নবীর বাগান [দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট]

নবীর বাগান [দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট] 

অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের আলমুস্তাফা ছিলেন তার সময়ের পুরোপুরি মধ্যাহ্ন, যিনি ফিরে গিয়েছিলেন তার সেই বিশেষ মাসের ক্ষুদ্র জন্মদ্বীপে— যে মাস হচ্ছে কেবলি স্মরণের জন্য। 

তাঁর জাহাজ পোতাশ্রয়ের নিকটবর্তী হলে তিনি জাহাজের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর নাবিকেরা তাকে ঘিরে ছিল এবং তাঁর হৃদয়ে ছিল ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষা। 

তারপর সমুদ্র তার কণ্ঠে কথা বলেছিল এবং তিনি বলেছিলেন, দ্যাখো আমাদের জন্মের ক্ষুদ্র দ্বীপটি। যদিও মাটি আমাদেরকে এখানে উত্তোলন করেছে—একটি গান ও একটি ধাঁধা—একটি গান আকাশের দিকে ধাবিত, একটি ধাঁধা মাটির দিকে ছুটে যায়, সেখানে আকাশ ও মাটির মাঝখানে কী আছে, যা আমাদের নিজস্ব আবেগকে বাঁচাতে বহন করবে গানগুলো এবং সমাধান করবে সব ধাঁধার? 

আর একবার এইসব তীরে সমুদ্র আমাদেরকে প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপাদন করে। আমরা আছি কিন্তু তার অন্য ঢেউয়ের আলোড়ন? সে (সমুদ্র) আমাদেরকে আজ পাঠিয়েছে তার কথা উচ্চারণ করতে, কিন্তু কীভাবে আমরা তা করব, যতক্ষণ আমরা বালি ও পাথরের ওপর আমাদের হৃদয়ের যথাযথ বন্ধনকে ভেঙে না ফেলি। 

সেজন্য, এটা হচ্ছে নাবিক ও সমুদ্রের আইন : যদি তুমি স্বাধীন হও তাহলে অবশ্যই তোমার ধোঁয়াশায় পরিণত হওয়া প্রয়োজন। আদলহীনতা হচ্ছে চিরকালীন আদল অনুসন্ধান এমনকি তা দূরের অগণিত নক্ষত্রপুঞ্জের মতো সূর্য ও চন্দ্রে পরিণত হবে। এবং আমরা প্রচুর অনুসন্ধান করেছি যারা, এখন তারাই ফিরেছে এই ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে— সেই একই অপরিবর্তনীয় ছাঁচ আমাদের অবশ্যই আর একবার ধোঁয়াশায় পরিণত হতে হবে এবং শিখতে হবে শুরুটা। সেখানে কী আছে যা বাঁচাবে জীবনকে এবং তুলে ধরবে উপরের দিকে শুধুমাত্র আবেগ ও স্বাধীনতার দিকে যেতে যেতে ভেঙে যাওয়া ছাড়া। 

চিরকাল আমরা সমুদ্রসৈকতে অনুসন্ধান করতে থাকব, যা আমরা গাইতে পারি এবং শুনতে পারি। কিন্তু সেই ঢেউগুলি কী? এগুলি সেইখানে ভাঙে যেখানে কারও কানই শুনতে পায় না— এটা আমাদের কাছে অশ্রুত যা আমাদের গভীর দুঃখের পরিচর্যা করে— যদিও এটা অশ্রুত, যা একটা আকার দিতে এবং আমাদের ভাগ্য গঠন করতে খোঁদাই করে আমাদের আত্মাকে। 

তারপর আর একজন নাবিক সামনে এসে বলল, ‘প্রভু এই পোতাশ্রয়ে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে আপনি আমাদের প্রতীক্ষাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দেখুন আমরা সত্যিই এসেছি। তারপরও আপনি দুঃখের কথা বললে প্রত্যেকেরই হৃদয় ভেঙে যাবে।’ 

আলমুস্তাফা জবাবে বলেন, ‘আমি কি স্বাধীনতার কথা বলি নাই? এবং ধোঁয়াশার কথা, যার ভেতরে রয়েছে আমাদের বৃহত্তম স্বাধীনতা? কষ্টের ভেতরেও এটা আছে— আমার এই তীর্থযাত্রা সেই ক্ষুদ্র দ্বীপটির প্রতি যেখানে আমি জন্মেছিলাম, এমনকি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসা একজন খুনি প্রেতাত্মার মুখোমুখি, যে তাকে খুন করেছে 

এবং অন্য নাবিক বলল, ‘দেখুন, সমুদ্রতটের ওপর অগণিত জনতা। তাদের নীরবতার ভেতরে তাদের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, এমনকি দিন ও আপনার আসার সময় এবং তারা একত্রিত করেছে প্রত্যেককে তাদের শস্য ও আঙুর ক্ষেত থেকে তাদের প্রিয় প্রয়োজনের ভেতরে— শুধুমাত্র আপনার প্রতীক্ষায়।’ 

আলমুস্তাফা জনতার ওপর দিয়ে অনেক দূরে তাকালেন এবং তার হৃদয় জনতার ব্যাকুল প্রতীক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী ছিল এবং তিনি নীরব ছিলেন। 

তারপর জনতার ভেতর থেকে ভেসে এল কান্নার শব্দ এবং তা ছিল শ্রদ্ধামিশ্রিত স্মরণ এবং সনির্বন্ধ অনুরোধের কান্না। 

তিনি নাবিকদের ওপর দিয়ে তাকালেন এবং বললেন, ‘আমি তাদের জন্য কী এনেছি? আমি ছিলাম দূরবর্তী প্রান্তরের এক শিকারি। লক্ষ্য ও পরাক্রমশীলতাসহ আমি খরচ করেছি সোনালি তীরগুচ্ছ, যা তারা আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু আমি কোনো করতালিমুখর খেলায় নামিনি। আমি অনুসরণ করিনি তীরগুচ্ছকে। হতে পারে তারা এখন বিস্তৃত হচ্ছে সূর্যের ভেতরে আহত ঈগলের ডানার সঙ্গে, যা মাটিতে পড়বে না। এবং হতে পারে সেই তীরের মাথাগুলি পড়ছে কারও হাতে— রুটি ও মদের প্রয়োজন ছিল যার। 

‘আমি জানি না তারা কোথায় কতক্ষণ উড়েছে, কিন্তু এটা জানি, তারাই তাদের বাঁক তৈরি করেছে আকাশে।’ 

‘যদিও ভালোবাসার হাত এখনও পর্যন্ত আমার ওপরে আছে এবং তোমরা, আমার নাবিকেরা এখনও আমার অন্তর্দৃষ্টিকে ভাসিয়ে নিচ্ছ এবং আমি বধির হব না। আমি কেঁদে উঠব তখনই যখন ঋতুচক্রের হাত আমার গলা চেপে ধরবে এবং আমি গাইব আমার গান, যখন তা আগুনের শিখায় পুড়ে যায়।’ 

এবং তারা হৃদয়ের ভেতরে ছিল সমস্যা জর্জরিত, কারণ তারা এসবই বলছিল এবং একজন বলেছিল, ‘প্রভু আমাদের সবকিছুই শিক্ষা দিন, কারণ আমাদের শিরার ভেতরে আপনার রক্ত প্রবাহিত হয় এবং আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে আপনার সুগন্ধ এবং এ সবই আমরা বুঝতে পারি।’ 

তারপর তিনি তাদের কথার উত্তর দেন। তার কণ্ঠে কথা বলে বাতাস এবং তিনি বলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষক হতে নিয়ে এলে আমারই ক্ষুদ্র জন্মদ্বীপে, যদিও স্বাধীনতার কারণেই আমি খাঁচাবদ্ধ হইনি। আমি একজন খুবই যুবক এবং সমৃদ্ধকরণ সম্পর্কে কথা বলতে খুবই অনভিজ্ঞ। কিন্তু আত্মা হচ্ছে গভীরতার ওপর চিরকালের জন্য একটা গভীর আহ্বান।’ 

‘যার স্বাধীনতা আছে তাকে অনুসরণ করতে দাও মাখনের পাত্র কিংবা লালমাটির ভেতরে। আমি এখনও পর্যন্ত গায়ক। আমি অবশ্যই মাটির গান গাইব এবং গাইব তোমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে, যা ঘুম এবং দিনের আলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু আমি ধারণা তৈরি করব সমুদ্রের উপরিভাগ সম্পর্কে।’ 

এখন জাহাজ পোতাশ্রয়ে ঢুকে পড়ল এবং সমুদ্রতটে ভিড়ল। তিনি এলেন তাঁর জন্মদ্বীপে এবং আর একবার দাঁড়ালেন নিজের লোকজনের ভেতরে— তাদের হৃদয় থেকে উত্থিত হল কান্না, সুতরাং ঘরে ফেরার নিঃসঙ্গতা তার ভেতরে আলাড়ন তুলেছিল। 

নাবিকেরা নীরবে অপেক্ষা করছিল তার কথা শোনার জন্য, কিন্তু দুঃখ-ভারাক্রান্ত স্মৃতির কারণে তিনি কোনো উত্তরই দিলেন না এবং হৃদয়ের ভেতর থেকে কথা বললেন, ‘আমি কি বলেছি যে আমি গান গাইব? না, আমি তা পারি না, কিন্তু আমার ঠোঁট খুলতে পারি যেন জীবনের কণ্ঠস্বর সামনে আসতে পারে এবং আনন্দ ও সহযোগিতার জন্য বেরিয়ে গিয়ে মিশে যেতে পারে বাতাসে।’ 

তারপর কারিমা—একটা শিশু, যে আলমুস্তাফার সঙ্গে তার মায়ের বাগানে খেলায় মেতেছিল এবং বলেছিল, ‘আপনি বারো বছর আপনার মুখমণ্ডল আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন এবং বারো বছর ধরে আপনার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমরা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি।’ 

আলমুস্তাফা সীমাহীন দরদ নিয়ে শিশুটির ওপর দিয়ে তাকালেন, কারণ এটা ছিল সে-ই যে তার মায়ের চোখের পাতাদুটি বন্ধ করে দিয়েছিল, যখন মৃত্যুর সাদা পাখা তাদেরকে একত্রিত করে। 

তিনি উত্তরে বলেন, ‘বারো বছর? কারিমা তুমি কী বললে বারো বছর? আমি নক্ষত্রশোভিত ছড়ি দিয়ে আমার প্রতীক্ষার পরিমাপ করিনি অথবা প্রতীক্ষার কারণে হৃদয়ের গভীর থেকে কোনো শব্দও সৃষ্টি করিনি— শুধু ভালোবাসার জন্য, যখন ভালোবাসা স্বদেশে ফেরার জন্য কাতর এবং সময়ের পরিমাপ ও শব্দ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে পরিশ্রান্ত।’ 

‘সেখানে একটা মুহূর্ত, যা পৃথকীকরণের মহাকালিক শক্তিকে ধরে রাখে। যদিও বিভাজন হচ্ছে শূন্যতা, কিন্তু তা হল মনের নিঃশেষিত অবস্থা। সম্ভবত আমরা বিচ্ছিন্ন হইনি।’ 

আলমুস্তাফা জনতার দিকে তাকান এবং প্রত্যেককে দেখেন—দেখেন যুবক ও প্রবীণ, বলিষ্ঠ ও ক্ষীণকায়, যারা বাতাস ও আলোর স্পর্শে লালবর্ণ ধারণ করেছিল—তাদের চেহারা ছিল ম্লান ও বিবর্ণ এবং তাদের মুখের ওপর পড়েছিল প্রতীক্ষা ও প্রশ্নের আলোকশিখা.

একজন নাবিক বলল, ‘প্রভু, আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে জীবনের প্রচুর তিক্ততা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ই অশান্ত এবং আমরা তা বুঝতে পারি না। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি—আমাদেরকে দুর্দশা থেকে মুক্ত করুন এবং আমাদের সামনে উন্মোচিত করুন আমাদের দুঃখবোধের অর্থকে।’ 

আলমুস্তাফার হৃদয় সমবেদনায় আলোড়িত হল এবং তিনি বললেন, ‘সমস্ত জীবন্ত অস্তিত্বের ভেতরে প্রাণ হচ্ছে অধিক পুরোনো, এমনকি সুন্দরের জন্মের আগেই পৃথিবীতে সৌন্দর্য দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়েছে এবং সত্য উচ্চারণের আগেই সত্য সেখানে ছিল।’ 

জীবন আমাদের নীরবতার ভেতরে গান গায় এবং তন্দ্রার ভেতরে স্বপ্ন দেখে। এমনকি যখন আমরা প্রহৃত এবং অবনত হই, জীবন তখন রাজাসনে অধিষ্ঠিত। যখন আমরা কাঁদি, জীবন তখন দিনের ওপরে বসে হাসে এবং মুক্ত হয়, যখন আমাদের শৃঙ্খলকে আমরা টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাই। 

প্রায় সময়ই আমরা বিভিন্ন তিক্ত নামে জীবনকে ডাকি কিন্তু শুধুমাত্র তখনই তা সম্ভব হয় যখন আমরাই তিক্ত এবং বিষণ্ণ। আমরা বিবেচনা করি জীবনের শূন্যতা ও অলাভজনক বিষয়গুলি, কিন্তু তা শুধুমাত্র তখনই যখন আত্মা নির্জন কোথাও দীর্ঘ ভ্রমণে যায় এবং অতিরিক্ত মনোযোগ সহকারে পান করে হৃদয়। 

জীবন গভীর, উন্নত ও দূরদর্শী, যদিও শুধুমাত্র তোমাদের বিশাল লক্ষ্যই পৌঁছাতে পারে তার পদপ্রান্তে—যদিও সে কাছে এবং শুধুমাত্র তোমাদের নিশ্বাসের প্রশ্বাস তার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছায়, তোমাদের ছায়ার ছায়া অতিক্রম করে তার মুখমণ্ডল এবং তোমাদের ক্ষীণতম কান্নার প্রতিধ্বনি জীবনের বক্ষঃস্থলে পরিণত হয় বসন্ত ও শরতে। 

জীবন হচ্ছে অবগুণ্ঠিত এবং গুপ্ত, যেমন তোমাদের বৃহত্তর সত্তা গুপ্ত ও অবগুণ্ঠিত। তারপরও জীবন যখন কথা বলে সমস্ত বাতাস পরিণত হয় শব্দে. এবং যখন সে আবার কথা বলে তখন তোমাদের ঠোঁটের হাসি ও চোখের পানিও শব্দে পরিণত হয়। যখন জীবন গান গায় তখন বধিরেরা তা শ্রবণ করে ও গচ্ছিত রাখে এবং যখন সে হেঁটে আসে, তখন দৃষ্টিহীনেরা তা দেখে, বিস্ময়ে অভিভূত হয় এবং অলৌকিক ও বিস্ময়কর ঘটনার ভেতরে তাকে অনুসরণ করে।’ 

আলমুস্তাফা তাঁর কথা শেষ করার পর একটা বিশাল নীরবতা জনতাকে আলিঙ্গন করে এবং এই নীরবতার ভেতরে ছিল অশ্রুত গান এবং তারা চাঙা হয়ে উঠেছিল তাদের একাকিত্ব ও দীর্ঘস্থায়ী বেদনার ভেতরে। 

আলমুস্তাফা তাদেরকে রেখে সরাসরি বাগানের পথ অনুসরণ করেন, যে বাগান ছিল তাঁর পিতা ও মাতার—যেখানে তাঁরা এবং তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ঘুমিয়ে আছে। 

সেখানে তাঁরাই ছিল, যাদেরকে অনুসরণ করবে তাঁর পরবর্তীরা-এটা ছিল ঘরে ফেরার আকাঙ্ক্ষা এবং তিনি ছিলেন একা। তাঁর লোকদের প্রথাগত অভ্যর্থনার পর, অভ্যর্থনার আনন্দোৎসব আরও বিস্তৃত করতে তাঁর সমস্ত জ্ঞাতি ছাড়া একজনও ছিল না। 

কিন্তু তার জাহাজের ক্যাপ্টেন একথা বলতে তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিল যে, তার পথে গিয়ে তাকে কষ্ট পেতে দাও। তার রুটি হচ্ছে তার একাকিত্ব এবং স্মৃতির মদে তার কাপ পরিপূর্ণ—যে মদ সে পান করবে একাই। 

এবং তার নাবিকেরা সেই পদক্ষেপই নেয়, কারণ তারা জানত যেরকম জাহাজের ক্যাপ্টেন তাদের বলেছিল এবং সমুদ্রতটে একত্রিত হওয়া মানুষেরা তাদের প্রত্যেকের আকাঙ্ক্ষার পদাঙ্ককে স্থায়িত্ব দান করছিল। 

একমাত্র কারিমাই গিয়েছিল তারপর –অল্প একটু পথ মাত্র, কারিমা ছিল তার একাকিত্ব ও স্মৃতির ওপর একটি আকুল আকাঙ্ক্ষা। কারিমা কথা বলল না কিন্তু ঘুরে দাঁড়াল এবং নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল, যাবার আগে পর্যন্ত সে একটা বাদামগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল যদিও সে জানত না—কেন সে কাঁদছে। 

আলমুস্তাফা এসেছিলেন, দেখেছিলেন তাঁর পিতামাতার বাগান এবং ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করেছিলেন যেন তিনি ঢোকার পর অন্য কেউ না আসতে পারে। 

চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত্রি তিনি একা সেই বাড়ি ও বাগানে বসবাস করেছেন এবং কেউই আসেনি, এমনকি দরজা পর্যন্তও না, কারণ তা ছিল বন্ধ এবং প্রত্যেকেই জানত তিনি সেখানে একা হবেন। 

এবং চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত্রি শেষ হয়ে এলে আলমুস্তাফা দরজা খুলে দিলেন যেন তারা ভেতরে আসতে পারে। 

নয়জন লোক তাঁর সঙ্গে বাগানে ঢুকে পড়ল— তাঁর নিজের জাহাজের তিন নাবিক, তিনজন মন্দিরের কর্মচারী এবং বাকি তিনজন যারা নাটকে তার কমরেড ছিল— যখন ছেলেবেলায় একসঙ্গে তারা খেলা করতেন এবং এরা ছিল তার শিষ্য। 

এক সকালে শিষ্যরা তাঁকে ঘিরে বসেছিল এবং তখন তাঁর দু-চোখে ছিল দূরত্ব এবং স্মৃতি। এবং সেই শিষ্য যাঁকে হাফিজ বলে ডাকা হত সে তাঁকে বলল, ‘প্রভু অফালিজ, শহর সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন এবং সেই ভূমি সম্পর্কে যেখানে আপনি সেই বারো বছর অস্থায়ীভাবে বাস করেছিলেন।’ 

আলমুস্তাফা নীরব ছিলেন এবং তিনি দূরের পাহাড়গুচ্ছের দিকে তাকালেন, তাকালেন বিশাল ইথারের (আলোকতরঙ্গ পাঠানোর কল্পিত মাধ্যম) দিকে এবং সেখানে তাঁর নীরবতার ভেতরে একটা যুদ্ধ চলছিল। 

তারপর তিনি বললেন, ‘আমার বন্ধু ও অনুসারীরা, করুনা করো এই জাতিকে, যারা বিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং ধর্মীয় ধারণার ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার ভেতরে বসবাস করে। 

‘করুণা করো সেই জাতিকে, যারা এমন বস্ত্র পরিধান করে যা বোনা যায় না, এমন রুটি খায় যা কৃষিক্ষেত্রে উৎপন্ন হয় না এবং পান করে এমন মদ, যা নিজস্ব আঙুর-পেষণকারী যন্ত্র থেকে প্রবাহিত হয় না। 

‘করুণা কর সেই জাতিকে, যারা কাপুরুষকে সাহসী হিসেবে প্রশংসা করে এবং আকর্ষণীয় বিজয়ীকে মনে করে অতি দানশীল।’ 

‘করুণা কর সেই জাতিকে, যারা অনুভূতিকে অবজ্ঞা করে স্বপ্নের ভেতরে, যদিও তারা স্বীকার করে জাগরণের বশ্যতা।’ 

‘করুণা কর সেই জতিকে, নিজস্ব কণ্ঠস্বরের ভেতরে যাদের উত্থান ঘটে নাই, কিন্তু নিরাপদ যখন তারা শবযাত্রায় অংশ নেয়, ধ্বংস ছাড়া দম্ভোক্তি করতে পারে না যারা এবং আবার বিদ্রোহী হয়ে উঠবে যখন তাদের গলা শায়িত হবে তরবারি ও পাথরের মাঝখানে। 

‘করুণা করো সেই জাতিকে, যাদের রাজনীতিবিদ একজন শেয়াল, দার্শনিক হচ্ছে একজন বাজিকর এবং যাদের শিল্পকর্ম হচ্ছে জোড়াতালি ও ভানসর্বস্ব। 

‘করুণা করো সেই জাতিকে, যারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নতুন শাসককে স্বাগত জানায় এবং বিদায়-সংবর্ধনা জানায় প্যাচার ডাক ডেকে— আবার শুধুমাত্র ঢাক-ঢোল বাজায় আর- একজনকে স্বাগত জানাতে।’ 

‘করুণা কর সেই জাতিকে, যাদের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বছরের পর বছর ধরে বধির হয়ে আছে এবং যাদের শক্তিশালী লোকেরা এখনও বসবাস করে দোলনায়। 

‘করুণা করো সেই জাতিকে, যারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যাদের প্রত্যেকটি খণ্ডাংশই এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি।’ 

একজন বলল, ‘এখন আপনার হৃদয়ের ভেতরে কী চলাফেরা করছে সে-সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন। ‘ 

তিনি সেই লোকটির মাথার ওপর দিয়ে তাকালেন এবং তখন তাঁর কণ্ঠস্বরে এমন একটা শব্দ ছিল যা গান-গাইতে-থাকা নক্ষত্রের মতো এবং তিনি বলেন, ‘তোমার জাগ্রত স্বপ্নের ভেতরে যখন তুমি নিশ্চুপ থাকো এবং শুনতে থাকো তোমার সত্তার গভীরে তোমার চিন্তা-ভাবনাগুলির শব্দ, বরফকণিকা ঝরে পড়ার মতো, জলপ্রপাতের মতো, তাই স্পন্দিত হও এবং সজ্জিত করো সাদা নীরবতা দিয়ে তোমার শূন্যতার সমস্ত শব্দকে। 

‘এবং বিনিদ্রতার স্বপ্নগুলি কি শুধুই মেঘমালা যা তোমার হৃদয়ের আকাশ বৃক্ষে মুকুলিত হয় এবং ফুটে ওঠে? এবং তোমার চিন্তাগুলি কি শুধুই পাঁপড়ি যা তোমার হৃদয়ের বাতাসে বিক্ষিপ্তভাবে উড়ে বেড়ায় মাঠ ও পাহাড়ের ওপর দিয়ে? 

‘এমনকি তোমারই মতো স্বপ্নগুলি শান্তির জন্য প্রতীক্ষা করে, যতক্ষণ আকারহীনতা তোমার ভেতরে কোনো আকার না নেয়। সুতরাং মেঘমালা কি একত্রিত ও প্রবাহিত হবে যতক্ষণ না আশীর্বাদকৃত আঙুল স্বপ্নের ধূসর আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষুদ্র এবং স্বচ্ছ সূর্য, চন্দ্ৰ ও নক্ষত্রের আকার দেয়?’ 

তারপর আধা-সন্দেহকারী সারকিস বলল, ‘কিন্তু বসন্ত আসবেই এবং আমাদের স্বপ্ন ও চিন্তার বরফগুলি গলে যাবে এবং তা আর কখনই স্বপ্নে পরিণত হবে না।’ 

এবং আলমুস্তাফা জবাবে বললেন, ‘যখন বসন্ত আসবে তন্দ্রাচ্ছন্ন কুঞ্জবন ও আঙুরক্ষেতের ভেতরে তাদের প্রিয়জনদের রক্ষা করতে, তখন গলে যাবে বরফ এবং তা স্রোতস্বিনী হয়ে উঠবে উপত্যকায় নদীকে রক্ষা করতে—চিরসবুজ বৃক্ষ এবং চিরসবুজ পত্রপল্লবের কাছে তা হবে পাত্রবহনকারী।’ 

‘সুতরাং যখন তোমার বসন্ত আসবে তখন কি তোমার হৃদয়ের বরফ গলবে এবং তোমার গোপনীয়তাগুলি স্রোতের সঙ্গে দৌড়বে উপত্যকায় জীবনের নদীকে রক্ষা করতে? নদী তোমার সেই গোপনীয়তাকে বুকে জড়িয়ে নেবে এবং বহন করবে বিশাল সমুদ্র পর্যন্ত।’ 

‘সবকিছুই গলে যাবে এবং পরিণত হবে গানে, যখন বসন্ত আসবে। এমনকি নক্ষত্রপুঞ্জ, অসংখ্য বরফকণিকা ধীরে ধীরে পতিত হবে বিশাল প্রান্তরের ওপর, তখন কোন হিমায়িত ভারসাম্য গলে গিয়ে তরল সংগীতে পরিণত হবে না? এবং তোমাদের ভেতরে কে হবে না চিরহরিৎ ও চিরসবুজ পাতার পাত্রবহনকারী? 

‘এটা ছিল—কিন্তু গতকাল তুমি ছিলে গতিশীল সমুদ্রের সঙ্গে সক্রিয় এবং আরও ছিলে তীরহীন ও সত্তাহীন। তারপর বাতাস, জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস তোমাকে বয়ন করে যেন তার মুখের ওপর আলোর একটি অবগুণ্ঠন, তারপর জীবনের হাত তোমাকে একত্রিত করে ও আকার দেয় এবং একটা মস্তিষ্ককে সঙ্গে নিয়ে তুমি অন্বেষণ কর শিখর। কিন্তু সমুদ্র অনুসরণ করে তোমাকে এবং তার গান এখনও তোমার সঙ্গে আছে। এবং যদিও তুমি ভুলে গেছ তোমার পিতৃত্ব কিন্তু সে চিরদিনের জন্য মাতৃত্বকে দাবি করবে এবং সে তোমাকে তার প্রতি আহ্বান জানাবে চিরদিন।’ 

‘পাহাড় ও মরুভূমির ভেতরে তোমার দীর্ঘভ্রমণ তোমাকে সারাক্ষণই স্মরণ করিয়ে দেবে তার ঠাণ্ডা হৃদয়ের গভীরতা। যদিও প্রায়ই তুমি জানবে কিসের জন্য প্রতীক্ষা করছ। বস্তুত সেটা তার বিশাল ও ছন্দোময় শান্তির প্রত্যাশায়। 

‘এবং কীভাবে এটা হবে? পাহাড়ের ওপর কুঞ্জবন ও লতাপাতা আচ্ছাদিত ছায়াঘেরা স্থানে যখন পাতার ওপর নাচতে থাকে বৃষ্টি, যখন ঝরে পড়া বরফকে মনে হয় একটি আশীর্বাদ ও একটি আইনসম্মত চুক্তিপত্র, তখন উপত্যকার ওপর দিয়ে তুমি তোমার পশুর পালকে নদীর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাও। তোমার শস্যক্ষেত, যেখানে রুপালি স্রোতের মতো ছোট্ট নদী আছে, যা সবুজ পোশাকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়, তোমার বাগানে যখন ঊষালগ্নের শিশির স্বর্গকে প্রতিফলিত করে, তোমার পশুচারণ ভূমিতে যখন সন্ধ্যার ধোঁয়াশা তোমার পথকে আধা-ছদ্মবেশ পরায়, তখন সবকিছুর ভেতরেও সমুদ্র তোমার সঙ্গে আছে, যে তোমার উত্তরাধিকারের সাক্ষী এবং তোমার ভালোবাসার প্রতি একটা অভিযোগ। 

এটা হচ্ছে তোমার ভেতরের বরফকণিকা যা সমুদ্রের তলদেশের দিকে দৌড়চ্ছে।’ 

এক সকালে তারা বাগানে হেঁটে বেড়ানোর সময় বাগানের দরজায় এক নারী আবির্ভুত হয়—এটা ছিল কারিমা—যাকে বালক বয়সে আলমুস্তাফা বোনের মতো ভালোবেসেছিলেন এবং কোনো জিজ্ঞাসা ছাড়া সে দাঁড়িয়েছিল, এমনকি হাত দিয়ে দরজায় সে কোনো শব্দও করেনি, কিন্তু স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল প্রতীক্ষা এবং বিষণ্নতা নিয়ে আলমুস্তাফা তার চোখের পাতায় আকাঙ্ক্ষা দেখতে পেলেন এবং দ্রুত পদক্ষেপে দরজার কাছে এসে দরজা খুললেন এবং কারিমা ভেতরে এসে শুভেচ্ছা জানাল। 

এবং কারিমা বলল, ‘কোন্ কারণগুলি আপনাকে আমাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিয়েছে, ফলে আপনার অপ্রসন্নতার আলোয় আমরা নাও বাঁচতে পারি? দেখুন, এইসব বছরগুলিতে আপনাকে আমরা ভালোবেসেছি এবং অপেক্ষায় থেকেছি আপনার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা নিয়ে এবং এখন জনতা আপনার জন্য কাঁদে এবং তারা আপনার সঙ্গে কথা বলবে। আমি তাদের সংবাদবাহক, এসেছি আপনার কাছে সকাতর প্রার্থনা জানাতে যেন আপনি নিজের সত্তা জনতাকে দেখান এবং আপনার স্বাধীনতার বাইরে যা- কিছু তা তাদেরকে বলেন, সান্ত্বনা দিন তাদের ভগ্নহৃদয়কে এবং আমাদের বোকামি সম্পর্কে শিক্ষা দিন।’ 

কারিমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাকে জ্ঞানী বোলো না, যদি-না সব লোককে তুমি জ্ঞানী বলে ডাক। আমি একটা তাজা ফল, এখনও শাখায় ঝুলে আছি এবং এটা ছিল শুধুমাত্র গতকাল, যখন আমি ফুটেছিলাম। 

‘তোমরা যারা বোকা তাদের ভেতর থেকে কাউকে ডেকো না, সত্যের জন্য আমরা জ্ঞানীও নই, বোকাও নই। আমরা হলাম জীবনবৃক্ষের ওপরের সবুজ পাতা এবং জীবন নিজেই থাকে স্বাধীনতার ঊর্ধ্বে এবং নিশ্চিতভাবে বোকামিরও ঊর্ধ্বে। 

বস্তুতপক্ষে আমি কি নিজেকে তোমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছি? তোমরা জানো না সেটা রক্ষা করার জন্য সেখানে কোনো দূরত্ব নেই এবং আত্মা তাকে কল্পনার ভেতরেও প্রসারিত করে না—এটা আত্মার ভেতরে একটা ছন্দে পরিণত হয়। 

‘যে শূন্যতা তোমার ও তোমাদের অবন্ধুসুলভ নিকট-প্রতিবেশীদের মাঝখানে অবস্থান করে তা বস্তুতপক্ষে মহৎ অন্তত তার চেয়ে, যা তোমার ও তোমার পছন্দের মানুষের ভেতরে অবস্থান করে, যে পছন্দের মানুষেরা বসবাস করে সপ্তভূমি এবং সপ্তসমুদ্রের ওপারে। 

‘স্মৃতির ভেতরে কোনো দূরত্ব নেই এবং শুধুমাত্র বিস্মৃতির ভেতরে স্থলবেষ্টিত উপসাগর রয়েছে, যা তোমাদের কণ্ঠস্বরও নয়, তোমাদের চোখও নয়, যে পারবে বিষয়টি সংক্ষেপ করতে। 

‘সমুদ্রতীর ও পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরের মাঝখানে রয়েছে একটা গোপন পথ, যে পথে অনতিবিলম্বে তোমাকে অবশ্যই ভ্রমণ করতে হবে এবং তুমি পরিণত হবে পৃথিবীর সন্তানদের একজনে। 

‘তোমার জ্ঞান ও বোঝাবুঝির মাঝখানে রয়েছে একটা গোপন পথ যা তোমার আবিষ্কার করা প্রয়োজন এবং অনতিবিলম্বে তুমি মানুষের সঙ্গে একীভূত হও এবং সেখানে তোমার সঙ্গে একজন থাকে।’ 

‘তোমার ডান হাত যা দান করে বাঁ হাত তাই গ্রহণ করে, এর মাঝখানে রয়েছে একটা বিশাল শূন্যতা। শুধুমাত্র তাদের কথা বিবেচনা করে উভয়েই প্রদান করেছে এবং গ্রহণ করেছে। তুমি কি তাদেরকে শূন্যতাহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারো? সেজন্য এটা হচ্ছে শুধুই জানাজানি, যেখানে তুমি ব্যর্থ হয়েছ দান করতে এবং গ্রহণ করতে, যে শূন্যতা তুমি সহজেই অতিক্রম করতে পারো। 

বস্তুত বিশালতম দূরত্ব হচ্ছে সেটাই, যা রয়েছে তোমার নিদ্রার আবিষ্টতা ও বিনিদ্রতার মাঝখানে এবং একটা চুক্তি ও আকাঙ্ক্ষার মাঝখানে। 

‘এবং সেখানে অন্য একটা পথ আছে যে পথে তোমাকে অনতিবিলম্বে অবশ্যই ভ্ৰমণ করতে হবে জীবনের সঙ্গে একীভূত হতে। কিন্তু সেই রাস্তা সম্পর্কে আমি তোমায় বলব না, ওটা দেখেই তোমরা ইতিমধ্যে ভ্রমণ সম্পর্কে ক্লান্ত।’ 

তারপর তিনি সেই নারীর সঙ্গে সামনের দিকে এগোলেন, এমনকি তিনি এবং সেই নয়জন একই সঙ্গে বাজারের দিকে যেতে যেতে কথা বললেন জনতার সঙ্গে, তার বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে এবং তাদের হৃদয় ও চোখের পাতায় ছিল আনন্দ। 

এবং তিনি বললেন, ‘তোমরা নিদ্রার ভেতরে বেড়ে ওঠো এবং পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচো স্বপ্নের ভেতরে। সে কারণে তোমাদের সমস্ত দিন অতিবাহিত হয় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে, রাত্রির নীরবতার ভেতর থেকে যা গ্রহণ করেছ। 

‘প্রায় সময়ই তোমরা রাত্রি সম্পর্কে ভাবো এবং আলোচনা করো যেমন অবসরের ঋতু সম্পর্কে মানুষ করে থাকে। যদিও সত্যের ভেতরে রাত্রি হচ্ছে অন্বেষণের ঋতু এবং অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্য। 

‘দিন তোমাদেরকে দেয় জ্ঞানের শক্তি এবং তোমাদের আঙুলগুলিকে শিক্ষা দেয় গ্রহণের শিল্পকলায় দক্ষতা অর্জন করতে, কিন্তু এটা হল রাত্রি যা তোমাদেরকে নেতৃত্ব দেয় জীবনের ধনভাণ্ডারের দিকে যেতে। 

‘সূর্য সবকিছুকেই শিক্ষা দেয় আলোর জন্য তাদের প্রতীক্ষাকে বাড়িয়ে তুলতে, কিন্তু এটা হচ্ছে রাত্রি যা তাদেরকে নক্ষত্রের দিকে উত্তোলন করে। 

প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে রাত্রির নীরবতা যা বিয়ের অবগুণ্ঠনকে বয়ন করে বৃক্ষসমূহ, বনভূমি ও বাগানের পুষ্পগুচ্ছের ওপর, তারপর বিস্তৃত করে আনন্দোৎসব এবং প্রস্তুত করে বাসরঘর এবং সেই পবিত্র নীরবতার ভেতরে সময়ের গর্ভে ধারণ করে আগামীকালকে। ‘ 

‘এটা তোমাদের সঙ্গে রয়েছে এবং এইমাত্র অন্বেষণের ভেতরে তুমি দেখতে পাও মাংস এবং পরিতৃপ্তি, যদিও সকালে তোমার জাগরণ স্মৃতিকে মুছে ফেলে, স্বপ্নের পাটাতন চিরদিনের জন্য বিস্তৃত হয় এবং বাসরঘরটি অপেক্ষায় থাকে। 

একটা শূন্যতার ভেতরে তিনি নীরব ছিলেন—এমনকি তারাও ছিল তাঁর কথার অপেক্ষায়। তারপর আলমুস্তাফা আবার বললেন, ‘যদিও তোমাদের উদ্দীপনা তোমাদের শরীরের ভেতরে চলাচল করে এবং তেলের মতো পুড়িয়ে ফেলে অন্ধকারকে, যদিও তুমি হচ্ছ একটা বাতির শিখা। 

শরীর রক্ষায় যদি তোমরা ব্যর্থ হয়ে থাকো তখন তোমাদের মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং তোমাদেরকে কিছু বলার অর্থ হবে কেবলি শূন্যতা—যেমন একজন মৃত একজন মৃতকে ডাকে। কিন্তু এটা তা নয়—ওগুলি সবই তোমাদের কাছে মৃত্যুহীন এবং মুক্ত দিন ও রাত্রির ভেতরে। তারা গৃহবাসী হবে না, হবে না প্রতিবন্ধক, সে-কারণে এটাই হল সর্বোচ্চ শক্তির ইচ্ছা। তুমি হলে তার শ্বাসপ্রশ্বাস—যেমন বাতাস—যাকে ধরা যাবে না, যাবে না খাঁচাবন্দি করা এবং আমিও হলাম সেই সর্বোচ্চ শক্তির নিশ্বাসের প্রশ্বাস। 

এবং তাদের ভেতর থেকে আলমুস্তাফা দ্রুতবেগে হেঁটে এসে আবার বাগানে প্রবেশ করলেন। 

আধাবিশ্বাসী সারকিস তখন বলল, ‘প্রভু কুৎসিত কী? কুৎসিত সম্পর্কে আপনি কখনই কিছু বলেন নি 

আলমুস্তাফার জবাবের শব্দগুলি ছিল বেত্রাঘাতের মতো। তিনি বলেন, ‘বন্ধু আমার, কোন লোক আতিথেয়তাশূন্য অবস্থায় তোমাকে ডাকবে, তোমার দরজার শব্দ না করে যদি সে তোমার বাড়ি অতিক্রম করে যায়? 

‘কে তোমাকে বধির ও অমনোযোগী বলে গণ্য করবে যদি সে অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে যার কিছুই তুমি বোঝো না? 

‘এটা সেরকম কেউ নয়—তুমি যার কাছে সংগ্রাম করে কখনই পৌঁছাতে পারবে না, যার হৃদয়ের ভেতরে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা তোমার কখনই ছিল না—তা-ই কি তুমি কুৎসিত মনে করো?’ 

‘কুৎসিত যদি সামান্য কিছু হয়, বস্তুতপক্ষে সেটা তা-ই কিন্তু আমাদের চোখের ওপরের তুলাদণ্ড এবং যে মোম আমাদের কানদুটোকে পূর্ণ করে দিল তার কী হবে? 

‘বন্ধু কোনোকিছুকেই কুৎসিত বোলো না, তোমার নিজের স্মৃতিসমূহের উপস্থিতিতে আত্মার ভীতিকে রক্ষা করো।’ 

একদিন সাদা পপলার গাছের দীর্ঘ ছায়ায় তাঁরা বসেছিলেন। একজন বলল, ‘প্ৰভু আমি সময় সম্পর্কে ভীত। এই সময় আমাদের ওপর দিয়ে চলে যায় এবং হরণ করে আমাদের যৌবন, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের সময় কী দেয়।’ 

আলমুস্তাফা জবাবে বলেন, ‘হাতে তুলে নাও একমুঠো উর্বর মাটি। তুমি কি সেখানে খুঁজে পাও কোনো বীজ কিংবা কীট-পতঙ্গ। তারপরও তোমার হাত প্রশস্ত এবং যথেষ্ট কষ্টসহিষ্ণু হলে হয়তো বীজ পরিণত হতে পারে বনভূমিতে এবং কীট-পতঙ্গ পরিণত হতে পারে একদল দেবদূতে। ভুলো না সেই বছরগুলির কথা যা পরিণত হয় বীজ ও বনভূমিতে এবং কীট-পতঙ্গগুলি দেবদূতে—এই নতুনত্বের অংশস্বরূপ—সমস্ত বছরগুলি—এইগুলি। 

এবং বছরের কোন্ ঋতুগুলি তোমার নিজস্ব পরিবর্তনশীল চিন্তাগুলিকে রক্ষা করে? তোমার বক্ষে জেগে আছে বসন্ত এবং গ্রীষ্মকাল, কিন্তু এটা তোমার নিজস্ব সফলতার একটা স্বীকৃতি। তোমার গানে শরৎ কি একটা প্রাচীন ঋতু নয়—একটি ঘুমপাড়ানি গান, যা তোমার অস্তিত্বে একজন শিশুকেই মূর্ত করে তোলে এবং আমি তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করি, যদিও শীত অন্যান্য ঋতুর স্বপ্নগুলির সঙ্গে তোমার দীর্ঘ ঘুমকে নিরাপদ রাখে। 

সেই জ্ঞানপিপাসু শিষ্য মান্নাস তারপর আলমুস্তাফার চারপাশে তাকাল এবং দেখতে পেল ডুমুরগাছের ফুলের ভেতরে চারাগাছগুলি ফেটে যাচ্ছে এবং সে বলল, ‘প্রভু পরগাছাগুলি দেখুন। ওগুলি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? তারা হচ্ছে ক্লান্ত চোখের পাতাযুক্ত তস্কর, সূর্যের অদম্য সন্তানদের কাছ থেকে তারা আলো চুরি করে এবং সংগ্রহ করে প্রাণরস, যা দ্রুত দৌড়ায় শাখা এবং পাতাগুলির দিকে। 

আলমুস্তাফা উত্তরে বলেন, ‘বন্ধু আমার, আমরা প্রত্যেকেই পরজীবী। আমরা, যারা পরিশ্রম করি ঘাসকে জীবনের স্পন্দনে পরিণত করতে, তারা সেইসব মানুষের ওপরে অবস্থান করে না, যারা ঘাস থেকে সরাসরি জীবনকে গ্রহণ করে ঘাস সম্পর্কে কোনোকিছু না-জেনেই। 

‘একজন মা কি তার শিশুকে বলবে, ‘আমি তোমাকে অরণ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব যে তোমার সর্বোত্তম মাতা, তোমার জন্য আমার হৃদয় ও হাত ক্লান্ত।’ 

‘অথবা কোনো গায়ক কি তার নিজস্ব গান সম্পর্কে তীব্র তিরস্কার করে বলবে : এখন প্রত্যাবর্তন করো সেই প্রতিধ্বনির গুহায়, যেখান থেকে তুমি এসেছিলে তোমার কণ্ঠস্বরের ভেতরে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস গিলে ফেলার জন্য?’ 

‘এবং কোনো মেষপালক কি তার দুইবছর বয়সী মেষশাবককে বলবে : আমার কোনো চারণভূমির কথা জানা নেই যেখানে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি? অতএব এই কারণের জন্য তুমি বিচ্ছিন্ন হও এবং পরিণত হও ত্যাগে।’ 

‘না বন্ধু আমার, সবকিছুরই উত্তর দেওয়া হয়েছে তারা প্রশ্ন করার আগেই এবং তোমার স্বপ্নের মতো তারা ঘুমের আগেই পরিপূর্ণ।’ 

নিয়ম, প্রাচীনত্ব ও সময়হীনতা অনুযায়ী আমরা একে অনের ওপর নির্ভর করে বাঁচি। চলো আমরা মহানুভবতাকে ভালোবেসে বাঁচি। আমরা একাকিত্বের ভেতরে একে অন্যকে খুঁজি এবং আমরা রাস্তায় হাঁটি, যখন পাশাপাশি বসার মতো কোনো অগ্নিকুণ্ড আমাদের নেই।’ 

‘আমার বন্ধু ও ভায়েরা শোনো, প্রশস্ত পথ হচ্ছে তোমাদের সমকক্ষ সঙ্গীদের জন্য।’ 

‘এই চারাগুলি বৃক্ষের ওপর বাঁচে, রাত্রির মধুর নীরবতার ভেতরে মাটি থেকে শুষে নেয় রস এবং মাটি তার শান্তিপূর্ণ স্বপ্নের ভেতরে সূর্যের স্তন্য চুষে খায়।’ 

‘এবং সূর্য, এমনকি তুমি, আমি এবং প্রত্যেকেই রাজকুমারের ভোজসভায় সমমর্যাদা নিয়ে বসে আছি—যে রাজকুমারের দরজা সবসময় খোলা এবং যার খাবার টেবিল সবসময়ই বিস্তৃত।’ 

‘মান্নাস, বন্ধু আমার, সেখানে যাকিছু আছে সবকিছুই জীবন্ত এবং সবকিছুই সেখানে আস্থার ভেতরে বাঁচে, যা তীরহীন এবং সর্বোচ্চ শক্তির উদারতার ওপরে অবস্থিত।’ 

.

একদিন ঊষালগ্নের আকাশ যখন বিবর্ণ তখন প্রত্যেকেই একসঙ্গে বাগানের ভেতরে হাঁটছিল এবং পূর্বদিকে তাকিয়ে উদিত সূর্যের উপস্থিতিতে প্রত্যেকেই ছিল নীরব। 

এবং অল্প কিছুক্ষণ পর আলমুস্তাফা নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললেন এবং বললেন, ‘একটি শিশিরবিন্দুতে ভোরের সূর্যের প্রতিমূর্তি সূর্যের চেয়ে কোনো অংশে ক্ষুদ্র নয়। তেমনি তোমাদের আত্মায় জীবনের প্রতিফলনও কম নয় জীবনের চেয়ে। 

‘শিশিরবিন্দু আলো প্রতিফলিত করে, কারণ তা আলোর সঙ্গে একীভূত এবং তোমরা প্রতিফলিত করো জীবনকে, কারণ তোমরা আর জীবন, একজন। 

‘যখন তোমরা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাও, তখন বলো : এ অন্ধকার হচ্ছে ঊষালগ্ন যে এখনও জন্মায়নি এবং যদিও রাত্রির প্রসবযন্ত্রণা আমাতেই পূর্ণ হবে, এমনকি আমার জন্য জন্ম হবে ঊষালগ্নের—যেমন পাহাড়গুচ্ছের জন্য জন্ম হয়। 

‘শিশিরবিন্দু গোল আকার নিচ্ছে পদ্মফুলের ওপর গোধূলির ছায়ায়, যেমন তোমরা একত্রিত করো তোমাদের আত্মাকে ঈশ্বরের হৃদয়ে। 

‘একটা শিশিরবিন্দু কি কখনও বলবে : হাজার বছরের আমি একবার শিশিরবিন্দু হব? উত্তরে তোমরা বলছ : তুমি জানো না যে সবগুলি বছরের আলো জ্বলছে তোমার বৃত্তের ভেতরে। 

.

এক সন্ধ্যায়, এক বিশাল ঝড় পরিদর্শন করে গেল জায়গাটা এবং আলমুস্তাফা, তার শিষ্যগণ এবং সেই নয়জন বাগানের ভেতরে গিয়ে আগুনের পাশে বসলেন, তখনও তারা ছিলেন নীরব ও নিশ্চুপ।

তারপর এক শিষ্য বলল, ‘প্রভু আমি একা, সময়ের দ্রুতগামী অশ্বক্ষুরের প্রচণ্ড পদাঘাত আমার বুকে।’ 

আলমুস্তাফা তাদের মাঝে উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রচণ্ড বাতাসের মতো উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘একা? তাতে কী হয়েছে? তুমি একা এসেছ এবং একাই তোমাকে এই ধোঁয়াশা অতিক্রম করতে হবে।’ 

‘সেখানে নীরবতার ভেতরে তোমার পানীয় তুমি একই পান করো। শরতের দিনগুলো দিয়েছে অন্য ঠোঁট ও অন্য কাপ এবং তিক্ত ও মধুর সুরায় পূর্ণ করেছে তাদের– এমনকি তোমার কাপও পূর্ণ করে দিয়েছে তারা। 

একাকী পান করো তোমার পানীয় যদিও এর স্বাদ তোমার রক্ত ও অশ্রুর মতো এবং প্রশংসা করো জীবনকে তৃষ্ণা উপহার দেবার জন্য, আর তৃষ্ণাহীন হৃদয় হচ্ছে উষর সমুদ্রের মতো, সংগীতহীন এবং স্রোতহীন।’ 

‘পান করো তোমার পানীয় একাকী এবং পান করো উল্লাসের সঙ্গে।’ 

‘তোমার মাথার ওপরে তোমার কাপটা তুলে ধরো এবং তাদের উদ্দেশ্যে গভীরতম পানে মগ্ন হও যারা একাকী পান করে।’ 

‘একবার আমার আকাঙ্ক্ষা হয়েছিল মানুষের সঙ্গ পাওয়ার এবং তাদের সঙ্গে বসেছিলাম তাদের ভোজ-উৎসবের টেবিলে এবং তাদের সঙ্গে মেতে উন্মত্তের মতো পান করেছিলাম, কিন্তু তাদের সুরা আমার মাথা পর্যন্ত উঠতে পারেনি, পারেনি এর স্রোত আমার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছাতে। এই সুরা শুধুমাত্র নেমে যায় আমার পায়ের দিকে। আমার স্বাধীনতা পরিত্যক্ত হয়েছিল শুষ্ক অবস্থায় এবং আমার হৃদয় ছিল তালাবদ্ধ এবং সিলমোহরকৃত। শুধু আমার পা ছিল তাদের সঙ্গে, তাদের কুয়াশার ভেতরে। 

এবং আর একবারও আমি মানুষের সঙ্গ পেতে চেষ্টা করিনি, চেষ্টা করিনি তাদের সঙ্গে সুরা পান করতে। 

সুতরাং আমি তোমাকে বলি, যদিও তোমার হৃদয়ে সময়ের দ্রুতগামী অশ্বক্ষুরের প্রচণ্ড পদাঘাত—আসলে এটা কী? একাকী তোমার জন্য তোমার দুঃখভর্তি কাপের পানীয় পান করাই শ্রেয় এবং তোমার আনন্দভর্তি কাপও তুমি একাই পান করবে। 

একদিন এক গ্রিক নাগরিক ফারদ্রোউজ সেই বাগানে হাঁটছিল, একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে সে রেগে গেল এবং ঘুরে পাথরটা তুলে নিচুস্বরে বলল, ‘আমার চলার পথে মৃত বস্তু!’ তারপর সে সজোরে পাথরটা ছুড়ে মারল। 

এবং সবার অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের আলমুস্তাফা বললেন : 

‘কেন তুমি ওকে মৃত বস্তু বলছ? তুমি কি দীর্ঘসময় ধরে এই বাগানে আছ এবং তুমি কি জানো না এখানে কেউ মৃত নয়? দিবসের জ্ঞান এবং রাত্রির রাজকীয় ক্ষমতার সবকিছুই জীবন্ত এবং উজ্জ্বল। তুমি এবং পাথর হচ্ছে একজন। পার্থক্য শুধু হৃদস্পন্দনে। তোমার হৃদস্পন্দন কিছুটা দ্রুত নয় কি বন্ধু আমার? কিন্তু এটাও চুপচাপ নয়। 

এর ছন্দ হতে পারে অন্য কোনো ছন্দ, কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলছি, যদি তোমরা আত্মার গভীরে শব্দ করো এবং পরিমাপ কর শূন্যের উচ্চতার তাহলে শুধুই শুনবে একটা সুর এবং সেই সুরের ভেতরে নিখুঁত ঐক্যসহ পাথর ও নক্ষত্র গাইবে গান। 

তোমাদের বোঝাবুঝির পর্যায়ে গিয়ে যদি আমার কথা না-পৌঁছায়, তাহলে আরেকটা উষালগ্ন পর্যন্ত তা দীর্ঘ হতে দেওয়া যায়। তুমি পাথরকে অভিশাপ দিয়েছ, কারণ অন্ধত্বের কারণে তার ওপর হোঁচট খেয়েছ তুমি। তারপর তুমি কী অভিশাপ দেবে একটা নক্ষত্রকে যদি তোমার মস্তিষ্ক আকাশে তার সঙ্গে শত্রুতার কারণে মুখোমুখি হয়? কিন্তু সেই দিন আসবে যখন উপত্যকায় শিশুদের পদ্মফুল তোলার মতো একত্রিত করবে তুমি পাথর ও নক্ষত্রপুঞ্জ এবং তারপর তুমি জানবে যে এই সবকিছুই জীবন্ত এবং সুরভিত।’ 

সপ্তাহের প্রথম দিনে মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ তাদের কানে এসে পৌঁছালে একজন বলে, ‘প্রভু আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছি। তাঁর সম্পর্কে আপনি কী বলেন এবং প্রত্যেক চূড়ান্ত সত্যের ভেতরে তিনি কে? 

বাতাস ও ঝড়ে ভয়হীন একটা তরুণ বৃক্ষের মতো আলমুস্তাফা তাদের মুখোমুখি দাঁড়ান ও উত্তরে বলেন, ‘ভাবো আমার সঙ্গী এবং পছন্দের মানুষেরা—একটা হৃদয় ধারণ করে তোমাদের সবগুলি হৃদয়কে, একটা ভালোবাসা বেষ্টন করে সমস্ত ভালোবাসাকে, একটা আত্মা আবৃত করে তোমাদের সমস্ত আত্মাকে, একটা কণ্ঠস্বর ঢেকে ফেলে তোমাদের সমস্ত কণ্ঠকে এবং একটি নীরবতা তোমাদের নীরবতার চেয়েও গভীর ও সময়হীন। 

‘এখন তোমার নিজের পরিপূর্ণতার ভেতরে উপলব্ধি করার জন্য অন্বেষণ করো—একটি সৌন্দর্য যা অধিক মোহিত করে সমস্ত সুন্দর জিনিসের চেয়ে, একটি গান সমুদ্রসংগীত ও বনভূমির চেয়ে অধিকতর বিশাল, একটি রাজকীয় ক্ষমতা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সেজন্য কালপুরুষ হচ্ছে একটা জলচৌকি- ধরে আছে একটা রাজদণ্ড—যেখানে দৈত্য অ্যাটলাসের সপ্তকন্যারা শিশিরবিন্দুর ক্ষীণ আলো রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

তোমরা সবসময়ই শুধু অন্বেষণ করেছ খাবার, আশ্রয়, একটি পোশাক এবং একটি লাঠি— এখন একজনকে খোঁজ করো যে তোমার তীরের লক্ষ্যবস্তু নয়, নয় তোমাকে সমস্ত কিছু থেকে রক্ষা করার একটা পাথুরে গুহা। 

যদি আমার কথা কঠিন ও প্রহেলিকা মনে হয় তাহলে অন্বেষণ করো, অবশ্য তা সত্ত্বেও তোমার হৃদয় ভেঙে যেতে পারে এবং তোমার প্রশ্নগুলি তোমাকে নিয়ে যেতে পারে ভালোবাসা এবং সর্বোচ্চ শক্তিমানের স্বাধীনতার কাছে—যাকে মানুষ ঈশ্বর বলে ডাকে।’ 

এবং তারা প্রত্যেকেই নীরব ছিল এবং হৃদয়ের ভেতরে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল এবং আলমুস্তাফা সমবেদনায় সক্রিয় হন তাদের জন্য এবং কোমল অথচ স্থিরদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমাদের পিতা ঈশ্বর সম্পর্কে এখন আর অধিক কথা না-বলাই শ্রেয়। বরং তার চেয়ে এসো আমরা ঈশ্বরের প্রকৃতি, তোমাদের প্রতিবেশী এবং ভাইদের নিয়ে কথা বলি। এমনকি সেইসব উপাদান নিয়ে কথা বলা যায়, যা তোমাদের গৃহ ও শস্যক্ষেতের ভেতরে চলাচল করে।’ 

‘কল্পনায় তুমি মেঘের দিকে উঠে যাবে এবং অনুভব করবে এর উচ্চতা। তুমি অতিক্রম করে যাবে বিশাল সমুদ্র এবং তুমি এটা দাবি করবে দূরত্বে পরিণত হওয়ার জন্য। কিন্তু আমি বলছি যে, যখন তোমরা মাটিতে একটা বীজ বপন করো, তখন তোমরা বিশাল আলোর কাছে পৌঁছে যাও এবং যখন তোমরা প্রতিবেশীদেরকে সকালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আহ্বান জানাও, তখন তোমরা অতিক্রম করো বৃহত্তর সমুদ্র।’ 

‘প্রায়ই তোমরা ঈশ্বরের প্রার্থনা করো—যা হচ্ছে অনন্ত এবং সত্যের ভেতরে তোমরা সেই গান শোনো না। তোমরা কি সেই পাখির গান শুনতে পাও এবং সেই পত্রপল্লবের গান—বাতাস এলে যা ঝরে যায় এবং ভুলে যেও না বন্ধুরা, এই গান শুধুমাত্র তখনই শোনা যায় যখন তা শাখা থেকে পৃথক হয়ে যায়।’ 

‘ঈশ্বর সম্পর্কে এত খোলাখুলি কথা না বলার জন্য আমি তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি। বরং উপলব্ধির চেয়ে তোমরা কথা বলো একে অন্যের সঙ্গে, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর সঙ্গে, ঈশ্বর ও তার প্রকৃতির সঙ্গে। 

পাখির বাসায় সদ্য পালকগজানো শাবককে কে আহার জোগাবে যদি মা-পাখিটা শুধুই আকাশে উড়ে বেড়ায়? এবং কোনো বায়ুপরাগী পুষ্প পূর্ণ করে দেবে মাঠ যদি মৌমাছি অন্য কোনো পুষ্পে পরাগায়ন না ঘটায়? 

শুধুমাত্র যখন তুমি তোমার ক্ষুদ্র আত্মার ভেতরে নিজে হারিয়ে যাও তখন তা অন্বেষণ করো আকাশে—যাকে তোমরা বলো ঈশ্বর। তোমরা কি পারবে তোমাদের বিশাল আত্মার ভেতরে কোনো পথ অনুসন্ধান করতে—তোমরা কম পরিশ্রমেও তা করতে পারো, তবে পথগুলো হতে হবে ইট দিয়ে ঢাকা। 

আমার নাবিকদল এবং আমার বন্ধুরা, ঈশ্বর সম্পর্কে কম বলাই হল বিজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া, যা আমরা বুঝতে পারি না এবং প্রত্যেকেই যা বেশি জানে তা আমরা বুঝতে পারি। যদিও আমি জেনেছি যে আমরা ঈশ্বরের শ্বাস-প্রশ্বাস এবং তার সুগন্ধ। আমরাই ঈশ্বর, গাছের পাতায়, ফুলে এবং কখনও কখনও ফলের ভেতরে।’ 

এবং এক সকালে সূর্য যখন বেশ উপরে উঠে এসেছিল, তখন একজন শিষ্য— ছেলেবেলায় যে তিনজনের সঙ্গে তিনি খেলা করতেন তাদের একজন আলমুস্তাফার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, ‘প্রভু আমার পোশাকটি বহুব্যবহারে জীর্ণ এবং আমার আর কোনো পোশাক নেই, সুতরাং আমার ছুটি মঞ্জুর করুন আমাকে বাজারে যেতে এবং দর কষাকষি করতে, সম্ভবত আমি আমাকে প্ররোচিত করব একটা নতুন পোশাক কিনতে।’ 

এবং আলমুস্তাফা যুবকটির দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘ তোমার পোশাকটা আমাকে দাও।’ এবং সে তাই করল এবং নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকল মধ্যদিনের আলোয়। 

এবং আলমুস্তাফা এমন স্বরে কথা বললেন যেন যুবক ঘোড়া রাস্তার ওপর দৌড়াচ্ছে; শুধুমাত্র নগ্নতাই সূর্যের আলোতে বাঁচতে পারে। শিল্পহীনতাই শুধুমাত্র চড়তে পারে বাতাসের ওপর এবং সে একাকী, যে হাজারবার পথ হারিয়েছে বাড়ি ফেরার আকাঙ্ক্ষায়। 

ধূর্তদের নিয়ে দেবদূতেরা ক্লান্ত। কিন্তু গতকাল এক দেবদূত আমাকে বলল আমরা নরক তৈরি করেছি তাদের জন্য, যারা জ্বলজ্বলে। কিন্তু আগুন মুছে দিতে পারে উজ্জ্বল উপরিভাগ এবং এর মর্মে গিয়ে তা গলে যায়। 

‘এবং আমি বলেছিলাম : কিন্তু নরক তৈরির সময়, নরক শাসন করার জন্য ঈশ্বর তৈরি করেছ দানব। কিন্তু দেবদূত উত্তর দিল : না, নরক শাসিত হয় তাদের দ্বারা, যারা আগুনে আত্মাহুতি দেবার জন্য প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন হয় না।’ 

‘জ্ঞানী দেবদূত! সে মানব ও অর্ধমানবের পথ চেনে। সে সর্বোচ্চ শ্রেণীর দেবদূতদের একজন, যে নবীদেরকে সাহায্য করতে আসে, যখন তারা ধূর্তদের দ্বারা প্রলুব্ধ হন। এবং সন্দেহ নেই, সে হাসে যখন নবীরা হাসেন, তেমনি সেও কাঁদে যখন নবীরা কাঁদেন।’ 

‘আমার বন্ধুগণ এবং আমার নাবিকদল, কেবলমাত্র নগ্নতাই সূর্যালোকে জীবন্ত। শুধুমাত্র রাডারশূন্য জলযানই পারে বৃহত্তর সমুদ্র পাড়ি দিতে। একমাত্র সে-ই, যে রাত্রির সঙ্গে অন্ধকারে একাকার, আবার জেগে উঠবে ঊষালগ্নের সঙ্গে এবং সে-ই, যে বরফের নিচে শিকড়ের সঙ্গে ঘুমায়, আবার পৌছে যাবে ঠিকই বসন্তের দ্বারপ্রান্তে। 

‘তোমাদের জন্য, এমনকি শিকড়ের মতো এবং শিকড়েরা তোমাদের মতো সাধারণ, যদিও তোমাদের স্বাধীনতা আছে যা তোমরা পেয়েছ মাটির কাছ থেকে এবং তোমরা নিশ্চুপ, যদিও তোমরা আছ, জন্ম হয়নি এরকম শাখাসমূহের ভেতরে। 

‘তোমরা হলে ক্ষণস্থায়ী এবং নিরাকার, যদিও তোমরাই আকাশের মুখোমুখি দৈত্যাকৃতির ওক এবং আধা-পেন্সিল রীতিতে আঁকা উইলোর শুরু। 

‘আরও একবার আমি বলছি, কিন্তু শিকড়েরা চারকোনা অন্ধকার এবং গতিশীল স্বর্গের মাঝখানে অনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। এবং আমি প্রায় সময়ই দেখেছি তোমরা আলোর সঙ্গে নৃত্য করার জন্য বেড়ে উঠছ, কিন্তু আমি আরও দেখেছি—তোমরা লজ্জিত। সব শিকড়ই লজ্জিত হয়। তারা তাদের হৃদয়কে লুকিয়েছে ততদিন, যতদিন তারা জানত না আত্মার সঙ্গে কী করতে হয়। 

‘কিন্তু মে আসবেই। মে হচ্ছে ক্লান্তিহীন এক কুমারী এবং সে হচ্ছে পাহাড়শ্রেণী ও সমতল ভূমির জননী। ‘ 

শিষ্যদের ভেতরে একজন ছিল মন্দিরের সেবক, সে সকাতরে প্রার্থনা করে বলল : প্ৰভু আমাদেরকে শিক্ষা দিন যেন আমাদের কথা হতে পারে আপনার কথা— এমনকি তা হতে পারে জনতার প্রতি ক্রুদ্ধতা এবং গুণকীর্তন।’ 

এবং আলমুস্তাফা উত্তরে বললেন, ‘তোমরা বেড়ে উঠবে তোমাদের কথারও ওপরে, কিন্তু তোমাদের পথে থাকবে ছন্দ এবং সুগন্ধ—সুগন্ধ থাকবে ভালোবাসার জন্য এবং সবকিছু থাকবে তাদের জন্য যারা সপ্রাণ বেঁচে থাকবে এই বাগানে। 

‘তোমরা উঠবে তোমাদের কথারও ওপরে একটা পাহাড়চূড়ায়, যেখানে নক্ষত্রের ধুলোরা ঝরে পড়ে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা হাত খুলে রাখো যতক্ষণ না মুঠো ভরছে। তারপর তোমরা শুয়ে পড়বে এবং ঘুমিয়ে যাবে একটা সাদা পাখির বাসায় সাদা পাখিশাবকের মতো এবং তারপর তোমরা স্বপ্ন দেখবে তোমাদের আগামীকালের—যেমন বসন্তের সাদা ও বেগুনি মেশানো স্বপ্ন। 

শোনো, তোমরা তোমাদের কথার চেয়েও গভীরতম নিচে চলে যাবে। তোমরা স্রোতসমূহের হারিয়ে যাওয়া আদি উৎস অনুসন্ধান করবে এবং তোমরা পরিণত হবে একটা গোপন গুহায়, যার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয় তোমাদের গভীরে যা তোমরা এখনও পর্যন্ত শোনোনি। 

‘তোমাদের কথার চেয়েও তোমরা গভীরতম নিচে চলে যাবে, এমনকি সমস্ত শব্দের চেয়েও অধিক গভীরে, পৃথিবীর হৃদয়ের দিকে এবং সেখানে তোমরা তার সঙ্গে একা হবে, যিনি ছায়াপথের ওপর দিয়ে হাঁটেন।’ 

এবং কিছুক্ষণ পর অন্য এক শিষ্য জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রভু আমাদেরকে সত্তা সম্পর্কে বলুন। কীভাবে তা হয়?’ 

আলমুস্তাফা তার দিকে দীর্ঘক্ষণ ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শিষ্যদের কাছ থেকে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসতে আসতে বললেন, ‘এই বাগানে আমার পিতা ও মাতা শায়িত, জীবন্ত মানুষের হাত তাদেরকে সমাহিত করেছে এবং এই বাগানে শুয়ে আছে গতবছরের বপনকৃত বীজ যা তোমাদেরকে বাতাসেরও পাখার ওপরে তুলে নেয়। আমার বাবা ও মা হাজারবার এখানে সমাহিত হবে এবং হাজারবার বাতাস বপন করবে বীজ এবং এখন হতে হাজার বছর তুমি, আমি এবং ফুলগুলি একসঙ্গে এই বাগানে আসব—এই এখনকার মতো এবং জীবনকে ভালোবেসে আমরা হয়ে উঠব শূন্যতার স্বপ্ন এবং আমরা হয়ে উঠব উদিত সূর্যের কাছাকাছি। 

‘কিন্তু আজ, এই এখন ‘হয়ে ওঠা’ হচ্ছে বিচক্ষণ হওয়া, যদিও একজন অচেনা লোক বোকা হবে না, সে হবে শক্তিশালী, কিন্তু দুর্বলের অকর্মণ্যতাও কখনও হয়ে উঠবে না। খেলা করো উঠতি বয়সী শিশুদের সঙ্গে, তবে পিতা হিসেবে নয় বরং খেলার সঙ্গী হিসেবে, যারা তাদের খেলা শিখবে। 

বৃদ্ধ পুরুষ ও নারীর সঙ্গে সাধারণ ও সরল হও এবং প্রাচীন ওকগাছের ছায়ায় তাদের সঙ্গে বসো—যদিও এখনও তুমি বসন্তের সঙ্গে হাঁটছ। 

অনুসন্ধান করো একজন কবির, যদিও সে বসবাস করতে পারে সপ্তনদীর ওপাড়ে এবং তার উপস্থিতিতে শান্তি আসতে পারে—কোনো চাহিদার কিছু নেই, কোনো সন্দেহের কিছু নেই এবং তোমাদের ঠোঁটেও কোনো প্রশ্ন নেই। ‘ 

‘তোমরা জেনে রাখো সাধু ও শয়তান হচ্ছে জমজ ভাই, যাদের পিতা হচ্ছে আমাদের ক্ষমতাশীল রাজা এবং একজনের জন্ম হয়েছিল অন্যজনের জন্মের পূর্বমূহূর্তে—সে কারণে আমরা তাকে যুবরাজ বলে গণ্য করি। 

‘সৌন্দর্যকে অনুসরণ করো, যখন সে তোমাদেরকে নিয়ে যাবে খাড়া ও উঁচু পাহাড়চূড়ার সীমানায় এবং যদিও সে পাখাযুক্ত এবং তোমাদের কোনো পাখা নেই এবং যদিও সে পাহাড়চূড়ারও ওপর দিয়ে তোমাদেরকে অতিক্রম করে যাবে—অনুসরণ করো তাকে সেই পর্যন্ত, যেখানে সৌন্দর্য নেই—যেখানে কিছুই নেই। 

‘তোমরা দেয়ালবিহীন বাগান হও—হও মালিকহীন একটা আঙুরক্ষেত এবং হও একটা কোষাগার, যা চির উন্মুক্ত থাকবে পথিকদের জন্য।’ 

‘অপহৃত হও, প্রতারিত হও, হও বঞ্চিত—হ্যাঁ, বিপথে চালানো, ফাঁদে আটকানো এবং তারপর বিদ্যুৎবাণে জর্জরিত হওয়া—এই সবকিছুসহ তোমাদের বৃহত্তম সত্তার উচ্চতা থেকে যদি নিজের দিকে তাকাও এবং হাসো, তাহলে সেসব জেনে বসন্ত আসবে তোমাদের বাগানে পাতায় পাতায় নৃত্য করতে এবং তোমাদের আঙুর পাকাতে আসবে শরৎ—এসব জেনে যদি একটা জানালা পূবের দিকে খোলা রাখো তবে তোমরা কখনই শূন্য হবে না—এসব জেনে অপরাধী, লুটেরা, প্রতারক ও বঞ্চনাকারী বলে তোমরা যাদের মনে করো, তারাও তোমাদের ভাই এবং তোমরা প্রত্যেকেই ও সবকিছুই সেই অদৃশ্য নগরের আশীর্বাদকৃত অধিবাসীদের চোখে আকস্মিক—যে নগর এই নগররেরও ওপরে। 

এবং এখন তোমরাও, যাদের হাত অলংকৃত এবং যে হাতগুলি সমস্ত জিনিস খুঁজে বেড়ায়, যেগুলি আমাদের দিন ও রাত্রির আয়েশের জন্য প্রয়োজনীয়। 

‘হওয়া’ অর্থ হচ্ছে দৃশ্যমান আঙুলসহ একজন বয়নকারী হওয়া, যে আলো ও শূন্যতার একজন মনোযোগী নির্মাতা। তোমরা কৃষিজীবী হও এবং অনুভব করো যে তোমাদের বপনকৃত প্রতিটি বীজের ভেতরে তোমরা লুকিয়ে রাখছ এক-একটা কোষাগার, একজন জেলে বা শিকারি হও মাছ ও পশুদের প্রতি দরদ নিয়ে—যদিও মানুষের ক্ষুধা ও প্রয়োজনের জন্য রয়েছে বৃহত্তর নিষ্ক্রিয় নম্রতা। 

এবং সবকিছুর ওপরে একথা বলছি যে, আমি তোমাদেরকে এবং তোমাদের প্রত্যেক অংশীদারকে গ্রহণ করব প্রত্যেকের উদ্দেশ্য অনুযায়ী। সুতরাং শুধুমাত্র সেজন্যই তোমাদের নিজের ভালো উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করার আশা করবে। 

কথা বলতে বলতে আলমুস্তাফা থামলেন এবং সেখানে নয়জনের ওপরে বিষাদ ও হতাশার ভাব নেমে এল এবং তাদের হৃদয় তখন অন্যদিকে পরিবর্তিত হল, কারণ তারা তাঁর কথা বুঝতে পারল না। 

এবং তারা দেখে, যে তিনজন নাবিক প্রতীক্ষা করছিল সমুদ্রে যাবার জন্য—যারা মন্দিরের সেবক তাদের ব্যাকুলতা ছিল মন্দিরের জন্য এবং যারা তার খেলার সঙ্গী ছিল তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাজার এলাকায় ফিরে যাওয়ার। তারা প্রত্যেকেই তার কথায় বধির হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তার যাবতীয় শব্দাবলি ক্লান্তিকর ও নীড়হারা পাখির আশ্রয় অনুসন্ধানের মতোই তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন করে। 

আলমুস্তাফা বাগানের ভেতরেই তাদের থেকে কিছুদূর হেঁটে গেলেন, কিছুই বললেন না এমনকি তাদের দিকে তাকালেনও না। 

তারা নিজেদের ভেতরে কারণ খুঁজতে শুরু করল এবং অনুসন্ধান করল কৈফিয়ত, নিজেদের প্রতীক্ষার জন্য— যা নিঃশেষিত হয়েছে। 

তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেল, ফলে তাদের অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের আলমুস্তাফা একা হয়ে গেলেন। 

তারপর যখন পুরোপুরি রাত্রি নেমে এল, তিনি তাঁর মায়ের কবরের পাশে গিয়ে কবরের ওপর বেড়ে ওঠা একটা সীড়ার গাছের নিচে বসলেন এবং আকাশের ওপর থেকে বিশাল আলোর ছায়া সেখানে নেমে এল এবং বাগানটি পৃথিবীর বক্ষঃস্থলের ওপর জহরতের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। 

এবং আলমুস্তাফা তার আত্মার নিঃসঙ্গতার ভেতরে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন : 

‘আমার আত্মা তার নিজস্ব পাকা ফলে ভর্তি হয়ে আছে। সেখানে কে আছে যে আসবে, তা গ্রহণ করবে এবং তুষ্ট হবে? সেখানে কী একজনও নেই যে উপবাস করেছে এবং কে মনের দিক থেকে দয়ালু ও উদার-যে আসে এবং তার উপবাস ভাঙায়—সূর্যের প্রতি আমার এই দ্রুত অবনত হওয়া এবং আমার নিজস্ব অতিপ্রাচুর্যের ওজন বহন করা আমার জন্য সহজসাধ্য। 

‘আমার আত্মা যুগের মদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে, সেখানে কি একজনও তৃষ্ণার্ত নেই যে আসে এবং পান করে? 

দ্যাখো, সেখানে একজন মানুষ তার দুহাত পথিকদের উদ্দেশে সামনের দিকে বাড়িয়ে দুই রাস্তার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েছিল এবং তার হাতভর্তি ছিল জহরত এবং সে পথিকদের ডেকে ডেকে বলছিল : 

আমাকে দয়া করুন এবং আমার হাত থেকে নিন। ঈশ্বরের নামে আমার হাতটা খালি করুন এবং আমাকে সান্ত্বনা দিন। 

কিন্তু পথিকেরা শুধুই তার দিকে তাকাল এবং কেউ তার হাত থেকে কিছুই নিল না। 

বরং পাওয়ার জন্য দুহাত পেতে সে ভিক্ষুক হবে। হ্যাঁ হ্যাঁ−ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকা একটা হাত এবং সে তা শূন্য অবস্থায় তুলে আনে বক্ষঃস্থলে—বাড়িয়ে রাখা দামি উপহারভর্তি হাত থেকে কেউ কিছু না-নেওয়ার চেয়ে এটাই উত্তম। 

‘এবং দ্যাখো সেখানে একজন উদার রাজকুমারও ছিল, যে পাহাড় ও মরুভূমির মাঝখানে নরম ও মসৃণ তাঁবু উঁচু কর তুলেছিল— এবং ভৃত্যকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আগুন জ্বালতে যা কিনা আগন্তুক ও পথভ্রষ্ট মানুষের চিহ্ন এবং যে তার দাসকে সামনে এগিয়ে দেয় রাস্তার ওপর লক্ষ্য রাখতে যেন সে প্রেতাত্মাকে পথ দেখাতে পারে, কিন্তু মরুভূমির রাস্তা ও ছোট ছোট পথগুলি ছিল প্রাকৃতিক রীতিতে অনুর্বর এবং সে কাউকেই দেখতে পায়নি। 

বাস্তবিক অর্থে ঐ রাজকুমার ছিল এমন একজন মানুষ যাকে কোথাও কখনও দেখা যায় না, কিন্তু সে খাবার ও আশ্রয় অন্বেষণ করে। সমস্ত ব্যর্থতাসহ সে ছিল পথভ্রষ্ট, কিন্তু তার ছিল একটা ছড়ি এবং মাটির পাত্র। তারপর রাত্রি নেমে এলে সে তার জ্ঞাতিবর্গ এবং যে কবিদের কোথাও কখনও দেখা যায় না তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এবং ভাগাভাগি করবে তাদের চরম দারিদ্র্য, স্মৃতি এবং তাদের স্বপ্ন। 

এবং দ্যাখো এক মহৎ রাজার কন্যা ঘুম থেকে জেগে উঠে পরিধান করেছিল মসৃণ ও নরম পোশাক, এমনকি তার মুক্তা ও চুনি-পান্নাগুলি এবং সে তার চুলের ওপরের মুখোশটা ইতস্তত ছড়িয়েছিল এবং আঙুল ডুবিয়েছিল অম্বরে। তারপর সে তার উঁচু অট্টালিকা থেকে বাগানে অবতরণ করেছিল, যেখানে তার সোনালি চটির ওপর পড়েছিল রাতের শিশির। 

রাতের নীরবতার ভেতরে মহৎ রাজার কন্যাটি এই বাগানে ভালোবাসা অনুসন্ধান করেছিল কারণ তার পিতার বিশাল সম্রাজ্যে তার প্রেমিক হওয়ার মতো কেউ ছিল না। 

প্রকৃত অর্থে সে ছিল একজন চাষির কন্যা, যে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে ভেড়ার পাল এবং সন্ধেবেলা বেঁকে যাওয়া রাস্তা ধরে ধুলোমাখা পায়ে এবং পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে দ্রাক্ষাক্ষেতের সুগন্ধ নিয়ে ফিরে আসছে পিতার বাড়িতে। এবং যখন রাত্রি এল এবং রাতের দেবদূত নেমে এল পৃথিবীর ওপর— চাষিকন্যা তখন তার পদক্ষেপ লুকাবে নদীতীরবর্তী উপত্যকা পর্যন্ত, যেখানে তার প্রেমিক অপেক্ষা করছিল। 

সেই চাষিকন্যা ছিল আশ্রমের একজন নান, যে সৌরভের জন্য তার হৃদয় পোড়াচ্ছে যেন তার হৃদয় বাতাসের দিকে উঠে যেতে পারে এবং নিঃশেষিত করছে উদ্দীপনা। জ্বালাচ্ছে মোমবাতি একটা আলোর জন্য, যা বেড়ে উঠে ধাবিত হচ্ছে বৃহত্তর আলোর দিকে— ঐ সবসহ কে উপাসনা করে এবং কে প্রিয় ও পছন্দের? 

‘মূলত সে হচ্ছে প্রাচীন বছরগুলির নারী, বসছে সূর্যালোকের ভেতরে এবং স্মরণ করছে কে তার যৌবন ভাগাভাগি করেছিল।’ 

এবং রাত্রি গভীর হলে রাত্রির সঙ্গে আলমুস্তাফাও অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন এবং তার উদ্দীপনা ছিল পুঞ্জীভূত মেঘের মতো এবং তিনি আবার কেঁদে ফেললেন : 

নিজস্ব পাকা ফলে আমার আত্মা 
বোঝাই হয়ে আছে, 
পাকা ফলে বোঝাই আমার হৃদয়। 
কে এখন আসবে, খাবে এবং পরিপূর্ণ হবে? 
আমার আত্মা উপচে পড়ছে আত্মার মদ 
এখন কে এই মদ ঢালবে, পান করবে এবং 
মরুভূমিসম তৃষ্ণা মিটিয়ে ক্লান্ত হবে। 

‘আমি কি একটা ফুল ও ফলহীন বৃক্ষ হব?’ 

অতিপ্রাচুর্যের যে যন্ত্রণা, তা বন্ধ্যাত্বের যন্ত্রণার
চেয়েও অধিক যন্ত্রণাদায়ক। 
এবং ধনীর দুঃখ হচ্ছে তার কাছ থেকে
কেউ কিছু নেবে না। যাকে কেউ কিছু দেবে না
এরকম ভিক্ষুকের দুর্দশার চেয়েও এটা বড়। 

আমি কি একটা শুষ্ক ও রৌদ্রদগ্ধ কুয়া হব,
মানুষ যার ভেতরে ক্রমাগত পাথর ফেলছে। 

পথিকেরা আমাকে অতিক্রম করে যাবে এবং
আমার পানি পান করবে না—সে কারণে জীবন্ত
পানির উৎস হওয়ার চেয়ে এভাবে জন্মানো ছিল 
ঢের উত্তম ও সহজ। 

আমি কি একটা নলখাগড়া হব যা পায়ের তলায় দলিত হয়।
এর চেয়ে রুপালি তারের বাদ্যযন্ত্র হওয়া উত্তম। 
এমনকি অধিক উত্তম যে বাড়ির মালিক 
আঙুলহীন এবং যার শিশুরা বধির। 

সাতদিন ও সাতরাত্রি বাগানের কাছে কেউ এল না এবং আলমুস্তাফা একা ছিলেন তার স্মৃতি ও যন্ত্রণা নিয়ে, শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা তাঁর কথা ধৈর্য্য ও ভালোবাসার সঙ্গে শুনেছিল। 

শুধুমাত্র কারিমা এসেছিল। তার মুখের ওপর ছিল নীরবতার মতো অবগুণ্ঠন। সে এসেছিল কাপ ও প্লেট হাতে নিয়ে— তাতে ছিল তাঁর নিঃসঙ্গতা ও ক্ষুধা নিবারণের মাংস এবং পানীয় এবং তার সামনে এগুলো সাজিয়ে দিয়ে কারিমা চলে গেল। 

আলমুস্তাফা আবার এসে বাগানের ভেতরে সাদা ঝাউগাছের তলায় বসে রাস্তার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর তিনি অনুধাবন করলেন যে, একটা ধূলোর মেঘ রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাঁর দিকেই আসছে এবং সেই মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল নয়জন, কারিমা তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। 

এবং আলমুস্তাফা অগ্রবর্তী হয়ে রাস্তার ওপরই তাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। তারপর তারা বাগানের দরজার ভেতরে প্রবেশ করল, যারা ঘণ্টাখানেক আগে নিজ নিজ পথে চলে গিয়েছিল। 

তারা ভেতরে এল এবং তাঁর সঙ্গে রাতের খাবার খেল তাঁরই টেবিলে যা মিতব্যয়িতায় পরিপূর্ণ। তারপর কারিমা টেবিলে শয়ন করলে রুটি, মাছ এবং মদের শেষ ফোঁটাটা ঝরে পড়ল কাপে— যেমন সে ঝরে পড়ার মতো প্রভুর কাছে সনির্বন্ধ প্রার্থনা করল: ‘আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন, আমি শহরে গিয়ে মদ নিয়ে আসি, পুনরায় আপনার কাপ ভরে দিতে। কারণ যা ছিল তা ফুরিয়ে গেছে।’ 

তিনি কারিমার দিকে তাকালেন এবং তার চোখের ভেতরে তিনি তখন দূরতম দেশে ভ্রমণ করছিলেন এবং তিনি বললেন, ‘না, এসময় পর্যন্ত এটাই যথেষ্ট। 

তারপর তারা খেলেন, পান করলেন এবং তৃপ্ত হলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর আলমুস্তাফা উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘যা ছিল সমুদ্রের মতো গভীর এবং চন্দ্রালোকের নিচে প্রবহমান বিশাল স্রোতের মতো পরিপূর্ণ— আমার সঙ্গী-সাথী এবং আমার অনুসারীরা, আমাদের অবশ্যই এই দিনটির প্রয়োজন ছিল— আমরা বিপদজনক সমুদ্রে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছি এবং আমরা চড়েছি সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে এবং মল্লযুদ্ধ করেছি ঝড়ের সঙ্গে, আমরা জেনেছি ক্ষুধা কী, কিন্তু তারপরও আমরা বিয়ের ভোজ উৎসবে বসেছিলাম। প্রায় সময়ই আমরা নগ্ন থেকেছি— যদিও আমরা রাজকীয় পোশাক পরেছিলাম। আমরা বস্তুতপক্ষে অনেক পথ ভ্রমণ করেছিলাম, কিন্তু এখন শুধুই আংশিক। তোমরা চলে যাবে একসঙ্গে তোমাদের পথে এবং আমাকে অবশ্যই আমার পথে যেতে হবে একাকী। 

যদিও সমুদ্র ও বিশাল ভূখণ্ড আমাদেরকে আলাদা করেছে, তবু এখনও পর্যন্ত পবিত্ৰ পাহাড়ে ভ্রমণকালে আমরা পরস্পরের সঙ্গী হব। 

কিন্তু আমাদের পরিচর্যাকৃত পথে যাওয়ার আগে আমি তোমাদেরকে ফসল কাটা ও গোলাজাত করার পাশাপাশি আমার হৃদয়ের ভূমিতে কেটে নেওয়ার পর পড়ে থাকা ফসল কুড়ানোর সময় দেব। 

গান গাইতে গাইতে তোমরা তোমাদের পথে চলে যাও, কিন্তু সব গানকেই সুনির্দিষ্ট হতে দিও— শুধু সেই গানটি যা যৌবনেই মারা গেছে তোমাদের ঠোঁটের ওপর এবং তা বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। 

খুব অল্প কথায় একটা চমৎকার সত্য কথা বলো, কিন্তু কোনো কুৎসিত সত্যকে কোনো শব্দেই প্রকাশ কোরো না। তরুণীটিকে বলো, যার চুল রৌদ্রালোকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে যেন ভোরবেলার কন্যা। কিন্তু যদি অন্ধদের দিকে লক্ষ্য করো এবং তাকে কিছু না বলো তবে সে রাত্রির সঙ্গে একীভূত হবে। 

বংশীবাদকেরা শোনো, যেমন শুনেছিল এপ্রিল মাস, কিন্তু তোমরা যখন নিন্দুকের কথা শুনবে, তখন বাঁশি-অন্বেষণকারীরা বলবে : তোমরা তোমাদের হাড়ের মতো বধির হও এবং দূরে যাও যতটুকু তোমাদের পক্ষে সম্ভব। 

আমার সঙ্গীসাথী ও পছন্দের মানুষেরা—তোমাদের পথে ক্ষুরঅলা মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, তোমাদের পাখাগুলি তাদেরকে দিও এবং দেখা হবে শিংঅলা মানুষের সঙ্গে তাদেরকে দিও শিঙে জড়ানোর জন্য জলপাই গাছের পাতা, আর দেখা হবে তীক্ষ্ণ নখবিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে, তাদেরকে ফুলের পাপড়ি দিও আঙুলে জড়ানোর জন্য এবং দেখা হবে দ্বিধাবিভক্ত জিভঅলা মানুষের সঙ্গে— কথা বলার জন্য তাদেরকে মধু দাও। 

‘হ্যাঁ, এসব এবং আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তোমাদের দেখা হবে– তোমাদের দেখা  হবে খোঁড়াদের সঙ্গে, যারা ক্রাচ বিক্রি করছে— দেখা হবে অন্ধদের সঙ্গে যারা বিক্রি করছে আয়না। আর দেখা হবে সেইসব ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে যারা মন্দিরের দরজায় ভিক্ষা করছে।’ 

‘পঙ্গুদের প্রতি তোমরা দ্রুততা প্রদর্শন করো, অন্ধদেরকে দাও তোমাদের দৃষ্টিশক্তি এবং দ্যাখো তোমরা তোমাদেরকেই দিয়ে দাও ধনী ভিক্ষুকদের, সবার ভেতরে তারাই সবচেয়ে অভাবী—সে কারণে কোনো মানুষই ভিক্ষার জন্য হাত বাড়াবে না যতক্ষণ-না সে সত্যিই দরিদ্র হয়ে পড়ে। 

আমার সঙ্গীসাথী ও বন্ধুরা, ভালোবাসার কারণেই আমি তোমাদেরকে অভিযুক্ত করছি যে তোমরা গণনাহীন পথ হতে পারো, যা মরুভূমিতে একটা অন্যটাকে অতিক্রম করে যাবে—সেখানে সিংহ এবং খরগোশ হাঁটাহাঁটি করে, এমনকি নেকড়ে এবং ভেড়াও। 

এবং আমার এসব কথা স্মরণ করো : আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিই কিছু না দিতে, কিন্তু কেবলই গ্রহণ করতে। প্রত্যাখ্যাত হতে নয়, পরিপূর্ণতা পেতে এবং একরোখা নয়, বোঝাবুঝি সম্পন্ন হতে, এমনকি ঠোঁটের ওপরের হাসিসহ।’ 

‘আমি তোমাদেরকে নিরবতা শিক্ষা দিই না, বরং একটা সংগীতের কথা বলি, যা অতি উচ্চকিত নয়। 

‘আমি তোমাদেরকে বিশাল আত্মা সম্পর্কে শিক্ষা দিই, যে আত্মা প্রত্যেককেই ধারণ করতে পারে।’ 

তারপর তিনি টেবিল ছেড়ে উঠলেন এবং সোজা বাগানের ভেতরে চলে এলেন সেই সাইপ্রেস গাছের ছায়ার নিচে আজকের দিনের মতো ক্লান্ত হয়ে। এবং তারা তাঁকে অনুসরণ করল অল্প কিছুদূর পর্যন্ত, কারণ তাদের হৃদয় বিষাদে ভারাক্রান্ত ছিল এবং তাদের জিভ ছুঁয়েছিল মুখের ছাদ 

তারপর শুধুমাত্র কারিমা তাঁর কাছে এল এবং বলল, ‘প্রভু আগামীকালের জন্য এবং আপনার ভ্রমণের জন্য খাবার প্রস্তুত করতে আমি কষ্ট স্বীকার করেছি।’ 

আলমুস্তাফা তার ওপর দিয়ে তাকালেন। তার চোখ তখন অন্য পৃথিবীকে দেখছিল এবং তিনি বললেন, ‘বোন আমার এবং আমার প্রিয়জন, সময়ের শুরুতেই এটা সম্পন্ন হয়েছে। আগামীকালের জন্য খাবার ও পানীয় প্রস্তুত, এমনকি আমাদের গতকাল ও আজকের জন্য। 

‘আমি যাই, কিন্তু যদি আমি কণ্ঠস্বর ছাড়া একটা সত্য নিয়ে যাই, সেই সত্য আবার আমাকে খুঁজবে এবং একত্রিত করবে— যদিও আমার উপাদানগুলি সর্বাংশে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল অনন্তকালের নীরবতায় এবং আবার আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব, কারণ আত্মার সেইসব বন্ধনহীন নীরবতার হৃদয় থেকে বেরিয়ে এসে নবজাতকের কণ্ঠে আমি নতুন করে কথা বলতে পারি। 

এবং সেখানে যদি সৌন্দর্যের কিছুমাত্র থাকে তা আমি তোমাদের শোনাব না, তবে আরও একবার আমাকে আহ্বান জানানো হবে— হ্যাঁ হ্যাঁ, এমনকি আহ্বান জানানো হবে আমার নাম ‘আলমুস্তাফা’ বলে ডেকে ডেকে। তাই আমি তোমাদেরকে একটা প্রতীকচিহ্ন দেব, যেন তোমরা জানতে পারো আমি ফিরে এসেছি, যেসব কথা বলা বাকি রয়ে গেছে সেসব বলতে— মানুষের ভেতর থেকে লুকিয়ে যেতে ঈশ্বরের নিজের কোনো কষ্ট হবে না, কষ্ট হবে না মানুষের হৃদয়ের অতল গহ্বর তার কথা দিয়ে ঢেকে দিতে। 

আমি বাঁচব মৃত্যুর ওপরে এবং তোমাদের কানে কানে গান শোনাব, এমনকি বিশাল সমুদ্রের ঢেউ আমাকে তার বিশাল গভীরতার দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরও। 

আমি আমার শরীর ছাড়াই তোমাদের টেবিলে বসব এবং আমি তোমাদের সঙ্গে তোমাদের ‘শস্যক্ষেতে’ যাব একটি অদৃশ্য আত্মা হয়ে। 

আমি তোমাদের অগ্নিকুণ্ডের পাশে যাব অচেনা অতিথি হয়ে, 

মৃত্যু কোনোকিছুই পরিবর্তন করছে না কিন্তু মুখোশগুলি ঢেকে দেয় আমাদের মুখ। 

একজন কাঠুরিয়া কাঠুরিয়াই থাকবে, কৃষক কৃষকই এবং যে বাতাসের উদ্দেশে গান গায়, সে আকাশমণ্ডলের উদ্দেশ্যেও গান গাইবে।’ 

শিষ্যরা ছিল পাথরের মতো স্থির এবং হৃদয়ের ভেতরে ছিল শোকাভিভূত, সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন : ‘আমি যাই।’ কিন্তু কেউই প্রভুর থেকে যাওয়ার জন্য হাত তুলে বাধা দেয়নি, কেউই অনুসরণ করেনি তাঁর পায়ের ছাপ। 

এবং আলমুস্তাফা তার মায়ের বাগান থেকে বেরিয়ে গেলেন, তাঁর পদক্ষেপ ছিল দ্রুত এবং শব্দহীন এবং একমুহূর্তে বাতাসে উড়ে যাওয়া বাদামি পাতার মতো তিনি তাদের থেকে অনেকদূরে চলে গেলেন— এবং তারা দেখতে পেল, একটা বিবর্ণ আলোর শিখা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। 

এবং সেই নয়জনই বাগানের রাস্তা থেকে নেমে নিজেদের পথে হাঁটতে লাগল। কিন্তু রাত্রির জমাটবাঁধা অন্ধকারে নারীটি দাঁড়িয়ে ছিল এবং সে দেখল কীভাবে আলো এবং গোধূলিলগ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল এবং তারপর সে তার নিরানন্দ ও নিঃসঙ্গতাকে সুখী করল একথা বলে যে, ‘আমি যাই, কিন্তু আমি যদি সত্যের সঙ্গে যাই যে সত্য কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়নি— তাহলে সেই সত্য আমাকে অনুসন্ধান করবে এবং একত্রিত করবে এবং আমি আবার আসবই।’ 

এবং তখন ছিল সন্ধেবেলা। 

আলমুস্তাফা পাহাড়ে পৌঁছে গেলেন। তাঁর পদক্ষেপ নেতৃত্ব দিল তাঁকে ধোঁয়াশার ভেতরে যেতে এবং তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন পাথর এবং সাদা সাইপ্রেস (ঝাউ জাতীয়) বৃক্ষের ভেতরে, যা সমস্তকিছু থেকে লুকানো রয়েছে এবং তিনি বললেন : 

হে ধোঁয়াশা ভগনি, আমার শরীরের কাঠামোর ভেতরে এখনও মৃত্যুর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়েনি। 

আমি তোমার কাছে ফিরব একটা শুভ্র শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শব্দহীন অবস্থায় যদিও একটা শব্দও উচ্চারিত হয়নি। 

হে ধোঁয়াশা, আমার পাখাবিশিষ্ট ভগনি ধোঁয়াশা, আমরা এখন একসঙ্গে এবং জীবনের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে থাকব। 

যে জীবনের ভোরবেলা বাগানের একফোঁটা শিশিরের মতো তোমার ওপর শুয়ে থাকবে এবং আমি হব নারীর বক্ষের ওপর একটা শিশু। 

এবং আমরা তা স্মরণ করব। 

হে ধোঁয়াশা ভগনি আমার, আমি ফিরে আসি— একটি হৃদয় তার গভীরতম প্রদেশে সেই শব্দ শুনতে পায়। এমনকি তোমার হৃদয়ের মতো, একটি আকাঙ্ক্ষা স্পন্দিত এবং উদ্দেশ্যহীন, এমনকি তোমার আকাঙ্ক্ষা যদিও একটি চিন্তা এবং তা এখনও একত্রিত হয়নি, যেভাবে তুমি চিন্তা করো। 

হে ধোঁয়াশা, ভগনী আমার, আমার মায়ের প্রথম সন্তান। আমার হাত এখনও পর্যন্ত সবুজ বীজ ধরে আছে যা আমাকে ছড়িয়ে দিতে বলেছিল এবং আমার ঠোঁটদুটো ছিল বন্ধ আর তুমি বলেছিলে গাইতে এবং আমি তোমার জন্য কোনো ফল আনিনি এবং আনিনি কোনো প্রতিধ্বনি। কারণ আমার হাতদুটি ছিল অন্ধ এবং ঠোঁট ছিল প্রাকৃতিক উৎপাদন রীতিতে অনুর্বর। 

হে ধোঁয়াশা ভগনি আমার, পৃথিবীকে আমি প্রচুর ভালোবেসেছিলাম এবং পৃথিবীও ভালোবেসেছিল আমাকে। সে-কারণে আমার হাসিগুচ্ছ ছিল পৃথিবীর ঠোঁটের ওপর এবং তার সমস্ত অশ্রু ঝরে পড়েছিল আমার চোখে। যদিও সেখানে আমাদের মধ্যে ছিল এক উপসাগর নীরবতা যা সে সংক্ষেপিত করবে না এবং আমি পারব না সীমা লঙ্ঘন করতে। 

হে ধোঁয়াশা ভগনি আমার, আমার অবিনশ্বর ভগনি ধোঁয়াশা, আমার ছোট্ট শিশুদেরকে আমি গেয়ে শুনিয়েছিলাম প্রাচীন গানগুলো, তারা শুনেছিল এবং তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়। কিন্তু আগামীকাল তারা সম্ভবত গানগুলো ভুলে যাবে এবং আমি জানি না বাতাস এ গান বহন করে কার কাছে নিয়ে যাবে এবং এ গানগুলো আমার ছিল না- যদিও তারা আমার হৃদয় থেকে এসেছিল এবং আমার ঠোঁটের ওপর বসবাস করেছিল এক মুহূর্তের জন্য। 

হে ধোঁয়াশা ভগনি আমার, যদিও সবকিছুই এসেছিল চলে যাবার জন্য, কিন্তু আমি শান্তিতে আছি। তাদের জন্য এই গান যথেষ্ট ছিল যারা ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে। এবং এ গান বাস্তবিক অর্থে আমার নয়, যদিও এটা আমার হৃদয়ের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা। 

হে ধোঁয়াশা ভগনি আমার, আমার ধোঁয়াশা ভগনি, আমি এখন একাই তোমার সঙ্গে। 

আমি এখন আর সত্তা নই, 

দেয়ালগুলো পড়ে গেছে এবং ভেঙে গেছে এর শৃঙ্খল, আমি তোমার কাছে তুলে ধরছি ধোঁয়াশা এবং আমরা একসঙ্গে সমুদ্রে ভেসে যাব জীবনের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত, যখন বাগানের শিশিরবিন্দুর মতো ভোরবেলা শুয়ে পড়বে তোমার ওপর এবং নারীর বক্ষে আমি হব একটা শিশু। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *