নব-হিটলার

নব-হিটলার

আত্তিলা, চেঙ্গিস, নাদির যখন রক্তের বন্যায় পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়েছেন তখন অসহায় মানবসন্তান কাতরকণ্ঠে রুদ্রকে স্মরণ করে তার দক্ষিণ মুখের কামনা করেছে, কিংবা হয়তো ভগবানকে অভিসম্পাত দিয়েছে। কিন্তু সাহস করে এ আশা করতে পারেনি, ভবিষ্যতের আত্তিলা-নাদিরকে ঠেকানো যায় কী প্রকারে?

আজ কিন্তু মানুষের চিন্তা, এমন কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে করে আবার যেন আরেকটা হিটলার দেখা না দিতে পারে? কারণ এই সুসভ্য বিংশ শতাব্দীতে হিটলার যে রক্তপাত করে গেলেন, তার সামনে খুব সম্ভব চেঙ্গিস-নাদির হার মানেন। তাই আমি যে হিটলার নিয়ে আলোচনা করি সেটা কিছু একাডেমিক ইনট্রেসট নয়– অর্থাৎ অমাবস্যার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্বডিম্বের অনুসন্ধান, সমস্যাটা শত লক্ষ নিরীহ মানুষের জীবনমরণ নিয়ে!

হিটলারকে আমি যে বিশেষ করে বেছে নিয়েছি তার দুটি কারণ আছে। প্রথমত তিনি এমন সব কীর্তিকর্ম করে গেছেন যা আত্তিলা-চেঙ্গিসের পক্ষে সম্ভব হয়নি। (সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বোধহয় রুদ্রের নবমাবতার হিটলারের পর দশমাবতার চীনের গোকুলে বাড়ছেন নেফার সংবাদ থেকে আমার এই অনুমানটি হয়েছে। এখানে সামান্য একটি উদাহরণ দিই। পাঠকদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি–অপরাধ নেবেন না–এটা অন্ধের অশ্বডিম্বের অনুসন্ধান* [*আমার শব্দগুলো ঠিক মনে নেই তবে শোপেনহাওয়ার দর্শনচর্চার বর্ণনা দিতে গিয়ে বোধহয় মোটামুটি এই বলেছেন : The search of a blind man in a dark night for a black cat, which is not there.] নয়। চেঙ্গিস-নাদির যখন কোনও শহর দখল করে পাইকারি কচুকাটার হুকুম দিতেন তখন দেখা যেত তাদের সৈন্যরা তলোয়ার দিয়ে যুবা-বৃদ্ধ-শিশুর গলা কেটে কেটে শেষটায় হয়রান হয়ে গিয়ে ক্ষান্ত দিত, শুধু তাই নয়, যুদ্ধের উত্তেজনাহীন আপন-জীবনমরণ-সমস্যাবিহীন এরকম একটানা কচুকাটা কেটে কেটে তাদের এক অদ্ভুত মানসিক অবসাদ দেখা যেত, যার ফলে নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু–পিপাসারও তো একটা সীমা আছে–বর্বরও নিস্তেজ হয়ে যেত। এ তত্ত্বটি বুঝতে হিটলারের বেশি সময় লাগেনি। হিটলার, হিমলার, হাইড্রিষ… আইষম্যান গোড়ার থেকে লক্ষ করলেন যদিও বাছাই বাছাই ব্ল্যাক-কোট পল্টনের পর-পীড়ন-উল্লাসী (স্যাডিস্ট)-দের ওপর ভার দেওয়া হয়েছিল বালবৃদ্ধবনিতা ইহুদিদের গুলি করে মারার– তারাও শেষ পর্যন্ত মানসিক অবসাদের স্নায়বিক জটিলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন হিটলার-হিমলার বের করলেন এক নয়া কল– যে কল চেঙ্গিস-নাদিরের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না, কারণ সে যুগের বিজ্ঞান তার বাল্যাবস্থায়। বিরাট একখানা অ্যারটাইট ঘরে ইহুদিদের ঢুকিয়ে দিয়ে ছাতের উপর থেকে ভেন্টিলেটারপনা ছিদ্র দিয়ে ছোট্ট একটি বিষে-ঠাসা গ্যাস ফেলে দেওয়া হত–দশ মিনিটেই ঘরের সব-কুছ বিলকুল ঠাণ্ডা। এতে করে যে গ্যাসের টিনটা ফেলল তার কোনও মারাত্মক স্নায়বিক ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।

হালে আইষম্যান সম্বন্ধে একখানা বাঙলা বই পড়েছিলুম। তাতে লেখক বলেছেন, পাঁচ লক্ষ ইহুদির প্রাণহরণের জন্য হিটলার সম্প্রদায় দায়ী। পাঁচ লাখ নয়, হবে পঞ্চাশ লাখ। ফাইভ মিলিয়ন পাঁচ লাখ নয়। হয়তো লেখক আশ্চর্য হয়ে ভেবেছেন, পঞ্চাশ লাখ কী করে হয়– এত অসংখ্য লোক মেরে ফেলা অসম্ভব পাঁচ লাখই হবে। আমরাও আশ্চর্য হই। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। একাধিক সহানুভূতিশীল এবং একাধিক নিরপেক্ষ জন বহু। গবেষণার পর যেসব গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তার থেকে দেখা যায়, আমেরিকার প্রকাশিত হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ আটাত্তর হাজার, প্যারিসের হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ ত্রিশ হাজার, লন্ডনের হিসাবে চল্লিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। অন্য আরেক হিসাবে পঞ্চাশ লক্ষ সাতানব্বই হাজার। নাৎসিরা যেসব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলতে পারেনি সেগুলো নরনবর্গের মকদ্দমায় মিত্রপক্ষ পেশ করেন। সেগুলো থেকে অনায়াসে চল্লিশ লক্ষের হিসাব পৌঁছনো যায় (আত্মহত্যা, অনাচার ও অকালরোগে যারা মরেছে তাদের হিসাব এতে বা অন্যান্য হিসাবে ধরা হয়নি)।

তাই আমি হিটলারকেই বেছে নিয়েছি। আমাদের সম্মুখে প্রশ্ন– এই বিরাট নরমেধ যজ্ঞ কি আবার অনুষ্ঠিত হতে পারে? কিংবা বিরাটতম?– এটম বমে যখন হাত বাড়ন্ত নয়? সে সম্ভাবনা যদি থাকে তবে আগেভাগে সময় থাকতে এমন কোনও এক কিংবা একাধিক ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে কি গ্রহণ করা যায়?

চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি, আরেক হিটলার খাড়া হয়ে উঠেছেন। এবং ইনি হিটলারেরও বাড়া। হিটলার মেরেছেন প্রধানত ইহুদিদের এবং শেষের দিকে যুদ্ধে পরাজয়ের বিভীষিকার সম্মুখীন হয়ে হন্যে হয়ে গিয়ে জর্মন জাতকে–১৩/১৪ বছরের বালকরাও বাদ যায়নি– পাঠিয়েছেন রণক্ষেত্রে, জয়ের আশা যখন সমূলে নির্মূল হয়ে গিয়েছে তখনও। আর এক চৈনিক নব-হিটলার গোড়ার থেকেই পাঠাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ চীনা যুবককে লস অব ম্যানপাওয়ারের কোনও চিন্তা-বিবেচনা না করে। আমাদের অফিসাররাই বলেছেন, ওরা নেমে আসে একেবারে পিঁপড়ের মতো। আফটার অল্ হাউ মেনি আর ইউ গোয়িং টু কিল, হাউ মেনি ক্যান ইউ কি! আমি শুনেছি কোরিয়াতেও চীনেরা এইভাবে নেমে এসেছিল। শুনেছি প্রথম সারির হাতে বন্দুক থাকে, দ্বিতীয় সারির হাতে তা-ও না। শত্রুপক্ষ প্রথম সারিকে কচুকাটা (মো ডাউন– আমি শব্দার্থে কচুকাটা বলছি, কারণ এদের ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়েছে, শুধু বন্দুক দিয়ে মেশিনগানের মোকাবেলা করতে, তাতে করে সামান্য একটা ঘাঁটি দখল করতে কত হাজার আপন সৈন্য অযথা মারা গেল বিলকুল তার কোনও পরওয়া না করে) করে ফেললে দ্বিতীয় সারি সেইসব বন্দুক তুলে নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কচুকাটা হয়। কোরিয়াতে নাকি একটা সুরক্ষিত ঘাঁটি থেকে শ-তিনেক মার্কিন সেপাই- এখানেও মেশিনগান বনাম রাইফেল– চীনাদের কচুকাটা করতে করতে শেষটায় তাদের প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে চললে কমান্ডার আদেশ দেন, ঘটি ত্যাগ করে পিছনে হটে যেতে। অর্থাৎ যেখানে লস্ অব ম্যানপাওয়ার সম্বন্ধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যুযুধান নব-হিটলার অগ্রসর হতে চান সেখানে তাঁর উপস্থিত জয় হবে, কিন্তু আখেরে সমূলস্তু বিনশ্যতি–কিন্তু অগণিত আপনজন ও বিস্তর পরজনকে মৃত্যু, অনাহার, মহামারীর কবলে তুলে ধরে ও বহু বহু গৃহে শোকের ঝঞ্ঝা বইয়ে দিয়ে।

হিটলারের একাধিক সেনানায়ক শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর বলেন, যেদিন আমি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করলুম, লস অব জর্মন ম্যানপাওয়ার হিটলার আর হিসাবে নেন না, সেদিন থেকেই আমি আত্মসমর্পণের চিন্তা আরম্ভ করি। স্তালিনগ্রাদে পাউলুস তাই করেছিলেন– যদিও হিটলারের কড়া হুকুম ছিল কচুকাটা হয়ে মরার। স্পেব কলকারখানা, পুল ধ্বংস করতে নারাজ হয়েছিলেন ও মোডেলের মতো একাধিক সেনানায়ক আত্মহত্যা বরণ করেন।

মৃত্যুর আটাশ দিন পূর্বে হিটলার কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। চীন যে একদিন মারমূর্তি ধারণ করবে সেটা তিনি জানতেন। তবে ভারতবর্ষ আক্রমণ করবে এ তত্ত্বটা তার জানা ছিল না। তিনি বলেছিলেন– From the point of view of both justice and history they (Batst) will have exactly the same arguments, or lack of arguments to support their invasion of the American continent as had the Europeans in the sixteenth century. Their vast and undernourished masses will confer on them the sole right that history recognizes the right of starving people to assuage their hunger provided always that their claim is well-backed by force.

হিটলারের এই শেষ ভবিষ্যদ্বাণী। এর পর তিনি কিছু বলে থাকলে সেটা আমাদের কাছে পৌঁছয়নি।

হিটলারের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত নই। তিনি মনে করেছিলেন, রুশ এবং মার্কিনে লড়াই লাগবে। ফলে আমেরিকা ছারখার হবে। তখন চীনারা সে দেশ দখল করবে। সেই দখল করার ভিতর অন্যায় বা অধর্ম কিছু নেই। কারণ ইতিহাস মাত্র একটি সত্য স্বীকার করে– ক্ষুধিত পঙ্গপালের মতো যে জনসমাজ কাতর সে যত্রতত্র বেদখলি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করার হক ধরে।

অর্থাৎ হিটলারের মতে ইতিহাস ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে না। আমরা করি। শাস্ত্রে আছে–

অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো দ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি।

অধর্ম দ্বারা বুদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া যায়, মঙ্গল দেখা যায়, শত্রু (সপত্ন = প্রতিদ্বন্দ্বী, সপত্নী এরই স্ত্রীলিঙ্গ এবং বাঙলায় চলিত) পরাজিত হয়, কিন্তু সমূলে বিনাশ পেতে হয়।

এই তত্ত্বকথাটি অভিজ্ঞতাপ্রসূত– আ পস্তেরিয়োরি এবং অভিজ্ঞতা থেকে নীতিসূত্র বের করা ইতিহাসের কর্ম, অথবা ইতিহাসের দর্শন (ফিলজফি অব হিস্ট্রি) এটি করে।

হিটলার ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি এমনকি রুশের বহুলাংশ জয় করতে ন্দ্র, মঙ্গল দেখেছিলেন, সপত্নগণকে পরাভূত করেছিলেন, কিন্তু বিনাশ যখন এল তখন সেটা সর্বস্ব সমূলে উৎপাটন করল।

এর আরেকটি গৌণ অর্থ আছে। আমরা যে ছোটখাটো পাপ-অবিচার করে থাকি তার জন্য এই পৃথিবীতেই অল্পস্বল্প সাজা পাই– কারণ আমরা হিটলার কিংবা লাই সায়েবের মতো ডাঙর প্রাণী নই। আমাদের বিনাশ সমূলে হয় না। কিন্তু ওদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা।

ভারতবর্ষের ইতিহাস আদ্যন্ত গৌরবময় না-ও হতে পারে, কিন্তু আমরা ক্ষুধার তাড়নায় বা অন্য কোনও কারণেই স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে পররাজ্য আক্রমণ করিনি।

বড় হিটলার, ছোট হিটলারের ডরাবার কারণ নেই।

কিন্তু বারুদ শুকনো রাখতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *