নমিনি
নিজেকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘ক-বাবু আপনি কেমন আছেন?’
তা হলেই বিপদ। ক-বাবু একটু থতমত খেয়ে যাবেন। ক-বাবু জানেন, খ কেমন আছে, কেমন আছে গ, জানা হয় না নিজে কেমন আছে। আমরা কেউই খেয়াল করি না, আমরা নিজে কেমন আছি। আধুনিক জীবনের এই হল মজা। সবসময় আমরা নিজের বাইরে নানা ধান্দায় নেচে বেড়াচ্ছি। দেহ যদি একটা বাড়ি হয়, আর সেই বাড়ির ভাড়াটে যদি ‘আমি’ হয় তাহলে সে কতক্ষণই বা বাড়িতে থাকে। গভীর রাতে যখন ফিরে এল, তখন এতই শ্রান্ত আর ক্লান্ত যে দেহ-ঘরের অবস্থা বোঝার আগেই নিদ্রা। দিন যায়। এমনি করেই যায় যৌবন। হঠাৎ ধরা পড়ল যে-খাটে শুয়ে আছি, তার পায়ায় তেমন আর জোর নেই। কমজোর লাগছে। বাত আসছে। দেহ-ঘরের জানালা দুটোয়, অর্থাৎ চোখের কাচে কুয়াশা জমছে, মানে ছানি আসছে। নিয়মিত ভিটামিন দিয়ে পালিশ করা হয়নি। দুটো ভেন্টিলেটার মানে কান, কানে ধরেছে পাখির বাসা। উপায় ছিল না কিছু। শত মানুষের শত কুজন দিবারাত্র পথ পেয়েছে এই ভেন্টিলেটার দিয়ে। আর তেমন ভালো শুনতে পাই না। উপায় ছিল না কিছু। সংসার আমাকে ভেন্টিলেটারে জালি লাগাবার অনুমতি দেয়নি। সংসারের নিয়ম হল, শুনতে হবে, শুনে যেতে হবে। নানা পাখির নানা ডাক। ভোর থেকে মধ্যরাত। এ ঘরের ভাড়াটে আমি হলেও, অতিথি অজস্র চিন্তা। সারাট জীবন চলেছে তাদের দাপাদাপি। কেউ আমার ঘরের দিকে তাকায়নি। নির্বিচারে ব্যবহার করে গেছে। দেওয়ালে-দেওয়ালে অজস্র বেদনার পেরেক পুঁতে স্মৃতির ছবি ঝুলিয়ে গেছে। ফেলে গেছে বসবাসের আবর্জনা। এমন এক খাটাল তৈরি করে দিয়ে গেছে, যা আর জীবনে পরিষ্কার করা যাবে না। আমি পারিনি অতিথিদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। মধ্যবিত্ত, নরম প্রকৃতির মানুষরা ধনীদের মতো স্বার্থপর হতে পারে না। শুধুই নিজের জন্যে বাঁচা, সে আর হয়ে ওঠে না। এ ঘরের দরজাই নেই তো তালা! এসো দু:খ এসো আনন্দ। আনন্দের স্বভাব পাখির মতো। বড় স্বাধীন। সহসা ঢুকতে চায় না দেহ-খাঁচায়। দু:খের স্বভাব টিকটিকির মতো—দেওয়াল ছাড়া থাকে না। দেহ-পিঞ্জরের খাঁজে-খাঁজে আশ্রয় খুঁজে নেয়। দু:খ-সুখের সেই পুঁটলিটি বগলে নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। বেশ বুঝতে পারি দিনে দিনে পাণ্ডুলিপির মতো তার আকার-আয়তন বাড়ছে। কেউ লেখে না সে কাহিনি; অথচ লেখাও হয়। শ্রোতাও কেউ নেই। শোনাতে চাইলেও শুনবে না কেউ। জীবনের সঙ্গে আত্মজীবনীও চিতায় গিয়ে চড়বে। নিজের জীবনী নিজেরও পড়া হয় না। সময় কোথায়! বাঁচার আগুনে ফুঁ দিতে-দিতেই জীবন চলে যায়। উপসংহার, এক মুঠো ছাই। ভূমিকাটা যার ক্রন্দন, তার পরিণতি ভস্ম ছাড়া আর কি হবে।
জীবন যেন শ্রী-ফলের আঠা। সেই আঠায় ক-বাবু রমরমে এক মহিলাকে জড়িয়েছিলেন। সেইটাই সংসারের নিয়ম। এক কাণ্ড থেকে বহু কাণ্ডের জন্ম। সৃজনী প্রতিভা বলতে সেইটাই বোঝায়। সংসার সৃজন। ক-বাবুকে মঞ্চে একা ফেলে রেখে পূর্বপুরুষরা একে-একে বিদায় নিলেন নাটক থেকে। এ পালার লেখক কে আজও মানুষের জানা হল না। যেখানে যার অঙ্ক শেষ, সেইখানেই তার চির-বিদায়। ফিরে আর আসে না। যাওয়ার আগে সবাই বলে যায়, আর একটু ইচ্ছে ছিল থাকার। উপায় নেই ট্রেন এসে গেছে আমার। ‘কোথায় চল্লে ঠিকানাটা দিয়ে যাও। আমিও তো যাব একদিন, আমার অঙ্ক শেষ করে।’ রেলের সিগন্যালের মতো হাত একটু ওঠে। মুখে একটু যন্ত্রণার রেখা ফোটে। জীবন-প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যায় ‘অনন্ত এক্সপ্রেস’। টাইম-টেবলে ছাড়ার স্টেশনের নাম লেখা আছে। গন্তব্য-স্থান লেখা নেই। সবটাই ‘মনে হয়।’ কেউ তো আর ফিরে এল না। এমনকী দু:খ-সুখের পুঁটলিটাও নিয়ে গেল না। জীবন-প্লাটফর্মের লেফট-লাগেজে পড়ে থেকে-থেকে বিবর্ণ বিস্মৃতি হয়ে গেল।
বালিশে মাথা রেখে একটা শব্দ শুনি। কীসের শব্দ। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারি, আমার হৃদয়ের শব্দ। বড় জোরে পা ফেলছে যেন। এত দ্রুত কেন ছুটছ হৃদয়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, একজন মানুষের হৃদয় কত কোটিবার স্পন্দিত হয়ে থেমে যাবে, তা নাকি নির্ধারিত আছে। একেই বলে দম। দম দিয়ে এই বিশ্বে আমাদের কে পাঠালেন, কেন পাঠালেন, তা তো জানা নেই! অত দ্রুত ছুটলে হৃদয়, তোমার দম ফুরিয়ে যাবে। আরও কিছুকাল থাকতে হবে। কিছু কাজ আছে বাকি। সংসারের জমিতে সবে চারা বেরিয়েছে। চারাগুলোকে বড় করে দিয়ে যেতে হবে। আসা-যাওয়ার মাঝখানে মানুষের এই এক চিলতে জমি। সেইখানেই তার চাষবাস। বীজ থেকে চারা, চারা থেকে গাছ। প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতা, পুত্র, প্রপৌত্র। অধ্যায়ের পর অধ্যায়। মহাকাল লিখে চলেছে মানবের ইতিহাস।
ক-এর পাশে খ। খ-এর পাশে গ। গ-এর পাশে ঘ। ক-বাবু সকালে বাজারে ছোটেন। ফিরে এসে জীবিকার হাতল ধরেন। জনে জনে খোঁজখবর নেন, কে কেমন আছে। ডাক্তারখানার বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকেন। প্রেসক্রিপশান পালটে নতুন ওষুধ আনেন। রোগীর শিয়রে বসে থাকেন সারারাত। দুর্ভাবনার কালো ছায়া পড়ে মুখে। আয়-ব্যয়ের সমতা রাখতে পারেন না। নিজের ভবিষ্যৎ নয় অন্যের ভবিষ্যৎ ভেবে আঁতকে ওঠেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখেন, সামনের চুল পাতলা হয়ে এসেছে। পাশে-পাশে পাক ধরেছে। চোখ দুটো হয়ে উঠেছে মরা মাছের মতো। শক্ত করে কোনও জিনিস ধরলে হাত কাঁপে। তেমন কোনও উত্তেজনা এলে শরীর দুলতে থাকে। মনে হয় হৃদয়টা এক লাফে চলে যাবে দেহের বাইরে।
মাঝে-মাঝে মনে হয়, লোহার জগতে বাস করছেন তিনি। স্নেহ নেই। দয়া নেই। মায়া-মমতা নেই কোথাও এতটুকু। আছে শুধু কর্তব্য। কতদিন কেউ স্নেহের হাত রাখেনি কপালে। উদ্বেগের কণ্ঠে জিগ্যেস করেনি, ‘কেমন আছিস বাবা!’ শুকনো মুখ দেখে বলেনি, ‘আয় আমার কাছে এসে একটু বোস। একটা মিষ্টি, এক গেলাস জল খা বাবা।’ তাঁর ছেলেবেলার গল্প বলার মতো একজনও কেউ নেই। ‘শোন তুই যখন এতটুকু, হাফপ্যান্ট পরে সবুজ ঘাসের ওপর ছোটাছুটি করিস, তখন তোর দাদু এলেন বিদেশ থেকে। দাদুকে দেখে ভয়ে তুই আমার পিছনে লুকিয়ে পড়লি। ভীষণ ভীতু ছিলিস তুই।’
ক-বাবু প্রথম ধাক্কা খেলেন সেদিন, যেদিন কিছু টাকা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে ফিকসড ডিপোজিট করার জন্যে। ফর্মের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে এজেন্ট বললেন, ‘কাকে নমিনি করবেন?’
‘নমিনি?’
‘হ্যাঁ, বলা তো যায় না, হঠাৎ আপনার কিছু হয়ে গেলে টাকাটা কে পাবে?’
সেই প্রথম শুনলেন যাওয়ার কথা।
AMAR BOYOS 57 BOCHHOR. UNI AMAR KOTHAI JENO BOLECHHEN.