা যায়।

‘তুমি প্যাঁচা না বাদুড়?’

অশোক কাঞ্চন বউদির ধমক শুনে, চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে, মুখ ফিরিয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে?’

কাঞ্চন সুইচে হাত দিয়ে আলো জ্বালিয়ে বলল, ‘তার মানে, আমি জানতাম, একমাত্র প্যাঁচা আর বাদুড়েরাই অন্ধকারে দেখতে পায়।’

অশোক বলল, ‘ভুল করলে। অন্ধকারে কেবল প্যাঁচা আর বাদুড়েরা দেখতে পায় না। বাঘেরাও দেখতে পায়।’

কাঞ্চনের হাতে খোসা—ছাড়ানো বাদামের ঠোঙা। সে তুলে তুলে মুখে দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, সে গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, ধোয়া শাড়ি—জামা পরে এসেছে। পায়ের আলতার ঔজ্জ্বল্য প্রমাণ করছে, একটু আগেই পরেছে। সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, কিন্তু কপালে টিপ পরেনি। বাদাম চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আর সেই বাঘ হল এই ঠাকুরবাড়ির অশোক ঠাকুর।’

অশোক গম্ভীর ভাবে বলল, ‘তা বলতে পার।’

কাঞ্চন ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ছুঁচো—ইঁদুরেরাও অন্ধকারে দেখতে পায়।’

অশোক বলল, ‘আবার বেড়ালও দেখতে পায়, ইঁদুরের যম। তা তুমি সিঁদুরের টিপ পরনি কেন?’

কাঞ্চন বলল, ‘আমার ইচ্ছে।’

‘ওহ, বুঝেছি।’

কাঞ্চন ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী বুঝলে?’

অশোক এক মুহূর্ত কাঞ্চনের চোখের দিকে দেখল, তারপর কাঞ্চনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলিয়ে, আবার চোখে চোখ রাখল। কাঞ্চনের মুখ হঠাৎ লাল হয়ে উঠল, এবং খানিকটা ক্ষুব্ধ লজ্জাতেই যেন অশোককে মারতে উদ্যত হয়ে বলে উঠল, ‘অসভ্য।’

অশোক শুয়েছিল, ঝটিতি খাটের আর এক পাশে চলে গেল। বলল, ‘না না ভুল বলেছি। তাহলে তুমি আলতা পরতে না, সিঁথিতেও সিঁদুর দিতে না! মনেই ছিল না।’

‘ফের এসব বাজে বাজে কথা?’

কাঞ্চন খাটের অন্যদিকে গিয়ে, অশোককে আক্রমণের চেষ্টা করল। অশোক প্রায় ডিগবাজি খেয়ে, আর একদিকে চলে গেল। বলল, ‘আচ্ছা, আর বলব না, এক কাপ চা খাওয়াও তো।’

‘কাঁচকলা খাওয়াব। খালি অসভ্য অসভ্য কথা বলবে, আর ওকে আমি চা খাওয়াব। পরের বৌয়ের পেছনে না লেগে, এবার নিজে একটি বিয়ে কর। বয়স তো কম হল না।’

অশোক অবাক হবার ভান করে বলল, ‘পরের বউ মানে?’

কাঞ্চন সত্যি সত্যি অবাক হয়ে বলল, ‘পরের বউ না তো কী?’

অশোক বলল, ‘তুমি পরের বউ হতে যাবে কোনো দুঃখে? তুমি আমার জ্ঞাতি সম্পর্কের দাদার বউ। পরের বউ মোটেই নও।’

কাঞ্চন ভুরু কুঁচকে ধমক দিতে গিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘ফাজিল।’

বলে বাদাম মুখে দিল। কাঞ্চন পাশের বাড়িতে থাকে, অশোকের এক বিকলাঙ্গ ধনী জ্ঞাতি—ভাইয়ের স্ত্রী। অশোকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তো আছেই, সম্পর্কের মধ্যে হয়তো আরো কোনো গভীরতা আছে যার মধ্যে কোনো অন্যায়ের ছায়া নেই বলে, ওদের মনে কোনো পাপ স্পর্শ করেনি।

অশোক বইটা মুড়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘তাহলে চা খাওয়াচ্ছ?’

কাঞ্চন বলল, ‘কেন, আজ কি বন্ধুদের সঙ্গে রকের আড্ডায় বসা হবে না? সেখানে তো দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা আসবে!’

‘সে তো রাত্রি দশটা অবধি আছেই। আচ্ছা, নীচে বড়দার গলা সাধার শব্দ শুনতে পাচ্ছি না কেন বল তো?

কাঞ্চন বলল, ‘বটঠাকুরপোর কথা জানো না? গলায় তো ব্যাং আটকেছে।’

‘ব্যাং?’

‘হ্যাঁ। পিসিমা পাচন করে দিয়েছেন, বারে বারে তাই খাচ্ছে, আর নুন গরমজল কুলি করছে, গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না।’

অশোকের বড়দা সকাল—সন্ধ্যায় নীচের বৈঠকখানা বাড়িতে, চিৎকার করে ধ্রুপদ সাধনা করে। ও বলল, ‘যাক, দু—চার দিন তা হলে গানের হাত থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু মেজদার ঘর থেকেও তো রাহু কেতু মঙ্গল বৃহস্পতির অবস্থান নিয়ে কোনো চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না?’

নীচের বৈঠকখানার আর এক ঘরে, অশোকের মেজদা তার বন্ধুদের সঙ্গে জ্যোতিষ চর্চা করে। বিয়ে করেনি কেউ। কাঞ্চন বলল, ‘শোনা যাচ্ছিল ঠিকই, এখন বোধ হয় কোনো কোষ্ঠি পড়া হচ্ছে। দাদাদের বেলায় তো খুব ফুট কাটা হচ্ছে, নিজে যে মন্দিরের রকে বসে সব সময় খুনখারাপি নিয়ে গ্যাঁজাও, তার বেলা?’

অশোক বলল, ‘মিথ্যে কথা বলো না বউদি। অপরাধ—তত্ত্ব নিয়ে আমি গ্যাঁজাই না। আমি অপরাধের সত্য আর তথ্য সন্ধানী। অপরাধের মূল আর অপরাধীকে খুঁজে বের করা আমার কাজ। ওটা রকে বসে হয় না।’

কাঞ্চন বলল, ‘ওই হল। তোমরা তিন ভাই—ই বাতিকগ্রস্ত। ঘরের খেয়ে সবাই বনের মোষ তাড়াচ্ছ।’

অশোক বলল, ‘তা বাপ—পিতামহ রেখে গেলে, খাবো না তো কী করব। তা তুমি এখন দয়া করে এক কাপ চা খাওয়াবে, না কি এই সব বাতেলা দেবে?’

‘বাতেলা মানে কী?’

‘কোনোদিন রকে বসলে না, জানবে কী করে?’

‘হ্যাঁ, মরতে এখন রকে বসাটা বাকি আছে।’

বলে সে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অশোক বলল, ‘চা দেবে না?’

কাঞ্চন মুখ না ফিরিয়েই বলল, ‘পারব না।’

বলে চলে গেল। অশোক হাসতে হাসতে খাট থেকে নামল। জানে, বউদি চা করে আনতেই গেল। ও ঘরের বাইরে, পুরনো আমলের থামওয়ালা বারান্দা দিয়ে গিয়ে, বাথরুমে ঢুকে চোখে—মুখে জল দিয়ে এল। মুখ মোছা হতে না হতেই, ওদের বাড়িতে কাজকর্ম করে যে লোকটি, সে এসে বলল, ‘ছোড়দা, থানার বড় দারোগাবাবু এসেছেন, গাড়িতে বসে আছেন, আপনাকে ডাকছেন।’

অশোক মুখটা বিকৃত করে বলল, ‘জ্বালালে। যাও, যাচ্ছি।’

লোকটি চলে গেল। অশোক পায়জামা ছেড়ে, ট্রাউজার আর শার্ট পরে চুলটা আঁচড়ে নীচে নেমে গেল। বাড়ির উঁচু রকের সামনে, রাস্তায়, জিপের ওপর শ্যামাপদ, থানার ও.সি., বসে আছে। অশোককে দেখে বলে উঠল, ‘এই যে অশোক, বাড়িতেই ছিলে?’

অশোক বলল, ‘আপনি কি ভেবেছিলেন, ওয়াগন লুট করতে বেরিয়েছি?’

শ্যামাপদর মুখ দেখলেই বোঝা যায়, সে বিশেষ চিন্তিত। তার হাঁড়ির মতো তুমবো মুখখানি গম্ভীর, কিন্তু অন্যসময় সে এরকম কথা শুনলে যেমন চটে যায়, এখন তা গেল না। তার মানে, অশোক বুঝতে পারল, শ্যামাপদ কোনো সমস্যায় পড়েছে। বলল, ‘সব সময় ফাজলামি করো না। এ সময় তো তোমার রকে বসে আড্ডা মারার কথা। না দেখে ভাবলাম, কোথাও বেরিয়ে গেলে কী না।’

অশোক বলল, ‘তার জন্য না। আপনার তো সব সময় ধারণা, আমি কোনো অপরাধ করে বেড়াচ্ছি, আর সেই জন্যেই আপনি আমাকে খোঁজেন।’

শ্যামাপদ বলল, ‘ধারণাটা একদিন ফললেই বুঝতে পারবে। তা এখন তোমার একটু সময় হবে? একটা জরুরি দরকার ছিল।’

অশোক বলল, ‘আসুন, বসুন বাইরের ঘরে।’

‘বসবার সময় নেই। শহরের ঘটনা কিছু শুনেছ?’

‘না তো? বাঙালি—বিহারি দাঙ্গা লেগেছে নাকি?’

‘আরে না! সে হলে তো কারফিউ দিয়ে ঠান্ডা করে দিতাম। মেহেন্দিপাড়ায় দিনে—দুপুরে একটা খুন হয়ে বসে আছে।’

‘মেহেন্দিপাড়ায়? কে?’

‘শশীকান্ত দত্ত। মেহেন্দিপাড়ার দত্তবাড়ির—’

অশোক বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘বুঝেছি। কনফার্মড ব্যাচেলর শশী দত্ত, তার ওপরে টাকার কুমির। তা ব্যাপারটা কী?’

শ্যামাপদ এবার ঝাঁজিয়ে উঠল, ‘তা ব্যাপারটা কি এ ভাবে রক থেকে গাড়িতে বসে বলাবলি করা চলে? দয়া করে একটু নেমে এসে, গাড়িতে ওঠ। থানার পার্টি চলে গেছে দত্তবাড়িতে। আমি একবার দেখে, তোমাকে ডাকতে এসেছি।’

অশোক বলল, ‘কিন্তু আমি যে চা করতে বলেছি!’

‘তোমাকে আমি একশো কাপ চা খাওয়াব, এখন এস তো।’

অশোক মুখটা বিকৃত করে বলল, ‘ওই জন্যই বউদি বলে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি। চলুন যাই।’

শ্যামাপদ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিল। অশোক তার পাশে উঠে বসে, সিগারেট ধরাল। আসলে, অশোকের মস্তিষ্কে তখন শশী দত্তর খুনের চিন্তা বিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্ভাব্য নানান চিন্তা তার মাথায় জট পাকাতে আরম্ভ করেছে। সোজা কথায়, হু ডান ইট অ্যাণ্ড হোয়াই।

শ্যামাপদ গাড়ি স্টার্ট করে বলল, ‘থানায় খবর আসে চারটে নাগাদ। গিয়ে দেখি, শশী দত্ত তার বাইরের ঘরে, একটা চেয়ারে বসে আছে। নাক আর মুখ দিয়ে সামান্য ব্লিডিং ছাড়া, আর কোনো কিছু নেই। গলায় একটা দাগ আছে, আমার ভালো করে দেখা হয়নি।’

অশোক শুনল, কোনো জবাব দিল না। ও তখন শশী দত্তর বিষয় ভাবছে, এবং শশী দত্তর বাড়ির অন্যান্যদের কথা। শশী দত্ত একসময়ে চাকরি করতেন। চাকরি করার তাঁর কোনো দরকার ছিল না। পিতৃপুরুষের ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন অগাধ। বিয়ে করেননি। তাঁরা দুই ভাই। ছোট ভাই নিশিকান্ত। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলেেটি শহরের মস্তান হিসাবে নাম করেছে। কোনো চাকরি—বাকরি করে না। দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, মেয়েদের সঙ্গে মেশবার ঝোঁক আছে। মদ্যপানও করে থাকে। অশোকের সঙ্গে পরিচয় আছে, মেলামেশা নেই। নিশিকান্ত ইস্টার্ন রেলের একজন অফিসার, কর্মস্থল কলকাতা, ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। বয়স বোধহয় আটচল্লিশ। শশীকান্ত পঞ্চাশ। শহরের সবাই জানে, দু—ভাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব নেই। না থাকার মূলেও সম্পত্তি। শশীকান্তর কেউ না থাকা সত্ত্বেও, বিশাল বাড়িটিকে তিনি চুলচেরা করে দু—ভাগে ভাগ করেছেন। নিশিকান্তর পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। তাঁর বিশাল সম্পত্তি এবং টাকা নিশিকান্তর ছেলেমেয়েরা যে পাবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিশিকান্তর বড়ছেলে রবি প্রায়ই তার জ্যাঠামশাইকে নানাভাবে শাসাত। দু—একবার নাকি মারধোরও করতে গিয়েছে।

গোটা মেহেন্দিপাড়াটা বলতে গেলে দত্তপাড়া। দত্তদের আরো বহু জ্ঞাতি—গোষ্ঠি গোটা পাড়ায়, গায়ে গায়ে ছড়ানো। শশীকান্তকে সকলেই খুশি করতে চাইত, কিন্তু শশীকান্ত খুশি হবার পাত্র ছিলেন না। মনে মনে সকলেরই রাগ ছিল।

শশীকান্ত শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। এম. এ. পাশ করেছিলেন, পুরাতত্ত্বের ওপর মাঝে—মধ্যে কাগজে লিখতেন। লেখা পড়লে বোঝা যায়, পড়াশোনা করতেন। কিছুদিনের জন্য কলকাতার একটি কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। একটু দুর্নাম ছিল, নারীঘটিত। চিরকুমারের সেটা বোধহয় বয়সকালীন বিকার। আসলে লোকে তাঁকে চশমখোর বলেই জানত। একটি পয়সা তাঁর হাত দিয়ে গলত না।

এ হেন শশীকান্ত দত্তকে কে, কেন খুন করতে পারে?

অশোক চলন্ত জীপে বসে ভাবতে ভাবতে, নিজেই মনে মনে নিজেকে জবাব দিল, ‘অনেকগুলো কেন থাকতে পারে, কিন্তু কে? অবিশ্যি ‘কেন’—র মধ্যেই ‘কে’ বিরাজ করছে।’

অশোক ভাবছে, শ্যামাপদ গাড়ি চালাতে চালাতে, মাঝে মাঝে ওর মুখের দিকে দেখছে। মেহেন্দিপাড়ায় ঢোকবার মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু আন্দাজ করতে পারছ নাকি?

অশোক বলল, ‘না, সেরকম কোনো ম্যাজিক আমার জানা নেই, কিছু না দেখে বা জেনেই, আন্দাজ করে ফেলব।’

শ্যামাপদ রেগে উঠে বলল, ‘কথাবার্তা একটু ভালোভাবে বলতে শেখ।’

‘কেন, পুলিশের লোকের থেকে কি খারাপ ভাবে কথা বলি?’

‘মনে রেখো। এই পুলিশের কাছেই তোমাকে একদিন মাথা নোয়াতে হবে।’

‘তা যা বলেছেন।’ অশোক হাসল।

গাড়ি এসে দাঁড়াল শশীকান্ত দত্তর বাড়ির সীমানায়, গেটের সামনে। পাড়ার লোকের ভিড় সেখানে। শ্যামাপদর গাড়ি দেখে, সবাই একটু এদিক—ওদিকে সরে গেল। গেট ছেড়ে দিল। অশোক শ্যামাপদর সঙ্গে জিপ থেকে নামল। শ্যামাপদ তার স্বভাবসুলভ গলায় হুংকার ছাড়ল, ‘কী ব্যাপার! এখানে এত ভিড় কিসের? আমি কোনো ঝামেলা চাই না, সবসুদ্ধু ভ্যানে তুলে নেব।’

ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে গেল। একটা ভ্যানও সামনে দাঁড়িয়েছিল। শ্যামাপদর হুঙ্কার শুনেই একজন সেপাই কর্তব্য করতে ছুটে এল, ‘এই ভাগো ভাগো।’

অশোক শ্যামাপদর সঙ্গে গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে, ভিতরের রেলিংয়ে ঘেরার মধ্যে, ডান দিকে শিবমন্দির দেখতে পেল। আগেও দেখেছে। শিবমন্দিরের পাশে পাঁচিল। তেমন উঁচু না। পাঁচিলের ও—পাশে বাগান এবং পুকুর। সেই সব শশীকান্ত চুলচেরা ভাগ করে, বাগানেও পাঁচিল বসিয়েছেন। পুকুরের অর্ধেক অংশ নিশিকান্তকে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। বাগান— পুকুরের ওপাশে মুখুজ্যেপাড়া। তার রাস্তা অন্য দিকে। ডান দিকে মন্দির, সংলগ্ন ঠাকুরদালান। অনেকখানি খোলা চত্বর, সামনেই দক্ষিণখোলা শশীকান্তর বসবার ঘর। ঘরের দরজায় পুলিশ পাহারা। শশীকান্ত বাইরের এই বসবার ঘরেই খুন হয়েছেন।

শামাপদর সঙ্গে অশোক ঘরের মধ্যে ঢুকল। বেশ বড় ঘর। ঘরের মধ্যে গুটি তিনেক কাঠের আলমারি, কাচের পাল্লা, ঠাসা বই। বড় টেবিল ঘিরে কয়েকটি চেয়ার। চেয়ারগুলো সেকালের, প্রশস্ত, গদি—মোড়া। এরকমই একটি চেয়ারে শশীকান্ত আধশোয়া অবস্থায় পড়ে আছেন। হাত দুটো হাতলের ওপর দু—দিকে লুটিয়ে পড়ে আছে। গায়ে গেঞ্জি, পরনে সিল্কের লুঙ্গি। টেবলের সামনে একটি বই খোলা।

অশোক সামনে এগিয়ে গেল। কমলালয় স্টুডিওর ফটোগ্রাফার ফটো তুলছিল। সে সরে গেল। খালিগায়ে একটি মাঝবয়সি লোক ঘরের একপাশে বসে আছে। পাশে একজন সেপাই। এস. আই. ঘরের চারপাশে দেখছে, নোট করছে। শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তারবাবু আসেননি?’ এস. আই. বলল, ‘খবর দিয়েছেন, এখুনি আসছেন।’

অশোক শশীকান্তর খুব সামনে গিয়ে দেখল, চেয়ারের ডানদিকে, মেঝেতে চশমা পড়ে রয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যায়, শশীকান্ত বই পড়ছিলেন। অশোক বইটার দিকে তাকিয়ে দেখল, খোলা বইয়ের পাতার ওপরে লেখা রয়েছে, সাংখ্যদর্শন। পুরনো চটি বই, নিউজ প্রিন্টে ছাপা। অশোক শশীকান্তর মুখের দিকে তাকাল। খোলা উদ্দীপ্ত চোখের তারা পাথরের মতো স্থির। নাকের সামনে, আর ঠোঁটের কষে রক্ত গড়িয়ে এসে, শুকিয়ে গিয়েছে। গলায় স্পষ্ট দাগ, খানিকটা রক্তের চিহ্নও ফুটে উঠেছে। মনে হয়, শক্ত সরু দড়ির মতো কিছু দিয়ে, গলায় ফাঁস লাগানো হয়েছিল, এবং সম্ভবত পিছন দিক থেকে আচমকা। হাতের থাবায় আঁচড়ে ধরার ভঙ্গি। শশীকান্ত বেশ দশাসই চেহারার লোক ছিলেন, সুপুরুষ বলা যায়। পা দুটো টেবিলের অনেকখানি নিচে চলে গিয়েছে। এক পাটি চটি টেবিলের নীচে ডানদিকে চলে গিয়েছে। আর এক পাটি টেবিলের তলা পেরিয়ে একবারে দেওয়ালের কাছে গিয়ে পড়েছে। বোধহয় পা ছুড়েছিলেন। ফাঁসটা টেনে খোলবারও চেষ্টা করেছিলেন বোধহয়, এবং আততায়ীকে পিছনে হাত দিয়ে ধরতে চেয়েছিলেন, পারেননি। কারণ চেয়ারের পিছনের হেলান দেবার জায়গাটি বেশ উঁচু। তারপরে বোধ হয়, চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। এলিয়ে বসে পড়েছিলেন। তখনই হয়তো, চোখ থেকে চশমাটা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য, চশমার কাচ ভাঙেনি। সম্ভবত ধীরে ধীরে শরীরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল।

অশোক নীচু হয়ে, গলার দিকে তীক্ষ্নচোখে আবার দেখল। মনে হয়, নাইলনের দড়ি দিয়ে, ফাঁস দেওয়া হয়েছিল, এবং অত্যন্ত মোক্ষমভাবে। তথাপি অবাক লাগে, ফাঁসটা খুনি খুলে নিয়েছে কীভাবে? সে কি, শশীকান্তর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত, হাত দিয়ে ফাঁসটা চেপে রেখেছিল? তা হলে তো শশীকান্ত খুনির হাত ধরতে পারতেন। অশোক নীচু হয়ে, শশীকান্তর দুটো হাতের আঙুল আর নখ দেখল। না, কোনো রক্ত, বা মাংস লেগে নেই। থাকলে বোঝা যেত, খুনির হাত উনি খামচে ধরেছিলেন। ও বলে উঠল, ‘এ তো যেন পাক্কা ঠগীর কাজ দেখছি।’

শ্যামাপদ বলে উঠল, ‘ঠগী?’

অশোক বলল, ‘হ্যাঁ, এরকম মোক্ষম ফাঁস দিয়ে মারা দেখলে, ঠগীদের কথাই মনে পড়ে যায়। তারা রেশমের সরু দড়ি দিয়ে মিনিটের মধ্যে কাজ সারতে পারত। কিন্তু ঠগীদের যুগ অনেককাল আগে চলে গেছে।’

শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি মনে হচ্ছে, ফাঁস দিয়ে মারা হয়েছে?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

এই সময়ে ডাক্তার এলেন। শ্যামাপদ বলল, ‘আসুন ডাক্তাবাবু, দেখুন কাণ্ড।’

ডাক্তার রাজেন চ্যাটার্জি, মধ্যবয়স্ক। বললেন, ‘তাই তো দেখছি।’

ডাক্তার চ্যাটার্জি স্থানীয় মিউনিসিপালে সকালে দু—ঘণ্টা বসেন। বাকি অন্যান্য সময় নিজের চেম্বারে। পুলিশের ব্যাপার হলে, তাঁরই ডাক পড়ে। তিনি শশীকান্তকে পরীক্ষা করলেন। বললেন, ‘মনে হয়, তিনটে থেকে চারটের মধ্যে মারা গেছে। শ্বাস বন্ধ করে মারা হয়েছে। গলার দাগ দেখেও তাই মনে হচ্ছে। মনে হয়, ফাঁস লাগানোর এক মিনিটের মধ্যে মারা গেছে। পোস্টমর্টেমে পাঠালেই সঠিক জানা যাবে।’

অশোক তখন ঘরের মেঝে এবং দরজার কাছে নিরীক্ষণ করে দেখছিল। রাস্তার দিকের জানালা সবই বন্ধ। পাশের ঘরে যাবার দরজা ভেজানো। অশোক শ্যামাপদকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওদিকে দেখেছেন নাকি?’

‘না। দেখবে?’

‘দেখা দরকার। শশী দত্তর দেখা—শোনা করত কে?’

ঘরের একপাশে বসে থাকা, খালি—গা মাঝবয়সি লোকটিকে দেখিয়ে, শ্যামাপদ বলল, ‘এই লোক। এর নাম শ্যাম।’

অশোক ঠোঁট টিপে হাসল, শ্যামাপদর দিকে একবার তাকাল। শ্যামাপদ হাসির কারণটা বুঝে, মুখ গম্ভীর করল। চাকর আর তার একই নাম। অশোক ডাকল, ‘এস তো শ্যাম, ঘরদোর একটু দেখাও।’

শ্যাম উঠে এল। তাকে ভীত এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে। তার কোমরে একটা বড় চাবির গোছা ঝুলছে। তাকে নিয়ে, অশোক আর শ্যামাপদ পাশের ঘরে ঢুকল। খাট, আয়না—লাগানো আলমারি, পাশে ছোট একটি টেবিলে চুলের ব্রাশ, চিরুনি, পাউডার, স্নো, আফটার শেভিং লোশন, দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, দামি গন্ধতেলের শিশি, একটি নেল—কাটার। কৃপণ হলেও, শশীকান্ত নিতান্ত অশৌখিন লোক ছিলেন না। অশোকের মনে আছে, পোশাকের ব্যাপারেও, শশীকান্ত বেশ সচেতন আর রুচিশীল ছিলেন।

অশোক শ্যামকে জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কি এ ঘরে শুতেন?’

শ্যাম বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘তুমি কোথায় থাকো, শোও?’

শ্যাম একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই দালানে।’

শোবার ঘর থেকে, দালানে যাবার দরজাটা খোলা। অশোক দালানে গেল। বিরাট দালান, যেমন চওড়া, তেমনি লম্বা। সেকালের বাড়ির যেরকম ধরন ছিল, সেই রকম। দালানের পশ্চিম প্রান্তে, দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘ওপরে কে থাকে?’ শ্যাম বলল, ‘কেউ না বাবু। ওপরে তালা—বন্ধ থাকে। সব ঘরেই তালা—বন্ধ করে রাখা হয়। কেবল এই দালান, বাবুর শোবার—বসবাস ঘর, আর রান্নাঘর খোলা থাকে।’

অশোক তা দেখল, দালান—সংলগ্ন বাকি ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে। ও দালানের বাইরে রকে গেল। চওড়া বড় উঠোন। উঠোনের একদিকে রান্নাঘর, শূন্য গোয়ালঘর, পাঁচিল, পাঁচিলের ওপাশে সেই বাগান। রকের পশ্চিমে পায়খানা, দেওয়াল ঘেরা জলঘর, স্নানের জায়গা। এদিক থেকে দালান শোবার ঘর পেরিয়ে, বসবার ঘরে গিয়ে কেউ শশীকান্তকে হত্যা করেছে বলে মনে হয় না। অবিশ্যি যদি বাড়ির কেউ খুন না করে থাকে, এবং বাড়ির কেউ বলতে একমাত্র শ্যামকেই বোঝায়। সে—ই একমাত্র লোক, যে এ বাড়িতে থাকে, শশীকান্তর দেখাশোনা করত। অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘রান্নাবান্নাও তুমি করতে নাকি?’

শ্যাম বলল, ‘না। দুপুরে এক বেলা বাড়িতে খেতেন, আর সকালবেলার জলখাবার। রান্না করে পাঁচুঠাকুরের মা।’

‘সে কে?’

‘ওই মুকুজ্যে পাড়ায় থাকে। রেঁধে বেড়ে বাবুকে খাইয়ে, নিজের খাবার নিয়ে দুপুরে চলে যায়। বাবুর বিকেলের চা আমি নিজেই করে দিই।’

‘বাবু রাত্রে খেতেন না?’

‘বাড়িতে খেতেন না।’

‘কোথায় খেতেন?’

শ্যাম চুপ করে রইল। শ্যামাপদ ধমক দিয়ে উঠল, ‘কথা বল, চুপ করে থেকো না।’

শ্যাম মুখ নীচু করে বলল, ‘মুকুজ্যে বাড়ির সেজঠাকরুণের বাড়িতে রাত্রে খেতেন।’

অশোক শ্যামাপদর সঙ্গে চোখাচোখি করল। অশোক চিনতে পারল, মুখুজ্যেদের সেজঠাকরুণ মানে, নীলমাধব মুখুজ্যের বিধবা। মহিলার বয়স অনুমান চল্লিশ। অশোক তাঁকে দেখেছে। মহিলার রূপ—যৌবন এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে। একটি ছেলে আছে। অনেকদিন ছেলেটিকে অশোক দেখতে পায়নি। শশীকান্তর সঙ্গে মহিলার ঘটনা, শহরের অনেকেই কম—বেশি জানে। কিন্তু অশোক এতটা জানত না, শশীকান্ত প্রত্যহ রাত্রে সে বাড়িতেই খেতেন। অসম্ভব কিছু না, মহিলা একলা একটি বাড়িতে থাকেন। নীচের তলা ভাড়া দেওয়া আছে। ওপরে নিজে থাকেন। অবস্থা খারাপ না। তা ছাড়া শশীকান্ত তো ছিলেনই।

অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘সে কথা তুমি জানলে কী করে?’

শ্যাম বলল, ‘আমি বাজার—টাজার পৌঁছে দিয়ে আসি। দরকার পড়লে বাবু আমাকে ও বাড়িতে পাঠাতেন, সেজঠাকরুণও ডেকে পাঠাতেন। তাইতেই জানি।’

শ্যামাপদ বলে উঠল, ‘যত্তো সব চরিত্রহীনের ব্যাপার। তা তোমার বাবু রাত্রেও সেখানে থাকত নাকি?’

‘না বাবু, রাত্রে বাড়িতে এসে শুতেন।’

অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘প্রথম কে শশীবাবুকে ওই অবস্থায় দেখেছে?’

শ্যাম বলল, ‘আমি বাবু, আমিই দেখেছি। সাড়ে তিনটে থেকে পৌনে চারটেয় বাবু চা খেতেন। আমি চা নিয়ে গিয়ে, ব্যাপার দেখে, তাড়াতাড়ি লোকজন ডাকি।’

‘তখন কি বসবার ঘরে ঢোকবার বাইরের দরজা খোলা ছিল?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, খোলা ছিল।’

অশোক শ্যামের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কতদিন এখানে কাজ করছ?’

‘তা একুশ—বাইশ বছর হয়ে গেল।’

‘তোমার বউ—ছেলে—মেয়ে নেই?’

‘আছে বাবু, গাঁয়ের বাড়িতে আছে। বছরে একবার সেখানে যাই।’

‘তোমার কারোকে সন্দেহ হয়?’

‘কিসের বাবু?’

শ্যামাপদ খেঁকিয়ে উঠল, ‘খুনের, আবার কিসের? ন্যাকা! তুমি কী জান তা বল। কে খুন করেছে?’

শ্যাম জোড়হাত করে, কাঁদো—কাঁদো স্বরে বলল, ‘আমি কিছুই জানি না বাবু।’

অশোক হাত তুলে, শ্যামাপদকে নিরস্ত করে, শ্যামকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি জান, তা বলছি না। তোমার কি কারোকে সন্দেহ হয়? তোমার বাবুকে খুন করতে পারে, এরকম কেউ থাকতে পারে?’

শ্যাম একটু চুপ করে বলল, ‘তা বাবু, কী বলব, আমার বাবুর আপনজনেরা তো কত কথাই বলত। ছোটবাবুর বড়ছেলে রবি তো আমাকে কতদিন বলেছে, লাঠি মেরে সে নাকি একদিন বাবুর মাথাটা দু—ফাঁক করে দেবে।

শ্যামাপদ বলে উঠল, ‘ওটাকে আমি আজই অ্যারেস্ট করে চালান দেব। আর কে এরকম কথা বলত?’

শ্যাম বলল, ‘ওই রবিই বেশি বলত। আর আর যারা, তারা এতটা না হলেও বাবুর নামে খারাপ খারাপ কথা বলতে ছাড়ত না।’

অশোক তখন পার্টিশনের উঁচু দেওয়ালটা দেখছিল। ওই দেওয়াল টপকে, নিশিকান্তর বাড়ি থেকে কারোর আসা সম্ভব না। বাইরের দিক থেকে কেউ এসে মেরে থাকলে, সেই আততায়ী বাইরের দরজা দিয়েই এসেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যথায়—অশোক শ্যামের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবু কেমন লোক ছিলেন বলে তোমার মনে হয়?

অশোকের চোখ, শ্যামের চোখের ওপরে নিবদ্ধ। শ্যাম বলল, ‘লোকেরা অনেকে অনেক কথা বলত, কিন্তু আমার কাছে, আমার বাবু ভালো লোক ছিলেন।’

‘তোমাকে বিশ্বাস করতেন?’

শ্যাম কোমর থেকে চাবির গোছা খুলে নিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখেন বাবু, গোটা বাড়ি—ঘরের সব চাবি আমার কাছে। আমি না চাইতে বাবুর কাছে সব পেতাম। পুজোর সময় আমার বৌ—ছেলে—মেয়ে সক্কলের জন্য জামা—কাপড় কিনে দিতেন।’

বলতে বলতে শ্যামের গলা ধরে এল, চোখে জল দেখা দিল। শ্যামাপদ হুমকে উঠতে যাচ্ছিল। অশোক ইশারায় বারণ করল। শ্যাম চোখ মুছে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘আমারই কপাল ভাঙল বাবু। বিশ্বাসের কথা বলছেন বাবু? আমি ছাড়া বাবুর কে ছিল? বাজার দোকান থেকে শুরু করে, সব আমি করতাম। বাবু পয়সা দিয়ে খালাস। কোনোদিন বলেননি, শ্যাম এ হিসেবটা মেলেনি। অমন পাপ কাজ আমি কোনোদিন করিনি।’

অশোক কথাগুলো শুনল, শ্যামাপদকে ইশারা করে, আবার বাইরের ঘরে ফিরে এল। শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘চাকরটাকে অ্যারেস্ট করব তো?’

অশোক বলল, ‘আমার মনে হয় না, কোনো দরকার আছে। তবে ওর ওপর নজর রাখা দরকার। রবিকে আপনি থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। বেলা তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত ও কোথায় ছিল, কোনো প্রমাণ আছে কী না, জানতে চেষ্টা করবেন। এখন লাশ পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিন। পরে আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।’

শ্যামাপদ এস. আই—কে যথাবিহিত নির্দেশ দিয়ে, অশোককে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘রবিকে কিন্তু আমি ছাড়ছি না।’

অশোক একটু হেসে বলল, ‘তা না ছাড়ুন, তবে একেবারে চালান করে দেবেন না। ওর বিরুদ্ধে মার্ডার কেস দেবার আগে, আপনাকে শিওর হতে হবে। নিশিকান্ত দত্ত, রবির বাবার ক্ষমতাও কিছু কম নেই, উনি লড়ে যাবেন।’

‘ওসব আমি পরোয়া করি না। ওকে আমি যে—কোনো সময়েই অ্যারেস্ট করতে পারি। ওর বিরুদ্ধে অনেক অ্যালিগেশন আছে।’

‘তা থাকতে পারে। আমি এই খুনের ব্যাপারে বলছি। চলুন, এবার যাওয়া যাক।’

বলতে বলতে অশোক বাইরে এল। খোলা চত্বর, ঠাকুরদালান, শিবমন্দিরের আশে—পাশে ঘুরে ঘুরে দেখল। মন্দিরের পিছনে গিয়ে, বাগানের পাঁচিলের কাছে দাঁড়াল। শ্যাওলাধরা পাঁচিল। অশোক ঠাকুরদালানের পিছনে গেল। আততায়ী খোলা গেট দিয়ে অনায়াসেই এসেছিল হয়তো। মেহেন্দিপাড়া মোটামুটি নিরিবিলি, অনেক ফাঁকা পোড়ো জমি, বুনো ঝোপ, মজা পুকুর আশেপাশে ছড়ানো। স্টেশন—কেন্দ্রিক শহর, বাজারও সেদিকে। মেহেন্দিপাড়া স্টেশন থেকে অনেকটা দূরে। লোকজনের চলাচল কম। সকালে—সন্ধেয় যা একটু লোকের আসা—যাওয়া। কেউ কলকাতায় যাবার জন্য স্টেশনে যায়, এবং আসে। সকালে বাজারে যাওয়া আছে। আর বাদবাকিদের চলাফেরা আছে কলে—কারখানায়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে। বেলা তিনটে থেকে চারটে, বেশ নিরিবিলি থাকবার কথা। আততায়ী নিশ্চয় জানত, শশীকান্ত এই সময়ে পড়াশোনা করে।

অশোক ঠাকুরদালানের পিছনে দাঁড়িয়ে ভাবল, তবু পাঁচিলটাকেও অবহেলা করার কিছু নেই। আততায়ী এদিক থেকেও আসতে পারে। অশোক পাঁচিল আর ঠাকুরদালানের তিন ফুট ফাঁকে, দু—দিকে পা দিয়ে উঠল, বাগানের দিকে দেখল। বাগান বলতে আম—নারকেল গাছ আর পুকুর। পুকুরের ওপারেও নারকেল গাছ, সীমানার পাঁচিল ঘেঁষে কিছু মানকচুর গাছ। নোনাধরা ইটের পাঁচিল, উচ্চতায় এই পাঁচিলের মতোই। পাঁচিলের ওপারে পর পর কয়েকটি বাড়ির পিছন দিক দেখা যাচ্ছে। ওটা মুখুজ্যে পাড়ার পিছন দিক। মাধব মুখুজ্যের বাড়ি কোনটা? সব বাড়িগুলোই পুরনো, দু—একটা হালের তৈরি। কিন্তু ওদিক থেকে কে আসতে পারে? যদি শশীকান্তর জ্ঞাতি আত্মীয়দের কেউ খুনি হয়, সে বাগানের ভিতর দিয়ে, পাচিল টপকে আসতে পারে। এক্ষেত্রে তাকে আসতে হয়েছে পুবদিক থেকে। দত্তদের সেকালের পুরনো বাড়ি ওদিকেই ছড়ানো, এবং অংশে অংশে ভাগে ভাগে, সেখানেই অনেকে থাকে। এমন কি রবিও যদি খুনি হয়, ওকেও বাগানের পুবদিক থেকেই আসতে হয়েছে। কিন্তু অশোকের মনে রবি যেন তেমন দাগ কাটছে না। যদিও রবিকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না। রাখা যায় না শ্যামকেও। আপাত দৃষ্টিতে যদিও তাকে নির্ভেজাল মনে হচ্ছে। সে অস্বীকার করেনি, বাড়িতে ছিল না বলে। তার অ্যালিবাইয়ের কোনো প্রশ্নই আসছে না। সে খুনের সময় বাড়িতে ছিল। চা তৈরি করছিল। চা দিতে এসে নিহত শশীকান্তকে দেখতে পায়।

অশোক পাঁচিল থেকে নেমেই, শ্যামাপদর চড়া গলা শুনতে পেল, ‘লোকটা কি হাওয়ায় উড়ে গেল? তুমি গেটে দাঁড়িয়ে আছ, অথচ দেখতে পেলে না?’

অশোক হাসল, বুঝল, শ্যামাপদ গেটের সিপাইকে ধমকাচ্ছে, ওকে খুঁজে না পেয়ে। ও মন্দিরের পিছন থেকে সামনে এসে দাঁড়াল। শ্যামাপদ বলে উঠল, ‘এই যে, কোথায় গেছলে তুমি?’

অশোক বলল, ‘পেছন দিকে।’

‘আর আমি এদিকে খুঁজে মরছি।’

অশোক চত্বরের দূর্বাঘাসের দিকে নিরীক্ষণ করে দেখল, দেখতে দেখতে শশীকান্তর বসবার ঘরের বারান্দা পেরিয়ে, দরজার ভিতর দিকে তাকাল। শশীকান্তর চেয়ারটি একেবারে দরজার বরাবর। অশোকের ভুরু কোঁচকাল। ঠোঁট ওল্টাল। গেটের সামনে গেল। রাস্তার দিকে তাকাল। তারপরে শ্যামাপদর দিকে ফিরে বলল, ‘চলুন যাই।’

বলে ও আগে আগে গিয়ে জিপে উঠল। শ্যামাপদ এস. আই—কে আরো কিছু নির্দেশ দিয়ে, জিপে এসে উঠল। গাড়ি স্টার্ট করল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝলে?’

অশোক বলল, ‘কিছুই না। এখন একটু চা চাই।’

বলে সিগারেট ধরাল। শ্যামাপদ বলল, ‘আমার মনে হয়, এটা নির্ঘাত রবির কাজ।’

অশোক বলল, ‘নাও হতে পারে। টাকার আর সম্পত্তির ব্যাপার হলে, আগে জানা দরকার, শশী দত্ত কোনো উইল করেছিলেন কী না। তাঁর ইনসিওরেন্সের নমিনি কে। টাকা—পয়সা সম্পত্তির ব্যাপারে, হতাশায় আর রাগে, রবি বা জ্ঞাতিদের মধ্যে কারোর কিছু করা অসম্ভব না। কিন্তু অন্য ব্যাপারেও শশী দত্তর দুর্বলতা ছিল।’

‘মানে, তুমি মেয়েছেলের কথা বলছ?’

‘ওই আর কি, নারীঘটিত। মাধব মুখুজ্যের বিধবা ছাড়া, আর কারোর আবির্ভাব হয়েছিল কী না, সেটা জানতে হবে। আর সেটা বোধহয় রবিই ভালো বলতে পারবে।’

‘আমি রবিকে থানায় নিয়ে আসতে বলেছি।’

অশোক বলল, ‘রবিকে কিন্তু যা জিজ্ঞাসাবাদ করার, আপনিই করবেন। একটু মাথা ঠান্ডা করে করবেন, যেন আপনি খুনির খোঁজখবর জানতে চাইছেন, ওকে খুনি বলে আগেই চার্জ করে বসবেন না।’

‘তুমি জিজ্ঞাসাবাদ করলে কী হবে?’

‘রবির কমপ্লেকস—এ লাগবে। আফটার অল, আমি পুলিশের লোক না, ওরই সমবয়সি শহরের ছেলে। রেগে যাবে, কথা বলবে না।’

‘আমি জুতিয়ে ওকে কথা বলাব।’

‘ওটা করতে যাবেন না, লাভ হবে না। আমি ঘরের মধ্যে থাকতে পারি, এই পর্যন্ত।’

গাড়ি থানার কমপাউন্ডে ঢুকল। শ্যামাপদ থানার বারান্দার সামনে জিপ দাঁড় করাল। অশোককে নিয়ে তার নিজের ঘরে গিয়ে, আগে চায়ের অর্ডার দিল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ পর্যন্ত তুমি একটাও ভালো লোককে খুন হতে দেখেছ?’

অশোক হেসে উঠে বলল, ‘কেন দেখব না? অনেক ভালো মানুষকেই খুন হতে দেখেছি। এই সেদিনও, ঘোড়দৌড়ের জন্য একটা নিরীহ বাচ্চা মেয়েকে মরতে হল, ভুলে গেলেন?’

শ্যামাপদ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু এই শশী দত্ত লোকটা মোটেই ভালো ছিল না।’

‘খারাপই বা কী। বিধবার সঙ্গে প্রেম করতেন। তাতে কারোর কোনো ক্ষতি হচ্ছিল না।’

শ্যামাপদ খেঁকিয়ে উঠল, ‘থাক, তোমার কাছ থেকে আমি ওসব শুনতে চাই না। পরের বিধবার সঙ্গে বদমাইশি করবে, তাকে আমি ভালো বলব, না?’

এ সময়ে চা এল। অশোক চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘লোকটা কিন্তু পণ্ডিত ছিল।’

‘দরকার নেই অমন পাণ্ডিত্যে।’

‘তাহলে আর খুনিকে খুঁজে কী লাভ। শশী দত্ত মরেছে, আপদ গেছে। ছেড়ে দিন না।’

শ্যামাপদ কয়েক সেকেন্ড অসহায় ক্রুদ্ধ চোখে অশোকের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে বলল, ‘ন্যাকা।’

অশোক হাসল। একজন সিপাই এসে বলল, ‘রবি এসেছে।’

শ্যামাপদর সঙ্গে অশোকের দৃষ্টি—বিনিময় হল। শ্যামাপদ সিপাইকে বলল, ‘আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও।’

সিপাই চলে গেল। অশোক ওর চায়ের কাপ নিয়ে, তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে দূরে, কোণের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। রবি ঢুকল। ড্রেনপাইপ ট্রাউজার, হাওয়াই শার্ট। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, রীতিমতো শক্ত পেশিবহুল চেহারা’ মাথার চুল ছোট করে কাটা, ডান হাতের কবজিতে ঘড়ি। ঢুকে বলল, ‘আমাকে ডেকেছেন?’

শ্যামাপদ গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, বসো।’

রবি বসতে গিয়ে, অশোককে দেখতে পেল। চকিতের জন্য থমকে গেলেও, মুখ ফিরিয়ে, শ্যামাপদর মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার জ্যাঠার খুনের খবর পেয়েছ?’

‘পেয়েছি।’

‘কোথায় পেলে?’

‘বাড়িতে বসেই।’

‘তখন বাড়িতেই ছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কে যেন বলল, তোমাকে বাইরে দেখেছে?’

‘কখন?’

‘যখন তোমার জ্যাঠা খুন হয়েছে?’

রবি মুখের একটা ভঙ্গি করে বলল, ‘জ্যাঠার চাকর শ্যাম দেখেছে বোধহয়?’

‘তাও দেখতে পারে।’

‘ও তো তাই দেখবে। ও কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করেছেন?’

শ্যামাপদ ধমকে উঠল, ‘ভালো ভাবে কথা বল। আমি কী করেছি না করেছি, তার কৈফিয়ত তোমাকে দেব না।’

অশোক একটু নড়ে—চড়ে বসল। শ্যামাপদ ওর দিকে দেখল। তার শক্ত মুখ একটু নরম হল। রবির দিকে ফিরে বলল, ‘তোমার কথা বল। তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে?’

রবি বলল, ‘বললাম তো, বাড়িতেই ছিলাম। বিশ্বাস না হয়, বাড়ির লোকদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন। থানার লোক গিয়ে, আমাকে বাড়িতেই দেখেছে।’

শ্যামাপদ একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে মারতে পারে বলে তোমার মনে হয়?’

রবি বলল, ‘তা কী করে জানব।’

‘তুমি তো অনেক সময় শাসাতে, শশী দত্তর মাথায় লাঠি মেরে দু—ফাঁক করে দেবে!’

রবি চুপ করে রইল। শ্যামাপদ বলল, ‘চুপ করে রইলে কেন? শাসাতে না?’

রবি একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘শাসাবার কিছু নেই। জ্যাঠা লোকটি তো ভালো ছিল না, তাই হয়তো রাগের মাথায় কিছু বলেছি।’

‘কিসের রাগ? তোমাদের কি ঠকিয়েছে?’

‘ঠকায়নি। তা বলে নিজের জ্যাঠা তার সবকিছু অন্য মেয়েমানুষকে দেবে, ভাইপোরা তা সহ্য করতে পারে না।’

‘কাকে দিত?’

‘মাধব মুখুজ্যের বিধবাকে, সবাই জানে।’

‘আর কারুকে দিত না?’

‘তাও দিতে পারে। যা চরিত্রের লোক।’

‘তুমি ঠিক কী জান, আর কারোকে দিত?’

‘টের পাই নি।’

‘মাধব মুখুজ্যের একটি ছেলে আছে না?’

‘আছে। তাকে তো জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে?’

‘জেলে?’

‘হ্যাঁ। নিজেদের লীলাখেলার অসুবিধা হচ্ছিল বলে, ছেলেটাকে কোথায় কোনো জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

শ্যামাপদ এবার অবাক। অশোকের দিকে তাকাল। অশোক গভীর চিন্তায় মগ্ন, মাথা নীচু করে শুনে যাচ্ছে। শ্যামাপদ রবির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে তোমার জ্যাঠার খুনের বিষয় তুমি কিছুই বলবে না?’

রবি বলল, ‘না জানলে কী করে বলব। কাঠ খেলে আংরা হাগতে হবে, এ তো জানা কথা। দেখুন গে, কোথায় কী কীর্তি করে বসে আছে।’

শ্যামাপদ বলল, ‘সে সব আমরা দেখব। তবে তোমাকেও আমি সহজে ছাড়ছি না। এখন যাও। কিন্তু ডাকলেই যেন পাই। শহর ছেড়ে কোথাও যাবে না। তোমার বাবা কখন ফিরবেন?’

রবি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সাতটায়।’

‘ঠিক আছে, তুমি যাও।’

রবি বেরিয়ে যাবার আগে, অশোকের দিকে আর একবার দেখল। শ্যামাপদ অশোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রকম বুঝলে?’

অশোক ওর জায়গা থেকেই বলল, ‘রবি বেশ শক্ত আছে। বিশেষ মুখ খোলেনি। তবে এই খুনে ও খুশিই হয়েছে।’

‘তার মানে, ও—ই খুন করেছে?’

‘তা ঠিক বলা যায় না। ও যদি খুন না করে থাকে, বা খুনিকে চিনতে পারে, তবে তাকে ও বাঁচাবার চেষ্টা করবে।’

‘তা হলে, রবিই কারুকে দিয়ে খুন করাতে পারে?’

‘অসম্ভব না।’

অশোক একটি সিগারেট ধরিয়ে, হাতের ঘড়ি দেখল। বলল, ‘মনে আছে, বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে?’

শ্যামাপদ বলল, ‘হ্যাঁ তুমি তখন বলছিলে বটে। কী কথা বল তো?’

অশোক বলল, ‘এখন ছ’টা বাজে। চলুন একবার মাধব মুখুজ্যের বৌয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।’

শ্যামাপদ একটু দ্বিধা করে বলল, ‘কোনো লাভ আছে? খুনের পিছনে, তার কী মোটিভ থাকতে পারে?’

অশোক বলল, ‘কেঁচো খুঁড়তে আপত্তি কী?’

‘সাপ বেরোবে বলে আমার মনে হয় না। তবু বলছ যখন, চল।’

শ্যামাপদর জিপে, অশোক আর শ্যামাপদ মুখুজ্যেপাড়ায় এল। মাধব মুখুজ্যের পুরনো সেকালের ধরনের বাড়ি। দরজা খোলা, সামনে উঠোন, বারান্দা, সংলগ্ন দালান। একজন মাঝবয়সি লোক, শ্যামাপদকে দেখে এগিয়ে এসে হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ‘কী ব্যাপার বড়বাবু?’

শ্যামাপদ বলল, ‘আপনাদের বাড়ির মালিকের সঙ্গে একবার দেখা করব।’

লোকটি বারন্দার পূর্ব প্রান্তে সিঁড়ি দেখিয়ে বলল, ‘ওপরে চলে যান, উনি বাড়িতেই আছেন।’

শ্যামাপদ বলল, ‘চলুন না, একটু ডেকে দেবেন।’

লোকটি ঘাড় কাত করে বলল, ‘আসুন।’

লোকটির সঙ্গে অশোক আর শ্যামাপদ উঠোন পেরিয়ে, বারান্দায় উঠে, সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠল। দোতলার দরজা বন্ধ। লোকটি কড়া নেড়ে শব্দ করল। দরজা খুলে সামনে যে দাঁড়াল, তাকে ঝি বলে মনে হল। লোকটি বলল, ‘সেজঠাকরুণকে খবর দাও, থানার বড়বাবু দেখা করতে এসেছেন।’

ঝি—টি ভীত চোখে তাকিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেল দালানের ভিতর দিয়ে। একটু পরেই মাধব মুখুজ্যের বিধবা এলেন। কালো ভেলভেট পাড়ের শাড়ি পরা, সাদা ব্লাউজ গায়ে, ফরসা নাতিদীর্ঘ স্বাস্থ্যবতী একজন মহিলা। মাথায় অল্প ঘোমটা টানা, সামনে ঘন কালো চুল দেখা যাচ্ছে। চেহারাটিতে লাবণ্যের থেকে, একটি ঝলকের তীব্রতাই যেন বেশি। ঠোঁটে পান খাওয়ার লাল দাগ। একটি সুগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে গেল। মহিলা হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, ‘আমার কাছে এসেছেন?’

শ্যামাপদ বলল, ‘হ্যাঁ।’

মহিলা ডাকলেন, ‘আসুন।’

শ্যামাপদ অশোককে নিয়ে ঢুকল। লোকটি নীচে নেমে গেল। দালানেই একপাশে, টেবিল এবং কয়েকটি চেয়ার রয়েছে। টেবিলের ঢাকনাটি পরিষ্কার, এমব্রয়ডারি করা। সবই বেশ পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। মহিলা বললেন, ‘বসুন।’

শ্যামাপদ বসে, অশোককে বলল, ‘বস।’

অশোক মহিলাকে বলল, ‘আপনি বসুন।’

মহিলা অশোকের দিকে তাকালেন। অশোককে চেনেন বলে মনে হল না। তিনি বসলেন। অশোক বসল। শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘শশীবাবু খুন হয়েছেন, শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

মহিলা মুখ নামিয়ে বললেন, ‘শুনেছি। কে যে এমন সর্বনাশ করল, কে জানে।’

শ্যামাপদ জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কি আপনার এখানে আসতেন?’

মহিলা এক মুহূর্ত থেমে বললেন, ‘আসতেন।’

‘নিয়মিতো?’

‘হ্যাঁ।’ মহিলা স্পষ্ট ভাবেই বললেন, ‘রোজই সন্ধের দিকে আসতেন। নিজের জ্ঞাতি—আত্মীয়দের সঙ্গে বনিবনা ছিল না। আমার হাতে খেতে ভালোবাসতেন, রাত্রে এখানেই খেতেন। আমার স্বামীরও খুব বন্ধু ছিলেন।’

শ্যামাপদ অশোকের দিকে তাকাল। অশোক বলল, ‘আপনার তো একটি ছেলে আছে।’

মহিলা অশোকের দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘আছে। ও এখানে নেই।’

অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আছে?’

মহিলা একটু চুপ করে রইলেন। তারপরে বললেন, ‘মোহন, মানে আমার ছেলে, খারাপ পথ ধরেছিল। রোজই টাকা—পয়সা সরাচ্ছিল, কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত ওকে রিফরমেটারি জেলে পাঠিয়ে দিয়েছি, ছোট ছোট ছেলেদের যেখানে সংশোধন করা হয়।’

শ্যামপদ বলে উঠল, ‘তাই নাকি? তার মানে ফরস্টল রিফরমেটারি জেলে? কোথায় আছে এখন।’

‘বাঁকুড়ায়।’

অশোক জিজ্ঞেস করল, ‘মোহনের বয়স কত?’

মহিলা বললেন, ‘এই তো সবে পনেরোয় পড়েছে।’

অশোক আবার জিজ্ঞেস করল, ‘রিফরমেটারিতে কতদিন গেছে?’

‘এক বছর হল। ও এখন আগের থেকে অনেক ভালো হয়ে গেছে।’

‘আপনি দেখতে গেছলেন নাকি?’

মহিলা হঠাৎ যেন একটু থিতিয়ে গেলেন, কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। তারপরে বললেন, ‘না, মানে ওখান থেকে রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তাতেই জেনেছি। আর মাস ছয়েক বাদেই ওকে ছেড়ে দেবে।’

অশোক এমন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল, শ্যামাপদ বিরক্ত বোধ করল। মহিলাকে আর কী জিজ্ঞেস করার আছে, বুঝতে পারছে না। মহিলাও চুপচাপ বসে আছেন। নিঃশব্দ সময় বয়ে চলেছে। বেশ কয়েক মিনিট পরে, শ্যামাপদ অশোকের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে? ওঁকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?’

অশোক সুপ্তোত্থিতের মতো চমকে উঠে বলল, ‘অ্যাঁ? না, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই, চলুন যাওয়া যাক।’

বলে ও উঠে দাঁড়াল। মহিলাকে নমস্কার জানিয়ে, দুজনেই বেরিয়ে এল। অশোক জিপে উঠে বলল, ‘এবার আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যান।’

শ্যামাপদ বলল, ‘কিন্তু, কী বুঝলে?’

অশোক বলল, ‘আর একটু ভাবি। কোথায় একটা গোলমাল হচ্ছে, এখনো ধরতে পারছি না। মোহন ছেলেটা সত্যি কতটা খারাপ ছিল, এটা জানা দরকার।’

‘এর মধ্যে আবার জানাজানির কী আছে? চোর ছেলেকে সামলাতে পারছিল না, রিফরমেটারিতে পাঠিয়ে দিয়েছে, বেশ করেছে। সব বাপ—মা এরকম হলে, ভালো হত।’

অশোক একথার কোনো জবাব দিল না।

পরের দিন অশোককে দেখা গেল শহরের হাই ইস্কুলে। সেখান থেকে মুখুজ্যেপাড়ায়। মুখুজ্যেপাড়া থেকে মেহেন্দিপাড়ায়। বিকালে নিজেই থানায় গেল। শ্যামাপদর সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘আপনি তো ভালো গাড়ি ড্রাইভ করতে পারেন।’

শ্যামাপদ অবাক হয়ে বলল, ‘সে তো তুমিও পারো।’

‘পারি, কিন্তু আপনার লেফট—হ্যান্ডার ল্যাটা জিপ চালাতে পারি না।’

‘ওসব ভণিতা রেখে বল তো, এখন কী করতে হবে?’

‘চলুন এখনই বেরিয়ে পড়ি, বাঁকুড়ায় বেড়িয়ে আসি।’

শ্যামাপদ কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি কি রসিকতা করছ নাকি? এখন যাব বাঁকুড়ায় বেড়াতে?’

‘রসিকতা করব কেন? আপনি সঙ্গে না গেলে, ফরস্টল জেলে আমাকে ঢুকতে দেবে না। গেলে মনে হয়, আপনার শশী দত্তর খুনের সঠিক সংবাদটা জানা যাবে।’

শ্যামাপদ কয়েক সেকেন্ড অশোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক বলছ?’

‘আজ অবধি বেঠিক কিছু বলেছি বলে তো মনে হয় না। কাজটা হয়তো আমার নিজেকে একলাই করতে হত, কিন্তু অপনি যখন আমার সাহায্য চেয়েছেন, আপনিও আমাকে একটু সাহায্য করুন।’

শ্যামাপদ দূঢ়স্বরে বলল, ‘নিশ্চয় করবো। আধঘণ্টার মধ্যে আমি তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। তুমি কি এই এক পোশাকেই যাবে?’

অশোক বলল, ‘একটা রাত্রের তো মামলা। কাল সকালেই তো আবার আমরা বাঁকুড়া থেকে বেরিয়ে পড়ব।’

‘তা হলে থানার ড্রাইভার নিয়ে যেতে হবে। সারারাত্রি গাড়ি চালিয়ে, আবার সকালেই আমি ড্রাইভ করতে পারব না।’

অশোক বলল, ‘ঠিক আছে, ফেরবার সময় আপনার ল্যাটা স্টিয়ারিং আমিই ধরব।’

শ্যামাপদ তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এস. আই—কে ডেকে কাজকর্ম সব বুঝিয়ে দিয়ে, তার বাঁকুড়া যাবার কথা জানাল। তারপরে টেলিফোন করল সার্কল ইনস্পেকটরকে। থানা ছেড়ে যাওয়া এবং বাঁকুড়ার কথা জানাল। কথামতো, ঠিক আধঘন্টার মধ্যেই সে প্রস্তুত হল, এবং অশোকের মতোই একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়ল।

পাঁচটায় বেরিয়ে, দুর্গাপুর পৌঁছতে দশটা বেজে গেল। সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে, আবার বাঁকুড়ার পথে। অশোক কেবল এইটুকু শ্যামাপদকে বলেছে, মোহন ইস্কুলের পড়াশোনায় কখনো ফাঁকি দিত না। পরীক্ষার রেজাল্ট বরাবরই ভালো করত। গত বছর সে ক্লাস নাইনে উঠেছিল। মোহনের বন্ধুরা কেউ—ই, তাকে চোর বলে বিশ্বাস করে না। তবে সে ভীষণ একরোখা আর জেদি।

বারোটার মধ্যেই বাঁকুড়া এসে গেল। রাত্রিটা একটা হোটেলে কাটাতে হল। পরের দিন সকালেই, বাঁকুড়া জেলের সামনেই, ফরস্টল জেলে গিয়ে দুজনে উপস্থিত হল। শ্যামাপদ নিজের আইডেন্টিটি দেখিয়ে, জেলারের সঙ্গে দেখা করল। অশোক আগেই বলে রেখেছিল, মোহনকে আলাদা ঘরে বসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে জেলারকে কারণটা জানাতে হবে। কিন্তু মোহন যা বলবে, সব কথা জেলারকে জানানো চলবে না। শ্যামাপদ অশোকের কথা মেনে নিয়েছে।

জেলার আপত্তি করলেন না, বললেন, ‘মোহন তো পরশুই ওর মায়ের সঙ্গে, প্যারোলে দেখা করতে গেছল। কিন্তু এই খুনের সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?’

শ্যামাপদ যেন বজ্রাহত হল, মোহনের পরশু দিন প্যারোলে বাড়ি যাবার কথা শুনে। সে অশোকের দিকে তাকাল। অশোক অবিকৃত মুখে, চুপ করে রইল। জেলার মোহনকে ডেকে দিতে বললেন।

কিছুক্ষণ পরেই মোহন এল। বেশ স্বাস্থ্যবান চেহারার ছেলে। এই বয়সেই বেশ লম্বায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ও শ্যামাপদ আর অশোককে দেখল। অবাক হল না, কিন্তু চিনতে পেরেছে, বোঝা গেল। জেলার বললেন, ‘এঁরা তোমার দেশের লোক, তোমাদের থানার ও. সি.। চেনো?’

মোহন ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। জেলার বললেন, ‘ওঁরা তোমার সঙ্গে একটু কথা বললেন। ওঁদের সঙ্গে পাশের ঘরে যাও।’

মোহনের মুখ কচি কিন্তু এখানে থাকার দরুন কী না কে জানে, ওকে একটু উগ্র দেখাচ্ছে। ও শ্যামাপদ আর অশোকের সঙ্গে পাশের ঘরে গেল। একটা টেবল আর খানকয়েক চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। শ্যামাপদ আর অশোক বসল। অশোক বলল, ‘মোহন, বসো।’

মোহন বলল, ‘আমার বসার দরকার নেই। আপনারা কী জন্য এসেছেন, জানি। শশী দত্তর খুনের ব্যাপার তো?’

অশোক বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি কিছু জানো নাকি?’

মোহন বলল, ‘জানি মানে, আমি নিজের হাতেই শশী দত্তকে মেরেছি।’

শ্যামাপদ লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, অশোক নিরস্ত করে বলল, ‘আচ্ছা, আমি যা যা জিজ্ঞেস করছি, তুমি তার জবাব দাও। তুলি প্যারোলে মাকে দেখতে গিয়েছিলে, শশী দত্তকে খুন করার মতলব নিয়েই, না?’

‘হ্যাঁ। ওই শয়তানটার মতলবেই মা আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। আমি কখনো চুরি করিনি।’

‘জানি, তুমি পায়খানায় যাবার নাম করে, পৌনে তিনটের সময় শশী দত্তর বাগানের পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকেছিলে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি জানতে, শশী দত্ত সেই সময় বাইরের ঘরে পড়াশোনা করে?’

‘জানতাম। আমি ভগবানকে ডেকেছিলাম, যেন লোকটাকে ঠিকমতো পাই।

‘তাই পেয়েছিলে। কী দিয়ে, কী ভাবে ফাঁস দিয়েছিলে?’

‘আমার আন্ডারওয়্যারের ইলাস্টিক ফিতের দড়ি দিয়ে। পিছন থেকে ফাঁসটা পরিয়ে দিয়েই, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গিঁট দিয়ে টেনেছিলাম।’

‘শশী দত্ত কোনো শব্দ করেনি?’

‘একটুও না।’

‘দড়িটা খুলে নিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ, যখন দেখেছিলাম, শশী দত্ত এলিয়ে পড়েছে, তখন খুলে নিয়ে আবার দৌড়ে চলে এসেছিলাম।’

‘তার মানে, যেতে আসতে আর কাজটা করতে তোমার সময় লেগেছিল পাঁচ থেকে ছ’ মিনিট?’

‘ওই রকম।’

‘কেউ জানতে বা দেখতে বা বুঝতে পারেনি?’

‘কেউ না। আমি ঠিক চারটের সময়, এখানকার জেলের পুলিশের সঙ্গে, গাড়িতে করে চলে এসেছি।’

অশোক উঠে দাঁড়াল। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন মারলে?’

মোহন বলল, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। একদিন না একদিন ওকে মারতামই।’

অশোক শ্যামাপদকে বলল, ‘চলুন, যাওয়া যাক।’

শ্যামাপদ বলল, ‘তার মানে?’

অশোক বলল, ‘তার মানে, আপনি সব জানলেন। এর পরে, আপনাকে কোর্টে প্রমাণ করতে হবে, যদি আপনি ওকে ধরেন। এই স্বীকারোক্তিটা কিছুই না, যতক্ষণ না কোর্টে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। এখন ফিরে চলুন, তারপর যা ব্যবস্থা করতে হয় করবেন।’

শ্যামাপদ যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। কী বলবে, কিছু ভেবে পাচ্ছে না।

বলল, ‘তার মানে তুমি বলতে চাও, ওকে ছেড়ে দেব?’

অশোক বলল, ‘ছাড়বেন কেন? আপনি সবই জানলেন। কিন্তু এখন এখানে কিছু বলার দরকার নেই। ও তো এখানেই রয়েছে। আপনি অপরাধীকে শাস্তি দেবার সব সুযোগ পাবেন। কিন্তু আমাকে যা কথা দিয়েছেন, তা করুন। এখন এখানে কিছু না বলে, আমরা রওনা হব।’

শ্যামাপদ উঠে দাঁড়াল। মোহন বলল, ‘আমি কিছুই অস্বীকার করব না।’

অশোক মোহনের দিকে দেখল। তারপর ঘরের বাইরে চলে গেল। ওরা যখন জিপ নিয়ে রাস্তায় বেরোল, অশোক বলল, ‘খুন নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু কোনো অপরাধই নির্বিচারে চালিয়ে যাওয়া যায় না। ছেলেটার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।’

শ্যামাপদ গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *