ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

নয়টি ছুরির মালিক

নয়টি ছুরির মালিক

আমেরিকার অন্তর্গত কলোরোডো প্রদেশের অরণ্যসংকুল অঞ্চলে শিকারি বিল ব্রায়ান্ট যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, সেই কাহিনি পরিবেশন করার আগে পুমা নামক জন্তুটি সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা দরকার।

মার্কিন মুলুকের মানুষ বিভিন্ন নামে পুমাকে ডাকে। সবচেয়ে প্রচলিত নামগুলো হচ্ছে- পুমা, কুগার, মাউন্টেন লায়ন বা পার্বত্য সিংহ। পুমা অবশ্য সিংহ নয়, যদিও গায়ের রং ও অবয়বে সিংহের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে। পুমা বিড়াল-জাতীয় জীব। কিন্তু বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, জাগুয়ার প্রভৃতি মার্জার গোষ্ঠীর অন্যান্য জীবের মতো সে ভয়ংকর নয়। একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লে সে লড়াই করে বটে, কিন্তু অধিকাংশ সময়ে সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে।

হলুদ ও ধূসর বর্ণের মিশ্রণে রঞ্জিত অতিকায় বিড়ালের মতো এই জন্তুটিকে জীববিজ্ঞানীরা নিরীহ আখ্যা দিয়াছেন। শিকারিদের মধ্যেও অনেকেই পুমাকে ভীরু ও নিরীহ মনে করেন। তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। কলোরেডোর পার্বত্য অঞ্চলে যে জন্তুটার কবলে শিকারি বিল ব্রায়ান্টের জীবন বিপন্ন হয়েছিল, সেই পুমাটাও ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।

পুমা শিকারের জন্য কলোরেডোর বনাঞ্চলে পদার্পণ করেনি বিল, তার উদ্দেশ্য ছিল হরিণ শিকার। পাহাড়ের উপর একটা পাথরে ঠেস দিয়ে দূরবীনের সাহায্যে তলদেশে অবস্থিত উপত্যকার দিকে নজর রাখছিল বিল, পিছনে ঘাস খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার ঘোড়া। হঠাৎ নাসিকা-ধ্বনিতে উত্তেজনা জানিয়ে ঘোড়াটা মাথা তুলে দাঁড়াল। বিল তার বাহনের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘোড়ার চোখে আতঙ্ক ও বিস্ময়ের আভাস ফুটে উঠেছে। পরক্ষণেই জন্তুটা দৌড়ে পিছনের জঙ্গলে গা-ঢাকা দিল।

ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত যে, বিল কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। সংবিৎ ফিরে আসতেই ঘোড়াটাকে ধরে আনার জন্য সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ নীচের উপত্যকার ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে পীতাভ-ধূসর বর্ণের একটা জলন্ত শরীরের আভাস তার চোখে পড়তেই সে আবার বসে পড়ে সন্দেহজনক বস্তুটির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

সঙ্গেসঙ্গে তার বাহনের আতঙ্কের কারণ বুঝতে পারল বিল। ওই হলুদ-ধূসর দেহের অধিকারী হচ্ছে একটা পুমা ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে তার শরীরটা আগে বিলের চোখে পড়েনি; বাতাসে শ্বাপদের গায়ের গন্ধ পেয়েই ঘোড়াটা ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়েছে।

লম্বা লম্বা ঘাসের ভিতর আত্মগোপন করে পুমা এগিয়ে চলেছে নিঃশব্দে, অতি সন্তর্পণে। একটু দূরেই যে গুরুটা ঘাস খাচ্ছে, পুমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে তারই দিকে।

বিল যদি চিৎকার করে তাহলে গরুটা রক্ষা পায়। মানুষের গলার আওয়াজ শুনলে পুমা নিশ্চয়ই পালিয়ে যেত। কিন্তু বিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল পুমার দিকে; শ্বাপদের আকস্মিক আর্বিভাবে সে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।

তিন লাফে শিকারের কাছে পৌঁছে গেল পুমা। এক এক লাফে সে প্রায় বিশ ফুট জায়গা পেরিয়ে গিয়েছিল। গরুটা চমকে একবার মাথা তুলে তাকাল। আর কিছু করার সময় সে পেল না– পুমা ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারের পিঠের উপর, মাথা আর ঘাড়ের সন্ধিস্থলে প্রচণ্ডবেগে আঘাত করল ডান দিকের থাবা দিয়ে গরুটা পড়তে পড়তে কোনোমতে সামলে নিল। সঙ্গেসঙ্গে বাঁ দিকের থাবার আঘাতে গরুর নাক চোখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল, নখরযুক্ত থাবাটার প্রবল আকর্ষণে শিং সমেত মাথাটা উপর দিকে উঠে পিছনে হেলে পড়ল আর তৎক্ষণাৎ ঘাড়ের উপর নিষ্ঠুর দংশনে চেপে বসল একজোড়া দাঁতালো চোয়াল পরক্ষণেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল গরুটার প্রাণহীন দেহ। এক কামড়েই শিকারের ঘাড় ভেঙ্গে দিয়েছে পুমা!

সমস্ত ঘটনা ঘটল নিঃশব্দে। প্রায় ৬০০ পাউন্ড ওজনের গরুটাকে মারতে পাঁচ সেকেণ্ডের বেশি সময় নেয়নি মাংসলোলপ শ্বাপদ।

পাহাড়ের উপর থেকে বিল দেখতে পেল দূরে উপত্যকার বুকে একপাল গরু নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খেতে খেতে চরে বেড়াচ্ছে। বাতাস অত দূরে তাদের নাকে শ্বাপদের গায়ের গন্ধ পৌঁছে দিতে পারেনি, তাই সঙ্গীর শোচনীয় পরিণাম তারা জানতে পারল না। পুমা ততক্ষণে শিকারের মাংস ছিঁড়ে ভোজন শুরু করেছে। খাওয়ার ধরন দেখে বিল বুঝল জন্তুটা অতিশয় ক্ষুধার্ত।

হাতে রাইফেল থাকলে খুব সহজেই জন্তুটাকে গুলি চালিয়ে বিল মারতে পারত। দুঃখের বিষয়, রাইফেলটা বাঁধা ছিল ঘোড়ার জিনের সঙ্গে। পলাতক ঘোড়ার মতো রাইফেলটাও তাই এখন বিলের হাতছাড়া। অতএব নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে বিল পুমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে লাগল।

পুমা এবার উঠে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গ টান করে আড়মোড়া ভাঙছে, রক্তাক্ত চোয়াল চেটে পরিষ্কার করছে… প্রসাধন শেষ করে অবলীলাক্রমে টানতে টানতে শিকারের গুরুভার মৃতদেহটাকে নিয়ে চলেছে নিকটবর্তী গাছগুলির দিকে…

গাছের ছায়াতে বসে জন্তুটা তার ক্ষুধা নিবারণ করল। প্রায় আধঘণ্টা পরে ভোজনপর্ব সমাধা করে সে স্থান ত্যাগ করল; শ্বাপদ প্রস্থান করতেই বিল অকুস্থলে গিয়ে পুমার শিকার এবং জায়গাটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

গরুর দেহটা তখন ছিন্নভিন্ন হাড় আর মাংসের পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। জায়গাটা রক্তে ভাসছে। তারই মধ্যে আততায়ীর পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে বিল দেখতে পেল তার বাঁ পায়ে একটি আঙ্গুল নেই। পুমার সামনের দুই থাবার প্রত্যেকটিতে পাঁচটি করে নখ থাকে; দুই থাবায় থাকে দশটি। কিন্তু এই জন্তুটার বাঁ পায়ে একটি আঙ্গুল নেই বলে সে দশটির পরিবর্তে নয়টি নখের মালিক! অলংকার দিয়ে বলতে গেলে বলা যায় নয়টি ছুরির মালিক। ছুরির সঙ্গে উপমা দিয়ে অলংকার প্রয়োগে দোষ নেই। কারণ, ছুরির মতোই ধারাল এই নখগুলো দিয়ে পুমা তার শিকারের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

এর মধ্যে বিল তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। একবার গোহত্যা করেই পুমা ক্ষান্ত হবে না, সে নিশ্চয়ই আবার গরু মারবে। ফলে, এই এলাকার গরুর মালিকেরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং মাংসলোলুপ জন্তুটাকে অবিলম্বে হত্যা করা উচিত।

ওই অঞ্চলে ওয়েব ট্যানার নামে একটি গোশালার মালিকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। রাত্রি এগারোটার সময় উক্ত ওয়েব ট্যানারের গোশালায় উপস্থিত হল বিল এবং সমস্ত ঘটনা ওয়েবকে জানাল।

রাত তিনটের সময় গোশালা থেকে অশ্বারোহণে রওনা দিল বিল আর ওয়েব সঙ্গে ওয়েব ট্যানারের চারটি প্রকাণ্ড শিকারি কুকুর।

অকুস্থলে গিয়ে সকাল নয়টার সময় কুকুরগুলো নিরুদ্দেশ পুমার গায়ের গন্ধ পেল। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চারটি কুকুরই এগিয়ে চলল উপত্যকার উপর অবস্থিত গিরিপথ ধরে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শিকারিদের দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরেই কুকুরের চিৎকার শুনে শিকারিরা বুঝল জন্তুগুলো পুমার সাক্ষাৎ পেয়েছে। চিৎকারের শব্দ সংকীর্ণ গিরিপথের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। অর্থাৎ কুকুরগুলো ওই দিকেই পুমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শব্দ লক্ষ্য করে শিকারিরা ঘোড়া চালাল। মাঝ মাঝে ঘোড়া থামিয়ে তারা শব্দের গতি নির্ণয় করছিল। বিলকে তার সঙ্গে আসতে বলে ওয়েব হঠাৎ পূর্ব দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। লাল পাথরে ঢাকা গিরিপথটার তলায় তারা ঘোড়া থামিয়ে চুপ করে দাঁড়াল। অশ্বারোহী শিকারিদের মাথার উপর ওই পার্বত্য পথে একটা তাকের মতো অবস্থান করছিল। ওই পথ ধরেই দেখা দিল পুমা। সে ছুটে আসছিল দ্রুতবেগে।

আগেই বলেছি, পার্বত্য পথটা ছিল তাকের মতো আর সেই তাকের তলায় দাঁড়িয়েছিল দুই অশ্বারোহী– পুমা ঠিক মাথার উপর এসে পড়লে তাকের বেরিয়ে-আসা-অংশ তার শরীরকে আড়াল করে দেবে, তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো সম্ভব হবে না তাই তাকের তলা থেকে ভোলা জায়গায় এসে দুই শিকারি পুমার দিকে সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

তিন চার মিনিট পরেই গিরিপথের উপর আত্মপ্রকাশ করল চারটি ধাবমান হাউন্ড। তারা জানে, পুমা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে না। পুমা অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও দ্রুতগামী, কিন্তু সে বেশিক্ষণ জোরে ছুটতে পারে না। কুকুর পুমার মতো দ্রুতগামী না হলেও সমানবেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছুটতে পারে। কাজেই, দৌড়ের প্রতিযোগিতায় কুকুরের সাথে পুমার পরাজয় অনিবার্য।

একটু পরেই কিছুদূরে পাহাড়ের গা থেকে সারমেয়কণ্ঠের সমবেত চিৎকার শোনা গেল। দুই শিকারি চমকে উঠল। পুমা যেভাবে ছুটছিল তাতে এতক্ষণ তার এক-শো গজ দুরে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু কুকুরের চিৎকারের ধরন শুনে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তাকের-মত-বেরিয়ে-আসা গিরিপথটার উপরেই তারা পুমাকে ঘেরাও করেছে।

কুকুরের চিৎকার হঠাৎ ভয়ংকর হয়ে উঠল– লড়াইয়ের শব্দ! দুই শিকারি সচমকে মুখ তুলে দেখল তাদের মাথার উপর তাকের মতো পার্বত্য পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে পুমা। সে পালায়নি। কুকুরের তাড়া খেয়ে গাছে উঠতেও সে রাজি নয়। তার কান দুটো চ্যাপটা হয়ে মাথার খুলির সঙ্গে মিশে গেছে। লম্বা ল্যাজটা এপাশে ওপাশে আছড়ে পড়ছে চাবুকের মতো একেবারে রণং দেহি মূর্তি!

বিল একবার রাইফেল তুলল। সঙ্গেসঙ্গে বাধা দিল ওয়েব, গুলি চালিও না।

না, গুলি চালানোর উপায় নেই। কুকুরের গায়ে লাগতে পারে। কুকুরগুলো এখন পুমার কাছে এসে পড়েছে। তারাও দস্তুরমতো আশ্চর্য হয়ে গেছে। কুকুরের সামনে পুমা বড়ো একটা রুখে দাঁড়ায় না। দম ফুরিয়ে গেলে তারা গাছে উঠে কুকুরদের ফাঁকি দিতে চেষ্টা করে। সেই অবসরে শিকারি এসে তলা থেকে গুলি। পুমাকে হত্যা করে। কিন্তু এই বেপরোয়া পুমাটা চার-চারটে হাউণ্ডের সামনে রুখে দাঁড়ি, বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে সে রাজি নয়।

একটা প্রকাণ্ড লালচে-বাদামী রং-এর কুকুর পুমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদ্যুতের মতো থাবা চালাল পুমা। দারুন যাতনায় আর্তনাদ করে উঠল আহত হাউণ্ড। থাবার ধারাল নখগুলো কুকুরটার পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি বার করে দিয়েছে! পাহাড়ের গায়ে ছড়ানো পাথরগুলোর উপর ছিটকে পড়ল মরণাহত কুকুর।

পাগলের মতো চিৎকার করে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামল ওয়েব, তারপর গিরিপথের বেরিয়ে আসা অংশটার উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। বিলও ঘোড়া ছেড়ে ওয়েবের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল। মাথার উপর সংকীর্ণ গিরিপথ থেকে ভেসে এল আরও একটা কুকুরের মৃত্যুকাতর আর্তনাদ। উপরে ওঠার চেষ্টা ছেড়ে ওয়েব রাইফেল তুলে শুন্যে আওয়াজ করল।

তাকের মতো জায়গাটায় এইবার তারা উঠে পড়েছে। সঙ্গেসঙ্গে পুমার ছিপছিপে শরীরটা তাদের কয়েক গজ দূর দিয়ে তীরবেগে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল।

এক লম্বা লাফ বিল এসে পড়ল দুটি ঘোড়ার ঠিক মাঝখানে। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে ওঠার আগেই ঘোড়া দুটো চিৎকার করে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠল। তারপর দৌড়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

পুমাও লাফ মারল এবং তাকের মতো গিরিপথের তলায় তার ধাবমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের পলকে…

জীবিত কুকুর দুটোকে সঙ্গে নিয়ে ওয়েব ফিরে চলল। সঙ্গে বিল ব্রায়ান্ট। পথ চলতে চলতে ওয়েব আপন মনেই বার বার বলছে, বিশ্বাস হয় না। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। নিতান্ত নিরীহ আর ভীরু বলে চিহ্নিত পুমার এমন বেপরোয়া হিংস্র আচরণ একেবারেই কল্পনাতীত, অবিশ্বাস্য।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পলাতক ঘোড়া দুটির সন্ধান পাওয়া গেল। সেই রাতটা শিকারিরা খোলা মাঠে শুয়ে কাটিয়ে দিল। কিছু খাদ্য তারা সঙ্গে এনেছিল, সেই খাবার কুকুরদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়ে তারা কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল।

খুব সকালে উঠে আবার তারা পলাতক শ্বাপদের সন্ধানে যাত্রা করল। প্রায় আঠারো ঘণ্টা পরেও অকুস্থল থেকে পুমার গায়ের গন্ধ শুঁকে জন্তুটার যাত্রাপথ নির্ণয় করতে শিক্ষিত কুকুরদের একটুও অসুবিধা হল না।

পুরো দুটি ঘণ্টা ধরে কুকুরের পিছনে পথ চলতে চলতে শিকারিরা এসে পড়ল একটা বড়ো জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গল কিছুদূর গিয়ে যেখানে শেষ হয়েছে, সেই জায়গাটা আবার নীচু হয়ে নেমে গেছে তলার দিকে। ওই নিম্নভূমি আর ঢালু জায়গাটা পাথরে ভর্তি। ওয়েবের প্রস্তাব অনুসারে বিল ঘোড়া দুটোকে নিয়ে জঙ্গলের শেষপ্রান্তে দাঁড়াল আর কুকুরের পিছনে পায়ে হেঁটে ওয়েব নেমে গেল নিম্নভূমিতে। তলা থেকে ওয়েব আর কুকুর দুটোর তাড়া খেয়ে পুমা আবার জঙ্গলে ঢুকে পাহাড়ের দিকে পলায়নের চেষ্টা করতে পারে, সেই জন্যই বিলকে পাহারায় রেখে গেল ওয়েব।

অনেকক্ষণ ধরে ওয়েবকে লক্ষ্য করল বিল। প্রায় এক মাইল দূর থেকেও ওয়েবকে বিল দেখতে পাচ্ছিল। ওয়েব তখন একটা চলন্ত বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

হঠাৎ বিলের ঘোড়া অস্বস্তি প্রকাশ করতে লাগল।

বাহনের এমন ভাবান্তরের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য বিল এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে উপর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই বিলের চক্ষুস্থির!

পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো ছোটো বড়ো পাথর আর ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে একটা হরিণের শিং! বলাই বাহুল্য, একটা জীবন্ত হরিণ পাহাড়ের ঢালে মাথা দিয়ে ওভাবে শুয়ে থাকতে পারে না– সুতরাং ওটি যে মৃতদেহ এবং এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক যে একটি পুমা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

দূরবীন চোখে লাগিয়ে বিল দেখল কুকুর দুটো গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে জঙ্গলের দিকেই ফিরে আসছে। অর্থাৎ শ্বাপদ ওখান থেকে এই দিকেই ফিরেছে। বিল বুঝল তাদের আসামী পলাতক পুমাই এই হরিণটাকে হত্যা করেছে। ঘোড়া দুটোকে বেঁধে বিল পাথর আর ঝোপঝাড় সরিয়ে হরিণের মৃতদেহটার গায়ে হাত রাখল। সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক– শরীরটা এখনও গরম। অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টা আগেই জন্তুটাকে মেরেছে পুমা!

পাহাড়টা খুব উঁচু নয়। ভরপেট খাওয়ার পর মাংসাশী পশুরা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে চায়। পুমাও নিশ্চয় এখন কাছাকাছি কোথাও নিদ্রাসুখ উপভোগ করছে। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে আবিষ্কার করতে পারলে সহজেই শ্বাপদের নিদ্রাকে চিরনিদ্রায় পরিণত করা যাবে– সুতরাং ওয়েবের জন্য অপেক্ষা না করে পদচিহ্ন অনুসরণ করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল বিল…

যেখানে এসে বিল থামল, সেটা একটা সংকীর্ণ গিরিপথ। পথের দুই ধারে অবস্থান করছে। দুটি প্রকাণ্ড পাথর। শক্ত পাথুরে জমিতে এখন আর পুমার পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ নিজের বোকামি বুঝতে পারল বিল। পুমা কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারে, অথবা এখান থেকে এক বা একাধিক মাইল দূরেও অবস্থান করতে পারে কুকুরের সাহায্য না নিয়ে তাকে ধরা অসম্ভব।

রাইফেল পিঠে ঝুলিয়ে বিল একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল। ধোঁয়া টানতেই তার মনে হল তামাকের গন্ধের সঙ্গে পুমার গায়ের দুর্গন্ধও তার নাকে আসছে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয় কুকুরের মতো প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন নয়। মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে এমন তীব্র শ্বাপদ-গন্ধ মানুষের নাকে আসতে পারে। বিল এদিক-ওদিক তাকাল না, কোথাও পুমার চিহ্নমাত্র নেই।

হঠাৎ একটা কুকুরের চিৎকার বিলের কানে ভেসে এল। বিলের মনে হল ওদের সাহচর্য পেলে সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করবে। ওরা কত দূরে আছে দেখার জন্যে পাহাড়ের ঢালের দিকে ঝুঁকে নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করল বিল, স্বাভাবিকভাবেই তার চোখ পড়ল পায়ের দিকে সঙ্গেসঙ্গে দারুণ আতঙ্কে তার হৃদপিণ্ড বুকের ভিতর চমকে উঠল!

মাথার উপর জ্বলছে মধ্যাহ্ন-সূর্য। পায়ের কাছে পড়েছে একটা ছায়া। ছায়ার মাথা আর কাঁধের ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় যে, ছায়ার পিছনে যে কায়া রয়েছে যে এখন লাফ মারার উদ্যোগ করছে।

পুমা!

একটু আগে তারই গায়ের গন্ধ পেয়েছিল বিল।

এক মুহূর্তের জন্য দারুণ আতঙ্কে বিল স্থাণু হয়ে গেল।

পরক্ষণেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো পিঠ থেকে রাইফেল টেনে নিয়ে সে গুলি চালাল। না, ছায়ার দিকে নয়- পুমার নিরেট কায়া লক্ষ করেই গুলি চালিয়েছিল সে। পুমা তখন মাথার উপরের মস্ত পাথরটার উপর থেকে লাফ মেরেছে বিলকে লক্ষ্য করে তার দেহ এখন শূন্যে, ধারাল দাঁতগুলো বেরিয়ে এসেছে মুখের ভিতর থেকে, নয়টি বাঁকা ছুরির মতো নয়টি ক্ষুরধার নখ প্রসারিত হয়েছে বিলকে ছিঁড়ে ফেলবার জন্য।

রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল। পুমার ডান থাবা যে-থাবার পাঁচটি নখই বর্তমান সেই থাবাটা যেন ধাক্কা খেয়ে একপাশে ছিটকে সরে গেল। শূন্যপথেই একবার ঘুরপাক খেয়ে পুমার দেহটা এসে পড়ল বিলের গায়ের উপর এবং সংঘাতের ফলে দুজনেই হল ধরাশয্যায় লম্বমান।

প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কারো অবস্থাই এখন খুব ভালো নয়। বিলের হাতের রাইফেল ছিটকে পড়েছে বেশ কয়েক ফুট দূরে। সেটাকে তুলতে গেলেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু যে আক্রমণ করবে সেই পুমার অবস্থাও বেশ কাহিল। ডান দিকের কাঁধ ভেঙে গেছে গুলির আঘাতে। সেই আঘাতের ফলে চৈতন্য একেবারে লুপ্ত না হলেও পুমা যেন কিছুটা আসন্ন ও অবশ হয়ে পড়েছে।

বিল জন্তুটার দিকে চাইল। আহত পুমা এখনই সামলে উঠবে সন্দেহ নেই। পুমার কাঁধ ভেঙে গিয়ে ডান থাবা অবশ্য অকেজো, কিন্তু বাঁ দিকের থাবার চারটি ধারাল নখ এখনও অটুট পিছনের পায়ের নখগুলো শত্রুর দেহ ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলতে পারে মুহূর্তের মধ্যে, দুই চোয়ালে সাজানো দাঁতগুলোই বা কম কি? না তাকে সামলে উঠতে দিলে আর রক্ষা নেই- কোমর থেকে ছুরি নিয়ে পুমার পিঠের উপর লাফিয়ে পড়ল বিল।

বাঁ হাত দিয়ে পুমার গলা প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে সে ডান হাতে সজোরে ছুরিকাঘাত করল। ছুরি বাঁট পর্যন্ত ঢুকে গেল পুমার পাঁজরে।

কিন্তু জন্তুটার দৈহিক শক্তি অসাধারণ। এমন সাংঘাতিক আঘাত খেয়েও সে মাটি নিল না। এমন জোরে সে লাফিয়ে উঠল যে তার পিঠের উপর থেকে বিল ছিটকে পড়ল কয়েক ফুট দূরে। সঙ্গেসঙ্গে বিকট চিৎকার- এমন বীভৎস রক্ত-জল-করা জান্তব ধ্বনি আগে কখনো বিলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের বিদ্যুৎপ্রবাহ।

সংঘাতের ফলে পুমাও ছিটকে পড়েছিল পথের উপর। কয়েকবার গড়াগড়ি খেয়ে সে উঠে পড়ল, গুঁড়ি মেরে বসে তীব্র দৃষ্টিতে চাইল শত্রুর দিকে। হিংস্র আক্রোশে জ্বলে উঠল দুই পিঙ্গল চক্ষু। বিল শুনতে পেল পিছনের থাবা দুটোর নখ পাথুরে জমির উপর সশব্দে ঘর্ষিত হল, অর্থাৎ জমি আঁকড়ে ধরে জন্তুটা লাফ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সামনের দিকের ডান থাবাটা অকর্মণ্য। বাঁ থাবার প্রসারিত চারটি নখ বিলের নজরে পড়ল। নয়টির মধ্যে পাঁচটি ছুরি বুলেটের আঘাতে অকেজো, কিন্তু চারটি ছুরি এখনও শত্রুর দেহ ছিন্নভিন্ন করতে প্রস্তুত।

পুমার কাঁধ ভেঙে গেছে গুলিতে, পাঁজর ফুটো করে ফুসফুস পর্যন্ত ঢুকে গেছে ছুরি তার মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু মৃত্যুর আগেই সে মরণ-কামড় বসাবে। ছুরির কোপ মেরে শ্বাপদের প্রতিহিংসাকে প্রতিহত করা যাবে না। রাইফেল নাগালের বাইরে, হাতের ছুরি শ্বাপদের নখদন্তের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ; পিছনে পালানোর পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের দেয়াল, সামনে মূর্তিমান মৃত্যুর মতো আহত পুমা বিল জীবনের আশা ত্যাগ করল।

হঠাৎ কুকুরের চিৎকার ভেসে এল বিলের কানে। সচমকে মুখ তুলে সে দেখল যে-পাথরটার উপর থেকে পুমা একটু আগেই তার উপর লাফিয়ে পড়েছিল, সেইখানে দুটো কুকুর নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ওয়েব। বিলের অবস্থা দেখে ওয়েব চিৎকার করে উঠল। পুমার জ্বলন্ত দৃষ্টি তবুও বিলের দিকেই নিবদ্ধ কুকুরের চিৎকার এবং মানুষের গলার আওয়াজ শুনেও সে কিছুমাত্র বিচলিত হল না।

পুমা লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। বিল নীচু হয়ে শক্ত হাতে ছুরি বাগিয়ে ধরল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল ওয়েবের রাইফেল। সঙ্গেসঙ্গে উঁচু পাথরটার উপর থেকে লাফ মেরে নীচে এল কুকুর দুটো, বীরবিক্রমে দংশন করতে লাগল ধরাশায়ী পুমার দেহে।

পুমার দেহ নিস্পন্দ। বার বার কামড় খেয়েও তার সাড় হল না। মখমলের মতো থাবা দুটোর ভিতর থেকে প্রতিহিংসার উদগ্র আগ্রহে একবারও বেরিয়ে এল না নয়টি বাঁকা বাঁকা নখ, ওয়েবের গুলি খেয়ে মরণ-ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে নয়টি ছুরির মালিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *