নমামি – জিতেশচন্দ্র লাহিড়ি

নমামি – জিতেশচন্দ্র লাহিড়ি

দুর্যোগের রাত্রি৷ ঝড় আর বৃষ্টি সমানেই চলেছে৷ আঁধারে পথ তো দূরের কথা, সামনের মানুষ-এমনকী নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখা যায় না৷ এই আঁধারভরা বাদল রাতে তিনজন যুবক চলেছে হাত ধরাধরি করে-অতি সন্তর্পণে৷ বাত্যাতাড়িত বৃষ্টির ধারা আছড়ে পড়ছে তাদের চোখে, মুখে সর্বাঙ্গে-সুতীক্ষ্ণ শরের মতো৷ পিছল পথে একজন পড়ে যাবার মতো হতেই আর একজন তাকে সামলে নেয়৷ আবার চলতে থাকে হাত মিলিয়ে-যথাসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকায়৷ তারই আলোতে পথ দেখে নেয় তারা৷ ঝড়ে ধান ও পাটের চারাগুলি জড়াজড়ি করে এলোমেলোভাবে শুয়ে পড়েছে-ঢেকে ফেলেছে পথের রেখাটুকু৷ তাই মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় পথ৷ মাঠের চারদিকের বসতিগুলোতে আলোও দেখা যায়৷ অথচ এই বিভ্রান্ত পথিকের দল একটু চেঁচিয়েও বলতে পারে না-‘কে আছ ভাই! একটু বাইরে এসো-আলো দেখাও!’ কেউ দেবে না সাড়া তাদের আহ্বানে, সারাটা দেশের বুক জুড়ে দুর্যোগ-দৈত্যের তাণ্ডব চলেছে৷ আর দোর জানালা বন্ধ করে ঠান্ডা হাওয়ায় দিব্য আরামে সকলে ঘুমে অচেতন৷ পথের ডাক কি পৌঁছুবে তাদের কানে? তাই নীরবেই চলছিল তিনজন৷ মাঝের যুবকটি চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেরি হচ্ছে না তো? ক-টা বাজে দেখুন না সেজদা৷’ ঘড়ির পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করল সামনের যুবকটি৷ ডান হাতে সেটা ধরেই চলতে লাগল পথ,-বিদ্যুতের আশায়৷ বিদ্যুৎ চমকাতে দেরি হয় না৷ দেখে নিল ঘড়ি-দশটা সাঁইত্রিশ৷

‘আরও একটু জোরে চলো৷ সাড়ে এগারোটায় পৌঁছুতেই হবে ঘাটে৷’ সেজদা গতিবেগ বাড়িয়ে দিলেন৷ মাঝের যুবকটির দলীয় নাম বিমান৷ ঘর ছেড়ে এই প্রথম বেরিয়েছে সে ভীষণ দুর্যোগে৷ ভীষণতার অভিযানে৷ মন তার মেতে উঠেছে এক সর্বনাশা নেশায়৷ উদ্বেল হৃদয়ের সীমাহীন সজীবতায় গ্রাহ্যই করে না প্রকৃতির প্রতিরোধ৷ অবশেষে নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট আগেই তারা পৌঁছে গেল ঘাটে৷ সারি সারি কয়েকখানি নৌকা বাঁধা৷

-‘হেই মা-ঝি-ই-ই-কই আছ,’-হাঁক দিলেন সেজদা৷

-‘আহেন-আহেন-কর্তা’-অন্ধকারে জবাব ভেসে আসে৷ পা টিপে টিপে অতি সাবধানে তিনজন অগ্রসর হল নৌকার দিকে৷ নৌকায় পৌঁছে কিনারে বসে পা ধুয়ে নিয়ে তারা ঢুকল ভিতরে৷ নৌকায় আরও লোক ছিল৷ আঁধারে জড়সড় হয়ে বসল আগন্তুক তিনজন৷ ঝড় বৃষ্টি কমে এলেও তখনও কিছুটা রয়েছে৷ তখনও বিক্ষুব্ধ মেঘনা আলোড়িত হচ্ছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে৷ একটা আস্ফালন,-একটানা গর্জন করেই চলেছে যেন এই বিশালকায় দৈত্য৷ এরই মাঝে নৌকা৷ দাঁড়ে বসেছে তিনজন৷ একই তালে দাঁড় পড়ে-‘ক্যাঁ-ও-ঝপ, ক্যাঁ-ও-ঝপ৷’

ঘুমের ঘোরে কখন যে বিমান এলিয়ে পড়েছে জড়সড় হয়ে ছাইয়ের মধ্যে একপাশে,-তা সে জানে না৷ ঘুম ভেঙেই দেখে ভোরের আলো ধীরে আঁধারের আবরণ ভেদ করে এগিয়ে আসছে৷ প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে দিগদিগন্তের রূপ৷ সোজা হয়ে বসেই বিমান দেখতে পেল নৌকায় আটজন লোক-মাঝিমাল্লা বাদে৷ তাদের মধ্যে একজন তার অতি পরিচিত, অতি প্রিয়৷ আনন্দে মন তার নেচে উঠল৷ হাসিমুখে পরিচিত লোকটির দিকে চেয়ে বলল সে, ‘আপনিও এসেছেন জ্যো-‘ কথা তার শেষ হতে পেল না৷ মাঝপথে একটি ধমক খেয়ে নিতান্ত অপ্রতিভ হয়ে থেমে গেল সে৷ মনের স্বঃতস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস থমকে গেল প্রচণ্ড ধাক্কায়৷ তারপর সব নীরব৷ আটটি বোবা যেন আটকে রয়েছে একটি ঘরে৷ এরা হাসে না-কথা কয় না৷ শুধু এ-ওর দিকে চায়-আর মুখ গুমড়িয়ে মনের খুশি চেপেই মারার চেষ্টা করে৷ কখনো কদাচিৎ তার ব্যর্থতা প্রকাশ পায় ক্ষণিকের তরে মুচকি হাসিতে৷ পাগল নাকি এরা!

বিমান হঠাৎ আবিষ্কার করল যে হাইলের মাঝিটি তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে৷ চোখে চোখ মিলতেই মাঝিটা চোখ ফিরিয়ে নিল৷ আবার যেন বিমানকে চেয়ে চেয়ে দেখছে৷ বিমানও এবার বেশ করে দেখে নিল লোকটিকে৷ ভীষণ কালো, মাথায় চুলের কমতি পুষিয়ে দিয়েছে দাড়ির জঙ্গল, কদাকার,-ময়লা ছেঁড়া ধুতি পরনে,-গলায় কাঠের মালা, আর সর্বাঙ্গ অনাবৃত৷ বিমানের ইচ্ছা হল তাকে জিজ্ঞাসা করে নামটি কী,-কী জাত! কোনোক্রমে এগিয়ে গেল সে গলুইয়ের দিকে৷ মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম কী?’

-‘আঁইগ্যা? মোর নাম জিগ্যান? মোর নাম ‘খালীছরন’৷

খুব হাসি পেল বিমানের ‘কালীচরণ’ কথাটা উচ্চারণ করছে ‘খালীছরন’৷

‘কী লোক, কী তোমরা,’ বিমান জিজ্ঞেস করে৷ উত্তর হল, ‘নমামি৷’

‘নমামি! সে আবার কী?’

-‘আঁইগ্যা-নমামি’-আবার জবাব দেয় মাঝি৷ বিমান অবাক হয়ে ভাবতে থাকে ‘নমামি’ আবার কী জাত৷

এবারে ‘খালীছরন’ই সেটা বুঝিয়ে দিল৷

-‘আঁইগ্যা খরতা! মোরা ছোটো জাত৷ হইলাম গিয়া আমি নমো৷’ এবারে বুঝল বিমান৷ কালীচরণ একটু তাড়াতাড়ি ‘নম’, ‘আমি’ এই শব্দ দু-টি একসাথে উচ্চারণ করেছে, ফলে হয়েছে ‘নমামির’ আবির্ভাব৷

বেলা বেড়েই চলল৷ নৌকার উপরেই টিনের তোলা উনুনে পাক চড়েছে৷ নৌকায় দাঁড় পড়ছে ঝপাঝপ,-চলেছে এগিয়ে৷ দুই কড়াই খিচুড়ি,-মানে চাল আর ডাল একসাথে সেদ্ধ করে তাতে নুন দেওয়া হয়েছে, হাতা তাতিয়ে সম্বারা দেবার ব্যবস্থাও হয়েছে৷ সেজদা বলে উঠলেন, ‘বড়োই যে বাহারের খাবার ব্যবস্থা! ভোজ দেখছি!’ নীরবেই হেসে নিল সবাই৷ একটি নির্জন স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে স্নান সেরে সকলে খেয়ে নিল৷ আবার চলল নৌকা৷ সন্ধ্যার পর তারা পৌঁছুল মণিতলার ঘাটে, ঘাটের উপরেই প্রকাণ্ড বটগাছ৷ সেখানে নাকি ষাট হাজার ভুত প্রেত বাস করে৷ কত অনভিজ্ঞ পথিক নাকি মারা গেছে ভূতের হাতে৷ ফলে দিনেরবেলাতেই পারতপক্ষে একাকী কেউ এধারে আসে না৷ বিমানও জানত এ কাহিনি৷ গা তার ছমছম করে৷ আর একখান নৌকা আগেই এসেছে এই ঘাটে তাতেও জনকয় আরোহী৷

রাত্রি প্রায় এগারোটা৷ দলের সাথে বিমানও হাফপ্যান্ট ও সার্ট পরে নৌকা ছেড়ে এগিয়ে চলে নিস্তব্ধ গ্রাম্য পথে৷ জানত সে যে সবাই চলেছে অ্যাকশানে৷ উত্তেজনায়, আশঙ্কায় তার বুকটা ঢিবঢিব করে৷ নির্দেশমতো সে একটি উপদলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রবেশ করল এক সুদখোর টাকার কুমির মহাজনের বাড়িতে৷ বাঁশির সা^ংকেতিক ধ্বনির সাথে সাথেই যে-যার নির্দিষ্ট কাজে লেগে গেল৷ কেউ যাতে বাড়ির বাইরে না যায় অন্দর থেকে, তাই লক্ষ রাখার ভার ছিল বিমানের৷ সে লক্ষ করল এই অ্যাকশানের সর্বাধিনায়ক এক কৃষ্ণকায় পাঞ্জাবি৷ মাথায় পাগড়ি, প্রকাণ্ড দাড়ি, চোখে চশমা, খাকির ট্রাউজার আর মিলিটারি সার্ট পরে সব কিছুরই তত্ত্বাবধান করছেন তিনি৷ অবাক হয়ে গেল বিমান৷ দলে পাঞ্জাবিও আছে,-আর তারাও বাংলাদেশে কাজে অংশ গ্রহণ করে৷ সহসা একটি বাঁশির আওয়াজ, সঙ্গেসঙ্গেই গুড়ম গুড়ম৷ উত্তেজনায় বিমান হারিয়ে ফেলে কর্তব্যের নির্দেশ, ছুটে যেতে চায় গেটের দিকে৷ হঠাৎ, কে যেন তার হাত চেপে ধরে কঠোর স্বরে আদেশ দেয় ‘ফিরে যাও অন্দরের ফটকে৷’

অভিভূত বিমান চেয়ে দেখে সেই পাঞ্জাবি৷ কিন্তু এমন পরিষ্কার বাংলা বলে সে! আশ্চর্য!

পর পর দুইটি বাঁশির শব্দ৷ একযোগে সকলে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে৷ উপদলে বিভক্ত পথে অগ্রসর হল নদীর দিকে, বিমানের ব্যাচ যখন নদীতীরে পৌঁছোল তখন গ্রামে ভীষণ সোরগোল৷ নৌকার উপর থেকে কে যেন আদেশ দিল, ‘হেই! চটপট৷’ বিমান দেখল একজন লোক ক্ষিপ্র হাতে প্রত্যেককে তল্লাসি করছে আর ধুতিজামা বিলি করছে৷ ক্ষিপ্রতার সাথে চলেছে বস্ত্র পরিবর্তন৷ ঠিক বিমানেরই জামা ধুতি বিমানের হাতেই পৌঁচেছে দেখে সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল৷ তাড়াতাড়ি সকলে নৌকায় উঠে পড়ল৷ নৌকা দিল ছেড়ে৷ উত্তেজনায় অধীরতায় বিমানের সারারাত ঘুম হল না৷ কী যে হয়ে গেল কিছু সে বুঝতে পারনি৷ নানা চিন্তার দাঙ্গা লেগেছে তার মনে,-মাথা তার ঝিমঝিম করতে লাগল৷

ভোরের আলোর সাথেসাথেই সে চেয়ে দেখে ‘নমামি’র চোখ দু-টি যেন তাকে গিলছে৷ কী কদাকার এই মাঝিটা! আর কেনই-বা সে এত চেয়ে থাকে বিমানের দিকে৷ স্পাই না তো! তার মনে হল জ্যোতিদাদের মস্ত ভুল হয়েছে অজানা মাঝির নৌকা ভাড়া করা, এই ভীষণ কাজে৷ কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ করে সে অবাক হল৷ তারা করেছে ডাকাতি৷ বড়ো বন্দুক, পিস্তল, রিভলভার, ছেনি, হাতুড়ি,-অনেক কিছুই দেখা গেল কার্যের ক্ষেত্রে৷ বস্তা বস্তা টাকাও লুটেছে তারা কিন্তু সেসব এমনকী খাকি সার্ট, হাফ প্যান্ট কিছুই তো নাই নৌকায়৷ গেল কোথায়? বিমান নিজেই ঠাওর পায় না-তো এই নিরক্ষর মাঝি বুঝবে কী?

দুপুরে আবার রান্না হয়েছে৷ একটি নির্জন স্থানে স্নানাহারের জন্যে সকলে নেমে গেছে৷ বিমানের শরীরটা ভালো নাই, মাথাটা খুব ধরেছে তাই সে নৌকাতেই রয়ে গেছে৷ আর রয়েছে ‘খালীছরণ৷’

মাঝি এবারে বিমানের সাথে গল্প জুড়ে দিল৷

‘কৈ গেছলেন হাপনারা?’-জিজ্ঞাসা করে সে৷

কী উত্তর দেবে বিমান? সে চুপ করে থাকে৷

মাঝি নিজেই উত্তর দেয়-‘ও-ও বিয়াবাড়ি বুঝি! বাজি পুড়াইন্ন্যার আওয়াজ পাইলাম-আর হারা গাঁ জুইড়া কী হইচই! খুব বড়ো ঘরের বিয়া বুঝি?’

বিমান লক্ষ করল যে মাঝি কথা বলে আর তার দিকে চেয়ে চেয়ে মুচকি হাসে৷ আবার প্রশ্নের ধরনও এই প্রকার! কিছুক্ষণ পুর্বে এই মাঝিটার চাওয়ার ধরন দেখে স্পাই বলে যে সন্দেহ তার মনের কোণে জেগেছিল এবার সেটা আরও দৃঢ়তর হল৷ আর প্রশ্নের সুযোগ দেওয়া উচিত নয় বিবেচনায় বিমান হাই তুলে গা মোড়ামুড়ি করে শুয়ে পড়ল৷ সত্যিই তার গা গরম হয়েছিল-মাথাটাও বেশ ধরেছে৷ চোখ বুজে পড়ে রইল সে৷ হঠাৎ সে অনুভব করল মাঝিটা এসে তার কপালে হাত দিয়েছে৷ বিমান মনে মনে খুব বিরক্ত হলেও ঘুমের ভাণ করেই পড়ে রইল৷ মাঝি ধীরে ধীরে তার কপাল টিপে, আর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল৷ প্রথম প্রথম বিরক্তির ভাব মনে এলেও মন্দ লাগছিল না বিমানের৷ তার মনে হল কত যত্ন, কত স্নেহ মাখানো রয়েছে মাঝির হাত দু-টিতে৷ যেন স্নেহময়ী জননী হৃদয় ঢেলে পীড়িত সন্তানের সেবা করছেন শিয়রে বসে৷ আহারান্তে আর সকলে নৌকায় ফিরে আসার আগে মাঝি চলে গেল গলুইয়ে৷

পদ্মা ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলির ধনী মহাজনদের বাড়িতে পর পর কয়েকটি ডাকাতি হয়েছে৷ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ডাকাত নেতা এক কৃষ্ণকায় পাঞ্জাবি৷ প্রকাণ্ড বড়ো তার দাড়ি৷ নদীতীরের বড়ো লোকদের মনে সে একটা রীতিমতো বিভীষিকা৷ কত অদ্ভুত কাহিনি রটে গেছে তার সম্বন্ধে৷ কেউ বলে পুরাণের শব্দভেদী বাণ আয়ত্ত করেছে সে,-শব্দ লক্ষ করেই ছোড়ে অব্যর্থ গুলি৷ কেউ বলে লাঠি ভর করে এক লাফে ওঠে দোতালায়, অবলীলাক্রমে লাফ দিয়ে পড়ে ভূমিতে৷ হাত দিয়ে ভাঙে সিন্দুকের তালা, হুংকার দেয় দৈত্যের মতো, নির্মম পাষাণ সে৷ অথচ কোনো ক্ষেত্রেই করেনি নারীর অসম্মান৷ এক বাড়িতে একজন দস্যু একটি মহিলার অঙ্গ থেকে গয়না খুলে নিচ্ছিল৷ কিন্তু সহসাই কে যেন তাকে দু-কান ধরে তুলে ধরল শূন্যে৷ সকলে চেয়ে দেখল, এই কৃষ্ণকায় পাঞ্জাবি৷ এও শোনা যায় ডাকাতি করতে গিয়েও সে রোগীকে সেবা করে, বাড়ির মেয়েদের কাছে জল চেয়ে খায় আর বলে, ‘কুচ্ছু ভয় নাই মায়ি৷’

এই সব ডাকাতির ফলে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে গেছে অসম্ভব৷ পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা নদীর স্থানে স্থানে লঞ্চে ও বোটে জলপুলিশের ঘাঁটি বসেছে৷ এদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল বড়ো ঘাসি নৌকা দেখেছে কি থামাবেই৷ একদিন কালীচরণ দু-জন সঙ্গীসহ জোর চালিয়েছে নৌকা৷ দূর থেকে সে দেখতে পেল জলপুলিশের ঘাঁটি৷ সেই সময় পাশ দিয়ে একখানা স্টিমারও যাচ্ছিল৷ ঢেউয়ের দোলায় দোলা খাচ্ছিল নৌকাখানি৷ হাইলের মুঠি শক্ত করে ধরে কালীচরণ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই বীরা! এই সোৎস্যা! তরা দ্যাখস কী? লাগা পাল্লা জাহাজের লগে!’ বলেই সে সবল হাতে হাইলের মুঠি ধরে ক্যাওড়া মারে আর মুখ বুঁজে শব্দ করে ‘উঁ-উঁ-হুঁ-উঁ-উঁ৷’ নৌকার গলুই একবার ওঠে পাঁচ-সাত হাত উঁচুতে,-আবার পড়ে গহ্বরে-যেন ঢেউয়ের দোলায় নৌকাখানি জুড়ে দিয়েছে প্রলয় নাচন৷ তারই সাথে সাথে নেচে উঠেছে কালীচরণের মন৷ শঙ্কা নাই-সংশয় নাই, যেন প্রলয়ের বুক চিরে ভ্রূক্ষেপহীন বেপরোয়া নিঃশঙ্ক চিত্তে ছোট্ট নৌকাখানি নিয়ে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে মাঝি কালীচরণ৷ ব্রিটিশের যান্ত্রিক জলযান নদীর বুকে তুলেছে উত্তাল তরঙ্গ,-ঢেউয়ের পর ঢেউ,-আঘাতের পর আঘাতে চুরমার করে দিতে চায় নৌকাখানি৷ কিন্তু কালীচরণের সবল হাতের কৌশলী চালনা এড়িয়ে চলেছে এই বিপর্যয়৷ নৌকা ডুবে ডুবেও ডুবে না৷ আবার ওঠে ভেসে৷ আর মাঝিমাল্লা দাঁতে দাঁত চেপে ভ্রূকুঞ্চিত করে-আবার ওঠে হেসে৷

জোরেই চলছিল নৌকাখানা কিন্তু পুলিশ ঘাঁটির আড়াআড়ি যেই এসেছে অমনি একজন সিপাই চিৎকার করে উঠল, ‘এ-এ-নাইয়া! রোকো নাও’-

বেপরোয়া কালীচরণ চাপা গলায় বলে ‘হুঁ! ইসে-চালা জোরে৷’

এইবার পুলিশ লঞ্চ দিল ছেড়ে৷ দু-তিনজন সেপাই হেঁকে বলে, ‘রোকো-রোকো!’

কালীচরণ এইবারে নৌকা দিল থামিয়ে৷ পুলিশের আদেশমতো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল তীরের দিকে৷

ইতিমধ্যে লঞ্চখানি নৌকার কাছে এসেছে৷ একজন সেপাই এগিয়ে এসে বলল, ‘এ শারোয়া! কানমে বাত নেহি যাতা?’

লঞ্চের সাথে নৌকাখানিও তীরে ভিড়ল৷ একজন অফিসার হুকুম জানালেন, ‘উতারো’-উতারো৷’

সঙ্গীদ্বয়সহ কালীচরণ নেমে পড়ে নৌকা থেকে৷ তল্লাসি সুরু হল৷ কিছুই আপত্তিজনক পাওয়া গেল না নৌকায়৷ অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাঝি কে?’

কালীচরণ এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে সেলাম ঠুকে বললে, ‘আমি খরতা৷’

-‘কেন অত জোরে নৌকা চালিয়েছিলে?’ প্রশ্ন করেন অফিসার৷

একগাল হেসে কালীচরণ জবাব দেয়ে, ‘হ করতা! ইসে জাহাজের লগে বাইজ ধরছিলাম৷’

-‘থামাওনি কেন-ডাক শুনেও?’

ধমকের চোটে চমকে ওঠে কালীচরণ৷ মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, ‘হুনিনি হুজুর৷’

-‘হুননি? এইবার হুনিয়ে দিচ্ছি!’-রহস্য করে বলেন অফিসার৷ সঙ্গেসঙ্গেই চোখমুখ খিঁচিয়ে বলেন, ‘শালা ডাকাত! দেখাচ্ছি মজাটা৷ এই! লে চল থানামে৷’

-‘মাফ করো হুজুর! এই হামি কানমলা খাই! আর করুম না এমন কাজ৷ হুজুর! মা বাপ! আমার পোলাপান না খাইয়া মোরবো৷ তাগো দ্যাখনের কেউ নাই৷ আমি হাপনার দুক্ষ্যানি ছরণ ধোরত্যাছি, আমাগো ছাইড়া দ্যান-ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল কালীচরণ৷ সাথেসাথেই বীরা আর সোৎস্যা চোখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে৷ এই দেখো একটি বুড়ো সিপাইয়ের মনে দয়া হল, বেচারার বাল বাচ্চা ছিল৷ সে এগিয়ে এসে জমাদারবাবুকে বললে, ‘এ বাবু সাহেব! ছোড়িয়ে-ছোড়িয়ে৷ ই লোগ একদম গঁওয়ার-বেঅকুফ হ্যয়৷’

সাথি সহ কালীচরণ ছাড়া পেল৷ ভক্তিভরে মাটিতে পেন্নাম ঠুকে ফিরে গেল তারা নৌকায়৷ এরই তিন-চার দিন পরে৷ বড়ো ঘাসি নৌকাখানা সাভার বন্দরের ঘাটে ভিড়িয়ে কালীচরণ রান্না চাপিয়েছে৷ বীরা ও সোৎস্যা গেছে বন্দরে তেল নুন কিনতে৷ কিন্তু কয়েকদিন আগেই কাছে ভিতে একটা ডাকাতি হয়েছে৷ অচেনা মাঝি দেখলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে থানায়৷ ভাত চাপিয়ে কালীচরণ একমনে সুতো পাক দিচ্ছে উরুর কাপড় তুলে৷ এমন সময় দু-জন সেপাই এসে তাকে ধরে থানায় নিয়ে গেল৷ কালীচরণ থানায় গিয়ে দারোগার সামনের মাটিতে ভক্তিভরে প্রণাম করল৷ দারোগাবাবু বারবার বক্রদৃষ্টিতে চেয়ে তাকে দেখলেন৷ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম?’

-‘আইগ্যা-খালীচরণ’-মাঝি জবাব দিল৷

-‘বাপের নাম?’

-‘আইগ্যা-শম্ভু৷’

-‘তোমার বয়স কত?’-দারোগাবাবু প্রশ্ন করেন৷

কালীচরণ একটু ভেবে নিয়ে চিন্তিত ভাবে বললে, ‘ইসে বয়সের কথা কন? বয়স ঢের হইছে৷ এই বারো-চৌদ্দ হইতে পারে৷’

থানা সমেত সকলে একযোগে হেসে উঠল৷ অপ্রতিভ হয়ে কালীচরণ কী যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগল৷ হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হুজুর! বারো-চোদ্দই হইব৷ হেবার গাঁয়ে যখন খুব বাঘের ভয় হইছিল-হেই যে আমাগো লাপসি গাপসি ছাগলডা লইয়া গ্যাল গিয়া, হেই বারেই তো আমি তামাক খাওন শিখছিলাম৷’

আবার একচোট হাসির ধুম পড়ে গেল থানায়৷ কালীচরণ বেকুবের মতো খানিকটা এধারে-ওধারে চেয়ে নিল৷ তারপর দাঁত দু-পাটি বের করে মিনতির সুরে বলল, ‘হুজুর! অ্যাড্ডা খতা খই৷ কোলক্যা নাই এখানে? গলাডা শুকাইয়যা কাড হইয়া গ্যাছে গিয়া, প্যাডডা যেনি ফুল্ল্যা উঠছে’-

দারোগাবাবু এবারে নিঃসন্দেহে বুঝলেন কালীচরণ নিতান্তই বোকা মাঝি! সুতরাং ছেড়ে দিলেন তাকে৷

নদীর পাশে পাশে গ্রামে আরও কয়েকটা ডাকাতি হওয়ায় কলকাতা থেকে একদল গোয়েন্দা এসেছে তদন্তে৷ একদিন তিনজন সি. আই. ডি. অফিসার নারায়ণগঞ্জ ঘাটে যে নৌকাখানি ভাড়া করল তার মাঝি হচ্ছে কালীচরণ৷ তাদের একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘এই মাঝি! সাত-আট দিন আগেই ঘাট থেকে পনেরো-কুড়িজন ভদ্দরলোকের ছেলে রাতে কোনো নৌকাভাড়া নিয়েছিল?’

‘খি খন খরতা?’-উলটে প্রশ্ন করে কালীচরণ৷

-‘একদল লোক গেছে এই ঘাট থেকে সাত-আট দিন আগে?’ কালীচরণ কী যেন মনে মনে ভাবে৷ তারপর জবাব দেয়, ‘হ-হ-খরতা! গেছিল একদল লুক৷ বিয়ার দল৷ তাগো লগে কী সুন্দর বউ আছিল!’ সঙ্গেসঙ্গেই গুণ গুণ করে গান জুড়ে দিল, ‘খুছবরণ কন্যারে হে,-ম্যাঘ বরণ ছু-উ-ল-‘

বাবুরা সব হেসে উঠলেন৷ ইনস্পেক্টরবাবু বললেন, ‘কন্যার কথাতেই মাঝির মন তেতে উঠেছে৷ ও হে মাঝি! কী নাম তোমার?’

-‘আঁইগ্যা-খালীছরণ৷’

-‘খালীচরণ? আচ্ছা! তাই সই৷ বাবা খালীছরণ৷ তোমার বে হয়েছে বাবা?’

‘বিয়ার কথা খন? কে দিব আমাগো মাইয়া? গরিব লুক, পরের লাউত খাইট্ট্যা খাই,-বিয়া করনের টাহা পামু কই? ছয়-সাত কুড়িতো লাগবই৷’-দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ মনে উত্তর দিল কালীচরণ৷

-‘কী লোক তোমরা?’-প্রশ্ন করেন ইনস্পেক্টরবাবু৷

-‘আইগ্যা, নমামি৷’

-‘নমামি? সে আবার কী?’

-‘হ খরতো-নম-আমি’-বুঝিয়ে বলে কালীচরণ৷

-‘আচ্ছা, কালীচরণ! এক বেটা পাঞ্জাবিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছ এধারে? সেটা ডাকাত দলের সর্দার৷ যদি তাকে ধরে দিতে পার এত টাকা পুরস্কার পাবে সরকার থেকে, যে শুধু বিয়ে নয়,-বউ নিয়ে চিরকাল সুখে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারবে৷’

-‘হাচা কন বাবু?’-আহ্লাদে বিকশিত-দন্ত কালীচরণ জিজ্ঞাসা করে৷

‘নিশ্চয় পাবে’-জোরের সাথে জবাব দেন ইনস্পেক্টরবাবু৷

সোৎসুকে কালীচরণ জিজ্ঞাসা করে, ‘কইতে পারেন হে হালার চেহারাডা কীরকম-?’

-‘ইয়া লম্বা ভীষণ কালো, মাথায় পাগড়ি, লম্বা দাড়ি৷ বেটা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সবই চলনসই বলতে পারে,’-বাবু জবাব দেন৷

রথের মেলার শোলার মোল্লার মতো মাথাটা বারকতক আলোড়ন করে, দাঁতে দাঁত চেপে মাঝি বলে, ‘হাচা খই বাবু! হালার পোরে পাইলে দ্যাখাইয়া দিমু কেমন ‘নমামি’৷’

ইনস্পেক্টরবাবু উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘যদি পার, তবে দেশের জনে জনে বলবে, ধন্য তুমি নমামি৷’

দলের একখানি জরুরি চিঠি নিয়ে বিমান গেল গড়পাড়া গ্রামে৷ সেখানকার মাইনর স্কুলে হেডমাস্টার শশীবাবুকে চিঠিখানা দিতে হবে৷ তিনি স্কুলের সেক্রেটারিবাবুর বাসায় থাকেন৷ সুতরাং খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হল না৷ শশীবাবুর গায়ের রং কালো, কিন্তু সৌম্যমূর্তি৷ সুগঠিত মুখমণ্ডলের দীর্ঘ দাড়ি এনে দিয়েছে বয়সোচিত গাম্ভীর্য ও প্রশান্তি৷ চিঠিখানা বিমানের হাত থেকে নিয়েই তিনি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন-

-‘আসতে কষ্ট হয়নি তো?’

-‘না-কষ্ট আর কি!’ ঈষৎ হেসে, জবাব দেয় বিমান৷

-‘নাম-কোথা থেকে আসছ কেউ জিজ্ঞেস করেনি?’

-‘কই না৷ করলে বলে দেব যা-তা৷’

-‘বেশ’-বলেই চুপ করলেন শশীবাবু৷ তার পর বিমানের সামনেই খামখানি ছিঁড়ে চিঠি বের করলেন৷ তক্তপোশের উপর চিঠিখানি রেখে একখানি কাগজ আর একটি পেনসিল নিয়ে আড়াআড়ি ভাবে কতকগুলি দাগ টেনে গেলেন৷ বিমান চিঠিখানার দিকে চেয়ে দেখে কই কিছু তো লেখা নেই-একেবারে সাদা কাগজ৷ দাগটানা হয়ে গেলে শশীবাবু কাগজখানিতে অতি সাবধানে আগুন ধরিয়ে দিলেন সেটা পুড়িয়ে৷ এইবার পোড়া কাগজের উপর ভেসে উঠল হরপ৷ কিন্তু একি! এযে অঙ্ক-ইংরেজিতে লেখা আছে-

Simplify—3\5×7\9×8\4×2\7 ইত্যাদি৷

শশীবাবু সবটা টুকে নিলেন কাগজে৷ তারপর কাগজের ছককাটা ঘরগুলির মধ্যে বসিয়ে গেলেন A, B, C, D ইত্যাদি এলোমেলো ভাবে৷ এবার নীচে লিখে গেলেন চিঠির মর্ম৷ ‘Take care—Police on Track—Shift Namami’ বিমান আর কিছু দেখতে পেল না৷ শশীবাবু আর একটা তক্তপোশ দেখিয়ে বললেন, ‘বড্ড পরিশ্রম হয়েছে তোমার! ওইখানে একটু গড়িয়ে নাও৷’

বিমান বুঝল তার সামনে চিঠির মর্ম উদ্ধার করা শশীবাবুর ইচ্ছে নয়৷ সরে গেল সে৷ খানিকবাদে শশীবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তোমার৷ অনেকখানি পথ হেঁটেছ৷ তা যে লক্ষ্মীছাড়ার দলে ভিড়েছ তাতে সবদিন যে খেতেই পাবে তার কোনো ঠিক নেই৷ যাক, আজ আছে কিছু সম্বল, খেয়ে নাও৷ ভাত হতে অনেক দেরি৷’

একটা ঝুড়ির ভেতর থেকে তিনি বের করলেন পোয়াটেক চিড়ে৷ বললেন, ‘চিনি, গুড় কিছুই নেই-তবে এ ফতুল্লার চিড়ে, মিষ্টি লাগে না৷’-বলেই তিনি পথ দেখালেন একমুঠো চিড়ে মুখে পুরে৷ বিমান মহামুশকিলে পড়ে গেল৷ বাড়িঘরে থাকে সে৷ আহারে এরূপ কৃচ্ছ্রসাধন তার অভ্যাস নেই৷ শুধু চিড়ে পরম সন্তোষ সহকারে খেয়ে যাচ্ছেন একটা স্কুলের হেডমাস্টার,-সেই-বা না খেয়ে করে কি! সুতরাং একমুঠ চিড়ে মুখে পুরে দাঁতের কসরত জুড়ে দিল সে৷ খেতে খেতেই শশীবাবু বললেন-‘তুমি কে জান তো?’

বিমান বুঝতে না পেরে চেয়ে রইল শশীবাবুর মুখের দিকে৷ চিড়ে চিবানো থেমে গেল৷

শান্ত কন্ঠে শশীবাবু বললেন-‘তুমি আমার ভাগনে-নাম অবনী৷ আসছ ইদিলপুর থেকে মার অসুখের খবর নিয়ে,-আমাকে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু-তোমার পৈতে আছে তো? আমরা যে বামুন৷’

বিমান এবার সব বুঝতে পেরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল৷ তার মনে খুব আনন্দও হল৷ এই গোপনতা,-এইরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া দেশের কাজে,-নাম নাই,-পরিচয় নাই,-আছে শুধু তন্ময়তা-নীরব সাধনা,-আঁধার-ঘেরা আরাধনা,-একি কম গর্বের!

রাত্রি প্রায় একটার সময় শশীবাবুর সাথে সে রওনা হল ঢাকা অভিমুখে৷ হেঁটে হেঁটে চলছে তারা৷ প্রায় তিন ঘণ্টা চলার পরই-শশীবাবু বললেন, ‘গাডা শিরশির কোরত্যাছে-জ্বরই কি আসে!’

কিছু পরেই প্রবল বেগে এল জ্বর৷ শশীবাবু ঠকঠক করে কাঁপেন, আর পথ চলেন! ভোরের পর যতই বেলা বাড়ে-ততই জ্বর বাড়ে৷ ধুঁকতে ধুঁকতে এক গাছতলায় শুয়ে পড়েন তিনি৷ বিমান মহামুশকিলে পড়ে গেল৷ কী করে সে এখন? হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ কাছে ছিল একটা নালা৷ এক দৌড়ে নালার কাছে গিয়ে-গায়ের জামা খুলে সেটা ভিজিয়ে এনে শশীবাবুর মাথায় নিংড়ে জল দিতে লাগল৷ প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে শশীবাবু চোখ মেলে চাইলেন৷ বললেন, ‘পিপাসা-জল৷’ বিমান আবার ছুটে গেল নালার ধারে৷ জামাটা বেশ করে ভিজিয়ে এনে নিংড়ে জল দিল শশীবাবুর মুখে৷

‘চলো, এখন যাই,’ বলে শশীবাবু উঠে খাড়া হলেন৷ আবার শুরু হল পথ চলা৷ কয়েক মাইল যেয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন৷ বিমান আবার জামা ভিজিয়ে জল এনে তাঁর মাথায় নিংড়ে দেয়,-তাঁর মুখে দিয়ে পিপাসা মেটায়, সংজ্ঞা ফিরে এলে বিমানের দিকে চেয়ে শশীবাবু বললেন, ‘বড়োই মুশকিলে পড়েছ তুমি৷ কী আর কই! আমার শরীরডা এক্কেবারেই অকেজো হইয়া গ্যাছে! আজ আমার কত কাজ, আজ কি জ্বর হওন উচিত!’

বিমান আশ্চর্য হয়ে গেল শশীবাবুর ধরন দেখে৷ জ্বর হয়েছে, সেটাও যেন মস্ত অপরাধ৷ গ্লানিতে আপশোসে তাঁর সমস্ত অন্তরটাই যেন ভরে গেছে৷

গভীর রাতে তারা পৌঁছোল ঢাকায়৷ বিমান নিজের বাসায় চলে গেল৷ যাবার আগে শশীবাবু তার পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ঢের কষ্ট পাইছ আমারে লইয়া৷ এখন যাও গিয়া৷’

পরদিন সন্ধ্যার সময় বিমান একখানি বইয়ের খোঁজে সদরঘাট লাইব্রেরিতে গিয়ে শুনতে পেল প্রায় আধঘণ্টা আগে বুড়িগঙ্গার ধারে একজন সি. আই. ডি. অফিসার খুন হয়েছে৷ আততায়ীকে অনেকই দেখেছে৷ তার নাকি লম্বা দাড়ি আছে৷ তাকে ধরার জন্যে কয়েকজন নাকি এগিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু লোকটি এমনই আশ্চর্য যে কয়েকটা ফাঁকা আওয়াজ করে দাড়ি নাড়তে নাড়তে গম্ভীরসে পাড়ি দিয়েছে৷

এই ঘটনার দুইদিন পরে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে একখানি বেঞ্চে একটি লোক বসে বসে কাশছে৷ শুকনো মুখ, ময়লা পোশাক, রুক্ষ চুল-দাড়ি, চোখে একটা হতাশার ভাব৷ হরদম কেশেই চলেছে সে৷ ইতিমধ্যে একটি আই. বি. স্পাই এসে বেঞ্চের অপর প্রান্তে বসে চেয়ে দেখতো কেশো রোগীটিকে৷ দাড়ির দিকেই তার বিশেষ মনোযোগ৷ খানিকটা ইতস্তত করে সে দাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম কী?’

লোকটি তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে৷ একটু দম নিয়ে বললে সে নাম, ‘ব্র-জ-‘

পরবর্তী অংশটুকু ঢেকে দিল কাশিতে৷

স্পাইটি প্রশ্ন করল, ‘অসুখ নাকি?’

লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, ‘হ্যাঁ৷’ তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বললে, ‘থাইসিস বলে সকলে সন্দেহ করে৷’

এবারে স্পাইটি উঠে দাঁড়াল৷ সহানুভূতির সুরে বললে, ‘বড়ো পাজি জিনিস! ভীষণ ছোঁয়াচে৷ খবরদার যেন বে থা করবে না৷’

আবার ফাঁৎ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দাড়িওয়ালা৷ থমথমে ভারী গলায় সে বললে-‘আমার দুই বিয়ে৷ এখন ভরসা’-আকাশের দিকে তর্জনী নির্দেশ করল সে৷

স্পাই প্রভু দৃষ্টিপথের বাহিরে গেলে জলের ধারে বসা একটি যুবকের কাছে উঠে গেল লোকটি৷ যুবকটি একখানা চিঠি দিল তার হাতে৷ খুলে পড়ে দাড়িওয়ালা বললে, ‘শশাঙ্কবাবুকে বোলো আজ রাতেই পূর্ববঙ্গে চলে যাব৷ তিনি যেন চন্দননগরে যেয়ে পুব আর পশ্চিমের বিষয় সব ঠিক করে আসেন৷’

যুবকটি প্রশ্ন করল, ‘আপনার নাম কী বলব?’

একটু ভেবে নিয়ে দাড়িওয়ালা উত্তর দিল, ‘শশীবাবু৷’

দু-জনে দু-দিকে চলে গেল৷

সপ্তাহ দুই পরে৷

নারায়ণগঞ্জে বিরাট আলোড়ন৷ শহরে জোর গুজব ঢাকায় ডাকাত দলের নেতা ধরা পড়েছে৷ প্রকাণ্ড তার দাড়ি৷ এই দাড়িওয়ালাই পাঞ্জাবি সেজে ডাকাতি করত৷ সদরঘাটের খুনও করেছে সে৷ তার কাছে নাকি একটা ‘হুইসেল’ পাওয়া গেছে৷ শহর ভেঙে লোক ছুটছে কোর্টের দিকে৷ আজ তাকে নারায়ণগঞ্জে কাছারিতে হাজির করা হবে৷ ‘পাঞ্জাবি ডাকাত’, ‘সদরঘাটের খুন’ প্রভৃতি গুজবের বিমানের মনেও জেগেছে কৌতূহল৷ সেও গিয়েছে কোর্টে৷ গিয়ে দেখে আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ আর সি. আই. ডি. গিজগিজ করছে৷ ঠিক এগারোটার সময় হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ দস্যু সর্দারকে কাছারিতে নিয়ে এল৷ ভিড়-করা জনতা, পুলিশ ডাকাতটিকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে কাঠগড়ার দিকে৷ কিন্তু তাকে দেখেই বিমান বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে গেল৷ একী? এ যে শশীবাবু!

বিমানের পাশেই দু-জন সি. আই. ডি. অফিসার আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে৷ একজন বলছে, ‘খুব ধরা পড়ে গেছে যাহোক৷ খবরটা না পেলে এর গায়ে কিন্তু হাতও দিতাম না আমরা৷ খুব বাহাদুর বটে! অপর একজন বলল, ‘বাহাদুর বলে বাহাদুর! এই তো কয়েকদিন আগে ইডেন গার্ডেনে কী ফাঁকিটাই দিয়েছে আমাকে৷ খকখক কাশি৷ বলে কিনা থাইসিস, তারপর আবার ডবল বিয়ে৷ ফলে আমাকে বোকা বানিয়ে ভেগে এসেছে৷ দাড়িটা দেখে আমার মন উশখুশ করছিল৷ কিন্তু থাইসিস আমাকে ফাঁকি দিল৷ পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার হাত ছাড়া হয়ে গেল৷’

প্রথমজন আবার বললে, ‘কিন্তু যাই বল ভাই, এরা মানুষ না দেবতা ভেবেই পাইনে৷ এত বড়ো একটা লোক, আদর্শ চরিত্র বলে বিপ্লবীরা যাকে শ্রদ্ধা করে অন্তর দিয়ে,-সেই ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী কিনা নৌকাচুরি করে জেল খেটেছে৷ বাইরে এসে মাঝি সেজে ঝড়-বাদল, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে মাসের পর মাস কাটিয়েছে নদীর বুকে৷ পাঞ্জাবি সেজে করেছে ডাকাত দলের নেতৃত্ব৷ কিছুদিন আগেই ঢাকায় সাফাই হাতে বিকেল বেলা খুন করেছে, আমাদেরও দিয়েছে ফাঁকি, নাম বলেছে ‘খালীছরণ’, জাত বলেছে ‘নমামি’-

বিমানের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল৷ অপার বিস্ময় তার মনে৷ দৃষ্টি তার ঝাপসা হয়ে এল, কানে পৌঁছোয় না কোনো কথা মনের মধ্যে লণ্ডভণ্ড এলোমেলো ভাব৷ কিছু পরে সে যেন সংবিত ফিরে পেল আদালতের পিয়নের হাঁক-ডাকে৷ অদ্ভুত ব্যাপার! মাঝি কালীচরণ নিরক্ষর গেঁয়ো লোক-যে নিজের নামটাও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না,-যাকে সে স্পাই বলে ঠাউরেছে সেই কি না ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী, যাঁর নাম শুনেছে সে অজস্রবার, যাঁর দেবোপম চরিত্র, নির্বাক-নিষ্ঠা যুবকের দলে জোগায় পথের প্রেরণা! তিনিই আবার পাঞ্জাবি সেজে অ্যাকশন পরিচালনা করেছেন; তালতলার ডাকাতিতে তো বিমানের হাতই চেপে ধরেছিলেন৷ কিন্তু নৌকায় ফিরে কালীচরণ মাঝিকে তো যথাস্থানেই দেখেছে বিমান৷ তারপর সদর ঘাটের খুন! এ যে অসম্ভব ব্যাপার! অসুস্থ শশীবাবুকে গড়পাড়া থেকে সেই তো ঢাকায় নিয়ে এসেছে৷ শশীবাবুই কি কালীচরণ? তিনিই কি পাঞ্জাবি নেতা? কোনো মীমাংসার খুঁজে পেল না তার মন৷ কাঠগড়ায় আসামির দিকে বার বার চেয়ে দেখল সে৷ মনে হল তার, সব মিথ্যে অথবা ভোজবাজি৷ এ যে শশীবাবু-গড়পাড়া স্কুলের হেডমাস্টার শশীবাবু৷ ওই তো বিমানের দিকে আড় চোখে চেয়ে চেয়ে হাসছেন তিনি,-ইঙ্গিতে বলছেন, চলে যাও৷ চলে যাও৷ এই শশীবাবু কি নিরক্ষর মাঝি কালীচরণ, পণ্ডিত আর মুর্খের যুগপৎ প্রকাশ? তিনিই আবার অ্যাকশানের অধিনায়ক এবং হত্যাকারী? শান্ত শশীবাবুই ভয়াল দস্যু-নির্মম হত্যাকারী?

বিমানের চিন্তা খেই হারাল৷ হাটের কোলাহল থমকে দাঁড়াল চৌরাস্তায় এসে৷ দিশেহারা অভিভূতের মতো যখন সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল কাছারি ঘর থেকে তখন তার মুহ্যমান সমগ্র চেতনা জুড়ে ওতপ্রোতভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে একটি মাত্র ধ্বনি-নমামি-নমামি-নমামি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *