3 of 3

নভেম্বর, ১৯৭১

৩ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭১

আজ সারাদিন কারেন্ট নেই। কোথায় যে কি হয়েছে এখনো কোন খবর কারো কাছে পাই নি। লুলুটা খবর আনার ব্যাপারে খুব করিতকর্মা। তাকে আমরা সব সময় গেজেট বলে ডাকি, তারও আজ পাত্তা নেই।

৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১

দিনগুলো কেমন যেন নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ হয়ে কাটছে। বেশি কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না। ফোনে মিনির সঙ্গে কথা বলি, রেজিয়ার সঙ্গে বলি, ডলির সঙ্গে কথা বলি। খালেদ মোশাররফের খবরে সবাই মর্মাহত। মিনির কাছে জেনেছি, খালেদের মৃত্যুসংবাদ শশানামাত্র ঢাকায় গেরিলাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। প্রত্যেকটি গ্রুপ থেকেই দুজন করে গেরিলা মেলাঘরে ছুটে গেছে খবরাখবর জানবার জন্য। আশা করা যাচ্ছে, দুএকদিনের মধ্যেই আমরা বিস্তারিত খবর জানতে পারব।

খালেদের মৃত্যু সংবাদে গেরিলাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেলেও কেউ মনোবল হারায় নি, তা বোঝা যাচ্ছে তাদের প্রতিদিনের অ্যাকশানে। বরং বলা যায়, তারা যেন খালেদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য আরো রুখে, আরো মরিয়া হয়ে, একটার পর একটা অ্যাকশান করে চলেছে।

জোনাকি সিনেমা হলের পাশে যে পলওয়েল মার্কেট আছে, গতকাল সেখানে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কে বিচ্ছুরা টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। এগারোটার সময় প্রকাশ্য দিবালোকেই একই দিনে মৌচাক মার্কেটে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে তিন-চারজন বিচ্ছু ঢুকে সাত হাজার টাকা নিয়ে যায়। ওটাও ওই এগারোটা-সাড়ে এগারোটার দিকেই প্রকাশ্য দিবালোকে।

খবর কাগজেই বেরিয়েছে এসব ব্যাঙ্ক লুটের কাহিনী। খবর কাগজে আরো বেরিয়েছে : ১ নভেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচনী কমিশন অফিসে বোমা বিস্ফোরণে একজন নিহত, দুজন আহত, দুটো ঘর বিধ্বস্ত, ছাদ ধসেছে, বোমার আগুনে কাগজপত্র পুড়ে ছাই। ২ নভেম্বর সন্ধ্যায় কাকরাইল পেট্রল পাম্পের ওপর গ্রেডেন ছোড়া হয়েছে। রাত আটটায় আজিমপুরে আর্মি রিক্রুটিং কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে।

আজ বিকেলে পাগলাপীরের আস্তানায় সাপ্তাহিক মিলাদ। কিন্তু যাবার ইচ্ছে নেই। আমার। ঠিক করেছি মিষ্টিসহ জামীকে পাঠিয়ে দেব। জামীর খুব আপত্তি নেই। কারণ শিমুলদের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে গেছে। এমনিতেই এক পায়ে খাড়া থাকে ও বাড়িতে যাবার জন্য।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলার পর খুব ঝরঝরে লাগল। কারণ এখন আর কোন তাড়াহুড়ো নেই আমার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা বাজে।

বেশ আয়েস করে এককাপ চা নিয়ে বসেছি, হঠাৎদরজায় বেল। জামী খুলে দিতেই হাসিমুখে ঘরে ঢুকে মিনি। ঢুকেই কল্ক করে বলে উঠল, চাচী সুখবর। খালেদ মোশাররফ মারা যায় নি। যুদ্ধে সাংঘাতিক জখম হয়েছে। কিন্তু বেঁচে আছে।

খালেদ মোশাররফ বেঁচে আছে!

খোদা! তুমি অপার করুণাময়।

আমি মিনিকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসিয়ে বললাম, কার কাছে শুনলে? সব খুলে বল।

মিনি বলল।

ঢাকা থেকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা মেলাঘরে ছুটে গিয়েছিল, তাদের দুএকজন ফিরে এসেছে। তাদের কাছ থেকে মিনি শুনেছে : যুদ্ধ করার সময় শত্রুপক্ষের শেলের একটা ম্প্রিন্টার খালেদের কপালে লেগেছে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে লক্ষ্মৌয়ে। এর বেশিকিছু মনি শোনে নি। শুনুক খালেদ মোশাররফ বেঁচে আছে, এই খবরটাই আমাদের কাছে অনেকখানি।

মিনিদের বাড়িটাই গেরিলাদের একটা আস্তানা। ওরাচাচাতো, খালাতো, পাড়াতুতো ভাইরা মুক্তিযোদ্ধা, তারা এবং তাদের সুবাদে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আসে ওদের বাড়িতে। সৌভাগ্যবশত ওদের বাড়িতে পাক আর্মির হামলা হয় নি, তাই গেরিলারা এখনো নিঃশঙ্কচিত্তে আসতে পারে ওদের বাড়িতে। জিগ্যেস করলাম, ডি.আই.টি. বিল্ডিংয়ে কারা ব্লাস্ট করেছে, জানো?

মিনির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, কথায় কথায় ঝরঝর করে হাসা। হেসে বলল, ওমা চাচী–ওতো আমাদের জন আর ফেরদৌস।

বল কি? ওই স্কুলের ছেলে দুটো? ওইরকম কড়া সিকিউরিটি কাটিয়ে? কি করে করল?

ওদের কথা আর বলবেন না। ওরা যা বিচ্ছু। অনেকদিন থেকে ওরা পাঁয়তারা কষছিল কি করে ডি.আই.টি, বিল্ডিংয়ের ভেতরে ব্লাষ্ট করা যায়। ডি.আই.টিতে কাজ করে এক ভদ্রলোক, নাম মাহবুব আলী, সে আবার টিভিতে নাটকে অভিনয়ও করে–ঐ যে সুজা খোন্দকারের সঙ্গে মাঝে-মাঝে গুরু-শিষ্য বলে একটা হাসির প্রোগ্রাম করে–ঐ মাহবুব। সে জন আর ফেরদৌসকে খুব সাহায্য করেছে। ওদেরকে ভেতরে ঢোকার পাস যোগাড় করে দিয়েছে। নিজের পায়ে নকল ব্যান্ডেজ লাগিয়ে তার ভেতর পি.কে. নিয়ে গেছে ডি.আই.টির সাততলায়। সাততলায় ঐরুমটাতে মেলাই পুরনো, ফাইল গাদি করে রাখা হত। ঐসব ফাইলের গাদির ভেতর ঐ পি.কে. লুকিয়ে রাখত।

মাহবুব আলীর খুব সাহস তো?

সাহস বলে সাহস? তাও একদিন তো নয় বারোদিন ধরে রোজ একটু একটু করে পি. কে. পায়ে বেঁধে নিয়ে গেছে। দিনে এক পাউন্ডের বেশি নেয়া যেত না, তাহলে ব্যান্ডেজ বেশি মোটা হয়ে গেলে পাক আর্মির সন্দেহ হবে। জন-ফেরদৌসের প্ল্যান ছিল আরো বড়। ডি.আই.টি, টাওয়ারের ওপর যে টি.ভি অ্যান্টেনা টাওয়ার আছে, ওটা ব্লাস্ট করা। এর জন্য দরকার ছিল মোল পাউন্ড পি. কে, ভেতরে নেবার। কিন্তু বারো পাউন্ড নেবার পর হঠাৎ ওরা শুনল সাততলায় ঐ ঘরের ফাইলপত্র সরিয়ে ঘরটা গোছানো হবে। অমনি ওরা ভয় পেয়ে গেল। ফাইলের পেছনে লুকানো পি. কে, একবার ধরা পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। ডি.আই.টি. বিল্ডিংয়ের তাবৎ বাঙালির জান তো যাবেই, ভবিষ্যতে আর কোনদিনও ডি.আই.টির ধারে কাছে যাওয়া যাবে না। তাই জন, ফেরদৌস আগেই অপারেশন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। একটু অন্যরকম হবে। তা কি আর করা। তবু ওদের ব্লাস্ট করা চাই-ই। কারণ দুনিয়াকে ওরা দেখাতে চায় পাক আর্মির সিকিউরিটি দুর্ভেদ্য নয়; পাক আর্মির অত্যাচারের চাপে হাঁসফাঁস করেও বাঙালিরা একেবারে মরে যায় নি। ওরা মাহবুব আলীর ব্যান্ডেজের মধ্যে ছয় ফুট সেফটি ফিউজ দিয়ে দিল; আর একটা ফাউন্টেন পেনের ভেতরটা খালি করে তার মধ্যে একটা ডিটোনেটার ভরে দিল। মাহবুব আলী এগুলো ভেতরে নেবার সময় প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিন পুলিশ শুধু সার্ট-প্যান্টের পকেট চেক করে। সেদিনের পুলিশটা হঠাৎ কি মনে করে মাহবুবের কোমর, উরু-হাঁটু এগুলোও চেক করা শুরু করল। মাহবুবের তখন যা অবস্থা! পুলিশটা আর এক ইঞ্চি নিচে হাত দিলেই ওর পায়ের ব্যান্ডেজ বুঝে ফেলত। কিন্তু মাহবুবের কপাল ভালো–পুলিশটা ঐ পর্যন্ত দেখেই ক্ষান্ত হয়েছিল। মাহবুব, জন আর ফেরদৌসকে অডিশান দেবার দুটো পাস যোগাড় করে দিয়েছিল। ওরা সেই পাস নিয়ে ডি.আই.টি. বিল্ডিংয়ে ঢুকে অপারেশন করে বেরিয়ে আসে।

আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, উঃ, বলতে কি সহজ। কিন্তু ওরা যখন কাজটা করেছিল, তখন মোটেই সহজ ছিল না।

তাতো ছিলইনা। ঘাপলাও কি কম হয়েছিল চাচী? এখন তো প্রত্যেক তলায়-তলায় সিঁড়ির মুখে চেকপোস্ট; ছয়তলা পর্যন্ত চেকপোস্টের পুলিশ ওদের ছেড়ে দিল। সাততলায় যাবার সিঁড়ির পুলিশটা বোধ হয় একটু বেয়াড়া ছিল। সে তো জেরা করা শুরু করল কেন যাবে? কার কাছে যাবে? কি কাজ? জন আর ফেরদৌস তো কম বিচ্ছু নয়। ওরা খুব উঁটে বলল, আরে, আমরা সরকারি অফিসের লোক। সরকারের জরুরি কাজে ওপরে যাচ্ছি। তুমি আমাদের আটকালে সরকারের কাজেই ক্ষতি হবে। আমাদের কি? আমাদের পাঠানো হয়েছে, বুড়িগঙ্গার পানি কতটুকু বেড়েছে, তা টাওয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করার জন্য। দেখছ না, কদিন থেকে কি বৃষ্টি? এ বছর এত বৃষ্টির জন্যেই তো দেশে এত বন্যা, এত ঝুট-ঝামেলা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখ না ঐ যে মাঠঘাট কেমন পানিতে ডুবে গেছে। ওদের লম্বা বক্তৃতার ফাঁকে ওদের পেছনে আরো লোক এসে জমা হয়েছে ওপরে যাবার জন্য, তাদেরকেও চেক করতে হবে। পুলিশটা তো ওয়েস্ট পাকিস্তানি জানেন তো ওরা কি রকম বুদ্ধ হয়–জনের কথার তোড়ে দিশেহারা হয়ে বলে আচ্ছা, আচ্ছা যাও।

মিনি হাসতে হাসতে কথা বলছিল, এখন হাসি এত বেড়ে গেল যে কথা থামাতে হলো। আমি আর জামীও খুব হাসলাম। সত্যি বলতে কি, খালেদের মিথ্যে মরার খবর শোনার পর এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসলাম। একটু পরে হাসি থামিয়ে বললাম, তারপর?

তারপর আর কি? ওরা সাততলায় সেই ঘরে গিয়ে যা যা করা দরকার–সব পি. কে. একত্রে টাল করা, ফিউজওয়ার লাগানো, ডিটোনেটার ফিট করা–সব দুজনে মিলে করে, ফিউওয়ারের মুখে আগুন ধরিয়ে এল। ফিউজওয়ার পুড়ে ব্লাস্ট হতে তিন মিনিট লাগবে, এই সময়ের মধ্যে ওদেরকে ডি.আই.টি. বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে বেরোতে না পারলে ওরা আটকা পড়ে যাবে। কারণ ব্লাস্ট হওয়া মাত্রই তো আর্মি পুরো বিল্ডিং ঘিরে ফেলবে, কাউকে বেরোতে দেবে না। তিন মিনিটে সাততলা থেকে নেমে রাস্তায় বেরোনো কি চাট্টিখানি কথা চাচী? দৌড়োতেও পারে না, পুলিশ দেখে ফেললে সন্দেহ করবে। আবার হেঁটে গেলেও সারতে পারবে না। তাই যেখানে কেউ নেই, সেখানে ওরা দৌড় দেয়, আবার পুলিশ দেখলে ভালো মানুষের মতো মুখ করে হাঁটে। ওদের কপাল ভালো, ব্লাস্ট হবার আগের মুহূর্তে ওরা বেরিয়ে যেতে পেরেছিল।

আমি আবারো নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বড়ো বেপরোয়া ওরা। আল্লা বাঁচিয়েছেন। ওদের। বাঘের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

মিনি বলল, চাচী, কাল আমাদের ওদিকে সারাদিন কারেন্ট ছিল না। আপনাদের। এ দিকে?

এদিকেও ছিল না। ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। চৌদ্দ ঘন্টা। জানো কালকেই প্রথম টিউবওয়েলটা ব্যবহার করতে পারলাম। ওটা বসানোর পর একদিনও কারেন্ট যায় নি। বড়ো দুঃখ ছিল মনে–পয়সাগুলো গচ্চা গেল।

মিনি আবার হেসে কুটিকুটি হলো, কাল কিছুটা উসুল হলো তাহলে?

তা হলো। কিন্তু কারা কোথায় কি করল, তা তো জানতে পারলাম না।

জামী খাবার টেবিলে বসে খবর কাগজগুলো ওল্টাচ্ছিল, সে বলল, কেন? কাগজে বেরিয়েছে, দেখ নি?

তাই নাকি? কি লিখেছে? জামী পড়ল, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসে বোমা বিস্ফোরণ।

গতকাল বুধবার ভোরে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসে পরপর তিনটি বোমা বিস্ফোরণের ফলে পাওয়ার হাউসের বিশেষ ক্ষতি হয় এবং চারটি জেনারেটরই বিকল হয়ে পড়ে। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও শহরতলি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। শুনতে শুনতে আমি উদাস হয়ে গেলাম। রুমীরা এই সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ওড়াবার প্ল্যান নিয়ে মেলাঘর থেকে ঢাকা এসেছিল। তারা তা করবার আগেই গ্রেপ্তার হয়ে গেল। রুমী, বদি, জুয়েল চিরতরে হারিয়ে গেল। কিন্তু রুমীদের আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত করার জন্য আরো অনেক রুমী, অনেক বদি, অনেক জুয়েল সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

৭ নভেম্বর, রবিবার ১৯৭১

আজ ডলির বাসায় দেখা হলো নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। ওর কাছে শুনলাম খালেদ মোশাররফ সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত খবর।

খালেদের মৃত্যুর খবর ওদের বেস ক্যাম্পে এসে পৌঁছায় অক্টোবরের ২৮/২৯ তারিখে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে কারবালার মাতম পড়ে যায় ছেলেদের মধ্যে। এই সব দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা তাদের স্বপ্নের নায়ক বীর নেতার মৃত্যুসংবাদে একেবারে ছেলেমানুষের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন গেরিলা ছেলেকে মেলাঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয় বিস্তারিত খবর আনার জন্য। গতকালই তারা ফিরেছে সব খবরাখবর নিয়ে।

কসবা যুদ্ধ পরিচালনা করার সময় খালেদ মোশাররফ জখম হয়েছে। শেলের। ম্প্রিন্টার খালেদের কপাল ফুটো করে মগজের ওপরদিক ঘেঁষে লেগেছে। অবস্থা খুব গুরুতর তবে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে উঠবে, আশা আছে। লক্ষ্মৌ শহরে যে হাসপাতালে খালেদকে নেয়া হয়েছে, সেটা খুবই উন্নতমানের হাসপাতাল।

খালেদের আহত হবার খবরে মেলাঘরে শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। সবাই ছেলেমানুষের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে। বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ম ভেঙে ক্যাম্প ছেড়ে আগরতলার দিকে ছুটে যায় খালেদের খবর নেবার জন্য। খালেদ মোশাররফ মেলাঘরের ছেলেদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। খালেদ শুধু তাদের সেক্টর কমান্ডার নয়, সে তাদের গার্ডিয়ান এঞ্জেল। তবে এত বড় সর্বনাশের মধ্যেও একটা সান্ত্বনার কথা এই যে, যে কসবার যুদ্ধে খালেদ জখম হয়েছে, সেই কসবা মুক্তিবাহিনী ঠিকই দখল করে নিতে পেরেছে।

কসবার যুদ্ধ? অক্টোবরের ২৪, ২৫, ২৬, ২৭ চারদিনই কাগজে কসবার যুদ্ধ নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে পরপর। খুব ফলাও করেই হয়েছে কিভাবে ভারতীয় চররা কামান, ফিল্ডগান, ভারি মর্টার, অ্যান্টিট্যাঙ্ক গান নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে, কিভাবে পাক আর্মি বহু ভারতীয় চর মেরছে; কিন্তু কোথাও বুঝতে দেয়নি যে মুক্তিবাহিনী তাদের কাছ থেকে কসবা কেড়ে নিয়েছে।

খালেদ মোশাররফ জখম হওয়ার পর এখন হায়দার সেক্টর টুর চার্জে আছে।

ইতোমধ্যে বাছুর বাড়িতেও বিপদের ঝড় বয়ে গেছে। ওর বাবা-মা-ভাইবোনরা ঢাকায় যে বাড়িতে থাকে, সেখানে হঠাৎ অক্টোবরের ২৩ তারিখে পাক আর্মি গিয়ে ওর পাঁচ ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। ওর বাবাকে বলে তোমার যে ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, তাকে এনে দিলে তবে এই পাঁচ ছেলেকে ছেড়ে দেব। বাছুর বাবা বলেন, সে ছেলের কোনো খোঁজই আমি জানি না তাকে কি করে এনে দেব? সামরিক কর্তৃপক্ষের কথামতো বাক্ষুকে উদ্দেশ্য করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। যাই হোক, সামরিক কর্তৃপক্ষ যখন বোঝে যে সত্যিই বাছুর খোঁজ তার বাবা জানে না, তখন তারা পাঁচ ভাইকে ছেড়ে দেয় ৩০ তারিখে।

বাচ্চু বলল, এত বিপদের মধ্যে আমরা কিন্তু মনের বল হারাই নি। এরমধ্যেও আমরা অ্যাকশান করে গেছি। সেপ্টেম্বরের শেষে আমরা যখন আসি তখন খালেদ মোশাররফ আর হায়দার ভাই বলেছিল শিগগিরই প্রবলেম বাঁধতে পারে, তোমরা পারলে কিছু টাকা পয়সা যোগাড় করে পাঠায়ো। গত সপ্তাহে আবারো একটা চিঠি পেলাম হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে। শিগগিরই যেন কিছু টাকা পাঠাই। সেই জন্য আমরা কয়দিন আগে পলওয়েল মার্কেটে একটা ব্যাঙ্ক লুট করে সেই টাকা সেক্টরে পাঠিয়েছি।

পলওয়েল মার্কেটের ব্যাঙ্ক তাহলে তোমরাই—

বাচ্চু হাসল, হ্যাঁ আমরাই।

কিন্তু বুঝতে পারছি না এখান থেকে সেক্টরে টাকা পয়সা পাঠাতে হবে কেন?

ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট সেক্টর টু-তে আর্মস দেওয়া বন্ধ করেছে, টাকা আর রেশনও দিচ্ছে না। তাই। আপনি জানেন না–সেক্টর টুর সঙ্গে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের একটা প্রবলেম প্রথম থেকেই ছিল। সেটা গত দুমাস থেকে বেশি হয়ে উঠেছে। ওরা তো সেক্টর টুকে রেড সেক্টর বলে। ওদের ধারণা এখানে নাকি নকশালদের হেলপ করা হয়। তাছাড়া আমারও একটা ঘটনা আছে। আমি ভাসানী ন্যাপ রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, তাই আমাকে দুতিনবার ইন্ডিয়ান আর্মি ইন্টারোগেশানের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিল, খালেদ মোশাররফ দেয় নি। আমাদের দলের লিডার মানিক, সে ছাত্রলীগ করে, সেও আমাকে কয়েকবার বাঁচিয়েছে। দুজন দুই রাজনীতির সমর্থক কিন্তু দেখুন যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা এক সঙ্গে যুদ্ধ করছি। মানিক লিডার, আমি ডেপুটি লিডার। এখানে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; কারণ এটা আমাদের জাতীয় যুদ্ধ, আমাদের বাঁচামরার ব্যাপার। ওপর দিকে যারা বসে আছে, তারাই খালি ক্ষমতা কি করে দখলে রাখা যায় তার পাঁয়তারা কষছে।

তোমরা ব্যাঙ্ক লুট করলে কিভাবে বল না।

বাচ্চু হেসে ফেলল, সে এক মজার ব্যাপার, সাত-আটদিন আগে হায়দার ভাইয়ের পাঠানো একটা চিঠি পেলাম–ওখানে বেশ একটা মোটা অঙ্কের টাকার দরকার। তখন ঠিক করলাম সাভারে আমাদের বেস ক্যাম্প যেখানে সেখানকার পিস কমিটির মেম্বারদের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করব আর ঢাকার একটা ব্যাঙ্ক লুট করব। জোনাকি সিনেমা হকের পাশের ঐ মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কটা টার্গেট করলাম। অ্যাকশানে গেল আসাদ, মুনীর, ফিরোজ, জন, আরিফ আর ফেরদৌস। আসাদ নিল একটা স্টেনগান, মুনীরের হাতে তার খেলনা রিভলভার। দেখতে একদম আসল রিভলভারের মতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওই খেলনা রিভলভার দিয়েই ওরা পঁচিশ হাজার টাকা তুলে এনেছিল। আরিফ তার বাবার গাড়িটা একটা বাহানা করে নিয়ে এসেছিল। আমরা নওরতন কলোনিতে জলিদের বাসায় বসে গাড়িটার নম্বর-প্লেট বদলালাম। আরিফের বাবা পীর সাহেব তো, তাই তার গাড়িটাও সবাই চেনে।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, পীর সাহেব!

পীর সাহেব কিন্তু ওঁর গাড়িতে আর্মস অ্যামুনিশান লুকোনো থাকে। পীর সাহেব বলেই তো সুবিধে। গাড়ির নম্বরপ্লেট বদলে ওরা তো গেল সকাল এগারোটায়। আরিফ গাড়ি চালাচ্ছিল, জন আগেই গিয়ে রাস্তায় দাড়িয়েছিল। ওরা ব্যাঙ্কের সামনে যেতেই জন অলক্লিয়ার ইশারা দিল। আসাদ, মুনীর আর ফিরোজ নামল। ঢুকেই প্রথমে দারোয়ানকে কাবু করল, তার রাইফেল কেড়ে নিল। ওদিকে বাইরে কিন্তু আর্মির দুটোলরি দাঁড়িয়ে আছে, তারা বুঝতে পারে নি ভেতরে কি হচ্ছে। আসাদ ভেতরে স্টেন তুলে সবাইকে বলল, হ্যান্ডস আপ।মুনীর তার খেলনা পিস্তল উচিয়ে সবাইকে ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে নিয়ে দাঁড় করাল। ম্যানেজারকে যখন বলা হলো, টাকা দেন। উনিও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই যে টাকা নিয়ে যান। আপনার মুক্তিবাহিনী, জানি টাকা আপনাদের দরকার। সবাই খুব কো-অপারেট করল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল, টাকা নেবো কিসে, ওরা তো টাকার বাণ্ডিল এগিয়ে দিলেন, টাকা নেবার মতো কোন ভাণ্ড আমাদের নেই, তখন ফিরোজ তার সার্ট খুলে দিল। তার মধ্যে সব টাকা রেখে মুড়িয়ে ওরা যখন বেরোচ্ছে, তখন দেখা গেল সার্টের হাতার ফাঁক দিয়ে টাকা পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়।

হাসতে হাসতে বিষম খেল বাচ্চু, সে এক মজার ব্যাঙ্ক লুট বটে! পাকিস্তান আর্মি ততক্ষণে টের পেয়ে গেছে।

টের পেয়ে গেছে? টাকা পড়ে যাচ্ছে দেখে?

না। রাস্তার লোকের তালি দেওয়া দেখে। এখন ঢাকার লোকের অভ্যেস হয়ে গেছে, মুক্তিরা কোনো অ্যাকশান করলে তারা তালি দেয়, জয় বাংলা বলে ওঠে। এখন তারা আর আর্মিকে ভয় পায় না। ওই তালি শুনেই আর্মি টের পেয়ে যায়। কিন্তু কিছু করতে পারে নি। আরিফ প্রথম থেকেই গাড়িতে বসেছিল ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে। আসাদ, মুনীররা বেরিয়েই গাড়িতে উঠে ভোঁ দৌড়। আর্মির ওই ভারি লরি ঘুরিয়ে ধাওয়া করতে করতে ওরা হাওয়া। ওরা আবার জলিদের বাসাতেই ফিরে আসে। এই বাসার মেইন গেটটা বেইলি রোডে। ওরা বেইলি রোড দিয়ে বাসায় ঢুকেই ফলস্ নম্বর-প্লেটটা খুলে ফেলে পেছনের আরেকটা গেট দিয়ে শান্তিনগরের রাস্তায় পড়ে অনেক ঘুরে ধানমন্ডিতে আরিফদের বাসায় চলে যায়। বিকেলে যখন রাস্তায় বেরোই তখন দেখি প্রত্যেকটি রাস্তায় কালো মরিস মাইনর চেকে করা হচ্ছে। পীর সাহেবের গাড়িটা কালো মরিস মাইনর কি না।

তোমরা কত টাকা পাঠিয়েছ মেলাঘরে?

ব্যাঙ্কের ২৫ হাজার আর পিস কমিটির ২৫ হাজার–মোট ৫০ হাজার টাকা।

তোমরা যে এত টাকা পাঠিয়ে দিলে, তোমাদের চলে কি করে?

আমাদের? আমাদের চিন্তা কি? আমরা যেখানে থাকি, সব্বাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চাদা দিয়ে যায়। যে যা পারে। জেলেরা মাছ দেয়, চাষীরা ক্ষেতের তরিতরকারি, একটু ধনী চাষী আস্ত গরু পাঠিয়ে দেয়। নদীর ঘাটে জেলেরা একটা বড় ডুলা বেঁধে দিয়েছে–সকালে নদী দিয়ে যাবার সময় নিজ নিজ নৌকো থেকে যার যা সাধ্যমত মাছ ঐডুলাতে দিয়ে যায়। দিনের শেষে দেখা যায় বিশ-ত্রিশ সের, কোনদিন এক মণ পর্যন্তও মাছ জমেছে। ঐ মাছ দিয়ে আমাদের দুবেলার খাওয়া চলে যায়। এ ছাড়াও সবাই নিয়মিত চাদা দেয়–তা থেকে দলের প্রত্যেককে একশো টাকা করে মাসোহারা দিই। আমরা প্রথম যখন রোহা গ্রামে বেস ক্যাম্প করি, তখন মেলাঘর থেকে এসেছিলাম মাত্র ৫২ জন। আসার পর বহু লোকাল ছেলেপিলে এসে দলে ভর্তি হয়ে গেল। জানেন, মাত্র দশদিনের মধ্যে আমরা ৪৫০ জন হয়ে গেলাম।

৮ নভেম্বর, সোমবার ১৯৭১

হ্যারিসের বাসায় গিয়েছিলাম রুমীর একটা ফটোর নেগেটিভ আনতে। বছর দুয়েক আগে ওরা দুজনে ওয়েস্ট পাকিস্তান বেড়াতে গিয়েছিল আমার দুই বোনের কাছে। তখন হ্যারিসই তুলেছিল ছবিটা। আমার কাছে একটা কপি আছে। কোমরে চিশতীর পিস্তল আর কাঁধের ওপর দিয়ে গুলির বেল্ট ঝুলিয়ে মাথায় একটা ক্যাপ লাগিয়ে কোমরে দুই হাত রেখে রুমী কি যেন বলছে–এমনি অবস্থায় তোলা ছবিটা। খুবই জীবন্ত মনে হয়। গতকাল হঠাৎহ্যারিস নিজেই ফোন করে বলেছিল তার কাছে রুমীর কয়েকটা ছবির নেগেটিভ আছে। আজ গিয়ে নিয়ে এলাম। কদিন থেকে রুমীর ফটো খুঁজছিলাম বাসার সব অ্যালবাম খুলে। ইদানীং রুমী একেবারেই ফটো তুলতে চাইত না। ফটো যা আছে, সব দুতিন বছর আগের তোলা। হ্যারিসের কাছ থেকে নেগেটিভ এনে দোকানে একটু বড় করে প্রিন্ট করতে দিলাম।

পুরনো ছেলেপিলেরা মাঝে-মধ্যে হঠাৎ এসে দেখা করে যায়। সেলিম এসেছিল গতকাল। আজ এসেছিল মনু অর্থাৎ মনিরুল আলম।

১০ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭১

মাসুম আজ বাড়ি গেল। ভোরে গাড়ি করে কোচ স্টেশনে দিয়ে এসেছি।

ঈদের কেনাকাটা খুব জমে উঠেছে। তবে তা এক শ্রেণীর লোকের মধ্যেই। যাদের বাড়ির মেয়েদের জামাকাপড় আর ছেলেদের টুপি-জুতোতে বেশি বেশি জরি, চুমকির বাহার দেখা যায়–সেই সব বিহারি আর বাড়িতে উর্দুবলা বাঙালিদের মধ্যেই ঈদের কোনাকাটার সমারোহটা বেশি দেখা যাচ্ছে। আমাদের কোন ঈদের কেনাকটা নেই। আমাদের মতো আরো অনেক পরিবারেরই নেই। কোথা থেকে কারো যেন সাইক্লোস্টাইল করা হ্যান্ডবিল ছেড়েছে দেশের এই দুর্দিনে ঈদের খুশি বলে কিছু নেই। সুতরাং ঈদ উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় কেনা, উৎসবের আয়োজন করা। অনুচিত। অন্যদিকে সামরিকজান্তা প্রচার করছে ঈদের খুশি সামনে-প্রাণভরে সবাই আনন্দ করো, কাপড় কেননা, পোলাও কোর্মা সেমাই ফিরনির আয়োজন করো। এক শ্রেণীর লোক মেতে উঠেছে তাই করতে। নিউ মার্কেটে, বায়তুল মোকাররমে, জিন্না এভিনিউতে গেলে লোকের এই আনন্দ-উল্লাস দেখে মনের মধ্যে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা ফুসে ওঠে।

১২ নভেম্বর, শুক্রবার ১৯৭১

চারদিকে কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। দৈনিক কাগজগুলো ভারতীয় আগ্রাসন, ভারত কর্তৃক যুদ্ধের হুমকি, সীমান্তে ভারতীয় তৎপরতা ইত্যাকার খবরে সয়লাব। পাচ। তারিখে হঠাৎসরকারি আদেশে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে রাত সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত ব্ল্যাক আউটের মহড়া হল। আজ আবার কাগজে দেখছি সরকারি-বেসরকারি সব বাড়িঘরের পাশে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সংগ্রহের উদ্দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছেন।

দেশের অভ্যন্তরেও লম্ফঝম্প কম হচ্ছে না। পি.ডি.পির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানিয়েছেন রাজাকারদের সংখ্যা এবং তাদেরকে দেওয়া অস্ত্র–দুই-ই বৃদ্ধি করা হোক। উপনির্বাচন শুরু হবার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যে হারে ভারতীয় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বেড়ে গেছে, তাতে রাজাকারদের শক্তিশালী করা খুবই প্রয়োজন।

কেরোসিনের দর হঠাৎ করে এক লাফে প্রতি টিন ১১ টাকা থেকে ১৮ টাকায় চড়ে গেছে। কি ব্যাপার? সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে বিচ্ছুদের ধাক্কার জের মনে হচ্ছে!

এতদিন কাগজে শুধু রাজাকার বাহিনীদের কথাই পড়তাম। এখন দেখছি আরো নতুন দুটো বাহিনীর নাম–আল-শামস আর আল-বদর। শব্দ দুটোর মানে কি? কাগজে দিচ্ছে–রাজাকারদের আল-শামস ও আল-বদর বাহিনী। তার মানে এরা রাজাকার বাহিনীরই দুটো অংশ? একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর?

গতকাল বায়তুল মোকাররমের দোকানে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আজকাল ঢাকায় এরকম কোথাও কিছু হলে আমার বিস্তারিত খবর জানতে কোন অসুবিধা হয় না। মিনিকে ফোন করলেই সব জানা যায়। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম এই দলটার মধ্যেও জন আর ফেরদৌস ছিল। আরো ছিল আসাদ, ফিরোজ, বাবু, সহর, মুনীর, জাহেদুল। ওদের ঘটানো বিস্ফোরণে ফ্যান্সি হাউস বলে শাড়ির দোকানের ভেতরে একজন পাঞ্জাবি মেজর, আর কয়েকজন মহিলা জখম হয়েছে। দোকানের সামনে দাড়ানো তিনজন খানসেনা মরেছে, আরো কয়েকজন জখম হয়েছে। ফল হয়েছে বাকি দিন দোকানপাট সব বন্ধ, লোকের ঈদের কেনাকাটায় ছাই পড়েছে।

বেশ হয়েছে।

১৭ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭১

আজ একখানা দিন গেল বটে। গত রাতটা ছিল শবে কদরের রাত, শরীফ আর বুড়া মিয়া পাড়ার প্লেনওয়ালা মসজিদে গিয়েছিল নামাজ পড়তে। গতকাল রাতে কারফিউ ছিল না। শবে কদরের রাত বলেই। মুসল্লিরা সারারাত ধরে মসজিদে এবাদত-বন্দেগি করে ফজরের নামাজ পড়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন। জামী আর আমি বাড়িতে নামাজ পড়েছি, মাঝরাতে ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েও নিয়েছি। পাচটার সময় হঠাৎনিচে কলিং বেল বাজল। বুক ধড়াস করে উঠল। এই ভোর রাতে কলিং বেল? ফজরের নামাজ না পড়ে তো শরীফদের ফেরার কথা নয়। তাহলে? ভাবতে ভাবতেই আবার কলিং বেল। দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে আস্তে করে বললাম, কে?

শরীফের গলা শোনা গেল, আমি।

অবাক হয়ে নিচে নেমে দরজা খুলে দিলাম, এখনো তো ফজরের সময় হয় নি। চলে এলে যে?

কারফিউ দিয়ে দিয়েছে সাড়ে পাঁচটা থেকে। মাইকে করে বলে বেড়াচ্ছে। মুসল্লিরা সবাই হুড়মুড়িয়ে বাড়ির পানে দৌড় দিয়েছে। ফজর নামাজ পর্যন্ত থাকার উপায় কি? তাহলে তো মসজিদেই আটকা পড়ে থাকতে হবে।

তা ঠিক। ফজরের আজান পড়বে পৌঁনে ছটায়। আর কারফিউ সাড়ে পাঁচটা থেকে। কাজেই ফজর নামাজ পর্যন্ত মসজিদে থাকার কোন উপায় নেই।

আজ ছুটি। শবে কদর বলেই। কাল সারারাত জেগে শবেকদরের নামাজ পড়েছেন মোমিন মুসলমানরা, আজ দিনে একটু ঘুমোবেন।

শরীফ নটার দিকে গোসলখানায় ঢুকতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ মাইকে কিছু ঘোষণার মতো শোনা গেল। কি আশ্চর্য, আমাদের গলিতে! সবাইকে যার যার বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল আর লাইসেন্স নিয়ে মেইন রোডে যেতে বলছে।

এ আবার কি ব্যাপার? শরীফ গেটের কাছে বেরিয়ে দেখল হোসেন সাহেব, ডাক্তার সাহেব, রশীদ সাহেব সবাই গেটের কাছে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। গলিতে দুজন মিলিশিয়া পুলিশ। কারফিউয়ের মধ্যে বন্দুক, বিস্তল নিয়ে মেইন রোডে গেলে কারফিউ ভঙ্গ করার অপরাধে পড়তে হবে কি না এ নিয়ে সবার মনে ভয়। মিলিশিয়া দুজন অভয় দিয়ে বলল, কারফিউয়ের মধ্যেই তো অর্ডার দেওয়া হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই।

আমাদের আছে একটা বারো বোর শটগান, একটা টুটু বোর রাইফেল আর একটা অ্যাশট্রা পিস্তল। শরীফ জামী ওগুলো হাতে নিয়ে মেইন রোডের দিকে হাঁটা দিল সাড়ে নটায়। আমিও গেটের কাছে বেরিয়ে দেখলাম অন্য সব বাড়ি থেকে সবাই নিজের অস্ত্র আর লাইসেন্স হাতে নিয়ে গুটিগুটি চলেছে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে।

ওরা ফিরল তখন প্রায় চারটে। খালি হাতে। অস্ত্র এবং লাইসেন্স দুই-ই রেখে দিয়েছে, শুধু কয়েকটা টুকরো কাগজে রসিদ দিয়েছে। শরীফের সারা মুখে খোচা খোচা দাড়ি, দুই চোখ লাল। গতকাল সারারাত জাগা, তারপর সারাদিন গোসল, বিশ্রাম কিছু নেই–অস্ত্র হাতে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা। শীতের রোদ হলেও রোজা রেখে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর। জামীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর জ্বর এসেছে।

১৯ নভেম্বর, শুক্রবার ১৯৭১

সকলেরই মনের অবস্থা খুব খারাপ। দুঃখ, হতাশা, ভয়, ভীতি, নিষ্ফল ক্রোধ–সব মিলে আমাদেরকে যেন পাগল বানিয়ে ছাড়বে। শরীফের ওজন খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমারও কমেছে। তবে আমাকে নিয়ে নাকি ভয় নেই। আমি কাঁদি, হাহুতাশ করি, কথা বলি, মনের বাষ্প বের করে দেই। শরীফ এমনিতেই কথা কম বলে, এখন আরো কম–তার ওপর সে কাঁদেও না, হাহুতাশ করে না, মনের বাষ্প বের করার কোন প্রক্রিয়া তার ভেতর দেখি না। প্রতিদিনের অভ্যস্ত নিপুণতায় সে তার সব কাজ করে। যায়–সকালে উঠে শেভ, গোসল, ফাঁকে ফাঁকে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনা, তারপর অফিস, বিকেলে টেনিস, সন্ধ্যায় আবার স্বাধীন বাংলা বেতার, বন্ধু বান্ধব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কীয় আলাপ-আলোচনা–ওকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই দুঃখ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

শহরে একটা নতুন জিনিস দেখা যাচ্ছে। বিহারিরা সবাই মাথা ন্যাড়া করে একটা লাল ফেটি বেধে বেড়াচ্ছে। ওদের দেখাদেখি অনেক বাঙালিও। ন্যাড়া মাথা দেখলেই খানসেনারা ছেড়ে দেয়, তাই বোধ হয় অকারণ হয়রানির হাত থেকে বাঁচবার জন্য অনেক ভীরু বাঙালি যুবকও মাথা ন্যাড়া করেছে।

রুমীর এনলার্জ করা ফটোটা দোকান থেকে এনেছি। বেশি বড় করি নি, মাত্র আট বাই দশ। ঐ মাপের একটা ফটোস্ট্যান্ডও কিনে এনেছি। ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। কতোদিন দেখি নি ওই প্রিয়মুখ। এই কি ছিল বিধিলিপি? রুমী। রুমী। তুমি কি কেবলি ছবি হয়ে রইবে আমার জীবনে? তুমি গেরিলা হতে চেয়েছিলে, গেরিলা হয়েছিলে। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দ, ক্ষিপ্র পদসঞ্চারে আঘাত হানতে শত্রুকে, নির্ভুল লক্ষ্যে। শত্রুও একদিন নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনে, রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেল তোমাকে। আর কি ফিরে পাবো না তোমাকে? তুমি যে সব সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে :

আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে–এই বাংলায়/হয় তো মানুষ নয়–হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়/হয়তোবা হাঁস হবো–কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়/সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে/আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে/জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়।

রুমী, তোমাকে আসতেই হবে আবার ফিরে।

চোখ মুছে ছবিটার নিচে একটুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লিখলাম : আবার আসিব ফিরে–এই বাংলায়। ফটোটা রাখলাম নিচতলায় বসার ঘরের কোণায় টেবিলে। আগামীকাল ঈদ। অনেক মানুষ আসবে ঈদ মিলতে। তারা সবাই এসে দেখবে–রুমী কেমন কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করছে–আবার আসিব ফিরে–এই বাংলায়।

২০ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১

আজ ঈদ। ঈদের কোন আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয় নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয় নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয় নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায় নি।

কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা বেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি বেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।

২৬ নভেম্বর, শুক্রবার ১৯৭১

ঘটনা যেন একটু দ্রুতই ঘটছে কিছুদিন থেকে। পূর্ব বাংলার চারধারে সবগুলো বর্ডারে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের চাপ যতই বাড়ছে, ঢাকার কাগজগুলোতে ভারতীয় হামলার খবর ততই বড় কলামে ছাপা হচ্ছে। ২৩ তারিখ সকালে দৈনিক পাকিস্তান খুলে হঠাৎ চমকে গিয়েছিলাম। আট কলামজুড়ে বিরাট হেডলাইন : ভারতের সর্বাত্মক আক্রমণ।

আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। কয়েক মাসব্যাপী ছোট ছোট হামলা, ছোট বড় সংঘর্ষ এবং পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে সুপরিকল্পিতভাবে বারোটি পদাতিক ডিভিশন মোতায়েনের পর এই হামলা চালানো হচ্ছে।

তাই বুঝি চারদিকে এমন সাজসাজ রব পড়ে গেছে। ২৪ তারিখে পাকিস্তান। সরকার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ঐদিনই সন্ধ্যায় ছটা থেকে সাতটা পর্যন্ত ঢাকা নারায়ণগঞ্জ আর টঙ্গীসহ শহরের আশপাশের এলাকায় এক নিষ্প্রদীপ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। শহরের সর্বত্র পরিখা যে খোঁড়া হচ্ছে, সে খবরটাও ছবিসহ কাগজে ফলাও করে দেওয়া হয়েছে। আর প্রতিদিন বক্স করে কাগজে ছাপা হয়ে চলেছে বিভিন্ন আপ্তবাক্য। যেমন : যুদ্ধকালে নীরবতাই উত্তর আর বাচালতা বিষবৎ। শান্ত থাকুন, নীরব থাকুন, আপনার গোপন কথা আপনার মধ্যে রাখুন। গুজব তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের চাইতেও ক্ষতিকর। ইত্যাদি।

যুদ্ধ-যুদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েছে। কি করবে, কি না করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গতকালের কাগজে ঘোষণা দেখলাম পর সাতদিন সন্ধ্যায় একঘন্টা করে নিষ্প্রদীপ মহড়া হবে। আজকের কাগজেই সেটা বাতিল করে নতুন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২৪ তারিখ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় হঠাৎ কারফিউ দেওয়া হল। শরীফ আর জামী ঢাকা ক্লাবে টেনিস খেলতে গিয়েছিল। সন্ধ্যার পর শরীফের একটা মিটিংও ছিল ক্লাবে। হঠাৎ দেখি সোয়া পাঁচটায় বাপবেটা বাসায় এসে হাজির। কি ব্যাপার? না, কারফিউ সাড়ে পাঁচটা থেকে! সেই সময় আইডিয়াল লাইব্রেরি থেকে রিয়াজ সাহেব এসেছেন বইয়ের লিস্ট নিয়ে। ঢাকা ক্লাব লাইব্রেরির জন্য বেশ কয়েকশো টাকার বই কেনা হবে। শরীফের মুখে কারফিউয়ের খবর পেয়ে ভদ্রলোক পড়িমরি করে ছুটলেন এলিফ্যান্ট রোডেই ওঁর এক বন্ধুর বাড়ি। আর কি আশ্চর্য। রাত সাড়ে নটাতেই কারফিউ উঠে গেল! এসব কি তামাশা হচ্ছে?

গতকাল সাড়ে বারোটার দিকে আবার শোনা গেল–বেলা একটা থেকে কারফিউ! অমনি সবখানে সব লোকে অফিস-আদালতে ছেড়ে, দোকানপাট বন্ধ করে ছুটল বাড়ির দিকে। শেষে আর কেউ রিকশাও পায় না। ওরাও তো ছুটছে বাড়ির দিকে। আমি এগারোটার দিকে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। সাড়ে বারোটায় ভাবলাম মার বাসা হয়ে তারপর ফিরব। রাস্তায় দেখি সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা, খালি রিকশা ছুটে যাচ্ছে, সওয়ারীর হাঁকডাক কানে নিচ্ছে না। লোকজন প্রায় দৌড়ের মত ছুটে যাচ্ছে। আমি আর মার বাড়ি গেলাম না, গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম। কিন্তু খানিক পরেই শুনি কারফিউ নাকি দেওয়া হয় নি। ওটামিথ্যে গুজব!মাইক দিয়ে সে কথা ঘোষণা করা হল, রেডিওর বিশেষ সংবাদ বুলেটিনে সেকথা প্রচার করা হল। কিন্তু তাতেও খালি জনপদ আর ভরে উঠল না! বেশ মজাই হল। একদিন সরকার বেটাইমে চার ঘন্টার জন্য কারফিউ দেয়, পরদিন লোকে গুজবটাকেই সত্যি বলে ধরে নেয়। লোকের আর দোষ কি?

২৮ নভেম্বর, রবিবার ১৯৭১

জীবন যে কতো অনিশ্চিত, আক্ষরিক অর্থেই পদ্মপত্রে নীর–তা যেন এই সময়ই মনেপ্রাণে উপলব্ধি করছি। কতো বছর ধরে কতো সুন্দর সুন্দর চাদর, ওয়াড়, তোয়ালে, প্লেট, গ্লাস, কাপ,ডিস, কাঁটাচামচ আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছি, ভবিষ্যতে কখনো কোন বিশেষ উপলক্ষে বের করব বলে। রুমী-জামীকে প্রায়ই হাসতে হাসতে বলতাম, তোদের বউ এলে বের করব। সেইসব বিশেষ উপলক্ষ আর কখনো আসবে কি? এখন যে প্রতিটি দিন বেঁচে রয়েছি, এটাই তো একটা বিশেষ ঘটনা। এর চেয়ে বড় উপলক্ষ আর কি হতে পারে? তাই আজ আলমারি খুলে সুন্দর সুন্দর চাদর, ওয়াড় বের করে সব ঘরের বিছানায় পেতেছি। দামী, সুদৃশ্য প্লেট, গ্লাস, কাপ, ডিস, কাঁটাচামচ সব বের করে টেবিলে রেখেছি। শরীফ-জামী অবাক চোখে তাকাতে হেসে বললাম, মরে গেলে সাত ভূতে লুটে খাবে তার চেয়ে নিজেরাই ভোগ করে যাই।

আগামীকালের ক্রাশ ইন্ডিয়া দিবসের কথা ভেবে অনেকেই উদ্বিগ্ন। মিরপুর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে এর প্রস্তুতি নিয়ে যেরম জোশ দেখা যাচ্ছে তাতে বাঙালিরা অনেকেই ভয় পাচ্ছে। তাদের ভারত বিদ্বেষের লাভা-স্রোতে ঢাকার বাঙালিরাও শেষমেষ তলিয়ে যায় নাকি, কে জানে? বহু অবাঙালির গাড়ির কাচে ক্রাশ ইন্ডিয়া লেখা স্টিকার জ্বলজ্বল করছে। অনেক অবাঙালির দোকানে ক্রাশ ইন্ডিয়া লেখা পোস্টার শোভা পাচ্ছে।

২৯ নভেম্বর, সোমবার ১৯৭১

যতটা ভয় পাওয়া গিয়েছিল, ততটা খারাপ কিছু ঘটে নি। সকাল থেকে গাড়ি-রিকশা বাস চলে নি। দোকানপাট বন্ধ ছিল-অবাঙালিদের-গুলো জোশে, বাঙালিদের-গুলো ভয়ে। এগারোটার দিকে লুলুকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে হেঁটে আজিমপুরে এক বাসায় গেলাম। পথে দুটো মিছিল দেখলাম। উর্দু, ইংরেজিতে ভারত বিধ্বস্ত করার বেশ কয়েকটা শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে মোহাম্মদপুরের দিক থেকে আসা মিছিল।

বারোটায় হরতাল শেষ। দেড়টার সময় বাসায় ফিরলাম রিকশা চড়ে।

মিছিল, মিটিং নাকি সন্ধ্যে পর্যন্ত চলেছে।

আজ থেকে ঠিক তিরানব্বই দিন আগে পাক হানাদাররা রাত বারোটার সময় এসে আমার রুমীকে ধরে নিয়ে গেছে।